সাঈদী সাহেবের মাহফিলের কপিরাইট ও একজন সাইফুল্লাহ মানছুরঃ মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম


মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃ সাইফুল্লাহ মানছুর। নাম বলার সাথে সাথে ইসলামী ঘরোনার সকলে তাকে চিনি। তিনি নিজ মহিমায় পরিচিত। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উস্তাদ মতিউর রহমান মল্লিকের পর অনেক বড় বড় শিল্পী ও সংগঠক এসেছেন। কিন্তু মতিউর রাহমান মল্লিকের পর যে নামটি বেশী উচ্চারিত হয় তিনি সাইফুল্লাহ মানছুর

রফিক সাঈদী, শামীম সাঈদী এবং মাসুদ সাঈদীকে আমরা চিনি। তাদেরকে আমরা চিনি তাদের আব্বা আল্লামা সাঈদীর সূত্রে। সাইফুল্লাহ মানসুরেরও তেমনি একটি বর্ণাঢ্য পারিবারিক পরিচয় আছে। কিন্তু সেই পরিচয়ে তিনি ফোকাস না হয়ে নিজ মহিমায় তিনি পরিচিত। তিনি জামায়াতে ইসলামীর মহিলা বিভাগের প্রাক্তণ সেক্রেটারী বহু গ্রন্থ প্রণেতা হাফেজা আসমা খাতুনের ছেলে। তিনি শহীদ মতিউর রহমান নিজামীর জামাতা। তিনি অধ্যাপক গোলাম আযমের প্রথম পুত্রবধুর ভাই। তার বিয়েতে হাজির হয়েছিলেন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াসহ আমাদের চেনাজানা সকল রতি মহারতি।

কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত জীবনে এই সব পরিচয়কে ধারণ না করে হয়েছেন নিজ মহিমায় পরিচিত। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্র সংগঠনের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্পাদক। কর্মজীবনে একটি কলেজের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংবাদ পাঠক। অবশেষে নিজের সহজাত প্রবৃত্তির টানে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া এবং সে আন্দোলনে আদ্যোপান্ত নিজেকে জড়িয়ে ফেলা।

আমরা কি জানি! সাইফুল্লাহ মানছুর কেন বাংলাদেশে অবস্থান করছেন না? নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন মালোয়েশীয়াতে। যদি তিনি দেশে অবস্থান করতেন, তাহলে তার ভাগ্যে হয়তো আমান আল আযামী আর আরমানদের অবস্থা হতো।

সাইফুল্লাহ মানছুর চাকুরী ছেড়ে গড়ে তুলেন স্পন্দন অডিও ভিজুয়েল সেন্টার বা সিএইচপি। আল্লামা দেলাওয়ার হোসাঈন সাঈদীর তাফসীর মাহফিল গুলো কাভার করতে থাকেন মরহুম মাওলানার লিখিত অনুমতি ও কপিরাইট স্বত্ত্ব নিয়ে। এটা সেই সময়ের কথা যখন হাতে হাতে মোবাইল ছিল না, রেকর্ডার ছিল না, ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল না। ছিলনা ভিডিও এডিটিং সফটওয়ার, ছিলনা ইউটিউব ফেইসবুকসহ সোসাল মিডিয়া, ছিলনা এখনকার যুগের এলইডি স্ক্রীন বা মনিটর। ১০/১৫ কেজি ওজনের টেলিভিশন সেটকে কাঁধে করে নিয়ে স্থাপন করতে হতো মাহফিলের একটা নির্দিষ্ট অংগনে। পুরো অনুষ্ঠান রেকর্ড করে দুইটা টেলিভেশন আর ভিসিআর যন্ত্রের সাথে নানান ধরণের ক্যাবল সেট করে মাহফিল গুলোকে এডিট করতে হতো। একটা মাহফিল শেষ হওয়ার পর অডিও ক্যাসেট হাতে আসতে সময় লাগতো ১ মাস, আর ভিডিও ক্যাসেটের জন্য অপেক্ষা করতে হতো ২/৩মাস।

এতো পরিশ্রম করে যিনি এই কাজ গুলো করতেন, তার সেই কাজগুলোকে আমরা এনালগ যুগে দেদারসে কপি করে বিক্রি করে হাজার লক্ষ টাকা ইনকাম করেছি। আমরা কি কখনো খবর নিয়েছি-সাইফুল্লাহ মানসুরের ইনভেস্ট-এর কতটাকা রিটার্ণ এসেছে? কাতার প্রবাসী হিসাবে আমি সাক্ষী-সাইফুল্লাহ মানসুরের অডিও ভিডিও ক্যাসেট দেশ থেকে মাত্র ১কপি সংগ্রহ করে শত শত কপি কাতার প্রবাসীদের মাঝে বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু সাইফুল্লাহ মানছুর কি তার বিনিময়ে ১টি টাকা পেয়েছেন বা দাবী করেছেন?

২০০৩ কিংবা ২০০৪ সালের কথা। সাইফুল্লাহ মানসুরের সাথে সাক্ষাৎ করলাম মগবাজারে তার স্টুডিওতে সদ্য সমাপ্ত আল্লামা সাঈদীর তাফসীর মাহফিলের ভিডিও ক্যাসেট সংগ্রহের জন্য। তিনি ভিডিও ক্যাসেট দিলেন। শতশত অডিও ক্যাসেটর স্টীকার দিলেন। কিন্তু আমরা তো ১টি টাকাও তাকে দিলাম না। তিনিও ১টি টাকাও দাবী করলেন না। তার প্রত্যাশা দ্বীনের বাণী, সুস্থ সংস্কৃতি যেন প্রবাসে ছড়িয়ে পড়ে।

এনালগ যুগ শেষ হয়ে ডিজিটাল যুগ শুরু হলো। আমরা সাইফুল্লাহ মানসুরের সকল কাজ তার অনুমতি ছাড়া ইউটিউবে আপলোড করলাম। শুধু আপলোড করলাম না, বরং সাথে সাথে কপিরাইট নিজেদের নামে দিয়ে দিলাম। সাইফুল্লাহ মানছুর যখন নিজের কাজ ইউটিউবে আপলোড করতে গেলেন, তখন দেখলেন তার নিজের করা কাজ অন্যের নামে নিবন্ধিত হয়ে আছে। কপি রাইট ক্লেইম এর নোটিশ আসছে। তাই সাইফুল্লাহ মানছুর কাজগুলোকে আবার নতুন আঙ্গিকে সাজিয়ে আপলোড করলেন। যার বদৌলতে আমরা অরিজিন্যাল কাজ গুলোকে আবার অরিজিন্যাল ভাবে ফেরত পেলাম। যারা সাইফুল্লাহ মানসুরের কাজ গুলো দেখেন, তারা অত্যন্ত সহজে উপলব্দি করতে পারবেন কোন কাজ গুলো নকল আর কোন কাজ গুলো আসল।

আল্লামা সাঈদী রাহিমাহুল্লাহর তাফসীরের সংরক্ষণ সাইফুল্লাহ মানছুর যা করতে পেরেছেন, তা আল্লামার সকল তাফসীরের ১০ ভাগও হবে না। তাহলে বাকী ৯০ভাগ কাজগুলো কোথায়? আমরা যারা সাইফুল্লাহ মানসুরের কাজ নিয়ে সমালোচনা করি, তারা কি তার কোন একটি কাজ নিজেরা সংরক্ষণ করতে পেরেছি। আমি কাতারে থাকি হিসাবে বলতে পারি, কাতারে লম্বা সময় সফর করেছিলেন আল্লামা সাঈদী। কেউ কি বলতে পারবেন, তার সফরের ভিডিও চিত্র গুলো অনলাইনে কোথাও দেখেছেন। মাত্র ২টি ভিডিও চিত্র অনলাইনে দেখা যায়, তাও সাইফুল্লাহ মানসুরের করা।

এখন অতিআবেগীরা হঠাৎ করে দ্বীনের খাদিম হয়ে আল্লামা সাঈদীর ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করছেন। আবার নিজে নিজে তার কপি রাইট ক্লেইম করছেন। প্রথমতঃ সাইফুল্লাহ মানসুরের করা ভিডিও আপনি আপলোড করার অধিকার কোথায় পেলেন? এটাতো একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এটা নিজের চ্যানেলে আপলোড করার মাধ্যমে কি হক্কুল ইবাদ নষ্ট করা হচ্ছে না? দ্বিতীয়তঃ আপলোড করার পর আবার কপি রাইট ক্লেইম করা কি অনৈতিক নয়? আপনি কপি রাইট ক্লেইম করার অধিকার কোথায় পেলেন? অতিআবেগী ভাইদের এই ক্লেইমের কারণে প্রতিদিন সাইফুল্লাহ মানসুরের কাছে ইউটিউব নোটিশ পাঠাচ্ছে। সাইফুল্লাহ মানছুরকে তার প্রতিটির জবাব দিতে হচ্ছে। আর কপিরাইট ক্লেইমের জবাব দেয়া কেবল ইয়েস-নট এর বিষয় নয়। তার জন্য রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়।

মনে রাখতে হবে, ইউটিউব প্রচারের একটা মাধ্যম হলেও এর কর্তৃপক্ষ ইসলামের খেদমতের জন্য ইউটিউভ প্লাটফরম তৈরী করেনি। বরং ইসলামের ক্ষতি করার জন্যই তারা এটা তৈরী করেছে। তারা ইসলামিক কন্টেন্ট গুলো প্রচার করে নিজেদের গ্রহণ যোগ্যতা সৃষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য। সাথে নিজেদের ব্যবসাকে সমৃদ্ধ করা জন্য।

আজ থেকে মাসদিন অতিবাহিত হওয়ার পর যখন অতিআবেগীদের আবেগ শেষ হয়ে যাবে। যখন জালেম সরকার উদ্যোগী হবে ইউটিউব থেকে সাঈদীকে মুছে ফেলার জন্য। তখন কি কোন আবেগী আছেন, যিনি তার অরিজিন্যাল কন্টেন্ট গুলো আবার ইউটিউবে অথেনটিক হিসাবে আপলোড করার জন্য? ঘুরে ফিরে আবার সাইফুল্লাহ মানছুরদেরকেই হাল ধরতে হবে। কেবল আবেগ নয়, বরং সুনির্দিষ্ট কমিটমেন্ট নিয়ে যারা দিন গুজরান করেন, যারা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন এবং করে যাচ্ছেন, তাদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে আল্লামা সাঈদীকে অনলাইন দুনিয়াতে ঠিকিয়ে রাখার জন্য।

প্রসংগত উল্লেখ করি, বর্তমান হাল জামানার উদীয়মান শিল্পী মাহমুদ ফায়সাল এর কথা। তুমি আসমানে থাকো প্রভূ আমি জমীনে গানের মাধ্যমে যিনি সারা দুনিয়াতে পরিচিতি লাভ করেছেন এবং নেট দুনিয়াতে তার অনেক অনেক মৌলিক কাজ রয়েছে। তিনি তার কাজগুলো যাতে সবাই ব্যবহার করতে পারে, ভিডিও ক্লিপ গুলো যাতে সকল ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারে-এজন্য তার ভিডিও গুলোতে তিনি কপিরাইট ক্লেইম করেননি। কিন্তু দূঃখের বিষয় হলো, একদিন তার নিজের তৈরী নিজের আপলোড করা ভিডিতে ইউটিউব কপিরাইট এর অভিযোগ প্রেরণ করলো। কারণ অতি আবেগী ভাইদের কোন একজন তার ভিডিও আপলোড করে নিজের ভিডিও বলে ইউটিউবে কপিরাইট ক্লেইম করেছেন। তখন আর কি করা? মাহমুদ ফয়সলকে বাধ্য হতে হলো তার অপরাপর কাজ গুলো কপি রাইট করে রাখা, যাতে নিজের কাজ গুলো অন্যরা ছিনতাই করতে না পারে।

নিজের কাজ নিজে কপি রাইট করলে ক্ষতি কোথায়? ইউটিউবে সিএইচপির নামে বা সাইফুল্লাহ মানছুরের নামে আল্লামার যে সব ভিডিও রয়েছে, তা যদি কপি রাইট করা থাকে, তাহলে আপনার সমস্যা কোথায়? আপনার যদি টেকনিক্যাল যোগ্যতা থাকে, তাহলে সে সব ভিডিও ক্লিপকে এডিট করে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে পারেন। তাকে সাইফুল্লাহ মানছুর তো কোন আপত্তি করছেন না। দ্বীনের প্রচার যদি উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট ভিডিওর নিচে লাইক এবং শেয়ার বটন রয়েছে। আপনি শেয়ার করতে পারেন। কিন্তু আপনি কেন তার ভিডিওকে ডাউনলোড করে নিজের নামে চালাবেন? তাতো নৈতিক নয়। দ্বীনের প্রচারে আপনি আমি অনৈতিক পন্থা গ্রহণ করতে পারিনা, এর ইখতিয়ার আমাদের নাই।

সাইফুল্লাহ মানছুরকে অনুরোধ করবোঃ কপি রাইট ক্লেইম করার কারণে যে সব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, তা উল্লেখ করে আপনি কিছু লিখবেন।

সাইফুল্লাহ মানছুরের মাধ্যমে আল্লামা সাঈদীর তাফসীর ও ইসলামী সংস্কৃতির ডকুমেন্টারীর যে আর্কাইভ গড়ে উঠেছে, তা যুগ যুগ ধরে অব্যাহত থাকুক এই প্রত্যাশা করছি।

Post a Comment

1 Comments

imranul said…
যেহেতু উনি এতো এতো শ্রম ঘাম দিয়েছেন, ইনভেস্ট করেছেন,এবং শুরু থেকে উনি স্বয়ং নিজে আল্লামার মাহফিলের অডিও, ভিডিও গুলো সংক্ষন করেছেন, উনি কপিরাইট করে রাখতে পারেন,কপিরাইট করে রাখাটাই উনার পক্ষে যৌক্তিক বলে আমি মনে করি, আমাদের যদি ভালো লাগে তাহলে হয়তো আমরা কমেন্টে করবো আর না হয় শেয়ার করবো,,এতে করে একজনের প্রতি আর বে-ইনসাফি হবে না, হক নষ্ট হবে না,
ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে।