ড. কামাল হোসেনঃ আপনাকেই বলছি – মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম


(ড. কামাল হোসেন-কে কাতার প্রবাসীর খোলা চিঠি)
আস্সালামু আলাইকুম।
শ্রদ্ধেয় ড. কামাল হোসেন, “পরাজয়”-এর চরম গ্লানি নিয়ে আপনি যখন বিরক্ত, ঠিক তখনই আপনাকে এই খোলা চিঠি লিখছি। পরাজয়শব্দ উল্লেখ করাতে আপনি হয়তো আমাকে খামোশবলতে পারেন। কিন্তু আমি পরাজয় শব্দটা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এবং দায়িত্ব নিয়েই বলছি। আপনার সাথে যুক্তি তর্কের সুযোগ পেলে আপনি যে পরাজিত-তা প্রমাণ করতে পারবো-এটা দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করছি।
পরাজয়ের বেদনা বিদুর সময়ে আপনাকে লিখতে বসায় দূঃখ প্রকাশ করছি। মনযোগ সহকারে এই চিঠিটি পড়ার অনুরোধ করছি। যদিও আমি জানি যে, এই চিঠি আপনার চোঁখে পড়বেনা অথবা এই চিঠি পড়ার সময় আপনার হবেনা, তবুও লিখছি। লিখছি এজন্য যে, আপনার দৃষ্টিভংগীর সাথে ঐক্যমত পোষণকারী হাজার হাজার কামাল হোসেনদের তা চোঁখে পড়বে।
জনাব কামাল হোসেন,
আপনি দেশের জনগনকে দেশের মালিকানাপ্রদানের প্রত্যয় নিয়ে একটি আন্দোলনের ঝাপিয়ে পড়েছিলেন এই বৃদ্ধ বয়সে। কিন্তু এই চমৎকার শব্দাবলী উল্লেখ ছাড়া একই উদ্দেশ্যে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী এই ধরণের আন্দালন তথা নির্বাচন হতে নিরাপদ দূরত্বে থেকে ছিল ৫ বছর আগে ৫ জানুয়ারীর একই ধরণের নির্বাচনে। কারণ জামায়াতে ইসলামী মনে করেছিল যে, এই ধরণেরই একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আর এই নির্বাচনেও জামায়াতে ইসলামীর একই দৃষ্টি ভংগী ছিল। কিন্তু আপনাদের মতো রাঘব বোয়ালদের দৃষ্টিভংগীর সাথে দ্বিমত পোষণ করা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বেমানান বলে দ্বিমত পোষণ করেনি। দ্বিমত পোষণ করেনি এজন্য যে, আপনার মতো ২৩ দলের অনেক বন্ধু মনে করতেন যে, জামায়াতের পরামর্শ শুনে ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন থেকে বিরত থেকে ভূল করেছিল। হাজার কাকের গর্জনের মাঝে একটি কুকিলের সুরেলা আওয়াজ বড়ই বেমানান বলে জামায়াত এই নির্বাচনে অংশ গ্রহণে ভিন্ন দৃষ্টিভংগী পোষণ করেনি। ১৯৭১ সালে সবাই পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হবেন এবং শ্লোগানের মাঝে পাকিস্তান থেকে আলাদা হবো নাএই শ্লোগানটি তেমনি এক কুকিলের সুর ছিল।
জনাব কামাল হোসেন,
এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে আপনি যে, অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেন,
১. জামায়াতকে আপনাদের দলে রাখতে পারবেন না বলে বিরাট দাবীর প্রেক্ষিতে ড. বদরুদ্দোজাকে হারালেন।
২. জামায়াতকে বাদ দিতে গিয়ে ২৩ দলের সাথে ঐক্য না করে বিএনপির সাথে ঐক্য করলেন।
৩. জামায়াত নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে খামোশউপাধি ধারণ করলেন।
৪. নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড-এর আশা করতে করতে নির্বাচন কমিশনের বৈঠক থেকে ওয়াক আউট করলেন।
৫. পুলিশের উপস্থিতিতে নিজে আক্রান্ত হয়ে ভাল একটি শিক্ষা পেলেন এবং পরে পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনী উপাধি প্রদান করে পুলিশের আরো বিরাগভাজন হলেন।
৬. সেনাবাহিনীকে না নামানোর ফলে নির্বাচন কমিশনের প্রতি যে কঠিন আচরণ করলেন, সেনাবাহিনী নেমে বিরাট বিরাট অশ্বডিম্ব উপহার দিয়ে সেনাবাহিনীর প্রতি ভালবাসার শিক্ষা পেলেন।
৭. সকাল সকাল জনগনকে ভোট কেন্দ্রে আসতে বললেন। কিন্তু ভোটের রাত এবং ভোটের দিনে ভোট কেন্দ্র হেফাজনের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হলেন।
৮. সকল অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আপনি স্বতঃই বলতে বাধ্য হলেন, এজন্য কি আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম। পাকিস্তানীরাও এই ধরণের আচরণ করেনি-ইত্যাদি।
জনাব কামাল হোসেন,
এই পরিস্থিতিতে আপনার পরাজয়ের বেলাভূমিতে দৃশ্যমান বিজয় মিছিল দেখে কি মনে হচ্ছে? যারা জোর করে কেন্দ্র দখল করে ভোট ডাকাতি করে নিজেদের নির্বাচিত ঘোষনা করলেন, তাদের চেহারায় কি লজ্জার কোন চিহ্ন দেখতে পেয়েছেন? তাদের কন্ঠে কি কোন কম্পণ লক্ষ করেছেন? করেননি। কারণ, আওয়ামীলীগ এমন একটি দল, যারা মিথ্যাকে সত্য বানাতে জানে-রাতকে দিন বানাতে জানে। কিছু সময়ের ভিতর আপনি তাদের ঘোষনা শুনতে পারবেনঃ রাজাকার ও তাদের দোসরদেরকে জাতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। জনগন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উৎসব মুখুর পরিবেশে ভোট প্রদান করেছে-ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদি।
জনাব কামাল হোসেন,
আপনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশে ছিলেন না। আপনার আদর্শিক পিতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবও ছিলেন না। আপনি স্বচক্ষে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্যাতন যেমন দেখেননি। আপনি পাকিস্তানীদের দোসর রাজাকারদের অত্যাচারও যেমন দেখেননি। আপনি তদানিন্তন সময়ে যারা জামায়াতে ইসলামীর লোক ছিল, তাদের তৎপরতাও তেমনি দেখেননি।
ড. কামাল হোসেন,
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচন সকল দলের অংশ গ্রহণ মুলক নির্বাচন ছিল-এই কথা যদি সত্য হয়। ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচন অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ছিল-এই কথাটাও যদি সত্য হয়। তাহলে একথাও সত্য যে, ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী হত্যা, লুঠৎরাজ, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষণের সাথে ছিল।
জনাব কামাল হোসেন,
আমি জানি যে, আপনি বলবেনঃ ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন সব দলের অংশ গ্রহণ মূলক নির্বাচন ছিলনা এবং অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ছিল না। কারণ আপনি এই দুইটি নির্বাচনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তাহলে ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা সম্পর্কে আপনার জানাটি কেন মিথ্যা হবেনা-কারণ আপনি তখন প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন না।
জনাব কামাল হোসেন,
আপনি যাদের কথায় বিশ্বাস করে জামায়াতে ইসলামীকে হত্যা, লুঠৎরাজ, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষণের সাথে জড়িত ছিল বলে মনে করেন, সেই বিশ্বস্তরাই বলছেঃ ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন সব দলের অংশ গ্রহণ মূলক নির্বাচন ছিল এবং অবাধ, স্বাচ্ছ ও নিরপেক্ষ ছিল।
জনাব কামাল হোসেন,
একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ছাড়া যেমন নির্বাচন গ্রহণ যোগ্য হতে পারেনা, লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড ছাড়া যেমন নির্বাচন প্রতিদ্বন্ধিতা মূলক হতে পারেনা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া যেমন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারেনা-রাজনৈতিক ভাবে নিয়োগ প্রাপ্ত বিচারক দ্বারা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গঠিত আইন দিয়ে, রাজনৈতিক প্রসিকিউটর দিয়ে, রাজনৈতিক গনজাগরণ মঞ্চ তৈরী করে আদালতকে চাপে রেখে কোন বিচারও নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হতে পারেনা।
জনাব কামাল হোসেন,
আপনি একজন আন্তর্জাতিক আইনজীবি। বাংলাদেশে এক সময় গন-আদালত বসেছিল। সেটা কোন আইনে হয়েছিল তা আপনিই ভাল বলতে পারবেন। আপনি সেই সময়ে সেই আদালতের কোন সমালোচনা করেছিলেন বলে আমার স্মরণ বলছেনা। আমি সেই ধরণের একটি গন-আদালত চাই। যেখানে আপনি হবেন জামায়াতে ইসলামীর বিপক্ষের আইনজীবি। আর বিচারক হবেন বাংলাদেশের বাহিরে আন্তর্জাতিক ভাবে প্রসিদ্ধ এমন ৩ বা ৫ জনের একটি বিচারিক প্যানেল। আর আপনি আপনাকে সহযোগিতার জন্য দেশ-বিদেশের যে কোন আন্তর্জাতিক মানবতা বিরোধী অপরাধ বিষয়ে দক্ষ আইনজীবি নিয়োগ করতে পারেন আপনার প্যানেলে। আর আমরা আমাদের পক্ষে লড়বো ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আমাদের সেই সব আইনজীবিদের নিয়ে-যারা ইতিমধ্যে ক্যাঙ্গারু আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন। আপনি প্রমাণ করবেন, জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত ছিল। আর আমরা প্রমাণ করবো, এই ধরণের কোন অপরাধের সাথে জামায়াতে ইসলামী জড়িত ছিল না।
জনাব কামাল হোসেন,
আমি আপনাকে এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করার আহবান জানাচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি, এই সুযোগ আপনি গ্রহণ করলে জাতির মাঝে জোর করে চাপিয়ে দেয়া একটি মিথ্যা গল্পের অবসান হবে। যারা ২০১৪ আর ২০১৮ সালের নির্বাচনকে অংশ গ্রহণ মূলক, নিরপেক্ষ আর স্বচ্ছ বলে, তাদের মুখোশ উম্মুচিত হবে। আপনার কাংখিত আইনের শাসন, দূর্নীতি মুক্ত দেশ প্রাপ্তির জন্য দূর্নীতিমুক্ত এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একদল লোক কালিমামুক্ত হয়ে দেশের উন্নয়নে অংশীদার হওয়ার সুযোগ পাবে।

২০১৯, ১৯ ফেব্রুয়ারী

Post a Comment

0 Comments