ইসলামে নির্বাচন পদ্ধতি – মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম

মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ রাসূল সা. এর ইনতিকালের পর তদানিন্তন ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য কোন একটি পদ্ধতিকে অনুসরণ করা হয়নি, রাসূল সা. নির্বাচনের পদ্ধতি বলে যাননি। কিন্তু রাসূল সা. তার উম্মতের মাঝে এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছিলেন যে, তখনকার সময়ের সকলেই জানতো যে, ইসলাম একটি শুরা বা পরামর্শ ভিত্তিক  খেলাফত ব্যবস্থার দাবী করে। ফলে রাসূল সা. এর ইনতিকালের পর সেখানে কোন বংশানুক্রমিক বাদশাহী প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বল প্রয়োগ করে কেউ ক্ষমতায় আসেননি, খেলাফত লাভের জন্য কেউ চেষ্টা তদরিব করেননি।

রাসূল সা. এর পর চারজন খলিফা নির্বাচিত হয়েছেন জনগনের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে। কিন্তু চারটি ভিন্ন ভিন্ন নির্বাচন প্রক্রিয়ায়। যেমনঃ

. হযরত আবু বকর রা. : রাসূল সা. এর ইনতিকালের পর খলিফা হিসাবে হযরত আবু বকর রা. এর নাম প্রস্তাব করেন হযরত উমর রা. । মদীনার সকল মানুষ তার এই প্রস্তাব সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করে এবং তাঁর হাতে বাইয়াত তথা আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে।

. হযরত উমরা রা. : হযরত আবু বকর রা. ইনতিকালের আগে একটি ওসিয়াত নামা লিখান-যাতে পরবর্তী খলিফা হিসাবে হযরত উমর রা. স্থলাভিষিক্ত করেন। তারপর মসজিদে নাবাউয়ীতে সর্বস্তরের জনতার সমাবেশ আহবান করে বলেনঃ

أترضون بما استخلفتُ عليكم؟ فإني والله ما آلوت من جهد الرأي فإني ما استخلفتُ عليكم ذا قرابة، وإنّي قد استخلفتُ عليكم عمرَ فاسمعوا له وأطيعوا.

আমি যাকে স্থলাভিষিক্ত করছি তোমরা কি তার উপর সন্তুষ্ট? আল্লাহ কসম! সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বুদ্ধি-বিবেক প্রয়োগে আমি বিন্দুমাত্রও ত্রুটি করিনি। আমার কোন আত্মীয়-স্বজনকে নয়, বরং উমর ইবনুল খাত্তাবকে আমার স্থলাভিষিক্ত করেছি। সুতরাং তোমরা তাঁর নির্দেশ শুনবে এবং আনুগত্য করবে।

তার বক্তব্য শেষ হলে সবাই সমস্বরে বলে উঠেঃ আমরা তাঁর নির্দেশ শুনবো এবং মানবো।

. হযরত উসমান রা. : হযরত উমর রা. তাঁর জীবনদ্দশায় তার পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য একটি পদ্ধতি ব্যাখ্যা করেন এবং ইনতিকালের আগে ৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি নির্বাচন কমিটি গঠন করেন। কমিটির পক্ষ থেকে হযরত আব্দুর রাহমান ইবনে আউফ রা.কে জনমতামত যাচাই করে খলিফার নাম প্রস্তাব করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। হযরত আব্দুর রহমান সাধারণ লোকদের মতামত গ্রহণ করে হযরত উসমান রা. এর নাম প্রস্তাব করেন। সাধারণ মানুষ তার প্রস্তাব গ্রহণ করলে জনতার সমাবেশে তার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করে।

. হযরত আলী রা. : হযরত উসমান রা. এর শাহাদাতের পর কিছু লোক হযরত আলী রা.কে খলিফা নির্বাচিত করতে চাইলে তিনি বলে :

ليس ذلك اليكم انما هو لأهل الشورى وأهل بدر فمن رضى به أهل الشورى وأهل بدر فهو الخليفة فنجتمع و ننظر في هذا الأمر.

"এটা করার ইখতিয়ার তোমাদের নাই। এটা তো শূরার সদস্য ও বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের কাজ। তারা যাকে খলিফা করতে চান, তিনিই খলিফা হবেন। আমরা মিলিত হবো এবং এব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করবো।"

সে অনুযায়ী আহলে শুরা ও আহলে বদর এর ফায়সালা অনুযায়ী হযরত আলী রা. খলিফা নির্বাচিত হোন। 

খুলাফায়ে রাশেদার পর : হযরত আলী রা. এর ওফাতের সময় লোকেরা তাকে জিজ্ঞেস করলো, আমরা কি আপনার ছেলে হযরত হাসান রা. এর হাতে বাইয়াত করবো? উত্তরে হযরত আলী রা. বললেন:

لا أمركم ولا أنهاكم انتم أبصر

"আমি তোমাদেরকে নির্দেশও দিচ্ছি না, নিষিধও করছি না। তোমরা নিজেরাই এ ব্যাপারে ভালোভাবে বিবেচনা করতে পারো।"

হযরত আলী রা. এর জীবনের একদম শেষ মুহুর্তে তাকে প্রশ্ন করা হলো: হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি আপনার উত্তরসূরী মনোনয়ন করছেন না কেন? উত্তরে হযরত আলী রা. বলেন:

لا ولكني أتركهم كما تركهم رسول الله صلى الله عليه وسلم

"না, আমি মনোনয়ন করছি না। কেননা আমি মুসলমানদেরকে সে অবস্থায় ছেড়ে যেতে চাই, যে অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ সা."

 

উপরের আলোচনা থেকে আমরা যে সব বিষয় উপলব্দি করতে পারি:

সিদ্ধান্ত গ্রহণে মূলনীতি যদি হয় রাসূল সা. এর সুন্নাহ ও খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নাহ, তাহলে আমরা দেখতে চাই রাসূল সা. এর সুন্নাহতে পরবর্তী দায়িত্বশীল বা প্রতিনিধি নির্বাচনে কোন নির্দেশ নাই। কিন্তু খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নাহতে রয়েছে নানাবিধ অপসন। যেমন:

১. পরিস্থিতির আলোকে কোন এক ব্যক্তি প্রস্তাব করবেন, বাকীরা সমর্থন করলেই তিনি নির্বাচিত প্রতিনিধি বা দায়িত্বশীল হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন।

২. নির্বাচিত প্রতিনিধি বা দায়িত্বশীল তার দায়িত্বের মেয়াদে তার পরবর্তী উত্তরাধিকার নির্বাচন করবেন। সেই উত্তরাধিকারী নির্বাচনের বিষয়টি তিনি মজলিসে শুরা বা সংসদ কর্তৃক অনুমোদন করাবেন।

৩. নির্বাচনের জন্য একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে। সেই নির্বাচন কমিশন ভোটারদের মতামত যাচাই করে একজন ব্যক্তিকে নির্বাচিত ঘোষনা করবে এবং তিনি প্রতিনিধি বা দায়িত্বশীল হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন।

৪. প্রতিনিধি বা দায়িত্বশীল নির্বাচন মজলিসে শুরা অথবা একটি বিশাল নির্বাচক মন্ডলীর হতো ন্যস্ত থাকবে। তারা পরামর্শ করে বা ভোটের মাধ্যমে একজনকে প্রতিনিধি বা দায়িত্বশীল নিয়োগ প্রদান করবেন।

৫. প্রতিনিধি বা দায়িত্বশীল নির্বাচনের বিষয়টি দায়িত্বপালনরত নির্বাচিত প্রতিনিধি বা দায়িত্বশীল তার দায়িত্বের মেয়াদে নির্ধারণ না করে  তার মেয়াদ সমাপ্ত করবেন। তারপর চলমান সিস্টেম (যা আগে থেকে নির্ধারিত) অনুযায়ী পরবর্তী প্রতিনিধি বা দায়িত্বশীল নিযুক্ত হবেন।

৬. প্রতিনিধি বা দায়িত্বশীল যিনি নির্বাচিত হবেন, তিনি কোন মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হবে না। বরং আমৃত্যু তিনি সে দায়িত্বে থাকবেন।

Post a Comment

0 Comments