এর মাঝে গত বছর তার বাবা মারা গিয়েছেন-তিনি তাঁর জানাযাতে শামীল হতে পারেননি অবৈধ অভিবাসী থাকার কারণে। এখন বরের মা চরম অসুস্ত। বর সাহেব ইউরোপে বৈধ হয়েছেন মাত্র ক’মাস। দেরী না করে তিনি রওয়ানা হলেন ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে অসুস্ত মায়ের সেবা করার নিয়াতে।তার অপর ৩ ভাই মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী। তারাও টিকেট নিয়েছেন দেশে আসার। ফ্রান্স প্রবাসী এবং আজকের গল্পের বর যখন ঢাকা এয়ারপোর্টে অবতরণ করলেন, তখন তাকে জানিয়ে দেয়া হলো তার মায়ের মৃত্যু সংবাদ। যে সংবাদ কাতার প্রবাসী ৩ভাই পেলেন কাতারের এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর খানিক আগে।
বাবাহীন পরিবারে মা-ই ছিলেন একমাত্র ভরসার আঁধার, ছিলেন পারিবারিক ঐক্যের প্রতীক। তিনি আজ নেই। প্রবাসী ৪ছেলে তার জানাযায় শামীল। বিবাহিতা চার মেয়ের কান্নায় ভারী আকাশ বাতাস। মরহুমাকে অস্রুজলে বিদায় জানিয়ে ৪ ছেলে সকল আত্নীয়-স্বজন নিয়ে পাঠ করলেন “রাব্বি ইরহাম হুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছাগিরা”।
দিন যায়, যায় সপ্তাহ। তাৎক্ষনিক সিদ্বান্তে দেশে আশা ৪ সন্তানের সকলেই আবার র্কমস্হলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। কিন্তু!
অভিভাবকহীন পরিবারের কে ধরবে হাল? পরিবারের এক মাত্র অবিবাহিত সদস্য ইউরোপ প্রবাসী আমাদের বর কে নিয়ে শুরু হলো গুঞ্জরণ। ভাই-বোন মিলে মিটিং-এর পর মিটিং । অবশেষে সবাই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ইউরোপিয়ানকে এভাবে ছেড়ে দেয়া যাবেনা। তার একটা ব্যবস্হা করতেই হবে। না হয় মা-বাবাহীন এযুবক কোথা থেকে কোথা যায়। তাছাড়া মা-বাবার অর্বতমানে ভাইয়েরা তাদের র্কতব্যর্কমটা বাকীতে রাখতে নারাজ।
জটপট আয়োজন হয়ে গেলো সব কিছুর । মায়ের মৃত্যুর মাত্র ১মাসের মাথায় বরকে বসতে হলো বিয়ের পিড়িতে। কিন্তু!!!
কিন্তু বিয়ে মানে কি?
বিয়ে মানেঃ
বিয়ে মানে রাসুলের সুন্নাত পালনে এগিয়ে আসা,
বিয়ে মানে অপরিচিত দূ’জনার নিখাদ ভালবাসা।
বিয়ে মানে দুই জীবনের এক সাথে পথ চলা,
বিয়ে মানে একজনারে আরেকজন সব বলা।
বিয়ে মানে দুই যুগলের সামাজিক বন্দন,
বিয়ে মানে আপনজনেরে ছেড়ে আসার ক্রন্দন।
বিয়ে মানে বনি আদমের সামনে চলার রীতি,
বিয়ে মানে দূ’জনার ভালবাসা সম্প্রীতি।
বিয়ে মানে তুমি আর আমি একটি কেন্দ্র বিন্দু,
বিয়ে মানে বিন্দু থেকে সৃষ্টি হবে মহাসিন্দু।
বিয়ের অনুষ্ঠান মানে হই হুল্লুড়, চিৎকার , অনেক মজা ইত্যাদি । কিন্তু যেই পরিবারে মাত্র ১ বছর আগে চলে যাওয়া বাবার স্মৃতি ভূলতে না ভূলতেই মায়ের চলে যাওয়া-সেই পরিবারে বিয়ে নিয়ে হই হুল্লুড় আর মজা করার সুযোগ কোথায়। কিন্তু জীবন তো আর থেমে থাকেনা, থাকতেও পারেনা। যেই ফিলিস্তিনি শিশুর জন্ম হয় যুদ্ধ ক্ষেত্রে, সেই শিশুই বড় হয়, লেখা পড়া করে, বিয়ে করে সংসারি হয়-সেই যুদ্ধ ক্ষেত্রেই। তাই জীবনকে এগিয়ে নিতে র্কতব্যকে প্রাধান্য দিয়ে সকল শোককে পিছনে ফেলে আয়োজন করা হলো বিয়ের অনুষ্ঠান।
বিয়ের দিনঃ
সকাল ১১টা ৩০ ।
বর সাজান শুরু হবে। বরের বাড়ীর উঠানে একটা মনোরম শীতল পাটি বিছিয়ে দেয়া হলো। কনের বাড়ী থেকে আসা বিয়ের সকল সাজ নিয়ে আসা হলো। বরের দুলাভাইরাই মূলতঃ বর সাজানোর দায়িত্বটা পলন করে থাকেন। তারা যথারীতি উপস্হিত।
একে একে সকল পোষাক পরিযে দেয়া হলো। এখন শুরু হবে সাজানোর সর্বশেষ আয়োজন। বরের ছোট বোন কাঁচা ফুলের তৈরী রাখি বন্দন পরিয়ে দিলেন বরের ডান হাতে । ক্যামেরার সামনে তিনি একটা হাসি দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। কিন্তু কান্নার চেয়ে ও বিষাক্ত মনে হলো। গায়ের ওড়না দিয়ে চোঁখ মূছতে মূছতে তিনি চলে গেলেন। বরকে পাগড়ী পরাতে হবে। বরের বোন পাগড়িতে সকল মুরুব্বীদের দোয়া গ্রহণ করে পরম আদরে পরিয়ে দিলেন ছোট ভাই বর-এর মাথায়। বরের বড় খালা মায়ের অনুপুস্হিতিতে হাজির হলেন মায়ের ভূমিকা নিয়ে। দূধের গ্লাস এগিয়ে দিলেন আপন বড় বোনের র্সবকনিষ্ট বরবেশী পুত্রের মুখে। মনে তার চরম বেদনা, হৃদয়াকাশে বড় বোনের স্মৃতি । আজ যদি তার বোন বেঁচে থাকতেন , তাহলে এ কাজটা তার করতে হতো না। এ ভাবেই দুধ পান করানোর পর্বও শেষ হয়ে গেলো। এখন মুনাজাত হবে সম্মিলিত ভাবে-একজন নেতৃত্ব দিবেন। তার পর বর সবাইকে সম্মিলিত সালাম জানিয়ে ফুলের পাপড়ি দিয়ে সাজান তার জন্য আনা বিশেষ গাড়ীতে আরোহন করবেন এবং যাত্রা করবেন কনের বাড়ীর উদ্দেশ্যে।
মুনাজাতঃ
বরের মেজো ভাই মাদ্রাসা শিক্ষিত মিয়াসাব। তার উপরই দায়িত্ব বর্তালো মুনাজাত করার। কয়েকবার দুরুদ পড়ে তিনি হাত উঠালেন রবের কাছে । ভূমিকা হিসাবে অনেক কিছু বললেন, সাহায্য চাইলেন আল্লাহর কাছে নতুন যোগলদের জন্য। এর পর হঠাৎ করে মেজো ভাইয়ের মুনাজাতের মোড় ঘুরে গেল ১৯০ ডিগ্রী এ্যাংগেলে।
তিনি হঠাৎ করে বললেনঃ হে আমাদের রব! তুমি তো দেখছো এ পরিবারের সর্বকনিষ্ট সদস্যকে বর বেশে সাজিয়ে আমরা তৈরী করেছি, অনুষ্ঠানকে আনন্দঘন করতে যত আয়োজন প্রয়োজন-তার কোথাও ঘাটতি রাখা হয়নি । আত্মীয়দের মাঝে এমন কেউ নেই-যিনি উপস্হিত হননি। কিন্তু কেন জানি আজ আমাদের মনের মাঝে আনন্দ আসছেনা, আনন্দের এই অনুষ্টানে যারা সবচেয়ে বেশী আনন্দিত হওয়ার কথা ছিল,তারা আজ এখানে অনুপস্থিত। তুমি সুন্দর মনে করেছো বলে তাদেরকে তোমার কাছে আগেই নিয়ে গেছো-কিন্তু আমরা তো অভিভাবকহীন অবস্হায় পড়ে আছি। আমাদের কারো মুখে হাসি নাই।—————-কথা গুলো বলছেন মেজো ভাই, আর চার দিকে কান্নার বিশাল চিৎকার, সবার চোঁখে অস্রুর বন্যা, যেন আষাঢ়ের প্রবল বর্ষণ। যেন এটা বিয়ের বাড়ী নয়, এটা কোন মরা বাড়ী-এই মাত্র কারো মৃত্যু হয়েছে এমন। ——–মেজো ভাই বলেছেনঃ হে আমাদের রব! কিভাবে আমরা সইতে পারি, কিভাবে আমরা মানতে পারি। তাই আজ আনন্দের দিনকে অস্রু দিয়ে বরণ করতে হচ্ছে। হে মাবুদ! আমাদের আব্বা আম্মার প্রতি তুমি রহম করো। তাদেরকে তুমি জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান হিসাবে কবুল করো- “রাব্বি ইরহাম হুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছাগিরা” । ————— সবাই কাঁদছে। সারা বাড়ীতে কান্নার রোল। সবার চোঁখে অস্রুর বন্যা। এমন অবস্হায় মেজো ভাই মুনাজাতের পর্ব শেষ করলেন। কিন্তু কেউ উঠার নাম নেই, সবাই যেন পাথর হয়ে বসে আছে। মা-বাবার ভালবাসার বিয়ের আসরকে অস্রুসিক্ত করে সবাই যেন দায়িত্ব মুক্ত।
এভাবে চলে গেল অনেক সময়। একজন মুরুব্বীর তাড়া আর বকুনিতে সবাই নড়ে চড়ে উঠলেন। বিয়ে বাড়ীর আনন্দময় আসরকে মা-বাবার ভালবাসার অস্রুতে সিক্ত করে সবাই এগিয়ে চললেন গাড়ীর দিকে। মা-বাবা হারা এতিম সন্তানদের মানস পটে আজও যে কোন বিয়ের আসরে গিলে ভেসে উঠে সেই চিত্র।
0 Comments