তেলাওয়াত ও তরজমাঃ
﴿يَسْأَلُونَكَ عَنِ
الْأَنفَالِ ۖ قُلِ الْأَنفَالُ لِلَّهِ وَالرَّسُولِ ۖ فَاتَّقُوا اللَّهَ
وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ ۖ وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِن كُنتُم
مُّؤْمِنِينَ﴾
১) লোকেরা তোমার কাছে গনীমাতের মাল সম্পর্কে
জিজ্ঞেস করছে? বলে দাও, এ গনীমতের
মাল তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ৷কাজেই তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, নিজেদের পারষ্পরিক সম্পর্কে শুধরে নাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য
করো, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো
﴿إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ
الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ
آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ﴾
২) সাচ্চা ঈমানদার তো তারাই আল্লাহকে স্মরণ করা হলে
যাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে৷ আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয়, তাদের ঈমান
বেড়ে যায় এবং তারা নিজেদের রবের ওপর
ভরসা করে৷
﴿الَّذِينَ يُقِيمُونَ
الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ﴾
৩) তারা নামায কায়েম করে এবং যা কিছু আমি তাদেরকে
দিয়েছি তা থেকে ( আমার পথে) খরচ করে৷
﴿أُولَٰئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ
حَقًّا ۚ لَّهُمْ دَرَجَاتٌ عِندَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ﴾
৪) এ ধরনের লোকেরাই প্রকৃত মুমিন৷ তাদের জন্য তাদের
রবের কাছে রয়েছে বিরাট মর্যাদা , ভূলত্রুটির ক্ষমা ও উত্তম রিযিক৷
﴿كَمَا أَخْرَجَكَ
رَبُّكَ مِن بَيْتِكَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ فَرِيقًا مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ
لَكَارِهُونَ﴾
৫) (এই গনীমাতের মালের ব্যাপারে ঠিক তেমনি অবস্থা
দেখা দিচ্ছে যেমন অবস্থা সে সময় দেখা দিয়েছিল যখন) তোমার রব তোমাকে সত্য সহকারে
ঘর থেকে বের করে এনেছিলেন এবং মুমিনদের একটি দলের কাছে এটা ছিল বড়ই অসহনীয়৷
﴿يُجَادِلُونَكَ فِي
الْحَقِّ بَعْدَمَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُونَ إِلَى الْمَوْتِ وَهُمْ
يَنظُرُونَ﴾
৬) তারা এ সত্যের ব্যাপারে তোমার সাথে ঝগড়া করছিল
অথচ তা একেবারে পরিস্কার হয়ে ভেসে উঠেছিল৷ তাদের অবস্থা এমন ছিল, যেন তরা
দেখছিল তাদেরকে মৃত্যুর দিকে হাকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
﴿وَإِذْ يَعِدُكُمُ
اللَّهُ إِحْدَى الطَّائِفَتَيْنِ أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّونَ أَنَّ غَيْرَ
ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُونُ لَكُمْ وَيُرِيدُ اللَّهُ أَن يُحِقَّ الْحَقَّ
بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِينَ﴾
৭) স্মরণ করো সেই সময়ের কথা যখন আল্লাহ তোমাদের
সাথে ওয়াদা করেছিলেন, দুটি দলের মধ্যে থেকে একটি তোমরা পেয়ে
যাবে৷ তোমরা চাচ্ছিলে, তোমরা
দুর্বল দলটি লাভ করবে৷ কিন্তু
আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, নিজের বাণীসমূহের সাহায্যে তিনি সত্যকে
সত্যরূপে প্রকাশিত করে দেখিয়ে দেবেন এবং কাফেরদের শিকড় কেটে দেবেন।
﴿لِيُحِقَّ الْحَقَّ
وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُونَ﴾
৮) যাতে সত্য সত্য রূপে এবং বাতিল বাতিল হিসেবে
প্রমাণিত হয়ে যায়, অপরাধিদের কাছে তা যতই অসহনীয় হোক না কেন৷
﴿إِذْ تَسْتَغِيثُونَ
رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّي مُمِدُّكُم بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلَائِكَةِ
مُرْدِفِينَ﴾
৯) আর সেই সময়ের কথা স্মরণ করো যখন তোমরা তোমাদের
রবের কাছে ফরিয়াদ করছিলে৷ জবাবে তিনি বললেন , তোমাদের সাহায্য করার
জন্য আমি একের পর এক, এক হাজার ফেরেশতা পাঠাচ্ছি৷
﴿وَمَا جَعَلَهُ اللَّهُ
إِلَّا بُشْرَىٰ وَلِتَطْمَئِنَّ بِهِ قُلُوبُكُمْ ۚ وَمَا النَّصْرُ إِلَّا مِنْ
عِندِ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾
১০) একথা আল্লাহ তোমাদের শুধুমাত্র এ জন্য জানিয়ে
দিলেন যাতে তোমরা সুখবর পাও এবং তোমাদের হৃদয় নিশ্চিন্ততা অনুভব করে৷ নয়তো
সাহায্য যখনই আসে আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে৷ অবশ্যই আল্লাহ মহাপরাক্রমশীল ও
মহাজ্ঞানী৷
নামকরণঃ
§ সূরার প্রথম আয়াতে الْأَنفَالِ শব্দ
থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে আল আনফাল।
§ আনফাল শব্দের অর্থঃ অতিরিক্ত সমূহ। যুদ্ধ বিজয়ে অতিরিক্ত
হিসাবে যে সম্পদ পাওয়া যায়, তাকে আনফাল বলা হয়। ইসলামী পরিভাষায় তাকে গনিমাত নামে
আখ্যায়িত করা হয়।
§ এই সূরার অপর নামঃ
১. সূরা বদর।
২. সূরা ফুরকান। এই সুরার ৪১ নম্বর
আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ ﴿وَمَا أَنزَلْنَا عَلَىٰ
عَبْدِنَا يَوْمَ الْفُرْقَانِ﴾
৩. সূরা ক্বিতাল।
নাযিলের সময়কাল
§ মদীনায় অবতীর্ণ সূরা সমূহের অন্যতম এবং
এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে ইজমা রয়েছে।
§ কুরআনে হাকীমের সূরার ধারাবাহিকতায় এটি ৮ম সূরা, এতে
রয়েছেঃ ৭৫টি আয়াত, ১৯৩১টি শব্দ, ৫০
হাজার ২শত ৯৪টি অক্ষর।
§ সূরাটি সূরা বাকারার পর নাযিল হয়।
§ নাযিল হয় দ্বিতীয় হিজরীর রামাদ্বান মাসে বদর যুদ্ধের
বিজয়ের প্রাক্ষালে।
عن سعيد بن جبير قال قلت لابن عباس رضي الله عنهما
سورة الأنفال؟ قال نزلت في بدر.
হযরত সাঈদ বিন জুবাইর রা. বলেন,
আমি ইবনে আব্বাস রা.কে সূরা আনফাল
সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছেনঃ সূরা আনফাল বদরে নাযিল হয়েছে।
§ হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. যার ভাই উমাইর রা. বদরের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ
করেন। তিনি পরে সাঈদ ইবনুল আসকে হত্যা করে
তার তরবারীটি নিয়ে নেন। তরবারীর নাম ছিল “যুল কুতাইফা”। তিনি বলেন, আমি তরবারী
খানা রাসূল সা. এর কাছে নিয়ে আসলে তিনি আমাকে বলেনঃ ওটা
অধিকৃত মালের স্তুপের মধ্যে রেখে দাও। তখন আমি ওটা স্তুপের মধ্যে রেখে দেয়ার জন্য
যাচ্ছিলাম। এই সময় আমার মনের অবস্থা কি
রকম ছিল, তা কেবলমাত্র আল্লাহ জানেন। একদিনে ভাই হত্যা, অন্যদিকে
আমি যা নিয়েছিলাম, তাও আমাকে জমা দিয়ে দিতে হচ্ছে। কিন্তু আমি
অল্প দূরে গিয়েছে, এমন সময়ে সূরা আনফালের এই আয়াত নাযিল
হয়। তখন রাসূল সা. আমাকে
ডেকে নিয়ে বলেনঃ
اذهب فاطرحه في القبض
যাও, তুমি তোমার ছিনিয়ে
নেয়া মাল নিয়ে নাও।
§ এই সূরায় ইসলাম ও কুফুরের মধ্যে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধের
বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়েছে।
§ এই সূরার বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে যা
অনুমান করা যায়ঃ
১. পুরো সূরা মাত্র ১টি ভাষণে
অন্তর্ভূক্ত এবং একসাথে নাযিল হয়েছে।
২. কিছু কিছু আয়াত বদর
যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট হলেও তা পরে নাযিল হয়েছে।
ঐতিহাসিক পটভূমি
§ তাফহীমূল কুরআনে সূরার আলোচনার শুরুতে বদর যুদ্ধ ও তার সাথে
সম্পর্কিত অবস্থা ও ঘটনাবলীর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যে সব বিষয় সেখানে নিয়ে আসা হয়েছেঃ
ক. রাসূলের
দাওয়াতের প্রভাবঃ
রাসূল সা. দাওয়াত শুরু
করা থেকে নিয়ে ১০/১২ বছর সময় পর্যন্ত তার দাওয়াত যথেষ্ট
রকমের পরিপক্ষতা ও স্থিতিশীলতার অর্জন করেছিল। যার কারণ ছিল দাওয়াতের পিছনে যিনি
নিয়ামক ছিলেন, তিনি ছিলেনঃ
১. উন্নত চরিত্র
ও বিশাল হৃদয়বৃত্তির অধিকারী জ্ঞানী মানুষ।
২. নিজের সকল
যোগ্যতা ও সামর্থ এই দাওয়াতের পিছনে নিয়োজিত করেছিলেন।
৩. আন্দোলনকে
সাফল্যেল চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছাতে ছিলেন দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ।
৪. আন্দোলনের
পথে আসা সকল বিপদ সংকট সমস্যা মোকাবেলায় ছিলেন প্রস্তুত।
৫. তার দাওয়াতে
ছিল অদ্ভূত আকর্ষণী ক্ষমতা, যা মন এবং মস্তিষ্কে প্রবেশ করতো
দ্রুত গতিতে। ফলে মূর্খতা, অজ্ঞতা, হিংসা,
সংকীর্ণতা, স্বার্থপ্রীতি তার পথ রোধ করতে
সক্ষম হচ্ছিল না।
৬. আরববাসী
প্রথমে বিষয়টাকে হালকা ভাবে নিলেও পরে তারা এই দাওয়াতকে গুরুতর বিপদ মনে করে তা
নিশ্চিহ্ন করার জন্য পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করেছিল।
খ. রাসূলের
দাওয়াতে যে সব দিকে অভাব রয়েছিলঃ
১. দাওয়াত যারা
কবুল করেছিলেন, তাদের পরীক্ষার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়নি যে,
§ তারা শুধু অনুগত নন, বরং রাসূলের নীতিকে তারা
মনে প্রাণে ভালবাসেন।
§ নীতিকে বিজয়ী ও কায়েম করার জন্য তারা নিজেদের শক্তি ও উপায়
উপকরণ ব্যয় করতে প্রস্তুত।
§ নীতির বাস্তবায়নে তারা নিজেদের সব কিছু কুরবানী দিতেও
প্রস্তুত।
§ নীতির বাস্তবায়নে তারা সারা দুনিয়ার সাথে যুদ্ধ করতে এমনকি
নিজেদের আত্মীয়তার বন্ধনকে কেটে ফেলতেও প্রস্তুত।
§ দাওয়াত যারা কবুল করেছিলেন, তারা ইসলামের সাথে থাকার কারণে ইতিমধ্যে নানাবিধ
জুলুমের শিকার হয়েছেন, ঈমানের অবিচলতা ও নিষ্ঠার প্রমাণ
দিয়েছেন। কিন্তু প্রমাণের বাকী ছিলঃ
o নিজেদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের মোকাবেলায় অন্য কিছুকে প্রিয়
মনে করেন না।
o উপরোক্ত প্রমাণের জন্য তাদের আরো কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন
ছিল।
২. সাংগঠনিক
মজবুতির অর্জিত হয়নি,
§ দাওয়াত বিস্তৃত হয়েছিল সারা দেশে, কিন্তু তার
প্রভাব ছিল বিক্ষিপ্ত ও অসংহত।
§ দাওয়াতের মাধ্যমে সংগৃহিত জনশক্তি ছিল সারাদেশে এলোমেলো।
§ জাহেলী ব্যবস্থার সাথে চূড়ান্ত মোকাবেলায় যতটুকু সামষ্টিক
শক্তি প্রয়োজন ছিল, তা তখনো অর্জিত হয়নি।
৩. ভূখন্ড
অর্জিত হয়নি,
§ রাসূলের দাওয়াত কোন মাটিতে পা ফেলতে পারেনি। দাওয়াত কেবল
বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছিল।
§ দাওয়াতের মিশনে যারা সাড়া দিয়েছিলেন, তা নিয়ে কোন
একটি স্থানে অবস্থান করার মতো জায়গা তখনো অর্জিত হয়নি, যেখানে
দাড়িয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করা যাবে।
§ মুসলমানদের অবস্থা ছিল খালি পেটে কুইনিন সেবনের মতো। কুইনিন খালি পেটে সেবন করলে পেটের ভিতর যা আছে, তা নিয়ে বমি
করে বের হয়ে যেতে চায়। কুফর আর শিরকে ভরা সমাজের মধ্যে ছিল মুসলমানদের
অবস্থান। বিধায়, দাওয়াত
কবুল করার কারণে তারা যে পরিস্থিতির শিকার হলেন, তারা সব সময়
ভয় আর টেনশনের মাঝে অবস্থান করছিলেন।
৪. নিজস্ব
সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি,
§ দাওয়াত বাস্তব জীবনের কাজ সমূহ নিজের আদর্শ অনুযায়ী
পরিচালনার সুযোগ পায়নি। ইসলামের নিজস্ব সভ্যতা, সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা বা
অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা রচনা করা সম্ভব
হয়নি। যুদ্ধ বা সন্ধির মতো কোন ঘটনা ঘটেনি।
ইসলাম যে নৈতিক বিধানের ভিত্তিতে সমগ্র দেশ ও সমাজকে পরিচালনা করতে চায়,
তার কোন মডেল প্রদর্শণ করতে পারেনি।
§ দাওয়াত যিনি দিচ্ছেন, আর দাওয়াত যারা কবুল
করেছেন, তারা এই দাওয়াতকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে কতটুকু
নিষ্ঠাবান, তা কোন পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের আসল চেহারা দেখা
যায়নি।
গ. মদীনায়
ইসলামের প্রচারঃ
§ মক্কী যুগের শেষ ৩/৪ বছরে তদানিন্তন ইয়াসরিব
তথা মদীনায় ইসলামের দাওয়াত পৌছে এবং তা ছড়িয়ে পড়ে অপ্রতিহত গতিতে।
§ মদীনার মানুষের তুলনামূলক সহজে ও নির্দ্বিধায় ইসলামের আলো
গ্রহণ করেন।
ঘ. আক্বাবার
শপথঃ
§ নবুয়াতের দ্বাদশ বছরে হজ্জের মওসূমে মদীনার ৭৫জনের একটি
প্রতিনিধি দল রাসূল সা. এর সাথে সাক্ষাৎ করে।
§ মদীনার প্রতিনিধিদল ইসলাম গ্রহণ করে, নবী সা.
ও তার অনুসারীদেরকে নিজেদের শহরে জায়গা দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে।
§ মদীনাবাসী নবী সা. কে একজন শরণার্থী হিসাবে
নয়, বরং আল্লাহর প্রতিনিধি, নেতা ও
শাসক হিসাবে গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে।
§ মদীনারবাসীর এই আগ্রহ ইসলামের ইতিহাসের বৈপ্লবিক পটপরিবর্তন-যা আল্লাহ
সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তার অনুগ্রহে দিয়েছিলেন এবং নবী সা. সুযোগটা
পেয়েই গ্রহণ করেছিলেন।
§ এভাবেই তদানিন্তন ইয়াসরিব মদীনাতুল ইসলাম হিসাবে প্রকাশিত
হয়। নবী সা. এই আহবানে সাড়া দিয়ে প্রথম দারুল ইসলাম গড়ে
তুলেন।
§ এই ধরণের আহবানের অর্থ ছিল একটি ছোট্ট শহরের জন্য চরম বৈরী
পরিবেশ ঢেকে আনা। সারা দেশের খোলা তরবারী, অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবরোধের মোকাবেলায় নিজেদের দাড় করানো। যে পরিস্থিতির বিবরণ মিলে বৈঠকের রাতের কিছু
বক্তব্যে। যেমনঃ
o যখন
এ বাইআত অনুষ্ঠিত হচ্ছিল ঠিক তখনই ইয়াসরেবী প্রতিনিধি দলের সর্বকনিষ্ঠ যুব সদস্য
আস’আদ ইবনে যুরারাহ (রা) উঠে বললেনঃ
رُوَيدًا يا أهلَ يَثرِبَ، إنَّا لم نَضرِبْ إليه
أكْبادَ المَطيِّ إلَّا ونحن نَعلَمُ أنَّه رسولُ اللهِ، إنَّ إخْراجَه اليومَ
مُفارَقةُ العَرَبِ كافَّةً، وقَتْلُ خيارِكُم، وأنْ تَعَضَّكُم السُّيوفُ، فإمَّا
أنتم قَومٌ تَصْبِرون على السُّيوفِ إذا مَسَّتْكُم، وعلى قَتْلِ خيارِكُم، وعلى
مُفارَقةِ العَرَبِ كافَّةً، فخُذوه وأجْرُكُم على اللهِ، وإمَّا أنتُم قَومٌ
تَخافون مِن أنفُسِكُم خيفةً فذَروه، فهو أعْذَرُ عِندَ الله
“থামো, হে ইয়াসরেব বাসীরা! আমরা একথা জেনে বুঝেই এঁর কাছে এসেছি যে, ইনি আল্লাহর রসূল এবং আজ এখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া মানে হচ্ছে সমগ্র
আরববাসীর শত্রুতার ঝুঁকি নেয়া। এর ফলে তোমাদের শিশু সন্তানদেরকে হত্যর করা হবে
এবং তোমাদের ওপর তরবারি বর্ষিত হবে। কাজেই যদি তোমাদের এ আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা
থাকে তাহলে এঁর দায়িত্ব গ্রহণ করো। আল্লাহ এর প্রতিদান দেবেন। আর যদি তোমরা নিজেদের প্রাণকে
প্রিয়তর মনে করে থাকো তাহলে দায়িত্ব ছেড়ে দাও এবং পরিষ্কার ভাষায় নিজেদের অক্ষমতা
জানিয়ে দাও। কারণ এ সময় অক্ষমতা প্রকাশ করা আল্লাহর কাছে বেশী গ্রহণযোগ্য হতে
পারে”।
o প্রতিনিধি
দলের আর একজন সদস্য আব্বাস ইবনে উবাদাহ ইবনে নাদলাহ (রা) একথারই পুনরাবৃত্তি করেন
এভাবেঃ
هَلْ تَدْرُونَ عَلامَ تُبَايِعُونَ هَذَا
الرَّجُلَ ؟ قَالُوا : نَعَمْ ، قَالَ : إِنَّكُمْ تُبَايِعُونَ عَلَى حَرْبِ
الأَحْمَرِ وَالأَسْوَدِ مِنَ النَّاسِ ، وَإِنْ كُنْتُمْ تَرَوْنَ أَنَّكُمْ
إِذَا نَهَكَتْ أَمْوَالَكُمْ مُصِيبَةٌ ، وَأَشْرَافُكُمْ قَتْلَى
أَسْلَمْتُمُوهُ ، فَمِنَ الآنَ فَهُوَ وَاللَّهِ إِنْ فَعَلْتُمْ خِزْيُ
الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ ، وَإِنْ كُنْتُمْ تَرَوْنَ أَنَّكُمْ وَافُونَ لَهُ بِمَا
دَعَوْتُمُوهُ إِلَيْهِ عَلَى نُهْكَةِ الأَمْوَالِ وَقَتْلِ الأَشْرَافِ
فَخُذُوهُ ، فَهُوَ وَاللَّهِ خَيْرُ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ ،
“তোমরা কি জানো, এ ব্যক্তির হাতে কিসের বাইআত করছো?
(ধ্বনিঃ
হাঁ আমরা জানি) তোমরা এঁর হাতে বাইআত করে সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ঝুঁকি
নিচ্ছো।কাজেই যদি তোমরা মনে করে থাকো, যখন তোমাদের ধন-সম্পদ ধ্বংসের মুখোমুখি হবে এবং তোমাদের নেতৃস্থানীয়
লোকদের নিহত হবার আশংকা দেখা দেবে তখন তোমরা এঁকে শত্রুদের হাতে সোপর্দ করে
দেবে, তাহলে আজই বরং এঁকে ত্যাগ করাই
ভাল। কারণ আল্লাহর কসম,এটা দুনিয়ায় ও আখেরাতের
সবখানেই লাঞ্চনার কারণ হবে। আর যদি তোমরা মনে করে থাকো, এ ব্যক্তিকে তোমরা যে,
আহবান
জানাচ্ছো, নিজেদের ধন-সম্পদ ধ্বংস ও
নেতৃস্থানীয় লোকেদের জীবন নাশ সত্ত্বেও তোমরা তা পালন করতে প্রস্তুত থাকবে, তাহলে অবশ্যি তাঁর হাতে আকড়ে ধরো। কারণ আল্লাহর কসম, এরই মধ্যে রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ”।
o একথায়
প্রতিনিধি দলের সবাই এক বাক্যে বলে উঠলেনঃ
فَإِنَّا وَاللَّهِ نَأْخُذُهُ عَلَى مُصِيبَةِ
الأَمْوَالِ وَقَتْلِ الأَشْرَافِ
“আমরা এঁকে গ্রহণ করে আমাদের
ধন-সম্পদ ধ্বংস করতে ও নেতৃস্থানীয় লোকদের নিহত হবার ঝুকি নিতে প্রস্তুত”।
§ এ ঘটনার পর সেই ঐতিহাসিক বাইআত অনুষ্ঠিত হয়। ইতিহাসে একে
আকাবার দ্বিতীয় বাইআত বলা হয়।
ঙ. আক্বাবার
শপথ পরবর্তী অবস্থা পর্যালোচনাঃ
অন্যদিকে
মক্কাবাসীদেরক কাছেও এ ঘটনাটির তাৎপর্য ছিল সুবিদিত। ইতিপূর্বে কুরাইশরা মুহাম্মাদ
(সা) এর বিপুল প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও অসাধারণ যোগ্যতার সাথে পরিচিত হয়েছিল এবং
এখন সেই মুহাম্মাদই (সা) যে, একটি আবাস লাভ করতে
যাচ্ছিলেন তা তারা বেশ অনুধাবন করতে পারছিল। তাঁর নেতৃত্বে ইসলামের অনুসারীরা যে
একটি সুসংগঠিত দলের আকারে অচিরেই গড়ে উঠবে এবং সমবেত হবে একথাও তারা বুঝতে পারছিল।
আর ইসলামের এ অনুসারীরা সংকল্পে কত দৃঢ়,
নিষ্ঠা
ও আত্মত্যাগে কত অবিচল, এতদিনে সেটা তাদের কাছে অনেকটা পরীক্ষিত হয়ে
গিয়েছিল। এহেন সত্যাভিসারী কাফেলার এ নব উত্থান পুরাতন ব্যবস্থার জন্যে মৃত্যুর
ঘন্টাস্বরূপ। তাছাড়া মদীনার মত জায়গায় এই মুসলিম শক্তির একত্র সমাবেশ কুরাইশদের জন্যে
আরো নতুন বিপদের সংকেত দিচ্ছিল। কারণ লোহিত সাগরের কিনারা ধরে ইয়ামন থেকে
সিরিয়ার দিকে যে বানিজ্য পথটি চলে গিয়েছিল তার সংরক্ষিত ও নিরাপদ থাকার ওপর কুরাইশ
ও অন্যাণ্য বড় বড় গোত্রের অর্থনৈতিক জীবন নির্ভরশীল ছিল। আর এটি এখন মুসলমানদের
প্রভাবাধীনে চলে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত। এ প্রধান বাণিজ্য পথটি দখল করে মুসলমানরা
জাহেলী ব্যবস্থার জীবন ধারণ দুর্বিসহ করে তূলতে পারতো।এ প্রধান বাণিজ্য পথের
ভিত্তিতে শুধু মাত্র মক্কাবাসীদের যে ব্যবসায় চলতো তার পরিমাণ ছিল বছরে আড়াই লাখ
আশরাফী। তায়েফ ও অন্যান্য স্থানের ব্যবসায় ছিল এর বাইরে।
কুরাইশরা
এ পরিণতির কথা ভালভাবেই জানতো। যে রাতে আকাবার বাইআত অনুষ্ঠিত হলো সে রাতেই এ
ঘটনার উড়ো খবর মক্কাবাসীদের কানে পৌছে গোলো। আর সাথে সাথেই সেখানে হৈ চৈ শুরু
হয় গেলো। প্রথমে তারা চেষ্টা করলো মদীনাবাসীদেরকে নবী (সা) এর দল থেকে ভাগিয়ে
নিতে। তারপর যখন মুসলমানরা একজন
দুজন করে মদিনায় হিজরত করতে থাকলো এবং কুরাইশদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেলো যে, এখন
মুহাম্মাদ (সা) সেখানে স্থানন্তরিত হয়ে যাবেন তখন তারা এ বিপদকে ঠেকিয়ে রাখার
জন্যে সর্বশেষ উপায় অবলম্বনে এগিয়ে এলো।
চ. রাসূল সা.কে হত্যার ষড়যন্ত্র ও হিজরাতঃ
রসূলের
(সা) হিজরতের মাত্র কয়েক দিন আগে কুরাইশদের পরিমর্শ সভা বসলো। অনেক আলোচনা
পর্যালোচানার পর সেখানে স্থির হলো,
বনী
হাশেম ছাড়া কুরাইশদের প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে লোক বাচাই করা হবে এবং এরা
সবাই মিলে মুহাম্মাদ (সা)কে হত্যা করবে। এর ফলে বনী হাশেমের জন্যে এ সমস্ত
গোত্রের সাথে একাকী লড়াই করা কঠিন হবে। কাজেই এ ক্ষেত্রে তারা প্রতিশোধের
পরিবর্তে রক্ত মূল্য গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানী এবং নবী (সা)
এর আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও উন্নত কৌশল অবলম্বনের কারণে তাদের সব চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে
গেলো। ফলে রসূলুল্লাহ (সা)নির্বিঘ্নে মদীনায় পৌছে গেলেন।এভাবে হিজরত প্রতিরোধ
ব্যর্থ হয়ে কুরাইশরা মদীনার সরদার আবুদুল্লাহ ইবনে উবাই কে(যাকে হিজরতের আগে
মদীনাবাসীরা নিজেদের বাদশাহ বানাবার প্রস্তুতি নিয়েছিল এবং রসূলের মদীনায় পৌছে
যাবার এবং আওস ও খাযরাজদের অধিকাংশের ইসলাম গ্রহণের ফলে যার বাড়া ভাতে ছাই পড়ে
গিয়েছিল) পত্র লিখলোঃ তোমারা আমাদের লোককে তোমাদের ওখানে আশ্রয় দিয়েছো। আমরা
এ মর্মে আল্লাহর কসম খেয়েছি, হয় তোমরা তার সাথে লড়বে বা
তাকে সেখান থেকে বের করে দেবে। অন্যথায় আমরা সবাই মিলে তোমাদের ওপর আক্রমণ করবো
এবং তোমাদের পুরুষদেরকে হত্যা ও মেয়েদেরকে বাদী বানাবো। কুরাইশদের এ উষ্কানির
মুখে আবুদুল্লাহ ইবনে উবাই কিছু দুষ্কর্ম করার চক্রান্ত এঁটেছিল। কিন্তু সময় মত
নবী (সা) তার দুষ্কর্ম রুখে দিলেন। তারপর মদীনার প্রধান সাদ ইবনে মুআয উমরাহ করার
জন্যে মক্কা গেলেন । সেখানে হারম শরীফের দরজার
ওপর আবু জেহেল তার সমালোচনা করে বললোঃ
ألَا أرَاكَ تَطُوفُ
بمَكَّةَ آمِنًا، وقدْ أوَيْتُمُ الصُّبَاةَ، وزَعَمْتُمْ أنَّكُمْ
تَنْصُرُونَهُمْ وتُعِينُونَهُمْ، أما واللَّهِ لَوْلَا أنَّكَ مع أبِي صَفْوَانَ
ما رَجَعْتَ إلى أهْلِكَ سَالِمًا،
“তোমরা আমাদের ধর্মত্যাগীদের
আশ্রয় দেবে এবং তাদেরকে সাহায্য -সহযোগীতা দান করবে আর আমরা তোমাদেরকে অবাধে
মক্কায় তাওয়াফ করতে দেবো ভেবেছ?
যদি
তুমি আবু সফওয়ান তথা উমাইয়া ইবনে খলফের মেহমান না হতে তাহলে তোমাকে এখান থেকে
প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরে যেতে দিতাম না”।
সাদ
জবাবে বললেনঃ
واللَّهِ لَئِنْ
مَنَعْتَنِي هذا لَأَمْنَعَنَّكَ ما هو أشَدُّ عَلَيْكَ منه، طَرِيقَكَ علَى
المَدِينَةِ
“আল্লাহর কসম, যদি তুমি আমাকে এ কাজে বাধা দাও তাহলে আমি তোমাকে এমন জিনিস থেকে রুখে দেবো, যা তোমার জন্যে এর চাইতে অনেক বেশী মারাত্মক। অর্থাৎ মদীনা দিয়ে তোমাদের
যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেবো”।
অর্থাৎ
এভাবে মক্কাবাসীদের পক্ষ থেকে যেন একথা ঘোষণা করে দেয়া হলো যে, বায়তুল্লাহ
যিয়ারত করার পথ মুসলমানদের জন্যে বন্ধ। আর এর জবাবে মদীনাবাসীদের পক্ষ থেকে বলা
হলো, সিরিয়ার সাথে বাণিজ্য করার পথ ইসলাম বিরোধীদের জন্যে
বিপদসংকুল।
ছ. ছোট ছোট
অভিযান বা সারিয়াঃ
আসলে
সে সময় মুসলমানদের জন্য উল্লেখিত বাণিজ্য পথের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব মজবুত করা
ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় ছিল না। কারণ এ পথের সাথে কুরাইশ ও অন্যান্যগোত্রগুলোর
স্বার্থ বিজড়িত ছিল। ফলে এর ওপর মুসলমানদের কৃত্বৃত্ব বেশী মজবুত হলে তারা ইসলাম ও
মুসলমানদের ব্যাপারে নিজেদের শত্রুতামূলক নীতি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হতে পারে
বলে আশা করা যায়। কাজেই মদীনায় পৌছার সাথে সাথেই নবী (সা) সদ্যজাত ইসলামী সমাজে
প্রাথমিক নিয়ম -শৃংখলা বিধান ও মদীনার ইহুদী অদিবাসীদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করার
পর সর্বপ্রথম এ বাণিজ্য পথটির প্রতি নজর দিলেন। এ ব্যাপারে তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ
ব্যবস্থা অবলম্বন করলেন।
প্রথমত
মদীনা ও লোহিত সাগরের উপকূলের মধ্যবর্তীস্থলে এ বাণিজ্য পথের আশেপাশে যেসব
গোত্রের বসতি ছিল তাদের সাথে তিনি আলাপ- আলোচনা শুরু করে দিলেন। এভাবে তাদেরকে
সহযোগিতামূলক মৈত্রী অথবা কমপক্ষে নিরপেক্ষতার চুক্তিতে আবদ্ধ করা ছিল মূল
উদ্দেশ্য । এ ক্ষেত্রে তিনি পূর্ণ সাফলতা লাভ করলেন। সর্বপ্রথম নিরপেক্ষতার চুক্তি
অনুষ্ঠিত হলো সাগর তীরবর্তী পার্বত্র এলাকার জুহাইনা গোত্রের সাথে। এ গোত্রটির
ভূমিকা এ এলাকায় ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারপর প্রথম হিজরীর শেষের দিকে চুক্তি
অনুষ্ঠিত হলে বনী যামরার সাথে। এ গোত্রটির অবস্থান ছিল ইয়াম্বু ও যুল আশীরার
সন্নিহিত স্থানে এটি ছিল প্রতিরক্ষামূলক সহযোগিতার চুক্তি। দ্বিতীয় হিজরীর
মাঝামাঝি সময়ে বনী মুদলিজও এ চুক্তিতে শামিল হলো। কারণ এ গোত্রটি ছিল বনী যামরার
প্রতিবেশী ও বন্ধু গোত্র। এ ছাড়াও ইসলাম প্রচারের ফলে এ গোত্রগুলোতে ইসলামের
সমর্থক ও অনুসারীদের একটি বিরাট গোষ্ঠি সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল।
দ্বিতীয়ত
কুরাইশদের সওদাগরী কাফেলাগুলোকে ভীত -সন্ত্রস্ত করে তোলার জন্যে বাণিজ্য পথের
ওপর একের পর এক ছোট ছোট ঝাটিকা বাহিনী পাঠাতে থাকলেন।কোন কোন ঝাটিকা বাহিনীর
সাথে তিনি নিজেও গেলেন। প্রথম বছর এ ধরনের ৪টি বাহিনী পাঠানো হলো। মাগাযী (যুদ্ধ
ইতিহাস) গ্রন্থগুলো এগুলোকে সারীয় হামযা,
সারীয়া, উবাইদা
ইবনে হারেস, সারীয়া সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস ও গাযওয়া তুল
আবওয়া নামে অভিহিত করা হয়েছে।
(ইসলামের
ইতিহাসের পরিভাষায় সীরিয়া বলা হয় এমন ধরনের ছোটখাট বাহিনীকে যাকে নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন সাহাবীর নেতৃত্বে পাঠিয়ে ছিলেন আর যে
বাহিনীতে তিনি নিজে গিয়েছিলেন তাকে বলা হয় গাযওয়া।)
দ্বিতীয়
বছরের প্রথম দিকের মাসগুলোর একই দিকে আরো দুটি আক্রমণ চালানো হলো। মাগাযী
গ্রন্থগুলোয় এ দুটিকে গাযওয়া বুওয়াত ও গাযওয়া যুল আশারী নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এ
সমস্ত অভিযানের দুটি বৈশিষ্ট উল্লেখযোগ্য । এক, এ
অভিযানগুলোয় কোন রক্তপাতের ঘটনা ঘটেনি এবং কোন কাফেলা লুণ্ঠিত ও হয়নি। এ থেকে
একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এর মাধ্যমে কুরাইশদেরকে বাতাসের গতি কোন দিকে
তা জানিয়ে দেয়াই ছিল আসল উদ্দেশ্য। দুই ,
এর
মধ্য থেকে কোন একটি বাহিনীতেও নবী (সা) মদীনার একটি লোককেও শামিল করেননি। মক্কা
থেকে আগত মুহাজিরদেরকেই তিনি এসব বাহিনীর অন্তরভুক্ত করেন। কারণ এর ফলে যদি সংঘর্ষ
বাধে তাহলে তা যেন এর সাথে চড়িয়ে পড়ে এ আগুনকে চারদিকে ছাড়িয়ে না দেয়। ওদিকে
মক্কাবাসীরাও মদীনার দিকে লুটেরা বাহিনী পাঠাতে থাকে। তাদেরই একটি বাহিনী কুরয
ইবনে জাবের আল ফিহরীর নেতৃত্বে একেবারে মদীনার কাছাকাছি এলাকায় হামলা চালিয়ে
মদীনাবাসীদের গৃহপালিত পশু লুট করে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে কুরাইশরা এ সংঘর্ষের
মধ্যে অন্যান্য গোত্রদেরকেও জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাছাড়া তারা কেবল
ভয় দেখিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছিল না , লুটতরাজও শুরু করে দিয়েছিল।
জ. বদর যুদ্ধঃ
এ
অবস্থায় ২য় হিজরীর শাবান মাসে(৬২৩ খৃষ্টব্দের ফেব্রুয়ারী বা মার্চ মাস)কুরাইশদের
একটি বিরাট বানিজ্য কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কার পথে অগ্রসর হয়ে এমন এক জায়গায় পৌছে
গিয়েছিল যে জায়গাটি ছিল মদীনাবাসীদের আওতার মধ্য। এ কাফেলার সাথে ছিল প্রায় ৫০
হাজার আশরাফীর সামগ্রী। তাদের সাথে তিরিশ চল্লিশ জনের বেশী রক্ষী ছিল না। যেহেতু
পণ্যসামগ্রী ছিল বেশী এবং রক্ষীর সংখ্যা ছিল কম আর আগের অবস্থার কারণে মুসলমানদের
কোন শক্তিশালী দলের তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করার আশংকা ছিল অত্যন্ত প্রবল, তাই
কাফেলা সরদার আবু সুফিয়ান এ বিপদ সংকুল স্থানে পৌছেই সাহায্য আনার জন্য কোন এক
ব্যক্তিকে মক্কা অভিমূখে পাঠিয়ে দিল। লোকটি মক্কায় পৌছেই প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী
নিজের উটের কান কেটে ফেললো, তার নাক চিরে দিল, উটের
পিঠের আসন উল্টে দিলে এবং নিজের জামা সামনের দিকে ও পিছনের দিকে ছিড়ে ফেলে এই বলে
চিৎকার করতে থাকলোঃ
يا معشر قريش اللطيمة
اللطيمة، أموالكم مع أبي سفيان قد عرض لها محمد في أصحابه لا أرى أن تدركوها،
الغوث الغوث.
“হে কুরাইশরা!
তোমাদের বাণিজ্য কাফেলার খবর শোনো। আবু সুফিয়ানের সাথে তোমাদের যে সম্পদ আছে, মুহাম্মাদ তার সঙ্গীসাথীদের
নিয়ে তার পেছনে ধাওয়া করেছে। তোমাদের তা পাবার আশা নেই। সাহায্যের জন্যে দৌড়ে
চলো! সাহায্যের জন্যে দৌড়ে চলো”।!
এ
ঘোষনা শুনে সারা মক্কার বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে গোলো। কুরাইশদের বড় বড়
সরদাররাই সবাই যুদ্ধের জন্যে তৈরী হলো। প্রায় এক হাজার যোদ্ধা রণসাজে সজ্জিত হয়ে
পূর্ণ আড়ম্বর ও জাঁক -জমকের সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে রওয়ানা হলো। তাদের মধ্যে ছিল ৬শ
বর্মধারী এবং একশ জন অশ্বারোহী। নিজেদের কাফেলাকে শুধু নিরাপদে মক্কায় ফিরিয়ে
নিয়ে আসাই তাদের কাজ ছিল না বরং এই সংগে তারা নিত্য দিনের এ আশংকা ও আতংকবোধকে
চিরতরে খতম করে দিতে চাচ্ছিল। মদীনায় এ বিরোধী শক্তির নতুন সংযোজনকে তারা গুড়িয়ে
দিতে এবং এর আশপাশের গোত্রগুলোকে এর দূর সন্ত্রন্ত করে তুলতে চাচ্ছিল যার ফলে
ভবিষ্যতে এ বানিজ্য পথটি তাদের জন্যে সম্পূর্ণ নিরাপদ হয়ে যায়।
নবী
(সা) চলমান ঘটনাবলীর প্রতি সবসময় সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। তিনি উদ্ভুত পরিস্থিতির
প্রেক্ষাপটি অনুভব করলেন যেন চূড়ান্ত মীমাংসার সময় এসে গেছে। তিনি ভাবলেন এ সময়
যদি একটি সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয় তাহলে ইসলামী আন্দোলন চিরকালের জন্যে
নিষ্প্রাণ হয়ে পড়বে। বরং এরপর এ আন্দোলনের জন্যে হয়ত আবার মাথা উচু করে দাড়াবার
আর কোন সুযোগই থাকবে না। মক্কা থেকে হিজরত করে এ নতুন শহরে আসার পর এখনো দুটি
বছরও পার হয়ে যায়নি। মুহাজিররা বিত্ত ও সরঞ্জামহীন, আনসাররা
অনভিজ্ঞ , ইহুদীগোত্রগুলো বিরুদ্ধাবাদিতায় মুখর খোদ
মদীনাতেই মুনাফিক ও মুশরিকদের একটি বিরাট গোষ্ঠি উপস্থিত এবং চারপাশের সমস্ত
গোত্র কুরাইশদের ভয়ে ভীত। আর সেই সংগে ধর্মীয় দিক দিয়েও তাদের প্রতি
সহানুভূতিশীল। এ অবস্থায় যদি কুরাইশরা মদীনা আক্রমণ করে তাহলে মুসলমানদের এ
ক্ষুদ্র দলটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু যদি তারা মদীনা আক্রমণ না করে শুধু
মাত্র নিজেদের শক্তি প্রয়োগ করে বাণীজ্য কাফেলাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় এবং
মুসলমানরা দমে গিয়ে ঘরের কোণে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে তাহলেও সহসাই মুসলমানদের
প্রতিপত্তি এমনভাবে আহত হবে এবং তাদের প্রভাব এত বেশী ক্ষুণ্ন হবে যার ফলে আরবের
প্রতিটি শিশুও তাদের বিরুদ্ধে দুঃসাহসী হয়ে উঠবে। সারা দেশে তাদের কোন আশ্রয় স্থল
থাকবে না। তখন চারপাশের সমস্ত গোত্র কুরাইশদের ইংগিতে কাজ করতে থাকবে। মদীনার
ইহুদী , মুনাফীক ও মুশরিকরা প্রকাশ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। মদীনায়
জীবন ধারণ করাও সে সময় দুসাধ্য হয় পড়বে। মুসলমানদের কোন প্রভাব প্রতিপত্তি থাকবে
না। ফলে তাদের ধন-প্রাণ-ইজ্জত -আবরুর উপর আক্রমন চালাতে কেউ ইতস্তত করবে না। এ
কারণে (সা) দৃঢ় সংকল্প নিলেন যে, বর্তমানে যতটুকু শক্তি
-সামর্থ আমাদের আছে তাই নিয়েই আমরা বের হয়ে পড়বো।দুনিয়ার বুকে বেঁচে থাকার ও টিকে
থাকার ক্ষমতা কার আছে এবং কার নেই ময়দানেই তার ফায়সালা হয়ে যাবে।
এ
চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেবার সংকল্প করেই তিনি আনসার ও মোহাজিরদের একত্র করলেন। তাদের
সামনে পরিস্থিতি পরিস্কার তূলে ধরলেন। একদিকে উত্তরে বাণিজ্য কাফেলা এবং অন্যদিকে
দক্ষিনে এগিয়ে আসছে কুরাইশদের সেনাদল। আল্লাহর ওয়াদা এ দুটির মধ্য থেকে কোন একটি
তোমরা পেয়ে যাবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ বলো,
এর
মধ্য থেকে কার মোকাবিলায় তোমরা এগিয়ে যেতে চাও? জবাবে
বিপুল সংখ্যক সাহাবী মত প্রকাশ করলেন,
কাফেলার
ওপর আক্রমণ চালানো হোক। কিন্তু নবী (সা) এর সামনে ছিল অন্য কিছু অভিপ্রায়। তাই
তিনি নিজের প্রশ্নের পুনরাকৃত্তি করলেন। একথায় মোহাজিরদের মধ্য থেকে মিকদাদ ইবনে
আমর (রা) উঠে বললেনঃ
يا رسول الله، امض لما أمرك
الله فانا معك حيثما احببت، لا نقول لك كما قال بنو إسرائيل لموسى : اذهب أنت وربك فقاتلا ،
إنا ههنا قاعدون، ولكن اذهب أنت وربك فقاتلا إنا معكما مقاتلون، مادامت عين
مناتطرف.
“হে আল্লাহর রসূল! আপনার রব
আপনাকে যেদিকে যাবার হুকুম দিচ্ছেন সেদিকে চলুন। আপনি যেদিকে যাবেন আমরা আপনার
সাথে আছি। আমরা বনী ইসরাঈলের মত একথা বলবো নাঃ যাও তুমি তোমার আল্লাহ দুজনে লড়াই
করো, আমরা তো এখানেই বসে রইলাম।
বরং আমরা বলছিঃ চলুন আপনি ও আপনার আল্লাহ দুজনে লড়ুন আর আমরা ও আপনাদের সাথে
জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করবো। যতক্ষণ আমাদের একটি চোখের তারাও নড়াচড়া করতে থাকবে
ততক্ষণ পর্যন্ত” ।
কিন্তু
আনসারদের মতামত না জেনে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভবপর ছিল না। কারণ এ
পর্যন্ত যেসব সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল তাতে তাদের সাহায্য গ্রহণ করা হয়নি এবং
প্রথম দিন তারা ইসলামকে সমর্থন করার যে শপথ নিয়েছিল তাকে কার্যকর করতে তারা কতটুকু
প্রস্তুত তা পরীক্ষা করার এটি ছিল প্রথম সুযোগ। সুতরাং রসূলুল্লাহ (সা) সরাসরি
তাদেরকে সম্বোধন না করে নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন । একথায় সাদ ইবনে মুআয উঠে
বললেন, সম্ভবত আপনি আমাদের সম্বোধন করে বলছেন? জবাব
দিলেনঃ হাঁ। একথা শুনে সাদ বললেনঃ
فقد آمنا بك، فصدقناك،
وشهدنا أن ما جئت به هو الحق، وأعطيناك على ذلك عهودنا ومواثيقنا على السمع
والطاعة، فامض يا رسول الله لما أردت فو الذي بعثك بالحق لو استعرضت بنا هذا البحر
فخضته لخضناه معك، ما تخلف منا رجل واحد، وما نكره أن تلقى بنا عدوًّا غدًا إنا لصبر
في الحرب، صدق في اللقاء، ولعل الله يريك منا ما تقر به عينك، فسر بنا على بركة
الله
“আমরা আপনার ওপর ঈমান এনেছি।
আপনি যা কিছু এনেছেন তাকে সত্য বলে ঘোষনা করেছি। আপনার কথা শুনার ও আপনার আনুগত্য
করার দৃঢ় শপথ নিয়েছি। কাজেই হে আল্লাহর রসূল! আপনি যা সংকল্প করেছেন তা করে ফেলুন।
সেই সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদের নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন তালে আমরাও আপনার সাথে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে
পড়বো। আমাদের একজনও পিছনে পড়ে থাকবে না। আপনি কালই আমাদের দুশমনদের সাথে যুদ্ধ
শুরু করুন।এটা আমাদের কাছে মোটেই অপছন্দনীয় নয়। আমরা যুদ্ধে অবিচল ও দৃঢ়পদে
থাকবো।মোকাবিলায় আমরা সত্যিকার প্রাণ উৎসর্গীতার প্রমাণ দেবো। সম্ভবত আল্লাহ
আমাদের থেকে আপনাকে এমন কিছু কৃতিত্ব দেখিয়ে দেবেন, যাতে আপনার চোখ শীতল হবে। কাজেই আল্লাহর বরকতের ভরসায় আপনি আমাদের নিয়ে
চলুন”।
উল্লেখ্য
যে,
-
মক্কা থেকে সিরিয়ার দূরত্বঃ ১৯৯০ কি.মি.
-
মক্কা থেকে বদরের দূরত্বঃ ৩২০ কি.মি.
-
সিরিয়া থেকে বদরের দূরত্বঃ ১৬৯৬ কি.মি.
-
মদীনা থেকে বদরের দূরত্বঃ ১৫৬ কি.মি.
অর্থাৎ
যুদ্ধক্ষেত্রটি কাফের এবং মুসলমান কারো বাড়ীর পাশে ছিল না।
-
কাফেরদের আবাস থেকে ৩২০ কি.মি. এবং
-
মুসলমানদের আবাস থেকে ১৫৬ কি.মি. দূরে
ছিল।
সেই
সময়ের যোগাযোগ ব্যবস্থার ধরণ অনুযায়ী সেই জায়গাটি কারো নিয়মিত যাতায়াতের মতো
পরিচিত জায়গা ছিল না। বরং বর্তমানেও যেই জায়গাটি বিশাল বিশাল পাহাড়ী এলাকা পেরিয়ে
যাওয়া দূরের এক জনপদ।
এ
আলোচনা ও বক্তৃতার পরে সিদ্ধান্ত হলো,
বাণিজ্য
কাফেলার পরিবর্তে কুরাইশ সেনা দলের মোকাবিলা করার জন্যে এগিয়ে যাওয়া উচিত।কিন্তু
এটা কোন যেন তেন সিদ্ধান্ত ছিল না।এ সংক্ষিপ্ত সময়ে যারা যুদ্ধ করতে এগিয়ে এলেন,
-
তাদের সংখ্যা ছিল তিনশর কিছু বেশী (৮৬ জন মোহাজির, ৬১
আওস গোত্রের এবং ১৭০ জন খাযরাজ গোত্রের)।
-
এদের মধ্যে মাত্র দুতিন জনের কাছে ঘোড়া ছিল।
-
আর বাকি লোকদের জন্য ৭০ টির বেশী উট ছিল না।
এগুলোর পিঠে তারা তিন চারজন করে পালাক্রমে সওয়ার হচ্ছিলেন।
-
যদ্ধাস্ত্রও ছিল একেবারেই অপ্রতুল।
-
মাত্র ৬০ জনের কাছে বর্ম ছিল।
এ কারণে
গুটিকয় উৎসর্গীত প্রাণ মুজাহিদ ছাড়া এ ভয়ংকর অভিযানে শরীক অধিকাংশ মুজাহিদই হৃদয়ে উৎকণ্ঠ
অনুভব করেছিলেন। তারা মনে করেছিলেন ,
যেন
তারা জেনে বুঝে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিছু সুবিধাবাদী ধরনের লোক ইসলামের
পরিসরে প্রবেশ করলেও তারা এমন ইসলামের প্রবক্তা ছিল না যাতে ধন-প্রাণের সংশয় দেখা
দেয়। তারা এ অভিযানকে নিছক পাগলামী বলে অবিহিত করছিল। তারা মনে করছিল, ধর্মীয়
আবেগ উচ্ছ্বাস এ লোকগুলোকে পাগলে পরিণত করেছে।কিন্তু নবী ও সাচ্চা-সত্যনিষ্ঠা
মুমিনগণ একথা অনুধাবন করতে পরেছিলেন যে,
এটিই
প্রাণ উৎসর্গ করার সময়। তাই আল্লাহর ওপর ভরসা করে তাঁরা বের হয়ে পড়েছিলেন। তারা
সোজা দক্ষিণ পশ্চিশ দিকে এগিয়ে গেলেন। এ পথেই কুরাইশদের বাহিনী মক্কা থেকে ধেয়ে
আসছিল। অথচ শুরুতে যদি বাণিজ্য
কাফেলা লুট করার ইচ্ছা থাকতো তাহলে উত্তর পশ্চিমের পথে এগিয়ে যাওয়া হতো।
(উল্লেখ্য
বদরের যুদ্ধের ব্যাপারে ইতিহাস ও সীরাত লেখকরা যুদ্ধ কাহিনীসংক্রান্ত হাদীস ও
ইতিহাস গ্রন্থগুলোয় উদ্ধৃত বর্ণনাসমূহের ওপর নির্ভর করেছেন।কিন্তু এই
বর্ণনাগুলোর বিরাট অংশ কুরআন বিরোধী ও অনির্ভরযোগ্য। শুধুমাত্র ঈমানের কারণেই
আমরা বদর যুদ্ধ সংক্রান্ত কুরআনী বর্ণনাকে সবচেয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য বলে মনে করতে বাধ্য
হই না বরং ঐতিহাসিক দিকে দিয়েও যদি আজ এ যুদ্ধ সংক্রান্ত সবচাইতে নির্ভরযোগ্য
কোন বর্ণনা থেকে থাকে তাহলে তা হচ্ছে এ সূরা আনফাল। কারণ যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই
এটি নাযিল হয়েছিল। যুদ্ধে যারা শরীক ছিলেন এবং যুদ্ধের স্বপক্ষের বিপক্ষের সবাই
এটি শুনেছিলেন ও পড়েছিলেন। নাউযুবিল্লাহ এর মধ্যে কোন একটি কথাও যদি সত্য ও
বাস্তব ঘটনা বিরোধী হতো তাহলে হাজার হাজার লোক এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতো।)
রমযান
মাসের ১৭তারিখে বদর নামক স্থানে উভয় পক্ষের মোকাবিলা হলো। নবী (সা) দেখলেন তিনজন
কাফেরের মোকাবিলায় একজন মুসলমান দাঁড়িয়েছে এবং তাও আবার তারা পুরোপুরি অস্ত্র
সজ্জিত নয়। এ অবস্থা দেখে তিনি আল্লাহর সামনে দোয়া করার জন্যে দু হাত বাড়িয়ে
দিলেন। অত্যন্ত কাতর কণ্ঠে ও কান্না বিজড়িত স্বরে তিনি দোয়া করতে থাকলেনঃ
اللهم
هذه قريش قد أتت بخيلائها، تحاول أن تكذب رسولك، اللهم فنصرك الذي
وعدتني، اللهم أن تهلك هذه العصابة اليوم لا تعبد.
“হে আল্লাহ! এই কুরাইশরা এসেছে, তাদের সকল ঔদ্বত্য ও দাম্ভিবকতা
নিয়ে তোমার রসূলকে মিথ্যা প্রমাণ করতে। হে আল্লাহ! এখন তোমার সেই সাহায্য এসে
যাওয়া দরকার , যার ওয়াদা
তুমি করেছিলে আমার সাথে। হে আল্লাহ! যদি আজ এ মুষ্টিমেয় দলটি ধ্বসং হয়ে যায় তাহলে
এ পৃথীবীতে আর কোথাও তোমার ইবাদত করার মত কেউ থাকবে না”।
এ
যুদ্ধের ময়দানে মক্কার মোহাজিরদের পরীক্ষা ছিল সবচেয়ে কঠিন । তাদের আপন ভাই -চাচা
ইত্যাদি তাদের বিরুদ্দে ময়দানে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ।কারোর বাপ,
কারোর
ছেলে,কারোর চাচা,
কারোর
মামা, কারোর ভাই দাড়িয়েছিল তার প্রতিপক্ষে । এ যুদ্ধে নিজের
কলিজার টুকরার ওপর তরবারী চালাতে হচ্ছিল তাদের। এ ধরনের কঠিন পরীক্ষায় একমাত্র
তারাই উত্তীর্ণ হতে পারে যারা পরিপূর্ণ নিষ্ঠা এ আন্তরিকতাসহকারে হক ও সত্যের সাথে
সম্পর্ক জড়েছে। এবং মিথ্যা ও বাতিলের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করতে
পুরোপুরি উদ্যোগী হয়েছে। ওদিকে আনসারদের পরীক্ষা ও কিছু কম ছিল না। এতদিন তারা
মুসলমানদেরকে শুধুমাত্র আশ্রয় দিয়ে কুরাইশ ও তাদের সহযোগী গোত্রগুলোর শত্রুতার
ঝুঁকি নিয়েছিল। কিন্তু এবার তো তারা ইসলামের সমর্থনে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে
যাচ্ছিল। এর মানে ছিল, কয়েক হাজার লোকের একটি জনবসতি সমগ্র আরব দেশের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে গেছে। এ ধরনের দুঃসাহস একমাত্র তারাই করতে পারে
যারা সত্য আদর্শের ওপর ঈমান এনে তার জন্যে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে পুরোপুরি
জলাঞ্জলী দিতে প্রস্তুত হতে পারে। অবশেষে তাদের অবিচল ঈমান ও সত্যানিষ্ঠা আল্লাহর
সাহায্যের পুরষ্কার লাভে হয়ে গেলো। আর নিজেদের সমস্ত অহংকার ও শক্তির অহমিকা
সত্ত্বেও কুরাইশরা এ সহায় সম্বলহীন জানবাজ সৈনিকদের হাতে পরাজিত হয়ে গেলো।তাদের ৭০জন
নিহিত হলো, ৭০জন বন্দী হলো এবং তাদের সাজসরঞ্জামগুলো
গনীমতের সামগ্রী হিসেবে মুসলমানদের দখলে এলো। কুরাইশদের যেসব বড় বড় সরদার তাদের
মজলিসে গুলজার করে বেড়াতো এবং ইসলাম বিরোধী আন্দোলনে যারা সর্বক্ষণ তৎপর থাকতো
তারা এ যুদ্ধে নিহিত হলো। এ চুড়ান্ত বিজয় আরবে ইসলামকে একটি উল্লেখযোগ্য শক্তিতে
পরিণত করলো। একজন পাশ্চত্য গবেষক লিখেছেন,
বদর
যুদ্ধের আগে ইসলাম ছিল শুধুমাত্র একটি ধর্ম ও রাষ্ট্র। কিন্তু বদর যুদ্ধের পরে তা
রাষ্ট্রীয় ধর্মে বরং নিজেই রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেলো।
সূত্রঃ
তাফহীমুল কুরআন-সূরা আল আনফালের ভূমিকা থেকে।
আলোচ্য বিষয়ঃ
§ এই সূরায় ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের ঘটনাবলী পর্যালোচনা করা
হয়েছে। আর সে পর্যালোচনার ধরণ ছিল দুনিয়ার
রাজা বাদশাদের যুদ্ধ জয়ের পর নিজ সেনাবাহিনীর পর্যালোচনার চেয়ে ভিন্ন ধারার একটি
পর্যালোচনা।
§ মুসলমানদের নৈতিকভাবে ত্রুটিমুক্তি করার উদ্দেশ্যে তাদের
মধ্যে বিদ্যমান নৈতিক ত্রুটি সমূহ নির্দেশ করা হয়েছে।
§ বদর যুদ্ধে আল্লাহ সাহায্য ও সমর্থনের পরিমাণ উল্লেখ করে
মুসলমানদের নসিহত করা হয়েছে যেন তারা নিজেদের সাহস, শৌর্য-বীর্য এবং মিথ্যা গরীমায় স্ফীত হয়ে না পড়ে। বরং তাদের মাঝে আল্লাহর প্রতি
তাওয়াক্কুল বাড়ে, তারা যেন আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের
শিক্ষা গ্রহণ করে।
§ হক ও বাতিলের সংঘাতে যে সব নৈতিক গুণাবলীর মাধ্যমে সাফল্য
অর্জিত হয়, সে সব গুনাবলী বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
§ মুনাফিক, মুশরিক, ইহুদী
ও যুদ্ধবন্দিদের উদ্দেশ্যে শিক্ষণীয় বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে।
§ যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমত সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে
যে, এ গুলো নিজেদের নয়-আল্লাহর সম্পদ। আর তা থেকে যা আল্লাহ নির্ধাণ করেছেন, তা নিয়ে কৃতজ্ঞ থাকে আর মনে রাখে যে, গনিমতে আল্লাহর
কাজ ও গরীব বান্দাদের জন্য হক নির্ধারণ করেছেন।
§ যুদ্ধ আর সন্ধি সংক্রান্ত কিছু নৈতিক বিধান বলা হয়েছে-যা ইসলামী
দাওয়াতের জন্য অত্যন্ত জরুরী। এর মাধ্যমে
চলমান জাহেলী পদ্ধতি থেকে দূরে থাকা যাবে আর দুনিয়ার উপর নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব
প্রতিষ্ঠিত হবে।
§ যুদ্ধ আর সন্ধি বিধির মাধ্যমে দুনিয়াবাসীকে ম্যাসেজ প্রদান
করা হয়েছে যে, ইসলাম তার শুরু থেকে যে নৈতিকতার কথা বলছে,
বাস্তব জীবনে তা কার্যকর করেছে।
§ ইসলামী হুকুমাতের শাসনতান্ত্রিক কিছু ধারা বর্ণনা করা
হয়েছে। যাতে দারুল ইসলামের ভিতরে ও বাহিরে
থাকা মুসলমানদের মর্যাদা আলাদা করা হয়েছে।
ব্যাখ্যাঃ
﴿يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَنفَالِ ۖ قُلِ
الْأَنفَالُ لِلَّهِ وَالرَّسُولِ ۖ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ
بَيْنِكُمْ ۖ وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾
১) লোকেরা তোমার কাছে গনীমাতের মাল সম্পর্কে
জিজ্ঞেস করছে? বলে দাও, এ গনীমতের
মাল তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ৷কাজেই তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, নিজেদের পারষ্পরিক সম্পর্কে শুধরে নাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য
করো, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো৷
তোমাকে জিজ্ঞাসা করে যুদ্ধলব্দ সম্পদ সম্পর্কে |
﴿يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَنفَالِ﴾ |
বলুন, যুদ্ধলব্দ সম্পদ আল্লাহ ও রাসূলের জন্য |
﴿قُلِ الْأَنفَالُ لِلَّهِ وَالرَّسُولِ﴾ |
অতএব, তোমরা ভয় কর
আল্লাহকে এবং তোমরা সংশোধন করো তোমাদের মধ্যকার অবস্থা |
﴿فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ﴾ |
এবং তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং তার
রাসূলের |
﴿وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ﴾ |
যদি তোমরা হও মুমিন |
﴿إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾ |
﴿يَسْأَلُونَكَ
عَنِ الْأَنفَالِ ۖ قُلِ الْأَنفَالُ لِلَّهِ وَالرَّسُولِ﴾ লোকেরা তোমার কাছে গনীমাতের মাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে?
বলে দাও,
এ গনীমতের মাল তো আল্লাহ ও
তাঁর রাসূলের ৷
§ বদরের যুদ্ধে যে গনীমতের মাল পাওয়া
গিয়েছিল, তার বন্টন নিয়ে
মুসলমানদের মাঝে বিবাদ দেখা দেয়। বিবাদের কারণ সমূহঃ
১. এটা ছিল ইসলামের প্রথম যুদ্ধ,
বিধায় ইসলামের যুদ্ধ ও যুদ্ধ সংক্রান্ত বিধান মুসলমানদের জানা ছিলনা।
-
সূরা বাকারা ও সূরা মুহাম্মদে সামান্য প্রাথমিক নির্দেশনা ছিল, কিন্তু ইসলামী সামাজে সামিরক কৃষ্টি,
সভ্যতা ও রীতির সূচনা হয়নি।
-
মুসলমানরা যুদ্ধ সংক্রন্ত ব্যাপারে সেই ধরণের জাহেলী ধারণা পোষন
করতো, যে ধরণের ধারণা পোষন করতো
আরো বহু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে।
২. মুসলমানরা জাহেলী প্রথা অনুযায়ী
মনে করতো যে, গনিমতের মাল যার কাছে যে পরিমাণ হস্তগত হয়েছে,
সেই সেই ব্যক্তি সেই মালের মালিক।
৩. যারা গনিমতের দিকে না থাকিয়ে
কাফিরদের পিছনে ধাওয়াতে ব্যস্ত ছিল, তারা গনিমতের মালে নিজেদের
সমান অংশীদার মনে করতো।
৪. আরেকদল, যারা রাসূল সা. এর নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল। তারাও গনিমতে দাবী করলো।
§ এই নিয়ে বিবাদ তিক্ততায় রূপ নিল। তিক্ততা কথাবার্তা থেকে মনে ছড়িয়ে
পড়লো।
§ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এমনি
মনস্তাত্বিক পরিবেশে সূরা আনফাল নাযিল করলেন।
§ প্রথম বক্তব্যে প্রশ্নের মধ্যেই
জবাব দিয়ে দেয়া হলো, যুদ্ধলব্দ মালকে
‘আনফাল’ বলে।
§ ইমাম বুখারী বলেন, ইবনে আব্বাস রা বলেছেনঃ الأنفال المغانم আনফাল মানে গনীমাত।
§ আরবীতে আনফাল শব্দ নাফল এর বহু
বচন। যা ফরয,
ওয়াজিব নয়, বরং যা যথার্থ অধিকার বা মূল পাওনার
অতিরিক্ত-তাই নফল।
§ নফল যখন অধীনের পক্ষ থেকে হয়, তখন তার অর্থ দাড়ায়ঃ গোলাম তার নিজের মালিকের
দেয়া অবশ্য পালনীয় কাজের চাইতে বাড়তি কিছু কাজ করেছে।
§ নফল যখন মালিকের পক্ষ থেকে হয়, তখন অর্থ দাড়ায়ঃ এমন দান বা পুরুস্কার,
যা মালিকের পক্ষ থেকে গোলামকে তার মূল পাওনার অতিরিক্ত বা বখশিস হিসাবে
দেয়া হয়েছে।
§ উপরোক্ত দুইটি অর্থকে বিবেচনায়
নিয়ে এই বক্তব্যের অর্থ হলো, আল্লাহ দেয়া পুরস্কার ও অনুগ্রহ সম্পর্কে বা আল্লাহর দেয়া অতিরিক্ত জিনিস বখশিস
সম্পর্কে কি বাদানুবাদ, জিজ্ঞাসাবাদ ও বিতর্ক কলহ চলছে?
§ যদি এই প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে জিজ্ঞাসাঃ তোমরা কবে এই নফল বা অতিরিক্ত
বখশিসের মালিক হলে যে নিজেরাই তা বন্টন করা সিদ্ধান্ত নিলে। আর উত্তর হলোঃ যিনি এই সম্পদ দিয়েছেন, তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন কাকে কতটুকু দেয়া হবে,
আর কাকে দেয়া হবে না।
عن علي بن أبي طلحة عن ابن عباس أنه قال الأنفال
الغنائم، كانت لرسول الله صلى الله عليه وسلم خالصة ليس لأحد منها شيء
হযরত
আলী বিন আবি তালহা ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা
করেন। ইবনে আব্বাস রা. বলেছেনঃ আনফাল হলো গনিমত। যাতে একমাত্র রাসূল সা. ছাড়া আর কারও অধিকার নাই।
§ আনফালের আরো ৩টি অর্থ মুফাস্সিরিনগন
উল্লেখ করেছেনঃ
১. কোন কোন লোককে মূল গনিমত বন্টনের পর আরো কিছু
বেশী প্রদান করা।
২. চার অংশ বের করার পর যে এক অংশ বাকী থাকে,
সেই পঞ্চমাংশ।
৩. মালে ফাই বা ঐ মাল যা বিনা যুদ্ধে কাফেরদের
নিকট থেকে লাভ করা হয়।
৪. সারিয়ার মাধ্যমে যে সম্পদ অর্জিত হয়,
তা আনফাল। সারিয়া
হচ্ছে ছোট ছোট অভিযান, যাতে নবী সা. অংশ
নেননি এবং মুসলমানরা উপস্থিত হলে কাফেররা যুদ্ধ না করে মালামাল রেখে পালিয়ে যায়।
§ যুদ্ধ বিষয়ে এই বক্তব্য হলো একধরণের নৈতিক সংস্কার। যাতে বুঝানো হয়েছেঃ
১. মুসলমানদের যুদ্ধ দুনিয়ার কোন স্বার্থ বা সম্পদ লাভ করার জন্য নয়।
২. মুসলমানের যুদ্ধ নৈতিক ও তামাদ্দুনিক বিকৃতির সংস্কার সাধণের জন্য।
৩. মুসলমানরা যুদ্ধ করে বাধ্য হয়ে, যখন দাওয়াত ও সংস্কারের সকল পথ বন্ধ করে দেয়া হয়।
৪. মুসলমানরা যারা যুদ্ধে অংশ নেবে, তারা দৃষ্টি দেবে যুদ্ধের উদ্দেশ্যের দিকে। যুদ্ধে যদি আল্লাহ কোন পুরস্কার দেন, তাহলে তার নিকে নজর দেয়া ঠিক নয়।
৫. ইসলামী রাষ্টের শুভ সূচনায় মুসলমানদের দৃষ্টিকে দুনিয়াবী স্বার্থ থেকে সরাতে হবে, যাতে তাদের নৈতিক অধপতন না হয় এবং দুনিয়ার স্বার্থ লাভ তাদের উদ্দেশ্য হয়ে না যায়।
§ যুদ্ধ বিষয়ে এই বক্তব্য ছিল একটি প্রশাসনিক ও ম্যানেজম্যান্ট সংক্রান্ত সংস্কার।
গনিমতের মালে আগের
নিয়ম ছিলঃ
১. যুদ্ধে যে মাল যার হাতে পড়তো, সেই তার মালিক গন্য হতো। এতে করে বিজয়ী সৈন্যদের মধ্যে মারামারি হতো, যা বিজয়কে পরাজয়ে নিয়ে যেতো।
২. যুদ্ধে বাদশাহ বা সেনাপতি সকল গনিমতের মালিক হতো। ফলে সৈনিকরা চুরি করতো।
ইসলাম গনিমতের মাল নীতিতে সংস্কার করে বললোঃ
১. এই সম্পদ-ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, আল্লাহ ও রাসূলের সম্পদ। বিধায় তা কমবেশী না করে সব কিছু দায়িত্বশীলের সামনে রেখে দিতে হবে।
২. যে সম্পদ পাওয়া যাবে, তা নিম্নোক্ত পন্থায় বন্টিন হবেঃ
ক. পুরো সম্পদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ বায়তুলমালে জমা হবে।
খ. পুরো সম্পদের পাঁচ ভাগের চার ভাগ যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের মধ্যে সমান ভাগে বন্ঠিত হবে।
§ গনিমতের মালের মালিকানা সম্পর্কে
এখানে বলা হয়েছে যে, তা আল্লাহ ও তার
রাসূলের। বন্টন সম্পর্কে এখানে
কোন আলোচনা হয়নি। এর মাধ্যমে মুসলমানদের
মালিকার স্বীকৃতি গ্রহণ ও অনুগত্য সৃষ্টি উদ্দেশ্য।
§ কয়েক রুকু পর বন্টন প্রক্রিয়া
বলা হয়েছে। এখানে যুদ্ধলব্দ
মালকে আনফাল বলা হলেও পরে একে গনিমত বলা হয়েছে।
﴿فَاتَّقُوا
اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ ۖ وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِن
كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾ কাজেই তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, নিজেদের পারষ্পরিক সম্পর্কে শুধরে নাও এবং
আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো, যদি তোমরা মুমিন হয়ে
থাকো৷
§ সুদ্দী বলেছেনঃ ﴿وَأَصْلِحُوا
ذَاتَ بَيْنِكُمْ﴾ এর অর্থ হলো-لا
تستبوا
পরস্পর ঝগড়া বিবাদ করোনা, গালাগালি করো
না।
§ সাহাবায়ে কিরামদের মধ্যে পারস্পরিক
যে, তিক্ত ভাব তৈরী হয়েছিল,
সেই দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলা হয়েছেঃ এই ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো এবং পারস্পরিক
সম্পর্ক যেভাবে থাকার কথা সেভাবে হয়ে যাও। দুনিয়ার স্বার্থের কারণে একজন আরেকজনের
উপর অত্যাচার করোনা, পরস্পর শত্রু হয়ে যেও না।
§ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যে, হেদায়াত ও জ্ঞান দান করেছেন, তা এই গনিমতের মালের চেয়ে কি উত্তম নয়। অতএব আল্লাহ আর রাসূলের অনুগত হও।
﴿إِنَّمَا
الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا
تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ
يَتَوَكَّلُونَ﴾
২) সাচ্চা ঈমানদার তো তারাই আল্লাহকে স্মরণ করা হলে
যাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে৷ আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয়, তাদের ঈমান
বেড়ে যায় এবং তারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা
করে৷
প্রকৃত পক্ষে মুমিনতো তারা |
﴿إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ﴾ |
যারা, যখন স্মরণ করা হয় আল্লাহর (তাদের সামনে) |
﴿الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ﴾ |
কেঁপে উঠে তাদের অন্তর সমূহ |
﴿وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ﴾ |
এবং যখন তেলাওয়াত করা হয় তাদের সামনে তার আয়াত সমূহ |
﴿وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ﴾ |
(তখন) বেড়ে যায় তাদের ঈমান |
﴿زَادَتْهُمْ إِيمَانًا﴾ |
এবং তাদের মালিকের উপর তারা নির্ভর করে |
﴿وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ﴾ |
﴿إِنَّمَا
الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ﴾ সাচ্চা ঈমানদার তো তারাই আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের
হৃদয় কেঁপে ওঠে৷
§ ইবনে কাসির বলেছেনঃ وهذه صفة المؤمن حق المؤمن الذي إذا ذكر الله وجل
قلبه، أي خاف منه “এটা হলো মুমিনের গুণ, সত্যিকার মুমিন সে, যার সামনে আল্লাহর যিকির করা হয়-তখন তার অন্তর কেঁপে
উঠে অর্থাৎ সে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।”
§ সূরা
আলে
ইমরানে
আল্লাহ
বলেনঃ
﴿وَالَّذِينَ إِذَا
فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا
لِذُنُوبِهِمْ وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَىٰ
مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ﴾
আর যারা
কখনো কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা কোন গোনাহের কাজ করে নিজেদের ওপর জুলুম করে
বসলে আবার সংগে সংগে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়ে তাঁর কাছে নিজেদের গোনাহ খাতার জন্য মাফ
চায় – কারণ আল্লাহ ছাড়া আর কে গোনাহ মাফ করতে পারেন – এবং জেনে বুঝে নিজেদের
কৃতকর্মের ওপর জোর দেয় না। (আয়াতঃ ১৩৫)
§ সূরা
আন
নাযিয়াতের ৪০-৪১ নম্বর
আয়াতে
আল্লাহ
বলেনঃ
﴿وَأَمَّا مَنْ خَافَ
مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَىٰ﴾﴿فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ
الْمَأْوَىٰ﴾
আর যে
ব্যক্তি নিজের রবের সামনে এসে দাঁড়াবার ব্যাপারে ভীত ছিল এবং নফসকে খারাপ কামনা
থেকে বিরত রেখেছিল। তার ঠিকানা হবে জান্নাত৷
﴿وَإِذَا
تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ
يَتَوَكَّلُونَ﴾ আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয়, তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে৷
§ যেমন সূরা তাওবাতে বলা হয়েছেঃ
আয়াত ১২৪
﴿وَإِذَا مَا أُنزِلَتْ
سُورَةٌ فَمِنْهُم مَّن يَقُولُ أَيُّكُمْ زَادَتْهُ هَٰذِهِ إِيمَانًا ۚ فَأَمَّا
الَّذِينَ آمَنُوا فَزَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ﴾
যখন
কোন নতুন সূরা নাযিল হয় তখন তাদের কেউ কেউ (ঠাট্রা করে মুসলমানদের ) জিজ্ঞেস করে, বলো,
এর ফলে তোমাদের কার ঈমান বেড়ে গেছে? (এর
জবাব হচ্ছে) যারা ঈমান এনেছে (প্রত্যেকটি অবতীর্ণ সুরা) যথার্থই ঈমান বাড়িয়েই
দিয়েছে এবং তারা এর ফলে আনন্দিত৷
§ সূরা
আলে
ইমরানে
আল্লাহ
বলেনঃ
﴿الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ
النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ
إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ﴾
লোকেরা
বললোঃ তোমাদের বিরুদ্ধে বিরাট সেনা সমাবেশ ঘটেছে৷ তাদেরকে ভয় করো, তা
শুনে তাদের ঈমান আরো বেড়ে গেছে এবং তারা জবাবে বলেছেঃ আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট
এবং তিনি সবচেয়ে ভালো কার্য উদ্ধারকারী৷ (আয়াতঃ ১৭৩)
§ ঈমান
বেড়ে
যায়
মানেঃ
- যখন
ঈমানদারের সামনে আল্লাহর কোন হুকুম আসে,
তখন
তাকে
সত্য
বলে
শিকার
করে
আনুগত্য
করে-এর আর মাধ্যমে
ঈমান
বাড়ে।
- মানুষ
যখন
আল্লাহর
কিতাব
বা
রাসূল
সা.
এর
হেদায়াতের মধ্যে এমন জিনিস দেখে যা তার নিম্নোক্ত কারণে তার কাছে গ্রহণ যোগ্য নয়,
বরং
বিরোধী। কিন্তু তখন আল্লাহ ও রাসূলের বিধান বদল করার পরিবর্তে নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলে। এই পরিবর্তন করতে যে কষ্ট স্বীকার করে,
তার
মাধ্যমে
ঈমান
তরতাজা
ও
পরিপুষ্ট হয়। যেমনঃ
ক. মানুষের ইচ্ছা আশা আকাংখা।
খ. মানুষের চিন্তা-ভাবনা
মতবাদ।
গ. মানুষের পরিচিত আচার-আচরণ।
ঘ. মানুষের স্বার্থ।
ঙ. মানুষের আরাম-আয়েশ।
চ. মানুষের ভালবাসা ও বন্ধুত্ব।
- অপরদিকে,
মানুষ
যখন
আল্লাহ
ও
রাসূলের
হেদায়াতের সামনে আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জানায়,
তখন
ঈমানের
প্রাণ
শক্তি
নিস্তেজ
হওয়া
শুরু
করে।
§ ঈমান
বাড়া
কমার
এই
আলোচনা
থেকে
আমরা
জানলামঃ
- ঈমান
কোন
অনড়,
নিশ্চল,
কোন
স্থির
জিনিসের
নাম
নয়।
- ঈমান
কোন
একবার
মানা
বা
না
মানার
বিষয়
নয়।
- ঈমান
বাড়ে
কমে।
- এইটা হলো ঈমান বাড়া কমার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা।
§ ফেকাহর
দৃষ্টিতে ঈমান বাড়া কমাঃ
- তামাদ্দুনিক ব্যবস্থায় অধিকার ও মার্যাদা নির্দিষ্ট করার জন্য ঈমান মানা বা না মানার বিষয়টি একবারই গন্য করা হয়।
- ইসলামী
ব্যবস্থায় সকল মুমিনের আইনগত অধিকার ও মর্যাদা সমান।
- ইসলামী
ব্যবস্থায় সকল অস্বীকারকারী এক ধরণের। তারা
যিম্মী
বা
বাহরবী
(যুদ্ধমান),
অথবা
চূক্তিবদ্ধ ও আশ্রিত। কুফুরীতে
তাদের
মাঝে
যতই
পার্থক্য হোক না কেন।
§ ইমাম বুখারী সহ অনেক ইমাম এই আয়াতকে
দলীল হিসাবে গ্রহণ করে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, ঈমান বাড়তে পারে, কমতে পারে।
﴿وَعَلَىٰ
رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ﴾ এবং তারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে৷
§ তারা তাদের মালিক ছাড়া অন্য কারো
কাচে কোন আশাই করে না, আশ্রয়দাতা একমাত্র
তাকেই মনে করে। প্রতিটি কাজে তার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
§ সাঈদ বিন জুবাইর বলেনঃ التوكل على الله جماع
الإيمان আল্লাহর উপর ভরসা হচ্ছে ঈমানের বন্ধন।
§ তাওয়াক্কুল মানে ভরসা, নির্ভরতা।
§ কুরআনে হাকীমে অন্যান্য স্থানে আল্লাহ বলছেনঃ
﴿وَعَلَى ٱللَّهِ
فَلۡيَتَوَكَّلِ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ﴾
‘‘আর
আল্লাহর ওপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিত।’’ – সূরা ইব্রাহীম-আয়াতঃ ১১
﴿فَإِذَا عَزَمۡتَ
فَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُتَوَكِّلِينَ﴾
‘‘অতঃপর
তুমি যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তখন আল্লাহর ওপর ভরসা কর।’’ -সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯
﴿وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى
ٱللَّهِ فَهُوَ حَسۡبُهُ﴾
‘‘আর যে
ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্যে যথেষ্ট।’’ -সূরা আত-তালাক, আয়াত: ৩
§ রাসূল সা. এর হাদীস-যা ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেনঃ
عَنِ ابنِ عباسٍ رضِي
الله عنهما قال: قال رسولُ الله صلّي الله عليه وسلم: «عُرِضتْ عليّ الأممِ،
فرأيتُ النبيَّ ومعه الرُّهيْط، والنبيَّ ومعه الرجلُ والرجلان، والنبيَّ وليس معه
أحدٌ؛ إذْ رُفِع لي سوادٌ عظيم فظننت أنهم أمَّتي، فقيل لي: هذا موسى وقومُه، ولكن
انظر إلى الأفقِ، فنظرتُ فإذا سوادٌ عظيم، فقيل لي: انظر إلى الأفق الآخر، فإذا
سواد عظيم، فقيل لي هذه أُمَّتُك، ومعهم سبعون ألفًا يدخلون الجنَّةَ بغير حسابٍ
ولا عذابٍ» ثم نهض فدخل منزلَه، فخاض الناس في أولئك الذين يدخلون الجنَّةَ بغير
حسابٍ ولا عذابٍ، فقال بعضُهم: فلعلَّهم الذين صَحِبوا رسولَ الله صلي الله عليه
وسلم، وقال بعضُهم: فلعلَّهم الذين ولدوا في الإسلام، فلم يُشركوا بالله شيئًا -
وذكروا أشياء - فخرج عليهم رسولُ الله صلَّي الله عليه وسلَّم فقال: «ما الذي
تخوضون فيه؟»، فأخبروه فقال: «هم الذين لا يرْقون، ولا يسْتَرقون ولا يتطيَّرون،
وعلي ربِّهم يتوكَّلون»، فقام عُكَّاشةُ بن محصنٍ فقال: ادعُ الله أنْ يجعلني
منهم، فقال: «أنْتَ منهم»، ثم قام رجلٌ آخر فقال: ادعُ الله أن يجعلَني منهم،
فقال: «سبقَك بها عُكَّاشة». مُتَّفقٌ عليه.
ইবনে
আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন। রাসূল সা. বলেছেনঃ “আমার সম্মুখে সকল উম্মতকে পেশ করা হলো। (এভাবে যে,) আমি একজন নবীকে ছোট একটি দলসহ দেখলাম।
কয়েকজন নবীকে একজন বা দু’জন অনুসারীসহ দেখলাম। আরেকজন নবীকে দেখলাম তার সাথে কেউ
নেই। ইতোমধ্যে আমাকে একটি বড় দল দেখানো হলো। আমি মনে করলাম এরা হয়ত আমার উম্মত
হবে। কিন্তু আমাকে বলা হলো, এরা হলো মূসা আলাইহিস সালাম ও তার
উম্মত। আমাকে বলা হলো, আপনি অন্য প্রান্তে তাকান। আমি
তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে বিরাট একটি দল। আবার আমাকে বলা হলো,
আপনি অন্য প্রান্তে তাকান। তাকিয়ে দেখলাম, সেখানেও বিশাল এক দল। এরপর আমাকে বলা হলো, এসব
হলো আপনার উম্মত। তাদের সাথে সত্তর হাজার মানুষ আছে যারা বিনা হিসেবে ও কোনো
শাস্তি ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ পর্যন্ত বলার পর রাসূলুল্লাহ সা. তার ঘরে চলে গেলেন। এরপর লোকেরা সেসব মানুষ (যারা বিনা হিসাবে ও বিনা
শাস্তিতে জান্নাতে প্রবেশ করবে) তারা কারা হবে, সে সম্পর্কে আলোচনা
শুরু করে দিল। কেউ বলল, এরা হচ্ছে, যারা রাসূলুল্লাহ সা. এর সাহচর্য লাভ করেছে।
আবার কেউ বলল, এরা হবে যারা ইসলাম অবস্থায় জন্ম গ্রহণ
করেছে আর আল্লাহর সাথে কখনো শরীক করে নি, তারা। এভাবে
সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন। এমন সময় রাসূলুল্লাহ সা. বের হয়ে এসে বললেন, তোমরা কী বিষয়ে আলোচনা
করছ? সাহাবীগণ আলোচনার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে তাকে জানালেন।
রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তারা
হচ্ছে এমনসব লোক যারা ঝাড়-ফুঁক করেনা। ঝাড়-ফুঁক চায় না। কোনো কুলক্ষণে-শুভাশুভে
বিশ্বাস করে না এবং শুধুমাত্র নিজ রবের ওপর তাওয়াক্কুল
করে।’’ এ কথা শুনে উক্কাশা ইবন মিহসান দাঁড়িয়ে বলল, আপনি
আল্লাহর কাছে দো‘আ করুন, তিনি যেন আমাকে তাদের
অন্তর্ভুক্ত করে দেন। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত। এরপর আরেকজন উঠে বলল, আপনি আল্লাহর কাছে দো‘আ করুন, তিনি যেন আমাকেও
তাদের অন্তর্ভুক্ত করে দেন। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন,
‘‘উক্কাশা এ ব্যাপারে তোমার অগ্রগামী হয়ে গেছে।’’
§ রাসূল সা. আরো বলেছেনঃ
من أحبّ أن يكون أقوى الناس فليتوكل على اللّه
تعالىযে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশী শক্তিমান হতে চায়, সে যেন একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে।
অধ্যাপক গোলাম আযম রাহি. তার ‘তাকদীর তাওয়াক্কুল সবর শোকর’ বইতে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। তবে শায়খ আলবানী হাদীসটাকে অত্যন্ত জয়ীফ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
§ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূল সা. বলতেনঃ
اللَّهُم لَكَ أسْلَمْتُ
وبِكَ آمنْتُ، وعليكَ توَكَّلْتُ، وإلَيكَ أنَبْتُ، وبِكَ خاصَمْتُ. اللَّهمَّ
أعُوذُ بِعِزَّتِكَ، لا إلَه إلاَّ أنْتَ أنْ تُضِلَّنِي أنْت الْحيُّ الَّذي لاَ
تمُوتُ، وَالْجِنُّ وَالإِنْسُ يمُوتُونَ
‘‘হে আল্লাহ!
আমি আপনার কাছেই আত্মসমর্পণ করেছি। আপনার
ওপরই ঈমান এনেছি। আপনার ওপরই তাওয়াক্কুল (ভরসা) করেছি। আপনার দিকেই মনোনিবেশ করেছি। আপনার জন্যই তর্ক করেছি। হে আল্লাহ! আপনার সম্মানের মাধ্যমে আশ্রয়
প্রার্থনা করছি -আর আপনি ছাড়াতো কোনো উপাস্য নেই- যেন আমাকে পথভ্রষ্ট না করেন। আপনি চিরঞ্জীব সত্তা, যিনি
মারা যাবেন না। আর মানুষ ও জিন মারা
যাবে।’’ (সহীহ মুসলিম)
﴿الَّذِينَ
يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ﴾
৩) তারা নামায কায়েম করে এবং যা কিছু আমি তাদেরকে
দিয়েছি তা থেকে ( আমার পথে) খরচ করে৷
যারা কায়েম করে নামায |
﴿الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ﴾ |
এবং যে রিযক তাদেরকে দেয়া হয়েছে, তা
থেকে খরচ করে |
﴿وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ﴾ |
﴿الَّذِينَ
يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ﴾ তারা নামায কায়েম করে এবং যা কিছু আমি তাদেরকে দিয়েছি তা
থেকে (আমার পথে) খরচ করে৷
§ মুমিনদের আকীদা সম্পর্কে আলোচনার পর তাদের আমল নিয়ে কথা শুরু হচ্ছে। বলা
হচ্ছেঃ
তারা
নামায
পড়ে
এবং
তাদেরকে
যে
মাল
দেয়া
হয়েছে,
তা
থেকে
গরীব
দূঃখী
মানুষকে
দান
করে।
§ ইবনে
আব্বাস
রা.
এই
আয়াতের
ব্যাখ্যা প্রসংগে বলেনঃ
المنافقون لا يدخل قلوبهم
شيء من ذكر الله عند أداء فرائضه. ولا يؤمنون بشيء من آيات الله، ولا يتوكلون، ولا
يصلون إذا غابوا، ولا يؤدون زكاة أموالهم، فأخبر الله تعالى أنهم ليسوا بمؤمنين،
মুনাফিকরা যখন নামায পড়ে, তখন কুরআনের আয়াত সমূহ তাদের অন্তরে ক্রিয়াশীল হয়না। না তারা আল্লাহর আয়াত সমূহের উপর ঈমান আনে, না আল্লাহর উপর ভরসা করে।
§ ইকামতে
সালাতের
অর্থঃ
-
নামাযকে
সময়
মতো
আদায়
করা।
-
ভাল
ভাবে
অজু
করা।
-
রুকু
সেজদা
তাড়াহুড়া না করে হক আদায় করে করা।
-
আদবের
সাথে
কুরআন
তেলাওয়াত ও দুরুদ পাঠ করা।
-
নামাযকে
সমাজে
প্রতিষ্ঠিত করা।
§ খরচ করা মানেঃ
- নিসাব অনুযায়ী যাকাত প্রদান করা।
- যা কিছু আছে, তা থেকে মানুষকে দান করা।
- বান্দার ওয়াজিব ও মুসতাহাব আর্থিক হক আদায় করা।
﴿أُولَٰئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا ۚ لَّهُمْ
دَرَجَاتٌ عِندَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ﴾
৪) এ ধরনের লোকেরাই প্রকৃত মুমিন৷ তাদের জন্য তাদের
রবের কাছে রয়েছে বিরাট মর্যাদা , ভূলত্রুটির ক্ষমা ও উত্তম রিযিক৷
এরা সেই সব লোক তারা সত্যিকার মুমিন |
﴿أُولَٰئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا﴾ |
তাদের জন্য রয়েছে মর্যাদাসমূহ, তাদের
মালিকের কাছে |
﴿لَّهُمْ دَرَجَاتٌ عِندَ رَبِّهِمْ﴾ |
এবং ক্ষমা ও সম্মাণ জনক রিযক |
﴿وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ﴾ |
﴿أُولَٰئِكَ
هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا﴾ এ ধরনের লোকেরাই প্রকৃত মুমিন৷
§ উপরে
যে
গুণ
গুলোর
কথা
বলা
হলো,
সে
সব
গুণে
যারা
গুনান্বিত,
তারাই
প্রকৃত
মুমিন।
§ হারিছ
ইবনে
মালিক
রা.
একবার
রাসূল
সা.
এর
খেদমতে
হাজির
হলেন। রাসূল সা. তাকে বললেনঃ كيف أصبحت يا حارث؟ হে
হারিস!
সকাল
বেলা
তোমার
কিভাবে
কেটেছে?
হারিস
উত্তরে
বললেনঃ
أصبحت مؤمناً حقاً একজন
প্রকৃত
মুমিন
হিসেবে। তখন
রাসূল
সা.
তাকে
বললেনঃ
انظر ما تقول، فإن لكل شيء حقيقة، فما حقيقة إيمانك؟ খুব
চিন্তা
করে
কথা
বল। প্রত্যেকটি জিনিসেরই একটা হাকীকত বা মূলতত্ত্ব রয়েছে। বলতো,
তোমার
ঈমানের
হাকীকত
কি?
হারিস
রা.
উত্তরে
বললেনঃ
عزفت نفسي عن الدنيا، فأسهرت ليلي، وأظمأت نهاري، وكأني أنظر
إلى عرش ربي بارزاً، وكأني أنظر إلى أهل الجنة يتزاورون فيها، وكأني أنظر إلى أهل
النار يتضاغون فيها আমি
দুনিয়ার
মহব্বত
থেকে
মুখ
ফিরিয়ে
নিয়েছি,
রাতে
জেগে
জেগে
ইবাদত
করি,
দিনে
রোযার
কারণে
পিপাসার্থ থাকি এবং নিজেকে এইরূপ পাই যে,
যেমন
আমার
সামনে
আল্লাহর
আরশ
খোলা
রয়েছে,
আমি
যেন
জান্নাতবাসীদেরকে পরস্পর মিলিত হতে দেখছি। জাহান্নামবাসীদেরকে
দেখছি
যে,
তরা
কষ্ট
ও
বিপদে
রয়েছে। রাসুল সা. বললেনঃ يا حارث عرفت فالزم হ্যাঁ,
হে
হারিস!
তাহলে
তুমি
ঈমানের
হাকীকতে
পৌছে
গেছো। এর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার চেষ্টা কর। ثلاثاً একথা তিনি তিনবার বললেন।
﴿لَّهُمْ
دَرَجَاتٌ عِندَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ﴾ তাদের জন্য তাদের রবের কাছে রয়েছে বিরাট
মর্যাদা , ভূলত্রুটির
ক্ষমা৷
§ ভূল
এমন
জিনিস-যা বড় বড় ও উন্নত
মানের
ঈমানদাররাও করতে পারে।
§ মানুষ
যতদিন
বাঁচবে,
ততদিন
সে
যেমন
উন্নত
মানের
আমল
করবে,
তেমনি
তার
দোষ-ত্রুটি
ও
ভূল-ভ্রান্তি
থাকবেই।
§ মানুষ
যদি
ইবাদতের
অনিবার্য শর্তসমূহ পালন করে,
তাহলে
আল্লাহ
সুবহানাহু ওয়া তায়ালা দয়া করে তার ভুল-ত্রুটি
উপেক্ষা
করেন।
§ মানুষ
ইবাদতে
অনিবার্য শর্ত মানলে,
যে
যতটুকু
ভাল
কাজ
করে
আল্লাহ
অনুগ্রহ
করে
তার
চেয়ে
বেশী
প্রতিদান দান করেন।
§ যদি
সকল
ভাল
ও
খারাপ
কাজকে
পংখানুপংখু হিসাব করা হতো,
তাহলে
বড়
বড়
আমলদান
মানুষও
শাস্তির
হাত
থেকে
রেহাই
পেতো
না।
§ রাসূল সা. বলেছেন-যা বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছেঃ إن أهل عليين ليراهم من أسفل منهم كما ترون الكوكب الغابر في
أفق من آفاق السماء
উপরের লোকদেরকে নিচের লোকেরা এরূপ দেখবে, যেমন তোমরা আকাশে তারকারাজি দেখে থাকো। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেনঃ يا رسول الله تلك منازل الأنبياء لا ينالها غيرهم হে আল্লাহর রাসূল সা.! এটা কি নবীদের মনযিল, যা অন্য কেউ লাভ করবে না? উত্তরে নবী সা. বললেনঃ بلى والذي نفسي بيده، لرجال آمنوا بالله وصدقوا المرسلين কেন লাভ করবে না? আল্লাহর শপথ! যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে এবং রাসূলদেরকে সত্য জেনেছে তারাও এর অধিকারী হবে।
§ অন্য
হাদীসে
হযরত
আবি
সাঈদ
রা.
থেকে
বর্ণিত,
রাসূল সা. বলেনঃ إن أهل الجنة ليتراءون أهل الدرجات العلى كما تراءون الكوكب الغابر في أفق
السماء، وإن أبا بكر وعمر منهم، وأنعما জান্নাতবাসীরা উপরের জান্নাতবাসীদের এরূপ দেখবে যেমন আকাশের উপর তারকারাজি দেখা যায়। আবু বকর এবং উমর রা. তাদেরই অন্তর্ভূক্ত। তারাও এই মর্যাদা লাভ করবে।
﴿وَرِزْقٌ
كَرِيمٌ﴾ ও উত্তম রিযিক৷
§ ﺭِﺯْﻕ এর বহু বচন হচ্ছেঃ ﺃَﺭﺯﺍﻕ রিযিক এমন বস্তু, যা দিয়ে মানুষ উপকৃত হয়।
§ লিসানুল আবর গ্রন্থে বলা হয়েছে রিযক দুই প্রকার। যেমনঃ
১. প্রকাশ্য রিযক যা শরীরকে প্রদান করা হয়,যেমন খাদ্য। ।
২. অপ্রকাশ্য রিযক যা রুহকে প্রদান করা হয়,যেমন আল্লাহর
মা'রেফত, জ্ঞানবিজ্ঞান ইত্যাদি।
§ হযরত উমর রা. বর্ণিত হাদীস। তিনি বলেনঃ
سمعت رسول الله ﷺ يقول: لو أنكم تتوكلون على الله
حق توكله لرزقكم كما يرزق الطير، تغدو خماصاً وتروح بطاناً
‘তোমরা
যদি যথার্থভাবে আল্লাহর ওপর ভরসা-তায়াক্কুল করতে পার তাহলে আল্লাহ তোমাদের রিযক
দেবেন যেমনি রিযিক দিয়ে থাকেন পাখিকুলকে, পাখি সকালে
শূন্য উদরে বের হয় আর সন্ধ্যায় নীড়ে ফিরে আসে উদরপূর্তি করে’। (আহমাদ ও তিরমিজি)
§ কুরআনে হাকীমে বর্ণিত হয়েছেঃ
﴿هُوَ الَّذِي جَعَلَ
لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُولًا فَامْشُوا فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُوا مِن رِّزْقِهِ ۖ
وَإِلَيْهِ النُّشُورُ﴾
তিনিই
তো সেই মহান সত্তা যিনি ভূপৃষ্ঠকে তোমাদের জন্য অনুগত করে দিয়েছেন৷ তোমরা এর
বুকের ওপর চলাফেরা করো এবং আল্লাহর দেয়া রিযিক খাও৷ আবার জীবিত হয়ে তোমাদেরকে তার
কাছেই ফিরে যেতে হবে। (সূরা আল মুলকঃ ১৫)
﴿وَاللَّهُ فَضَّلَ
بَعْضَكُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ فِي الرِّزْقِ ۚ فَمَا الَّذِينَ فُضِّلُوا بِرَادِّي
رِزْقِهِمْ عَلَىٰ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَهُمْ فِيهِ سَوَاءٌ ۚ
أَفَبِنِعْمَةِ اللَّهِ يَجْحَدُونَ﴾
আর দেখো, আল্লাহ
তোমাদের একজনকে আর একজনের ওপর রিযিকের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন৷ তারপর
যাদেরকে এ শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে তারা এমন নয় যে নিজেদের রিযিক নিজেদের
গোলামদের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে থাকে, যাতে উভয় এ রিযিকে সমান
অংশীদার হয়ে যায়৷ তাহলে কি এরা শুধু আল্লাহরই অনুগ্রহ মেনে নিতে অস্বীকার করে?
(সূরা আন নাহলঃ ৭১)
﴿قُلْ إِنَّ رَبِّي
يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَن يَشَاءُ وَيَقْدِرُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا
يَعْلَمُونَ﴾
হে নবী
!তাদেরকে বলে দাও, আমার রব যাকে চান প্রশস্ত রিযিক দান
করেন এবং যাকে চান মাপাজোপা দান করেন কিন্তু বেশীর ভাগ লোক এর প্রকৃত তাৎপর্য
জানে না৷ (সূরা সাবাঃ ৩৬)
﴿إِنَّ اللَّهَ يَرْزُقُ
مَن يَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ﴾
আল্লাহ
যাকে চান, বেহিসেব দান করেন। (সূরা আলে ইমরানঃ ৩৭)
﴿كَمَا أَخْرَجَكَ
رَبُّكَ مِن بَيْتِكَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ فَرِيقًا مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ
لَكَارِهُونَ﴾
৫) (এই গনীমাতের মালের ব্যাপারে ঠিক তেমনি অবস্থা
দেখা দিচ্ছে যেমন অবস্থা সে সময় দেখা দিয়েছিল যখন) তোমার রব তোমাকে সত্য সহকারে
ঘর থেকে বের করে এনেছিলেন এবং মুমিনদের একটি দলের কাছে এটা ছিল বড়ই অসহনীয়৷
যেভাবে তোমাকে বের করেছিলেন তোমার মালিক তোমার ঘর থেকে
ন্যায়ের সাথে |
﴿كَمَا أَخْرَجَكَ رَبُّكَ مِن بَيْتِكَ بِالْحَقِّ﴾ |
এবং নিশ্চয়ই একটি দল মুমিনদের মধ্য থেকে যারা ছিল অবশ্যই
অপছন্দকারী |
﴿وَإِنَّ فَرِيقًا مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ لَكَارِهُونَ﴾ |
﴿كَمَا
أَخْرَجَكَ رَبُّكَ مِن بَيْتِكَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ فَرِيقًا مِّنَ
الْمُؤْمِنِينَ لَكَارِهُونَ﴾ (এই গনীমাতের মালের ব্যাপারে ঠিক তেমনি
অবস্থা দেখা দিচ্ছে যেমন অবস্থা সে সময় দেখা দিয়েছিল যখন) তোমার রব তোমাকে সত্য
সহকারে ঘর থেকে বের করে এনেছিলেন এবং মুমিনদের একটি দলের কাছে এটা ছিল বড়ই অসহনীয়৷
§ বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের একটা
দল যুদ্ধে বের হওয়াটাকে অপছন্দনীয় মনে করছি। আল্লাহ তাদের অপছন্দনীয় থাকা অবস্থায়ও তাদেরকে বের করে নিয়ে
আসলেন, সেই ঘটনার দিকে দৃষ্টি দেয়া
হয়েছে।
§ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এখানে
বুঝাচ্ছেনঃ যুদ্ধকে অপছন্দ করার ফল এই দাড়ালো যে, আল্লাহ কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করতে তোমাদের বাধ্য করলেন। এর মাধ্যমে তোমাদের বের করে এনে মূলত
হেদায়াত দান করলেন। তোমাদের
সাহায্য করে জয়যুক্ত করলেন।
§ কুরআনের সুরা বাকারার ২১৬ নম্বর
আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ
﴿كُتِبَ عَلَيْكُمُ
الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَّكُمْ ۖ وَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ
خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ وَعَسَىٰ أَن تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ ۗ
وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ﴾
তোমাদের
যুদ্ধ করার হুকুম দেয়া হয়েছে এবং তা তোমাদের কাছে অপ্রীতিকর ৷ হতে পারে কোন জিনিস তোমরা
পছন্দ করো অথচ তা তোমাদের জন্য খারাপ ৷ আল্লাহ জানেন, তোমরা
জানো না ৷
﴿يُجَادِلُونَكَ فِي الْحَقِّ بَعْدَمَا
تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُونَ إِلَى الْمَوْتِ وَهُمْ يَنظُرُونَ﴾
৬) তারা এ সত্যের ব্যাপারে তোমার সাথে ঝগড়া করছিল
অথচ তা একেবারে পরিস্কার হয়ে ভেসে উঠেছিল৷ তাদের অবস্থা এমন ছিল, যেন তারা
দেখছিল তাদেরকে মৃত্যুর দিকে হাকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷
তারা তোমার সাথে বিতর্ক করে সত্যের ব্যাপারে |
﴿يُجَادِلُونَكَ فِي الْحَقِّ﴾ |
যা অত্যন্ত পরিস্কার হয়ে যাওয়ার পরে |
﴿بَعْدَمَا تَبَيَّنَ﴾ |
যেন আসলে তারা পরিচালিত হচ্ছে
মৃত্যুর দিকে |
﴿ كَأَنَّمَا يُسَاقُونَ إِلَى الْمَوْتِ﴾ |
আর তারা তা দেখছিলো |
﴿وَهُمْ يَنظُرُونَ﴾ |
﴿يُجَادِلُونَكَ
فِي الْحَقِّ بَعْدَمَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُونَ إِلَى الْمَوْتِ وَهُمْ
يَنظُرُونَ﴾ তারা এ সত্যের ব্যাপারে তোমার সাথে ঝগড়া
করছিল অথচ তা একেবারে পরিস্কার হয়ে ভেসে উঠেছিল৷ তাদের অবস্থা এমন ছিল, যেন তরা দেখছিল তাদেরকে মৃত্যুর দিকে
হাকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷
§ এই
বক্তব্যের ২টি অর্থ হতে পারেঃ
১. বদরের যুদ্ধে যখন বিপদ আসে,
তখন
সেই
বিপদের
মুখে
এগিয়ে
যাওয়া
ছিল
হকের
দাবী-কিন্তু
সে
সময়ে
তারা
বিপদের
মোকাবেলা করতে ভয় পাচ্ছিল। একই
ভাবে,
বদরের
যুদ্ধে
পাওয়া
মালের
ব্যাপারে আল্লাহর ও রাসূলের নির্দেশনা কি,
তার
অপেক্ষা
করা
ছিল
হকের
দাবী-কিন্তু
তারা
অপেক্ষা
না
করে
মাল
হাত
ছাড়া
হয়ে
যাচ্ছে
মনে
করে
তাদের
কষ্ট
হচ্ছে।
২. বদরের যুদ্ধে যেমন ভাল ফল দেখেছো, যদি আল্লাহর আনুগত্য করো এবং নিজের নফসের পরিবর্তে রাসূল সা. এর কথা মানো, তাহলে তেমন ভাল ফল দেখবে। কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ করা যেমন দুসহনীয় ও ধ্বংসবার্তা মনে হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর রাসূলের কথা মানার কারণে বিপজ্জনক এই কাজটা তোমাদের জন্য সাফল্যের রার্তা বয়ে নিয়ে আসলো।
§ সীরাত ও ইতিহাসের বইয়ে বদর যুদ্ধের যে বর্ণনা এসেছে, তাতে এসেছে রাসূল সা. মুসলমানদের নিয়ে কুরাইশদের বানিজ্য কাফেলা লুট করার জন্য মদীনা থেকে বের হয়েছিলেন। কয়েক মনজিল যাওয়ার পর খবর আসলো বানিজ্য কাফেলাকে হেফাজত করার জন্য কুরাইশদের বাহিনী মক্কা থেকে এগিয়ে আসছে। সেই সময় পরামর্শ করা হলো বানিজ্য কাফেলায় হামলা করা হবে, না মক্কার সেনাবাহিনীর মুকাবেলার করা হবে?
§ কুরআন উপরোক্ত বর্ণনার প্রতিবাদ করে সম্পূর্ণ কথা বলছেঃ নবী সা. ঘর থেকে বের হয়েছিলেন কুরাইশ সেনাদলের সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে। বানিজ্য কাফেলায় হামলা হবে, না মক্কার সেনাবাহিনীতে-তার পরামর্শ হয়েছে মদীনায় বসেই। সেনাদলের মোকাবেলা করা অপরিহার্য হলেও কিছু মানুষ যুদ্ধ থেকে বাঁচার জন্য বিতর্ক করেছিল। পরে যখন কুরাইশ সেনা কাফেলায় হামলারই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো, তখন তারা মদীনা থেকে একথা মনে করেই বের হয়েছিল যে, তাদেরকে সোজা মৃত্যুর দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
§ মাওলানা মওদূদী রাহ. এর এই বক্তব্য এবং অন্যান্য তাফসীরের বক্তব্যে
আমরা কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করি। যেমনঃ
o ইবনে
কাসিরে
উল্লেখ
করা
হয়েছে
যে,
মদীনা
থেকে
বের
হয়েছেন
বানিজ্য
কাফেলাকে অবরোধ করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু
পথিমধ্যে গিয়ে জানা গেছে,
কুরাইশ
বাহিনী
১
হাজার
সৈন্য
নিয়ে
আসছে। তখন রাসূল সা. পরামর্শ করেছেন। সেই
পরামর্শে অধিকাংশ সাহাবী যে উদ্দেশ্যে বের হয়েছে,
সে
উদ্দেশ্যে তথা বানিজ্য কাফেলাকে ফলো করার পক্ষে মত দেন। কিন্তু
পরে
কুরাইশদের মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে তিনি নিম্নোক্ত হাদীস গুলো উল্লেখ করেনঃ
عن أسلم أبي عمران، حدثه أنه سمع أبا أيوب الأنصاري يقول قال رسول
الله صلى الله عليه وسلم ونحن بالمدينة" إني أخبرت عن عير أبي سفيان أنها مقبلة، فهل لكم أن نخرج قبل هذه
العير لعل الله أن يغنمناها؟ " فقلنا نعم، فخرج وخرجنا، فلما سرنا يوماً أو يومين، قال لنا "ما ترون في قتال القوم
فإنهم قد أخبروا بمخرجكم؟ "فقلنا لا، والله ما لنا طاقة بقتال العدو، ولكنا أردنا العير، ثم
قال "
ما ترون في قتال القوم؟ فقلنا مثل ذلك، فقال
المقداد بن عمرو إذاً لا نقول لك يا رسول الله كما قال قوم موسى لموسى فَٱذْهَبْ أَنتَ
وَرَبُّكَ فَقَاتِلاۤ إِنَّا هَـٰهُنَا قَـٰعِدُونَ قال فتمنينا معشر الأنصار
أن لو قلنا كما قال المقداد أحب إلينا من أن يكون لنا مال عظيم.
আসলাম
এর পিতা ইমরান আবু আবু আইয়ুব আনসারী রা. কে বলতে শুনেছেন
এবং তখন আমরা মদিীনায় ছিলাম। রাসূল সা.
বলেছেনঃ আমি সংবাদ পেয়েছি একটি কাফেলা সম্পর্কে, যা আবু সুফিয়ান রা. নিয়ে আসতেছে। তোমাদের
মতামত কি? আমরা কি এই ঐ কাফেলার পথরোধ করার জন্য বের হবো? হতে পারে এর
মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে অনেক গনিমাত প্রদান করবেন। আমরা আরজ করলাম, আমরা অবশ্যই বের হতে চাই। সুতরাং বেরিয়ে পড়লাম। আমরা দু’একদিন চলতে থাকলাম। অতঃপর তিনি বললেনঃ আচ্ছা বল তো, এসব কাফিরের সাথে যুদ্ধ করা সম্পর্কে তোমাদের মতামত কি? তারা সংবাদ পেয়ে গেছে যে, তোমরা কাফেলার
উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছো! মুসলমানেরা উত্তরে বললোঃ আল্লাহর
কসম শত্রুদের এতো বড় সেনাবাহিনীর সাতে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নাই। আমরা তো শুধু
কাফেলার মালধন লুটবার জন্য বের হয়েছি। রাসূল সা. দ্বিতীয়বার
এ প্রশ্ন করলেন। আমরা এবারও একই উত্তর দিলাম। তখন হযরত মিকদাদ ইবনে আমর রা.
বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল সা.! আমরা এ
স্থলে এমন কথা বলবো না যেমন কথা হযরত মূসা আ.কে তাঁ
উম্মতরা বলেছিল। তারা তাঁকে বলেছিল, “হে মুসা আ.! আপনি ও আপনার রব যান এবং শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করুন, আমরা এখানে বসে থাকছি।” আমরা আনসার দল আশা
পোষণ করলাম এবং বললামঃ হযরত মিকদাদ রা. যে কথা বললেন,
আমরাও যদি ঐ কথাই বলতাম তবে এই কাফেলার প্রচুর মাল লুট করা
অপেক্ষা ওটাই আমাদের জন্য অধিক পছন্দনীয় হতো।
একই
ধরণের কথা আমরা পাই ইবনে আবি হাতিম রাহ. বর্ণিত অপর এক
হাদীসে। হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে মুহাম্মদ
বিন আমর বিন আলকামা বিন আক্কাস আল লাইসি থেকে। তিনি তার বাবা থেকে এবং বাবা তার
দাদা থেকে বর্ণনা করেন। তার দাদা বলেনঃ
خرج رسول الله صلى الله عليه وسلم إلى بدر، حتى إذا كان بالروحاء،
خطب الناس فقال " كيف ترون؟ " فقال أبو بكر يا رسول الله بلغنا أنهم بمكان كذا وكذا، قال ثم خطب
الناس، فقال " كيف ترون؟ " فقال عمر مثل قول أبي بكر، ثم خطب الناس فقال " كيف ترون؟ " فقال سعد بن معاذ يا رسول
الله إيانا تريد؟ فو الذي أكرمك وأنزل عليك الكتاب ما سلكتها قط، ولا لي بها علم،
ولئن سرت حتى تأتي برك الغماد من ذي يمن لنسيرن معك، ولا نكون كالذين قالوا لموسى فَٱذْهَبْ أَنتَ
وَرَبُّكَ فَقَاتِلاۤ إِنَّا هَـٰهُنَا قَـٰعِدُونَ ولكن اذهب أنت وربك
فقاتلا، إنا معكما مقاتلون ولعلك أن تكون خرجت لأمر، وأحدث الله إليك غيره، فانظر الذي أحدث
الله إليك فامض له، فصل حبال من شئت، واقطع حبال من شئت، وعاد من شئت، وسالم من
شئت، وخذ من أموالنا ما شئت
রাসূলুল্লাহ
সা. বদর অভিমূখে যাত্রা শুরু করলেন এবং রাওহা নামক স্থানে পৌছলেন। সেখানে
লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দান করলেন। এবং
বললেনঃ তোমাদের মত কি? তখন হযরত আবু বকর রা. বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল সা.! আমাদের কাছে খবর
পৌছেছে যে, ওরা এই এই স্থান পর্যন্ত পৌছে গেছে। এরপর রাসূল সা. লোকদের
বললেনঃ তোমাদের মত কি? এবার হযরত উমর রা. জবাব দিলেন আবু বকর রা. এর জবাবের মত
করেই। রাসূল সা. এর
পর লোকদের বললেনঃ তোমাদের মত কি? তখন হযরত সা’দ বিন মুয়ায রা. বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল সা.!
আপনি কি আমাদের লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করছেন? (তাহলে শুনুন) তার শপথ, যিনি আপনাকে সম্মানিত করেছেন এবং আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। আমরা
না কখনও বারকুল গামাদ গিয়েছি, না ওর পথ আমাদের জানা
আছে। তবু যদি আপনি ইয়ামান থেকে বারকুল গামাদ (হাবশ বা আবিসিনিয়ার একটি জায়গা) পর্যন্ত গমন
করেন, তবে আমরা আপনার সাথে গমন করবো আমরা মুসা আ. এর উম্মতের মতো বলবো না- আপনি ও আপনার বর যান
ও যুদ্ধ করেন, আমরা এখানেই বসে থাকছি। বরং আমরা বলবোঃ আপনি ও আপনার রব যান যুদ্ধ
করুন। এবং নিশ্চয়ই আমরা আপনাদের সাথে থেকে যুদ্ধ করবো। হয়তো আপনি বের হবার সময় একটা উদ্দেশ্যকে সামনে
রেখে বের হচ্ছেন, অতঃপর আল্লাহ অন্য অবস্থার সৃষ্টি
করেছেন। তখন আপনি যেটা ইচ্ছা সেটাই গ্রহণ করুন। যে আপনার সাথে থাকতে চায় থাকবে,
সে সরে পড়তে চায় সে সরে পড়বে। যে আপনার বিরুধীতা করতে চায় সে
বিরুধীতা করুক এবং যে সন্ধি করতে চায় সে সন্ধি করুক। আমাদের যা কিছু মাল রয়েছে তা
আপনি নিয়ে যেতে পারেন।
﴿وَإِذْ يَعِدُكُمُ اللَّهُ إِحْدَى الطَّائِفَتَيْنِ
أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّونَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُونُ لَكُمْ
وَيُرِيدُ اللَّهُ أَن يُحِقَّ الْحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ
الْكَافِرِينَ﴾
৭) স্মরণ করো সেই সময়ের কথা যখন আল্লাহ তোমাদের
সাথে ওয়াদা করেছিলেন, দুটি দলের মধ্যে থেকে একটি তোমরা পেয়ে
যাবে৷ তোমরা চাচ্ছিলে, তোমরা দুর্বল
দলটি লাভ করবে৷ কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, নিজের
বাণীসমূহের সাহায্যে তিনি সত্যকে সত্যরূপে প্রকাশিত করে দেখিয়ে দেবেন এবং কাফেরদের
শিকড় কেটে দেবেন ,
এবং স্মরণ কর, যখন তোমাদের আল্লাহ
ওয়াদা করেছিলেন যে, |
﴿وَإِذْ يَعِدُكُمُ اللَّهُ إِحْدَى الطَّائِفَتَيْنِ﴾ |
দুইটি দলের একটি |
﴿إِحْدَى الطَّائِفَتَيْنِ﴾ |
যা তোমাদের জন্য হবে। |
﴿أَنَّهَا لَكُمْ﴾ |
এবং তোমরা চেয়েছিলে, যে কাঁটা যুক্ত নয় এমন দল তোমাদের জন্য হবে |
﴿وَتَوَدُّونَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُونُ لَكُمْ ﴾ |
আর আল্লাহর ইচ্ছা ছিল যে, হককে প্রতিষ্ঠিত করতে তার বানী সমূহের সাহায্যে |
﴿وَيُرِيدُ اللَّهُ أَن يُحِقَّ الْحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ﴾ |
এবং তিনি কাটবেন কাফেরদের মূল। |
﴿وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِينَ﴾ |
﴿وَإِذْ
يَعِدُكُمُ اللَّهُ إِحْدَى الطَّائِفَتَيْنِ﴾ স্মরণ করো সেই সময়ের কথা যখন আল্লাহ
তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন,
দুটি দলের মধ্যে থেকে একটি তোমরা পেয়ে যাবে৷
§ দুই দল মানে হয় বাণিজ্য কাফেলা, নতুবা কুরাইশ সেনাদল-যারা বানিজ্য কাফেলাকে রক্ষা করার জন্য মক্কা থেকে রওয়ানা হয়েছিল।
﴿أَنَّهَا
لَكُمْ وَتَوَدُّونَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُونُ لَكُمْ﴾ তোমরা চাচ্ছিলে,
তোমরা দুর্বল দলটি লাভ করবে৷
§ দূর্বল দল মানে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বাধীন বানিজ্য কাফেলা-যাদের সাথে মাত্র তিরিশ থেকে চল্লিশ জন রক্ষী ছিল।
§ বদর যুদ্ধে সফলতার পর কেহ কেহ রাসূল সা.কে পরামর্শ দেন, আবু সুফিয়ানের বানিজ্য কাফেলায় আক্রমন করতে। এসম্পর্কে একটি হাদীস রয়েছে, যা এসেছে মুসনাদে আহমাদেঃ
عن ابن عباس قال قيل لرسول الله صلى الله عليه وسلم حين فرغ من بدر
عليك بالعير ليس دونها شيء، فناداه العباس بن عبد المطلب - قال عبد الرزاق وهو
أسير في وثاقه - إنه لا يصلح لك، قال " ولم؟ " قال لأن الله عز وجل إنما وعدك إحدى الطائفتين، وقد أعطاك الله ما
وعدك إسناد جيد ولم يخرجه
হযরত
ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিন বলেন, রাসূল সা. যখন
সফলতার সাথে বদর যুদ্ধ সমাপ্ত করলেন, তখন তাকে বলা হলোঃ
আপনি এখন মালসম্পদে ভরপুর কাফেলার উপর আক্রমন চালিয়ে দিন। এখন তো কোন বাঁধা
নাই। তখন হযরত আব্বাস ইবনে আব্দুল
মুত্তালিব রা. বললেনঃ (তিনি
ছিলেন বদর যুদ্ধে যুদ্ধবন্দীদের একজন) এটা কখনো উচিত হবে
না। কেননা, আল্লাহ পাক তো আপনার সাথে দুটোর যে কোন একটার
ওয়াদা করেছেন। আর একটা তো আপনি লাভ করেছেন। সুতরাং দ্বিতীয়টি লাভ করার কোন অধিকার আপনার
নাই। (ইবনে কাসির
বলেনঃ হাদীসের সনদ উত্তম, এবং তাকে তাখরিজ করা হয়নি)
﴿وَيُرِيدُ اللَّهُ أَن يُحِقَّ الْحَقَّ
بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِينَ﴾ কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, নিজের বাণীসমূহের সাহায্যে তিনি সত্যকে
সত্যরূপে প্রকাশিত করে দেখিয়ে দেবেন এবং কাফেরদের শিকড় কেটে দেবেন
﴿لِيُحِقَّ الْحَقَّ
وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُونَ﴾
৮) যাতে সত্য সত্য রূপে এবং বাতিল বাতিল হিসেবে
প্রমাণিত হয়ে যায়, অপরাধিদের কাছে তা যতই অসহনীয় হোক না কেন৷ ৭
যাতে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় সত্য রূপে |
﴿لِيُحِقَّ الْحَقَّ﴾ |
আর বাতিল প্রতিষ্ঠিত হয় বাতিল রূপে |
﴿وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ﴾ |
আর তা যদিও অপছন্দনীয় হয়
অপরাধীদের নিকট |
﴿وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُونَ﴾ |
﴿لِيُحِقَّ
الْحَقَّ وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُونَ﴾ যাতে সত্য সত্য রূপে এবং বাতিল বাতিল হিসেবে প্রমাণিত হয়ে
যায়, অপরাধিদের
কাছে তা যতই অসহনীয় হোক না কেন৷
§ কুরাইশ সেনাদল যখন মক্কা থেকে রওয়ানা হলো, তখনই এই প্রশ্ন সামনে চলে আসলো যে, কে আরব ভূখন্ডে বেঁচে থাকার অধিকার লাভ করবে? ইসলামী দাওয়াত না জাহেলী ব্যবস্থা।
§ মুসলমানরা এই প্রশ্নে সাহসিকার পরিচয় দিয়ে এগিয়ে না আসলে ইসলামী দাওয়াত আর বেঁচে থাকার সুযোগ থাকতো না।
§ মুসলমানরা প্রথম আঘাতেই কুরাইশের মতো শক্তির উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার কারণে ইসলামের রেপুটেশন বেড়ে গেল-ইসলাম মজবুত ভাবে পা রাখার জায়গা পেয়ে গেল। ইসলাম একটা শক্তি-এমনটা প্রমাণিত হলো। তার ফল হলোঃ জাহিলিয়াতের মোকাবিলায় একের পর এক ইসলাম বিজয়ী হলো, জাহেলিয়াত পরাজয় বরণ করলো।
﴿إِذْ
تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّي مُمِدُّكُم بِأَلْفٍ مِّنَ
الْمَلَائِكَةِ مُرْدِفِينَ﴾
৯) আর সেই সময়ের কথা স্মরণ করো যখন তোমরা তোমাদের
রবের কাছে ফরিয়াদ করছিলে৷ জবাবে তিনি বললেন , তোমাদের সাহায্য করার
জন্য আমি একের পর এক, এক হাজার ফেরেশতা পাঠাচ্ছি৷
(স্মরণ করে) যখন তোমরা সাহায্য চেয়েছিলে
তোমাদের মালিকের |
﴿إِذْ تَسْتَغِيثُونَ﴾ |
তখন তিনি তোমাদের জন্য সাড়া দিলেন |
﴿فَاسْتَجَابَ لَكُمْ﴾ |
নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সাহায্য করেছিল |
﴿أَنِّي مُمِدُّكُم﴾ |
হাজারো ফেরেশতাদের দিয়ে ধারাবাহিক
ভাবে |
﴿بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلَائِكَةِ مُرْدِفِينَ﴾ |
﴿إِذْ
تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّي مُمِدُّكُم بِأَلْفٍ مِّنَ
الْمَلَائِكَةِ مُرْدِفِينَ﴾ আর সেই সময়ের কথা স্মরণ করো যখন তোমরা
তোমাদের রবের কাছে ফরিয়াদ করছিলে৷ জবাবে তিনি বললেন , তোমাদের সাহায্য করার জন্য আমি একের পর এক,
এক হাজার ফেরেশতা পাঠাচ্ছি৷
§
শানে নুযুলঃ
حدثني عمر بن الخطاب رضي الله عنه قال لما كان يوم بدر، نظر النبي
صلى الله عليه وسلم إلى أصحابه، وهم ثلاثمائة ونيف، ونظر إلى المشركين، فإذا هم
ألف وزيادة، فاستقبل النبي صلى الله عليه وسلم القبلة، وعليه رداؤه وإزاره، ثم
قال "
اللهم أنجز لي ما وعدتني،
اللهم إن تهلك هذه العصابة من أهل الإسلام فلا تعبد في الارض أبداً قال فما زال
يستغيث ربه ويدعوه حتى سقط رداؤه عن منكبيه، فأتاه أبو بكر، فأخذ رداءه، فرداه، ثم
التزمه من ورائه، ثم قال يانبي الله كفاك مناشدتك ربك فإنه سينجز لك ما وعدك،
فأنزل الله عز وجل ﴿إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَٱسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّي
مُمِدُّكُمْ بِأَلْفٍ مِّنَ ٱلْمَلَـٰئِكَةِ مُرْدِفِينَ﴾
বদরের
দিন নবী সা. স্বীয় সহচরদেরকে গণনা করে দেখলেন যে,
তাদের সংখ্যা চিল তিনশর কিছু বেশী। আর মুশরিকদের দিকে তাকিয়ে
তিনি অনুমান করলেন যে, তাদের সংখ্যা ছিল এক হাজারের চেয়েও
বেশী। অতঃপর নবী সা. কিবলামুখী হয়ে দোয়া করতে লাগলেন। তখন
তার গায়ে চাদর ছিল এবং তিনি লংগী পরিহিত ছিলেন। অতঃপর তিন বললেনঃ হে আল্লাহ!
আপনি আমার সাথে যে ওয়াদা করেছিলেন, তা
আজ পূর্ণ করুন। যদি আপনি মুসলমানদের এই ছোটদলকে আজ ধ্বংস করে দেন, তবে দুনিয়ার বুকে আপনার ইবাদত করার কেউই থাকবে না এবং তাওহীদের নাম ও
চিহ্নটুকু মুছে যাবে। তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছিলেন ও দোয়অ করছিলেন, এমনকি তাছর কাঁধ থেকে চাদরখানা পড়ে যাচ্ছিল। হযরত আবু বকর রা. এসে চাদর খানা তাঁর কাঁদে উঠিয়ে দিলেন এবং তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে গিয়ে
বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল সা.! আল্লাহর কাছে আপনার
প্রার্থনা যথেষ্ট হয়েছে। তিনি স্বীয় ওয়াদা পূর্ণ করবেন। তখন এই আয়াত নাযিল হয়।
﴿أَنِّي
مُمِدُّكُم بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلَائِكَةِ مُرْدِفِينَ﴾ তোমাদের সাহায্য করার জন্য আমি একের পর
এক, এক হাজার
ফেরেশতা পাঠাচ্ছি৷
§ مُرْدِفِينَ এর ফেরেশতাদের সারি, যা একটার পিছনে আরেকটা ছিল। আবার তার অর্থ সাহায্য হতেও পারে। মানে ফেরেশতাদের সাহায্যর উপর ছিল।
§ বদরের যুদ্ধে ফেরেশতাদের সাহায্য সম্পর্কে হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত হাদীসঃ
عن علي رضي الله عنه قال نزل جبريل في ألف من الملائكة عن ميمنة
النبي صلى الله عليه وسلم وفيها أبو بكر، ونزل ميكائيل في ألف من الملائكة عن
ميسرة النبي صلى الله عليه وسلموأنا في الميسرة.
হযরত আলী
রা.থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ জিব্রাঈল আ. হাজার ফিরিশা সহ নবী সা. এর ডান দিকে ছিলেন, যে দিক হযরত আবু বকর রা.ও ছিলেন। আর হযরত মীকাঈল আ. হাজার ফেরেশতাসহ নবী সা. এর বাম দিকে ছিলেন, যে দিকে আমি ছিলাম।
§
বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সাহাবীদের মর্যাদাঃ
১.
عن رافع الزرقي عن أبيه - وكان أبوه من أهل بدر - قال جاء جبريل إلى النبي صلى الله عليه
وسلم فقال ما تعدون أهل بدر فيكم؟ قال: من أفضل المسلمين أو كلمة نحوها، قال وكذلك
من شهد بدراً من الملائكة.
হযরত রাফি
রা. তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, যিন বদরী
সাহাবীদের একজন ছিলেন। তিন বলেনঃ একদিন হযরত জিব্রাঈল আ. রাসূল সা.কে জিজ্ঞস করলেনঃ আপনি বদরী সাহাবীদেরকে
কি মনে করেন? রাসূল সা. উত্তরে বললেনঃ বদরী সাহাবাীরা মুসলমানদের
মধ্যে সর্বোত্তম। তখন জিব্রাঈল আ. বললেনঃ বদরের যুদ্ধে যে সব ফেরেশতা মুসলমানদের সাহায্য করার
জন্য এসেছিল, তাদেরকেউ
অন্যান্য ফেরেশেতাদের অপেক্ষা উত্তম মনে করা হয়।
২.
أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لعمر
لما شاوره في قتل حاطب بن أبي بلتعة " إنه قد شهد بدراً، وما
يدريك لعل الله قد اطلع على أهل بدر، فقال اعملوا ما شئتم، فقد غفرت لكم؟
"
হযরত উমর
রা. যখন হাতিব ইবনে আবি বুলতা রা.কে হত্যা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তখন বনী সা. হযরত উমরকে বলেছিলেনঃ এই হাতিব বদরের
যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল। আর তুমি কি এই খবর রাখো যে, সম্ভবতঃ আল্রাহ বদরী সাহাবীদেরকে ক্ষমা
করে দিয়েছেন? কেনন, তিনি বলেছেনঃ তোমরা যা ইচ্ছা তাই আমল কর, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
﴿وَمَا جَعَلَهُ اللَّهُ إِلَّا بُشْرَىٰ
وَلِتَطْمَئِنَّ بِهِ قُلُوبُكُمْ ۚ وَمَا النَّصْرُ إِلَّا مِنْ عِندِ اللَّهِ ۚ
إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾
১০) একথা আল্লাহ তোমাদের শুধুমাত্র এ জন্য জানিয়ে
দিলেন যাতে তোমরা সুখবর পাও এবং তোমাদের হৃদয় নিশ্চিন্ততা অনুভব করে৷ নয়তো
সাহায্য যখনই আসে আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে৷ অবশ্যই আল্লাহ মহাপরাক্রমশীল ও
মহাজ্ঞানী৷
আর তা আল্লাহ কেবল এজন্য করেছিলেন |
﴿وَمَا جَعَلَهُ اللَّهُ﴾ |
যাতে তা হয় সুসংবাদ এবং তা হয় তোমাদের অন্তরের প্রশান্তির
মাধ্যম |
﴿إِلَّا بُشْرَىٰ وَلِتَطْمَئِنَّ بِهِ قُلُوبُكُمْ﴾ |
আর সাহায্য আসে না আল্লাহর নিকট ছাড়া |
وَمَا النَّصْرُ إِلَّا مِنْ عِندِ اللَّهِ |
নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী ও
মহাবিজ্ঞ |
﴿إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾ |
﴿وَمَا
جَعَلَهُ اللَّهُ إِلَّا بُشْرَىٰ وَلِتَطْمَئِنَّ بِهِ قُلُوبُكُمْ ۚ وَمَا
النَّصْرُ إِلَّا مِنْ عِندِ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾ একথা আল্লাহ তোমাদের শুধুমাত্র এ জন্য জানিয়ে দিলেন যাতে
তোমরা সুখবর পাও এবং তোমাদের হৃদয় নিশ্চিন্ততা অনুভব করে৷ নয়তো সাহায্য যখনই
আসে আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে৷ অবশ্যই আল্লাহ মহাপরাক্রমশীল ও মহাজ্ঞানী৷
§ ফেরেশতাদের পাঠানোর ব্যাপারটির লক্ষ্য হলোঃ যুদ্ধরত মুমিনদের সংসবাদ দেয়ার জন্য। যাতে করে তাদের মাঝে মনবল তৈরী হয়।
§ আল্লাহ সাহায্য করার জন্য কোন মাধ্যম গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু যাদেরকে সাহায্য করা হচ্ছে, তাদের বুঝার সুবিধার জন্য এটা করা হয়েছে থাকে। নতুবা আল্লাহ সরাসরি সাহায্য করতে পারেন।
§ ফেরেশতাদের মাধ্যমে সাহায্যের বিষয়টি আল্লাহর সাহায্যোর বাহ্যিক রূপ।
§ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সূরা মুহাম্মদ এর ৪-৬ আয়াতে বলেনঃ
﴿فَإِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ
كَفَرُوا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتَّىٰ إِذَا أَثْخَنتُمُوهُمْ فَشُدُّوا الْوَثَاقَ
فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاءً حَتَّىٰ تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا ۚ
ذَٰلِكَ وَلَوْ يَشَاءُ اللَّهُ لَانتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَٰكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم
بِبَعْضٍ ۗ وَالَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَلَن يُضِلَّ أَعْمَالَهُمْ﴾ ﴿سَيَهْدِيهِمْ وَيُصْلِحُ بَالَهُمْ﴾ ﴿وَيُدْخِلُهُمُ الْجَنَّةَ عَرَّفَهَا لَهُمْ﴾
অতপর
এসব কাফেরের সাথে যখনই তোমাদের মোকাবিলা হবে তখন প্রথম কাজ হবে তাদেরকে হত্যা করা৷
এভাবে তোমরা যখন তাদেরকে আচ্ছাতম পর্যুদস্ত করে ফেলবে তখন বেশ শক্ত করে বাঁধো৷
এরপর (তোমাদের ইখতিয়ার আছে) হয় অনুকম্পা দেখাও, নতুবা মুক্তিপণ
গ্রহণ করো যতক্ষণ না যুদ্ধবাজরা অন্ত্র সংবরণ করে৷ এটা হচ্ছে তোমাদের করণীয় কাজ৷ আল্লাহ
চাইলে নিজেই তাদের সাথে বুঝাপড়া করতেন৷ কিন্তু (তিনি এ পন্থা গ্রহণ করেছেন এ জন্য)
যাতে তোমাদেরকে পরস্পরের দ্বারা পরীক্ষা করেন৷ আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হবে আল্লাহ কখনো তাদের আমলসমূহ
ধ্বংস করবেন না৷ তিনি
তাদের পথপ্রদর্শন করবেন৷ তাদের অবস্থা শুধরে দিবেন৷ এবং তাদেরকে সেই জান্নাতে
প্রবেশ করাবেন যার পরিচয় তিনি তাদেরকে আগেই অবহিত করেছেন৷
§ সূরা আলে ইমরান এর ১৪০-১৪১ আয়াতে বলা হয়েছেঃ
﴿إِن يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ
فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِّثْلُهُ ۚ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا
بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنكُمْ
شُهَدَاءَ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ﴾﴿وَلِيُمَحِّصَ اللَّهُ
الَّذِينَ آمَنُوا وَيَمْحَقَ الْكَافِرِينَ﴾
এখন যদি
তোমাদের আঘাত লেগে থাকে, তাহলে এর আগে এমনি ধরনের আঘাত লেগেছে
তোমাদের বিরোধী পক্ষের গায়েও ৷ এ – তো কালের উত্থান পতন, মানুষের
মধ্যে আমি এর আবর্তন করে থাকি ৷ এ সময় ও অবস্থাটি তোমাদের ওপর এ জন্য আনা হয়েছে যে,
আল্লাহ দেখতে চান তোমাদের মধ্যে সাচ্চা মুমিন কে ? আর তিনি তাদেরকে বাছাই করে নিতে চান, যারা
যথার্থ ( সত্য ও ন্যায়ের ) সাক্ষী হবে-কেননা জালেমদেরকে
আল্লাহ পছন্দ করেন না–এবং তিনি এই পরীক্ষার মাধ্যমে সাচ্চা
মুমিনদের বাছাই করে নিয়ে কাফেরদের চিহ্নিত করতে চাইছিলেন ৷
§ কিন্তু তিনি কেবল ফেরেশতার মাধ্যমে সাহায্য করেন না। যেমনঃ কাওমে নূহকে তুফানের মাধ্যমে, আদ সম্প্রদায়কে ঘুর্ণিঝড়ের মাধ্যমে, লুত সম্প্রদায়কে পাথর বর্ষণ, শুআইব সম্প্রদায়কে মাথার উপর পাহাড় লটকিয়ে, মুসার শত্রু ফিরাউন ও তার কাওমকে নদীতে ডুবিয়ে।
0 Comments