লেম ও লেফটনের ইতিকথা



মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ ছবিতে যে বস্তু গুলো দেখা যাচ্ছে, তা ছিল আমার ছাত্রজীবনে রাতের আঁধারের সাথী। মাঝখানের বস্তুটাকে বলে হারিকেন-আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হতো লেফটন, সম্ভবতঃ ইংরেজীতে লেন্টন বলা হয়ে থাকে। এক সময় নির্বাচন সমূহে অন্যতম মার্কা ছিল লেফটন। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে আমরা দেখেছিলাম কুলাউড়া আসন থেকে এম এ ইউসুফ সাহেব মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসাবে লেফটন নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করতে। তখন তার সমর্থকেরা শ্লোগান তুলতেনঃ ইসুফ ভাইয়ের মার্কা কি-লেফটন লেফটন।

ছবিতে লেফটনের চার পাশে যে বস্তু গুলো দেখা যাচ্ছে, তার নাম প্রদীপ-আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হতো লেম, ইংরেজীতে লেম্প থেকে লেম হয়েছে। কোন কোন এলাকায় এটাকে কুপি বাতিও বলা হয়ে থাকে।

লেম আর লেফটন বা হারিকেন আর লেম্প-সবক’টারই কমন নাম হলো “বাতি”। যার জ্বালানী হলো কেরসিন। আধুনিকক জামানায় এই বস্তুটা যাদুঘরে স্থান পেলেও আমাদের ছাত্র জামানায় এটাই ছিল আমাদের একমাত্র অবলম্বন। ব্যক্তিগত ভাবে আমি ছাত্রজীবনে নিয়মিত ভাবে অনেক রাত জেগে পড়ুয়া ছাত্র ছিলাম না। তাই লেম লেফটনে কেরসিন সংকটের বিষয়টির বাস্তব অভিজ্ঞতা নাই। কিন্তু আমার সহপাটি ও বড় ভাইদের যারা বই পোকা ছিলেন এবং লজিং এ থাকতেন, তাদের নিকট কেরসিন সংকটের গল্প শুনেছি। লজিং বাড়ীতে লেমের মধ্যে পরিমিত পরিমাণ কেরসিন দেয়া হতো না। ফলে রাত ৯টা ১০টার দিকে কেরসিন শেষ হয়ে যেতো। অনেক রাত জেগে পড়ার জন্য নিজের পক্ষ থেকে বাজার থেকে শিশিতে (বোতল) করে কেরসিন নিয়ে আসতে হতো। কেরসিন দেখতে পেট্রোলের মতো হলেও তাতে যে গন্ধ আছে, মারাত্মক। বিধায় হাতে লাগলে সাবান দিয়ে হাত পরিস্কার করলেও গন্ধ থাকতো।

আমার একজন সিনিয়র দায়িত্বশীল ছিলেন, যিনি এলাকার নামকরা বাড়ীতে লজিং থাকতেন। কিন্তু এই বাড়ীতেও ছিল একই অবস্থা। লেমের মাঝে পরিমিত পরিমাণ কেরসিন দেয়া হতো না। তার লজিং বাড়ীর পাশেই ছিল একটি মাজার। উনি নিয়মিত ভাবে সেই মাজারে জিয়ারত করতে যেতেন বলে এলাকায় তাকে ভাল চোঁখে দেখা হতো। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। গভীর রাতে আলো সংকট তথা কেরসিন শেষ হয়ে যেতো বলে তিনি নিয়মিত মাজার থেকে মোমবাতি চুরি করতেন।

আমি যখন মাধ্যমিকের ছাত্র, তখন বাংলাদেশে লিটারের প্রচলন ছিল না। তখন লিটারের একককে সের বলা হতো। আমি সেই সময়ে বাজার থেকে ৫ সের কেরসিন বাড়ীর জন্য নিয়ে এসেছি অনেক বার। আর সেজন্য ৫সেরের পাত্র বাড়ী থেকে নিয়ে যেতে হতো।

লেমের আগুন কখনো নিভে গেলে বা নিভিয়ে ফেললে আবার তা জ্বালানোর জন্য প্রয়োজন হতো দিয়াশলাই। সেই সময়ে বাজারের দোকান গুলোতে দিয়াশলাইয়ের প্যাকেট বিক্রি হতো ২৫ পয়সা, যাকে চার আনাও বলা হতো। প্রত্যেরক বাড়ীতে দিয়াশলাই থাকতো। দিয়াশলাই যাতে বাতাসে নষ্ট না হয়ে যায়, সেজন্য গরম রাখতে চুলার পাশে রাখা হতো এবং বালিশের কাভারের ভিতর রাখা হতো। ছোটকালে আমাদের বাড়ীতে ১২ পেকেট দিয়াশলাইয়ের ১ কার্টুন একসাথে ক্রয় করা হতো।

হারিক্যান বা লেফটনটা ছিল সেই সময়ে একটু স্ট্যান্ডার্ড বস্তু। একটি বাড়ীতে একাধিক লেফটন ছিল না। বাড়ীর বৈঠক খানা বা প্রধান ঘরে লেফটন থাকতো আর অন্যান্য ঘরে লেম। বাতাস যাতে আলোকে নিভিয়ে ফেলতে না পারে সে জন্য আলোর উৎসের চারপাশে একটা গ্লাস দিয়ে আবৃত থাকতো লেফটনে। লেফটন বহন করার জন্য থাকতো একটি লটকনি। লেফটন যে পরিবারে ব্যবহার হতো, সেই পরিবারে আসরের পরে লেফটনের গ্লাস পরিস্কার করা একটা নিয়মিত কাজ ছিল। কিন্তু অধিকাংশ ফ্যামেলীতে লেফটনের গ্লাস (যাকে চিমনী বা ছিফনীও বলা হতো) পরিস্কার করার জন্য সাবান ব্যবহার করা হতো না। কারণ সেই সময়ে সাবান ব্যবহারের সামর্থ অধিকাংশ ফ্যামেলীর ছিলনা। ফলে চুলার ছাই দিয়ে হারিক্যান বা লেফটনের গ্লাস পরিস্কার করা হতো। সন্ধ্যার অনেক আগেই গ্লাস পরিস্কার করে রাখা হতো, যাতে গ্লাসের পানি শুকিয়ে ঝকঝকে হয়ে যায়। গ্লাসে পানি থাকলে বা গ্লাস ভিজা থাকলে আলো জ্বালানোর সাথে সাথে ধোঁয়া গ্লাসের ঝকঝকে ভাব নষ্ট করে ফেলতো। এতে করে পরিস্কার আলো পাওয়া যেতো না।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে একএক করে সকল বাড়ীতে বিদ্যুৎ সংযোগ চলে আসে। আমার এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত সকল পড়ালেখা লেমের আলোতেই হয়েছে। এসএসসি পরীক্ষা দেয়া হয়েছে মৌলভী বাজার টাউন সিনিয়র মাদ্রাসায়। পরীক্ষা শেষ শহর থেকে ফিরে বাড়ীতে গিয়ে দেখি আমাদের সকল ঘর কারেন্টের আলোতে ঝলমল করছে। বিদ্যুৎ চলে আসলেও সেই সময়ে বেশীর ভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকতো না। হাল আমলের লোড শেডিং এর খবরও আমরা ভূলিনি। ফলে লেমের প্রয়োজন না থাকলেও সকল ফ্যামেলিতে লেফটনের প্রয়োজন থেকে যায়। আর প্রতিটি পরিবারে লেফটনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। সেই সময়ে বিয়ের কনের সাথে যে সব যৌতুক বা উপহার প্রদান করা হতো, তন্মধ্যে একটি হারিক্যান বা লেফটন ও একটি লেম অনিবার্য ছিল। গ্রাম শহরের প্রতিটি পরিবারে বিদ্যুৎ চলে আসলেও লোড শেডিং এর কারণে সকল ফ্যামেলিতে সন্ধ্যা বেলা লেফটন জ্বালিয়ে তার আলো মিটমিট করে রাখা হতো। লোড শেডিং এর সময় কারেন্ট চলে যাওয়া মাত্র সেই মিটিমিট আলোকে বাড়িয়ে দেয়া হতো।

লেফটনের উপরের অংমে যে জায়গাটা থাকতো, তা কেরসিন জ্বলে সৃষ্ট ধোঁয়াটাকে অনেকটা আটকিয়ে রাখতো। সেখানে ধোঁয়ার একটা স্থর তৈরী হতো এবং কয়েকদিন পরপর লেফটন পরিস্কার করার সময় সেই ধোঁয়া স্থরকে ভাল ভাবে পরিস্কার করা হতো। কিন্তু লেমের মাঝে সেই সুবিধা ছিল না। ফলে লেম পুরো ঘরকে ধোঁয়ার কালিতে কালো করে ফেলতো। সেই সময়ে মশার উপদ্রবের কারণ সকল বাড়ীতেই মশারী ব্যবহার করা হতো। এখনকার মতো সকল বাড়ীতে পালং ছিল না। ফলে দেয়ালের মাঝে লোহা (তারকাটা) গেড়ে তাতে রশি লাগিয়ে মশারী টানানো হতো। আমার মতো যারা অলস ছিলেন, তারা প্রতিদিন মশারী টানানোর কঠিন কাজটাকে সহজ করার জন্য মশারীর নিচের অংশকে উপরে উঠেয়ে ছাদ বা শামিয়ানার মতো করে রাখতেন। খাটের পাশেরই পড়ার টেবিল। আর টেবিলে থাকতো লেম। ফলে কয়েকদিন পরে দেখা যেতো লেমের কালিতে মশারীর এক কোনা পুরো কালো হয়ে গেছে। যা পরিস্কার করলেও ‍পুরো ধবধরে হতো না।

আজ আমার ছাত্র জীবন শেষ হয়ে গেছে। এখন চলছে আমার সন্তানদের ছাত্র জীবন। কিন্তু তারা সবাই চিনেনা ছবির এই বস্তু গুলো কি? লেফটন চিনলেও লেম চিনে না। একজন তো লেম লেফটন কোনটাই চিনেনা। তাদেরকে ব্যাখ্যা করে বুঝাতে হয়েছে এটি লেম আর ওটি লেফটন, যা এক সময়ে আমাদের বাল্ব, লাইট বা টিউব লাইট ছিল। এক সময় এই বস্তুটিই আমাদের আঁধার দূর করার মাধ্যম ছিল।

Post a Comment

0 Comments