ইকামাতে দ্বীন এবং রাষ্ট্রীয় ভাবে দ্বীন কায়েম-একটুখানি ভিন্নচোঁখে


মুহাম্মদনজরুল ইসলামঃঃ ইকামাতে দ্বীন মানে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করা। ইকামাতে দ্বীন শব্দটা জামায়াতে ইসলামীর সংগঠনে বহুল প্রচারিত। এই শব্দটাকে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী নামক সংগঠনটি যত বেশী ব্যবহার করে, অন্য কোন ইসলামী সংগঠন ততটা ব্যবহার করে না। জামায়াতে ইসলামী শব্দটির ব্যবহার এতো বেশী যে, এখন ‘ইকামাতে দ্বীন’ শব্দ ব্যবহার করলে ব্যবহারকারীকে জামায়াতী সন্দেহ করা হয়। জামায়াতে ইসলামী মরহূম আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম ইকামাতে দ্বীন নামে একটি বই রচনা করেছেন।

ইকামাতে দ্বীন মানে কি?

মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম ইকামাত শব্দের অর্থ বলেছেনঃ চালু করা। ইকামাতে দ্বীন মানে তার ভাষায়ঃ দ্বীনকে চালু করা।

নামাযের জামায়াতের জন্য জন্য একামত দেয়া হয়, তখন আমরা বুঝি নামায চালু হয়ে গিয়েছে। ক্বাদ ক্বামাতিস সালাহ-মানে সালাত কায়েম হয়ে গেছে বা নামায চালু হয়ে গেছে।

ইকামাতে দ্বীন বলতে আমরা কি বুঝি?

ইকামাতে দ্বীন বলতে আমাদের মাঝে একটি বদ্ধমূল ধারণা হচ্ছেঃ একটি রাষ্ট্র হবে, যেখানকার রাষ্ট্র প্রধান হবেন ইসলামী দলের প্রধান, সেখানে একটি পরামর্শ সভা বা মজলিসে শুরা হবে, সেখানে ইসলামী লোকদের নিয়ে একটি মন্ত্রী সভা হবে, সেখানে সবকিছু ইসলামী তরিকা তথা কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী পরিচালিত হবে, সেখানে ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত হতে বাধ্য করা হবে, সেখানে সকল আইন-আদালত, ব্যবসা-অর্থনীতি, সমাজ-রাষ্ট্র-পররাষ্ট্র সবকিছু কুরআন সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত হবে।

কিন্তু এটা কি আদৌ সম্ভব? জামায়াতে ইসলামীর কথাই যদি ধরা হয়। এই সংগঠনটি গত শতাব্দির চল্লিশের দশক থেকে এই ধরণের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু ২০২৩ সালের এই সময়ে দাড়িয়ে আমরা যদি সংগঠনটির অগ্রগতি পর্যালোচনা করি, তাহলে আমরা কি বলতে পারি যে, আগামী ১০/২০ বছরে এই ধরণের একটি রাষ্ট্র তাদের পক্ষে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? তাহলে কি ইকামতে দ্বীনের স্বপ্ন জামায়াতে ইসলামীর ধ্যান ধারণার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে? স্বপ্ন কি স্বপ্নই থেকে যাবে? দ্বীন কি আর কায়েম হবে না?

আমার বিবেচনায় ইকামতে দ্বীন কেবলমাত্র এই ধারণার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এই ধারণা হচ্ছে ইকামতে দ্বীনের অনেক পযায়ের একটি পর্যায় এবং সর্বশেষ পর্যায়। কিন্তু তার আগে আরো তিনটি পর্যায় রয়েছে। যে পর্যায় গুলোর যতটুকু বাস্তবায়িত হবে, ইকামতে দ্বীনের ঠিক ততটুকুই বাস্তবায়িত হয়েছে বলে মনে করতে হবে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনে হাকীমে বলেছেনঃ আল্লাহ ঈমানদারদের ওয়াদা প্রদান করছেন যে, তারা যদি সৎকর্মশীল হয়-তাহলে তাদেরকে দুনিয়াতে ক্ষমতা প্রদান করা হবে। আর এই ক্ষমতা প্রদান করা হলে তারা চারটি কাজ করবেঃ ১. নামায কায়েম করবে। ২. যাকাত আদায় করবে। ৩. সৎ কাজের আদেশ দেবে। এবং ৪. অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে।

ইকামাতে দ্বীনের ৪টি পর্যায়ঃ

আমার বিবেচনায় ইকামাতে দ্বীনের চারটি পর্যায় রয়েছে। এই চারটি পর্যায়ে যে যেখানে ক্ষমতাধর হবে, যে যেখানে কর্তৃত্ববান হবে, তার দায়িত্ব হচ্ছে সেখানে দ্বীনকে কায়েম করা-যা অধ্যাপক গোলাম আযমের ভাষায় ‘দ্বীনকে চালু করা’। এই চারটি পর্যায় হলোঃ

১. ব্যক্তি জীবনে ইকামাতে দ্বীন।

২. পারিবারিক পর্যায়ে ইকামাতে দ্বীন।

৩. সামাজিক পর্যায়ে ইকামাতে দ্বীন।

৪. রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইকামাতে দ্বীন।

প্রথমেই বলে রাখি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইকামাতে দ্বীন বা দ্বীনকে চালু করা ব্যক্তি ও সংগঠন উভয়ের দায়িত্ব। কিন্তু মূল দায়িত্ব সংগঠনের। কিন্তু কোন মুমিন যদি কোন ভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল হয়ে পড়ে, তাহলে তার ব্যক্তিগত দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বীনকে কায়েম করা বা চালু করা। উদাহরণ হিসাবে আমরা মরহুম প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদের কথা অথবা ওয়ান ইলেভেনের সরকার প্রধান ফখরুদ্দিনের কথা বলতে পারি। তারা হঠাৎ করে রাষ্ট্রের দায়িত্বে আসীন হলেও তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতা ছিল। সেই ক্ষমতার বলে চলমান আইনে নেই, কিন্তু কর্তৃত্বের মাধ্যমে অফিস আদেশের দ্বারা অনেক কিছু করেছেন। একই ভাবে তাদের দায়িত্ব ছিল দ্বীনকে কায়েম করা বা চালু করা। কিন্তু একজন মুসলমান হিসাবে দ্বীনকে কতটুকু চালু করেছেন বা করতে সহযোগিতা করেছেন, তা আরেকটি দীর্ঘ আলোচনার বিষয়।

আমরা এ পর্যায়ে উপরোক্ত চার ধরণের ইকামাতে দ্বীন নিয়ে আলোচনা করবোঃ

১. ব্যক্তি জীবনে ইকামাতে দ্বীনঃ

একজন ব্যক্তি তার জীবনের রাজা, তার জীবনে কোন কিছু করা না করার তিনিই একমাত্র কর্তৃত্বশালী সত্ত্বা। সেই ব্যক্তি ইচ্ছা করলে নিজের জীবনকে গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসিয়ে দিতে পারেন, আবার ইচ্ছা করলে একটি সুশৃংখল নিয়মের অধীনে জীবনকে গড়ে তুলতে পারেন। ব্যক্তির জীবন নামক ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের তিনিই প্রেসিডেন্ট, তিনিই নাগরিক। যদি সে তার ব্যক্তি জীবনে দ্বীনকে কায়েম করতে চায়, তাহলে সে ব্যক্তিগত ভাবে নামায আদায় করবে, কুরআন সুন্নাহর আলোকে হক আদায় করে নামায আদায় করবে, মসজিদে জামায়াতে শামীল হয়ে নামায আদায় করবে, নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার ব্যক্তিগত যাকাত আল্লাহ নির্ধারিত ৮টি খাতে ব্যয় করবে, নিজেকে এবং মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দেবে আর নিজে অসৎ কাজ থেকে নিজে বিরত থাকবে, মানুষকে অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে। এই কাজগুলো করার সাথে সাথে তার ব্যক্তি জীবনকে ইসলাম বর্ণিত ভাল ভাল কাজ গুলোর মাধ্যমে সৌন্দর্য মন্ডিত করবে। খারাপ কাজগুলো না করার মাধ্যমে নিজেকে রুচিশীল ও আদর্শ হিসাবে উপস্থাপন করবে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেঃ আমরা যারা ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলন করি, তারা কি ব্যক্তি জীবনে দ্বীনকে কায়েম করেছি। সহজ উত্তর হচ্ছেঃ আমরা করিনি বা করতে পারিনি। আমাদের নামায এখনো সহীহ নেই। আমরা নামাযে হাত বারবার উঠাবো না একবার উঠাবো, এই নিয়ে ঝগড়া করি, কিন্তু নামাযে পঠিত সূরা সমূহ আমাদের সহীহ আছে কিনা, তার খবর নাই। আমাদের রুকু সেজদা যেভাবে হওয়ার কথা-সেভাবে কি হচ্ছে? আমাদের নামাযে যতটুকু ভয় ও বিনম্রতা থাকার কথা, তা কি আছে? আমরা কি সময় মতো মসজিদে গিয়ে জামায়াতের সাথে নামায আদায় করি? আমরা কি প্রতি বছর যথাযথ হিসাব করে আমাদের সম্পদের যাকাত আদায় করি? আমরা ব্যক্তিজীবনে কি ভাল ভাল কাজ গুলো করি? আমার ব্যক্তিগত জীবনে পরচর্চা, গীবত, চোগলখুরী, মিথ্যা, খেয়ানত, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি পরিত্যাগ করি?  এই সব প্রশ্নের উত্তর দূঃখজনক ভাবে আশাব্যঞ্জক নয়। তাহলে রাষ্ট্রে ইকামাতে দ্বীন এর আগে আপনার আমার ব্যক্তির নিজস্ব ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলন জোরদার করা দরকার। জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমীর বলেছেনঃ ৫৬ হাজার বর্গমাইল আবাদ করার আগে সাড়ে ৩হাত আবাদ করুন।

২. পারিবারিক পর্যায়ে ইকামাতে দ্বীনঃ

রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় পরিবার হলো রাষ্ট্রের একক। অর্থাৎ রাষ্ট গঠিত হয় কয়েকটি পরিবার নিয়ে। আমার ভাষায়ঃ পরিবার হলো ছোট্ট একটি রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রে আমার বাবা হলেন রাষ্ট্রপতি। যিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি। বিভিন্ন সময়ে উনি এমন কিছু উপদেশ প্রদান করেন, যা সন্তানকে নির্দেশ হিসেবে গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করতে হয়। কিন্তু পরিবার নামক রাষ্ট্রের সরকার প্রধান হচ্ছি আপনি আমি। পরিবারের দৈনন্দিন জীবনে এক্সিকিউটিভ কাজ গুলো আমার চিন্তা ভাবনা, পরিকল্পনা ও নির্দেশনা অনুযায়ী হয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেই পরিবারে কি দ্বীন কায়েম আছে? আমার পরিবারে কি নামায কায়েম আছে? আমি আযান শুনে চুপি চুপি মসজিদে চলে যাই। আর আমার স্ত্রী সন্তান তখন ঘুমিয়ে থাকে, না আমার সাথে হয়ে আমার ছেলেটাও মসজিদে যায়? পরিবারের মহিলারা আযান শুনে সকল কাজ ফেলে রেখে নামায আদায় করে? আমার স্ত্রীর গহনার কি যাকাত প্রদান করা হয়? আমার পরিবারে অন্য পরিবারের পরচর্চা ও গীবত হয় কি? আমার পরিবারের একান্ত পরিবেশে আমার ভাবী, বোন, মা গংদের গীবত চর্চা হয় কি না? আমার প্রতিবেশী পরিবারের খারাপ বিষয় গুলো নিয়ে আমার পরিবারে খোশগল্পের আসর বসে কিনা?  আমার স্ত্রী ও মেয়েরা কি পর্দা মেনে চলে? আমার উঠন্তি বয়সের মেয়েটি কি বুরকা পরে স্কুলে যায়? আমার পরিবারে কি ভাল ভাল কাজ করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয়, খারাপ কাজ গুলো থেকে বেঁচে থাকার জন্য কি আমি কঠোর? ইত্যাদি বিষয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ফলাফল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। সেই আমি কি দ্বীন কায়েম করবো? আমাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বীন কায়েম করার আগে আমার পরিবারে দ্বীন কায়েম করা দরকার। আমি যে পরিবার নামক ছোট্ট রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী, সেই পরিবার নামক রাষ্ট্রে দ্বীনকে চালু করা দরকার।

৩. সামাজিক পর্যায়ে ইকামাতে দ্বীনঃ

মানুষ সামাজিক জীব। মানুষের বসবাস একটি সমাজ নিয়ে। আপনি শহরের বাসিন্দা হোন, কিংবা গ্রামে অথবা অজোঁ পড়া গায়ের। সবখানেই একটি সমাজ আছে। সেই সমাজের আপনি একজন এবং কোন না কোন পর্যায়ে আপনি নেতাও বটে। এই সমাজের কোন সাইনবোর্ড বা নাম না থাকলেও ওখানে রয়েছে কিছু অলিখিত নিয়ম, অলংগনীয় রীতি। সেই নিয়ম ও রীতির কিছু কিছু রয়েছে যা প্রকৃতপক্ষে অনিয়ম এবং বিকৃতি। আপনি আমি সেই সমাজের নেতা হিসাবে কি সেই অনিয়মকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা, বিকৃতিকে সুকৃতিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করি? যে সমাজে আমি বসবাস করি সেখানকার প্রতিটি প্রতিবেশীকে আমি কি নামাযের দাওয়াত দেই, তাকে মসজিদে হাজির করার চেষ্টা করি, সেখানে কি আমি মসজিদ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হই-নেতৃত্ব দেই, মসজিদ ভিত্তিক সমাজ গড়ার চেষ্টা করি? বাচ্ছাদের দ্বীনি শিক্ষা দেয়ার জন্য মকতবের প্রচলন করি? সমাজের দূস্থ মানুষে সহায়তার জন্য যাকাত কালেকশন করি? সমাজ নামক ছোট্ট রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১০/২০টি পরিবার নিয়ে। আমি সেই ছোট্ট রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আমি কি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সেখানে দ্বীনকে চালু করার চেষ্টা করি? সামাজিক সালিস কি দ্বীন অনুযায়ী পরিচালিত হয়? সমাজের মানুষ কি ইনসাফ বা ন্যায় বিচার পায়? সমাজের অসামাজিকতা দূরিকরণে, বেহায়াপনা অশ্লীলতা রোধে, অপসংস্কৃতির বিনাশ সাধনে আমি কি চেষ্টা করি? যদি সেই সমাজে আমি পদ নিয়ে বসে থেকে সকল ধরণের অসামাজিকতাকে নির্বিবাদে তার তান্ডব চালাতে সুযোগ করে দেই, তাহলে আমি আমার সমাজে দ্বীন কায়েম করলাম না।

সংগঠন হলো সমাজ নামক বস্তুর সুশংখল রূপ। ইসলামী সংগঠন গুলো একেকটি ভাসমান রাষ্ট্র। ইসলামী সংগঠনের সভাপতি বা প্রধান সেই ভাসমান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি আর তাদের সদস্যরা সেই রাষ্ট্রের নাগরিক। ইসলামী সংগঠন নামক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিরা কি তাদের সংগঠনে ইসলাম কায়েম করেছেন বা দ্বীনকে কায়েম করেছেন? দ্বীনের সেই সব সংগঠনের সদস্যরা কি নামায পড়ে? নামাযের হক আদায় করে তারা কি নামায পড়ছে? সংগঠনের জনশক্তি প্রতি ওয়াক্ত মসজিদে গিয়ে কি নামায আদায় করছে? সংগঠনের নেতা কর্মীদের দীল কি মসজিদের সাথে লেগে থাকে? ইসলামী সংগঠনের সদস্যরা কি হিসাব করে যাকাত আদায় করে অথবা ইসলামী সংগঠন নামক রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তার নাগরিক তথা সংগঠনের সদস্যদের যাকাত আদায় করা হয় বা যাকাত প্রদানে বাধ্য করা হয়? ইসলামী সংগঠন নামক রাষ্ট্রের আভ্যন্তরিন পরিবেশ কেমন? ওখানে কি সৎ কাজের আদেশ দেয়া হয়, অসৎকাজ থেকে বিরত রাখা হয়? ওখানে কি তার সদস্যদের জান, মাল, ইজ্জতের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়? ওখানে দুইজন সদস্য যখন পারস্পরিক কলহে লিপ্ত হোন, তখন কি ইনসাফের সাথে সমাধান করা হয়? ইসলামী সংগঠনের দায়িত্বশীলরা কি দাবী করতে পারবেন যে, তারা তাদের সংগঠনের দায়িত্ব প্রদানে সদস্যদের মাঝে ইনসাফ করেন আর কর্মীরা কি দাবী করতে পারবেন যে, পদ কি দেয়া হলো তা বিবেচনা না করে যখন যে পদে দায়িত্ব দেয়া হয়, তা নিষ্ঠার সাথে পালন করেন? ইসলামী সংগঠনের আভ্যন্তরিন পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন? পরস্পর কল্যাণকামী, না একজন আরেকজনের ‍বিরুদ্ধে লেগে থাকেন? ইসলামী সংগঠন কি একক ব্যক্তির মর্জি অনুযায়ী চলে, না মজলিসে শুরা বা পরামর্শ সভার পরামর্শের ভিত্তিতে চলে? ইসলামী সংগঠনের প্রধান তার জনশক্তিদের দ্বারা নির্বাচিত, না ওয়ারিশী সূত্রে ক্ষমতাবান? এমনতর হাজারও প্রশ্নের জবাব যদি আশাব্যঞ্জক হয়, তাহলে মনে করতে হবে এই ইসলামী সংগঠনে দ্বীন কায়েম হয়েছে। এমনতর সংগঠনের সাথে কাজ করে আপনি নিজেকে গর্বিত মনে করতে পারেন। এই ধরণের সংগঠনে থেকে আপনি ইকামাতে দ্বীনের ৭৫% কাজ করার সুযোগ পাবেন।

তবে এখানে একটা কথা খুবই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইসলামী সংগঠন যদি ভাসমান রাষ্ট্র হয়ে থাকে, তাহলে সেই ইসলামী সংগঠনে রাষ্টের সকল অর্গানের মতো অর্গান (মন্ত্রনালয় বা বিভাগ) থাকতে হবে এবং সেই সব অর্গানকে পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় মন্ত্রী বা সচিব থাকতে হবে। কিন্তু আমরা আমাদের দেশে কোন একটি সংগঠনে সেই পরিমাণ বিভাগ ও নেতৃত্ব কি পাই? আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামী সংগঠন গুলোর সেই প্রস্তুতি এখনো পরিপূর্ণ নয়।

৪. রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইকামাতে দ্বীনঃ

দ্বীন নিয়ে এসেছেন আল্লাহর রাসূল। আর দিন প্রেরিত হয়েছে অন্যান্য দ্বীনের উপর বিজয়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য। দ্বীন মানে জীবন ব্যবস্থা। এর মানে রাষ্ট্রে চলমান ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে সেই শুন্যস্থানে ইসলাম নামক দ্বীনকে কায়েম করা। রাসূল সা. এই দ্বীন কায়েম করার প্রাথমিক প্রস্তুতিমূলক কাজটি করেছেন মক্কাতে। কিন্তু মক্কাতে সেই দ্বীন গ্রহণের সমাজ ছিল না। বিধায় তিনি হিজরত করে মদীনায় গিয়ে সেখানে দ্বীনকে রাষ্ট্রীয় ভাবে কায়েম করেছেন। সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন রাসূল সা. নিজে।

যে সমাজ দ্বীন চায়, সেই সমাজের নেতৃস্থানীয়দের দায়িত্ব হলো দ্বীনকে রাষ্টের আসনে বসানো। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সকল কিছু পরিচালিত হবে দ্বীন অনুযায়ী। আর তা যদি হয়, তাহলে তা হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইকামাতে দ্বীন। যেই ইকামাতে দ্বীনের বাস্তব নমূনা হলো নবী সা. এর নেতৃত্বাধীন মদীনা রাষ্ট্র, যেই ইকামাতে দ্বীনের বাস্তব নমূনা হলো খুলাফায়ে রাশেদার শাসন।

খুলাফায়ে রাশেদার সর্বশেষ খলিফা হযরত আলী রা. এর শাহাদাত পর্যন্ত দ্বীন কায়েম ছিল একশত ভাগ। তাই স্কলারগন এই সময়কালকে বলেন “খেলাফত আলা মিনহাজিন নাবুয়্যাহ” নবুয়াতের মানহাজ অনুসারী খেলাফত। এরপর দ্বীন কায়েম ছিল। কিন্তু দ্বীনের ১০০ ভাগ অনুসরণ করা হয়নি বলে তাকে “খেলাফত আলা মিনহাজিন নাবুয়্যাহ” বলা হয়না। হযরত আমীর মুয়াবিয়া রা. থেকে পরবর্তী পর্যায়ে দ্বীন ধীরে ধীরে বিচ্যুতির দিকে গিয়েছে। কিন্তু রাসূল সা. এর হাদীস অনুযায়ী আমরা তাঁর যুগ, এরপর সাহাবায়ে কিরামদের যুগ এবং সবশেষে তাবেয়ীদের যুগকে পর্যায়ক্রমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ বলতে বাধ্য। এখন যদি রাষ্ট্রীয় ভাবে ইসলাম কায়েমও করা হয়, তাহলে তা কোন অবস্থায়ই তাবেয়ীদের যুগের চেয়ে শ্রেষ্ট হবে না। অথচ সাহাবীদের যুগে হযরত আলী রা. এর পর থেকে নিয়ে উসমানী খেলাফত অবধি কোথাও গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাচিত হননি। তারা নিযুক্ত হয়েছেন রাজতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে। রাজতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে নির্বাচিত হলেও খুলাফায়ে রাশেদার পরবর্তী সময় গুলোতে দ্বীন সর্বপর্যায়ে কায়েম ছিল। এজন্য তাবেয়ীর যুগের শাসক হযরত উমর বিন আব্দুল আজীজকে আমরা ইসলামের পঞ্চম খলিফা বলে আখ্যায়িত করি-অথচ তিনি রাজতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেই ধরণের একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সকল মুসলমানদের উদ্যোগ থাকতে হবে। কিন্তু এই ধরণের রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা চাট্টিখানি কথা নয়। বিধায়, এই ধরণের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালাতে চালাতে আপনার জীবন শেষ হবে, সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য আপনার পরিবার থেকে পরবর্তী প্রজন্ম এগিয়ে আসতে হবে-এমন পরিবার ও সন্তান আপনাকে গঠন করতে হবে পারিবারিক পর্যায়ে দ্বীন কায়েম করে, আপনার সমাজ ও সংগঠন থেকে পরবর্তীতে পদক্ষেপ থাকতে হবে-এজন্য সমাজ ও সংগঠনে দ্বীন কায়েম করতে হবে। এই ধারাবাহিকতা চলবে, যতদিন না দ্বীন কায়েম হবে।

বিষয়টাকে কবি ফররুখ বলেছেন এই ভাবেঃ নহে সমাপ্ত কর্ম মোদের, অবসর কোথা বিশ্রামের। উজ্জল হয়ে ফোঁটেনি আজো, সুবিমল জ্যোতি তাওহীদের।

১৬ই জুন ২০২৩

ইকামাতে দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞানীদের কথাঃ


আমার লিখা অন্যান্য আর্টিক্যাল পড়তে  এখানে ক্লিক করুন


Post a Comment

2 Comments

Md Abdul Mannan said…
আসসালামুয়ালাইকুম । নজরুল ভাই, আপনার লিখাটি পড়লাম । বুঝলাম আপনি অনেক চিন্তা -গবেষণা করেন । আল্লাহ আপনার চিন্তার মধ্যে বারাকাহ দান করুন । আমার সময় এবং ধৈর্যের অভাব নতুবা আপনার লেখাকে আরো স্টাডি করে একটি বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ দিতাম । সেটা সম্ভব নয় । তাই সংক্ষেপে দু একটি কথা শেয়ার করছি ।
১।ইক্বামাতে দ্বীন সম্পর্কে আপনি যে বদ্ধমূল ধারণার কথা বলেছেন এ সিদ্ধান্তে আপনি কিসের ভিত্তিতে পৌছুলেন ? সাধারণ কর্মীদের চিন্তা নানা রকম হতে পারে । তবে যারা আন্দোলনের অভিজ্ঞ এবং চিন্তাশীল কর্মি তাদের ধারণা এ রকম সংকীর্ণ নয় বলে আমি মনে করি ।
২। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বীন কায়েম না থাকলে ব্যক্তি পর্যায়ে দ্বীনের অনেক বিধান যে মানা যায় না এটা সমাজ সচেতন দ্বীন্দার ব্যক্তি মাত্রই বুঝতে পারার কথা ।
৩। দ্বীন কায়েমের যে চারটি পর্যায় আপনি ভাগ করেছেন আমার ধারনা ইসলামি আন্দোলন যারা করেন তাদের এ সম্পর্কে ধারনা রয়েছে । এবং ইক্বামাতে দ্বীনের সংগঠণের পক্ষ থেকে জনশক্তি এবং জনগণের মাঝে এটার ডেভলাপমেন্টের জন্য অব্যাহত চেষ্টা চালু রয়েছে । প্রশ্ন হতে পারে সফল্তা কতটুকু ? কাজে সবাই শতভাগ সফল হয় না । যার যার চেষ্টা এবং নিয়্যতের স্বচ্ছতা অনুযায়ী ফলাফল প্রাপ্ত হবেন ।
৪। আপনি অনেকগুলো দুর্বলতার বিষয়ে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন । বিভিন্ন পর্যায়ে নানা দুর্বলতা অবশ্যই আছে । কিন্তু উপায় কী ? বিজ্ঞ এবং সমজদার লোকদের দায়িত্ব তো হবে সাধ্যমত নিজ অবস্থান থেকে সাধ্যমত উন্নয়নের চেশটা করা ।
৫। খুলাফায়ে রাশেদিনের পরের ইতিহাস নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে স্টাডি করলে খুব বেশি খুশী বা প্রীত হবার কিছু আছে কী ? বরং ইসলামের সুউন্নত নৈতিক আদর্শের সাথে পরবর্তি লোকদের আচরণ তুলনা করলে অনেকটা হতাশাব্যাঞ্জক এবং দুঃখজনক । সুতরাং এ যুগের লোকদের আচরণে আপনি কতটা উচ্চতা আশা করতে পারেন ?
৬। ইক্বামাতে দ্বীনের সংগঠণ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত যেখানে সব ধরণের ছাত্র আছে । আর প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো তার ছাত্রদের ভাল ফলাফল তৈরির জন্য প্রস্তুত করা । কিন্তু সব ছাত্র কোন সময়ই সমান কৃতিত্ব অর্জন করতে পারে না । কিন্তু প্রতিষ্ঠান তাতে থেমে থাকে না । সে সাধ্যমত তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে ।
৭। আর যত গুলো বিষয়ের প্রতি আপনি মনযোগ আকর্ষণ করেছেন ওই সূচকে আপনি নিজেকে একবার যাচাই করে দেখুন যে আপনি নিজে কতটা করতে পারছেন বা আপনি তাতে কতটা উত্তীর্ণ ?
৮। ভুল হলে আমাকে মাফ করবেন আপনার লেখার মধ্যে যেন একটা নেগেটিভ এপ্রোচ আমি অনুভব করি । আল্লাহ আপনার খেদমতকে কবুল করুন । জাযাকাল্লাহ খায়র ।
জনাব Md Abdul Mannan, ওয়া আলাইকুম আস্সালাম। দীর্ঘ একটি মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এ ধরণের মন্তব্য একজন লেখককে আরো লিখার জন্য উৎসাহিত করে। আল্লাহ আপনাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন।
লেখাটি কোন একটি সংগঠনকে কেন্দ্র করে লিখা হয়নি। তবে একটি সংগঠনকে হাইলাইট করা হয়েছে।
লেখাটির মাত্র ১টি পয়েন্ট সংগঠন কেন্দ্রীক। বাকী আরো পয়েন্ট রয়েছে, যার কোনটি আমার নিজের জন্য, কোনটি আমার এবং আমাদের পরিবারের জন্য। লেখার পয়েন্টের সূচক অনুযায়ী আমার অবস্থান হয়তো বা জিরোতে। কিন্তু আমাদের সকলের অবস্থান জিরোতে নয়। যাদের জিরো আছে, তারা ১ হবার চেষ্টার জন্য এই লিখা, যাদের ১ আছে, তারা যাতে ২ হয় সেজন্য এই লিখা। ধন্যবাদ আপনাকে।