বই নোটঃ
ইসলামে শক্তির উৎস-সাইয়েদ
আবুল আ’লা মওদূদী
গ্রন্থ পরিচিতি
§ বইটির লেখকঃ
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রাহ.
§ বইটি ৩ অংশে
বিস্তৃতি।
১. গ্রন্থ পরিচিতি-যাতে বইয়ের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে।
২. প্রথম খন্ডঃ যাতে মাওলানা মওদূদীর ইসলামে শক্তির উৎস
প্রবন্ধটি ৭টি অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে।
৩. দ্বিতীয় খন্ডঃ যাতে মাওলানা মওদূদী রহ. এর ১৯৬৭ সালের
একটি ভাষন উদৃত করা হয়েছে-যেন পাঠকরা মাওলানার চিন্তাগত সাদৃশ্য উপলব্দি করতে
পারেন।
§ গ্রন্থ পরিচিতির
শুরুতে মাওলানা মওদূদীর সাংবাদিকতার ইতিহাস উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছেঃ
o
১৯২০ সালে মাওলানা তাজ পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন।
o
১৯২১-২৩ সাল মাওলানা মুসলিম পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন।
o
১৯২৫ সালে মাওলানা আল জমিয়ত পত্রিকার সম্পাদক।
§ বই সম্পর্কে বলা
হয়েছেঃ
o
মওলানা মওদূদী রাহ. বইটি লিখেন ১৯২৫
সালে জুলাই ও আগষ্ট মাসে। তখন তার বয়স ছিল ২২ বছর। তখন তিনি আল জমিয়ত পত্রিকার
সম্পাদক।
o
সেই সময়ে “ইসলামে শক্তির উৎস” শিরোনামে নিবন্ধ আকাঁরে
লেখাটি প্রকাশিত হয় আল জমিয়ত পত্রিকায়।
o
১৯৬৯ সালে ঐ লেখা গুলো বই আকাঁরে প্রকাশ করা হয়।
§ বই সম্পর্কে বলা
আরো বলা হয়েছেঃ
o
“আল জিহাদ ফিল ইসলাম” মাওলানার
প্রথম বই হিসাবে প্রসিদ্ধ। যা ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়। ছাপার অক্ষরে প্রথম প্রকাশিত
হয়নি বলে ইসলামে শক্তির উৎস প্রথম প্রকাশিত বই নয়। কিন্তু মাওলানার প্রথম রচিত বই
এটি।
o
আল জিহাদ ফিল ইসলাম-প্রকাশিত হয় স্বামী শ্রদ্ধানন্দের আকস্মিক হত্যাকান্ডের পর,
যখন মুসলমানদেরকে নরহত্যার প্রেরণা দানকারী রূপে অভিযুক্ত করার
প্রবণতা দেখা দেয়। যাতে মাওলানা জিহাদের বস্তুনিষ্ট ব্যাখা প্রদান করেন।
o
ইসলামে শক্তির উৎস-লেখা হয় স্বামী শ্রদ্ধানন্দের আন্দোলন
কিভাবে মোকাবেলা করা যায়? তার জবাব হিসাবে।
(পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ঊনবিংশ শতক জুড়ে হিন্দু সমাজের ব্যাপাক ভাঙন দেখা দেয়। এই অবস্থা থেকে হিন্দু সমাজকে বাঁচাতে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে অহিন্দু ও ধর্মান্তরিত হিন্দুকে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনার জন্য যে আন্দোলন শুরু করেন, তা শুদ্ধি আন্দোলন নামে পরিচিত।)
§ সবশেষে বলা
হয়েছেঃ
o
ইসলামে শক্তির উৎস বই খানা থেকে মাওলানার চিন্তাগত সাদৃশ্য
ভেসে উঠে। অর্ধশতাব্দি পরে প্রদান করা তার বক্তব্য ও লিখনি এবং আগের লিখনীতে
চিন্তাগত কোন পার্থক্য পাওয়া যায়না। এর তার প্রমাণ হিসাবে ১৯৬৭ সালে তার প্রদত্ত
একটি ভাষণ বইটিতে উদৃত হয়েছে।
প্রথম খণ্ড
একঃ
মুসলিম জাতির প্রচার ধর্মী
চরিত্র
§ ভারত বর্ষের
মুসলমানদের মাঝে ইসলাম প্রচারের একটা জাগরণ বা উদ্দীনপনা সৃষ্টি হয়েছে। আর এর কারণ, কিছু কিছু নও মুসলিমদের মাঝে ইসলাম ত্যাগের
প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
§ এই জাগরণ আর
উদ্দীপনার অংশ হিসাবে তারা কি করছেন?
o
সংগঠন সমূহ দ্বীনের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেছে।
o
পত্র-পত্রিকায় দ্বীনি দাওয়াতের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা হচ্ছে।
o
সেমিনার সিম্পোজিয়াম হচ্ছে, যাতে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য আমাদের
কি কি উপায়-উপকরণ ও সুযোগ-সামর্থ আছে ইত্যাদি আলোচিত হচ্ছে।
§ এই জাগরণ ও
উদ্দীপনাকে আমরা তলিয়ে দেখলে জানতে পারবো যে, আমরা অতীতের মুসলমানদের ন্যায় তাবলিগী প্রেরণা ও উদ্দীপনার
সম্পর্কে অবগত নই।
o
অতীতের মুসলমানদের যে তাবলিগি প্রেরণা ছিল, তা ইসলামকে সর্বব্যাপী বিজয়, কর্তৃত্ব ও পরাক্রমমের হাতিয়ার ছিল।
o
অতীতের মুসলমানদের সেই প্রেরণা আর উদ্দীপনা যদি আমাদের মাঝে
থাকতো, তাহলে আমাদের এই
সাংগঠনিক তত্পরতা, পত্র পত্রিকায় লেখালেখি আর সেমিনার
সিম্পোজিয়াম ইত্যাদির প্রয়োজন দেখা দিত না।
o
অতীতের মুসলমানদের সেই প্রেরণা আমাদের মাঝে থাকলে ইসলামের
শত্রুদের শত্রুতার মোকাবেলায় আমরা আমাদের কপালে করাঘাত করার প্রয়োজন হতো না, বরং আমাদের শক্তি দেখে তারা দিশেহারা হয়ে
পড়তো।
§ ইসলাম ধর্মের
সাংগঠনিক উপদান গুলো একটা অপরিহার্য উপাদান ছিলঃ
১. সত্য ও ন্যায়ের দিকে আহবান জানানো।
২. আল্লাহর বাণীকে তার বান্দাদের কাছে পৌছে দেয়া।
§ ইতিহাস বলে,
ইসলামের অনুসারীরা সত্য দ্বীনের প্রচারের এই কাজ এক শতাব্দির মধ্যে আটলান্টিক
উপকূল থেকে ভূ-মধ্যসাগর উপকূল পর্যন্ত সম্পাদন করেছিলেন।
§ স্বভাবতই প্রশ্ন
জাগেঃ মুসলমানরা সত্য দ্বীনের অনুসরণ করছেন, না বনী ইসরাঈলের মতো নবীর ইনতিকালের
পর নতুন কোন ধর্ম বানিয়ে নিলেন।
§ বর্তমানে ইসলাম
প্রচারের সংকল্প, দল, সংগঠন প্রচারণা সোচ্চার। আমাদের তৎপরতা খৃষ্টানদের ন্যায়।
আমরা মিশনারী বানাতে ব্যস্ত, ইসলাম প্রচারের শ্লোগানে ব্যস্ত, সভা সমিতি হৈ
হোল্লোড় ইত্যাদিতে ব্যস্ত। কিন্তু এই
পদ্ধতি সাফল্যের চাবিকাঠি নয়। যদি হতো, তাহলে আমরা আমাদের পূর্ববর্তীদের চেয়ে আরো
উন্নতি করতে পারতাম।
§ বাস্তব ক্ষেত্রে
এতো এতো প্রস্তুতির পরও আমরা শুধু পিছনের দিকে যাচ্ছি।
§ আমাদের
পূর্বসূরী যারা দাওয়ার কাজ করেছেন, তাদের এতো উপায়-উপকরণ-প্রস্তুতি ছিল না। কিন্তু
সফল হয়েছিলেন। যার বদৌলতে আজ পৃথিবীর কোনায় কোনায় মুসলমান বর্তমান। সেই সময়ের
হিসাব অনুযায়ী ভারতে ৭ কোটি মুসলমান বাস করছে।
§ এমন পরিস্থিতে
আমাদের ভাবতে হবেঃ আমাদের পূর্বসূরীরা কোন উপায় উপকরণ না থাকার পরও কিভাবে সাফল্য
লাভ করলেন? আর আমাদের কিসের অভাব? ইসলাম প্রচারের মূল রহস্যটি কি?
§ মুসলমানদের মাঝে
দৃশ্যমান দূর্বলতার কারণ হচ্ছে, মুসলমানদের মধ্য থেকে ইসলামের প্রাণ শক্তি বেরিয়ে
গেছে। মুসলমানরা ভূলে গেছে, তারা কি মর্যাদার অধিকারী। মুসলাম যদি তার জীবনের
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জেনে নেয় এবং ইসলামকে ভালভাবে উপলব্দি করতে পারে, তাহলে ইসলাম
প্রচারের সমস্যা আপনা আপনি হয়ে যাবে। এর জন্য এতো হই হুল্লোড়, সভা সমাবেশ, সংগঠন
ইত্যাদির প্রয়োজন হবে না।
মুসলমানদের জীবনের উদ্দেশ্য
§ মাক্স মুলার
নামক একজন অধ্যাপক। তিনি বলেছেনঃ ইসলাম মূলতঃ একটি প্রচারমূলক ধর্ম। তাবলীগ বা
প্রচারের উপরই এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। প্রচারের বলেই তার অগ্রগতি ও বিকাশ সাধিত
হয়েছে এবং প্রচারের উপরই তার অস্তিত্ব নির্ভরশীল।
§ ইসলাম মানেই
হলোঃ হকের প্রতি দাওয়াত দেয়া আর মুসলমানদের জীবনের উদ্দেশ্য হলোঃ সৎকাজের আদেশ
দেয়া এবং অসৎকাজের নিষেধ করা-এই কথাটা স্পষ্ট হয়ে উঠে ইসলামের শিক্ষা আর উপদেশে সমূহ অনুশীলন করলে।
§ এই বিষয়টা সুস্পষ্ট করার জন্য কুরআনে হাকীমের ৫টি আয়াত রেফারেন্স হিসাবে উদৃত
হয়েছে। সূরা আলে ইমরান-১১০, ১০৪, সূরা আন নাহল-১২৫, সূরা ক্বাফ-৪৫, সূরা আল গাফিশয়া-২১ যাতে
মুসলমানদের জীবনের উদ্দেশ্য, পৃথিবীর জন্য মুসলমানদের অস্তিত্বের প্রয়োজনীতা
ইত্যাদি বারবার নির্দেশ করা হয়েছে।
§ আলোচ্য আয়াত গুলো নিম্নরূপ:
“তোমাদের দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম জাতি করে সৃষ্টি করা হয়েছে যেন তোমরা মানুষকে
সৎকাজের নির্দেশ দান কর ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখ এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখ”-(সূরা আলে ইমরানঃ ১১০) |
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ ۗ وَلَوْ آمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْرًا لَّهُم ۚ مِّنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ |
“তোমাদের মধ্য হতে এমন
একটি গোষ্ঠী তৈরী হওয়া চাই যারা কেবল কল্যাণের দিকে আহবান জানাবে, সৎকাজের নির্দেশ দেবে এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখবে”।–(সূরা আলে ইমরানঃ ১০৪) |
وَلتَكُن مِنكُم أُمَّةٌ يَدعونَ إِلَى الخَيرِ وَيَأمُرونَ بِالمَعروفِ وَيَنهَونَ عَنِ المُنكَرِ ۚ وَأُولٰئِكَ هُمُ المُفلِحونَ |
“তোমার প্রতিপালকের পথের
দিকে মানুষকে আহবান জানাও কুশলতা ও সদুপদেশ সহকারে”। -(সূরা আন নাহলঃ ১২৫) |
ادعُ إِلىٰ سَبيلِ رَبِّكَ بِالحِكمَةِ وَالمَوعِظَةِ الحَسَنَةِ ۖ وَجٰدِلهُم بِالَّتى هِىَ أَحسَنُ ۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبيلِهِ ۖ وَهُوَ أَعلَمُ بِالمُهتَدينَ |
“কুরআনের সাহায্যে সেই
ব্যি্তিকে উদ্দীপিত কর যে আমার হুশিয়ারীতে ভীত হয়”। -(সূরা ক্বাফঃ ৪৫) |
فَذَكِّر بِالقُرءانِ مَن يَخافُ وَعيدِ |
“আপনি উদ্দীপিত করুন।
উদ্দীপিত করা ছাড়া আপনার আর কোনো দায়িত্ব নেই”। -(সূরা আল গাশিয়াঃ ২১) |
فَذَكِّر إِنَّما أَنتَ مُذَكِّرٌ |
§ ইসলামের এই সব
শিক্ষার রাসূল সা. এর জীবনে ছিল প্রবল।
§ ইসলামের এই সব
শিক্ষা সাহাবায়ে কিরামের জীবনে এনেছিল সর্বাত্মক বিপ্লব। সাহাবায়ে কিরামের পুরো
জীবন ছিল দাওয়াত আর তাবলিগ। তাদের চলাফেরা, উঠাবসা-সকল কাজের লক্ষবস্তু ছিল মানুষকে
দাওয়াত দেয়া, সিরাতুল মুসতাকিম দেখানো।
§ মুসলমানরা যতদিন
কুরআন সুন্নাহর এই শিক্ষা অনুযায়ী চলেছে, ততদিন তারা ছিল প্রচারক ও মুবাল্লিগ।
§ মুসলমানরা এই
দাওয়াতের কাজ করতে গিয়ে দুনিয়ার সকল কাজ থেকে নিজেদের গুঠিয়ে নেননি। বরং তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকলা, কৃষি,
রাষ্ট্র পরিচালনা এবং দুনিয়ার সকল কাজ করেছেন। কিন্তু সকল সব সময়
তাদের প্রেরণা ও চেতনায় ছিল একটি বস্তু। আর তাহলো, ইসলাম নামক যে নিয়ামত আল্লাহ
দিয়েছেন, তা পুরো মানব জাতির নিকট পৌছে দেয়া।
§ সাহাবায়ে
কিরামকে ইসলামকে দুনিয়াবাসীর জন্য উপাদেয় ও উত্তম নিয়ামত মনে করতেন আর এই নিয়ামতকে
সকল মানুষের কাছে পৌছানো ঈমানী দায়িত্ব বলে মনে করতেন। ফলে তারা যেখানে যে অবসথায়
থাকতেন সে অবস্থায় এই নিয়ামত পৌছানোর কাজ করতোন। যেমন:
o সওদাগর ও
ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায়ী কাজকর্ম ও লেনদেনের সময়।
o
পর্যটকরা তাদের পর্যটনের ভেতর দিয়ে।
o
কয়েদীরা জেলখানার অভ্যন্তরে।
o চাকুরেরা অফিসে।
o
কৃষকরা খেত-খামারে।
o
মহিলারা পর্যন্ত অত্যন্ত আগ্রহ ও উদ্দীপনার সাথে ইসলাম
প্রচার করেছেন।
ইসলামের শক্তির আসল উৎস
§ ইসলামের শক্তির
মূল উৎস ছিল প্রচার উদ্দীপনা। ১৯২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীর ৪০ কোটি মুসলমানের
অবস্থান এবং নানাবিধ জাতি, বর্ণ, বংশ ও দেশে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে ইসলামের
অবস্থান-তার সবই মুসলমানদের দায়ী চরিত্রের ফসল।
§ ইসলামের শত্রুরা
বলে ইসলাম বিস্তৃত হয়েছে তরবারীর সাহায্যে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয়, ইসলাম বিস্তার
লাভ করেছে তাবলীগ বা প্রচারের মাধ্যমে।
§ তরবারীর মাধ্যমে
যেখানে বিজয় এসেছে, সেখানে তরবারীর আঘাতে নি:শেষ হয়েছে।
§ ইতিহাস বলে, যেখানে তরবারীর মাধ্যমে বল প্রয়োগ করে
মুসলমানরা পরাজিত হয়েছে, সেখানে দাওয়াতের অস্ত্র প্রয়োজন করে
মুসলমানরা বিজয়ী হয়েছে। যেমন:
o
একদিকে বাগদাদে মুসলমানদের হত্যাকান্ড চলছিল, সেই সময়ে সুমাত্রায় ইসলামী হুকুমাত কায়েম
হচ্ছিল।
o
কর্ডোভা থেকে নির্বাসিত যখন হচ্ছিল, তখন জাভায় ইসলামের পতাকা উডডীন হচ্ছিল।
o
সিলিলিতে যখন ইসলাম খতমের অভিযান চলছিল, জাভায় তখন ইসলাম নতুন জীবনী শক্তি লাভ
করছিল।
o
একদিকে তাতারীরা ইসলামের গলায় ছুরি চালাচ্ছিল, অন্যদিকে মুবাল্লিগরা তাতারীদের হৃদয় জয়
করে নিচ্ছির।
o
তুর্কীরা যখন ইসলামের দাসত্বে জিঞ্জির পরাচ্ছিল, তখন তারা নিজেদের মনকে ইসলামের গোলামীর
জন্য পেশ করছিল।
§ ইতিহাস বলে
যেখানে সামরিক শক্তি দেয়ে ইসলামের বিজয় করা হয়েছিল, তা পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ধ্বংস হয়ে গেছে।
যেমন: স্পেন, সিসিলি, গ্রীস।
§ ইতিহাস আরো বলে, যেখানে দাওয়াতের অস্ত্রের মাধ্যমে বিজয়
অর্জিত হয়েছিল, সেখানে ইসলাম যথার্থ ভাবে বিদ্যমান রয়েছে।
যেমন: আফ্রিকা, জাভা, সুমাত্রা, চীন, মালয়।
§ প্রশ্ন: এই সব প্রচার কি মিশনারী সমিতি দ্বারা
হয়েছিল, হৈ-হোল্লড দ্বারা হয়েছিল,
মিডিয়া বা পত্রিকায় আলোচনার মাধ্যমে হয়েছিল। প্রকৃত পক্ষে আমরা কি
খৃষ্টান মিশনারীদের অনুকরণ করছি না?
§ ইসলামে শক্তির
উত্স নিবন্ধে সেই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
দুইঃ
ইসলাম কিভাবে প্রচারিত
হয়েছিল
§ ইতিহাসের
পর্যালোচনায় জানা যায়, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে তিনটি জিনিস কাজ করেছে:
১. ইসলামের সহজ ও
সরল আকীদা-বিশ্বাস ও তার আকর্ষণীয় ইবাদত। যা বিবেক ও বুদ্ধিভিত্তিক আহবান।
২. মুসলমানদের
জীবনে ইসলামের শিক্ষা, উপদেশ ও অনুশাসনের প্রভাব। যা আবেগ ও উদ্দীপনা
জাগ্রতকারী প্ররণা জোগায়।
৩. মুসলমানদের
জীবনের ইসলামের প্রচার মুখী চরিত্র। যা একজন স্নেহময় নেতা ও মুরব্বীর মত ভ্রান্ত ও
পথভ্রস্ট মানুষদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।
§ উদাহরণ:
১. কোন পণ্য ভাল
হলেই তার ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়না বা তা ব্যাপক প্রসার লাভ করেনা। বরং পণ্যের
উপকারিতা ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে মার্কেটিং করতে হয়। কিছু লোক বাজারে গিয়ে
ক্রেতাদেরকে তা বুঝাতে হয়। বিজ্ঞাপন দিতে হয়।
২. শুধু মার্কেটিং
করলে বা বিজ্ঞাপন দিলেই হয়না, বরং কিছু গ্রাহক এমন লাগে, যারা পণ্য ব্যবহার করে তার
উপকারিতা সম্পর্কে বাস্তব সাক্ষী হয়।
§ উদাহরণের শিক্ষা:
একই ভাবে
ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য উপরোক্ত তিনটি জিনিস সমান ভাবে থাকতে হবে। যখনই
কোন একটি জিনিসের অভাব হবে, তখনই ইসলামের প্রচার প্রসারে ভাটা পড়বে।
§ উপরোক্ত তিনটি
জিনিস কিভাবে ভূমিকা রাখে, তার কয়েকটি একত্র হলে কি ফলাফল দেখা দেয়, তার জন্য
প্রয়োজন বিস্তারিত আলোচনা।
ইসলামী আকায়েদের সহজবোধ্যতা ও
মানব-প্রকৃতির সাথে তার সামঞ্জস্য
§ ইসলামী আকীদাতে
কোন দার্শনিক জটিলতা নাই, নাই কোন কুসংস্কার বা অলীক কল্পনা, নাই অবাস্তব কোন
কথাবার্তা। বরং ইসলামী আকীদা সহজ, হৃদয়গ্রাহী। তাই অতি
সাধারণ মানুষেও তা মেনে নিতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
§ ইসলাম যে সব
মূলনীতি পেশ করে তা সহজ সরল, যা সকল স্তরের বুদ্ধিবৃত্তির কাছে গ্রহণযোগ্য। মূলনীতি গুলোর এমন প্রভাব
যে, এগুলো গ্রহণ করলে মানুষের মাঝে আমুল পরিবর্তন অনুভূত হয়।
আকীদা সমূহের বৈশিষ্ট্য হলো, তা স্পষ্ট, বলিষ্ট, তাকে নেই কোন দ্বিধা-দ্বন্দ।
যেমন:
o
আল্লাহ সম্পর্কে আকীদা হলো: আল্লাহ একজন-এতে দ্বিত্বের
কোন অবকাশ নাই, তাঁর কোন সাহায্যকারীর প্রয়োজন হয়না, তিনি সর্বশক্তিমান, তিনি পিতা এবং
জাত থেকে মুক্ত ও পবিত্র, তার সাথে কোন তুলনা চলেনা, মানব সুলভ দূর্বলতা থেকে তিনি
মুক্ত, তিনি ছাড়া আকাশ ও পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যার কাছে মানুষ সাহায্য চাইতে পারে, উপাসনার উপযুক্ত
কেবল তিনিই।
“তোমাদের খোদা, একই খোদা”। (সূরা আল আম্বিয়াঃ ১০৮) |
أَنَّما إِلٰهُكُم إِلٰهٌ وٰحِدٌ ۖ فَهَل أَنتُم مُسلِمونَ |
“তোমরা দুই খোদা গ্রহণ করো না”। (সূরা আন নাহলঃ ৫১) |
لا تَتَّخِذوا إِلٰهَينِ اثنَينِ ۖ |
“নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান”। (বাকারাঃ ২০) |
إِنَّ اللَّهَ عَلىٰ كُلِّ شَيءٍ قَديرٌ |
“আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন”। (সূরা ইবরাহীমঃ২৭) |
وَيَفعَلُ اللَّهُ ما يَشاءُ |
“নিজের ইচ্ছা মতই তিনি সিদ্ধান্ত করেন”। (সূরা আল মায়েদাঃ১) |
يَحكُمُ ما يُريدُ |
“তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তিনি জাতও নন। তাঁর সমতুল্য কেউ নেই”। (সূরা ইখলাসঃ ৩-৪) |
لَم يَلِد وَلَم يولَد ০ وَلَم يَكُن لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ০ |
“তিনি চিরঞ্জীব চিরস্থায়ী, ঘুম ও তন্দ্রা তাকে স্পর্শ করে না”। (সূরা বাকারাঃ২৫৫) |
الحَىُّ القَيّومُ ۚ لا تَأخُذُهُ سِنَةٌ وَلا نَومٌ |
“তুমি কি জান না যে, আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত কর্তৃত্ব একমাত্র
আল্লাহর? বস্তুত তোমাদের জন্য তিনি ছাড়া আর কোনো
অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই”। (সূরা আল বাকারাঃ ১০৭) |
أَلَم تَعلَم أَنَّ اللَّهَ لَهُ مُلكُ السَّمٰوٰتِ وَالأَرضِ ۗ وَما لَكُم مِن دونِ اللَّهِ مِن وَلِىٍّ وَلا نَصيرٍ |
“পূর্ণ আনুগত্য আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে তাঁর উপাসনা করা”। (সূরা আল যুমার-১১) |
أَعبُدَ اللَّهَ مُخلِصًا لَهُ الدّينَ |
o
রাসূল সা. সম্পর্কে
আক্বীদা হলো: রাসূলকে কোন রকমের খোদায়ীর অংশীদার রাখা হয়নি। বলা
হয়েছে: রাসূল মানুষ ছিলৈন, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের নিকট নিজের বক্তব্য পৌছানোর
জন্য একজন মানুষকে রাসূল হিসাবে নির্বাচন করেছেন মাত্র। পৃথিবীর সকল জাতির কাছে এই
ধরণের রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে।
إِنَّما أَنا۠
بَشَرٌ
مِثلُكُم
يوحىٰ
إِلَىَّ
“আমি
তোমাদের মতই মানুষ। কেবল আমার নিকট ‘ওহি’ প্রেরণ করা হয়”। -(সূরা আল কাহাফঃ ১১০)
وَلِكُلِّ قَومٍ
هادٍ
“প্রত্যেক জাতির জন্য হেদায়েতকারী রয়েছে”।–(সূরা আর রা’দঃ ৭)
o
মানুষের দুনিয়ার কাজকর্ম সম্পর্কে
বক্তব্য হচ্ছে: দুনিয়ায় মানুষের কাজ, দায়িত্ব ও ফলাফল নিয়ে ইসলাম
পরিস্কার কথা বলেছে। বলা হয়েছে, নিজ নিজ কাজের জন্য নিজেরাই দায়ী হবে, যেমন কর্ম তেমন
ফল ভোগ করতে হবে।
فَمَن يَعمَل
مِثقالَ
ذَرَّةٍ
خَيرًا
يَرَهُ ০ وَمَن يَعمَل مِثقالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ
“যে ব্যক্তি কণা পরিমাণও ভালো কাজ করবে সে
তাঁর প্রতিদান পাবে আর যে ব্যক্তি কণা পরিমাণও খারাপ কাজ করবে সে তাঁর প্রতিফল
পাবে”। -(সূরা যিলযালঃ ৭-৮)
o
আখেরাত সম্পর্কে আক্বীদা: ইসলাম আখেরাত
সম্পর্কে সহজ করে বলে দিয়েছে যে, মানুষের বর্তমান কর্মস্থল শেষে তাকে পরবর্তী এই
জীবনের কর্মফল ভোগ করার জন্য আরেকটি জীবনে যেতে হবে-সেই জীবনটাই প্রকৃত জীবন। এক্ষেত্রে বৌদ্ধ, হিন্দু বা জড়বাদের দূর্বোধ্য মুক্তি মতবাদ, জটিল ও পেঁচালো
পুনর্জন্মবাদ বা পূর্ণ বিনাশবাদের অবকাশ যাপনের কোন মন্ত্রের উপস্থাপন করা হয়নি।
§ উপরোক্ত
আকীদাগুলো সহজ ও সরল, বিধায় মানবীয় বিবেক-বুদ্ধি তা অনায়াসে গ্রহণ করে।
§ ইসলামের দায়ী
যারা তা এমন কিছু বলেননি, যা সাধারণ বিবেক-বুদ্ধি বুঝতে অক্ষম।
§ ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে ফরাসী দার্শনিক অধ্যাপক
মন্টেইন-এ উক্তি:
“এত সহজ ও স্পষ্ট যে আকীদা,
যে আকীদা
দার্শনিক জটিলতা থেকে এতটা মুক্ত এবং সাধারণ বিবেক-বুদ্ধির পক্ষে এতটা অনায়াসে
অনুধাবনযোগ্য, তাতে মানব জাতির মন-মগজে বশীভূত করার এক অভাবনীয় ও বিস্ময়কর
শক্তি থাকার কথা এবং বাস্তবিকপক্ষে তার সে শক্তি আছে”।
§ ইসলামের আকীদা
সমূহ মানুষের মন-মগজের
প্রভাব ফেলে। যা আফ্রিকার গারা উপজাতির ক্রীতদাসের বক্তব্যে প্রমাণিত হয়। তার
প্রতি প্রশ্ন ছিল: যারা তোমাকে এভাবে বিনা অধিকারে ধরে এনে
জানোয়ারের মত বিক্রি করে দিলো তাদের প্রতি তোমার কি রাগ হয় না? তিনি তার উত্তরে বলেন-
“হ্যাঁ,
স্বাভাবিকভাবেই
তাদের প্রতি আমার রাগ হয়। তবে একটি জিনিস আমার ক্ষতিপূরণ করে দিয়েছে। সেটা হলো,
আমি তাদের
কারণেই কুফরীর অন্ধত্ব থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছি। আমি যে এই দেশে আসতে পেরেছি এবং আমি
যে ইসলামের মত অপূর্ব নেয়ামত অর্জন করতে পেরেছি,
একে আমি আল্লাহর
অনুগ্রহ মনে করি। বিশ্বাস করুন, ঈমানে যে স্বাদ,
যে মধুরতা,
তার চেয়ে বড়
স্বাদ ও মধুরতা আর কোনো বস্তুতেই নেই। এ মধুরতাকে কেবল হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়।
ভাষা দিয়ে তা ব্যক্ত করা যায় না”।
ইসলাম ইবাদাতের চিত্তাকর্ষতা
§ ইসলামী
ইবাদাতগুলো চিত্তাকর্ষক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। যার দ্বারা কোন মন প্রভাবিত না হয়ে
পারেনা।
§ আলেকজান্দ্রিয়ার
জনৈক ইহুদী ধর্মত্যাগী নও মুসলিম লিখেছেনঃ
“আমি শুধু মুসলমানদের ইবাদাত দেখে মুসলমান
হয়েছি। একবার আমি জামে মসজিদে নামাযের দৃশ্য দেখতে গিয়েছিলাম। সর্বপ্রথম যে
জিনিসটি আমার মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে তাহরো খুতবা। খুতবার প্রতিটি শব্দ আমার
মনকে প্রভাবিত করছিল। বিশেষত খতবি যখন বললেনঃ
إِنَّ اللَّهَ يَأمُرُ بِالعَدلِ وَالإِحسٰنِ وَإيتائِ ذِى القُربىٰ وَيَنهىٰ عَنِ الفَحشاءِ وَالمُنكَرِ وَالبَغىِ
“নিশ্চয়ই আল্রাহ ন্যায় বিচার,
সদাচার ও আত্মীয়
স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন আর অশ্লীলতা, অন্যায় ও ব্যভিচার থেকে বিরত থাকতে বলেন”। (সূরা আন নাহলঃ ৯০)
খতীবের মুখে একথা শুনে আমার মন এ ধর্মের
প্রতি অপরিসীম শ্রদ্দায় ভরে উঠরো যার খোদা এমন উচ্চাংগের নীতি শিক্ষা দেন। এরপর
যখন নামাজ শুরু হলো এবং মুসলমানরা কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল তখন আমার মনে হলো যেন,
এরা সব ফেরেশতা
দাঁড়িয়েছে আর আল্লাহ যেন খোলাখুলি-ভাবে তাদের সামনে দেখা দিয়েছেন। আমার মন বলে
উঠলো, বনী ইসরাঈলের সাথে তো আল্লাদ দু’বার কথা বলেছেন,
আর এ জাতির সাথে
তিনি প্রতিদিন পাঁচবার করে কথা বলেন।“
§ নামায হলো এমন এক ইবাদত, যা পালনের জন্য অন্য ধর্মের মতো পাদ্রী-পুরোহিতের প্রয়োজন যেমন পড়েনা, তেমনী গির্জা বা
মন্দিরে যাওয়ারও বাধ্যবাধকতা নেই। বরং যে মুসলমান সেই ইমাম, আর
পৃথিবীর সকল জায়গাই নামাযের স্থান, পদ, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে এক কাতারে অদৃশ্য খোদার তরে
পরম ভক্তি শ্রদ্ধার সাথে, যা দেখে পাশান হৃদয়ও গলে যায়।
§ পাদ্রী লেফরদের
আলেমদের একটি বাহাসের উল্লেখ করে পাদ্রী তার Mankind and Church গ্রন্থে লিখেছেনঃ “মুসলমানদের এ ইবাদাত দেখে কেউই প্রভাবিত
না হয়ে পারে না। মুসলমান যেখানে যে অবস্থায় থাক না কেন –রাস্তায় হাটুক,
রেলষ্টেশনে
দাঁড়িয়ে থাক, দোকানে বসে থাক, কিংবা মাঠে বিচরণ করুক,
আযান হওয়া
মাত্রই সব কাজ ছেড়ে দিয়ে এক খোদার সামনে আনত মস্তকে দাঁড়িয়ে যায়। এ দৃশ্য মানুষের
মনে ছাপ না রেখে যায় না। বিশেষতঃ দিল্লীর জামে মসজিদে জুমায়াতুল বিদার নামাযে
পনেরো বিশ হাজার মুসলশানকে পরম বিনয়, নিষ্ঠা ও পূর্ণ নীরবতার সাথে নামায পড়তে
যে ব্যক্তি দেখেছে সে ঐ দৃশ্য দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারে না। ইসলামের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে যে শক্তি নিহিত রয়েছে,
এ দৃশ্য দেখে তা
বেশ অনুভব করা যায়। এছাড়া মুসলমানদের প্রত্যহ পাঁচবার নিয়মিত নামায পড়া এবং চরম
শোরগোলের মধ্যেও ধীরস্থিরভাবে নিজ দায়িথ্ব পালন করার এ ধারাবাহিকতার মধ্যে এক
বিশেষ আবেদন রয়েছে”।
মুসলমানদের জীবনে ইসলামের
অনুশাসনের প্রভাব
§ মুসলমাদের
ইসলামী জীবন-বিষয়টা
আকায়েদ ও ইবাদতের পর সবচেয়ে কার্যকর বস্তু।
§ মানুষ ইসলামের
দিকে আকৃষ্ট হতো না, যদি না ইসলাম তার নীতি পেশ করার সাথে সাথে শিক্ষা ও অনুশাসনের বিপ্লবী
প্রভাব না থাকতো।
§ ইসলামের শিক্ষা
ও অনুশাসনের প্রভাবই মূলতঃ বিবর্জিত জাতিকে মানবতার উচ্চ স্তরে পৌছে দিয়েছিল।
§ ইসলাম নীতির
সাথে সাথে দৃষ্টান্ত পেশ করেছে। যা মানুষেকে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করেছে। যেমনঃ
১. আল্লাহর একত্ব, শক্তিমানত্ব এবং
তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করার পদ্ধিতিঃ এই মূলনীতি মুসলমানদেরকে
আত্মসম্ভ্রমী, ধৈর্যশীল, কৃতজ্ঞ, সহনশীল, স্বাতন্ত্রবোধ সম্পন্ন ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন করেছে।
২. আখেরাত বিষয়ক
শিক্ষাঃ এই মূলনীতি বীরত্ব, শৌর্য-বির্যের জন্ম দিয়েছে।
৩. তাকওয়ার
শিক্ষাঃ এই মূলনীতি ন্যায়পরায়ণতা ও নিঃস্বার্থতার গুনাবলী সৃষ্টি ও নেশা, চুরি ও
নৈতিক অপরাধ এড়িয়ে চলে ধর্মাবলম্বী হতে শিখিয়েছে।
৪. সাম্য ও
ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষাঃ এই মূলনীতি গনতান্ত্রিক মূল্যবোধ সৃষ্টি, বর্ণ ও
বংশের ভেদাভেদ, ধনী-গরীবের মর্যাদাগত পার্থক্য এবং ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের গোঁড়ামীকে
ধ্বংস করেছে। নামায এক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে রয়েছে।
৫. তাছাড়া আরো উদাহরণ
হলোঃ
ক. জ্ঞানার্জন, সভ্যতা ও কৃষ্টি উন্নয়ন।
খ. মসজিদ নির্মান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, সামাজিক জীবন, সংগঠন,
ব্যবসা-বানিজ্য ও আর্থিক সচ্ছলতায় উৎকর্ষতা সাধন।
গ. নাইজেরিয়াঃ নাইজেরিয়ার জিন্নীনে বারবার-নাপিত শ্রেণীর লোকেরা ইসলাম গ্রহণ
করলে সেখানে প্রচুর আলিম তৈরী হয়। যেখান আলেমের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪শ।
ঘ. আরব, ভারত বর্ষ, মিশর ও স্পেনে বিষ্ময়কর প্রভাব।
ইসলামী সাম্যের প্রভাব
§ ইসলামের প্রচার
প্রসারে সবচেয়ে প্রভাবশালী জিনিসটা ছিল-সাম্য। ইসলামের সাম্য নামক বস্তুটি করুণা হয়ে এসেছিল সেই সব
জাতির জন্য, যারা রসম-রেওয়াজ আর
শক্তিধরদের স্বার্থপরতার দরুন নিচে থেকে নিচে নেমে যেত বাধ্য হয়েছি।
§ ইতিহাস বলেঃ
ইসলাম হাজার হাজার জাতিকে মানবেতন পর্যায় থেকে ইজ্জত সম্মানের উচ্চতর শিখরে পৌছে
দিয়েছিল।
§ সাম্য বিষয়ে
স্যার উউলিয়াম হান্টারের উক্তিঃ
“এসব দরিদ্র জেলে, শিকারী ও নিম্নশ্রেণীর কৃষকদের জন্য
ইসলাম একটি আসমানী করুণাধারা হয়ে বর্ষিত হয়েছিল। এটা শুধু শাসক জাতির ধর্মই ছিল না
বরং এতে এতটা সাম্য্ও ছিল যে, তারা এটা মেনে নিয়ে যে অভিজাত হিন্দুরা
তাদের ঘৃণা করতো তাদের চেয়েও লাভ করতে পারতো। এ কারণে ভারতবর্ষের সবচেয়ে সচ্ছল
প্রদেশটিতে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়েছিল। যদিও কোথাও কোথাও বলপ্রয়োগে ইসলাম
প্রচারের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও প্রকৃতপক্ষে শক্তি প্রয়োগ
মুখ্য ভূমিকা পারন করেনি বরং মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল তার নিজের গুণাবলী। ইসলাম
এদেশের মানুষের বিবেকের কাছে আবেদন জানিয়েছিল এবং তাদের সামনে মানবতার একটি উচ্চ
ধারণা পেশ করেছিল। ইসলাম মানবিক ভ্রাতৃত্বের এমন এক অপূর্ব নীতি প্রতিষ্ঠা করেছিল
যা তারা কখনো দেখেনি এবং মানুষে মানুষে ভেদাভেদের সমস্ত শৃঙ্খল সে ভেঙ্গে গুড়িয়ে
দিয়েছিল”।
§ সাম্যের মাধ্যমে
ইসলামের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এমন কিছু জাতির উদাহরণঃ
১. দক্ষিণ ভারতঃ যেখানে টিনাভেলী
অঞ্চলে সানার সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল-যাদেরকে নিচ সম্প্রদায় গন্য করা
হতো। তারা নিজেদের চেষ্টার মাধ্যমে হয়ে উঠি সাধারণ হিন্দুদের চেয়ে বিত্তশালী, শিক্ষিত এবং
সামাজিক। কিন্তু তাদেরকে নিচুই ভাবা হতো। তাদেরকে হিন্দুদের মন্দিরে প্রবেশে বাঁধা
দিয়ে মারধোর করা হয়। সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে ৬শ সানার ইসলাম কবুল করে। পরে বাকী সবাই
ইসলাম কবুল করে।
২. আফ্রিকার
নিগ্রোঃ যাদের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ ইসলাম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখে। মি. ব্লাইডেন এর
মতেঃ
“মুহাম্মদের অনুগামীরা যখনই শুনতে পায় যে,
একজন পৌত্তলিক
নিগ্রো ইসলাম গ্রহণে ইচ্ছুক, তখন সেই নিগ্রো যতই ইতর শ্রেণীর মানুষ
হোক না কেন, তাকে তৎক্ষণাৎ মুসলিম সমাজের একজন সমান মর্যাদাবান সদস্য
হিসাবে গ্রহণ করা হয় এবং শুধু তার মন জয় করার মানসেই নয় বরং সত্যি সত্যি ভাই মনে
করেই তাকে সমাদর করা হয়। ফলে সে অনুভব করতে পারে যে,
ইসলাম বাস্তবিকই
তার জন্য এক অপূর্ব নেয়ামত। বস্তুতঃ আফ্রিকায় ইসলাম যে খৃষ্টবাদের উপর প্রাধান্য
লাভ করেছে, তার প্রধান কারণ এটাই।
তিনঃ
ইসলাম প্রচারে সুফী সাধকদর
অবদান
§ ইতিপূর্বে
আলোচিত দুইটি অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছেঃ
১. মুসলমানরা কিভাবে
দাওয়াত দিচ্ছে এবং প্রকৃত পক্ষে কিভাবে দাওয়াত দেয়া উচিত।
২. ইসলামের আকীদাগত
প্রভাব এবং মুসলমানদের আমলী প্রভাব।
§ এই পর্যায়ে
আলোচিত হবে ইসলাম নামক পণ্যের ভাল দিকটা মানুষের কাছে কিভাবে পৌছানো হবে, সে সম্পর্কে।
§ পণ্যের ব্যাপারে
সাধারণ নিয়ম হলোঃ পণ্য ভাল হলেই বিক্রি হয় না, বরং বিক্রির জন্য প্রয়োজনে বিক্রেতার যোগ্যতা। পণ্যের ভাল
দিকটা উপস্থাপনে বিক্রেতার তৎপরতা, যোগ্যতা ও প্রচারক্ষমতার
উপর নির্ভরশীল।
§ ইসলাম যতই সত্য
ও ভাল হোক, তার প্রচার ও প্রসারের জন্য দায়ীদের প্রচারমূখী চরিত্রের অধিকারী হতে হবে।
ইসলাম প্রচারে তিনটি অপরিহার্য উপকরণের বাস্তব ও কার্যকর উপকরণ হলো প্রচারমূখী
চরিত্র।
মুসলমানদের প্রচার মুখী
চরিত্রের বিশ্বজনীন প্রসার
§ সেই সময়ের কথা, যখন চীনে কমুনিষ্ট সকরকার গঠিত হয়নি।
§ অতীতের মুসলমান
যারা ছিলেন, তাদের প্রচারমুখী চরিত্র ও কর্মতৎপরতা কেমন ছিল, তা
আমরা কল্পনাও করতে পারবো না।
§ অতীতে না গিয়ে
আমরা যদি বর্তমান যুগের মুসলমানদের কথা চিন্তা করি, তাহলে আফ্রিকা, চীন ও
মালয় দ্বীপপুঞ্জে মুসলমানদের যে তাবলিগী চরিত্র বিদ্যমান, তা
আমাদের ধারণার বাহিরে।
§ মুসলমানদের
দৈনিক কর্মসূচীর সবচেয়ে বড় কাজ ছিল ইসলামের মাহাত্ম বড়ত্ব মানুষের কাছে পৌছানো।
§ তাদের দিল ছিল
ইসলামের আলোতে ভাসানো। আর সেই দিলে পাথরে খোদাই করার মতো করে বিশ্বাস খোদাই করা
ছিল যে, তাদের জীবনের একমাত্র
উদ্দেশ্য মানুষেকে কল্যাণের দিকে ডাকা, সৎ কাজের আদেশ দেয়া
িএবং অসৎ কাজের নিষেধ করা।
§ তারা যেখানে
যেতেন সেখানে এই একই কাজ ছিল। এমনকি কুরাইশদের নির্যাতনে নির্যাতিত হয়ে হাবশায়
হিজরত করে সেখানে একই কাজ। মক্কা থেকে মদীনায় গিয়ে একই কাজ।
§ সাসানী, রোমান, সিরিয়া,
ইরাক, রোম সকল জায়গায় তারা একই দায়িত্ব পালন
করেছেন।
§ এমনকি যখন
হুকুমাত কায়েম হয়ে গেল, তখন তারা একই কাজ চালিয়ে গেলেন। আর তা অব্যাহত থাকলো আটলান্টিকের
তরঙ্গমালা থেকে চীনের পাহাড় পর্বত পেরিয়ে।
§ তাদের প্রচার
মুখী চরিত্রের কারণে তারা যখন বানিজ্যের জন্য দেশে দেশে বেড়িয়েছেন, তখনও সেই মিশন জারি থেকেছে। তা আফ্রিকার
মরুভূমি, কিংবা ভারতের শ্যামল উপত্যকা, অথবা আটলান্টিকের ভিতরের দ্বীপ, নতুবা ইউরোপের
শ্বেতাঙ্গদের জনপদ যেখানেই হোক না কেন।
§ ইসলাম প্রচারের
এই উদ্দীপনা কারাগারে কঠোর যন্ত্রণা ভোগের সময়ও অব্যাহত ছিল।
§ মৃত্যুদন্ড
প্রাপ্তির লগ্নেও তারা ইসলামের দাওয়াতী চরিত্র থেকে সরে যাননি। উদাহরণঃ বেলজিয়ামের
কঙ্গোতে পাদ্রীর ইসলাম গ্রহণ।
§ সাইযেদ মুজাদ্দিদ
সরহিন্দী রাহ, সম্রাজ জাহাঙীরের কারাগারে দুই বছর অতিবাহিত করেছেন ইসলাম প্রচার করে-যেখানে তার মুক্তির সময়ে কয়েক শো হিন্দু কায়েদী ইসলাম কবুল করে।
§ মাওলানা জাফর
থানেশ্বরী-যিনি
আন্দামানে নির্বাসিত হোন এবং সেখানে বহু মানুষকে মুসলাম বানিয়ে দেন।
§ ইউরোপে ইসলাম
ছড়িয়ে দেয়া হয় মাত্র একজন আলিমের মাধ্যমে-যিনি খৃষ্টানদের সাথে জিহাদে গ্রেফতার হোন। অল্পদিনে তিনি ১২
হাজার মানুষকে মুসলমান করেন।
§ হিজরী ৬ষ্ট শতকে
গোটা ইউরোপে ইসলাম পৌছে যায়।
ইসলাম প্রচারে মুসলিম নারী
§ মোগল হানদের হাত
থেকে মুসলিম নিধনের তরবারি ছিনিয়ে নিয়ে ইসলামের শৃংখল পরানোর পুরো কৃতিত্ব নারীরা।
যেমনঃ গাজান শাহের ভাই ওল জাতিভ খানকে মুসলমান বানিয়েছেন তার স্ত্রী। যিনি ইসলামী
সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
§ ইসলামের বড়
শত্রু চুগতাই বংশে ইসলাম প্রচার করেন হালাকু খানের স্ত্রী কোররাই। যা কারণে মুবারক
শাহ ও বাররাক শাহ মুসলমান হোন।
§ মুসলিম নারীরা
কাফেদের কর্তৃক দাসী হয়েছে, কিন্তু ইসলাম ছাড়েনি। তারা তাদের দাওয়াতী চরিত্র ভুলেনি।
§ আবিসিনিয়ায়
ইসলাম প্রচার করেন নারীরা।
ভারত বর্ষে ইসলাম প্রচারে
সুফী সাধকগণের অবদান
§ সুফী সাধকদের দল-যারা আল্লাহ দ্বীন প্রচার-প্রসারে ছিলেন সবচেয়ে সক্রিয়। কিন্তু আজকে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সুফী সাধকরা এব্যাপারে প্রায় নিষ্কৃয়।
§ এই অঞ্চলে
আউলিয়া ও সুফীগন যে দৃঢ়তা ও নিষ্ঠা নিয়ে ইসলামের নুর বিস্তার করেছেন, তাতে তাসাউফের প্রচারকারী বর্তমানদের গভীর
শিক্ষনীয় বিষয় ছিল। যেমনঃ
১. খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী রাহ.-রাজপুত।
২. খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী রাহ.-দিল্লী।
৩. ফরিদউদ্দিন গঞ্জে শাকার রাহ.-পাঞ্জাব।
৪. নিজামউদ্দিন মাহবুবে ইলাহী রাহ.-দিল্লী
৫. সাইয়েদ মুহাম্মদ গেসুদারাজ রাহ.
৬.
শেখ
বুরহানউদ্দীন রাহ.
৭.
শেখ জয়নুদ্দীন রাহ.
৮.
নিজামউদ্দীন রাহ.-দাক্ষিণাত্যে।
৯.
শাহ কলিমুল্লাহ জাহান আবাদী রাহ.-দিল্লী।
১০.
সাইয়েদ ইসমাঈল বুখারী রাহ.- যিনি হিজরী ৫ম শতকে লাহোরে আগমন করন।
১১.
বাহাউল হক জাকারিয়া মুলতানী-পশ্চিম পাঞ্চাব।
১২.
সাইয়েদ জালাল বুখারীর রাহ.-বাহাওয়ালপুর ও পূর্ব সিন্ধু
১৩.
মাখছুম জাহনিয়াঁ রাহ.-পাঞ্জাব।
১৪.
সাইয়েদ সদরুদ্দীন রহ.-পাঞ্জাব।
১৫.
হাসান কবীরুদ্দীন রাহ.-পাঞ্জাব।
১৬.
হাসান কবীরুদ্দীন রাহ.
১৭.
সাইয়েদ ইউসুফুদ্দীন (র)
১৮.
ইমাম শাহ পিরানভী (র)
১৯.
মালিক আবদুল লতিফ (র)
২০.
শেখ শিহাবুদ্দীন সোহারাওয়ার্দী (র)
২১.
শেখ জালালুদ্দীন ফারছী (র)
২২.
শাহ জালাল (র)।
২৩.
সাইয়েদ আলী হামদানী (র)
২৪.
সাইয়েদ শাহ ফরিদ উদ্দীন
২৫.
মহাবীর খামদায়েত
২৬.
শেখ আবদুল কাদের জিলানীর (র) বংশধর অপর এক বুজর্গ
২৭.
ইবরাহীম আদিল শাহের পীর হযরত হাশেম গুজরাতী (র)
২৮.
মোহাম্মদ ছাদেক ছারমাস্ত (র)
২৯.
খাজা আখ্ন্দে মীর হোসাইনী (র)
৩০.
সাইয়েদ নেছার শাহ (র),
৩১.
সাইয়েদ ইবরাহীম
শহীদ (র)
৩২.
শাহ আল হামেদ (র)।
৩৩.
বাবা ফখরুদ্দীন (র)।
§ সুফীদের ইসলাম
প্রচারের ফলঃ হিন্দুদের বিরাট অংশ মুসলমান না হলেও মুসলিম পীরে ভক্ত হয়। যার
প্রমাণ হলো ১৮৯১ সালের আদম শুমারী। যাতে ২৩২৩৬৪৩জন হিন্দু নিজেদেরকে মুসলিম পীরের
ভক্ত বলে ঘোষনা করে।
ভারতের বাইরে
§ ভারতের বাহিরে
সুফী সাধকদের দাওয়াতী কাজ উল্লেখ যোগ্য। তার মধ্যে চেঞ্জিস খানের তাতারীরা যখন
ইসলামী সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়, তখন কেবল সুফী সাধকদের আধ্যাত্মিক শক্তিটা কেবল বাকী
ছিল।
§ সুফী সাধকরা
তাদের তৎপতার মাধ্যমে তাতারীদের পরাজিত করেছিলেন।
আফ্রিকায়
§ আমাদের দেশের
সূফীগনের জন্য শিক্ষার বিষয় হলো আফ্রিকার সুফীদের ইসলাম প্রচারকারী দল।
১. আমিরগনীল দল- এর প্রতিষ্ঠাতাঃ
মুহাম্মদ উসমান আমীরগনী। প্রায় ১৮ বছর (১৮৩৫-৫৩) পূর্ব সূদানে আত্মশুদ্ধির কাজ
করেন। বহু মুশরিককে মুসলমান করেন।
২. কাদেরীয়া দল-তাদের কাজ শুরু
হয় হিজরী ৯০০ সনে পশ্চিম আফ্রিকায়। এ প্রক্রিয়া চালু ছিল ১৯০০ সন অবধি। পশ্চিম
সুদান থেকে টাম্বাকটো ও সেনেগাল পর্যন্ত তারা সংগঠন গড়ে তুলেন। তাদের মাধ্যমে অনেক
অনেক মূর্তি পূজারী মুসলমান হয়।
o কাদেরীদের কাজের
পদ্ধতিঃ যেখানে কিছু
লোক ইসলাম কবুল করবে, সেখানের বাছাইকৃত তরুণদের পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় সংগঠনের
ট্রেনিং ক্যাম্পে। ট্রেনিং-এ যারা দক্ষতার স্বাক্ষর রাখে তাদের আরো উচ্চতর
ট্রেনিং-এর জন্য পাঠানো হয় কিরোওয়ান, ফাস, ত্রিপোরী এবং আল আজহারে। ট্রেনিং শেষে
তাদেরকে নিযুক্ত করা হয় দাওয়াহ এর কাজে। মাদ্রাসা কায়েম ও গরীব তরুনদের ইসলামী
ট্রেনিং দেয়াও তাদের কাজ।
৩. তিজানিয়া দল-উত্তর আফ্রিকায়
আলহাজ্ব ওমর এর নেতৃত্বে ১৯৩৩ সালে দাওয়ার কাজ শুরু করেন। যে দলটি মূলতঃ
আলজিরিয়াতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর কাজের পদ্ধতি প্রায় কাদেরীয়াদের মতোই। তবে তাদের
কর্মসূচীতে জিহাদ অতিরিক্ত ছিল। নাইজেরিয়া ও সেনেগালে মুশরিকদের ইসলামী দীক্ষিত
করে ইসলামী হুকুমাত কায়েম করে, যা ফরাসি সাম্রাজ্য কর্তৃক পতন হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান
ছিল।
৪. সন্নৌসী দল-যা ছিল আফ্রিকায়
ইসলাম প্রচারক সংগঠন সমূহের মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী দল। যার শুরু ১৮৩৩ সালে
আলজিরিয়ার মুহাম্মদ ইবনে আলী সন্নৌসীর নেতৃত্বে। উদ্শ্যেঃ মুসলমানদের সংশোধন,
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিরোধ ও ইসলামের প্রচার।
o
মাত্র ২২ বছরে রাষ্ট্রীয় শৃংখলার চেয়েও শক্তিশালী সংগঠন
কায়েম হলো।
o
সংগঠনের প্রতিটি সদস্য উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের স্বপ্নে
বিভোর এবং তারা ছিল খালেস ইসলামী শিক্ষায় প্রশিক্ষিত সাচ্চা মুসলমান-যারা কুরআনের
প্রতিটি শব্দ অনুরণ করা আবশ্যক ছিল।
o
আউলিয়া পূজা, মাজার পূজা, কফি ও তামাক সেবন এবং ইহুদী
ও খৃষ্টানদের সাথে সম্পর্ক রাখা নিষেধ।
o
প্রত্যেক ব্যক্তি খাঁটি মুজাহিদের মত জীবন যাপন করতো।
o
মিশর থেকে মরক্কো, ত্রিপোলীর সমূদ্রসীমা থেকে সাহারা
মরুভূমির শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সংগঠনের খানকাসমূহ।
o
আফ্রিকা ছাড়াও আরব, ইরাক ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত এর প্রভাব ছড়িয়ে রয়েছে।
o
আফ্রিকার যারা নামমাত্র মুসলমান ছিল, সন্নৌসী দলেন কল্যাণে তারা খাঁটি মুসলমানে
পরিণত হয়।
o
আফ্রিকার কোণে কোণে তারা ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেন।
o কাদেরিয়া দলের
লোকদের মতো সন্নৌসী প্রচারকগণও প্রচার কার্যের সাথে সাথে প্রত্যেক নও-মুসলিমকে এক
একজন মুবাল্লিগ রূপে গড়ে তোলেন।
o আফ্রিকার এই
ইসলাম প্রচারক দলসমূহের সফলতা নিয়ে জনৈক ইউরোপীয় পর্যটক লিখেছেনঃ
“নাইজেরিয়া নদীর কিনার দিয়ে যখন আমি মধ্য-আফ্রিকার দিকে রওনা
হলাম, তখন প্রথম দু’শো মাইল পর্যন্ত আফ্রিকার উপজাতিগুলোর
অসভ্যপনা, বর্বরতা ও নরখাদকতা সম্পর্কে আমার যে ধারণা ছিল তা বদলানোর
কোনো প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু আমি যখন মধ্য সুদানের নিকট পৌঁছুলাম তখন উপজাতীয়
গোত্রগুলোর জীবনে আমি প্রগতির নিদর্শনাবলী দেখতে পেলাম,
যা দেখে আমার
ধারণা পাল্টে যেতে লাগলো। আমি দেখলাম,
সেখানে মানুষ
খাওয়ার প্রবণতা নেই, মুর্তিপূজারও অস্তিত্ব নেই,
মদখোরী
নেশাখোরীও বিলুপ্ত প্রায়। সকল গোত্রের লোকেরা কাপড় পরে। কাপড়-চোপড় পরিস্কার ও
পবিত্র রাখে এবং আচার-আচরণে ভদ্রতা রক্ষা করে। দেখে স্পষ্টতই মনে হয়,
তাদের নৈতিক মান
তাদের সমপর্যায়ের অন্যান্য গোত্রসমূহের চেয়ে অনেক বেশী উন্নত। তাদের সবকিছুই
প্রগতিশীল। নিগ্রো প্রকৃতি যেন কোনো উন্নততর প্রকৃতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে আর এসবই
হচ্ছে ইসলামের কল্যাণে। ‘লোকোজা’
নামক জায়গাটা
অতিক্রম করার পর আমি মূল ইসলামী প্রচার কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছুলাম এবং সেখানে এক অতি
উচ্চাংগের শৃংখলাবদ্ধ প্রশাসন সক্রিয় দেখলাম। চারদিকের লোক বসতিতে সর্বত্র সভ্যতার
নিদর্শন পরিস্ফুট। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও কারিগরির ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে
এবং আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন একটি সুসভ্য দেশে এসে উপস্থিত
হয়েছি”।
চারঃ
আফ্রিকায় ইসলামের প্রসার
§ মুসলমানদের মাঝে
কখনোই ধর্ম প্রচারের জন্য আলাদা কোন সংগঠন ছিলনা। কারণ, মুসলমানরা দাওয়াহ এর কাজকে
কোন বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে সীমিত রাখেনি। বরং এটা সকল মুসলমানদের উপর ব্যক্তিগত ফরয।
§ যদি এটা
ব্যক্তিগত ফরয না হতো, তাহলে খৃষ্টানদের ন্যায় কোন একটি বিশেষ দলের উপর এই দায়িত্ব
বর্তাতো এবং বাকী সবাই এ দায়িত্ব পালনে কোন আগ্রহ প্রকাশ করতে না। যার ফলে
মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে দাওয়ার কাজ সীমিত হয়ে যেত।
§ ইসলাম হলো
গনতান্ত্রিক ধর্ম-যার নিকট শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড হলোঃ সৎকাজ। বিধায়, এখানে সকলের
জন্য ধর্ম কল্যাণ ও সৌভাগ্যের দরজা সকলের জন্য উম্মুক্ত রাখতে হবে।
§ পৃথিবীতে ইসলাম
হচ্ছে একমাত্র ধর্ম, যেখানে দ্বীনের প্রচারের আগ্রহ সবচেয়ে বেশী এবং তার অনুসারী
প্রত্যেকেই এক একজন মুবাল্লিগ।
§ এপর্যায়ে কিভাবে
এই দাওয়াহ কাজের আগ্রহ দেশের পর দেশ জয় করেছে এবং ইসলাম প্রসারিত হয়েছে-তা বর্ণনা
করা হবে। এক্ষেত্রে মুসলানরা ক্ষমতাসীন ছিল এমন অঞ্চলের উদাহরণ দেয়া হবে না। যেমনঃ
উপমহাদেশ, ইরান, মিশর ও আরব বিশ্ব। বরং উদাহরণ দেয়া হবে আফ্রিকা, চীন ও
মালয়েশিয়ার।
§ আফ্রিকা, চীন ও মালয়েশিয়া-এসব দেশে ইসলাম কখনোই
শক্তিপ্রয়োগ করার সুযোগ পায়নি। তাতার দেশসমূহ এবং তুর্কীস্তান-যেখানে
নিরস্ত্র ইসলাম সশস্ত্র কুফরীর মোকাবিলা করে তাকে পরাজিত করেছে।
§ অতএব, ধর্মীয়
নিষ্ঠার অধিকারী মুসলমানরা যে রকম ইসলামের খেদমত করেছে, আমরা যদি এমনি ধরনের
ধর্মীয় উদ্দীপনা নিয়ে কাজে লেগে যাই তাহলে অতি সহজেই ইসলামের প্রচার ও হেফাজতের
দায়িত্ব পালন করতে পারি।
আফ্রিকায় ইসলামের সূর্যোদয়
§ ‘বারবার’
জাতীয় লোকদের বাণিজ্যোপলক্ষ্যে পশ্চিম সুদানে যে সব নওমুসলি
আসা-যাওয়া করতেন, তারাই সর্বপ্রথম সেখা ইসলাম প্রচার করেন। ইউসুফ বিন তাশফিনের
আমলে বারবার গোত্রের লামতোনা ও জাদ্দালা গোত্র ইসলামের আলোয় আলোকিত করে পুরো
পশ্চিম সুদান।
§ ৫ম হিজরী শতকে ‘বারবার’ ব্যবসায়ীগন
সেই সময়ে নিগ্রো রাজ্য ঘানাকে ইসলামে দীক্ষিত করেন। সুদানের প্রাচীনতম রাজ্য
সংঘাইও বারবারদের হাতে ইসলামে দীক্ষিত হয়।
§ ৬ষ্ঠ হিজরী শতকে
এই প্রভাব দূর-দূরান্তে পৌছে। যখন বাণিজ্যিক শহর টামবাকটো ইসলামের সবচেয়ে বড়
প্রচার কেন্দ্রে পরিণত হয়।
§ নিগ্রোরা
বাণিজ্যোপলক্ষে যারা সেখানে আসতো তারা ‘বারবার’ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ইসলামের
অমূল্য সম্পদ নিয়ে সমগ্র সুদান ও নাইজেরিয়ায় ছড়িয়ে দিতো।
§ ইসলামের প্রতি
তাদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা এতবেশী ছিল যে, ইবনে বতুতা যখন সেখানে পৌঁছেন তখন তাদের সম্পর্কে লিখেনঃ
“এরা কুরআনের প্রেমিক। আর নামাযের প্রতি তারা এমন নিষ্ঠাবান
ও নিবেদিত প্রাণ যে, জুমআর দিন সকাল বেলা গিয়ে মসজিদে না বসলে জায়গা পাওয়া
অসম্ভব”।
§ নও মুসলিম জাতি
সমূহের মাঝে ইসলাম প্রচারে সবচেয়ে একটিভ ছিল মন্ডেদু জাতি। যারা পুরো আফ্রিকায়
খাতিমান ছিল তাদের আদত অভ্যাস আর সদাচরণের জন্য। তাদের প্রচেষ্টায় হাউসা জাতি ইসলাম কবুল করে-যারা ছিল মধ্য
আফ্রিকার সবচেয়ে প্রতিভাবন, কর্মঠ ও ব্যবসায়ী। যাদের ব্যবসায়িক কর্তৃত্ব ছিল পুরো
সুদান ও নাইজেরিয়া জুড়ে।
§ মিশরীয়
বণিকগন-যা ইসলাম প্রচার করেন পূর্ব সুদানে। মিশরে ফাতেমী খেলাফতের পতনের পর বহু
আরব সুদানে আশ্রয় নেয়। তারা সেই অঞ্চলে দূরদূরান্ত পর্যন্ত ইসলাম প্রচার করেন।
§ দক্ষিণ-পশ্চিম
সুদানে ইসলাম প্রচারিত হয় তিউনিস ও তানজানিয়ার আরব বণিকদের দ্বারা। যার ফলশ্রুতিতে
আহমদ নামক একজন আরব “দারাকোর”-এ ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। –যা কয়েক শ’বছর পর
মুহাম্মদ আলী পাশা নিজ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া পর্যন্ত বহাল থাকে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে
§ ১৮শ শতাব্দী।
মধ্য আফ্রিকায় ইসলামী দাওয়াহ-এর নতুন জাগরণ তৈরী হয়। প্রথম
দায়ীঃ শেখ ওসমান দানফেদিও। যিনি ছিলেন শাইখ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব নাজদীর
শিষ্য। তাই তিনি সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করার সুন্নাত পূনরুজ্জীবিত
করেন।
§ সেখানে ফুলবী
সম্প্রদায় ইসলামের খেদমত শুরু করে এবং গোবার রাজ্য থেকে শিরক ও মূর্তিপূজা উচ্ছেদ
করে পুরো হাউসাল্যান্ডকে কুফুরী থেকে পবিত্র করে।
§ ওসমান দানফোদিও
১৮১৬ সালে ইনতিকাল করেন। যখন তিনি হাউসাল্যান্ড এর বাদশাহ। তার মৃত্যুর সময়ে তার
সাম্রাজ্যের কোথাও শিরক বা মূর্তিপূজার নাম নিশানা ছিলোনা।
§ ১৯৯০ সালে
হাউসল্যান্ড সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ইংরেজদের হাতে।
§ ইংরেজরা
সাম্রাজ্য দখল করলেও মুসলমানদের দাওয়াতী স্পৃহা ম্লান হয়নি। যার দরুন বিংশ
শতাব্দিতে ওখানে তথা ইউরোবা অঞ্চলে মূর্তি পূজার উচ্ছেদ করে নাইজার নদীর দক্ষিণ
অবধি দ্বীনের প্রসার ঘটানো হয়। ১৮৯৪ সালে শুরু হওয়া দাওয়াহ-এর কাজ ১৯০৮ সালে সেখানে ২টি শহরে ২০ ও ১২টি
মসজিদ গড়ে উঠে।
§ ১৮৯৮ – ১৯১০ পর্যন্ত নাইজার নদীর দক্ষিণ তীরে সবক’টি গোত্র ইসলামের ছায়াতলে চলে আসে।
§ আফ্রিকার পশ্চিম
উপকূলীয় অঞ্চলে ১০০ মাইল বিস্তুত এলাকায় প্রায় সোয়শ’ বছর আগে ব্যবসায়ীরা ইসলাম প্রচার আরম্ব
করেন। সেখানকার অজ্ঞতা ও মূর্খতাকে সভ্যতায় রূপান্তর করা হয় কিভাবে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ইংরেজ কোম্পানীর এক আবেদন পত্রে এভাবেঃ
“এখান থেকে প্রায়
৪০ মাইল দূরে আজ
থেকে ৭০ বছর আগে
কতিপয় মুসলিম বণিক এসে
বসতি স্থাপন করে। অন্যান্য
জায়গায় মুসলমানদের মত
তারা এখানেও মাদ্রাসা ইত্যাদি
স্থাপন করে ধর্মীয় শিক্ষা
বিস্তার করতে আরম্ভ করে
এবং এরূপ সংকল্প গ্রহণ
করে যে, যে ব্যক্তি
ইসলাম পগ্রহণ করবে তাকে
দাস হিসেবে বিক্রী করা
হবে না। অল্প দিনের
মধ্যেই একানে উন্নতমানের কৃষ্টি
ও সভ্যতার চিহ্ন
পরিস্ফুট হতে আরম্ভ করে।
লোক সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
সেই সাথে প্রাচুর্যও বেড়ে
যায়। ক্রমে এ এলাকায়
ইসলামের প্রভাব সবকিছুর ওপর
বিজয়ী হয়ে উঠে। লোকেরা
দলে দলে মুসলমানদের ধর্মে
দীক্ষিত হচ্ছে। মনে হয়, শীঘ্রই
গোটা অঞ্চল ইসলামে দীক্ষিত
হয়ে যাবে”।
§ সিয়েরালিওনে ইসলাম
প্রচার সম্পর্কে ডঃ ভেমার লিখেছেনঃ
“এখানকার মুসলমানদের
মধ্যে ইসলাম প্রচারের জন্য
কোনো বিশেষ দল নির্দিষ্ট
নেই বরং এদের প্রতিটি
ব্যক্তি ইসলাম প্রচারকারী। যেখানেই
৫/৬জন
মুসলমানের বসতি হয়েছে, সেখানেই
একটা মসজিদ হয়ে গেছে।
আর সেই ক্ষুদ্র ঘরটি
ঐ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের
কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এদের
নিয়ম কানুনও খুব সহজ।
যে ব্যক্তি কালেমা
পড়ে। নামায পড়া ও
মদ ত্যাগ করার অঙ্গীকার
করে সে তাদের বিশ্বজোড়া
পরিবারে সদস্য হয়ে যায়”।
§ গায়েনায়, পূর্ব আফ্রিকা, কেপ উপনিবেশে
একই ভাবে বণিকদের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার শুরু হয়।। ১৮০৯ সালে কোলব্রুক লিখেছিলেনঃ
“আমাদের মিশনারীদের সর্বাত্মক
চেষ্টা সত্ত্বেও মুসলিম
প্রচারকগণ কৃষ্ণকায় দাসগণকে
ও স্বাধীন লোকদেরকে
সাফল্যের সাথে মুসলমান বানিয়ে
ফেলছে। আমাদের প্রচারকরা বহু
সময় ও টাকা খরচ
করে অতি কষ্টে মুষ্টিমেয়
সংখ্যক লোককে খৃষ্টান বানায়।
কিন্তু মুসলিম প্রচারকগণ বিনা
পরিশ্রমেই বিপুল সংখ্যক লোক
হস্তগত করতে সক্ষম হচ্ছে”।
§ বিগত ৫০/৬০ বছরে
বাইরের মুসলমানরাও ঐসব এলাকায় পৌঁছে গেছে এবং তারা ইসলাম প্রচারে নতুন প্রাণশক্তির
সঞ্চার করেছে। বর্তমানে বিশেষভাবে ক্লেরামতিন্টে ইসলাম প্রচারের গতি অধিকতর বেগবান।
এখানে বিপুল সংখ্যক ইয়াতীম ও অনাথ বালক-কিশোর ইসলাম গ্রহণ করেছে।
পাঁচঃ
চীনে ইসলাম প্রচার
§ দূর প্রাচ্য।
দূর প্রাচ্য বলতে আমরা চীন ও মালয় দ্বীপপুঞ্জ বুঝি।
§ আফ্রিকার পর
মুসলমানদের দাওয়াহ এর দ্বিতীয় ক্ষেত্র ছিল দূরপ্রাচ্য। যেখানে মুসলমানরা দাওয়াহ-এ কাজ করেন নিজ স্পৃহা ও ধর্মীয় আবেগ থেকে-যাদের মধ্যে ছিলেন ব্যবসায়ীগন, সিপাহীগন ও সাধারণ
পেশার মুসলমান।
§ যারা এই দাওয়াহ-এর কাজে অংশ নিয়েছেন, তারা
আর্থিক বা রাষ্ট্রীয় কোন আনুকূল্য পাননি। বরং নির্যাতনমূলক আক্রমনের শিকার হয়েছে।
তবুও তারা সাফল্য লাভ করেন।
§ তাদের দাওয়াতে
বর্তমানে সব মিলিয়ে ৮.৯
কোটি মুসলমান বাস করে।
§ চীনে প্রথম
ইসলামের সূচনাঃ
o
বনু উমাইয়ার যুগে।
o
খোলাফায়ে রাশেদার যুগে আরব সাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত
আরব বনিকরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন এবং সে সময়েই তারা ইসলামের দাওয়াত চীনে ছড়িয়ে
দিয়েছিলেন। কিন্তু বনু উমাইয়ার শাসনামুলৈ যখন চীনের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত
হয়, তখন ইসলামের সাথে চীনের
যথার্থ পরিচিতি ঘটে।
o
চীনের তদানিন্তন সম্রাট সোয়ানসোংক হঠাৎ ষড়ন্ত্রের শিকার হয়ে
ক্ষমতাচূৎ হলে উমাইয়া সম্রাট তার সাহার্যার্থে ৪ হাজার সেনা প্রেরণ করেন। যারা
সম্রাটকে পুণরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয়।
o
চীনে প্রেরিত সৈন্যরা ছিলেন ইসলাম প্রচারক। বিধায় তারা আর
দেশে ফিরে না গিয়ে চীনে বসবাস শুরু করেন, সেখানে বিয়ে করেন, সেখানে ইসলামের
দাওয়াত শুরু করেন।
o
ফলে কয়েক শতাব্দীর মধ্যে চীনের ক্যান্টেম অঞ্চল ইসলামের
আলোয় আলোকিত হয়ে যায়।
ইসলাম প্রচার-স্তরে স্তরে
§ চীন সম্রাট
সোয়ানসোংক-এর
এই ঘটনার ৬শ বছর পর
o
ইসলাম প্রচারকগন চীনে গমন করেন। যাদের মধ্যে ছিলেন আরব, ইরান ও তুরস্কের মুহাজির।
o
হিজরী ৭ম শতাব্দীতে মঙ্গোলীয়রা তুরস্ক, ইরান ও আরব ভূখন্ডে আক্রমন চালায়। ফলে
সেখানকার মুসলামনদের অনেকে দেশ ত্যাগ করে চীনে চলে আসেন।
o
১০০ থেকে দেড়শ বছরের মধ্যে চীনের অধিকাংশ অঞ্চলে ইসলাম
বিস্তৃত হয়।
§ মার্কো পোলো
লিখেছেনঃ ১৩শ শতকে প্রায় সমগ্র উনান প্রদেশ মুসলমান হয়ে যায়।
§ অন্য ঐতিহাসিক
লিখেছেনঃ ১৪শ শতকে “তালিফো”
এলাকার সমস্ত অধিবাসীরা মুসলমান।
§ ইবনে বতুতা
লিখেছেনঃ দক্ষিণ চীনের সব শহর গুলোতে মুসলিম মহল্লা রয়েছে। মুসলিমরা চীনা মহিলাদের
বিয়ে করে এবং তাদের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখে। এজন্য খুব দ্রুত ইসলাম ছড়িয়ে পড়ছে।
§ আলী আকবর নামক
একজন মুসলিম বনিক লিখেছেনঃ ১৫শ শতকে পিকিং এ প্রায় ত্রিশ হাজার মুসলিম পরিবার বাস
করতো। ১৭শ শতকে চীনা ইহুদের বিরাট একটি অংশ মুসলমান হয়ে যায়।
§ ১৮শ শতকে কিন লং
জিঙ্গারিয়ার বিদ্রোহ দমন করার পর সেখানে ১০ হাজার পরিবারকে পুণর্বাসিত করা হয়। সেই
১০ হাজারের সবাই পার্শ্ববর্তী মুসলমান জনবসতি দ্বারা দাওয়াত প্রাপ্ত হয়ে মুসলমান
হয়।
§ শানতোং অঞ্চলে
দুর্ভিক্ষের সময় মুসলমানরা দশ হাজার চীনা বালককে আশ্রয় দেয় এবং তারা সকলেই পরে
ইসলামে দীক্ষিত হয়।
§ অপর এক
দুর্ভিক্ষের সময় কোয়ান তুং অঞ্চলে প্রায় দশ হাজার চীনা বালক মুসলমানদের হস্তগত হয়
এবং তাদের সকলকে ইসলামী ট্রেনিং দিয়ে লালন-পালন করা হয়।
§ সাইয়েদ সোলায়মান
নামক জনৈক চীনা মুসলমানের সাক্ষ্যমতেঃ সাধারণ অবস্থায় মুসলমানরা এত বেশী পরিমাণে
প্রচারকার্য চালাতেন যে, প্রতি বছর নতুন ইসলাম
গ্রহণকারীদের সংখ্যা গণনা করে শেষ করা কঠিন।
§ চীনা মুলমানদের
মাঝে দাওয়াতের এই ঝোঁক এখনো বিদ্যমান। ব্যবসায়ী, কারিগর, মুসলিম কর্মচারী, সেনা
সদস্য, অফিসার সবাই ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব উপলব্দি করেছেন। যার ফলঃ কানসু প্রদেশে এবং পরে আরও দশটি প্রদেশে
মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।
§ চীনে বাহির থেকে
আসা মুসলমানদের সংখ্যা হয়তো এক লাখের বেশী হবে না। কিন্তু এই বিশ্বজনীন প্রচার
স্পৃহাই তাদের সংখ্যা ৫ কোটিতে পৌঁছিয়ে দিয়েছে।
§ একজন রুশ
পর্যবেক্ষক এই অবস্থা দেখে উদ্বেগের সাথে বলেছেনঃ ইসলাম প্রসারের এই গতি অব্যাহত
থাকলে একদিন হয়তো মুসলমানরা দূরপ্রাচ্যের রাজনীতির কাঠামোটাই পাল্টে ফেলবে।
ছয়ঃ
মালয় দ্বীপপুঞ্জে ইসলামের
প্রসার
§ মালয়
দ্বীপপুঞ্জে ইসলাম প্রচার করেন আরব ও ভারতীয় বণিকগণ।
§ বনিকরাঃ
o
স্পেনীয় বা পর্তুগীজদের মতো যুদ্ধজয়ী ছিলেন না।
o
তরাবারী মাধ্যমে ধর্মপ্রচারে ইচ্ছুক ছিলেন না।
o
তাদের কাছে ঈমানী শক্তি ছাড়া কোন শক্তি ছিলনা।
o
তাদের সাথে ছিল সত্য ও ন্যায়ের বাণী।
§ এই শক্তি দিয়ে
তারা মালয় দ্বীপপুঞ্জ জয় করেন এবং ৬শ বছরে সেখানে ৮০ ভাগ মানুষ মুসলমান হয়ে যায়।
§ তারা অবশ্য
প্রাচীন পৌত্তলিক ধ্যান ধারণা, স্পেন ও পর্তগালের ঔপনিবেশিক লালসা, হল্যান্ডের
খৃষ্টীয় সাম্রাজ্যবাদের থাবার শিকার হোন। কিন্তু সব কিছুকে পায়ে দলে তারা তাদের
দাওয়াত অব্যাহত রাখেন।
সুমাত্রা
§ সুমাত্রায়
ইসলামের সূচনা হয় ইতজা থেকে। আবদুল্লাহ আরিক সর্বপ্রথম ইসলামের আওয়াজ বুলন্দ করেন।
§ আব্দুল্লাহ
আরিকের মুরিদ বুরহান উদ্দীন পারিয়ামান পর্যন্ত ইসলামের বিস্তার ঘটান।
§ ১২০৫ সালে গোটা
ইতজা রাজ্য ইসলাম গ্রহণ করে এবং স্বয়ং রাজাও মুসলমান হয়ে যান। তাঁকে ‘জাহানশাহ’ উপাধি দেয়া
হয়।
o
এখান থেকে বাণিজ্যিক জাহাজে চড়ে ইসলাম উত্তর সুমাত্রায়
পৌঁছে। পারলাক ও পাসুরীতে মুসলমানদের বাণিজ্যিক কুঠি প্রতিষ্ঠিত হয়।
§ ১৪শ’ শতাব্দীতে শেখ ইসমাঈলের নেতৃত্বে মকআর
কতিপয় আলেম সুমাত্রায় আসেন এবং তারা লামবেরী থেকে নিয়ে আরু পর্যন্ত গোটা উপকূল
অঞ্চলকে ইসলামের আলোকে আলোকিত করেন।
o
মাসুদরা রাজ্যের রাজা মুসলমান হয়ে যান এবং তাকে “আল মালিকুস সালেহ” উপাধিতে
ভূষিত করা হয়।
o
তাঁর চেষ্টায় পালকাক রাজ্যও ইসলাম গ্রহণ করে।
o
ইবনে বতুতা তার পর্যটনক্রমে যখন এখানে পৌঁছেন তখন ক্ষমতাসীন
ছিলেন ‘আল মালিকুস সালেহ”-এর পুত্র “আল-মালিকুজ জাহের” এবং
সুলমান মুহাম্মদ তুঘলকের সাথে তার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল।
§ পালমবাং-এ
হিন্দু ধর্মের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী। জাভার শ্রেষ্ঠ ইসলাম প্রচারক
রাডান রহমত এখানে ইসলাম প্রচার করেন এবং তার পরেও ইসলামের প্রসার অব্যাহত থাকে।
§ পরে যখন এ
অঞ্চলে হল্যাণ্ডের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং খৃষ্টান মিশনারীদের প্রতিরোধের জন্য
মুসলমানরা অক্লান্ত চেষ্টা-সাধনা শুরু করে দেন তখনই সত্যিকারভাবে এখানে ইসলামের
প্রসার ঘটতে আরম্ভ করে।
§ বিংশ শতাব্দীর
শুরু থেকেই এখানকার পৌত্তলিক অধিবাসীরা ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে।
§ দক্ষিণ
সুমাত্রায় ইসলামের বিস্তার ঘটে সবার শেষে। এখানে ইসলামের প্রথম প্রচারক ছিলেন
জাভাবাসী এক সরদার মিনাক কুমালা বুমী। ইতি বাটনামে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরে মক্কায়
ইসলামী জ্ঞান অর্জন করেন এবং লাম্পাং-এ বহু সংখ্যক পৌত্তলিক গোত্রকে ইসলামে
দীক্ষিত করেন। এ অঞ্চল যখন চারদিক থেকে মুসলিম রাজ্যের ঘেরাও হয়েছিল তখন ইসলামের
কোলে আশ্রয় নেয়নি। কিন্তু হল্যাণ্ডের মুসলিম পীড়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দ্রুত
ইসলামের দীক্ষিত হয়।
§ হল্যাণ্ড শক্তির
বলে ইসলামের প্রসার ঠেকাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এতে মুসলমানদের প্রচার স্পৃহা
তীব্রতর হয় এবং তারা খৃষ্টান প্রচারকদের পর্যুদস্ত করেন।
§ একজন মিশনারী
বর্ণনা করেছেন যে, একবার পুরো একটা গ্রাম খৃষ্ট ধর্মের প্রাথমিক দীক্ষা নিয়েও সহসা ইসলাম
গ্রহণ করে। এমনিভাবে মসজিদের এক ইমামের চেষ্টায় ‘সেপরুফ’
নামজ একটি জেলার সব লোকেরা মুসলমান হয়ে যায়। অপর একজন ধর্ম প্রচারক
সম্পর্কে খৃষ্টান মিশনারীরা বলেছেন যে, তিনি দশ বছর ধরে
চেষ্টা করে একটা পৌত্তলিক গোত্রকে খৃষ্ট ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত করে ইসলামে
দীক্ষিত করেন। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, স্বয়ং
হল্যাণ্ড সরকারের বেতনভুক্ত মুসলিম কর্মচারীরাও ইসলাম প্রচার করেন এবং সরকার তা
অপছন্দ সত্ত্বেও ঠেকাতে সক্ষম হয়নি।
§ সুমাত্রা দ্বীপ
থেকে ইসলাম পৌঁছে মালয় উপদ্বীপে।
o
১২’শ
শতাব্দীতে সুমাত্রার বহু সংখ্যক মুসলিম বণিক বাণিজ্যোপলক্ষে সিঙ্গাপুরে গিয়ে বসতি
স্থাপন করে।
o
এক শতাব্দী পর তারা মালাক্কা বন্দরের নিকট উপনিবেশ স্থাপন
করেন। তাদের চেষ্ট্যায় উপকূলের অধিকাংশ বাণিজ্যিক জনপদ ইসলাম গ্রহণ করে এবং তাদের
মাধ্যমে মালয়ের অভ্যন্তরভাগে ইসলাম বিস্তার করে।
o
১৪’শ
শতাব্দীতে এখানকার রাজাও আবদুল আজীজ নামক জনৈক আবর বণিকের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন।
অতপর তার নাম বদলে রাখা হয় সুলতান মুহাম্মদ মাহ।
o
১৬শ’ শতাব্দীর প্রারম্ভে মালয়ের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য ‘কোয়েডা’ও ইসলামের প্রভাবাধীনে এসে যায়।
o
১৫০৫ সালে সেখানকার রাজা পেরাওং মহাওংসা শেখ আবদুল্লাহ নামক
জনৈক মুসলমান আলেমের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখা হয় সুলতান
মুজলাফ শাহ। এই রাজা তার সমগ্র জীবন ইসলাম প্রচারের কাজে নিয়োজিত করেন এবং মৃত্যুর
পূর্বে কোয়েডা রাজ্যের একটি বিরাট অংশকে পৌত্তলিকতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করেন।
§ মালয় থেকে
ইসলামের আলো পৌঁছে থাইল্যাণ্ডে। সিঙ্গাপুরের মুসলিম বণিকরা তা পরে ইন্দোচীন
পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেন। আজকাল এসব দেশে ইসলামের যেটুকু প্রভাব দৃষ্টিগোচর হয় তা সব ঐ
বণিকদেরই চেষ্টার ফল।
জাভা
§ এটা ১৯২৫ সালের
ঘটনা। জাভা বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার একটি অঙ্গরাজ্য।
§ মালয়
দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে পৌত্তলিকতা ও হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে বেশী প্রভাব ছিল জাভা
দ্বীপে।
o
মুসলমানদের উচ্চশিক্ষঅ সত্ত্বেও কাল্পনিক খোদার উপাসনাজনিত
রকমারি বাতিল আকীদা-বিশ্বাস ও অলিক ধ্যান-ধারণা তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল।
o
১৭৬৮ সাল পর্যন্ত মনুর ধর্মশাস্ত্র প্রচলিত ছিল বলে ইতিহাসে
প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু ইসলামের নীরব প্রচারকগণ কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই সেসব গভীর
প্রভাব নির্মূল করে দেন। ফলে আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মুষ্টিমেয় সংখ্যক লোক বাদে সমগ্র জাভা
দ্বীপের অধিবাসীরা মুসলমান হয়ে গেছে। অধিকন্তু জাভী মুসলমানদের ইসলাম প্রিয়তা
পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে অধিক।
§ জাভার এ
কৃতিত্বপূর্ব ঘটনার সূচনা করেন জাভারই একজন বণিক হাজী পুরওয়া।
o
তিনি পাজা জারনের রাজার পুত্র ছিলেন। তিনি রাজকীয় মুকুট ও
সিংহাসন –যা
উত্তরাধিকার হিসাবে তার প্রাপ্য ছিল –নিজের ছোট বাই এর জন্য
রেখে দেন এবং নিজে ব্যবসা পণ্য নিয়ে ভারতবর্ষে চলে আসেন।
o
এখানে এসে পার্থিব সামগ্রীর পরিবর্তে তিনি আখেরাতের সামগ্রী
পেয়ে যান। তারপর নিজের দেশবাসীকে ঐ অমূল্য সম্পদ পৌঁছিয়ে দেয়া তাঁর জীবনের একমাত্র
লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
o
তিনি একজন আরব আলেমকে নিয়ে জাভায় পৌঁছেন এবং সারা জীবন
ইসলামের খেদমত করতে থাকেন।
o
এরপর আরব ও ভারতীয় বণিক ও পর্যটকদের দৃষ্টি ঐ দ্বীপের প্রতি
আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তাঁরা ব্যাপকভাবে এখানে আসেন এবং উপকূল এলাকায় ইসলামের আলো
বিস্তার করতে থাকেন।
§ এ ধরনের
পর্যটকদের সবচেয়ে বড় দলটি আসে ১৪শ শতাব্দীতে মাওলানা সৈয়দ ইবরাহীমের নেতৃত্বে এবং
গ্রীসফ নামক স্থানে অবস্থান করেন।
o
এ দলটি প্রচারকার্যের কল্যাণে। বর্মণ রাজ্যের রাজা ইসলাম
কবুল করেন এবং সেখান থেকে আশপাশের রাজ্যগুলোতে ইসলামের প্রসার ঘটতে আরম্ভ করে।
o
জাভার ইতিহাসে এতবড় সাফল্য সর্বপ্রথম এ দলটির ভাগ্যেই যুটে।
রাডান রহমদের অভ্যুদ্বয়
§ জাভা দ্বীপের
সবচেয়ে বড় ইসলাম প্রচারক রাডান রহমদ ১৫শ’ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেন।
o
তিনিই এ অঞ্চলে ইসলামকে দারিদ্রের ছিন্ন কুটীর থেকে তুলে
রাজকীয় প্রসাদে ও কর্তৃত্বের আসনে পৌঁছিয়ে দেন। তিনি লালিত-পালিত হন রাজসিক
আভিজাত্যে ও বিলাস ব্যসনে। ইচ্ছা করলে তিনি নিজেও কোনো সিংহাসনের অধিকারী হতে
পারতেন কিন্তু আত্মসেবার পরিবর্তে ইসলামের সেবা করার আবেগে তার হৃদয় ছিল পরিপ্লুত।
o
এজন্য তিনি ইসলামের প্রচার ও প্রসারকেই নিজের জীবনের
একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারিত করেন। তিনি আল্লাহর প্রত্যাদেশ “নিকটতম আত্মীয়-স্বজনকে সতর্ক করে দাও”
অনুসারে সর্বপ্রথম নিজের পরিবার থেকেই প্রচারের কাজ শুরু করেন।
o
তিনি স্বীয় নানা চম্পার রাজাকে ইসলামের দাওয়াত দেন। তারপর
পালপবাং গিয়ে সেখানকার গভর্নর ও নিজের আত্মীয় ভাই আঘদামিরকে মুসলমান বানিয়ে ফেলেন।
o
এরপর মাওলানা জুমা দাল কুবরাকে সাথে নিয়ে ‘মাজা পাহিত’ রাজ্যে
যান এবং সেখানকার রাজা তথা তাঁর খালুকে ইসলামের দাওয়াত দেন। রাজা নিজে ইসলাম কবুল
করেননি বটে। তবে তাকে এম্পল অঞ্চলের গভর্নর নিয়োগ করে পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে ইসলাম
প্রচারের সুযোগ দেন। তিনি গভর্নর থাকাকালে এম্পলের প্রায় তিন হাজার পরিবারকে
মুসলমান বানান এবং ইসলাম প্রচারকদের একটি বিরাট দলকে পাশ্ববর্তী সকল দ্বীপ ও
রাজ্যে ছড়িয়ে দেন।
o
‘মুদোরা’কে যিনি
ইসলামের আলোকে আলোকিত করেন সেই শেখ খলিফা হোসাইন ছিলেন রাডানেরই প্রেরিত।
বালমিঙ্গন রাজ্যে যিনি ইসলাম প্রচার করেন সেই মাওলানা ইসহাকও ছিলেন তাঁরই শিষ্য।
o
গ্রিস্ক অঞ্চলে যে রাডান পা পৌত্তলিকতা নির্মূল করেন তিনিও
তারই ট্রেনিংপ্রাপ্ত শাগরিদ ছিলেন। স্বয়ং তার উভয় পুত্রও জাভায় খ্যাতনামা ইসলাম
প্রচারক ছিলেন।
o
তার দু’জন নিকটাত্মীয় রাডান পাট্টা ও রাডান হোসাইনের সবচেয়ে খ্যাতিপূর্ণ কৃতিত্ব
এই যে, তারা হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গ ‘মাজা পাহাত’কে চূড়ান্তভাবে ইসলামের নিকট নতি স্বীকার
করান।
o
রাডান হোসাইন মাজাপাহাতের সেনাপতি হিসেবে ইসলামের দাওয়াত
দেন এবং রাডান পাট্টা ১৪৭৮ সালে কাফেরী মতবাদকে শেষবারের মত পরাজিত করে
মাজাপাহাতকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করেন।
§ পশ্চিম জাভায়
ইসলাম প্রচারের কাজ ছিল আরও কঠিন। কেননা সেখানকার হিন্দুরা সাধারণ জাভীদের চেয়ে
অনেক বেশী গোঁড়া ছিল।
o
সেখানে অবশ্য মাওলানা হাসান উদ্দীন চায়বিবুনীর মত প্রচারকগণ
ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত হিন্দুরা
ইসলামের মোকাবিলা করতে থাকে।
o
অবশেষে ১৬শ’ শতাব্দীতে সত্যের চূড়ান্ত জয় হয় এবং হিন্দুরাজ্য ‘পজাজারান’ পুরোপুরিভাবে ইসলামে দীক্ষিত হয়।
o
এভাবে ১২’শ শতাব্দী থেকে শুরু করে ১৬শ’ শতাব্দী পর্যন্ত ৪শ’
বছরের মধ্যে জাভা দ্বীপ পরিপূর্ণভাবে ইসলামে দীক্ষিত হয়।
o
হিন্দু মতবাদ কোনো প্রকার রক্তপাত ছাড়াই শুধুমাত্র প্রচারের
বলে ইসলামের নিকট নতি স্বীকার করে।
মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জ
§ জাভার পর ইসলামী
শক্তির দ্বিথীয় কেন্দ্র চিল মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জ।
o
এখানে ইসলাম প্রচারিত হয় অনেক পরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে
স্পেনীয় ও পর্তুগীজ বাণিজ্য এবং ইসলাম এক সাথেই পৌঁছে।
o
মুসলিম বনিকগণ জঙ্গী খৃষ্টবাদের মোকাবিলায় শাক্তিপূর্ণ
উপায়ে সাফল্যজনকভাবে ইসলাম প্রচার করেন।
o
১৫শ’ ও ১৬শ’ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এখানে জাভা ও মালয়ের
বণিকরা ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তাদের এই প্রচার কার্যের কল্যণে অল্পদিনের মধ্যেই
সমগ্র মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে এবং চারটি শক্তিশালী ইসলামী সরকার
প্রতিষ্ঠিত হয়।
o
একটি ছিল ‘টার্ণেট’-এর সরকার। এর সুলতান টার্নেট আল-মাহেরার
একটি বিরাট অংশে শাসন চালাতেন।
o
দ্বিতীয়টি ছিল ‘টোডোরের সরকার’। সমগ্র টেডোর, আল-মাহেরার একটি অংশ, সিরামের একটি অংশ এবং
নউগিয়েনার পশ্চিম অংশ এ শাসনের আওতায় ছিল।
o
তৃতীয়টি ছিল সুলতান গুরুলুর –যার শাসনাধীন এলাকার মধ্যে ছিল মধ্য
আল-মাহেরা ও উত্তর সিরাম।
o
চতুর্থ সরকার ছিল হেজান দ্বীপের সরকার। এর শাসন তেজান দ্বীপ
ও ওবি দ্বীপমালার ওপর বিস্তৃত ছিল।
o
এ চারটি রাজ্যই কিছুদিন জ্যোলুস প্রকাশের পর খৃষ্টীয়
সাম্রাজ্যবাদের বিষাক্ত হাওয়ায় ধ্বংস হয়ে যায়। তবে ইসলামের অস্তিত্ব এসব সরকারের
করুণার উপর নির্ভরশীল ছিলো না, তাদের করুণায় তার আবির্ভাবও হয়নি।
o
পরে হল্যাণ্ড প্রভৃতি খৃষ্টীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এগুলোকে
গ্রাস করে নেয়ার পরও মালাক্কা দ্বীপপুহ্জে দ্রুত ইসলাম ছড়িয় পড়ে। একথা নিশ্চয় করে
বলা যায় যে, শীঘ্রই এমন দিন আসবে যখন সেখানে ইসলাম ছাড়া আর কোনো ধর্মের স্থান থাকবে
না।
§ এ দ্বীপগুলোর
মধ্যে সর্বপ্রথম টেডোর দ্বীপ ইসলামে দীক্ষিত হয়।
o
১৫শ’ শতাব্দীতে শেখ মনসুর নামক জনৈক আরব বণিক এখানকার রাজাকে মুসলমান বানিয়ে
তার নাম জামালুদ্দীন রাখেন।
o
১৫২১ সালে যখন স্পেনীয় বণিকদের দ্বিতীয় দল এখানে আসে তখন
শাসন ছিলেন জামালুদ্দীনের পুত্র সুলতান মনসুর এবং তখন ঐস্থানে ইসলামের বয়স হয়েছে
মাত্র ৫০ বছর।
o
পর্তুগীজ বণিকদের বর্ণনা মতে টার্ণেটে টেডোরেরও আগে ইসলামের
আবির্ভাব হয়েছিল।
o
১৫২১ সালে যখন সেখানে পর্তুগীজ দল আসে তখন সেখানে ইসলাম
প্রচারের বয়স ৮০ বছর হয়েছে।
o
এ দ্বীপে ইসলাম প্রচার সম্পর্কে একটা মজার গল্প আছে। ওয়াতো
মোল্লা হোসাইন নামক জনৈক জাভাবাসী বণিক ওখানে বাণিজ্যোপলক্ষে বসতিস্থাপন করেন।
তিনি প্রতিদিন সকালে উচ্চস্বরে কুরআন শরীফ পড়তেন। তাঁর তেলাওয়াত শুনে পৌত্তলিকরা
মোহিত হয়ে যেতো ও তার কাছে ভীড় জমাতো। এভাবে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি বহু লোককে
ইসলামে দীক্ষিত করেন।
o
শেষ পর্যন্ত ১৪৯৫ খৃষ্টান্দে স্বয়ং রাজাও গ্রীস্ক গিয়ে
ইসলাম গ্রহণ করেন।
§ আম্বুইনাতে ‘পাটিপুটা’ নামক জনৈক
স্থানীয় ব্যবসায়ী ইসলাম প্রচার করেন এবং জাভা থেকে ইসলামের শিক্ষা বনহ করে সমগ্র
আম্বুইনা উপকূলে ছড়িয়ে দেন।
o
তখন ছিল পর্তুগীজ উপনিবেশবাদরে অভ্যূদয়ের যুগ। পর্তুগীজরা
শক্তি প্রয়োগ করে এই ধর্মের অগ্রগতি রুখতে চেষ্টা করে। তারা আসলে ক্রুসেড যুদ্ধের
প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু পর্তুগীজদের কঠোর মোকাবিলা সত্ত্বেও সত্য দ্বীনের
প্রসার স্তিমিত হয়নি। বরঞ্চ সাধারণ মানুষেল মধ্যে তা আরো বেশী জনপ্রিয়তা লাভ করে।
o
এরপর ১৬শ’ শতাব্দীতে যখন পর্তুগাল অভ্যন্তরীণ সংকটে পড়ে তখন আম্বুইনার লোকেরা সমস্ত
খৃষ্টান মিশনারীদের মেরে তাড়িয়ে দেয় এবং দলে দলে ইসলামে দীক্ষিত হতে থাকে।
o
এ দ্বীপগুলোর সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক থাকার কারণে মালাক্কার
অবশিষ্ট দ্বীপগুলোও মুসলমান হয়ে যায়।
বোর্ণিও দ্বীপ
§ ১৫২১ সালে
গুলুলুর রাজা ইসলাম গ্রহণ করেন। এ শতাব্দীতে বোর্ণিও ইসলামের আলোকে আলোকিত হয়।
o
সর্বপ্রথম ‘বাঞ্চার মাসিম’ রাজ্যটি ইসলামে দীক্ষিত
হয়।
o
তারপর উত্তরে বোর্ণিওর ব্রুনাই রাজ্য মুসলমান হয়।
o
১৫৫০ সালে পালম্বাং-এর বণিকগণ সোকডনা রাজ্যে ইসলাম প্রচার
করেন।
o
১৫৯০ সালে বোর্ণিওর সবচেয়ে শক্তিমান রাজা মুসলমান হন। তার
নাম রাখা হয় সুলতান মুহাম্মদ সফউদ্দীন।
o
১৬০০ সালে জনৈক পাশ্চাত্য পর্যটক যখন বোর্ণিও পৌঁছেন তখন
তিনি দেখতে পান যে সমগ্র উপকূলীয় এলাকা ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং শুধুমাত্র
আভ্যন্তরীণ এলাকায় কুফরী ও পৌত্তলিকতার সামান্য প্রভাব রয়েছে।
o
১৮শ’ শতাব্দীর শুরু থেকেই বোর্ণিওর অভ্যন্তরেও ইসলাম প্রচারিত হতে আরম্ভ করে।
একদিকে পুঁজিপতি ও সুসংগঠিত খৃষ্টান দলগুলো নিজ ধর্মের প্রচার চালাচ্ছিলেন।
অপরদিকে দরিদ্র ও বিচ্ছিন্ন মুসলমান বণিকগণ ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিল। কিন্তু
দুনিয়ার মানুষ দেখে বিস্মিত হয়েছে যে, খৃষ্টানরা ব্যর্থ এবং
মুসলমানরা সফল হয়েছে। তারা মাত্র কয়েখ বছরের চেষ্টায় উত্তর বোর্ণিওর একটি বড়
সম্প্রদায় ‘ইদান’কে মুসলমান বানিয়ে
নেয়।
o
মধ্য বোর্ণিওর ‘ডাইক’ সম্প্রদায়ও খৃষ্টবাদের তুলনায়
ইসলামকে ভালো মনে করে।
সিলিবিস দ্বীপ
§ সিলিবিস দ্বীপেও
এই সাধারণ নিয়ম অনুসারেই ইসলাম প্রচারিত হয়।
o
প্রথমে জাভাবাসী ও মালয়ী বণিকরা ইসলামকে উপকূল এলকায়
পৌঁছিয়ে দেয়।
o
তারপর স্থানীয় বণিকদের সাহায্যে তা দেশের অভ্যন্তরভাগে
পৌঁছে।
o
১৫৪০ সালে যখন পর্তুগজ উপনিবেশবাদীরা এখানে আসে তখন সবে
ইসলামের প্রসার শুরু হয়েছে এবং শুধুমাত্র গোভাতে কয়েকজন মুসলমান বাস করতো।
o
৬০ বছরের মধ্যেই তা এতখানি উন্নতি লাভ করে যে সমগ্র উপকূল
এলাকা মুসলমান হয়ে যায় এবং মোকাসের রাজা সমেত ইসলাম গ্রহন করে।
o
মোকাসের থেকে আলফুর ও বোগী সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলামের
বিস্তার ঘটে।
o
বোগী সম্প্রদায়ের মধ্যে তো ইসলামের এমন প্রভাব পড়ে যে, এর ফলে তারা সমস্ত সহজাত প্রতিভা ও যোগ্যতা
জেগে ওঠে। তার মেধা ও কর্মঠতা তাকে মালাক্কা দ্বীপ পুঞ্জের সেরা সুসভ্য জাতিতে
পরিণত করে। আজকাল সমগ্র অঞ্চলে একটি ইসলাম প্রচারক সম্প্রদায় হিসেবে এ জাতি
সুপরিচিত।
o
নিউগিনি থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত এর বণিকরা নিজস্ব বহর নিয়ে
ঘুরে বেড়ায়। তাদের প্রভাবে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ছে। এদেরই বদৌলতে
সুমবাদা, লোমবোক, চন্দন দ্বীপ, প্রভৃতি
সমস্ত দ্বীপে ইসলাম প্রচারিত হয় এবং খোদ সিলিবিস দ্বীপে খৃষ্টবাদন শোচনীয়ভাবে
পরাভূত হয়।
o
১৮শ’ শতাব্দীতে খৃষ্টয়ি প্রচারকগন বোলাং ও মেছোণ্ডাও রাজ্যের রাজাকে খৃষ্টান বানিয়ে ফেলেছিল। তার প্রভাবে সমগ্র
রাজ্য খৃষ্টান হয়ে গিয়েছিল।
o
কিনউত বোগী বণিকগণ এক শতাব্দীর মদ্যে তাকে খৃষ্টবাদের কবল
থেকে মুক্ত করেন এবং ১৮৪৪ সালে স্বয়ং রাজা জেকোবিস ইসলাম গ্রহণ করেন।
ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জে
§ নিরস্ত্র
ইসলামের সবচেয়ে অলৌকিক কীর্তি প্রকাশ পেয়েছে ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জে।
o
মালয়ের জনৈক ব্যবসায়ী শরীফ কাবুং সুয়ান এখানে ইসলামের
ভিত্তি পত্তন করেন। তিনি তার কয়েকজন সঙ্গী-সাথী নিয়ে মিন্দানাও এসে বসতি স্থাপন
করেন। এখানে তিনি বিপুল সংখ্যক ফিলিপাইনবাসীকে ইসলামে দীক্ষিত করেন। এখানে তিনি
বিপুল সংখ্যক ফিলিপাইনবাসীকে ইসলামে দীক্ষিত করেন।
o
তারপর মুসলিম বণিকদের আগমনও ইসলামের প্রচারের ধারা দীর্ঘ
দিন ব্যাপী অব্যাহত থাকে।
o
এখানকার অসভ্য জাতিগুলোর উপনিবেশবাদীরা এখানে আসে তখন তারা
মুসলমান ও অমুসলমানদের সমাজ, সভ্যতা ও আচরণে সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখতে পায়। তারা ভেবে অবাক হয় যে,
এত অল্প সময়ের মধ্যে সভ্যতা বিবর্জিত পৌত্তলিক জাতিগুলোর জীবনে এতবড়
বিপ্লব এলা কেমন করে? যেহেতু এখানে ইসলামের প্রভাব ছিল খুবই
সাম্প্রতিক। এজন্য ইসলামকে হটিয়ে দিয়ে খৃষ্টবাদ ছড়ানোর জন্য তারা অত্যন্ত নিষ্ঠুর
কার্যক্রম গ্রহণ করলো এবং তরবারীর জোরে গোত্রগুলোকে খৃষ্টান বানাতে লাগরো।
o
বিংশ শতাব্দীর সভ্য দিনগুরোর প্রারম্ভ পর্যন্ত এ কার্যক্রম
চালু থাকে।
o
স্পেন এখানে ধর্মের নামে সব রকমের যুলুম-নির্যাতন অব্যাহত
রাখে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানে খৃষ্টবাদের মোকাবিলায় ইসলাম খুবই দ্রুতগতিতে
বিস্তার লাভ করেছে।
o
ফিলিপাইনের লোকেরা মিন্দানাও ও সেলো নামক মুসলিম রাজ্যগুরোতে
হাজারে হাজারে আসতো এবং দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতো।
o
বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে যখন এখানে মার্কিন আধিপত্য বিস্তৃত
হয় এবং ধর্মীয় জোর-যুলুমের সমাপ্তি গটে তখন ইসরাম প্রচারের সেই প্রবলতা অব্যাহত
থাকেনি।
o
তথাপি মুসলিম বণিকগণ ব্যাপকভাবে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েছে।
o
সাম্প্রতিকতম খবর থেকে জানা যায় যে, ফিলিপাইনে নীরবে ইসলাম প্রচারের কাজ আবার
নতুন করে চালু হয়ে গেছে।
নিউগিনি
§ নিউগিনিতে ইসলাম
প্রচার সবচেয়ে আধুনিক কালের ঘটনা। এখানে ইসলাম প্রধানতঃ উপকূলভাগে সীমাবদ্ধ
থাকে।
o
প্রথমতঃ এর পশ্চিম অঞ্চল তেজানের সুলতানের শাসনাধীন ছিল।
এজন্য ১৬শ’ শতাব্দীতে উত্তর-পশ্চিম গিনীতে ইসলামের প্রভাব অধিকতর ব্যাপক হয়।
o
১৬০৬ সালে মুসলিম বণিকগণ তা পশ্চিম উপকূলেও ছড়িয়ে দেন এবং ‘উনীম’ উপদ্বীপের
পৌত্তলিক জনবসতিতে ইসলামের প্রসার ঘটান। তবে এসব অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের আসল যুগ
ঊনবিংশ শতাব্দী।
o
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আদী দ্বীপ ইসলাম গ্রহণ করে।
o
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সিরাম ও গোরামের মুসলমান বণিকগণ
পুলাভা প্রভৃতি দ্বীপকে ইসলামে দীক্ষিত করেন। কাই দ্বীপে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত মুসলমানদের
নাম-নিশানাও ছিলো না। কেবল বণ্ডা দ্বীপের কতিপয় ব্যবসায়ী সেখানে থাকতেন।
o
সহসা ১৮৭৮ সালে প্রচারের কাজ শুরু হলো। মুদোরা, জাভা ও বামীর মুসলমান ব্যবসায়ীগণ অল্পদিনের
মধ্যেই কাই দ্বীপের লোকদেরকে এতবেশী করে মুসলমান বানালো যে, এখন
সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা ১৬ হাজারেরও বেশী অর্থাৎ মোট লোক সংখ্যার অর্ধেকের
কাছাকাছি।
§ মালয়
দ্বীপপুঞ্জে ইসলামের এ বিস্ময়কর সাফল্য ছয় শতাব্দীর নীরব প্রচারের ফল।
o
এ প্রচার কার্য সম্পাদন করেছেন প্রধানতঃ ব্যবসায়ীরা ও
সাধারণ পর্যটকরা।
o
তাদের কাছে কোনো তরবারীও ছিলো না, কোনো আধিপত্যকারী শক্তিও ছিলো না। ছিল শুধু
আল্লাহর দ্বীন প্রচারের এক অনিবার্য উদ্যম ও উদ্দীপনা।
o
এ উদ্দীপনার জন্যই তারা বিদেশ ভ্রমণের বিপদ ও ঝুঁকি এবং
বাণিজ্যিক লাভালাভের চরম ধনবাদী জীবনের মধ্যে ইসলামের সেবার জন্য আত্মনিবেদিত
থেকেছেন।
o
এজন্য তাদের মধ্যে এমন নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা ছিল যে, তারা অন্য সব উদ্দেশ্যকে দ্বিতীয় পর্যায়ে
রাখতেন আর ইসলাম প্রচারকে প্রাথমিক লক্ষ্য বলে গ্রহণ করতেন।
o
আধুনিক যুগেও, যখন একমাত্র আফ্রিকা ছাড়া সারা দুনিয়ার মুসলমানরা ইসলাম
প্রচারের দায়িত্ব সম্পর্কে শিথিল হয়ে গেছে, পূর্ব-ভারতীয়
দ্বীপপুঞ্জের মুসলমানদের মধ্যে এখনো এ ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ্ ও উদ্দীপনা রয়েছে।
o
আমরা দেখতে পাচ্ছি, এখনো সেখানে ব্যবসায়ীরা ছাড়াও হল্যাণ্ড সরকারের সরকারী
কর্মচারীরা পর্যন্ত ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তারা মালয়ী ভাষায়
এতবেশী সংখ্যক ইসলামী বই-পুস্তক প্রকাশ করেছেন যে, কোনো
অমুসলিম সরকারী ভাষা হিসাসে মালয়ী ভাষা শিখরে তার ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে
উপায় থাকে না। অধিকাংশ সময় তার মুসলমান হওয়া ছাড়াও গত্যন্তর থাকে না।
সাতঃ
বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের ডাক
§ ইসলাম প্রচারের
উপরোক্ত দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনার কারণঃ
১. প্রমাণ করা যে, ইসলামের ধর্মীয় ও পার্থিব শক্তির মূল উৎসঃ কল্যাণের দিকে আহবান জানানো,
সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখা।
২. দাওয়ার এই কাজের উপরই ইসলামের
গোটা জীবনী শক্তির নির্ভরতা।
৩. এই কাজের জন্যই আল্লাহ মুসলিম
নামক জাতিকে সৃষ্টি করেছেন।
৪. কোন বাণীর দাবী যখন হয়,
তা অন্য ব্যক্তির কাছে পৌছে দেয়া। তখন এই পৌছে দেয়ার কাজটি হয়
ফিতরতি দাবী। ইসলাম আল্লাহর বাণী, এই বাণী প্রেরণ করা হয়েছে
জমীনের সকল আদম সন্তানের কাছে। বিধায়,
যে সন্তানের কাছে এই বাণী পৌছবে, তার দায়িত্ব
হলো অন্য সন্তানের কাছে তা পৌছে দেয়া। এইটি আল্লাহর নির্দেশ। আদম সন্তান সেই
নির্দেশ পালনে একজন দায়িত্বশীল।
§ দাওয়ার এই
কাজটাকে সম্পাদনের জন্য মানুষকে নির্বাচিত করা হয়েছে বলে কুরআনে বলা হয়েছেঃ
كُنتُم
خَيرَ أُمَّةٍ أُخرِجَت لِلنّاسِ تَأمُرونَ بِالمَعروفِ وَتَنهَونَ عَنِ المُنكَرِ
وَتُؤمِنونَ بِاللَّهِ
“তোমরাই বিশ্বের সেই
শ্রেষ্ঠতম জাতি যাকে মানবজাতির কল্যাণের জন্য আবির্ভূত করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ দেবে,
মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী থাকবে”। (আলে
ইমরানঃ১১০)
§ দাওয়ার কাজ করার
একটি মাত্র উদ্দেশ্যে মুসলিম জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছেঃ
وَلتَكُن
مِنكُم أُمَّةٌ يَدعونَ إِلَى الخَيرِ وَيَأمُرونَ بِالمَعروفِ وَيَنهَونَ عَنِ
المُنكَرِ ۚ
“তোমাদের মধ্যে এমন
কিছু লোক অবশ্য থাকা চাই যারা কল্যাণের দিকে ডাকবে,
ভালো কাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজ থেকে বিরথ রাখবে”। (সূরা
আলে ইমরানঃ
১০৪)
§ দাওয়ার কাজের এই
দায়িত্বানুভূতি ইসলামের ১৩শ’ বছরের জীবনে বিস্ময়কর ফল দেখিয়েছে তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে দেয়া
হলো। যার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, মুসলমানিত্বের দায়িত্ব
ও কর্তব্য কি?
§ মুসলমানিত্বের
দায়িত্ব ও কর্তব্য হলোঃ
ادعُ
إِلىٰ سَبيلِ رَبِّكَ بِالحِكمَةِ وَالمَوعِظَةِ الحَسَنَةِ
“বুদ্ধিমত্তা ও উত্তম উপদেশাবলী
প্রয়োগ করে আল্লাহর পথে ডাকো”
§ এই খোদায়ী নির্দেশ
অনুসারে কেবলমাত্র উপদেশ প্রদান ও প্রচারের শক্তি দ্বারাই বিশাল এক ভূ-খণ্ডকে ইসলামের কাছে নতি স্বীকার করানো
হয়েছে। কোনো প্রকার লোভ প্রদর্শন জোর-জবরদস্তি এবং ধোঁকা-প্রতারণা ছাড়া। যার প্রমাণঃ আফ্রিকা, চীন, মালয় দ্বীপপুঞ্জ, তাতার ভূমি,
§ এই কাহিনী পেশ
করার উদ্দেশ্যঃ মুসলিম ভাইদের মধ্যেও যেন ঐ দায়িত্বানুভূতি কোনো রকমে জাগ্রত হয়।
১৮৫৭ সালের পরবর্তী
প্রচারমূলক তৎপরতা
§ ১৮৫৭ সালে
ভারতের মুসলমানরা একটি ব্যর্থ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়।
o
এই যুদ্ধ মুসলমানদের ইসলামী সম্ভ্রমবোধে আঘাত দেয়।
o
এই আঘাত মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি জাগিয়ে তুলে।
o
এর ফল হয় ১৮৮৫ সালের পর প্রায় ৪০ বছর ইসলাম প্রচারের কাজ
খুব দ্রুততর হয়।
o
অমুসলিম কর্তৃত্বে প্রভাবে সেই অনুভূতি এবং প্রচারস্পৃহা
শেষ হয়ে যায়।
o
এই প্রচারস্পৃহা পারস্পরিক দ্বন্দ তথা কুফুরী ফতোয়া, দাঙ্গা ফাসাদে রূপান্তরিত হয়।
(cjvkx hy‡×i GKk eQi ci fvi‡Zi DËi I c~e©v‡j
cÖavbZ wmcvnx‡`i †bZ…‡Z¡ †h e¨vcK mk¯¿ we‡`ªvn msNwUZ nq, Zv‡KB fvi‡Zi cÖ_g
¯^vaxbZv msMÖvg ejv nq| we‡`ªv‡ni Av¸b cÖ_g R¡‡j D‡V cwðg e‡½i e¨vivKcy‡i| 1857
wLª÷v‡ãi 29 gvP© e›`y‡Ki ¸wj Qz‡o we‡`ªv‡ni m~Pbv K‡ib g½jcv‡Û bv‡g GK wmcvnx|
`ªæZ GB we‡`ªvn Qwo‡q c‡o wgivU, Kvbcyi cvÄve, DËi cÖ‡`k, ga¨ cÖ‡`k, wenvi,
evsjvmn fvi‡Zi cÖvq me©Î| evsjv‡`‡ki XvKv, PÆMÖvg, h‡kvi, wm‡jU, Kzwgjøv,
cvebv, iscyi, w`bvRcyi, ivRkvnx GB we‡`ªv‡n kvwgj nq| we‡`ªvnxiv w`wjø `Lj K‡i
gyNj mgªvU wØZxq evnv`yi kvn‡K fviZe‡l©i ev`kv e‡j †NvlYv K‡i| Bs‡iR Mfb©i
†Rbv‡ij jW© K¨vwbs wmcvnx RbZvi GB we‡`ªvn wbôzi Ges AZ¨šÍ K‡Vvi nv‡Z `gb K‡i|
GB msMÖv‡gi m‡½ RwoZ‡`i †ewki fvM nq hy‡× kwn` nb A_ev Zuv‡`i duvwm‡Z Szwj‡q
nZ¨v Kiv nq|)
§ ১৯শ শতাব্দির
শেষ অর্ধেক সময়ে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেই সময়ে ইসলাম প্রচারের নিয়মিত কোন ব্যবস্থা ছিল না। তবুও
সেখানে নও মুসলিমের সংখ্যা বাড়তে থাকে ১০ হাজার থেকে ৬ লাখ পর্যন্ত।
১. এই বৃদ্ধির পিছনে কাজ
করে বড় একদল ওলামা ও ওয়ায়েজীন। যারা নিজেদেরকে ইসলাম প্রচারের জন্য উৎসর্গ
করেছিলেন।
o
তারা শহরে শহরে ঘুরে ঘুরে মানুষকে ইসলামে দীক্ষিত করেন।
২. সেই সময়ে সাধারণ
মুসলমানদের মাঝেও ইসলাম প্রচারের প্রেরণা জাগে। ফলে অফিসের কর্মচারী থেকে সাধারণ
দোকানদার সবাই ইসলাম প্রচারে রত হয়।
o
আনজুমানে হেমায়াতে ইসলাম-লাহোর এর রিপোর্ট অনুযায়ী, সে সময় স্কুল-মাদ্রসার শিক্ষক, সরকারী কর্মচারী,
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এমনটি একজন উট গাড়ীর চালক পর্যন্ত ইসলাম প্রচারে
রত থাকতো।
বর্তমান অবস্থা
§ এই সময়ে ইসলাম
প্রচারের ধীর গতির কারণ, আমাদের শৈথিল্য ও ধর্মীয় উদাসীনতা।
o
আগে যে ইসলাম ছিল, তা এখনো আছে।
o
ইসলামের প্রকৃতিতে কোন পরিবর্তন আসেনি।
o
আমাদের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে।
o
আমাদের চরিত্র পাল্টে গেছে।
o
আমাদের অনুভূতি বদলে গেছে।
§ সমাধানঃ
o
উপমহাদেরশে ইসলাম প্রচারের এই নাজুক সমস্যার সমাধান সভা-সমিতি, পত্র-পত্রিকা প্রকাশ, হৈ-হোল্লোড়
নয়।
o
মুসলমানদের মুসলমান বানাতে হবে।
o
মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী উদ্দীপনা ও প্রাণ শক্তির সঞ্চার
করতে হবে।
o
মুসলমানদের জীবনকে ইসলামী ছাঁচে ঢালাই করতে হবে।
o
মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান বাতিল আকীদা-বিশ্বাস, বেদাতী রসম-রেওয়াজ ও ভ্রান্ত আদত অভ্যাস দূর করতে হবে।
o
শত শত বছর মুশরিকদের সাথে বসবাস করতে করতে মুসলমানদের মধ্যে
এসব সমস্যার জন্ম হয়েছে। ধর্মীয় উদ্দীপনার সৃষ্টি করে প্রতিটি মুসলমানকে ইসলামের
সক্রিয় প্রচারকে পরিণত করতে হবে।
§ মুসলমানরা কখনও
খৃষ্টানদের মত মিশনারী সমিতি বানিয়ে ইসলাম প্রচার করেনি। তবে অবশ্যই সংঘবদ্ধতার
সাথে কাজ করতে হবে।
§ দাওয়াতের কাজ এক
বা একাধিক দলের করণীয় বিষয় নয়। বরং মুসলমানদের প্রত্যেককে এই মহতি কাজের দায়িত্বের
জন্য নিজেদেরকে দায়িত্বশীল মনে করে কাজ আরম্ভ করতে হবে।
শুধু প্রচারক দল না সর্বজনীন
প্রচার স্পৃহা?
§ সাধরণ
মুসলমানদের মধ্যে দাওয়োতের স্পৃহা ও প্রচার উদ্দীনা জাগ্রত না হলে কেবল এক বা
একাধিক সমিতিকে এই দায়িত্ব প্রদান করলে অমুসলিমদের মোকাবিলায় সফল হওয়া যাবে না।
o
ইসলাম সব জায়গায় মুসলমানদের সার্বজনীন প্রচার স্পৃহায়ই
সফলকাম হয়েছে।
o
আফ্রিকায় যদি ব্যক্তিগত দাওয়াত না দিয়ে এই দায়িত্ব কোন
সমিতিকে দিয়ে দেয়া হতো, তাহলে বহুগুণ শক্তিশালী ও বিত্তবান খৃষ্টান মিশনারী গুলোর মোকাবেলা করা
কিয়ামত পর্যন্ত সম্ভব হতো না।
o
মালয় দীপপুঞ্জে যদি সর্ব স্তরের ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের মাঝে
এই স্পৃহা না থাকতো। বরং এ দায়িত্ব যদি থাকতো মাঝে মাঝে আসা আরব, ওয়ায়েজীন ও আলেমদের উপর, তাহলে ভূমধ্য সাগরের কিনার থেকে আজতক আযানের শব্দ শোনা যেতো না।
§ ইসলাম প্রচার
ফরযে কিফায়া। একটা দল এ্ কিাজ করলে সমগ্র উম্মতের জন্য তা যথেষ্ট। কিন্তু শরীয়ার
এই উদার বিধান মুসলমানদেরকে তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব থেকে মুক্ত ও বেপরোয়া করার জন্য
নয়।
o
এই উদারতার অর্থ, দায়িত্ব সকলের। কিন্তু এমন একটা দল থাকা উচিত, যারা সব সময় ফরয হিসাবে এ দায়িত্ব পালন করবে। আর সে দলটা উলামা ও পূণ্যবাদদের দল।
§ বিধায় ইসলাম
প্রচারের সর্বোত্তম পন্থা হলোঃ
o
অমুসলিমদের ডাক দেয়ার পরিবর্তে স্বয়ং মুসলমানদেরকেই ডাক
দিতে হবে।
o
তাদের মধ্যে এমন ধর্মীয় জাগরণ ও প্রেরণার সৃষ্টি করতে হবে
যেন প্রত্যেক মুসলমান এক একজন প্রচারকে পরিণত হয়।
o
ফলাফলঃ
১. এতে করে শুধু যে ইসলাম প্রচারের
দায়িত্বই অতি উত্তমভাবে সমাধা হবে।
২. সেই সাথে আমাদের অনেকগুলো ধর্মীয় রোগও
আরোগ্য হবে।
কয়েকটি সংস্কার-প্রস্তাব
§ বিশ্বের বিভিন্ন
দেশের প্রচারাভিজ্ঞতার আলোকে যে কয়টি সংস্কার প্রক্রিয়া এ দেশে ইসলাম প্রচারে
সহায়ক হবে। তা হলোঃ
(ক) শ্রেণী বৈষম্যের বিলোপ সাধনঃ
o
হিন্দুদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশে থাকার কারণে মুসলমানদের মধ্যে
যে শ্রেণী বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে, তার বিলোপ সাধন করতে হবে।
o
ইসলামের একটি মৌলিক আকীদা হচ্ছে, কোনো মানুষ জন্মগতভাবে অপবিত্র বা নীচ নয়।
o
এ আকীদাই মুসলিম সমাজে নিখুঁত সাম্য এনে দিয়েছে এবং এ বিশ্বাসই
তার সাফল্যের এক বিরাট কারণ।
o
এখন এ নীতিটাকে পুনরায় আমাদের সকল ব্যাপারে একটা মৌলিন নীতি
হিসেবে গণ্য করতে হবে।
(খ)
বংশগত বৈষম্যের বিলোপ সাধনঃ
o
আমাদের দেশে সাধারণভাবে নও-মুসলিমদের, যারা পুরুষানুক্রমিকভাবে মুসলমান–তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট মনে করা হয়। এটা সম্পূর্ণ অনৈসলামী আচরণ।
o
এটা অত্যন্ত কঠোরভাবে নির্মূল করতে হবে।
o
নও-মুসলিম স্ত্রী ও পুরুষের সাথে বিয়ে-শাদীর প্রথা
পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।
o
আমাদের দেশের অভিজাত লোকেরা এটা এড়িয়ে চলেন। কিন্তু আমাদের
শ্রেষ্ঠতম অভিজাত ব্যক্তিও নিজেকে হযরত রসূলুল্লাহ (স)-এর চেয়ে অভিজাত বলে দাবী
করতে পারে না
§ যিনি দু’জন নও-মুসলিম হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) এবং
হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর মেয়ে বিয়ে করেছিলেন।
§ অন্য দু’জন নও-মুসলিম হযরত ওসমান (রা) ও হযরত আলী
(রা)-কে নিজের মেয়ে দিয়েছিলেন।
(গ)
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের উজ্জীবনঃ
o
মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী সৌভ্রাতৃত্বের মনোভাব জাগিয়ে তুলতে
হবে যেন অমুসলিমরা তা দেখে ইসলামী সমাজে প্রবেশ করতে আগ্রহী হয়।
(ঘ)
সাধারণ ধর্মীয় ও নৈতিক অবস্থার সংশোধনঃ
o
মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ জীবনের সংশোধনের জন্য হয়তো বা কোনো
গভীরতর সংস্কার আন্দোলনের প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু অন্ততঃপক্ষে তাদের বাহ্যিক
জীবনে এতটা চমক সৃষ্টি করা আবশ্যক যাতে করে অমুসলিমরা আপনা থেকেই তাদের দিকে
আকৃষ্ট হয়।
o
উদাহরণ স্বরূপ, জামায়ত সহকারে নামায পড়া ও রোযা রাখা, শেরকী
ও বেদাতী রসম-রেওয়াজ ও শরীয়তের নিষিদ্ধ সমস্ত কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার জন্য
সবাইকে উপদেশ দিতে হবে, বিশেষতঃ মুসলমানদের মধ্যে নৈতিক
অপরাধ নির্মূল করার সর্বাত্মক চেষ্টা চারাতে হবে।
o
কেননা মুসলমানদের নৈতিক অবস্থা উন্নত হলে অমুসলিমদের মনে
তাদের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব জাগবে।
(ঙ)
ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ও প্রচারমূলক তৎপরতায় উৎসাহ প্রদানঃ
o
জুমআর দিনের ওয়াজ, নৈশ সভা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে
মুসলমাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে।
o
ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের পার্থক্য সহজ তুলনামূলক আলোচনার
মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে।
o
বিশেষতঃ শিক্ষক, সরকারী কর্মচারী ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে এ আন্দোলন চালু
করা খুবই ফলপ্রসু।
o
কেননা তারা জনগণের সাথে বেশী করে মেলামেশা করার সুযোগ পান
এবং তার অত্যন্ত সফলতার সাথে প্রচারের কাজ চালাতে সক্ষম।
শেষ কথা
§ এ কাজ করতে হলেঃ
o
আমাদের ওলামা ও পীর সাহেবানদের নিজ নিজ হুজরা ও খানকা থেকে
বেরুতে হবে।
o
ওলামাদের দায়িত্ব ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। কুরআনে
তাদেরকে যে ‘খোদাভীরু’
খেতাব দেয়া হয়েছে এবং হাদীসে যে তাদেরকে বনী ইসরাঈলের নবীদের সাথে
তুলনা করা হয়েছে –সেই মূল্যমান মর্যাদা তাদেরকে এমনিতেই দেয়া
হয়নি। বরং তাদের ওপর এ উম্মতের সংশোধন ও হেদায়াতের এক অতি বড় দায়িত্ব অর্পণ করা
হয়েছে। সে দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র ত্রুটি হলেও তাঁরা আল্লাহর কঠোর পাকড়াও থেকে
রেহাই পাবেন না।
o
আমি হযরত পীর সাহেবান ও সুফী সাহেবানদেরকেও তাঁদের
গুরুদায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
§ আজ তারা যে
মহিমান্বিত আসনগুলোতে সমাসীন, সে গুলেঅ একদিন আল্লাহর বান্দাদেরকে আল্লাহর পথে ডাকার মহান কাজেই নিয়োজিত
ছিল।
§ তারা শুধু তাদের
পূর্ববর্তীদের আধ্যাত্মিক মহত্ব ও পার্থিব লাভেরই উত্তরাধিকারী নন, বরং তারা অনেকগুলো দায়িত্ব ও কর্তব্যেরও
উত্তরাধিকারী।
§ এ দায়িত্ব ও
কর্তব্যের অনুভূতি পূর্ববর্তী সুফি ও পীর সাহেবানদের মধ্যে এত তীব্র ছিল যে, তারা অন্য কোনো বিষয়ের কথা ভাবতেও অবসর
পেতেন না।
§ একজন মুসলমানকে
মুরিদ করার পর তার সংশোধনের ব্যাপারে যে দায়িত্ব পীর সাহেবানদের ওপর অর্পিত হয় তা
যদি এখনো তারা অনুভব করেন তাহলে মুসলমানদের বহু সমস্যার সমাধান হতে পারে।
§ বড় বড় গদ্দীনশীন
ও পীর সাহেবানদের মুরিদদের সংখ্যা কমপক্ষে এক থেকে দেড় কোটি হবে। এই বিপুল সংখ্যক
মুসলমানের ওপর তাদের এমক প্রভাব যে, তাদের ইশারাই তাদের চরিত্র ও জবিনকে পাল্টে দিতে পারেন,
এত বিপুল সংখ্যক মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী প্রেরণার সৃষ্টি করতে
পারলে মাত্র কয়েখ বছরে এ দেশের চেহারাই পাল্টে যেতে পারে।
o
এমতাবস্থায় এই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিগণ তাদের শান্তির নীড় থেকে
বেরিয়ে এই দুর্যোগ মুহুর্তে আল্লাহ ও তার সত্য দ্বীনের জন্য কিছু পরিশ্রম করবেন এ
আশা কি আমরা করতে পারি না?
দ্বিতীয় খণ্ড
ইসলামের উপর বাতিলের হামলা ও তার কারণ
এ দেশের খৃষ্টান মিশনারীরা এ দেশের
মুসলমানদেরকে খৃষ্ট ধর্মের দিকে আহবান জানানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে সম্প্রতি কতিপয়
প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন। সেসব প্রস্তাব পত্র-পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। এগুরো পড়ে
পাঠকদের মধ্যে কয়ঝন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে কার্যকর পদক্ষেপের উদ্যোগী হয়েছেন আর
কয়জনই বা ঈষৎ পরিতাপ করে আমার নিজ কাজে মন দিয়েছেন তা আমি জানি না । তবে একথা সত্য
যে, হৈ-হল্লা করার প্রবণতা
আমাদের একটা মজ্জাগগত ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল আমাদের এরূপ অভ্যাস হয়ে গেছে যে,
যখনই বিরোধীদের কোনো বড় হামলা বা বিশেষ পরিকল্পনার খবর আমরা পাই তখন
সহসাই চমকে উঠি এবং বেশামাল ও উদ্বেগাকুল অবস্থায় কিছু অগোচাল ধরনের পদক্ষেপও নিয়ে
বসি। আমর যে-ই বিপদ একটু কমে যায় অমনি নিশ্চিত হয়ে বসে পড়ি। খৃষ্টান মিশনার ও আর্য
প্রচারকদের নিজ নিজ ধর্ম প্রচারের ৫০ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। এ দীর্ঘ সময় ধরে তারা
অত্যন্ত নীরবে কাজ করেছে। এমন একটি বছর যায়নি যখন তারা নতুন কিছু সংখ্যক লোককে
স্বধর্মে দীক্ষিত করেনি। কিন্তু আমরা তাদের নীরবতাকে নিজেদের মত নিষ্ক্রিয়তার
লক্ষণ মনে করেছি এবং কখনো নিজেদের রক্ষার ব্যবস্থা করিনি। আমাদের অবস্থা মারেবের
গ্রামবাসীদের মত। নিজেদের পিতৃ-পুরুষদের বানানো বাঁধকে তারা দেবতাদের নির্মিত বাঁধ
মনে করতো। তারা ভাবতো, ঐ বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়া বা দুর্বল হওয়া
সম্ভব নয় যখন ইঁদুর বাঁধে ছিদ্র করতে শুরু করতো তখনও তারা এই ভেবে নিশ্চিত হয়ে বসে
রইরো যে, দেবতাদের নির্মিত এ বাঁধ ভাঙ্গা ইঁদুরের কাজ নয়।
কিন্তু সেই ইঁদুরগুরো বহু বছর ধরে একাধিক্রমে চেষ্টা চালিয়ে এতটা সফলতা লাভ করলো
যে বাঁধ থেকে পানি চুইয়ে পড়তে লাগলো। পরে কিছুটা পানির প্রবলতায় ও কিছুটা
প্রাচীরের ভাঙ্গনে এমন ফল হলো যে, একদিন সহসা বাঁধ একেবারেই
ভেঙ্গে পড়রো এবং দূর-দূরান্তের জনবসতিগুরো পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে গেল। আমাদের দশাও সেই
রকম। ইসলামের বাঁধ ভীষণ মজবুত বলে আমাদের একটা ভরসা আছে। বস্তুতঃ সে ভরসা থাকাও
উচিত। কিন্তু আমাদের নিজেদের ত্রুটির কারণে সেই বাঁধকে দুর্বল বানিয়ে ফেলছি। তার
ফলে ইঁদুরেরা এর মধ্যে ছিদ্র করার চেষ্টা করছে এবং কিছু কিছু সফলও হচ্ছে।
অন্যদের সাফল্য আমাদের অযোগ্যতারই ফল
আমাদের ভেবে দেখা উচিত যে, কি কারণে আর্যপ্রচারকগণ ও খৃষ্টান
মিশনারীরা আমাদের মোকাবিলা করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারছে। তাদের ধর্মকে যাঁচাই বাছাই
করে দেখুন, দেখবেন তা এমন সব হাস্যকর রীতিনীতির সমাবেশ যা
তারা আমাদের কাছে পেশ করা তো দূরের কথা নিজেরা কখনো এগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে
বসরো নিজেরাই লজ্জা পাবে। তাহলে এহেন অচল পণ্য নিয়ে তারা কিভাবে বাজারে আসছে এবং
কেমন করেই বা সফলতা লাভ করছে? এর একটা কারণ তো থাকা চাই। এ
প্রশ্নের ব্যাপারে চিন্তা করলে স্পষ্টতই মনে হয় যে, তাদের এ
সাফল্য তাদের যোগ্যতার নয় আমাদের অযোগ্যতার ফল। তাদের বাণিজ্যের এ চাকচিক্য এজন্য
নয় যে, তাদের পণ্য ভালো এবং বাজারে তার চাহিদা আছে। বরং এটা
শুধু এজন্য বিক্রি হচ্ছে যে, বাজারে আমাদের পণ্যের কদর আমরাই
নষ্ট করেছি। এটা আমাদের সুনিশ্চিত বিশ্বাস যে, কোনো ব্যক্তি
একবার ইসলামের দীক্ষা নিলে পৃথিবীর কোনো শক্তি তাকে এ সত্য ধর্ম থেকে বিচ্যুত করতে
পারে না। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা যদি পেশ করাই না হয় সাদারণ মুসলমানদের কাছে কেবল
ঐতিহ্যগত ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ইসলামই যদি থেকে যায় এবং তাদেরকে ইসলামের
শ্রেষ্ঠত্ব যদি বুঝানো না হয় তাহলে এর দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব সম্পর্কে ভরসা করা যায়
কিভাবে? আর ভরসা করলেও সে ভরসা টিকবার নিশ্চয়তা কোথায়?
বিপদের মূল কারণঃ আমাদের ধর্মীয় দুর্যোগাদির স্থায়ী উৎস
একটু গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা কররে বোঝা
যাবে যে, একমাত্র আমাদের দুর্বলতার জন্যই অমুসলিম প্রচারকরা মুসরমান সমাজে নিজ
ধর্মের প্রচার চালানোর ও তাদেরকে ধর্মান্তরিত করার ধৃষ্টতা দেখিয়ে থাকে। আমাদের
মধ্যে যতদিন এসব দুর্বলতা ও ত্রুটি থাকবে ততদিন এ বিপদের ঝুঁকিও থাকবে। আমাদের
হতভাগা শ্রবণেন্দ্রীয় নিয়তই এরূপ খবর শুনতে থাকবে যে. আজ অমুক জায়গায় আর্য ও
খৃষ্টানদের হামলা হয়েছে, আজ অমুক জায়গায় মুসলমানরা
বিধর্মীদের টোপের শিকার হয়েছে। সাময়িকভাবে এসব বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য
ভাসাভাসা কতিপয় কর্মপন্থা গ্রহণ করা এবং তারপর নিশ্চিত হয়ে বসে থাকার এ ব্যাধি দূর
হবে না। বরং এতে করে কিছুদিন পর এমন অবস্থা হবার আশংকা রয়েছে যে, আমরা এসব খবর শুনতে অভ্যস্ত হয়ে যাব এবং এদিকে মনোযোগ দেয়াই বন্ধ করে দেব।
এর যদি কোনো কার্যকর প্রতিকার করতে হয় তবে আমাদের মূল দুর্বলতাগুরোর চিকিৎসায়
মনোযোগী হতে হবে এবং তাকে স্থায়ীভাবে নির্মূল করার জন্য কাযৃকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
এতে করে আমাদের মধ্য থেকে সেই মূল বস্তুটাই দূর হয়ে যাবে যা দুশমনদেরকে আমাদের উপর
হামলা চালানোর উৎসাহ যোগায়। আমার দৃষ্টিতে আমাদের এ দুর্বলতা তিন রকমের এবং এগুলোই
সমস্ত অকল্যাণের মূল উৎসঃ
(১) অজ্ঞতা
প্রথমতঃ মুসলমানদের একটি বিরাট অংশ অজ্ঞ
ও মূর্খ। বিশেষতঃ ইসলামের ব্যাপারে তাদের অজ্হতা এমন পর্যায়ে যে, অনেকে কলেমা পড়াও জানে না। সত্রি বলতে কি,
মুসলমান পরিবারে জন্মেও অনেকে নামের মুসলমানও নেই। এজন্য এ ধরনের
লোকদেরকে শত্রুরা সহজেই ইসলাম থেকে বিচ্যুৎ করতে সক্ষম।
(২) দারিদ্র
দ্বিতীয়তঃ মুসলমানরা সীমাতিরিক্ত দরিদ্র।
অজ্ঞতা ও দারিদ্র একাকার হয়ে তাদেরকে বিত্তশালী অমুসলিম প্রচারকদের আক্রমনের সহজ
শিকার বানিয়ে দেয়।
(৩) ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা
তৃতীয়তঃ মুসলমানদের নিজস্ব শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা হেতু তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে মিশনারী শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে হয়। সেখানে তাদের সরল মনের উপর শিশুকাল থেকেই খৃষ্টবাদের ছাপ
পড়তে আরম্ভ করে। পরবর্তীকালে এ ছাপই গোপন কিংবা প্রকাশ্য ধর্মান্তরিত হওয়ার সহায়ক
হয়।
এই হলো আমাদের ধর্মীয় বিভ্রান্তির স্থায়ী
উৎস।–[এটা ১৯২৫ সালের
পর্যবেক্ষণের ফল। সতর্ক বিচার-বিবেচনায় দেখা যাবে, এ যুগেও
কম-বেশী এগুরোই মুসলমানদের ধর্মীয় অনগ্রসরতা ও বিভ্রান্তির মূল উৎস।-অনুবাদক] এ
বিভ্রান্তির কারণ এতো অধিক সংখ্যক যে, তা গুণে শেষ করা যায়
না এবং এখানে তার বিস্তারিত আলোচনাও সম্ভব নয়। তবে মোটামুটিভাবে বলা যায়, এর মধ্যে কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক জিনিস হলো নিম্নরূপঃ
মুসলমানদের পরাধীনতা, আলেম সমাজের উদাসীনতা, মুসলিম সমাজে অনৈসলামী রসম-রেওয়াজের প্রচলন, বিশ্ব
মুসলিম শক্তির বহুধা বিচ্ছিন্নতা এবং টাকা-পয়সার শক্তি সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যে
বাস্তব অনুভূতির অভাব –যা তাদের দারিদ্র বৃদ্ধির প্রধান
অন্যতম কারণ।
আমাদের সরলতা ও অদূরদর্শিতা বনাম শত্রুদের চতুরতা ও দূরদর্শিতা
উল্লেখিত করণসমূহ ও দুর্বলতাসমূহের মধ্যে
একটিও এমন নয় যার জন্য আমরা নিজেদের ছাড়া কাউকে দোষারোপ করতে পারি। এর কোনোটিরই
উৎস আমাদের বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে নয়। এখন এগুরোর প্রতিরোধের জন্য যদি আমরা
প্রচারাভযান চারাই অথবা সেমিনার সিম্পজিয়াম অনুষ্ঠিত করি অথবা সেমিনার সিম্পজিয়াম
অনুষ্ঠিত করি অথবা যেসব জায়গায় মুসলমানরা ইসলাম তেকে বিপথগামী হচ্ছে সেখানে আমাদের
প্রচারকদের পাঠিয়ে দেই, তাহলে তাতে করে বর্তমান রোগের চিকিৎসা হবে না, ভবিষ্যতের
রোগ থেকেও নিরাপত্তা লাভ করা যাবে না। অথচ এ ধরনের কাজই আমরা এ যাবত করে আসছি।
আমাদের বিরুদ্ধবাদীদের কর্মপদ্ধীত যদি এ রকম হতো, তাহলে হয়তো
এভাবে আমরা কিছুটা সফলকাম হতে পারতাম। কিন্তু তারা তো প্রচারাভিযান ও ওয়াজ-নছিহত
শুধু আমাদেরকে কর্মব্যস্ত করাকার জন্য একটা চক্রান্ত হিসেবে করে থাকে। নচেৎ আসলে
তাদের কর্মপদ্ধীত সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাসত্ব,
আমাদের আলেম সমাজের উদাসীনতা, আমাদের জাতীয়
অনৈক্য, আমাদের অন্য সমম্ত দুর্বলতাকে পুরোপুরিভাবেই কাজে
লাগায়। তারা হাজার হাজার হাসপাতাল স্থাপন করেছে। সেখানে নিজ ধর্মের প্রচার চালিয়ে
থাকে। তারা হাজার হাজার এতিমখানা খুলছে। সেখানে অসংখ্য এতিম বালক-বালিকাদেরকে
খৃষ্টবাদের ট্যাবলেট গেলানো হয়। তারা তাদের কার্যক্রমকে এতটা নিখুঁত করে তৈরী করে
রেখেছে যে, যেখানেই দুর্ভিক্ষ কিংবা অন্য কোন প্রকৃতিক
দুর্যোগ দেখা দেয়, সেখানে সমস্ত নিরাশ্রয় লোকদেরকে আশ্রয় দেয়,
ভাত-কাপড়ের রিলিফ দেয়ার মাধ্যমে নিজ ধর্ম প্রচার করে থাকে। তারা
সারা ভারতবর্ষে হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। সেখানে অতি ধীরে ধীরে
ও পর্যায়ক্রমে বালক বালিকাদেরকে ধর্মান্তরিত হতে উৎসাহিত করা হয়। তারা নিজেদের
মধ্যে এমন ধৈর্য ও স্থিরতা, এতটা ত্যাগ ও সেবার মনোবাব এবং
এমন সাচ্চা ধর্মীয় নিষ্ঠা গড়ে তুলেছে যে, তারা বছরের পর বছর
এক জায়গায় চরম একাকীত্ব ও বৈরাগ্যে অবস্থান কাটিয়ে দেয়। তারা যোগী-সন্যাসী ও
ফকীর-দরবেশদের জীবন-যাপন করে এবং অতি নীরবে লোকদের মধ্যে নিজ ধর্মের প্রচার চালায়।
তাদের মধ্যে এমন গভীর বুদ্ধিমত্তা বিদ্যমান যে, একেবারে
খালেছভাবে না হলেও অন্ততঃপক্ষে কৃত্রিমভাবে লোকদের সামনে উঁচু মানের পরহেজগারীমূলক
এবং সরল ও অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করে এবং এমন উন্নত নৈতিক চরিত্র জাহির করে থাকে যে,
মৌখিক ও ছাপানো উপদেশের চেয়ে তাদের বাস্তব সদাচরণই বেশী করে প্রচার
মাধ্যমের রূপ পরিগ্রহ করে। তদুপরি আমাদের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তারা আমাদের উপর
অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করে থাকে। এ কর্মপদ্ধতি কতখানি গভীর ও কার্যকর তা বুঝতে
কারোই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ যেন এক ভয়াবহ বন্যার তাণ্ডব যা এক সাথে ভীষণ শব্দও
করে, দালান কোঠাও ভেঙ্গে চুরে গুড়িয়ে দেয় এবং বড় বড়
প্রাসাদের ভিত্তিও ধ্বসিয়ে দেয়। এর মোকাবিলায় মামুলি তকতা দিয়ে বাঁধ দিলে কিংবা
অনুরূপ কোনো লেপপোচ দিলে তাতে কোনো কাজ হয় না। এজন্য আমাদেরকেও বিরুদ্ধবাদীদের মতই
গভীর ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নচেৎ আমাদের আত্মরক্ষা চেষ্টার সাফল্য
অসম্ভব।
প্রতিরক্ষার উপায়
মুসলমান সমাজের যেসব আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা
ও অন্যান্য যেসব অসুবিধার দরুন ভবিষ্যতে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম একেবারে খতম না
হয়ে গেলেও তার অত্যণ্ত অসহায় অবস্থায় পতিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমি ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি।
আমি ঐ সাথে পাঠকগণের সামনে ইসলামের শত্রুরা ইসলামের শক্তি চূর্ণ করার জন্য যেসব
গভীর ও অত্যন্ত কার্যকর চক্রান্ত চালাচ্ছে, তাও তুলে ধরেছি।
সেই আলোচনায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আমরাও যতক্ষণ এমনি
ধরনের সুদূর প্রসারী ও কার্যকর কৌশল গ্রহণ না করি ততক্ষণ আমাদের ইসলামের রক্ষায় ও
প্রসারে সাফল্য অর্জন করা অসম্ভব। এখন সেই রক্ষা ব্যবস্থা কি রকম হওয়া উচিত,
কি কি কৌশল আমাদের গ্রহণ করা উচিত তাই নিয়ে আলোচনা করবো।
১-ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক
প্রসার ও ধর্মীয় প্রেরণার উজ্জীবন
আমি আগেই বলেছি, অজ্ঞতাই আমাদের প্রধানতম দুর্বলতা।
মুসলমানদের একটি বিরাট অংশ নিজেদের ধর্মের শিক্ষা এবং তার আকীদা ও আইনগত
অনুশীলনাদি সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। এটাই তাদেরকে ধর্মচ্যুত করার ব্যাপারে
শত্রুদের সবচেয়ে বেশী সহায়ক। এদিক থেকে আমাদের প্রথম প্রয়োজন হলো
ভারতবর্ষের-[এখানে ১৯২৫ সালের অবিভক্ত ভারতের কথা বলা হয়েছে।-অনুবাদক] সমস্ত অজ্ঞ
মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের শিক্ষার প্রসার ঘটানো –ইসলামের
সহজবোধ্য আকীদাসমূহ তাদের মনে বদ্ধমূল করে দেয়া দরকার এবং তাদের মধ্যে এতটা ধর্মীয়
প্রেরণার সৃষ্টি করা দরকার যেন তারা নামায-রোযার পাবন্দ হয়ে যায়। এজন্য আমাদেরকে সাধারণভাবে গ্রামাঞ্চলে ও ছোট ছোট
শহরমোকামগুলোতে একজন করে এমন লোক নিয়োগ করতে হবে যিতি জনগণকে তাদের অবসর সময়ে
অত্যন্ত ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে ধর্মীয় শিক্ষা দিতে পারেন এবং তাদের বোধগম্য
ভাষাতে তাদেরকে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো ও তার উপকারিতা বুঝিয়ে দিতে পারেন। যদিও এই সাথে অমুসলিমদেরকেও দাওয়াত
দেয়া যেতে পারে। তবে আপাততঃ আমাদের পূর্ণ মনোযোগ দিতে হেব কাফেরদের মুসলমান
বানানোর পরিবর্তে মুসলমানদেরকে খাঁটি মুসলমান বানানোর দিকে। মুসলমানদের ঘুমন্ত
ধর্মীয় প্রেরণাকে জাগিয়ে তুলতে পারলে আমরা আমাদের আভ্যন্তরীণ সমাজ কাঠামোকে
বহিরাগতদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত করে দিতে পারবো। তারপর অন্যদের দিকে মনোযোগ দেয়ার
জন্য আমরা অধিকতর সুযোগ পাব।
২-প্রাথমিক ধর্মীয় বিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠা
এই সাথেই দ্বিতীয় যে জিনিসটি প্রয়োজন
তাহলো, মুসলমান বালক
বালিকাদেরকে প্রাথবিম ধর্মীয় শিক্ষা দেয়ার জন্য গ্রামে গ্রামে প্রতিষ্ঠান গড়ে
তুলতে হবে। এজন্য কোনো লম্বা-চওড়া বিধি-ব্যবস্থা বা কোনো বিশেষ শিক্ষা কারিকুলামের
প্রয়োজন হয় না। তাদেরকে মুসলমান বানানোর জন্য শুধু এটুকু যথেষ্ট যে, খুব সহজ ভাষায় ইসলামী আকীদাসমূহ তাদের মনে বদ্ধমূল করিয়ে দিতে হবে। ওযু, মলমূত্র থেকে পবিত্রতা অর্জন, নামায, রোযা প্রভৃতি সম্পর্কে সাধারণ মাসলাসমূহ মুখস্ত করিয়ে দিতে হবে এবং কুরআন
মজিদ পড়াতে হবে। কুরআন শরীফ শুধু তোতা পাখীল মত পড়াতেই মানুষের ওপর এমন প্রভাব পড়ে
যে, মনের ওপর ইসলামের মহত্বের ছাপ পড়ে যায় এবং তারপর সেই
প্রভাব দূর করা সহজসাধ্য হয় না। সুতরাং আমাদের শিশুদেরকে কার্যকর শিক্ষা দেয়ার
ক্ষমতা যদি আমাদের না হয়, তাহলে তাদের
কোমল মনে অন্ততঃ কুরআনের ছাপ বসিয়ে দেয়াই উচিত যাতে তাদের ওপর কুফরীর যাদুর প্রভাব
না হয়।
এটা হলো সর্বনিম্ন অত্যাবশ্যকীয় কাজ।
এটুকু কাজ করতে আমাদের বিন্দুমাত্রও বিলম্ব না করা উচিত। এ কাজের জন্য আলাদা
মুবাল্লিগ বাহিনী সফরে পাঠানো কোনো স্বার্থকতা নেই। বরং এমন রোকের দরকার যারা
স্থায়ীভাবে এক জায়গায় থাকবে এবং আর্য মিশনারীদের মত গ্রামীণ জীবনের কষ্ট সহ্য করে
পূর্ণ নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার সাথে ইসলামের খেদমত করতে পারবে। তাদের মধ্যে এতটা মহনশীলতা
থাকা প্রয়োজন যেন সাফল্যের সাথে লোকদের মূর্খজনোচিত আচরণের মোকাবিলা করতে পারে।
প্রাথবিম ব্যর্থতায় যেন তারা হিম্মতহারা না হয়। শেরেকী ও বেদাতী রসম-রেওয়াজ দূর
করতে যদি কয়েক বছরও লেগে যায় তবুও যেন মনোবল না হারায় এবং তাড়াহুড়া করতে গিয়ে মূর্খদের
সাথে যুদ্ধ না করে দেয়। বরং ধীরে উপদেশ দান, শিক্ষাদান ও প্রচারের মাধ্যমে মানুষের মনকে চরিত্র সংশোধনের
প্রতি আগ্রহী করে তোলে। এই সাথে তাদের মধ্যে এতটা ত্যাগের মনোভাবও থাকা উচিত যেন
তারা এই দরিদ্র জাতির কাছ থেকে ইসলামের খেদমতের জন্য যথাসাধ্য কম পারিশ্রকিম নেয়।
জানা কথা যে, খৃষ্টানদের মত কোটি কোটি টাকা পানির মত গড়িয়ে
দেবে, সে সামর্থ এ জাতির নেই। তাদের নৈতিক চরিত্র এতটা
পূতপবিত্র হওয়া চাই যেন সরলমতি গ্রামবাসী তাদের কাজ দেখে বিরূপ না হয়। বরং তাদের
মহৎ চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তারা যেন নিজেদের মধ্যে এমন ইসলামী
চরিত্রের নমুনা পেশ করতে পারে যেন লোকেরা তাদের কাছ থেকে ইসলামী আখলাকের বাস্তব
শিক্ষা পায়।
৩-প্রাকৃতিক দুর্যোগের
উপদ্রুতদের পুনর্বাসনের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা
এতক্ষণ যা আলোচিত হলো, তা ছিল প্রথম স্তরের কাজ। এরপর দ্বিতীয়
স্তর হলো, মুসলমানদের প্রাকৃতিক দুর্যোগাদির ক্ষতিকর প্রভাব
থেকে রক্ষা করার জন্য আঞ্চলিক পুনর্বাসন ব্যবস্থা কায়েম করা। এ ব্যবস্থা না থাকার
কারণেই উপদ্রুত মুসলমানেরা খৃষ্টান ও আর্য প্রচারকদের করুণার উপর র্নিভরশীল হয়ে
পড়ে। উদাহরণ স্বরূপ, দুর্ভিক্ষ ও বন্যার সময় হাজার হাজার
পুরুষ, স্ত্রী ও ভিশু গৃহহারা হয়ে পড়ে। সেই বিপদের সময়
তাদেরকে আশ্রয় দেয়ার কেউ থাকে না। তাই বাধ্য হয়ে তাদের ধর্ম ও ঈমান বেচে দিয়ে
বিত্তশালী খৃষ্টান মিশনারীদের কাছ থেকে পেট বাঁচানোর জন্য ভাত ও লজ্জা ঢাকার জন্য
কাপড় সংগ্রহ করতে হয়। এভাবে যেসব শিমুর অভিভাবক নেই তারা কেবল আশ্রয়ের অভাবে
দিন-রাত ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়ায় এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তারা খৃষ্টান অথবা আর্য
প্রচারকদের এতিমখানায় আশ্রয় পায়। ইসলামের শত্রুদের পক্ষ থেকে পরিচালিত
মুসলমানদেরকে ধর্মচ্যুত করার ষড়যন্ত্রের এর চিরন্তর শিকার। কেবলমাত্র মুসলমানদের
উদাসীনতাই এ কোমলমতি বালকদেরকে ইসলামের কোল থেকে ছিনিয়ে কুফরীর আবর্তে নিক্ষেপ
করে। এদেরকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করতে হলে স্থায়ী অনাথাশ্রমের প্রয়োজন। অবশ্য খুব
ব্যাপক ভিত্তিক একটা ব্যবস্থা যে নিতেই হবে –এমন কথা বলা
হচ্ছে না। তাদেরকে মিশনারীদের খপ্পরে পড়া থেকে বাঁচানো যায়, আপাততঃ
এতটুকু ব্যবস্থাই যথেষ্ট। অবশ্য তাদেরকে কিছু কাজ দেয়ার এবং কাজ করার যোগ্য করে
গড়ে তোলার জন্য কি ব্যবস্থা করা যায়, সেটা আলাদাভাবে বিবেচনা
করতে হবে। আপাততঃ আমাদের লক্ষ্য শুধু এটুকু হওয়া উচিত যে, তাদের
ইসলামকে রক্ষা করতে হবে। সেটা এভাবে সম্ভব হতে পারে যে, তাদেরকে
মুসলিম পরিবারসমূহের আশ্রয়ে দিয়ে দিতে হবে। আর এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, সেসব পরিবারে তারা যেন দাসসুলভ ব্যবহার না পায় বরং খেদমতগারের মত সদয়
ব্যবহার পায়। আরযদি কেউ কারিগরি কাজ জানে তবে তাকে কোনো কাজে লাঘিয়ে দেয়া যেতে
পারে। একথা নিসন্দেহে বলা যায় যে, ইয়াতীম ও অনাথদের এ অবস্থা
কিছুতেই সহনীয় নয়। কিন্তু যদি আমাদের জাতির মধ্যে এতটুকু অনুভূতি না থেকে থাকে
যাতে করে তারা তাদের শিশু কিশোরদের লালন-পালনের উত্তম ব্যভস্থা করতে পারে তাহলেও
এটা সুনিশ্চিত সত্য যে, একজন মুসলমান কিশোরের মুসলমান
অবস্থায় খেদমতগার হওয়া, কুফরী বরণ করে নিয়ে ব্যাপিষ্টার
হওয়ার চেয়ে বহুগুণ শ্রেয়।
৪-মিশনারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
বয়কট করা
একটা জরুরী কাজ হলো, মুসলমান ছেলেদের মিশনারী স্কুল ও কলেজ থেকে
তুলে আনার একটা জোরদার আন্দোলন চালাতে হবে। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য
জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো বিস্তার করা নয়। এদের উদ্দেশ্য হলো, বালক-বালিকাদেরকে
তাদের ধর্ম থেকে বিচ্যত করে সেন্টপলের মনগড়া ধর্ম খৃষ্টবাদে দীক্ষিত করা।
সাধারণভাবে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করার অনিবার্য ফল এই দাঁড়ায় যে,
ছাত্ররা যদি প্রকাশ্যতঃ ইসলাম ত্যাগ নাও করে তথাপি অন্ততঃ পক্ষে নিজ
ধর্মের প্রতি বিমুখ হয়ই। তাদের মনে ইসলামের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাই আর অবশিষ্ট থাকে
না। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস থেকে তারা স্পষ্টতই দূরে সরে যায়। ইবাদাতকে তারা খেলা
মনে করতে আরম্ভ করে। ইসলামী বিধানকে খোলাখুলিভাবে লংঘন করে। শুধুমাত্র বংশগত সম্পক
ও সামাজিক প্রতিরোধের মুখে তাদের ইসলামের সাথে নামমাত্র সম্পর্ক থাকে। একথা সত্য
যে, মিঃ আরনল্ডের অভিজ্ঞতা অনুসারে মিশনারী শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা অর্জন কোনো কোনো সময় সম্পূর্ণ বিপরীত ফলও দর্শিয়েছে। কোনো কোনো
ছাত্র খৃষ্ট ধর্মের দোষ-ত্রুটি জানতে পেরে তারা আরো প্রবল বিরোধী হয়ে গেছে। কিন্তু এমন ভাগ্যবান পুণ্যাত্মার সংখ্যা খুবই কম।
সাধারণভাবে মিশনারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুরোর ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থা, আমরা যা উপরে আলোচনা করেছি তাই। তাদেরকে এ
ধর্মহীনতার বিপদ থেকে নিষ্কৃতি দেয়া নিশ্চয়ই ইসলামের এক অতি বড় সেবার কাজ।
এ ধরনের আন্দোলনের বিপক্ষে একটি যুক্তি
দর্শানো হয়ে থাকে। বলা হয়, মুসলমানরা এমনিই শিক্ষা-দীক্ষায় পেছনে পড়ে আছে এবং তাদের মধ্যে এর কোনো
ভালো ব্যবস্থা নেই। এরপর যদি মিশনারী স্কুল-কলেজও বয়কট করা হয় তাহলে আমাদের ছেলেরা
পড়বে কোথায়? কিন্তু আমার কথা হলো, মিশনারী
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘাটতি বর্তমান ইসলামী ও সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পূরণ করতে
পারে। বস্তুতঃ এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা তাদের প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেকগুণ উত্তম।
কিন্তু সেখানে যদি ঐ ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নাও হয় তথাপি একজন খাঁটি মুসলমানের
দৃষ্টিভঙ্গিতে নিছক উচ্চ শিক্ষার খাতিরে ধর্মকে বিসর্জন দেয়া যেতে পারে না।
মুসলমানদের উচ্চ শিক্ষা অর্জন করার জন্য যদি মিশনারী প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়া আর কোনো
উপায় না থাকে, তবে তেমন উচ্চ শিক্ষা অর্জন করার চেয়ে বর্জন
করাই উত্তম। কেননা আমাদের শিশুদের অজ্ঞ থেকে যাওয়ার চেয়ে তাদের ইসলাম থেকে দূরে
সরে যাওয়া অনেক বড় আপদ। সুতরাং মিশনারী মিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর
বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালানো প্রয়োজন। শুধু প্রচারাভিযানই যথেষ্ট নয়, প্রত্যেক মুসলমান যাতে নিজ নিজ ছেলেমেয়েদের
ঐসব প্রতিষ্ঠান থেকে তুলে আনে সে জন্যও তাদেরকে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে।
৫-অর্থনৈতিক দাসত্ব থেকে
মুক্তি
সর্বশেষ কাজ এবং বর্তমান অবস্থার সবচেয়ে
জরুরী কাজ এই যে, মুসলশানদেরকে তাদের বর্তমান অর্থনৈতকি দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে হবে। আগে
সরকারই ছিল ভারতীয় মুসলমানদের অর্থনৈতিক কল্যাণের প্রধান সহায়। তাদের অবশ্য
বাণিজ্য ও পুঁজি সংগঠনের প্রবণতা কোনোদিনই ছিল না। তাদের ছিল শুধু বিভিন্ন কারিগরি
পেশার সহজাত ঝোঁক। আর এসব পেশার আর্থিক সুফল নির্ভর করতো পুরোপুরিভাবে সরকার ও
সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকদের উপর। তারা এসবের কদর ও মূল্য দিতো। যখন সরকার গেল,
তখন সেই সাথে তাদের সচ্ছলতা ও ধনাঢ্যতার উৎসও শুকিয়ে গেল। ফলে আজ এ
অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, মুসলমানদের মধ্যে যারা বিভিন্ন পেশার
দ্ক্ষ কারিগর ও কৃষক আছে সকলেই পুঁজিপতি হিন্দুদের গোলাম। আর যাদেরকে আল্লাহ পৈতৃক
সম্পদে সম্পদশারী করেছেন তারা তাদের বিকৃত কৃষ্টি ও রুচি এবং ভ্রান্ত অপব্যয়মূলক
আদত-অভ্যাসের দরুন প্রতিনিয়ত তা দেনার খাতে উড়িয়ে দিচ্ছে। এই অর্থনৈতিক দাসত্বের
ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, কায়-কারবারের ক্ষেত্রে হিন্দুদের শক্তি
এত বেড়ে গেছে যে, তারা মুসলমানদের জন্য ধ্বংসাত্মক হয়ে
দাঁড়িয়েছে। তারা এ দিকটায় এতখানি অগ্রসর হয়েছে যে, যখন খুশী
অবরোধ চালিয়ে মুসলমানেদর বেকায়দায় ফেলে দিতে পারে। শহর-বন্দরে এ ব্যাপারটা কেবল
অর্থনৈতিক দাসত্বের মধ্যে সীমিত আছে বটে। তবে দূর-দূরান্তের গ্রামাঞ্চলে এ জিনিসই
মুসলমানদের ধর্মচ্যুত করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অমুসলিম ধর্ম
প্রচারকরা পূর্ণ শক্তি নিয়ে অজ্ঞ গ্রাম্য মুসলমানদেরকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা
চালাচ্ছে। অতএব ইসলামকে নিরাপদ করার জন্য এ রোগের চিকিৎসা সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন।
এমনকি বর্তমান অবস্থার আলোকে একথা বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে, অর্থনৈতিক বিপদই ভারবর্সে ইসলামের অস্তিত্বের জন্য হুমটি স্বরূপ।
জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব
মুসলমানদের অর্থনৈতিক বিপদ থেকে বাঁচানোর
জন্য কি কর্মপন্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, সেটা একটা স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয়। তা নিয়ে এখানে বিস্তারিত
আলোকনা করার অবকাশ নেই। তবে এটা সত্য যে, এতবড় গুরুত্বপূর্ণ
কাজ সম্পন্ন করার জন্য আমাদের এ অনৈক্য ও জাতীয় দলসমূহের বিভিন্নতা মোটেই সমীচীন
নয়। আমরা এখনো আলাদা আলাদা দল গড়ার তালে আছি। অথচ এ ক্ষেত্রে সমগ্র জাতির ঐক্যবদ্ধ
শক্তি প্রয়োজন। আমরা অল্প সময়েল মধ্যে বিরাট ফল আশা করছি। অথচ এ কাজে বছরের পর বছর
ধরে অবিশ্রান্ত পরিশ্রম প্রয়োজন। আমরা এখনো হৈ-হল্লা করাতেই পূর্ণ স্বাদ অনুভব
করি। অথচ এক্ষেত্রে উদ্দেশ্যের প্রতি গভীরতর নিষ্ঠা ও সত্যিকার ত্যাগ-তিতিক্ষার
প্রয়োজন। আমরা এখনো কেবলা আগুনের মত সহসা জ্বালিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রপ্ত করেছি। অথচ এ
ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন নেই। আমাদের এখনো অতি সামান্য উত্তাপের প্রয়োজন –যে উত্তাপ বছরের পর বছর ধরে ভেতরে ভেতরেই পাকিয়ে মণি-মুক্তা তৈরী করে দিতে
পারে। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা কাজ করার সঠিক পদ্ধতি আয়ত্ব করতে না পারবো
ততক্ষণ সমস্ত প্রস্তাবাদি নিস্ফল। বিভিন্ন আন্দোলন যদি এখনো এ ভাবাবেগই সক্রিয়
থাকে এবং আমরা যদি অন্যদের মোকাবিলা করার বদলে নিজেদের মধ্যে ঠুকাঠুকিতেই যথারিত
মশগুল থাকি, আমাদের সব কাজ যদি একতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার
পরিবর্তে অনৈক্যের পথ অনুসরণ করে চলতে থাকে তাহলে আমাদের সংস্কার ও সংশোধনের সব
চেষ্টা বাদ দিয়ে সকলে মিলে ইসলামের ফাতেহা পাঠ করে যার যার পসন্দসই সাকে নিয়োজিত
হওয়াই উত্তম। একটি দালান তৈরী করতে যেমন ভারো মাল মশলার চেয়ে মিস্ত্রির দক্ষতার
প্রয়োজন বেশী, তেমনি আমাদের ভালো ভালো প্রস্তাব ও কর্মপন্থার
চেয়ে কাজ করার উত্তম যোগ্যতার প্রয়োজন বেশী। ওষুধ যত ভালোই হোক না কেন, চিকিৎসক যোগ্য না হলে সে ওষুধে রোগীর কোনো উপকার সাধিত হয় না। অতএব আমাদের
জাতির (অর্থাৎ মুসলিম উম্মতের) সুধীবৃন্দ যদি সময়ের গুরুত্ব ও নাজুকতা সঠিকভাবে
অনুভব করেন তাহলে তাদের অন্য সব চিন্তা বাদ দিয়ে সর্বপ্রথম মুসলিম জাতির ঐক্য
কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায় সেই চ্নিতা করতে হবে। আজ সমস্ত জাতীয় আন্দোলনগুলোতে যে
অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা বিরাজমান তা যত শীঘ্র সম্ভব দূর করে দিতে হবে।
মুসলমান ও দাওয়াত
“ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রণাঙ্গণেও দাওয়াত ও
প্রচারের কাজ অব্যাহত রেখেছেন। আল্লাহর বান্দাদেরকে তাঁর বন্দেগীর দিকে
দাওয়াত দেয়ার কাজ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, কোনো অবস্থাতেই কোনো মুসলমানের পক্ষে সে কাজ বাদ দেয়া সম্ভব
নয়। দাওয়াতের এ কাজ মুসলমানের জীবন ও তার ব্যক্তি সত্ত্বার অবিচ্ছেদ্য অংগ। বাস্তব
জীবনের কঠোর সংগ্রামের ভেতর দিয়েও যখন আমরা এ দাওয়াত অব্যাহত রাখতে পারবো তখনই
আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য সফল হবে এবং লক্ষ্য অর্জিত হবে। আমাদের ও খৃষ্টান
মিশনারীদের মধ্যে পার্থক্য এটুকুই যে, তারা একদল পেশাধার
ধর্ম প্রচারক। কিন্তু মুসলমানের প্রচার চলে কর্মব্যস্ত জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে। এ
প্রচার কোথাও আলাদাভাবে বসে শুধুমাত্র ওয়ায়েজ হিসেবে করা হয় না। বরং মুসলমান যদি
কোনো বাজারে কার্যরত থাকে তাহলে একদিকে সে নিজের কায়কারবার চালায়, অপরদিকে আল্লাহর দ্বীনের দিকেও মানুষকে আহবান জানায়। সে যেখানেই থাক এবং
যে কাজই করুক –সব অবস্থাতেই সে প্রথমে আল্লাহর দ্বীনের
আহবায়ক, অতপর অন্য কিছু”।
মাওলানা মওদূদী
ঝিলামঃ ১৪ নভেম্বর, ১৯৬৭ইং
0 Comments