এক নজরে হজ্জ ও উমরাহঃ মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম



বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

 হজ্জ’-ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। হজ্জ তিনটি পদ্ধতিতে পালন করা যায়। তন্মধ্যে ‘তামত্তু হজ্জ’ পালন সবচে সহজ। আর এ জন্য হাজী সাহেবানদের উমরা এবং হজ্জ পৃথক পৃথক ভাবে আদায় করতে হবে। নিচে এজন্য প্রয়োজনীয় করণীয় ধারাবাহিক ভাবে প্রদান করা হলঃ

প্রথম পর্বঃ উমরাহ্

মীকাত থেকে বাইতুল্লাহ্

১। প্রথমেই গোসল করতে হবে। অবশ্য এর আগে নোখ কাটা এবং চূল-লোম পরিষ্কার সহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সেরে নিতে হবে।

২। গোসলের পর সুগন্ধি ব্যবহার করা (কেবলমাত্র শরীরে ও দাড়িতে-ইহরামের কাপড়ে নয়)।

৩। ইহরামের কাপড় পরিধান করা।

৪। ইহরাম পরিধানের পর দু’রাকাত নফল নামাজ পড়া।

৫। মুখে উচ্চারণ করে উমরার জন্য  নিয়ত করাঃ اَللَّهُمَّ لَبَّيْكَ عُمْرَةْ

৬। তালবিয়া পাঠ করাঃ لَبَّيْكَ اَللَّهُمَّ لَبَّيْكْ، لَبَّيْكَ لاَشَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكْ، اِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكْ، لاَشَرِيْكَ لَكْ

F তালবিয়া মীকাত থেকে শুরু হবে এবং কাবা শরীফ দেখা পর্যন্ত চলবে। কাবা শরীফ দেখা গেলে তালবিয়া পাঠ বন্ধ করে দিতে হবে।

ইহরামকালীন সময়ে যেসব কাজ নিষিদ্ধ

১। চুল, নখ বা লোম কর্তন করা বা উঠানো।

২। শরীরে, খাদ্যে, কাপড়ে বা পানীয় বস্তুতে সুগন্ধি  ব্যবহার করা।

৩। কোন কিছু শিকার করা, তাড়ানো, শিকার দেখিয়ে দেয়া।

৪। হারাম শরীফের এলাকায় গাছ-বৃক্ষ কর্তন করা, সবুজ ঘাস কর্তন করা বা মাড়ানো অথবা কোন কিছু কুড়িয়ে নেয়া।

৫। বিয়ে করা, বিয়ের প্রস্তাব দেয়া, বিয়ের আক্বদ পড়ানো, যৌন মিলন অথবা যৌনাগ্রহে নারীদেহ স্পর্শ করা।

৬। ইচ্ছাকৃত ভাবে মাথা ঢেকে রাখা।

৭। সেলাইযুক্ত কোন কিছু পরিধান করা।

৮। ইহরামের কাপড় শরীর থেকে পুরোপুরি খূলে নেয়া।

তাওয়াফ থেকে সায়ী

১। মসজিদে প্রবেশের দোয়া পড়ে মসজিদে হারামে প্রবেশ করা।

২। প্রতিবার তাওয়াফের শুরুতে হাজারে আসওয়াদে চুম্বন করা। চুম্বন করা কষ্টকর হলে হাজারে আসওয়াদের বরাবর হয়ে দূর হতে ইশারা করে “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলা।

৩। “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলে হাজারে আসওয়াদের বরাবর জায়গা থেকে বাইতুল্লাহকে হাতের বাম পাশে রেখে তাওয়াফ শুরু করে হাজারে আসওয়াদের বরাবর জায়গায় এসে শেষ করা।

৪। পুরুষেরা পরিহিত চাদর ডান কাঁধের নিচে দিয়ে বাম কাঁধের উপর ধারণ করা এবং ডান কাঁধ খোলা রাখা।

৫। প্রতি চক্করে রুকনে ইয়ামানীতে ডান হাত স্পর্শ করা অথবা ইশারা করা এবং বলা “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” (রুকনে ইয়ামানী হল কাবাঘরের হাজারে আসওয়াদের আগের কোন)।

৬। রুকনে ইয়ামানী ও হাজারে আসওয়াদের মাঝখানে নিচের দোয়া পড়াঃ رَبَّنَا أَتِنَا فِيْ الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِيْ الاَخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارْ

৭। মোট সাতবার তাওয়াফ করা। প্রথম তিন তাওয়াফে দ্রুত চলা বা রমল করা, বাকী চার তাওয়াফে স্বাভাবিক চলা। তাওয়াফ চলাকালীন যিকির করা, দোয়া করা এবং কুরআন তেলাওয়াত করা।

৮। সাত চক্করের পর মাক্বামে ইব্রাহীমের পিছনে দু’রাকাত নামাজ পড়া (প্রথম রাকাতে সূরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ইখলাছ পড়া উত্তম)।

৯। দু’রাকাত নামাজের পর জমজমের পানি পান করে সাফা পাহাড়ে গমন করা।

 (এটি একটি শর্ট নোট। হজ্জের কার্যক্রম পালনের সময় বই সাথে রাখা কষ্টকর। তাই সংক্ষিপ্ত ভাবে হজ্জ ও উমরাহ এর প্রয়োজনীয় বিষয় গুলো এখানে প্রদান করা হলো। হজ্জের সফর শুরুর পূর্ব “হজ্জের হাকীকত” বইটি পড়ে নিন)

 সায়ী থেকে মাথা মুন্ডন

১। সাফা পাহাড়ে আরোহন করা এবং পড়াঃ

إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوْ اعْتَمَرَ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يَطَّوَّفَ بِهِمَا وَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَإِنَّ اللَّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ

২। কাবাঘর সামনে রেখে দু’হাত উর্ধ্বে তুলে তিনবার  হামদ সহ তাকবির বলা ও তিনবার এই দোয়া করাঃ

لاَاِلَهَ اِلاَّاللهُ وَحْدَهُ أَنْجَزَ وَعَدَهُ، وَنَصَرَ عَبْدَهُ، وَهَزَمَ الأَحْزَابَ وَحْدَهُ .

৩। সাফা হতে নেমে মারওয়ার দিকে হাটা। হাটার সময় যিকির করা, দোয়া করা অথবা কুরআন তেলাওয়াত করা।

৪। সবুজ বাতির স্থানে দ্রুত দৌড়িয়ে চলা।

৫। মারওয়াতে গিয়ে পূর্বের ন্যায় কাবামূখী হয়ে দু’হাত তুলে হামদ সহ তিনবার তাকবির বলা এবং দোয়া করা।

৬। অতঃপর সাফার দিকে যাওয়া। এভাবে ৭বার সাফা মারওয়া দৌড়ানো এবং প্রতিবার সাফা মারওয়ায় প্রথমবারের ন্যায় দোয়া ও যিকির করা।

৭। সাত চক্কর পূর্ণ হলে মারওয়া পাহাড়ে দাড়িয়ে যিকির ও দোয়া করা।

৮। অতঃপর পুরুষেরা মাথা মুন্ডানোর মাধ্যমে ইহরাম মুক্ত হওয়া। আর মহিলাদের জন্য চুলের অগ্রভাগ কর্তন করা।

F আর এর মাধ্যমে শেষ হবে  উমরাহ্ পালনের কার্যক্রম।

দ্বিতীয় পর্বঃ হজ্জ

৮ই জিলহজ্জে যা করনীয়

১। নিজ বাসস্থান থেকে ইহরাম বাঁধা। উমরার ইহরাম যেভাবে মীকাতে বাঁধা হয়ে ছিল, সেই নিয়মে ইহরাম বাঁধা। ইহরাম বাঁধা ফরজ। আর এ ইহরাম জিলহজ্জের ১০ তারিখ পর্যন্ত থাকবে। এ সময় ইহরামকালীন নিষিদ্ধ কাজ সমূহ করা যাবেনা।

২। মুখে উচ্চারণ করে হজ্জের নিয়ত করাঃ   اَللَّهُمَّ لَبَّيْكَ حَجَّا

৩। তালবিয়া পাঠ করা, যেভাবে উমরার সময় পাঠ করা হয়েছিল।

৪।তালবিয়া পড়তে পড়তে মীনার দিকে রওয়ানা হওয়া।

৫। মীনায় পৌছে সেখানে অবস্থান করা, ইবাদতে মাশগুল থাকা, যথা সময়ে জামায়াতের সাথে জোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজরের নামাজ আদায় করা। চার রাকাত ওয়ালা নামাজ দুই রাকাতে কসর করে পড়া।

F মিনাতে যাওয়ার সময় অতিরিক্ত ১ সেট ইহরামের কাপড় রাখা, যাতে কোন কারণে ইহরামের কাপড় অপবিত্র হয়ে গেলে তা বদল করা যায়।

৯ই জিলহজ্জে যা করণীয়

F আরাফাতঃ

১। সূর্য উদয়ের পর মিনা হতে আরাফাতের দিকে রওয়ানা দেয়া এবং দুপুরের আগেই আরাফাতের সীমানায় পৌছে সেখানে অবস্থান করা। ইহা হজ্জের আরেকটি ফরজ।

২। আরাফাতে জোহর ও আসরের নামাজ জোহরের প্রথম ওয়াক্তে এক আজানে দু’ইক্বামাতে জামায়াতের সাথে কছর আদায় করা।

৩। নামাজ শেষ হলে ক্বিবলামূখী হয়ে দু’হাত উপরে তুলে আল্লাহর যিকির করা ও একান্ত মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকা এবং খুতবা শুনা।

৪। সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতে অবস্থান করা ওয়াজিব।

F মুজদালিফাহ্ঃ

১। সূর্যাস্তের পর মুজদালিফার উদ্দেশ্যে আরাফাত ত্যাগ করা। আরাফাতের ময়দানে মাগরিবের নামাজের ওয়াক্ত হওয়ার পরও সেখানে মাগরিবের নামাজ না পড়া।

২। মুজদালিফাতে পৌছে মাগরিব ও এশার নামাজ একত্রে এক আযান ও দু’ইক্বামাতে আদায় করা। এশার নামাজ কছর করে দু’রাকাত পড়া।

৩। মুজদালিফাতে সারা রাত অবস্থান করা ওয়াজিব।

৪। ফজরের নামাজ মুজদালিফায় আদায় করা।

৫। ফজরের নামাজের পর  ফর্সা হওয়া পর্যন্ত ক্বিবলামূখী হয়ে যিকির ও দু’হাত তুলে দোয়া করা।

৬। জামারাতুল আকাবায় (বড় শয়তানে) নিক্ষেপ করার জন্য মুজদালিফা হতে ৭টি কংকর (পাথর) সংগ্রহ করা। কংকর হবে ছানা বা ছাগলের বিষ্টার অনুরূপ ছোট।

F মুজদালিফায় অবস্থানের সময় সাইন বোর্ড পড়ে ভালভাবে নিশ্চিত হওয়া যে, আপনি মুজদালিফা এলাকার ভিতরে অবস্থান করছেন-বাহিরে নয়।

১০ই জিলহজ্জে যা করনীয়

১। ফর্সা হবার পর এবং সূর্য উদয়ের পূর্বে তালবিয়া পড়তে পড়তে মীনার দিকে ধীরে ধীরে যাত্রা করা।

২। মীনায় পৌছে জামারাতুল আকাবাতে (বড় শয়তানে) পর পর ৭টি পাথর নিক্ষেপ করা। প্রতি বার আল্লাহু আকবার বলা।

৩। পাথর নিক্ষেপ করা শেষ হলে কুরবানী করা। মনে রাখতে হবে কুরবানী করা ওয়াজিব। কুরবানীর গোশত সম্ভব হলে নিজে খাওয়া এবং মিসকিনদের দেয়া।

৪। কুরবানী করা শেষে পুরুষদের জন্য মাথা মুন্ডানো ওয়াজিব। মহিলাদের জন্য মাথার চুলের অগ্রভাগ কর্তন করা।

৫। মাথা মুন্ডানোর পর ইহরামের কাপড় খুলে নেয়া।

৬। গোসল করে সাধারণ পোষাক পরিধান করে নেয়া।

৭। অতঃপর মক্কায় গিয়ে তাওয়াফে ইফাদা (তাওয়াফে যিয়ারাত) করা। ইহাও হজ্জের একটি ফরজ কাজ।

৮। উমরাতে যে ভাবে তাওয়াফ করা হয়েছিল সেভাবে একই নিয়মে তাওয়াফ করতে হবে। তবে উমরার মত রমল (দ্রুত চলা) করতে হবেনা। অতঃপর মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে দু’রাকাত নামাজ পড়ে জমজমের পানি পান করা। অতঃপর সাফা পাহাড়ে যাওয়া।

৯। সাফা মারওয়াতে উমরার ন্যায় সায়ী করা।

১০। তাওয়াফ ও সায়ীর পর মীনায় চলে যাওয়া এবং সেখানে রাত্রী যাপন করা। মীনাতে রাত্রী যাপন করা হজ্জের ওয়াজিব সমুহের একটি।

১১ই জিলহজ্জে যা করনীয়

১। মীনাতে অবস্থান এবং ইবাদতে মশগুল থাকা। সময় মতো নামায কসর করে আদায় করা।

২। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়লে তিনটি জামারাতে (তিন শয়তানে) পর্যায়ক্রমে প্রতিটিতে ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করা। প্রত্যেক কংকর নিক্ষেপের সময় আল্লাহু আকবার বলা।

৩। কংকর মীনা থেকে সংগ্রহ করা।

৪। ব্যবহৃত কংকর ব্যবহার না করা।

৫। রাত্রী মীনাতে অবস্থান করা। মীনাতে রাত্রী যাপন ওয়াজিব।

১২ই জিলহজ্জে যা করনীয়

১। মীনায় অবস্থান করে ইবাদতে মাশগুল থাকা। সময় মতো নামায কসর করে আদায় করা।

২। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়লে তিনটি জামারাতে (তিন শয়তানে) পর্যায়ক্রমে প্রতিটিতে ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করা। প্রত্যেক কংকর নিক্ষেপের সময় আল্লাহু আকবার বলা।

৩। কংকর মীনা থেকে সংগ্রহ করা।

৪। ব্যবহৃত কংকর ব্যবহার না করা।

৫। সূর্যাস্তের পূর্বে মীনা থেকে প্রস্থান করা। যদি কেউ সূর্যাস্তের পূর্বে মীনা থেকে প্রস্থান না করেন অথবা প্রস্থান করতে না পারেন, তাহলে পরবর্তী দিন একই নিয়মে তিন শয়তানে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করে মীনা ত্যাগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে জামারাত সমূহে কংকর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব।

হজ্জের সর্বশেষ কাজঃ বিদায়ী তাওয়াফ

দেশে চলে আসার বা মদীনায় চলে যাওয়ার জন্য মক্কা ত্যাগের পূর্বে কাবা শরীফের বিদায়ী তাওয়াফ করতে হবে। এর নাম তাওয়াফে বিদা বা বিদায়ী তাওয়াফ। ইহা হজ্জের ওয়াজিব সমূহের একটি।

F আর এর মাধ্যমে হজ্জের যাবতীয় কাজ শেষ হয়ে যায়।

 

F জ্ঞাতব্য বিষয় হলঃ

১। হজ্জের ফরজ বাদ পড়লে হজ্জ হবেনা।

২। হজ্জের ওয়াজিব বাদ পড়লে “দম” দিতে হবে।

আল্লাহ্ আমাদেরকে হজ্জের যাবতীয় আহকাম ও আরকান যথাযথ ভাবে পালনের তাওফীক্ব দিন। আমীন॥

 (হজ্জ পালন করার পূর্বে হজ্জ পালনের নিয়মাবলী সংক্রান্ত বই সমূহ পড়ে নিন। এই নোট হজ্জ ও উমরাহ পালনের সময় সংগে রাখুন)



Post a Comment

0 Comments