ফুলতলী সাহেবের মাহফিলে মুহাদ্দিস আব্দুল মালিক সাহেব – মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম


সত্য ও সুন্দরের পথে অবিরাম পথ চলা-১২

মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ ১৯৮৬ সালের কোন এক সময়ে বড়লেখার চান্দগ্রাম মাদ্রাসার বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলে ফুলতলী সাহেব সহ ফুলতলী মাসলাকের উলামায়ে কিরামদের সাথে বিশেষ ব্যতিক্রম হিসাবে অংশ নিয়েছিলেন ফরিদপুরের মাওলানা এমদাদুল হক এবং সিলেট আলীয়া মাদ্রাসার কিংবদন্তী মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল মালিক সাহেব। মাওলানা এমদাদুল হক সাহেবের ওয়াজের বিবরণ গত আলোচনায় আমরা উপস্থাপন করেছি। এ পর্যায়ে একই মাহফিলের অন্যতম বিশেষ অতিথি মুহাদ্দিস আব্দুল মালিক সাহেব নিয়ে আলোচনা করবো। আব্দুল মালিক সাহেব এই মাহফিলে অবাঞ্চিত অতিথিদের মাঝে একজন ছিলেন। আসলে এধরণের মাহফিলে লাঠি সোটা বা সহযোগী পাহারাদার ছাড়া যাওয়া ছিল রীতিমতো দূঃসাহসিকতা। কিন্তু এই দূঃসাহসিক কাজটা করেছেন মাওলানা আব্দুল মালিক মুহাদ্দিস সাহেব। মুহাদ্দিস আব্দুল মালিক সাহেবের পরিচয় দেয়ার মতো আর কিছু বলতে হবে এমন দূঃসাহস আমার নাই। তিনি এই নামেই সর্বমহলে পরিচিত। দিনের বেলা এমদাদুল হক সাহেব এক ধরণের বিপ্লব করে ফেলাতে ফুলতলী সাহেব বিষম রাগান্মিত ছিলেন। একজন্য পরবর্তী ফুলতলী মাসলাকের নয় এমন বক্তার ব্যাপারে ছিল সতর্ক পাহারা। তার জন্য সময় নির্ধারণ করা হলো এমন সময়, যে সময়ে সাধারণতঃ গ্রামের ওয়াজ মাহফিল গুলোতে উপস্থিতি কম থাকে। মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল উনার আলোচনা শুরুর অনেক আগেই মঞ্চের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। উনার বক্তব্য শুরুর আগেই মাইকে জানিয়ে দিলেন যে, তার আলোচনার বিষয়ঃ ইলম ও আমল। উনি যেন এই বিষয়ের ভিতরই থাকেন এ বিষয়ে তাকে প্রচ্ছন্ন সতর্ক করে দিলেন। অবস্থাটা এমন ছিল যে, কি থেকে কি বলে ফেলে। পরে যদি হিতে বিপরীত হয়ে মুরিদানে কেরাম বিগড়ে যায়। মাওলানা আব্দুল মালিক মুহাদ্দিস সাহেব আলোচনা শুরু করলেন। তার সময় মাত্র ১ ঘন্টা। আলোচনার শুরুতেই তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন, বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে দেয়া গ্রামাঞ্চলের ওয়াজ মাহফিলে সাধারণ রেওয়াজে নাই। তবে এই নিয়মটা খুবই ভাল। এই প্রেকটিসটা চালু রাখতে পারলে আমাদের খুবই উপকারে আসবে। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমি ১ ঘন্টা বক্তব্য রাখবো। এই ১ ঘন্টায় আমি একটা বাক্যও বিষয় বস্তুর বাহিরে বলবোনা ইনশাআল্লাহ। উনি আলোচনা পেশ করলেন ইলম সম্পর্কে। ইলম সম্পর্কে তিনি অনেক কথা বললেন। আর শ্রোতারা তন্ময় হয়ে শোনলেন। উনার আলোচনার জন্য দেয়া সময় শেষ হতে এখনো ১০ মিনিট বাকী। শ্রোতাদের মনমুগ্ধকর ও তন্ময়াচ্চনতা খানখান হয়ে গেলো যখন প্রিন্সিপাল সাহেব তথা বর্নির হুজুর মঞ্চে আসলেন এবং কানে কানে মুহাদ্দিস সাহেবকে বললেন যে, উনার সময় শেষ হয়ে গেছে। এই প্রথম দেখলাম চান্দগ্রামের কোন মাহফিলে শ্রোতারা দাবী জানালেন, তাকে আরো সময় দেয়ার জন্য। বর্নির হুজুর বাধ্য হলেন, তাকে আরো সময় বাড়ীয়ে দিতে। সময় বাড়ানো হলো ঠিকই। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মুহাদ্দিস সাহেব বললেন, এতক্ষণ ইলম সম্পর্কে আলোচনা করলাম। এটা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত একটি আলোচনা। আরো একঘন্টা সময় পেলে আমি আপনাদেরকে আমল সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ভাব ধারণা দিতে পারতাম। ভবিষ্যতে যদি কোনদিন চান্দগ্রামের দাওয়াত পাই, তাহলে আমল সম্পর্কে বলবো। যেহেতু আমাকে ১ ঘন্টা সময় দেয়া হয়েছে, এবং পরবর্তী বক্তা যেহেতু অপেক্ষায় আছেন। সেহেতু আমি তার প্রতি জুলুম না করে আমি আমার সময়ের মাঝেই আমার কথা শেষ করা উচিত বলে মনে করি। ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগ। মুহাদ্দিস আব্দুল মালিক সাহেব তার জীবনে আর কোন দিন চান্দগ্রামে আসেননি। সেই যুগ আর এই যুগ, কোন যুগের মানুষ তার আমল সম্পর্কিত আলোচনার শুনার সুযোগ পায়নি। কিন্তু আমলের ময়দানে বৃদ্ধ বয়সেও তিনি সব সময় চিরযৌবনা। মুহাদ্দিস আব্দুল মালিককে সব সময় বৃদ্ধ বয়সে দেখা গেছে মিছিলের অগ্রভাগে। কথিত আছে, তার মিছিলের দিনে ছেলেদের তিনি কখনো বাসায় থাকতে দিতেন না। তার সাথে যারা তার ফিফটি মটর সাইকেলের পিছনে বসার সুযোগ পেয়েছেন, তারা সাক্ষী-তিনি ড্রাইভিং এর শুরু থেকে শেষ অবধি পুরো সময়টা কুরআন তেলাওয়াতে কাটিয়ে দিতেন। সেই সব মুরব্বী মুহাদ্দিসরাই কবি নজরুলের বাসায় প্রকৃত যুবক। আর আমাদের মতো যারা ফেইসবুকে কি বোর্ড মাস্টারী করি, তারা যুবক নয়। বরং তারা সেই সব যুবক, যাদের উর্দির নিচে বার্ধক্যের জীর্ণ কংকাল লুকিয়ে থাকে।

Post a Comment

0 Comments