আপ-ইঞ্জিন আপ, ডাউন-ইঞ্জিন গো, টু-ইঞ্জিন টাচ, বয়লার বাস্ট – মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম


সত্য ও সুন্দরের পথে অবিরাম পথ চলা-১৩

মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ ১৯৮৭ সালের কথা। ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সাথী সম্মেলন। স্থানঃ শেরে বাংলা নগর রফতানী মেলা মাঠ। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে চলছে ব্যাপক অর্থ কালেকশন। বড়লেখা থানা শিবিরের সাংগঠনিক এলাকা বড়লেখার পুরো ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে। এককথায় বর্তমানের পূর্বজুড়ি এবং পশ্চিম জুড়ি ইউনিয়ন ছিল বড়লেখা থানা শিবিরের অধীনে।

তখন মৌলভী বাজার জেলা শিবির একক ভাবে সাংগঠনিক কাজ না চালিয়ে চলতো হবিগঞ্জ-মৌলভী বাজার সাংগঠনিক জেলা নামে। সভাপতি ছিলেন বর্তমান সিলেট (উত্তর) জেলা জামায়াতের আমীর জনাব হাফেজ আনোয়ার হোসাঈন খান।

আমি তখন শিবিরের নতুন শপথ নেয়া সাথী। ৪ঠা জানুয়ারী ১৯৮৭ সালের বাদ ফজর আমি শপথ নিয়েছি। সেই হিসাবে শরীরের রক্ত গরম তুলনামূলক ভাবে অন্য সকলের চেয়ে। আমরা জেলা কোঠা পুরণ করার জন্য সীমাহীন চেষ্ঠা চালিয়ে টার্গেটের কাছাকাছি পৌছতে পেরেছি-যা ছিল মৌলভী বাজার জেলার শাখা গুলোর মাঝে সবচেয়ে বড় কোঠা। এই কোঠা কালেকশন করতে গিয়ে আমরা বড়লেখা উপজেলার সম্ভাব্য সকল এলাকা চষে বেড়িয়েছি। ইতিমধ্যে কোঠার ৮ হাজার টাকা জেলা সভাপতির কাছে হস্তান্তর করার জন্য একজন ভাই মৌলভী বাজার সফর করেছেন। কোঠা ছিল ১০ হাজার। কালেকশন হয়েছে ৮ হাজার। একদম ছোট ব্যাপার নয়। আশা করি জেলা সভাপতি সম্মাণের সাথে গ্রহণ করে বড়লেখার সাথীদের ধন্যবাদ জানালেন।

পরদিন সকাল বেলা। উপজেলা সভাপতির জরুরী তলব। আমি এবং আকমল ভালকে যেতে হবে জুড়ি এলাকায়। সেখানে নয়াবাজার মাদ্রাসা থেকে জনাব আব্দুল মান্নান মানিককে সাথে নিয়ে কালেকশনে যেতে হবে। কারণ, জেলা সভাপতির কড়া নির্দেশ আরো ২ হাজার টাকা যে কোন উপায়ে কালেকশন করতে হবে।

উপজেলা সভাপতির নির্দেশে লাতুর ট্রেনে করে জুড়ি স্টেশনে নামলাম। পায়ে হেটে নয়াবাজার মাদ্রাসায় হাজির হলাম। সেখানে জনাব আব্দুল মান্নান মানিক এবং আব্দুল মালিক মতলিব ভাইকে সাথে নিয়ে আমি আর আকমল ভাই দিনভর বিভিন্ন জায়গায় কালেকশন করলাম। আমার মনে পড়ে সেখানে টালিয়াউরা নামে একটা বাজার আছে। মাগরিবের সময় সেখানে আমরা তরকারী বিক্রেতার নিকট থেকে ২৫ পয়সাও কালেকশন করেছিলাম।

সেই দিনের ঘটনা। মতলিব ভাই আমাদেরকে নিয়ে এলাকার গন্যমান্য এক ব্যক্তির বাড়িতে গেলেন। ঐ ব্যক্তির নাম আমার এই মুহুর্তে মনে নেই। তিনি আমাদেরকে অত্যন্ত সম্মাণ দিলেন, আমরা বড়লেখা থেকে এসেছি জেনে আলাদা একটা সম্মাণ দিলেন। দীর্ঘ সময় জুড়ে আমাদের সাথে খোশগল্প করলেন। সে সময়ের বয়সে উপলব্দি করতে না পারলেও এখন উপলব্দি করি যে, ঐ ব্যক্তি এমন একজন লোক ছিলেন যিনি মানুষের সাথে গল্প করতে ভালবাসতেন এবং তার অভ্যাস ছিলঃ তিনি শুধু বলবেন, আর সবাই মনযোগ দিয়ে শুনবেনআমরা বাধ্য ছাত্রের মতো তা কথা শুনতে থাকলাম। উল্লেখ্য যে, আমরা আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য কিন্তু সেখানে পৌছেই বলে দিয়েছিএখন তার থেকে জবাব পাওয়ার পালা। কমপক্ষে এক ঘন্টা জুড়ে তিনি তার বক্তৃা এবং উপদেশ নামা শুনালেন। আমরা প্রতিক্ষায় ছিলাম, আমাদেরকে তিনি কি দেন। আমার মনে মনে ধারণা ছিল তিনি কমপক্ষে ২শ টাকা প্রদান করবেন। এক সময় তিনি তার পকেট থেকে চকচকে নোট বের করলেন। চোঁখ বন্ধ করলে এখনো সেই টাকার গন্ধ পাই। এর আগে কখনো এতো নতুন নোট আমি দেখিনি। তিনি তার পকেটে গুনেই নোট গুলো বের করেছেন। এক এক করে ৩০টি নোট আমাদের দিলেনআমরা টাকার পরিমাণ কত সে দিকে খেয়াল নেই। বরং টাকার নতুন নোট গুলোর দিকেই মনযোগ। অবশেষে তার থেকে সর্বমোট ৩০ টাকা কালেকশন করতে পেরে গর্বিত হয়ে বিদায় নিলাম।

বিদায়ের আগে উনি আমাদেরকে একটি নসিহত করলেন। বললেন, ভাষার উপর আমাদের দখল থাকতে হবে। তাহলে আমরা জীবনে অনেক উন্নতি করতে পারবো। তিনি বললেনঃ আপ-ইঞ্জিন আপ, ডাউন-ইঞ্জিন গো, টু ইঞ্জিন টাচ, বয়লার বাষ্ট।

তিনি বললেন, এক জামায় এই ধরণের ইংরেজী দিয়ে পার পাওয়া যেতো। কিন্তু আগামী দিনের পৃথিবীতে এই ধরণের ইংরেজী চলবেনা। তাই ভাষার উপর দখল থাকতে হবে পুরো মাত্রায়।

তিনি ঘটনার বিবরণ দিলেন এই ভাবেঃ তখনকার দিনে রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টাররা খুব বেশী শিক্ষিত ছিলেন না। আর শিক্ষিত থাকলেও ইংরেজী জ্ঞান খুব বেশী ছিলনা। ইংরেজের জামানা। হঠাৎ করে একদিন রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন দূর্ঘটানা ঘটলো-দূটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ। উপর থেকে বড় বাবু আসলেন। জিজ্ঞেস করনে, ঘটনা কিভাবে ঘটলো। ইংরেজ বড় বাবুকে এখন মাষ্টার সাহেব কিভাবে বুঝাবেন! বাংলা বললেতো আর উনি বুঝবেন না। তাই তিনি ইংরেজীতে বললেনঃ আপ ইঞ্জিন আপ, ডাউন ইঞ্জিন গো, টু ইঞ্জিন টাচ, বয়লার বাস্ট। অর্থাৎ এদিক থেকে একটা ট্রেন আসছিল, বিপরীত দিক থেকে আরেকটি ট্রেন আসলো। এমতাবস্তায় দুই ট্রেনের মাঝে মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো এবং বয়লার বাস্ট হয়ে গেলো।

১৯৮৭ থেকে ২০১৭ ৩০ বছর আগের ঘটনা। কিন্তু কর্মজীবনের ফাঁকে ফাঁকে, বাঁকে বাঁকে দেখি তার কথাগুলো কতইনা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যখনই ভাষা সমস্যায় পড়ি, তখন সেই মানুষটির কথা মনে পড়ে।

Post a Comment

0 Comments