প্রথমতঃ উল্লেখ করতে চাই যে, বিদায়াত জিনিসটা কি? আমার পড়ালেখা অনুযায়ী বিদায়াত হলো এমন বিষয় চালু করা যা আগে কখনও চালু ছিলনা। আরো পরিস্কার করে বললেঃ দ্বীনের মাঝে এমন সব বিষয় চালু করা, যা আগে ছিলনা।
দ্বিতীয়তঃ উল্লেখ করছি সুন্নাত সম্পর্কে। সুন্নাত হলো নবী মুহাম্মদ সা. অনুসৃত বিধান বা নিয়ম পদ্ধতি। আরো পরিস্কার করে বললেঃ দ্বীনের নিয়ম কানুন-যেমন রাসূল বলেছেন, করেছেন বা অনুমোদন দিয়েছেন।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি যে, গায়ে হলুদ সংস্কৃতিটা মাত্র কয় বছর আগে শুরু হওয়া কোন বিষয় নয়। রাসূল সা. এর আগমনের আগেও মক্কা মাদীনায় বিয়ে শাদীতে গায়ে হলুদের কালচার প্রচলিত ছিল। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখি যে, মাত্র ৩৫/৪০ বছর আগে আমাদের চাচা-ফুফু-খালাদের বিয়েতে শিল পাটায় গশাগশি করে হলুদ বাটতে আমরাই দেখেছি।
ইসলামে অনেক বিষয় আছে যা ইসলাম পূর্ব সময়েও প্রচলিত ছিল। ইসলাম এসে সে সব বিষয়কে লালন করেছে, সুন্দর করেছে, একটা নিয়েমের মাঝে নিয়ে এসেছে। যেমন, নামায-রোযা-হজ্জ-উমরা ইত্যাদি। এগুলো আগেও ছিল। নবী সা. এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ৫ওয়াক্ত নামায, রামাদ্বানে রোযা সহ ইসলামের বিধি বিধান জারি করেছেন। দাড়ি নামক জিনিসটা ইসলাম পূর্ব সময়েও আরবের কালচারে ছিল। কিন্তু সাথে ছিল তাদের গোফের চর্চা। রাসূল সা. দাড়ির জন্য একটা সীমা ও নিয়ম করে দিলেন, গোফের ব্যাপারে কর্তনের বিধান জারি করলেন।
যিনা নামক জিনিসটা ইসলাম শুধু অপছন্দ করে এমন নয়, ইসলাম যিনা থেকে দূরে অবস্থান করার নির্দেশ প্রদান করে। তার বিপরীতে বিয়ে নামক জিনিসটাকে ইসলাম উৎসাহিত করে বিয়ের যাবতীয় শর্তাবলীতে সহজতার তাগিদ দেয়। যেমনঃ সন্তান বালেগ হওয়ার সাথে সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করা, বিয়েতে মোহরানা সামর্থ অনুযায়ী রাখা, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা কেবলমাত্র ইজাব কবুল আর মাত্র ২জন সাক্ষীর মাধ্যমে সম্পন্ন করা ইত্যাদি। সাথে সাথে ইসলাম বিয়ে নামক জিনিসটার ব্যাপক প্রচারে উৎসাহিত করে। আর তা এ জন্য যে, দুজন যুবক যুবতী একটি সুন্দর ও স্বীকৃত বিধানের মাধ্যমে বৈধ প্রক্রিয়ার একত্রিত হচেছ। এর মাধ্যমে একটি বংশের সুচনা হচ্ছে। তাই এর প্রচার প্রয়োজন। আর গায়ে হলুদ বিয়ের প্রচারের মাধ্যম গুলোর একটি অন্যতম মাধ্যম।
গায়ে হলুদ কি? গায়ে হলুদ মানে গা নামক জিনিসটাকে হলুদ নামক জিনিস দিয়ে রঙিন করা। যাতে হলুদের রঙে বর এবং কনের শরীরে চাকচিক্যের সৃষ্টি হয়। এতে করে একের প্রতি যেমন অপরের আকর্ষণ সৃষ্টি হয়, তার চেয়ে বেশী যে বিষয়টা পাওয়া যায় তা হলোঃ মানুষ জানতে পারে যে, অমুক পুরুষ আর অমুক মহিলা দাম্পত্য জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। বৈধ প্রক্রিয়ায় পারস্পরিক মিলনের শুভ সুচনা করতে যাচ্ছে।
হযরত আনাস মালিক (রাদ্বি) বলেন, আব্দুর রাহমান ইবনে আউফ রা. একদিন রাসূল সা. এর নিকট আসলেন। এবং তাঁর শরীরে হলুদের চিহ্ন লাগানো ছিল। রাসূল সা. তার কারণ জিজ্ঞেস করলে ইবনে আউফ রা. জানালেন যে, তিনি আনসার বংশের একজন মহিলাকে বিয়ে করেছেন।(عن أنس بن مالك رضي الله عنه أن عبد الرحمن بن عوف جاء إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم وبه أثر صفرة فسأله رسول الله صلى الله عليه وسلم فأخبره أنه تزوج امرأة من الأنصار)
পুর্ণ শিক্ষিত মানুষ বলে যারা স্বীকৃত মাওলানা আব্দুর রহীম তাদের অন্যতম। তিনি বলেছেনঃ বিয়ের সময় বর ও কনেকে নতুন চাকচিক্যময় পোষাক ও পরিচ্ছদের সুসজ্জিত করা এবং ছেলেমেয়ের গায়ে হলুদ মাখা ইসলামী শরীয়াতে সম্পূণ জায়েজ।
আর যেহেতু হযরত আব্দুর রাহমান ইবনে আউফ রা. এর গায়ে হলুদ লাগানোর বিষয়টাতে রাসূল সা. আপত্তি করেননি এবং তার এই হলুদ লাগানোতে প্রমাণ হয় যে, বিষয়টা প্রাচীনকাল থেকে আরবে প্রচলিত ছিল। তাই আমরা বিষয়টাকে সুন্নত হিসাবে দেখেছি।
গায়ে হলুদ কিভাবে হতে পারে?সুন্নত হিসাবে গ্রহণ করলে আমরা কেবল হলুদ দিয়ে গাকে হলুদ বর্ণ করা নয়, বরং হলুদ পোষাক পরিধান করে জনসমাবেশে উপস্থিতি, হলুদের কাছাকাছি বস্তু মেহদী লাগানো ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা সাজাতে পারি বর ও কনেকে। আর হলুদ রংগের ব্যাপারে হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেছেনঃ সমস্ত রং ও বর্ণের মধ্যে হলুদ বর্ণই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম ও সুন্দর। কুরআনে সূরা বাকারার ৬৯ আয়াতে বলা হয়েছেঃ “উজ্জ্বল হলুদ নর্ব সম্পন্ন, যার রঙ চকচকে, দর্শকদের মনকে আনন্দে উৎফল্ল করে দেয়।” আমাদের নবী সা. হলুদ রং পছন্দ করতেন বরে আমরা জানতে পারি হযরত আনাস রা, থেকে। তিনি বলেছেনঃ নবী সা. হলুদ বর্ণ লাগাতেন, আমিও তাই-ই লাগিয়ে থাকি এবং তা-ই আমি পছন্দ করি, ভালবাসি।
আর বিয়ে উপলক্ষে তাদের সাজাতে বা তাদের বিয়ের প্রচারের জন্য আমরা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারি। বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রচারের জন্য দফ বাজানোর ব্যবস্থা করতে পারি। যা ইসলামী শরীয়াত অনুমোদন করে।
গায়ে হলুদের বর্তমান কালচারঃগায়ে হলুদের বর্তমান কালচার রয়েছে দুই ধরনের। ১. ইসলামী কালচার। ২. বিদায়াতী কালচার বা গাইর ইসলামী কালচার।
একঃ ইসলামী কালচার-যাদের কালচারের নিয়ন্ত্রক হচ্ছে ইসলাম, যারা কালচারকে ইসলামিকি করণ করতে চান বা যারা দ্বীনকে সকল বিষয়ের সিদ্ধান্ত দাতা হিসাবে গ্রহণ করেন, তারা দুনিয়ার জীবনের চাকচিক্য আর নিয়ামাত গুলো থেকে গাফেল না থেকে তা আল্লাহর নিয়ামত হিসাবে ভোগ করেন। আর এজন্য তারা নিজেদের জন্য একটা সীমা নির্ধারণ করেন। আর সেই সীমার মাঝে অবস্থান করে তারা যাবতীয় খুশী ফুর্তি করেন। বিয়েতে তারা গায়ে হলুদ লাগান, মেহদী লাগান, হলুদ জামা গায়ে দিয়ে হিমু সেজে বাজারে ঘুরতে যান। এই বিষয় গুলো করতে গিয়ে তারা ইসলামের সীমাকে লংগন করেন না। সুন্নাতকে পালন করতে গিয়ে ফরজ তরক করেন না। বিশেষ করে এই বিষয় গুলোতে পর্দার ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নবান থাকেন এবং গান বাজনা থেকে দূরে অবস্থান করেন।
দুইঃ বিদায়াতী কালচার বা গাইর ইসলামী কালচার-যাদের চলাফেরায় দ্বীন নিয়ন্ত্রক নয়, যারা দ্বীনকে মসজিদ আর মাদ্রাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন, যারা দুনিয়ার জীবনকে খাও-দাও-ফূতি করো বলে মনে করেন, তারা যে প্রক্রিয়ায় গায়ে হলুদকরে থাকেন, তা একটি বিদায়াতী অনুষ্ঠান বা গাইর ইসলামী অনুষ্ঠান। গায়ে হলুদরে নামে ষোড়ষী যুবতীরা দলবেধে হলুদ শাড়ী পরে, যুবকেরা পরে হলুদ পানজাবী। উভয়ে মিলিত হয় বাজনার তালে তালে। ভিডিও ক্যামেরা ম্যান বন্দী করে তাদের সকল কার্যক্রম। বেগানা যুবক যুবতী মিলিত হয় একই মোহনায়। বর বা কনেকে কেন্দ্র করে চলে যিনার প্রাথমিক উৎসব। অপচয়ে আর অপচয়ে ভরপূর হয়ে পুরো অনুষ্ঠান। শয়তান আর তার চেলা চামুন্ডারা সাংঘাতিক রকমের পুলকিত হয়ে শীষ দেয়।
এই দীর্ঘ উপস্থাপনাকে আমি দলীল বলে মনে করছি। আপনারা কি মনে করলেন?
0 Comments