আলোচনা নোট - আনুগত্য ও মুহাসাবা

আনুগত্য

(আনুগত্য ও মুহাসাবা বিষয়ক আলোচনাটি পিডিএল ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন)

মানুষ সৃষ্টিঃ

  • মানুষ মানে-এক বোঝা ময়লার বাক্স। এমন নিকৃষ্ট ময়লা, যার মতো কোন জীব জানোয়ারের নাই।
  • মানুষ-যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে এক নাপাক পানি থেকে।
  • মানুষ-তার জন্ম থেকে সে অপবিত্র রক্ত ছিল যার খাদ্য।
  • মানুষ-যাকে পায়ের তলার বস্তু মাটি থেকে তৈরী করা হয়েছে।
وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنسَانِ مِن طِينٍ
তিনি মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদামাটি থেকে।” (আস-সিজদাহঃ৭)
خَلَقَ الْإِنسَانَ مِن صَلْصَالٍ كَالْفَخَّارِ
মাটির শুকনো ঢিলের মত পচা কাদা থেকে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।” (আর-রাহমানঃ১৪)
خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ
জমাট বাঁধা রক্তের দলা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।” (আল-আলাক্বঃ ২)
وَخُلِقَ الإِنسَانُ ضَعِيفاً
কারণ মানুষকে দূর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে।” (আন-নিসাঃ ২৮)
خَلَقَ الإِنسَانَ مِن نُّطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُّبِينٌ
তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ছোট্ট একটি ফোঁটআ থেকে। তারপর দেখতে দেখতে সে এক কলহপ্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে।” (আন-নাহলঃ ৪)
خُلِقَ الْإِنسَانُ مِنْ عَجَلٍ سَأُرِيكُمْ آيَاتِي فَلَا تَسْتَعْجِلُونِ
মানুষ দ্রুততাপ্রবণ সৃষ্টি। এখনই আমি তোমাদের দেখিয়ে দিচ্ছি নিজের নিদর্শনাবলী, আমাকে তাড়াহুড়া করতে বলো না।” (আল-আম্বিয়াঃ ৩৭)

মানুষের দায়িত্বঃ

আমাদেরকে মানবতার কল্যাণের জন্য চয়েজ করা হয়েছেঃ
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللّهِ
“এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম দল৷ তোমাদের কর্মক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের হিদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য ৷ তোমরা নেকীর হুকুম দিয়ে থাকো, দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো৷ ” (আলে ইমরানঃ ১১০)

আমাদেরকে নির্দেশ করা হয়েছে সত্য ও সুন্দরের পথে মানুষকে ডাকার জন্যঃ
ادْعُ إِلِى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
“হে নবী! প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা এবং সদুপদেশ সহকারে তোমার রবের পথের দিকে দাওয়াত দাও এবং লোকদের সাথে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পদ্ধতিতে৷” (আন-নাহলঃ ১২৫)


এ দায়িত্ব যিনি পালন করেন, তাকে বলা হয় খলিফা। আর খলিফা হিসাবেই মানুষ দুনিয়াতে প্রেরিতঃ
إِنِّي جَاعِلٌ فِي الأَرْضِ خَلِيفَةً
“আমি পৃথিবীতে একজন খলীফা- প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে চাই ৷” (আল-বাকারাঃ ৩০)


সত্য ও সুন্দরের পথে যারা ডাকবে, তাদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ-একা একা থাকা যাবেনাঃ
وَاعْتَصِمُواْ بِحَبْلِ اللّهِ جَمِيعاً وَلاَ تَفَرَّقُواْ
“তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জু মজবুতভাবে আকঁড়ে ধরো এবং দলাদলি করো না৷” (আলে ইমরানঃ ১০৩)


আল্লাহর রাসূল এমন পাঁচটি জিনিসের নির্দেশ মানুষকে প্রদান করেছেন, যে ৫টি সম্পর্কে তিনি আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত হয়েছেন। আর তার মাঝে ১টি হলোঃ সংগঠনে অন্তর্ভূক্ত হওয়াঃ
أنا أمركم بخمس، والله أمرني بهن، الجماعة والسمع والطاعة والهجرة والجهاد في سبيل الله
“আমি তোমাদেরকে ০৫টি জিনিসের নির্দেশ প্রদান করছি, যে ০৫টি বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাকে নির্দেশ প্রদান করেছেন। আর তাহলোঃ সংগঠনভূক্ত হওয়া, নেতৃনির্দেশ যথাযথ ভাবে শ্রবণ করা, শ্রোত নির্দেশ যথাযথ ভাবে আনুগত্য করা, হিজরত করা এবং আল্লাহর পথে সর্বাত্মক সংগ্রাম করা। (আল-হাদীস)
যেখানে সংগঠন থাকে, সেখানে দায়িত্বশীল হন, নেতা থাকেন, কর্মী থাকেন, আমীর থাকেন, মামুর থাকে। আর সেখানেই প্রয়োজন হয় আনুগত্যের, সেখানেই প্রয়োজন হয় মুহাসাবার।

আনুগত্যঃ

  • আনুগত্য মানে মান্য করা, মেনে চলা, আদেশে ও নিষেধ পালন করা, উর্ধতন কর্তপক্ষ বা দায়িত্বশীলের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করা।
  • আনুগত্যের কুরআনিক ভাষাঃ এত্বায়াত। যার বিপরীত শব্দ হলোঃ عصيان বা معصية। যার অর্থ নাফরমানী করা, হুকুম অমান্য করা।
  • প্রকৃত আনুগত্য হলো আল্লাহর আনুগত্য। এ আনুগত্য মানে ইবাদত।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ“হে ঈমানগারগণ ! আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রসূলের আর সেই সব লোকের যারা তোমাদের মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী৷ ” (আন-নিসাঃ ৫৯)
  • আর আল্লাহ আনুগত্য হয় রাসূল সা. এর মাধ্যমে। অপর দিকে রাসূল সা. এর আনুগত্য হয় ইসলামী নেতৃত্বেও আনুগত্যের মাধ্যমে। রাসূল সা. বলেছেনঃ
من أطاعني فقد أطاع الله ومن عصاني فقط عصى الله ومن يطع الأمير فقد أطاعني ومن عصى الأمير  فقد عصاني
“যে আমার আনুগত্য করল-সে আল্লাহর আনুগত্য করল, যে আমার নাফরমানী করল-সে আল্লাহর নাফরমানী করল, যে আমার নিযুক্ত আমীরের আনুগত্য করল-সে আমার আনুগত্য করল, যে আমার নিযুক্ত আমীরের নাফরমানী করল-সে আমার নাফরমানী করল। (আল-হাদীস)
  • ইসলাম আর আনুগত্য একটি আরেকটির সাথে অতোপ্রোত ভাবে জড়িত। যেমনঃ
    ১.    ইসলাম অর্থ আনুগত্য বা আত্মসমর্পন-এত্বায়াত অর্থও আনুগত্য বা আত্ম সমর্পন।
    ২.    দ্বীন শব্দের ৪টি অর্থেও ১টি হলো এত্বায়াত।
    ৩.    দ্বীনের অপর নাম আনুগত্য। আনুগত্যের অপর নাম দ্বীন।
    ৪.    যেখানে ইসলাম নেই, সেখানে দ্বীন নেই-আনুগত্য নেই। অপর দিকে যেখানে আনুগত্য নেই, সেখানে ইসলাম নেই-দ্বীন নেই।

আনুগত্যের শরয়ী মর্যাদাঃ

কুরআনঃ
فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ
“আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো।” (আশ-শুয়ারাঃ ১৫০)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ
“হে ঈমানদারগন! আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রাসূল সা. এর, এবং সে সব লোকদেরও যারা তোমাদের মধ্যে সামগ্রিক দায়িত্বশীল।” (আন-নিসাঃ ৫৯)
إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَن يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“ঈমানদার লোকদের কাজ তো এই যে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ডাকা হবে-যেমন রাসূল তাদের মামলা মুকাদ্দামায় ফায়সালা করে দেয়, তখন তারা বলেঃ আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম।” (আন-নূরঃ ৫১)
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْراً أَن يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَن يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالاً مُّبِيناً
“কোন মুমিন পুরুষ ও কোন মুমিন স্ত্রীলোকের এই অধিকার নেই যে, আল্লাহ ও তার রাসূল যখন কোন বিষয়ে ফায়সালা করে দেবে, তখন সে নিজেই সেই ব্যাপারে কোন ফায়সালা করার এখতিয়ার রাখবে।” (আল আহযাবঃ ৩৬)

হাদীসঃ
عن ابن عمر رضـ عن النبي صـ قال على المرء المسلم السمع والطاعة فيما أحب وكره إلا أن يؤمر بمعصية فإذا أمر بمعصية فلا سمع ولا طاعة.
“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, মুসলমানদের উপর নেতার আদেশ শোনা ও মানা অপরিহার্য্য কর্তব্য। চাই সে আদেশ তার পছন্দনীয় হোক, আর অপছন্দনীয় হোক। তবে হ্যাঁ, যদি আল্লাহর নাফরমানী মূলক কোন কাজের নির্দেশ হয়, তবে সেই নির্দেশ শোনা ও মানার কোন প্রয়োজন নাই।” (বুখারী ও মুসলিম)
عن أبي الوليد عبادة بن الصامت  رضـ قال بايعنا رسول الله صــ على السمع والطاعة في العسر واليسر والمنشط والمكره وعلى أثرة علينا وعلى أن لا تنازع المر أهله إلا أن تروا كفرا بواحا عندكم من الله تعالى فيه برهان وعلى أن نقول الحق إنما كنا لانخاف في الله لومة لائم.
“হযরত আবু অলিদ ওবাদা ইবনে সামেত রা. বলেন, আমরা নিম্নোক্ত কাজগুলোর জন্যে রাসূল সা. এর এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেছিলাম। ১. নেতার আদেশ মনযোগ দিয়ে শুনতে হবে-তা দূঃসময়ে হোক আর সু সময়ে হোক। ২. নিজের তুলনায় অপরের সুযোগ-সুবিধাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ৩. ছাহেবে আমরের সাথে বিতর্কে জড়াবে না, তবে হ্যাঁ, যদি নেতার আদেশ প্রকাশ্য কুফরীর শামীল হয় এবং সে ব্যাপারে আল্লাহ পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে যথেষ্ট দলিল প্রমাণ থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। ৪. যেখানে যে অবস্থাতেই থাকি না কেন হক কথা বলতে হবে। আল্লাহর পথে কোন নিন্দুকের ভয় করা চলবেনা।” (বুখারী ও মুসলিম)

ইজমাঃ
- রাসূল সা. এর ইনতিকালের পর আবু বকর রা. এ হাতে আনুগত্যের বাইয়াত গ্রহণ।
- হযরত উমর রা. বলেছেনঃ ولا جماعة إلا بإمارة، ولا إمارة إلا بطاعة

যুক্তিঃ
- ছোট পরিবার বা বড় প্রতিষ্ঠান-সব কিছু সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য নেতৃত্ব আর আনুগত্য প্রয়োজন।
- বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বিজয় সংগঠিত হওয়ার পিছনে যে বিষয়টি সবচেয়ে বড়ই হিসাবে কাজ করছে, তাহলো আনুগত্য।
- বর্তমান জামায়াতে ইসলামী এ পর্যন্ত ঠিকে থাকার একমাত্র কারণ আনুগত্যের চরম পরাকাষ্টা প্রদর্শন।

আনুগত্যহীনতার পরিণামঃ

আনুগত্যহীনতা আমল বিনষ্ট করে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ
“হে ঈমানদারগন! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রাসূলের অনুসরণ করো আর নিজের আমল বিনষ্ট করোনা”। (মুহাম্মদঃ ৩৩)
আনুগত্যহীনতা আল্লাহর সন্তুষ্টি হতে বঞ্চিত-
فَإِن تَرْضَوْاْ عَنْهُمْ فَإِنَّ اللّهَ لاَ يَرْضَى عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ
“অথচ তোমরা তাদের প্রতি রাজী ও সন্তুষ্ট হলেও আল্লাহ তো কিছুতেই ফাসেকদের প্রতি সন্তুুষ্ট হবেন না”। (আত-তাওবাঃ ৩৩)
আনুগত্যহীনতা জামায়াত ত্যাগের শামীল-
من كره من أميره شيئا فليصبر فإنه من خرج من السلطان شبرا مات ميته جاهلية
“যদি কেউ তার আমীরের মধ্যে কোন অপছন্দনীয় কাজ দেখতে পায়, তাহলে যেন সবর করে। (আনুগত্য পরিহার না করে) কেননা যে, ইসলামী কর্তৃপক্ষের আনুগত্য থেকে এক বিঘত পরিমাণ সরে যায় বা বের হয়ে যায়, তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু।”
আনুগত্যহীনতার পরিণাম জাহেলিয়াতের মৃত্যু-
من خرج من الطاعة وفارق الجماعة فمات مات ميتة جاهلية
“যে আনুগত্যের গন্ডি হতে বের হয়ে যায় এবং জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, অতঃপর মৃত্যুবরণ করে, তার মৃত্যু হয় জাহিলিয়াতের মৃত্যু”।
আনুগত্যহীনতা চরম বিপদের কারণ-
عن ابن عمر رضـ عن النبي صـ قال من خلع يدا من طاعة لقى الله بو القيامة لا حجة له ومن مات وليس في عنقه بيعة مات ميتة جاهلية.
“আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. রাসূল সা. থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আনুগত্যের বন্ধন থেকে হাত খুলে নেয়, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে এমন অবস্থায় হাজির হবে যে, নিজের আত্মপক্ষ সমর্থনে তার বলার কিছুই থাকবেনা। আর যে ব্যক্তি বাইয়াত ছাড়া মারা যাবে তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু।” (মুসলিম)

আনুগত্যের দাবীঃ

  • আনুগত্য হবে মনের ১০০% ভক্তি-শ্রদ্ধা সহকারে।
  • আনুগত্য হবে পূর্ণ আন্তুরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে।
  • আনুগত্য হবে স্বতঃস্ফ‚র্ত প্রেরণা সহকারে।
  • আনুগত্য হবে কৃত্রিমতা ও দ্বিধা-দ্ব›দ্ব, সংকোচ-সংশয়হীন।
  • আনুগত্য হবে অনানুষ্ঠানিক রুহ সম্পন্ন।
  • আনুগত্য হবে নির্দেশের অন্তর্নিহিত দাবী উপলব্দি করে নিষ্ঠার সাথে সর্বোত্তম উপায়ে।
فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّىَ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُواْ فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجاً مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسْلِيماً
“আপনার রবের কসম! তারা কখনো ঈমানদার হতে পারবেনা যতক্ষণ না তাদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ, মামলা-মোকাদ্দামার ব্যাপারে একমাত্র আপনাকেই ফায়সালা দানকারী হিসাবে গ্রহণ করবে, অতঃপর আপনার দেয়া সিদ্ধান্তের প্রতি তাদের মনে দ্বিধা-সংশয় থাকবেনা এবং এই সিদ্ধান্ত সর্বোত্তম উপায়ে মাথা পেতে নেবে।” (আন-নিসাঃ ৬৫)
لَّا تُقْسِمُوا طَاعَةٌ مَّعْرُوفَةٌ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
“বলে দিন হে নবী! কসম খেয়ে আনুগত্য প্রমাণের তো কোন প্রয়োজন নেই। আনুগত্যের ব্যাপারটা তো খুবই পরিচিত ব্যাপার। সন্দেহ নেই, আল্লাহ তোমাদের আমল সম্পর্কে অবগত আছেন।” (আন-নূরঃ ৫৩)

আনুগত্যের পূর্বশর্তঃ

  • আনুগত্যের পূর্বশত একটিই। তা হলোঃ সিদ্ধান্ত শোনা, জানা, বুঝা, গুরুত্ব উপলব্দি করা, বাস্তবায়নের পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা অতঃপর বাস্তবায়ন করা।
  • কুরআনের যত জায়গায় আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে  وأطيعواতার প্রায় সব জায়গাতেই শোনার কথাটা আগে বলা হয়েছে واسمعواহাদীসে যে ৫টি জিনিসের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তার মাঝে আনুগত্যের আগেই শোনার কথা বলা হয়েছে।
    أمركم بخمس الجماعة والسمع والطاعة والهجرة والجهاد في سبيل الله
    “আমি তোমাদেরকে পাঁচটি জিনিসের নির্দেশ দিচ্ছি। জামায়াতবদ্ধ হওয়ার, শোনার, আনুগত্য করার, হিজরত করার এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার।”

আনুগত্যের পথে বাঁধা সমূহঃ

প্রধান বাঁধা সমূহঃ
১.    পরকালে জবাবদিহির অনুভ‚তির অভাব।
২.    আখেরাতের জীবনের তুলনায় দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দেয়া।
مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ انفِرُواْ فِي سَبِيلِ اللّهِ اثَّاقَلْتُمْ إِلَى الأَرْضِ أَرَضِيتُم بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الآخِرَةِ فَمَا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الآخِرَةِ إِلاَّ قَلِيلٌ
“তোমাদের কি হয়েছে যে, যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে বের হতে বলা হলো, তোমরা মাটি কামড়িয়ে পড়ে থাকলে? তোমরা কি আখেরাতের মোকাবেলায় দুনিয়ার জীবনকেই পছন্দ করে নিলে? যদি এমনই হয়ে থাকে, তাহলে জেনে নিও, দুনিয়ার এসব বিষয় সামগ্রী আখেরাতে অতি তুচ্ছ ও নগন্য হিসাবে পাবে।” (আত-তাওবাঃ ৩৮)
৩.    দায়িত্বানুভ‚তির অভাব।
৪.    সিদ্ধান্তের চেতনার অভাব।

অন্যান্য বাঁধা সমূহঃ

ক. গর্ব, অহংকার, আত্মপূঁজা ও আত্মম্ভরিতা।

- আমি বেশী শিক্ষিত।
- আমি বেশী সুন্দরী।
- আমার যোগ্যতা বেশী।
- আমি মাদ্রাসা শিক্ষিত অথবা আমি মাস্টারসধারী।
- আমার স্বামী বড় চাকুরী করে।
- আমরা স্টাবলিস।
- আমাদের বাসা বড়।
إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ
“আল্লাহ কখনো অহংকারীকে পছন্দ করেননা।” (লোকমানঃ ১৮)
হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছেঃ আল্লাহ বলেন, অহংকার আমার চাদর। (একমাত্র আমার জন্যই শোভনীয়)। যে অহংকার করে, সে প্রকৃতপক্ষে আমার চাদর নিয়ে টানাটানি করতে ব্যর্থ প্রয়াস পায়।

খ. হৃদয়ের বক্রতা/দায়িত্ব এড়ানোর কৌশল হিসাবে নানান জটিল প্রশ্ন তোলা।

- এটা মুসা আ. এর কাওমের রোগ। উম্মতে মুহাম্মদীকে সেই রোগ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। দোয়া করতে হবেঃ
رَبَّنَا لاَ تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ
“হে আমাদের রব! একবার হেদায়াত দানের পর তুমি আমাদের হৃদয়কে বাঁকা করে দিও না। তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য খাস রহমত দান করো, তুমিতো অতিশয় দাতা ও দয়ালু।” (আলে ইমরানঃ ৮)

গ. অন্তরের দ্বিধা-দ্ব›দ্ব ও সংশয়-সন্দেহের প্রবণতা।

- এটা সৃষ্টি হয় লাভ-ক্ষতির জাগতিক ব্যাখ্যা ও হিসাব নিকাশ থেকে। যা সূরা হাদীদে স্পষ্ট করা হয়েছে।

আদেশ ও আনুগত্যের ভারসাম্য সৃষ্টিঃ

রুহানী পরিবেশ তৈরীঃ
১.    আল্লাহ ও রাসূলের যথাযথ আনুগত্য।
২.    কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও কেন্দ্রীয় বডির সিদ্ধান্তের প্রতি নিষ্ঠার সাথে শ্রদ্ধা ও যতেœর সাথে বাস্তবায়ন।
৩.    অধীনস্তদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
৪.    দায়িত্বশীলকে আনুত্যের পরিবেশ তৈরী করা । যেমনঃ
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللّهِ لِنتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنتَ فَظّاً غَلِيظَ الْقَلْبِ لاَنفَضُّواْ مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللّهِ إِنَّ اللّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ 
“এটা একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ যে, আপনি এদের প্রতি কোমল। যদি আপনি কঠোরভাষী বা তিক্ত মেজাজের অধিকারী হতেন, তাহলে এরা আপনার চারপাশ থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেতো। কাজেই এদের ত্রæটিকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখুন, এদের জন্য শাফায়াত চান এবং বিভিন্ন বিষয়ে এদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর পরামর্শের পর যখন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর উপর ভরসাকারীদের ভালবাসেন।” (আলে ইমরানঃ ১৫৯)

আমলিয়াতের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলদের অগ্রগামী থাকাঃ
১.    ঈমানী শক্তি ও ঈমানের দাবী পুরণের ক্ষেত্রে।
২.    ঈমানী শক্তি অর্জন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে।
৩.    আমল আখলাক ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে।
৪.    সাংগঠনিক যোগ্যতা ও দক্ষতার ক্ষেত্রে।
৫.    মাঠে ময়দানে কর্মতৎপরতা ও ত্যাগ, কুরবানী আর ঝুঁকির ক্ষেত্রে।

আনুগত্যের পরিধিঃ

আনুগত্য হবে কেবল সৎকাজের বেলায়ঃ
وَتَعَاوَنُواْ عَلَى الْبرِّ وَالتَّقْوَى وَلاَ تَعَاوَنُواْ عَلَى الإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُواْ اللّهَ إِنَّ اللّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
“নেকী ও আল্লাহভীতির সমস্ত কাজে সবার সাথে সহযোগীতা করো এবং গুনাহ ও সীমালংঘনের কাজে কাউকে সহযোগীতা করো না৷ আল্লাহকে ভয় করো৷ তাঁর শাস্তি বড়ই কঠোর৷” (আল মায়িদাহঃ ০২)
لا طاعة لمخلوق في معصية الخالق، إن الطاعة في المعروف
“স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টির আনুগত্য করোনা।, নিশ্চয়ই আনুগত্য হবে কেবলমাত্র সৎকাজের বেলায়।” (আল হাদীস)
- “বন্ধুগন! তোমাদের কেউ যদি আমার নীতি বা কাজে বক্র দেখে, তাহলে আমার এই বক্রতাকে সোজা করে দেয়া তার কর্তব্য হয়ে দাড়াবে”। (হযরত উমর রা.)
ব্যক্তির পরিবর্তনের কারণে আনুগত্যের পরিবর্তন হবেনাঃ
- রাসূল সা. বলেছেনঃ নাক কাঁটা হাবসী গোলামকেও যদি তোমাদের ইমাম করা হয়, তাহলে তার নির্দেশ শ্রবণ করো এবং তার যথাযথ আনুগত্য করো।
- আবু বকরের পদক্ষেপঃ
وَمَا مُحَمَّدٌ إِلاَّ رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِن مَّاتَ أَوْ قُتِلَ انقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَن يَنقَلِبْ عَلَىَ عَقِبَيْهِ فَلَن يَضُرَّ اللّهَ شَيْئاً وَسَيَجْزِي اللّهُ الشَّاكِرِينَ
“মুহাম্মদ সা. একজন রাসূল মাত্র ছিলেন। তাঁর পূর্বে আরো অনেক রাসুল অতিবাহিত হয়েছেন। যদি তিনি মরে যান বা নিহত হন, তবে কি তোমরা আবার পিছনের দিকে ফিরে যাবে।”  (আলে ইমরানঃ ১৪৪)

মুহাসাবা

আয়নার বৈশিষ্টঃ

- আয়নার সামনে গেলে আমি আমার চেহারা দেখতে পাই, নিজে নিজে দেখতে পাই না।
- আয়নার সামনে যে যায়, কেবল তারই চেহারা দেখা যায়।
- আয়নায় তখনই চেহারা দেখা যায়, যখন আয়নার সরাসরি সামনে যাওয়া যায়।
- আয়নার সামনে যা আছে, কেবল তাই দেখা যায়-কমবেশী দেখা যায়না।
- আয়নার সামনে গেলে পূর্বে যে এসেছে, তার বিবরণ জানা যায় না।
- আয়নায় নিজের বিকৃত চেহারা দেখে কেউ রাগ করেনা।
- আয়নার উপকার স্বীকার করে সবাই আয়নাকে যতনে রাখে।
রাসূল সা. বলেছেনঃ
- المؤمن مرءة المؤمن এক মুমিন আরেক মুমিনের জন্য আয়না
- حاسبوا قبل أن تحاسبوا তোমার হিসাব নেয়ার আগে তুমি তোমার হিসাব করো।
- كلكم راع وكلكم مسؤول عن رعيته তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই যার যার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হবে।

মুহাসাবা ৩ প্রকারঃ
১. ব্যক্তিগত মুহাসাবা-যাকে আমরা আত্ম সমালোচনা বলি।
২. পারস্পরিক মুহাসাবা-যাকে আমরা মুহাসাবা বলি।
৩. সাংগঠনিক মুহাসাবা-যাকে আমরা পর্য্যালোচনা বলি।

ব্যক্তিগত মুহাসাবাঃ
১. দিনের কোন নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মিত করা।
২. কুরআন হাদীস পড়ার সময়ে প্রেক্ষাপট ও শিক্ষার প্রেক্ষিতে।
৩. বাস্তব জীবনে হয়ে যাওয়া ভূল সাথে সাথে শুধরানোর মাধ্যমে।

পারস্পরিক মুহাসাবাঃ
- ব্যক্তিগত মুহাসাবা মানে পারস্পকি ভ‚লত্রæটি শুধরানোর আন্তরিক প্রচেষ্টা।
- ব্যক্তিগত মুহসাবার স্পীরিট হলোঃ নিজের ভাই /বোন সংশোধন কামনা, দুনিয়া ও আখেরারাতের ক্ষতি হতে রক্ষা, উন্নতি ও কল্যাণের পথে চলতে সাহায্য করা। বিধায় কল্যাণ কামনা দ্বারা মনকে ভরপুর রাখা।

পারস্পরিক মুহাসাবা ০৪ প্রকারেরঃ
১. দায়িত্বশীলের পক্ষ থেকে কর্মী বা অধস্তন দায়িত্বশীলের মুহাসাবা।
২. কর্মী বা অধস্তন দায়িত্বশীলের পক্ষ থেকে কর্মী বা অধস্তন দায়িত্বশীলের মুহাসাবা।
৩. কর্মী বা অধস্তন দায়িত্বশীলের পক্ষ থেকে উর্ধ্বতন দায়িত্বশীলের মুহাসাবা।
৪. কর্মীদের পরস্পরে একে অপরের মুহাসাবা।

পারস্পরিক মুহাসাবাতে লক্ষণীয় বিষয় সমূহঃ
১. অন্তরঙ্গ পরিবেশ।
২. যে ভূলের ব্যাপারে মুহাসাবা হচ্ছে তা ঐ ভাই/বোনের কাছে আছেই এমন ভাবে উপস্থাপন না করা। বরং বলা যে, আমার কাছে মনে হচ্ছে ------।
৩. ব্যক্তি ব্যাখ্যা প্রদানের পর নিজের মনকে পরিস্কার করে নেয়া।
৪. যে ভ‚ল ধরে দেয়া হলো তা স্বীকার না করলে তাকে ভাল পরিবেশে নসিহত করা এবং আল্লাহর নিকট বেশী বেশী করে দোয়া করা।
৫. যার মুহাসাবা করা হলো, তিনি মুহাসাবাকারীকে উদ্যোগী হওয়াতে শ্রদ্ধা জানানো।
৬.  অন্যের ভাই/বোনের এই সংশোধনী পদক্ষেপের কারণে নিজে সংশোধনের সুযোগ পাওয়াতে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়।
৭. ভাষা আর যুক্তির জোরে নিজেকে দোষমুক্ত প্রমাণের চেষ্টা না করা। বরং ভূলত্রুটির স্বীকৃতি দিয়ে নিজেকে সংশোধনের জন্য উদ্যোগী হওয়া এবং মুহাসাবাকারীকে ধন্যবাদ জানানো।

সাংগঠনিক মুহাসাবাঃ

সাংগঠনিক মুহাসাবা প্রয়োজন
- সাংগঠনিক কাজের গতিশীলতার জন্য।
- সুস্থতার সাথে সংগঠন পরিচালনার জন্য।
- পরামর্শ যেমন প্রয়োজন, মুহাসাবা তেমনি প্রয়োজন।
- পরামর্শ যেমন যত্রতত্র দেয়ার বিষয় নয়, মুহাসাবাও তেমন যত্রতত্র করার বিষয় নয়।
- গঠনমূলক মুহাসাবা আন্দোলনকে জীবনিশক্তি দান করে। লাগামহীন সমালোচনা সংগঠনের জন্য আত্মঘাতি হয়।

সাংগঠনিক মুহাসাবার নিয়মঃ
- স্থানীয় সংগনের মুহাসাবা উর্ধতন সংগঠনের পক্ষ থেকে করা যায়।
- স্থানীয় সংগঠনের মুহসাবা স্থানীয় সংগঠনের জনশক্তিও করতে পারবে মৌখিক বা লিখিত ভাবে।
- স্থানীয় সংগঠন কোন কাজের পয্যালোচনার জন্য বৈঠকেও আলোচনা করতে পারে।

মুহাসাবা না করার পরিণতিঃ
- যেখানে মুহাসাবা নেই সেখানে আছে গীবত।
- যেখানে মুহাসাবা নেই, সেখানে আছে অনৈক্য।
-  যেখানে মুহাসাবা নেই, সেখানে আছে।

Post a Comment

0 Comments