বিএনপির দেউলিয়াত্ব

https://muhammadnazrulislam.info/

মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ দল হিসাবে বাংলাদেশে বিএনপি একটি বৃহৎ ও সৌভাগ্যবান দল। সৌভাগ্যবান দল এজন্য বললাম যে, যখনই দেশের মানুষ স্বৈরাচারের বিকল্প হিসাবে কাউকে চিন্তা করেছেন, তখন বিএনপিকেই গ্রহণ করে। কিন্তু জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে দলটি যতটুকু ব্যাপক, সাংগঠনিক মজবুতির দিক দিয়ে দলটি তুলনামূলক ভাবে ততটুকুই ক্ষীন। এককথায় বলতে গেলে ব্যাপক জনপ্রিয় এই দলটি সাংগঠনিক দিক দিয়ে অত্যন্ত নড়বড়ে এতিম একটি দল।

আমরা এ পর্যায়ে সাম্প্রতিক সময়ে দলটি দেউলিয়াত্বের কয়েকটি উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করবোঃ

১. নেতৃত্বের প্রতি আস্তাহীনতাঃ

বেগম খালেদা জিয়ার কারাগারে অবস্থান ও আইনি বাদ্যবাদকতার কারণে চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে না পারার কারণে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্বপালন করছেন তারেক জিয়া। তিনি আইনি সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে দেশান্তরি। দেশে অবস্থানকারী একজন নেতাও তাদের মাঝে নেই, যিনি দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। বাস্তবতা হচ্ছে, দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যায়ে এতো বড় দেউলিয়াত্ব বিরাজ করছে যে, দেশে অবস্থানকারী নেতারা তাদের কোন একজন সিনিয়রকে তাদের নেতা হিসাবে মানতে পারতেছেন না। একই ভাবে বেগম খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান দেশে অবস্থানরত কোন একজন নেতাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়ার মতো আস্থা রাখতে পারতেছেন না।

২. রাজতান্ত্রিক নেতৃত্বঃ

দলটি বাকশালের পতনের বেলাভূমিতে বহুদলীয় গনতন্ত্রে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জন্ম গ্রহণ করলেও দলটিতে নেই গনতন্ত্রের কোন চর্চা। প্রেসিডিন্ট জিয়ার ইনতিকালের পর দলটিতে হাল ধরার জন্য দলে অবস্থানকারী কোন নেতা আস্তাভাজন হতে পারেননি। দলের হাল ধরতে হয়েছিল তদানিন্তন গৃহবধু বেগম খালেদা জিয়াকে। খালেদা জিয়ার অবর্তমানে তারেক রহমানকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করে দলটি। তারপর নেতা হিসাবে গ্রহণ করার জন্য জিয়া পরিবারের পুত্রবধু ডা. জোবায়দা রহমান অথবা নাতিন জাইমা রাহমানের কথাই চিন্তা করা হয়। কিন্তু দলটির জন্মলগ্ন থেকে দলে অবস্থানকারী অথবা উদীয়মান তরুণ নেতাদের কেউ কোনদিন বিএনপির চেয়ারম্যান হবে এমন চিন্তা পাগলের প্রলাপ বৈ কিছু নয়। এই পারিবারিক ব্যবস্থা যখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হয়, তখন আমরা তাকে রাজতন্ত্র বলি। অথচ এই রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা দল গুলোতে বিরাজমান। তা শুধু বিএনপির বেলায় নয়। বরং আওয়ামীলীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি সকল দলে একই অবস্থা। এক্ষেত্রে শীর্ষ দলগুলোর মাঝে কেবল জামায়াতে ইসলামী ব্যতিক্রম।

৩. ড. কামাল হোসেনকে নেতা বানানোঃ

ড. কামাল হোসেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন একজন আইনজীবি হলেও ভোটের রাজনীতিতে তিনি অত্যন্ত পরিত্যাক্ত রাজনীতিবিদ। তিনি কোন নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন বলে আমি দেখিনি। সবচেয়ে বড় কথা হলো তিনি একজন আদর্শবাদী আওয়ামীলীগার। শেখ হাসিনা, শেখ সেলিমরা পারিবারিক কারণে আওয়ামীলীগ হলেও তিনি মরহুম শেখ মুজিবুর রাহমানের হাতে গড়া বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামীলীগ। তিনি দলে আওয়ামীলীগ না হলেও আদর্শে আওয়ামীলীগ। বিএনপির মতো একটা জনপ্রিয় দল কতটুকু দেউলিয়া হলে নিজ দল থেকে নেতৃত্ব পুরোপুরি ড. কামাল হোসেনের হাতে অর্পণ করে। যার পরিণতিতে আওয়ামীলীগ ২০১৮ সালে একটি অংশ গ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করে। বলা হয়ে থাকে যে, ড. কামাল সে সময়ে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার জন্য আওয়ামীলীগ থেকে এসাইনম্যান্ট প্রাপ্ত হয়েই কাজ করেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন।

৪. বিএনপি কর্তৃক নির্বাচন বর্জনে বিলম্বঃ

বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যখন দেখা গেল দিনের ভোট রাতে হয়ে গেছে, তখন সকাল ১১টায় জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন বর্জনের ঘোষনা প্রদান করলো। দেশ পরিচালনার আশা রাখে এমন একটি দল বিএনপি জামায়াতের আগেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ার কথা থাকলেও তাদেরকে বারবার অনুরোধ করার পরও তারা নির্বাচন বর্জনের ঘোষনা দেয়নি। দিনের ভোট রাতে হয়ে গেছে, এমনটা বুঝতে বুঝতে বিএনপির সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাতের বেলা যখন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হচ্ছে, তখন বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষনা দিল। একটি দল কত বড় দেউলিয়া হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে এতো দেরী করতে পারে। অবশেষে দেখা গেল ক্ষমতার আশার বিভোর দলটির আসন সংখ্যা দশের কোটা ফাঁড়ি দিতে ব্যর্থ হয়। একটি ব্যর্থ ও অকর্মন্য দল হিসাবে নিজেদের প্রকাশ করে।

৫. মহাসচিবের শপথ গ্রহণ না করা বনাম অবশিষ্ট এমপিদের শপথ গ্রহণঃ

নির্বাচন বর্জন করার পর নির্বাচিত এমপি বিএনপি মহাসচিব মির্যা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ নিলেন না। কিন্তু বিএনপি হচ্ছে সেই দেউলিয়া দল, যাদের হাতে গোনা ক’জন নির্বাচিত সংসদ সদস্য-যারা রাতের ভোটে নির্বাচিত হলেন, তারা দলীয় নেতৃত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদার্শণ করে শপথ গ্রহণ করলেন, সংসদের গেলেন, সংসদ সদস্য হিসাবে সকল ধরণের সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করলেন। তাদের বিরুদ্ধে ন্যনতম সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের নূন্যতম সাহসটুকুও বিএনপির হয়নি। বরং দেউলিয়অ বিএনপি নেতৃত্ব এই সংসদ সদস্যদের হাতে জিম্মি অবস্থায় সময় অতিবাহিত করে।

৬. মহিলা সংরক্ষিত আসন গ্রহণঃ

যার কথার ফুলঝুরিত টকশো হয় মুখরিত, যিনি জামায়াতকে নিয়ে বেফাহেশ মন্তব্য করতেও একটু ভাবেন না, যার সাথে তারেক রাহমানের বিশেষ সম্পর্ক আছে বলে নেটপাড়ায় গুজব আছে, সেই রুমিন ফারহানাকে বিএনপি যে নির্বাচন বর্জন করলো, সেই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে মনোনয়ন দিয়ে সেই সংসদের বৈধতা প্রদান করলো। কতটুকু দেউলিয়া হলে একটা দল নির্বাচন বর্জনের ঘোষনা দিয়ে আবার তারাই সংসদের বৈধতা দেয় এবং পরে আবার সেই নির্বাচনকে রাতের ভোটের নির্বাচন বলে বক্তব্য দেয়। নূন্যতম রাজনৈতিক হায়া শরম থাকলে এমন করার কথা ছিল না। সেই রুমিন ফারাহানা ব্যক্তিগত জীবনে একজন ব্যরিস্টার। যার কথা টকে টকশো গুলো হয় ভিউতে সমৃদ্ধ, সেই ব্যরিস্টারের যোগ্যতা এমন যে, ব্যরিস্টারী পেশা দিয়ে ঢাকায় একখন্ড জমিও কিনতে পারেননি বলে সেই অবৈধ সংসদের অবৈধ এমপি হিসাবে অবৈধ্য সরকারের কাছে একখন্ড জমি খয়রাত হিসাবে চেয়ে আবেদন করেছেন। অথচ তিনি বলেছিলেনঃ সংসদ যে অবৈধ সেই কথাটাই নাকি সংসদের বলার জন্য জন্য তিনি সংসদে গিয়েছেন।

৭. জামায়াতের সাথে জোটঃ

জামায়াতে ইসলামীর সাথে বিএনপির জোটের বিষয়টি কোন রাতের অন্ধকারে চূক্তি ছিল না। অত্যন্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে চারদলীয় জোট গঠনের পর ধীরে ধীরে সেই জোট বিস্তৃত হয়ে বিশ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। সেই জোট এক সময় বিএনপির অভ্যন্তরে থাকা বামদের কুটচালে দূর্বল হয়ে পড়ে। কথিত আছে, সেই বামরা আওয়ামীলীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে বিএনপিতে অনুপ্রবেশ ঘটায় এবং ধীরে ধীরে তারা শীর্ষ নেতৃত্বের আসনে পৌছে। আরো কথিত আছে, তারা নিয়মিত ভাবে আওয়ামীলীগ থেকে মাসওয়ারা পায়। বিনিময়ে তারা বিএনপির সকল গোপন তথ্য আওয়ামীলীগকে প্রদান করে এবং বিএনপি যাতে চূড়ান্ত আন্দোলনে না যায়, সেই মিশন নিয়েই তারা কাজ করে। সেই বামরা আদর্শিক ভাবে জামায়াতের শত্রু। তাই দেখা যায়, জামায়াতকে তারা ব্যবহার করতে চায়,  বিভিন্ন সময়ে বিএনপির মাঝে তারা জামায়াত বিদ্বেষ ছড়ায়। আওয়ামী আমলে জামায়াতের বিরুদ্ধে চলা মেসাকারে তারা নূন্যতম একটি বিবৃতি প্রদান করেনি। একটা দল কতটুকু দেউলিয়া হলে যাদের সাথে জোট আছে, তাদের সুখে দূঃখে অভিনন্দন ও সমবেদনা জানায় না, বিএনপি বাংলাদেশের শুধু নয় বিশ্ব রাজনীতিতে একটা বড় উদাহরণ।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আধুনালুপ্ত বিশ দলীয় জোটের শরীক বাকী ১৮টি দলের দিকে যদি নজর দেয়া যায়, তাহলে বিএনপির এই দশা চোঁখে পড়েনা। বরং তারা প্রকাশ্যে জামায়াতের পক্ষে কথা বলে, জামায়াতের নেতাদের সাথে বসে, জামায়াতের পক্ষে বক্তব্য মন্তব্য প্রদান করে। কিন্তু বিএনপি আজিব এক দেউলিয়া দল, তারা জানেনা যে তাদের কি করা উচিত, কি করা উচিত নয়।

সুপ্রিয় পাঠক!

আমরা বিএনপির মাত্র ৭টি দেউলিয়াত্ব এখানে উপস্থাপন করলাম। কিন্তু বিএনপির দেউলিয়াত্ব কি এই ৭টির মাঝে সীমাবদ্ধ। আপনি কি মনে করেন? লিখতে পারেন ‘মন্তব্যে’ আপনার মতামত।

জাতির দূর্ভাগ্য যে, এই ধরণের একটি দেউলিয়া দলকেই বাধ্য হয়ে জাতিকে নেতৃত্বের জন্য নির্বাচিত করতে হয়। অন্যান্য দলের জন্য দূর্ভাগ্য যে, এই ধরণের একটি দেউলিয়া দলকে বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান দুই দল ভিত্তিক চিন্তা থেকে সরে এসেছে। প্রতিষ্ঠিত পিপিপি ও মুসলিমলীগের বিকল্প তৃতীয় শক্তি তাহরিকে ইনসাফ এর  ইমরান খানকে গ্রহণ করেছে মানুষ। আমাদের একদম প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিম বাংলায় মানুষ কংগ্রেস, বিজিপে আর কমিউনিস্ট পার্টির রাজত্বকে চুরমার করে তৃণমূলের মমতা ব্যানার্জিকে গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা পরবর্তী দূর্ভিক্ষের সাথে সাথে কম্বল চোর দেখেছে, ৯ বছরের রাজার ১০ বছরের সাজা দেখেছে, হাওয়া ভবন আর হলমার্ক কেলেংকারী সব দেখা শেষ হয়ে গেছে। তাহলে কি বাংলাদেশে তৃতীয় শক্তিকে পছন্দ করার সময় এখনো আসেনি?

বাংলাদেশে পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতি ডিজিটাল বিশ্বের সাথে তাল মিলাতে প্রয়োজন ডিজিটাল নেতৃত্ব। আর এজন্য প্রয়োজন ডিজিটাল নেতৃত্বে সমৃদ্ধ তৃতীয় বিকল্প রাজনৈতিক দল।

Post a Comment

0 Comments