বই নোটঃ অর্থনীতিতে রাসূল সা. এর ১০ দফা
শাহ
মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান
ভূমিকা
§ সমাজকাঠামো ও রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার অন্যতম মৌল ভিত্তি
হলো অর্থনীতি।
§ যুগে যুগে গড়ে অঞ্চল ভিত্তিক সভ্যতার অর্থনৈতিক উন্নতি ও
শ্রীবৃদ্ধি সে সময়ে ছিল অবিশ্বাস্য।
§ সে সব সভ্যতায় আল্লাহ রাসূলের শিক্ষা ছিল না। ফলে তাতে ছিল
শোষন ও নির্যাতন-যা
ইতিহাস হয়ে আছে। যেমনঃ মিসরীয় সভ্যতা, রোমান সভ্যতা ইত্যাদি।
§ এই সভ জুলুমকারী সভ্যতা সময়ের ব্যবধানে বিলীন হলেও তাদরে
প্রভাব ও আচরণ বা প্রথা বিলুপ্ত হয়নি। আর যার কারণে এখনো সমাজে অনাচার আর অত্যাচার
রয়ে গেছে। মানুষ সে সব অত্যাচার বা অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও হতাশা থেকে মুক্তি চায়।
§ সেই সময়ের অর্থনৈতিক শোষনের স্বরূপ হচ্ছেঃ
o অগণিত মানুষ জেলের মাঝে মারা গেছে-যাদের
অপরাধ ছিল, তারা রাজা বাদশাহ বা জমিদারদের বিলাসিতার অর্থ
যোগাড় করতে পারেনি।
o সূদের কবলে পড়ে মানুষ নিজ বসত বাড়ী থেকে উচ্ছেদ হয়েছে।
o নারীরা রয়েছে উত্তরাধিকার অধিকার থেকে বঞ্চিত যুগের পর যুগ।
o এতিমরা সম্পত্তি থেকে হয়েছে বিতাড়িত।
o জুয়ার খপ্পড়ে মানুষ হয়েছে সম্বলহীন।
o ব্যবসায়িক অসাধুতার কারণে যেমন মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে, তেমনি
মেহনতি কর্মচারীদের পবিত্র জীবন পরাস্ত হয়েছে হারাম উপার্জনের নেশার কাছে।
§ এই সব অনিয়ম আর অন্ধকার দূর করতে আলোর মশাল নিয়ে এসেছিলেন
নবী মুহাম্মদ সা.। যিনি তার মিশন শুরু আগে ৪০ বছর তার
এলাকার মানুষে জীবনধারা প্রত্যক্ষ করছিলেন।
§ রাসূল সা. অন্ধকার দূর করতে করণীয় বিষয়ে চিন্তা
করতে যান হেরা গুহায়। সেখান থেকে ফিরেন মুক্তির সনদ নিয়ে। সেই মুক্তির সনদের
ভিত্তিতে উদ্যোগী হোন মশাল জ্বালাতে। কিন্তু সমাজের বিরাজমান ক্ষমতাসীনরা এর
বিরুধীতা করে কারণ তারা চায়নি যে, তাদের চলমান ব্যবসাতে কোন
ক্ষতি হোক।
§ রাসূল মক্কাতে শোষন মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠান উপযুক্ত পরিবেশ
না পেয়ে হিজরতে করেন ইয়াসরিবে। সেখানে রাষ্ট্র ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করে তার
কার্যক্রম শুরু করেন।
§ অর্থনীতি হলে রাষ্ট্রের স্থায়ীত্ব ও সমৃদ্ধির বুনিয়াদ। তাই
রাসূল কুরআনের আলোকে ১০ দফা কর্মসূচীর মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করেন। ইতিহাস সাক্ষী
দেয় মাত্র ১০ বছরে তা সমকালীন বিশ্বের বিস্ময়ে রূপন্তরিত হয় এবং দীর্ঘ ৯শত বছর
দাপনের সাথে পৃথিবী ব্যাপী প্রতিষ্ঠিত ছিল। আর এই কর্মসূচীর মাধ্যমে স্পেন থেকে
ইন্দোনেশিয়া অবধি কল্যাণধর্মী ও শোষণমুক্ত অর্থনীতি গড়ে উঠে।
§ উল্লেখ্য যে, কুরআন মানবতার জন্য
এক ঐশী গাইডবুক আর তার বাস্তব রূকার রাসূল সা.। রাসূল
এমন কিছু বলেননি বা করেননি, যাতে আল্লাহর নির্দেশ ছিলনা।
§ অর্থনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়নে রাসূল যে কাজ গুলো করেছেন, তা দশ
দফা আঁকারে উল্লেখ করা হয়েছে। যা আমর বিল মারুফ ও নহী আনিল মুনকারের সমন্বয়ে
গৃহিত।
§ অর্থনীতিতে রাসূল সা. গৃহিত কর্মসূচী সমূহ
নিম্নরূপঃ
১। হালাল উপায়ে উপার্জন ও হারাম পথ বর্জন
২। সুদ উচ্ছেদ
৩। ব্যবসায়িক অসাধুতা উচ্ছেদ
৪। যাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন
৫। বায়তুলমালের প্রতিষ্ঠা
৬। মানবিক শ্রমনীতির প্রবর্তন
৭। ওশরের প্রবর্তন ও ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ইসলামীকরণ
৮। উত্তরাধিকার ব্যবস্থার যৌক্তিক রূপদান
৯। ন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের
বিধান, এবং
১০। সামাজিক কল্যাণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রবর্তন।
§ বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে রাসূল সা. এর এই
কর্মসূচী ছিল সুদূর প্রসারী, প্রগতিশীল চরিত্রের এবং সাধারণ
মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের সহায়ক।
একঃ হালাল উপায়ে উপার্জন ও হারাম পথ বর্জন
§ ইসলাম নীতিগত উৎপাদন, ভোগ, বন্টন ইত্যাদি সকলকে ক্ষেত্রে স্বাধীনাত প্রদান করছে। তবে তা হালাল উপায়ে
হতে হবে। হারাম উপায় বর্জন করতে হবে।
§ সভ্য ও অসভ্য সকল যুগে বৈধতার মাপকাটি ছিল বা আছে সরকারী
ট্রাক্স। ট্যাক্স দিলেই সব হালাল।
§ পূঁজিবাদী অর্থনীতেতে উৎপাদন, ভোগ,
বন্টনে কোন সীমা বা বৈধ-অবৈধের কোন প্রশ্ন
নাই।
§ সমাজতন্ত্রে সিসটেমটা একই ধরণের। পার্থক্য হলো উপার্জন আর
ভোগে ব্যক্তির স্বাধীনতা রাষ্ট্রধারা কঠিন ভাবে নিয়ন্ত্রিত। আর দলের নেতাদের
ক্ষেত্রে পূঁজিবাদী ধারণা প্রযোজ্য।
§ ইসলাম বৈধ উপায়ে যে সম্পদ বা অর্থ অর্জিত হয়, তা
ব্যবহারেও বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। যা ৩ ধরণেরঃ
১। বৈধ বা হালাল পন্থায় ভোগ
২। লাভজনক প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ এবং
৩। আল্লাহর পথে ব্যয়।
বৈধ বা হালাল পন্থায় ভোগঃ
§ কেবলমাত্র বৈধ পন্থায় ব্যয় করা যাবে।
§ অপচয় করা যাবে না।
§ অপব্যয় করা যাবে না।
§ চরিত্র ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর কোন খাতে ব্যয় করা যাবে না।
যেমনঃ মদ্যপান, ব্যভিচার, নাচ-গান,
রং-তামাশা, জুয়া-বাজী-লটারী, নৈতিকতাবিরোধী বিলাস-ব্যসন, সোনা-রূপার তৈজসপত্র
ব্যবহার ইত্যাদি।
§ স্বাভাবিক ব্যয় ও মধ্যম পন্থার জীবন যাপন।
§ লাভজনক প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ে বিনিয়োগঃ
§ ইসলাম প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের নির্দেশ দেয়।
§ বিনিয়োগ একা না পারলে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে করতে
(মুদারাবা) উৎসাহিত করে।
§ ব্যবসা সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেনঃ
o রুজীর দশ ভাগের নয় ভাগই রয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে।
(কানযুল আমল)
o তিনি আরও বলেন- সত্যবাদী, ন্যায়পন্থী
ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবী, সিদ্দীক ও শহীদদের সমান মর্যাদায়
অভিষিক্ত হবে। (তিরমিযী)
আল্লাহর পথে ব্যয়ঃ
§ নিজ খরচ, পারিবারিক খরচ শেষে ব্যবসায়
বিনিয়োগের পর অবশিষ্ট অর্থ ব্যয়ের উত্তম খাত হলো আল্লাহর পথে ব্যয়।
§ রাসূ সা. বলেছেনঃ হে আদম সন্তান! তুমি যদি
তোমার উদ্ধৃত্ত সম্পদ আল্লাহর ওয়াস্তে ব্যয় কর তবে তা তোমার জন্যে উত্তম। মুসলমান
হিসেবে এভাবেই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সন্তষ্টি
অর্জন করা সম্ভব।
§ যদি কারো আয় ব্যয় হয় অবৈধ, তাহলে সেই ব্যক্তি সমাজের জন্য
একটি দুষ্টক্ষত। আর এই ধরণের মানব সমষ্ঠির সমাজ যদি উত্তম আদর্শধারী হলেও সেই
সমাজের অধঃপতন অবধারিত। ইসলাম আয় ও ব্যয়ের বৈধতা ও অবৈধতা নির্ধারণ করেছে।
§ কতিয় অবৈধ উপায়ে আয়ের পথঃ ঘুষ, সুদ, হারাম পণ্যসামগ্রীর ব্যবসা, কালোবাজারী, চোরাকারবারী, নাচ-গান, ফটকবাজারী, পরদ্রব্য আত্মসাৎ, সব ধরনের প্রতরণা, ধাপপাবাজী, পতিতাবৃত্তি, সমস্ত প্রকারের লটারী, জুয়া ইত্যাদি।
§
হারাম পথে উপার্জন কেন
নিষিদ্ধ? ৩টি কারণেঃ
১. এর
মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ত জুলুম, হয়রানী বা কৌশলের মাধ্যমে
প্রতারণা, বাধ্য করে উপার্জন। এতে করে জনগন হয় ক্ষতিগ্রস্থ,
সমাজে সৃষ্টি হয় অসন্তোষ, মানুষ হয় অধিকার হতে
বঞ্চিত। কলহ, বিশৃংখলা বিদ্বেষ ও বিভেদ সৃষ্টির পথ প্রশস্ত
হয়। ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য চালু হয় ঘুষ। যে সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেনঃ ঘুষ গ্রহণকারী ও ঘুষ প্রদানকারী উভয়েরই উপর আল্লাহর অভিসম্পাত। (বুখারী, মুসলিম)
২. চারিত্রিক নৈরাজ্য
সৃষ্টিকারী বিষয়ঃ নৃত্য সঙ্গীত, মদ, বেশ্যাবৃত্তিসহ
সবধরনের অশ্লীল কাজ এবং এসবের ব্যবসা নিষিদ্ধ। এসবের মাধ্যমে অশ্লীলতা, বেহায়াপনার কলুষতা ছড়িয়ে পড়ে।
৩. অবৈধ উপায়ে অর্জিত
ধন-সম্পদ অবৈধ কাজে ব্যয়ের অর্থই হচ্ছে সামাজিক অনাচার ও পংকিলতার পরিমাণ বৃদ্ধি
করা। যেমনঃ নাচ-গান, সিনেমা, নানা রং তামাশা, বিলাস-ব্যসন, মদ্যসক্তি, বেশ্যাগমন, ব্যয়বহুল, প্রাসাদোপম বাড়ী তৈরী ইত্যাদি।
o অপব্যয়ঃ অপব্যয়ের ছিদ্রপথেই সংসারে আসে
অভাব-অনটন। সমাজে আসে অশান্তি। এ দুয়ের মধ্যবর্তী পথই হচ্ছে উত্তম পথ। আল কুরআনে
এরশাদ হয়েছে- وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا
وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا তারাই
আল্লাহর নেক বান্দা যারা অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে না অপচয় ও বেহুদা খরচ করে, না কোনরূপ কৃপণতা করে। বরং তারা এ উভয়
দিকের মাঝখানে মজবুত হয়ে চলে। (ফুরকানঃ ৬৭)
o হিসবাহঃ অতিরিক্ত অর্থ-সম্পদ রয়েছে যাদের
আছে, তাদের সেসব সম্পত্তি বৈধ বা জায়েজ পথে অর্জিত হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করা।রাসূল
সা. এর হিসবাহ নামে একটি দপ্তর ছিল। যার কাজ ছিলঃ
১. অবৈধ উপায়ে আয় রোধ করা।
২. একাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা।
৩. অবৈধভাবে গ্রহণ করে থাকলে তা মূল মালিকের কাছে
প্রত্যর্পণ করা।
৪.
মালিক না পেয়ে বায়তুল মালেই জমা দেওয়া।
o জুয়াঃ হারাম আয়ের বড় একটি উৎস। অতীতেও এর
প্রচলন ছিল। পূর্বে জুয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তীর ও পাশার খেলা। পরে ঘোড়াদৌড়, তাসের বিভিন্ন খেলা,
হাউজী, রুলেতে, শব্দচয়ন,
লটারী প্রাইজবন্ড ইত্যাদি নানা ধরনের ও কৌশলের জুয়া। ফটকাবাজীও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবদান এক প্রকারের জুয়া-যার
মাধ্যমেশেয়ার মার্কেটে সম্ভাব্য মুনাফার চটকদার হিসেব দেখিয়ে ও অন্যান্য অপকৌশলের
মাধ্যমে শেয়ার বিক্রির ফলে কত পরিবার যে রাতারাতি নি:স্ব করা হয়।
o ধোঁকাবাজী বা প্রতারণাঃ যার ঘোর শত্রু ইসলাম।
o কুরআনের ঘোষনা- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
হে মুমিনগণ! জেনে রাখ, মদ জুয়া মূর্তি এবং
(গায়েব জানার জন্যে) পাশা খেলা, ফাল গ্রহণ ইত্যাদি অতি
অপবিত্র জিনিষ ও শয়তানের কাজ। অতএব, তোমরা তা পরিত্যাগ কর।
তবেই তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারবে। সূরা আল মায়েদা : ৯০ আয়াত
o রাসূল সা. বলেছেন-যে ব্যক্তি ধোঁকাবাজী করে সে আমার দলভূক্ত
লোক নয়। (সিহাহ সিত্তাহ)
o যে সব কারণে ইসলামে জুয়া ও ফটকাবাজারী নিষিদ্ধ করা হয়েছে
সেগুলি হচ্ছেঃ
১. অর্থ ও সময়ের অপচয়।
২. সামাজিক বিশৃংখ্লা ও অপরাধ সৃষ্টিকারী।
৩. বিপুল
প্রতারণা।
দুইঃ সুদ উচ্ছেদ
§ দুর্নীতির অবসান ও জুলুমতন্ত্রের বিলোপ সাধনে ইসলাম প্রথম
আঘাত এনেছে সুদের উচ্ছেদ এর মাধ্যমে। সুদ ও সুদভিত্তিক কারবার ও লেনদেন
হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।
§ কুরআন- وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ
الرِّبَا আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।
(বাকারাহঃ ২৭৫)
§ রাসূল সা. বলেন- তোমাদের মধ্যে যারা সুদ খায়, সুদ দেয়,
সুদের হিসাব লেখে এবং সুদের সাক্ষ্য দেয় তারা সবাই সমান পাপী। (তিরমিযী, মুসলিম)
§ ইসলামী অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থায় সকল অসৎ কাজের মধ্যে
সবচেয়ে পাপের জিনিস গণ্য করা হয়েছে সুদকে। বস্তুত : সুদের মতো
সমাজবিধ্বংসী অর্থনৈতিক হাতিয়ার আর দুটি নেই। সুদের কুফলগুলির প্রতি একটু লক্ষ
করলেই বোঝা যাবে কেন সুদ চিরতরে হারাম ঘোষিত হয়েছে।
§ সূদের কূফলঃ
১. সমাজ শোষণের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম।
২. দরিদ্র আরও দরিদ্র এবং ধনী আরও ধনী হয়।
৩. ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
৪. দ্রব্যমূল্য
ক্রমেই বৃদ্ধি পায়।
তিনঃ ব্যবসায়িক অসাধুতা উচ্ছেদ
§ ব্যবসায়িক অসাধুনা ইসলামী অর্থনীতিতে নিন্দনীয় এবং কঠোর
শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
§ পূঁজিবাদী বা আধা পূঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় ব্যবসায়িক
অসাধুতার জন্য আসলে কোন শাস্তি নাই। বর্তমান যামানায় এই অর্থব্যবস্থার নাম দেয়া
হয়েছে অপেন মার্কেট ইকোনমি।
§ ব্যবসায়িক অসাধুতার জন্য শাস্তি না থাকার কারণঃ সরকার বা
তার অর্থব্যবস্থা খুবই উদার অথবা ব্যবসায়ীরা এতো শক্তিশালী যে, তাদের
শাস্তি দেয়া বা দমন করার ক্ষমতা সরকারের নাই।
§ ব্যবসায়িক অসাধুতার পর্যায় পড়ে এমন কাজ সমূহ-যার সবক’টি জঘন্য ধরণের অপরাধ। আর তাহলোঃ
o কালোবাজারী বা চোরাকারবারী।
o মজুতদারী।
o ওজনে কারচুপি।
o ভেজাল দেওয়া।
o নকল করা।
§ এই সব ব্যবসায়িত অসাধুতা প্রতিরোধের লক্ষ্যে রাসূল সা. হিজর
নামে একটি দফতর কায়েম করেন। যার কাজ ছিল ব্যবসায়ে অসাধুতা নিয়ন্ত্রণ ও অসাধু
ব্যবসায়ীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের পরিচালনায় নিয়ে আসা, যা খোলাফায়ে রাশেদা অবধি বহাল ছিল।
§ মজুতদারীঃ
o মজুতদারী-যার অপর নাম ইহতিকার।
o বেশী লাভের আশায় পণ্য মজুত রাখা।এর ফলে পন্যমূল্য হু হু করে
বেড়ে যায়। জনগনের দূঃখ কষ্ট বাড়ে।
o একচেটিয়া কারবারের উদ্দেশ্যে মজুতদারী করা হয়। বিপুল পরিমাণ
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও শিল্পজাত পণ্য মজুত করে বাজারে সংকট তৈরী করা হয়। এমন
অবস্থায় বেশী দামে বিক্রি করা হয়।
o মজুতদারী নিষিদ্ধ করে রাসূল সা. বলেছেনঃ
-
যে বেক্তি ইহতিকার করবে
অর্থাৎ অতিরিক্ত দামের আশায় চল্লিশ দিন যাবৎ খাদ্যদ্রব্য বিক্রয় না করে আটক রাখবে
আল্লাহর সঙ্গে তার ও তার সঙ্গে আল্লাহর সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। (মুসনাদে
আহমেদ)
-
খাদ্যশস্য মজুতকারী
ব্যক্তির মনোভাব অত্যন্ত বীভৎস ও কুটিল। খাদ্য দ্রব্যের মূল্য হ্রাস হলে তারা
চিন্তিত হয়ে পড়ে আর মূল্য বৃদ্ধির পেলে তারা আনন্দিত হয়। (মুসলিম)
§ কাপচূপিঃ
o ওজনে বা মাপে কম দেয়া। যা সংক্রামক ব্যাধির মতো
ব্যবসায়ীদেরকে সংক্রমিত করে এবং ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
o ব্যবসায়িক কারচূপির মধ্যে রয়েছে ওজনে কম দেয়া, নিম্নমানের
সামগ্রী, ভিজা দ্রব্য, মেয়াদোত্তীর্ণ
দ্রব্য, মিথ্য ও বানোয়াট কথামালা বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে
বিক্রি।
o কারচুপি প্রসংগে কুরআনঃ
أَوْفُوا
الْكَيْلَ وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُخْسِرِينَ ﴿181﴾ وَزِنُوا بِالْقِسْطَاسِ
الْمُسْتَقِيمِ ﴿182﴾ وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءَهُمْ وَلَا تَعْثَوْا
فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ ﴿183﴾
“তোমরা মাপে ঠিক দাও এবং
কারো ক্ষতি করো না, সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ঠিকমত ওজন কর। লোকদের
পরিমাপে কম বা নিকৃষ্ট কিংবা দোষমুক্ত জিনিষ দিও না এবং দুনিয়াতে অশান্তি সৃষ্টি
করে বেড়িয়ো না।” (আশ-শোয়ারাঃ
১৮১-১৮৩)
§ মজুতদারী থেকে সৃষ্টি হয় মুনাফাখোরীর মানসিকতা। ব্যবসায়িক
অসাধুতা হতে গড়ে উঠে নৈতিকতাবিরোধী মনোবৃত্তি।
§ মুনাফাখোরীর মানসিকতা ও নৈতিকতা বিরোধী মনোবৃত্তির কারণে
বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছে কালোবাজারী ও চোরাকাবারী চক্র। যাদের কাছে দেশপ্রেম বা
জনস্বার্থ কোন বিষয় নয়-তাদের একমাত্র লক্ষ্য মুনাফা অর্জন।
§ চোরাকারবার অর্থনীতিকে ধ্বংস করে আর কালোবাজারী সামাজিক
অবক্ষয়কে তরান্বিত করে।
চারঃ যাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন
§ যাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। আল-কুরআনে নামায কায়েমের
পরই যাকাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
§ রাসূল সা. যাকাত আদায়ের জন্য সাহাবায়ে কিরামদের
উদ্বুদ্ধ করেন এবং প্রশাসনিক কাঠামো গড়েন।
§ ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদের বন্টন ও সামাজিক সাম্য
অর্জনের অন্যতম প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হলো যাকাত।
§ আয় ও সম্পদ বন্টনে বিরাজমান পার্থক্য হ্রাস করা জন্য যাকাত
ব্যবস্থা একটি উপযোগী হাতিয়ার।
§
যাকাত আর করের মধ্যে
পার্থক্য হলোঃ
o যাকাতের মধ্যে রয়েছে নৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক
মূল্যবোধ। সাধারণ করের মধ্যে নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক তাগিদ নাই। মৌলিক পার্থক্য
গুলো হলোঃ
১. যাকাতের অর্থ
কেবলমাত্র কুরআনে নির্দেশিত খাতে ব্যবহৃত হবে। কর সরকারকে বাধ্যতামূলক ভাবে কোন
উপকারের আশা না করে দিতে হয়। করের অর্থ দরিদ্র ও অভাবী জনসাধারণের জন্য ব্যয় করতে
সরকার বাধ্য নয়।
২. যাকাতের অর্থ
রাষ্ট্রের সাধরণ কাজে ব্যয় করা যাবেনা। করের অর্থ যে কোন খাতে ব্যয় করা যায়্
৩. যাকাত কেবল
সামর্থবানদের জন্য বাধ্যতামূলক। কর সর্বসাধারণের উপর বাধ্যতামূলক।
৪. যাকাতের হার পূর্ব
নির্ধারিত ও স্থিরিকৃত। করের হার স্থির নয়। সরকার ইচ্ছা করলেই তা বাড়াতে বা কমাতে
পারে।
§
ইসলামী শরীয়ত অনুসারে যে
সমস্ত সামগ্রীর উপর যাকাত ধার্য হয়েছে সেগুলি হলোঃ
১। ব্যাংকে/হাতে সঞ্চিত/জমাকৃত অর্থ।
২। সোনা, রূপা, এবং সোনা-রূপা দ্বারা তৈরী অলংকার।
৩। ব্যবসায়ের পণ্য সামগ্রী।
৪। জমির ফসল।
৫। খনিজ উৎপাদন।
৬। সব ধরনের গবাদি পশু।
o উপরোক্ত দ্রব্য সামগ্রী যখন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কোন
মুসলমান কর্তৃক অর্জিত হয়, তখন যাকাত দিতে হয়। যাকে নিসাব বলে।
o নিসাবের সীমা বা পরিমাণ একেক দ্রব্যে একেক ধরণের। একইভাবে
যাকাতের হারও একেক দ্রব্যে একেক ধরণের। যাকাতের সর্বনিন্ম হার শতকরা ২.৫%।
o যাকাত ব্যয়ের খাত সম্পর্কে কুরআনঃ
إِنَّمَا
الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا
وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ
اللَّهِ وَاِبْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
“দান-খয়রাত তো পাওনা হলো
দরিদ্র ও অভাবীগণের, যে সকল কর্মচারীরউপর আদায়ের ভার আছে তাদের,
যাদের মন (সত্যের প্রতি) সম্প্রতি অনুরাগীহয়েছে, গোলামদের মুক্তির জন্যে, ঋণগ্রস্তদের জন্যে, আল্লাহর পথে (মুজাহিদদের) এবং মুসাফিরদের জন্যে। এটি আল্লাহর তরফ হতে ফরয
এবং আল্লাহ সব জানেন ও বুঝেন। (আত-তাওবাঃ ৬০)
§
কুরআনের আয়াত থেকে
যাকাতের আটটি খাত পাওয়া যায়ঃ
১। দরিদ্র জনসাধারণ
২। অভাবী ব্যক্তি
৩। যে সকল কর্মচারী যাকাত আদায়ে নিযুক্ত রয়েছে
৪। নও-মুসলিম
৫। ক্রীতদাস বা গোলাম মুক্তি
৬। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি
৭। আল্লাহর পথে মুজাহিদ এবং
৮। মুসাফির।
o যাকাতের ৮টি খাতের মাঝে ৬টি দরিদ্র মানুষে সাথে সম্পর্কিত
আর ২টি দরিদ্র নয় এমন নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্কিত।
o যাকাতের অর্থ দরিদ্র নয় এমন যে ২ শ্রেণীর মানুষকে দেয়া হয়, তার
ব্যাখ্যা হলোঃ
১. যাকাত
বিভাগের কর্মচারীঃ যারা যাকাত আদায় ও ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত-যা কঠিন ও শ্রমসাপেক্ষ কাজ। যাদের ডিউটি ছিল সার্বক্ষনিক এবং যার কারণে আয়
রোযগারের জন্য তারা অন্য কোন কাজ করার সুযোগ ছিল না।
২. আল্লাহর
রাস্তায় জিহাদকারীগনঃ যারা সার্বক্ষনিক ভাবে জিহাদের ময়দানে থাকার কারণে জীবিকা
অর্জনের সুযোগ হতে বঞ্চিত ছিলেন।
§
যাকাত আদায়ের জন্য জোন বা
অঞ্চলঃ
o ইসলামী রাষ্ট্রে মৌলিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে যাকাত
আদায় ও বন্টনে রাসূল সা. জোর তাগিদ দিয়েছেন।
o রাসূল সা. যাকাত আদায়ের জন্য ৯ম ও ১০ম হিজরীতে
আরব ভূখন্ডকে ১২টি অঞ্চলে ভাগ করে তার দায়িত্বশীল নিযুক্ত করেন। যা নিম্নরূপঃ
ক্রম |
এলাকা |
দায়িত্বশীল
নাম |
১ |
মদীনা
মুনাওয়ারা |
বিলাল
বিন রাবাহ রা. |
২ |
মক্কা
মুয়াযযামা |
হুবায়রাহ
বিন শিবল রা. |
৩ |
জেদ্দা |
হারিস
বিন নওফল রা. |
৪ |
তায়েফ |
উসমান
বিন আবী আল-আস রা. |
৫ |
সানা |
মুহাজির
বিন আবি উমাইয়াহ রা. |
৬ |
নাজরান |
আলী
বিন আবী তালিব রা. |
৭ |
ইয়ামান |
মুআয
বিন জাবাল রা. |
৮ |
বাহরাইন |
আবান
বিন সাঈদ রা. |
৯ |
হুনায়ন
|
আমর
বিন আল-আস রা. |
১০ |
খায়বার |
সাওয়াদ
বিন আযীয়াহ রা. |
১১ |
ওয়াদী
উল কুরা |
আমর
বিন সাঈদ রা. |
১২ |
হাযরামাউত |
যিয়াদ
বিন লাবীদ রা. |
o রাসূল সা. আরবের ১৫টি গোত্র হতে যাকাত আদায়
করার জন্য ১২জন বিশিষ্ট সাহাবীকে দায়িত্ব প্রদান করেন। যা নিম্নরূপঃ
ক্রম |
গোত্র |
দায়িত্বশীল
নাম |
১ |
বনু
মুসতালিক |
ওয়ালীদ
বিন উকরাহ |
২ |
বনু
গাতফান |
নওফাল
বিন মুয়াবিয়াহ |
৩ |
বনু
বনু হাওয়াযিন |
ইকরামাহ
বিন আবু জাহেল |
৪ |
বনু
গিফার |
বুরাইদাহ
বিন হুসায়ব |
৫ |
বনু
আসলাম |
বুরাইদাহ
বিন হুসায়ব |
৬ |
বনু
হানযালাহ |
মালিক
বিন নোওয়াইরাহ |
৭ |
বনু
সুলাইম |
আব্বাস
বিন বশীর আশহালী |
৮ |
বনু
মুযাইনাহ |
আব্বাস
বিন বশীর আশহালী |
৯ |
বনু
তামীম |
উয়ায়নাহ
বিন হিসন |
১০ |
বনু
জুহায়নাহ |
রাফি
বিন মাকীস |
১১ |
বনু
ক্বিলাব |
যাহহাক
বিন সুফিয়ান |
১২ |
বনু
সাকীফ |
কিলাব
বিন উমাইয়াহ |
১৩ |
বনু
আযদ |
হুযায়ফা
বিন আল ইমরান |
১৪ |
বনু
তাঈ |
আদী বিন
হাতীম |
১৫ |
বনু
আসাদ |
আদী
বিন হাতীম |
§
রাসূল সা. এর সময়ে
যাকাত আদায় ও বিলি বন্টনের বলিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরী করেন। যা নিম্নরূপঃ
১। সায়ীঃ গবাদী পশুর যাকাত সংগ্রাহক।
২। ক্বাতিবঃ করণিক।
৩। ক্বাসামঃ বন্টনকারী।
৪। আশিরঃ যাকাত প্রদানকারী ও যাকাত প্রাপকদের মধ্যে
সম্বন্ধ স্থাপনকারী।
৫। আরিফঃ যাকাত প্রাপকদের অনুসন্ধানকারী।
৬। হাসিবঃ হিসাব রক্ষক।
৭। হাফিজঃ যাকাতের বস্তু ও অর্থ সংরক্ষক।
৮। ক্বায়ালঃ যাকাতের পরিমাণ নির্ণয় ও ওজনকারী।
§
যাকাতের সামাজিক ও
অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যঃ
o কতিপয় ব্যক্তির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে না দেয়া।
o সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য দূরীকরণ।
o অসহায় ও দুঃস্থ মানবতার কল্যাণ।
o ধন-সম্পদের লালদা দূরীকরণ।
o দারিদ্র বিমোচনে দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি।
o আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়ের তাগিদ।
o মজুতদারী বন্ধ করণঃ ১. শিল্প বা ব্যবসায়ে অর্থ
বিনিয়োগ। অথবা ২. ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী ব্যয়।
§ যাকাতের মাধ্যমে শুধু অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা হয়না, বরং
অর্থনৈতিক কার্যক্রম গতি সঞ্চার হয়।
পাঁচঃ বায়তুলমালের
প্রতিষ্ঠা
§ মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই বায়তুলমাল
প্রতিষ্ঠা করা হয়।
§ বায়তুলমান মানে সরকারের অর্থ সম্বন্ধীয় কার্যক্রম। যাতে
রয়েছে ইসলামী রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সম্মিলিত মালিকানা।
§ বায়তুলমালের প্রথম ও প্রধান দায়িত্বঃ ইসলামী রাষ্টের সীমার
মধ্যে একজন লোকও যেন তাদের মৌলিক প্রয়োজন হতে বঞ্চিত না হয়, তার
ব্যবস্থা করা।
§ কোন নাগরিক যদি সাধ্যমতে পরিশ্রম করার পরও জীবিকার অভাব
পুরণে ব্যর্থ হয় এবং স্বচ্ছল মানুষ তাদের আত্মীয় বা প্রতিবেশীর প্রয়োজন পূরণের
চেষ্টার পরও মৌলিক প্রয়োজন অপূর্ণ থাকে, তাহলে বাইতুলমালে হতে
সাহায্য গ্রহণ করা যাবে।
§ বায়তুলমাল ব্যবস্থা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ও মৌলিক
ব্যবস্থা।
§
ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী
বায়তুলমালের অর্থ সংস্থানের উৎসগুলি নিন্মরূপঃ
১। অর্থ সম্পদ ও গবাদি পশুর যাকাত।
২। সদাকাতুল ফিতর।
৩। কাফফারাহ।
৪। ওশর।
৫। খারাজ।
৬। গণীমতের মাল ও ফাই।
৭। জিজিয়া।
৮। খনিজ সম্পদের আয়।
৯। নদী ও সমুদ্র হতে প্রাপ্ত সম্পদের এক-পঞ্চামাংশ।
১০। ইজারা ও কেরায়ার অর্থ।
১১। মালিক ও উত্তরাধিকারহীন সম্পদ।
১২। আমদানী ও রফতানী শুল্ক।
১৩। রাষ্ট্রের মালিকানা ও কর্তৃত্বধীন জমি, বন ব্যবসায় ও শিল্পের মুনাফা।
১৪। শরীয়াহ মোতাবেক আরোপিত কর।
১৫। বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের অনুদান ও উপটৌকন।
§
যে সমস্ত খাতে
বায়তুলমালের অর্থ ব্যয়ের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে সেগুলি হচ্ছেঃ
১। রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার কর্মচারীদের বেতন
২। বন্দী ও কয়েদীদের ভরণ-পোষণ
৩। লা-ওয়ারিশ শিশুদের প্রতিপালন
৪। অমুসলিমদের আর্থিক নিরাপত্তা
৫। করযে হাসানা প্রদান এবং
৬। সামাজিক কল্যাণ
§
রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারী
কর্মচারীদের বেতনঃ
o
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান
তাঁর বেতন বা সম্মানী বায়তুলমাল হতে নেবেন। আর তা নির্ধারিত হবে প্রয়োজন ও
সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য অনুসারে। হযরত উমর রা. বলেনঃ তোমাদের সামগ্রিক ধনসম্পদ
ইয়াতীমের ধনসম্পদের সমতূল্য এবাং আমি যেন ইয়াতীমের মালেরই রক্ষাণবেক্ষণকারী। অতএব
আমি যদি ধনী হই-তবে আমি বায়তুলমাল হতে কিছুই গ্রহণ করব না। আর যদি দরিদ্র ও অভাবী
হই, তবে অপরিহার্য পরিমাণ
কিংবা সাধারণ প্রচলিত মানের বেতনই আমি গ্রহণ করব।(আবু ইউসূফ-কিতাবুল খারাজ)
o
সরকারী কর্মচারীদের
বেতনের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান হচ্ছে বেতন হবে ভরণ-পোষণের দায়িত্বপালনক্ষম এবং
নিম্নপদ বা সাধারণ কর্মচারীদের প্রয়োজন পূরণ না করে উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের
বিলাস-ব্যাসনের ব্যবস্থা না করা।
o
বেতন নির্ধারণে হযরত উমর
রা. অনুসৃত বিচার্য বিষয় সমূহঃ
১। ইসলামের জন্যে কি পরিমাণ দু:খ ভোগ করেছে।
২। ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে কতখানি অগ্রসর হয়েছে
৩। ইসলাম প্রতিষ্ঠার কতখানি কষ্ট স্বীকার করেছে
৪। ইসলামী জীবন যাপনের জন্যে প্রকৃত প্রয়োজন কতখানি
এবং
৫। কতজন লোকের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার উপর অর্পিত
রয়েছে।
§
বন্দী ও কয়েদীদের
ভরণ-পোষণঃ
o যুদ্ধবন্দী ও বিভিন্ন অপরাধে কয়েদীদের মৌলিক প্রয়োজন
মেটাবার জন্যে ইসলামী সরকার বাধ্য।
§
লা-ওয়ারিশ শিশুদের
প্রতিপালনঃ
o ইয়াতীম, অনাথ ও লা-ওয়ারিশ শিশুদের লালন পালন
করা ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য।
o রাসূল সা.লা-ওয়ারিশ শিশুদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে গণ্য করেছেন।
তিনি বলেন” যে বেক্তি কোন দায়ভার রেখে যাবে তা বহন করা করা আমার কর্তব্য। (আবু দাউদ)
§
অমুলিমদের আর্থিক
নিরাপত্তা প্রদানঃ
o ইসলামের সামাজিক নিরাপত্তা শুধুমাত্র মুসলিম নাগরিকদের
জন্যেই নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-ভাষা-লিঙ্গ
নির্বিশেষে আবাল বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই এর অন্তর্ভূক্ত।
o বিধর্মীরা অক্ষম অবস্থায় জিজিয়া দেবে না, বরং
রাষ্ট্র তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবে বায়তুল মাল হতে।
§
করযে হাসানা প্রদানঃ
o জাহেলী যুগে বিনা প্রতিদানে ঋণ দেবার রীতি চালু ছিল না। বরং
সুদই ছিল লেনদেনের ভিত্তি।
o রাসূল সা.এই রীতির মূলোচ্ছেদ করেন এবং বিনা সুদে ঋণ বা করযে
হাসানা দেবার রীতি চালু করেন।
§
সামাজিক কল্যাণঃ
o সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন হতে পারে এমন সব কাজে বায়তুলমাল
হতেই অর্থ ব্যয় করার বিধান রয়েছে। যেমনঃ
-
সরাইখানা নির্মাণ।
-
শিক্ষাবিস্তার।
-
পানির নহর খনন।
-
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা
ব্যবস্থার বিস্তার।
-
বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ
পদ্ধতির ব্যাপক সম্প্রসারণ।
-
পথিকদের সুবিধার ব্যবস্থা।
-
রাস্তা-ঘাট, কালভার্ট
ও সেতু নির্মাণ, দিঘী-পুকুর খনন।
-
মুসাফিরখানা স্থাপন।
-
ভিক্ষাবৃত্তির উচ্ছেদ।
-
গরমৌসূমে কাজের বিনিময়ে
খাদ্যের যোগান।
-
পুষ্টিহীনতা দূর।
-
শ্রমিক কল্যাণ।
-
বৃদ্ধদের প্রয়োজন পূর্ণ
ছয়ঃ মানবিক শ্রমনীতির প্রবর্তন
o বিশ্বের ইতিহাসে রাসূল সা. সর্বপ্রথম মানবিক শ্রমনীতির
প্রবর্তন করেন।
o রাসূল সা. এর আগে বা পরে কোন দেশ বা অর্থনীতিতেই শ্রমিকদের
স্বার্থ সংরক্ষণের প্রয়াস গ্রহীত হয়নি।
o চৌদ্দশত বছর পূর্বে প্রবর্তিত সেই শ্রমনীতি আজও বিশ্বের
শ্রেষ্ঠ শ্রমনীতি।
o পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার শ্রমনীতি মানবিক
নয়, ইনসাফভিত্তিক নয়।
o ইসলামের বৈপ্লবিক ও মানবিক শ্রমনীতির পরিচয় মিলে শ্রমিক-মালিক
সম্পর্ক, শ্রমিকদের সঙ্গে ব্যবহার, তাদর বেতন ও মৌলিক প্রয়োজন পূরণ ইত্যাদি প্রসঙ্গে রাসূল সা. প্রদর্শিত পথ
ও বর্ণিত হাদীস সমূহে। যেমনঃ
-
মজুরদের অধিকার সম্বন্ধে
তিনি বলেন-
·
“তারা তোমাদের ভাই!
আল্লাহ তাদের দায়িত্ব তোমাদের উপর অর্পণ করেছেন। কাজেই
আল্লাহ যাদের উপর এরূপ দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন তাদের কর্তব্য হলো তারা যে রকম
খাবার খাবে তাদেরকেও সেরকম খাবার দেবে, তারা যা পরিধান করবে তাদেরকে তা
পরাবার ব্যবস্থা করবে। যে কাজ করা তাদের পক্ষে কষ্টকর ও সাধ্যতীত তা করার জন্যে
তাদেরকে কখনও বাধ্য করবে না। যদি সে কাজ তাদের দিয়েই করাতে হয় তা হলে সে জন্যে
তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য অবশ্যই করতে হবে।” (বুখারী)
·
“শ্রমিককে এমন কাজ করতে
বাধ্য করা যাবে না, যা
তাদেরকে অক্ষম ও অকর্মণ্য বানিয়ে দেবে।”(তিরমিযী)
·
“তাদের উপর
ততখানি চাপ দেওয়া যেতে পারে, যতখানি তাদের সামর্থ্যে কুলায়। সাধ্যাতীত কোন কাজের নির্দেশ
কিছুতেই দেওয়া যেতে পারে না।” (মুয়াত্তা, মুসলিম)
·
“মজুরদের বেতন, উৎপাদিত পণ্যে তাদের অংশ ইত্যাদি
সম্পর্কে তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন- মজুরের মজুরী তার গায়ের ঘাম শুকাবার
পূর্বেই পরিশোধ কর।” (ইবনে
মাজাহ, বায়হাকী)
·
“মজুরকে তার কাজ হতে অংশ
দান কর। কারণ, আল্লাহ
মজুরকে কিছুতেই বঞ্চিত করা যেতে পারে না।” (মুসনাদে আহমদ বিন হাম্বল)
o উপরের হাদীস গুলো থেকে রাসূল সা. এর মানবিক শ্রমনীতির যে
চিত্র পাওয়া যায়, তাহলোঃ
১। উদ্যোক্তা বা শিল্প
মালিক মজুর-শ্রমিককে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করবে। সহোদর ভাইয়ের মধ্যে যে সম্পর্ক
বিদ্যমান থাকে এ ক্ষেত্রেও সে রকম সম্পর্ক থাকবে।
২। অন্ন বস্ত্র-বাসস্থান
প্রভৃতি মৌলিক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শ্রমিক ও মালিক উভয়ের মান সমান হবে। মালিক যা
খাবে ও পরবে শ্রমিককেও তাই খেতে ও পরতে দেবে।
৩। সময় ও কাজ উভয় দিক
দিয়েই শ্রমিকদের সাধ্যমতো দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, তার বেশী নয়। শ্রমিককে এত বেশী কাজ
দেওয়া উচিৎ হবে না যাতে সে ক্লান্ত ও পীড়িত হয়ে পড়ে। এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাকে
শ্রম দিতে বাধ্য করা যাবে না, যার ফলে সে অক্ষম হয়ে পড়ে। শ্রমিকের কাজের সময় নির্দিষ্ট
হতে হবে এবং বিশ্রামের সুযোগ থাকতে হবে।
৪। যে শ্রমিকের পক্ষে
একটি কাজ করা অসাধ্য তা সম্পন্ন হবে না এমন কথা ইসলাম বলে না। বরং সে ক্ষেত্রে আরও
বেশী সময় দিয়ে বা বেশী শ্রমিক নিয়োগ করে তা সম্পন্ন করা যেতে পারে।
৫। শ্রমিকদের বেতন
শুধুমাত্র তাদের জীবন রক্ষার জন্যে যথেষ্ট হলে হবে না। তাদের স্বাস্থ্য, শক্তি ও সজীবতা রক্ষার জন্যে ন্যূনতম
প্রয়োজনীয় ব্যয়ের ভিত্তিতেই বেতন নির্ধারণ করতে হবে।
৬। উৎপন্ন দ্রব্যের
অংশবিশেষ বা লভ্যাংশের নির্দিষ্ট অংশও শ্রমিকদের দান করতে হবে।
৭। শ্রমিকদের কাজে কোন
ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে তাদের প্রতি অমানুষিক আচরণ বা নির্যাতন করা চলবে না। বরং
যথাযথ সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার করতে হবে।
৮। চুক্তিমত কাজ শেষ হলে
অথবা নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হলে শ্রমিককে দ্রুত মজুরী বা বেতন পরিশোধ করতে হবে। এ
ব্যাপারে কোন ওজর-আপত্তি বা গাফলতি করা চলবে ন।
৯। পেশা বা কাজ নির্বাচন
করার ও
মজুরীর পরিমাণ বা হার নির্ধারণ সম্পর্কেও দর-দস্তর করার পূর্ণ স্বাধীনতা ও অধিকার
শ্রমিকের রয়েছে। বিশেষ কোন কাজে বা মজুরীর বিশেষ কোন পরিমাণের বিনিময়ে কাজ করতে
জবরদস্তি করা যাবে না।
১০। কোন অবস্থাতেই
মজুরদের অসহায় করে ছেড়ে দেওয়া চলবে না। তারা অক্ষম ও বৃদ্ধ হয়ে পড়লে পেনশন বা
ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে বায়তুল মালের তহবিল ব্যবহৃত হতে পারে।
সাতঃ ওশরের প্রবর্তন ও ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার
ইসলামীকরণ
o বিশ্ব ব্যবস্থায় রাসূল সা. কর্তৃক
প্রবর্তনের আগ পর্যন্ত জমির রাজস্বের কোন সুনির্দিষ্ট নয়ম ছিল না।
o রাসূল সা. প্রথম এ নিয়ম চালু করেন।
o রাসূল সা. ভূমি রাজস্বের জন্য জমিকে দুই ভাগে
ভাগ করেন। ১. সেচ বিহীন জমি। ২. সেচযুক্ত
জমি।
o সেচ বিহনী জমিঃ যা আল্লাহর প্রদত্ত পানি তথা বৃস্টির পানিতে
যা সিক্ত হয়।
o সেচ বিহীন জমিঃ যাতে মানুষ, পশু বা
যন্ত্রের সাহায্যে সেচ দিয়ে চাষের উপযুক্ত করতে হয়।
o রাসূল সা. ওশর ও নিসফে ওশর এর বিধান চালু করেন।
o ওশরঃ যে সব জমি সেচ বিহীন, তাতে
উৎপাদিত ফসলের এক দশমাংশ প্রদান করা।
o নিসফে ওশরঃ যে সব জমি সেচ দিয়ে চাষাবাদ করতে হয়, তাতে
উৎপাদিত ফসলের এক-বিংশতি অংশ প্রদান করা।
o তবে উভয় ক্ষেত্রেই বিধান হচ্ছে যে, নিসাব
পরিমাণ ফসল উৎপন্ন হলে ওশর বা নিসফে ওশর প্রদান করতে হবে।
o
ওশরের বৈশিষ্ট সমূহঃ
১. ওশর সব সময় জারি থাকবেঃ ওশর কখনই এবং কোন
অবস্থাতেই রহিত করা যাবে না। এর হারও চিরকালের জন্যে নির্দিষ্ট। এ থেকে কোন
অবস্থাতেই কাউকে অব্যহতি দেওয়া যেতে পারে না। তবে কোন মৌসুমে কোন ফসল নিসাব
পরিমাণের কম উৎপন্ন হলে তার ওশর আদায় করতে হবে না।
২. ওশর আদায় হবে যতবার উৎপাদিত হবে ততবারঃ ওশর
আদায় করতে হবে প্রতিটি ফসল হতেই। অর্থাৎ যেসব জমিতে বছরে দুটি বা তিনটি ফসল হবে
সেই ফসলের প্রত্যেকটি হতেই ওশর আদায় করতে হবে। এর ফলে বায়তুল মালের সম্পদ বৃদ্ধি
পাবে, পরোক্ষভাবে জাতি ও দেশেরই
খেদমত করা হবে।
৩. ওশর প্রদান করা হবে উৎপাদিত সেই ফসল থেকেঃ ওশর
আদায় করতে হবে ফসলের দ্বারাই। এ ব্যবস্থা কৃষক বা ভূমি মালিকের জন্যে খুবই অনুকূল।
কারণ, ফসল কমই হোক আর বেশীই হোক, তা থেকে নির্দিষ্ট অংশ পরিশোধ করতে
কৃষকের অসুবিধার সম্ভবনা নেই। তাছাড়া নগদ টাকা যদি ওশর দিতে হয় তাহলে কৃষকের
অসুবিধা হওয়ার সম্ভবনা থাকে। ফসলের দাম কখনই নির্দিষ্ট থাকে না। কোন বছর যদি বিশেষ
কোন ফসল বেশী পরিমান উৎপন্ন হয় বা অন্য কোন নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কারণে মূল্য হ্রাস
পায় তাহলে নির্দিষ্ট ওশর পরিশোধ করার জন্যে কৃষক অধিক পরিমাণে ফসল বিক্রি করতে
বাধ্য হবে। এতে কৃষকের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে।
o বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মতবাদ অনুযায়ী নানা ধরনের
ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যেমনঃ
-
ইউরোপের জমি ব্যবস্থাপনাঃ
·
ইউরোপ, বিশেষ
করে ইংল্যান্ডে ভূমিদাস দ্বারা জমি চাষ করানো হতো। যারা ছিল রায়ত, তাদের উৎপন্ন
ফসলের অর্ধেক জমিদার বা চারর্চকে দিতে হতো।
·
ইউরোপীয় ব্যবস্থায় জমির
মালিকানা ছিল মুষ্টিমেয় কয়েক পরিবারের মাঝ সীমাবদ্ধ।
·
শিল্প বিপ্লবের কারণে
জমির উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এতে করে শিল্পপতিরা সস্তায় বিশাল আয়তনে জমি কিনে হয়
ভূস্বামী।
·
নব্য জমিদাররা ছোট ছোট
জমি চাষীদের থেকে কিনে নেয় বা জোর করে দখল করে। ফলে তারা হয় বেকার বা ভূমিহীন। এ
থেকে ভূমিহীন কৃষকের সৃষ্টি।
·
ভূমির মালিকানা মুষ্টিমেয়
পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর পর শিল্প বিপ্লবের ফলে জমির উৎপাদন যখন বহুগুন
বৃদ্ধি পায়, তখন বড় বড় শিল্পপতিরা হাজার হাজার একর জমি
সস্তায় কিনে একই সঙ্গে ভূস্বামী হয়ে বসে। উপরন্ত নব্য জমিদাররা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
জমি হয় কিনে নেয় অথবা শক্তির দ্বারা চাষীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে। ফলে বেকার ও
ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
-
সমাজতন্ত্রঃ
·
সমাজতন্ত্র এসে ব্যক্তির
মালিকানা উচ্ছেদ করে। সমগ্র জমির মালিক হয়ে যায় রাষ্ট।
·
জমির এই রাষ্ট্রীয়
মালিকানা কায়েম করতে লক্ষ লক্ষ মানুষকে পাঠানো হয় নির্বাসনে, লেবার
ক্যাম্পে বা বন্দি শিবিরে। অথবা হত্যা করা হয়
·
সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের
মালিকানাধীন জমিতে কৃষকদের কাজা করতে বাধ্য করা হয়। আর এর বিপরীতে তাদেরকে সামান্য
ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করা হয়।
-
ইসলামঃ
·
এই উভয় প্রকার
ভূমিব্যবস্থাই বঞ্চনামূলক ও স্বভাববিরোধী।
·
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমাজ
ও জাতি বঞ্চিত ; সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি মানুষ শুধু বঞ্চিত হয়,
বরং শোষিত ও নিপীড়িত।
·
এই অবস্থা থেকে মুক্তির
জন্য চৌদ্দশত বছর পূর্বেই রাসূল সা. এক অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিস্বত্ব নীতি
ঘোষণা করেছিলেন।
·
আব্বাসীয় খিলাফত পর্যন্ত
সে নীতি অনুসারে ভূমির বিলি-বন্টন ও মালিকানা নির্ধারিত হয়েছে।
·
রাসূল সা. ফায়সালা করে
দিয়েছেন, জমি জায়গা সব কিছুই আল্লাহর। মানুষ তাঁরই
দাস। অতএব যে ব্যক্তি অনাবাদী জমি চাষ উপযোগী ও উৎপাদনক্ষম করে তুলবে তার মালিকানা
লাভে সেই-ই অগ্রাধিকার পাবে। (আবু দাউদ)
o ইসলাম ভূমিস্বত্ব নীতি অনুযায়ী জমির মালিকানা লাভ ও
ভোগদখলের দৃষ্টিতে জমিকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। সে গুলি হচ্ছে-
১। আবাদী ও মালিকানাধীন
জমি। মালিকের বৈধ অনুমতি ব্যতীত এই জমি অপর কেউ ব্যবহার বা কোন অংশ দখল করতে পারবে
না।
২। কারো মালিকানাভূক্ত
হওয়া সত্বেও পতিত আবাদ অযোগ্য জমি। এই জমিতে বসবাস নেই, কৃষিকাজ
হয় না, ফলমূলের চাষ হয় না। এই শ্রেণীর জমিও মালিকেরই
অধিকারভুক্ত থাকবে।
৩। জনগণের সাধারণ
কল্যাণের জন্যে নির্দিষ্ট জমি। কবরস্থান, মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ, স্কুল-কলেজ,
চারণ ভূমি ইত্যাদি সর্বসাধারণের জন্যে নির্দিষ্ট জমি এই শ্রেণীর
আওতাভূক্ত।
৪। অনাবাদী ও পরিত্যক্ত
জমি যার কোন মালিক নেই বা কেউ ভোগ-দখলও করছে না। এ ধরনের জমির বিলি-বন্টন সম্পর্কে
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসনই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
o অনাবাদি, অনুর্বর, মালিকহীন
ও উত্তরাধীকারহীন জমি-জায়গা এবং যে জমিতে কেউ চাষাবাদ ও ফসল ফলানোর কাজ করে না তা
ইসলামী রাষ্ট্রের উপযুক্ত লোকদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব
ও কর্তব্য।
o ইসলামে মাত্র একপ্রকার ভূমিস্বত্বই স্বীকৃত-রাষ্ট্রের সঙ্গে
ভূমি মালিকের সরাসরি সম্পর্ক। জমিদার তালুকদার মানবদার প্রমুখ মধ্যস্বত্বভোগীর কোন
স্থান ইসলামে নেই। সে কারণে শোষণও নেই।
o ওশর ও খারাজ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকায় জমির মালিক বা কৃষকদের
উপর ইনসাফ ও ইহসান করা হয়েছে।
o জমি পতিত রাখাকে ইসলাম সমর্থন করেনি, সে জমি
রাষ্ট্রের হোক আর ব্যক্তিরই হোক।
o জমির মালিক যদি বৃদ্ধ, পংগু, শিশু বা স্ত্রীলোক হয় অথবা চাষাবাদ করতে অনিচ্ছুক বা অসমর্থ হয় তবে অন্যের
দ্বারা জমি চাষ করাতে হবে। “যার অতিরিক্ত জমি রয়েছে সে তা হয় নিজে চাষ করবে,
অন্যথায় তার কোন ভাইয়ের দ্বারা চাষ করাবে অথবা তাকে চাষ করতে হবে।” (ইবনে মাজাহ)
o “সেই জমি নিজেরা চাষ কর কিংবা অন্যদের চাষ করাও।” (মুসলিম)
o উমর ফারুক (রা) হযরত বিলাল ইবনুল হারেস (রা) এর নিকট হতে সা.
প্রদত্ত জমির যে পরিমাণ তাঁর চাষের সাধ্যাতীত ছিল তা ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং মুসলিম
কৃষকদের মধ্যে পুনর্বন্টন করে দিয়েছিলেন।
o বর্তমান সময়ে প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনবার জন্যে এক
দিকে কিছু দেশ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। অন্যদিকে ফসলের দাম কমে যাওয়ার ভয়ে কোন
কোন দেশে হাজার হাজার একর জমি ইচ্ছাকৃতভাবে অনাবাদী ও পতিত রাখা হচ্ছে। তাই
সামগ্রিকভাবে পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে বিশ্ব খাদ্যের
অনটন লেগেই রয়েছে।
o জমি যেমন ইচ্ছাকৃতভাবে অনাবাদী ও পতিত রাখা যাবে না তেমনি
সমস্ত পতিত জমি চাষের আওতায় আনতে হবে। ইসলামের দাবীই তাই। এই
অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পতিত জমি শুধু ব্যক্তিকে চাষ করতেই বলা হয়নি, উৎসাহ
দেবার জন্যে ঐ জমিতে তার মালিকানাও স্বীকার করা হয়েছে। রাসূল সাঃ বলেছেন- যে লোক
পোড়ো ও অনাবাদী জমি আবাদ ও চাষযোগ্য করে নেবে সে তার মালিক হবে। (আবু দাউদ)
o ইচ্ছাকৃতভাবে জমি অনাবাদী রাখার কোন সুযোগ ইসলামে নেই। বরং
জমি চাষের জন্যে এতদূর হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, ইচ্ছাকৃতভাবে কোন
আবাদী জমি পর পর তিন বছর চাষ না করলে তা রাষ্ট্রের দখলে চলে যাবে। রাষ্ট্রই তা
পুনরায় কৃষকদের মধ্যে বিলি-বন্টন করে দেবে।
o উন্নত কৃষি ব্যবস্থার মূখ্য শর্ত হিসেবেই উন্নত ভূমিস্বত্ব
ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন হওয়া দরকার। এ জন্যে ইসলামের সেই প্রারম্ভিক
যুগে বিশ্ব মানবতার কল্যাণকামী ও শান্তির পথিকৃৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম যে ভূমিস্বত্ব ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল তা আজও
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিধান। মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কোন কিছু দিক
দিকেই এর সমকক্ষ ও সমতূল্য কোন বিধানই আজকের পৃথিবীর নেই।
আটঃ উত্তরাধিকার ব্যবস্থার যৌক্তিক রূপদান
o
ইসলাম পূর্ব সময়েঃ
-
পুরুষানুক্রমে পরিবারের
জ্যেষ্ঠ পুত্র সন্তানই সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির উত্তরাধিকারত্ব লাভ করতো। বঞ্চিত হতো
পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।
-
সমাজে যৌথ পরিবার প্রথা
চালু ছিল। এ প্রথার মূল বক্তব্য হচ্ছে সম্পত্তি গোটা পরিবারের হাতেই থাকবে।
পরিবারের বাইরে তা যাবে না।
-
পরিবার প্রথার ফলে মেয়ারা
বিয়ের পর পিতার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হতো। সম্পত্তির কর্তৃত্ব বা ব্যবস্থাপনার ভার
জ্যেষ্ঠ পুত্রসন্তানের হাতেই ন্যস্ত থাকত।
-
এই দুটি নীতিই হিন্দু, খ্রীষ্টান
ও ইহুদী ধর্মে অনুসৃত হয়ে আসছিল যুগ যুগ ধরে। সম্পত্তি যেন বিভক্ত না হয় তার প্রতি
সব ধর্মের ছিল তীক্ষ্ম নজর। কারণ সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে গেলে পুঁজির পাহাড়
গড়ে উঠবে না, গড়ে উঠবে না বিশেষ একটি ধনিক শ্রেণী যারা
অর্থবলেই সমাজের প্রভুত্ব লাভ করে। এরাই নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে অত্যাচার,
অবিচার, অনাচার ও নানা ধরণের সমাজবিরোধী কাজে
লিপ্ত হয়ে থাকে।
o
উত্তরাধীকারিত্বের
ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অধিকারের স্বীকৃত প্রদান ও প্রতিষ্ঠা ছিল রাসূল
সা. এর অন্যন্য অবদান।
-
কুরআনে সূরা আন নিসার
দুটি দীর্ঘ আয়াতে সম্পত্তির ওয়ারিশ বা উত্তরাধীকারিনী হিসেবে নারীদের অংশ
নির্দিষ্ট করে দিলেন।
-
ইসলামই প্রথম পৃথিবীতে
মাতা, ভগ্নি স্ত্রী ও কন্যা হিসেবে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ও অংশ স্বীকৃত ও
প্রতিষ্ঠিত হলো।
-
ইসলামের এ বিধান ছিল
সম্পত্তির এককেন্দ্রীকরণ বা পুঞ্জিভূতকরণ নিরোধের এক মোক্ষম ব্যবস্থা।
-
ইসলাম মানুষের
খেয়াল-খুশীর উপর সম্পত্তির উত্তরাধিকারত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়নি।
-
ইসলাম নারীকে দুই দিক দিয়ে
সম্পত্তিতে অংশীদারত্ব প্রদান করা হয়েছে। প্রথমত : পিতার দিক হতে, দ্বিতীয়ত: স্বামীর দিক হতে।
-
ইসলামে স্ত্রী তার
দেনমোহরও পাবে।
-
ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর
বিচ্ছেদে ইদ্দৎ পালনের সময়ে ভরণ-পোষণের ব্যয়ভার বহন করতে নির্দেশ দিয়েছে
স্বামীকেই।
-
ইসলাম স্বামী মারা গেলে
তখনও তারই বাড়ীতে নূন্যতম এক বছর স্ত্রীর বসাবাসের হক রয়েছে, যদি তার মধ্যে স্ত্রী পুনরায় বিবাহ না
করে। ঐ সময়ের খরচও স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পত্তিই হতেই বহন করা হবে।
o
পুঁজিবাদী সামাজে উইল করে
কোন বিত্তশালী মানুষ যেকোন কাজে তার সমুদয় সম্পত্তি দান করে যেতে পারে।
-
এর সুযোগ নিয়ে মানুষ
মৃত্যুর পূর্বে তার সর্বস্ব দান করে যায় ইচ্ছামতো যে কাউকে, ক্ষেত্রবিশেষ
কুকুর, বিড়াল বা পাখীর জন্য। এর পরিমাণ লক্ষ লক্ষ ডলার হয়ে
থাকে।
-
এমনও নজীর রয়েছে যে
একাদিকে পুত্র-কন্যা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে পথে পথে ঘোরে, অপরদিকে
কুকুর-বিড়ালের জন্যে সম্পত্তি উইল করে যায়।
o
ইসলামে অসিয়ত করর
ব্যাপারে ও রাসূল সা. এর দিক নির্দেশনা রয়েছেঃ
-
কোন ব্যক্তি অসিয়ত করতে
পারে তার সম্পত্তির সর্বোচ্চ এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত, তার বেশী
নয়।
-
করলেও তা ইসলামী আইনে
সিদ্ধ হবে না।
-
এই অসিয়তও কার্যকর হবে
মৃতের যদি কোন ঋণ বা কর্জ ও কাফফারা থেকে তবে তা পরিশোধের পর।
নয়ঃ ন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিধান
o
ইসলামী জীবন ব্যবস্থার
অন্যতম উদ্দেশ্যে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা।
-
অন্যসব অর্থনৈতিক
বিবেচনাকে সামাজিক সুবিচার ও মূলনীতির আলোকেই বিচার-বিশ্লেষণ ও গ্রহণ করতে হবে।
-
সামাজিক ও অর্থনৈতিক
সুবিচার ব্যহত হতে পারে এমন কোন অর্থনৈতিক নিয়ম বা নীতি কার্যকর করতে বা থাকতে
দেওয়া কিছুতেই সঙ্গত হতে পারে না।
-
এই উদ্দেশ্যেই অর্থনৈতিক
ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রেকে অবশ্যই মারুফ বা সুনীতির প্রতিষ্ঠা এবং মুনকার বা
দুর্নীতির প্রতিরোধ করতে হবে।
-
অর্থনীতিতে সুনীতি
প্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে সমস্ত উপায়ে সুবিচারমূলক অর্থনীতি গড়ে তোলে। আর দুর্নীতি
প্রতিরোধের অর্থ হচ্ছে সব ধরণের অর্থনৈতিক জুলুম ও শোষণের পথ বন্ধ করা।
o
সুবিচার প্রতিষ্ঠা ও
জুলুমের অবসানের জন্যে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় সব আইন রচনা করতে পারে।
-
এজন্যে প্রয়োজনীয় আইনগত
ক্ষমতা আল্লাহ তাআলা আল কুরাআনেই প্রদান করেছেন।
-
ইসলামী সরকার আইন প্রয়োগ
করে অবৈধ উপার্জণের সমস্ত পথ বন্ধ করে দিতে পারে, পারে সব
ধরনের অনাচারের উচ্ছেদ করতে।
-
এই উপায়েই রাষ্ট্র সুদ, ঘুষ,
মুনাফাখোরী, মজুতদারী, চোরাচালান,কালোবাজারী, পরদ্রব্য আত্মসাৎ, সব ধরনের জুয়া, হারাম সামগ্রীর উৎপাদন ও
ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রচলিত সব ধরনের অসাধুতা সমূলে উৎপাদন করতে পারে।
-
রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপেই
মাধ্যমেই যাকাত আদায় ও বিলি-বন্টন, বায়তুল মালের সংগঠন ও
ব্যবস্থাপনা, উত্তরাধিকা বা মীরাসী আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন,
ইসলামী শ্রমনীতির রূপদান প্রভৃতি অর্থনৈতিক কার্যক্রম গ্রহণ সম্ভব।
o
রাসূলুল্লাহ সা. যখন
মদীনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তখন তাঁর সামনে কোন
মডেল ছিল না।
-
আল্লাহ তাঁকে মডেল তৈরীতে সাহায্য করলেন জীবরীল
এর মাধ্যমে নির্দেশ পাঠিয়ে।
-
সেই আলোকে তিনি গড়ে
তুললেন নতুন এক সমাজ কাঠামো, অর্থনীতি ছিল যার অবিচ্ছেদ্য
অনুষঙ্গ।
-
তিনি ঠিক করে দিলেন
অর্থনীতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে অবশ্যই নজরদারী করতে হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে কঠোর
নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। আবার প্রয়োজন পূর্ণ সহযোগিতা নিয়েও এগিয়ে আসতে হবে।
o
অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের
মধ্যে এমন কতগুলি বিষয় রয়েছে যা ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া উত্তম, কিন্তু
তার লাগাম রাষ্ট্রের হাতে থাকাই বাঞ্চনীয়।
-
যেমন উৎপাদন, বন্টন ও
বিনিয়োগ। এগুলির যথাযথ তত্ত্বাবধান না হলে সমাজে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে,
মুষ্টিমেয় লোকেই সকল সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে।
ফলে সাধারণ মানুষের দুর্গতির অন্ত রইবে না।
-
মূলত : এই দৃষ্টিকোণ হতেই
মানবতার অকৃতিম দরদী মুহাম্মাদ সা. উৎপাদের পাশাপাশি তা থেকে গরীবদের হক আদায়ের
নির্দেশ দিয়েছেন, ইয়াতীমদের যত্ন নিতে বলেছেন।
-
তিনি ব্যবসায়ীদের
নিয়ন্ত্রণের জন্যে পৃথক দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কৃষি জমি
অনাবদী ফেলে রাখার বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন।
o
আলোচ্য প্রসঙ্গে যে বিশেষ
ক্ষেত্রেগুলিতে রাসূল সা. হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন তার কারণ ও
ফলাফল পর্যালোচনা করা দরকার। সেগুলি হচ্ছে-
১। উপার্জন
২। কৃষি
৩। শিল্প ও শ্রমিক এবং
৪। ব্যবসা-বাণিজ্য
-
উপার্জনঃ
·
ইসলামী রাষ্ট্র অবশ্যই
ব্যক্তির উপার্জনের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখবে।
·
উপার্জনের পথ ও পদ্ধতি
হালাল বা বৈধ হতে হবে।
·
অবৈধ উপায়ে অর্জিত সমস্ত
সম্পদ ইসলামী সরকার বাজেয়াপ্ত করে নেবে। কেননা সব অবৈধ পন্থাই হচ্ছে হারাম বা
মুনকার এবং মুনকার নির্মূল করা ইসলামী সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
·
সরকার সুদ, ঘুষ,
জুয়া,কালোবাজারী, মজুতদারী,
চোরাকারবারী ইত্যাদি সকল হারাম উপায়ে উপার্জনের পথ রুদ্ধ করে দেবে। সরকার
এজন্যে আইনের কঠোর ও ত্বরিৎ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
·
অপরদিকে যদি অন্যের জমি, সম্পত্তি
বা অর্থে কেউ জোর-জবরদস্তিমূলকভাবে আত্মসাৎ করে থাকে তবে তা উদ্ধার করে প্রকৃত
মালিককে ফিরিয়ে দেবে। তা সম্ভব না হলে ঐ ধন-সম্পদ বায়তুলমালে জমা হবে। এমনকি কোন
শাসনকর্তা বা সরকারী কর্মচারী পদের সুযোগ নিয়ে বিত্ত-সম্পত্তি করলে তাও সরকার
বাজেয়াপ্ত করতে পারেন। যদি এ কাজ না করা হয়, তবে সমাজে
দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার অব্যাহত থাকবে। পরিণামে তা রাষ্ট্র ও সমাজের অকল্যাণ
ও মারাত্মক দুর্গতি ডেকে আনবে।
-
কৃষিঃ
·
কৃষির স্বার্থে
বর্গাচাষের শর্ত ও পদ্ধতির কারণে কৃষক যেন অত্যাচারিত না হয় সে বিষয়ে রাসূল সা.
সবিশেষ সতর্ক থাকতে বলেছেন।
·
উপরন্তু জমি যেন অনাবাদী
ও পতিত পড়ে না থাকে সে ব্যবস্থা করা সকরকারেই দায়িত্ব।
·
জমির উৎপাদন ক্ষমতা, পরিমাণ ও
গুণাগুণের ভিত্তিতে খারাজ নির্ধারণ করা হবে।
·
ট্যাক্স জনগণের জন্যে
দুর্বিষহ ভারের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে কিনা তাও যাচাই করে দেখতে হবে সরকারকেই।
·
কৃষির প্রয়োজনীয় উপকরণ
সংগ্রহ করতে কৃষককে সাহায্য করা দরকার।
·
কৃষিপণ্যের বাজার, মূল্য ও
সরবরাহের উপরও সরকারের নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে তেমনি কৃষকও তার উৎপাদিত পণ্যের
ন্যায়সঙ্গত দাম হতে বঞ্চিত হবে। তাছাড়া মূল্য বেড়ে গিয়ে জনগণের ও অসুবিধা সৃষ্টি
করতে পারে।
·
সরকারের অপর অন্যতম
দায়িত্ব হচ্ছে মীরাস বা উত্তরাধিকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা লক্ষ্য করা।
·
বিশেষত :ইয়াতীম ও
স্ত্রীলোক এই বিধানের সুফল পাচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। বর্তমানে সমাজে
ন্যায্য প্রাপ্য হতে ওয়ারিশরা প্রায়ই বঞ্চিত হয়। সৎভাই-বোনেরা বিতাড়িত হয়। এর কারণ
মীরাসী আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাব। এ ব্যাপারে সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে।
পক্ষপাতহীন শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই এই দুর্নীতি দমনে করা সম্ভব। অসিয়ত ও
ওয়াকফকৃত জমি যেন সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে সরকারকেই।
-
শ্রমিকঃ
·
রাসূল সা. এর নির্দেশের
প্রেক্ষিতে একথা বুঝতে বাকী থাকার কথা নয় যে, ইসলামী সরকারের
দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় নিশ্চিত করা। তাদের উপর
যাতে জুলুম না হতে পারে তার যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
·
শ্রমিকদের মজুরী যেন
তাদের জীবন-যাপনের জন্যে উপযুক্ত হয় তা দেখাও সরকারে দায়িত্ব। শ্রমিকদের জন্য
সরকার একটা নিন্মতম মজুরী নির্ধারণ করে দেবে।
·
শিল্পমালিকেরা এই মজুরী
দিতে বাধ্য থাকবে। বাস্তবতার আলোকেই সরকার শ্রমিকদের অন্যান্য সুবিধা দানের
ব্যবস্থা সম্বলিত আইন প্রণয়ন করবে।
·
শ্রমিকদের নায্য অধিকার
সংরক্ষণ, বাসস্থান, চিকিৎসা,
বোনাস ইত্যাদির সুবিধাও এই আইনে থাকবে। এসব আইনের উদ্দেশ্যে হবে
শ্রমিকদের সত্যিকার স্বার্থ রক্ষা করা।
-
ব্যবসা-বাণিজ্যঃ
·
ব্যবসায়ের সব অবৈধ ও
অন্যায় পথ এবং প্রতারণামূলক কাজ নিষিদ্ধ করাই শুধু ইসলামী সরকারের দায়িত্ব নয় বরং
তা যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তাও দেখা কর্তব্য।
·
ইহতিকার অর্থাৎ অধিক
লাভের আশায় পণ্য মজুদ রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। ওজনে
কারচুপিও তাই। এ সমস্তই প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। না হলে জনসাধারণ ক্রমাগত ঠকতে
থাকবে। এর প্রতিবিধানের জন্যে হিসবাহ নামে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান কায়েম
হয়েছিল। এ থেকেই উপলব্ধি করা যায় সমাজকে তথা মানব চরিত্রকে কত গভীলভাবে রাসূলে
করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
·
রাসূল সা. মাঝে মাঝে
বাজার পরিদর্শনে যেতেন। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়ে দোকানদারদের কার্যক্রম লক্ষ্য
করতেন। এ থেকেই বোঝা যায় বাজার ব্যবস্থার উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সরকারের
দায়িত্ব ও কর্তব্যও বটে।
·
পরবর্তীকালে আমীরুল
মুমিনীন উমর (রা) একাজ করতেন। এর উদ্দেশ্যে হচ্ছে বাজার যেন স্বাভাবিক নিয়মে চলে।
·
মজুতদারী, মুনাফাখারী, ওজনে কারচুপি, ভেজাল দেওয়া, নকল করা প্রভৃতি বাজারে অনুপ্রবেশের
সুযোগ না পায়। পন্যসামগ্রীর অভ্যন্তরীণ চলাচলের উপর বিধি-নিষেধও সম্ভবপর ক্ষেত্রে
সম্পূর্ণ তুলে নিতে হবে। কারণ, খাদ্যদ্রব্য ও প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর অবাধ চলাচলের উপর
বাধা-নিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলেই কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হয় ও দুর্নীতির পথ
প্রশস্ত হয়। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণ ও দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক করার জন্যে সরকারকে সুষ্ঠু
ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দশঃ সামাজিক কল্যাণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার
প্রবর্তন
o যে কোন উত্তম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিচায়ক হচ্ছে তার
সামাজিক কল্যাণ ও নিরাপত্তার জন্যে গৃহীত ব্যবস্থা।
-
প্রচলিত সমস্ত অর্থনৈতিক
ও রাজনৈতিক মতাদর্শে এজন্যেই সমাজকল্যাণের কথা বলা হয়ে থাকে।
-
কিন্তু সে সবের কোনটিই
ইসলামের সমকক্ষ নয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলামেই জনকল্যাণের জন্যে সর্বপ্রথম সর্বাত্মক জোর
ও সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
-
এ ব্যাপারে শুধু
আল-কুরআনে ও হাদীস শরীফে যে নির্দেশ রয়েছে তার যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলে গোটা
সমাজব্যবস্থায় এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হওয়া সম্ভবপর।
-
নির্বাচিত প্রতিনিধিরা
আপন আপন মর্জি-মাফিক যতটুকু করতে ইচ্ছুক ততটুকুই মাত্র জনসাধারণ পেতে পারে।
-
অন্যদিকে সমাজতন্ত্রে
একদলীয় সরকারের নিজস্ব নীতি ও প্রয়োজন অনুসারে জনকল্যাণমূলক নীতি গৃহীত হয়ে থাকে।
এর কোনটিই পূর্ণাংগ ও সুষ্ঠ হতে পারে না।
o জনকল্যাণের জন্যে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য ছাড়াও ব্যক্তির দায়িত্ব
ও কর্তব্য রয়েছে।
-
ব্যক্তিকেও নিজস্ব সামর্থ
ও যোগ্যতা অনুযায়ী এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তির ধন-সম্পত্তিতে অন্যেরও হক বা অধিকার
রয়েছে। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে- وَآَتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ
وَابْنَ السَّبِيلِ তুমি আত্মীয় স্বজন ও গরীব এবং পথের কাঙালগণকে তাদের পাওনা
দিয়ে দাও। (সূরা
বনি ইসরাইল : ২৬ আয়াত)
-
রাসূল সা. বলেছেন- তোমাদের
ধন সম্পদে যাকাত ছাড়াও দরিদ্রদের অধিকার রয়েছে। (তিরমিযী)
-
উপরের আয়াত ও হাদিস
দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে,
·
কোন ব্যক্তির উপার্জিত
অর্থে তার নিজের ছাড়াও আত্মীয়-স্বজন ও সমাজের অন্যান্য অভাবগ্রস্তদের অধিকার
রয়েছে।
·
কোন ব্যক্তি যদি
প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী হয় এবং তার আত্মীয়দের মধ্যে কেউ প্রয়োজনের
চেয়ে কম উপার্জন করে তাহলে সামর্থ্য অনুযায়ী ঐ আত্মীয়কে সাহায্য করা তার সামাজিক
দায়িত্ব।
·
আত্মীয়দের মধ্যে কেউ এমন
না থাকলে প্রতিবেশী বা পরিচিতদের মধ্যে অভাবগ্রস্ত বা প্রয়োজন পূরণে অক্ষম
ব্যক্তিকে সাহায্য করা ঐ ব্যক্তির পক্ষে অবশ্য কর্তব্য।
·
এমন ব্যাপকভাবে প্রতিটি
ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নির্দেশ পৃথিবীর আর কোন ধর্মে বা মতাদর্শে ইসলামের
পূর্বেও দেওয়া হয়নি, পরেও
না।
·
বস্তুত: এই নির্দেশের
মধ্যে পারষ্পরিক সাহায্য, সহযোগিতা
ও সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধনের দায়িত্ব অনুভূতির প্রেরণা রয়েছে।
o জনকল্যাণমূলক কাজের উদ্দেশ্যে ও সমাজের সাধারণ মানুষের
আর্থিক নিরাপত্তা বিধানের জন্যে রাসূল সা. দুটি বলিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেনঃ
১. যাকাত।
২. বায়তুলমাল।
-
যাকাত কারা দেবে, কিভাবে
তা আদায় হবে এবং কারা যাকাতের হকদার সে সম্পর্কে ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে।
-
বায়তুল মাল সৃষ্টির
উদ্দেশ্য, এর অর্থের উৎস ও ব্যয়ের খাত প্রভৃতি
সম্বন্ধেও বলা হয়েছে।
-
ইসলামী সমাজে বায়তুলমাল ও
যাকাত একযোগে যে বিপুল সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ করতে পারে এবং দু:স্থ, দারিদ্রপীড়িত,
অক্ষম, বৃদ্ধ, পঙ্গু,
বিধবা ও ইয়াতীম শিশুদের যে আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারে তা আর
কোনভাবেই সম্ভব নয়।
-
ইসলাম পূর্ব যুগের কোন
সমাজে তা ছিল না, এখনও নেই।
o রাষ্ট্রীয় প্রশাসন লোক ঢোকানোর জন্যে সমস্যার সাময়িক উপশম
করতে পারে বটে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণ সাধন হয় না।
o স্বেচ্ছায় মানুষ যখন কোন কাজে সাড়া দেয় এবং অংশ গ্রহণ করে
তখন যে দুর্বার শক্তির সৃষ্টি হয় তার মুখে কোন বাধাই যেমন বাধা নয়, তেমনি
কোন কাজই কঠিন নয়।
o যাকাত ও বায়তুলমাল ছাড়াও মীরাসী আইনের প্রয়োগ, মানবিক
শ্রমনীতির প্রবর্তন, সম্পত্তিতে নারীরা অধিকারের প্রতিষ্ঠা,
করযে হাসানার বিধান এবং উপার্জন ভোগ-বন্টন প্রভৃতি ক্ষেত্রে হালাল-হারামের
পার্থক্য নির্দেশ একদিকে বহু সামাজিক অনাচারের পথ যেমন চিরতরে রুদ্ধ করে দিয়েছে,
অন্যদিকে তেমনি মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ ও জনসাধারণের দীর্ঘ মেয়াদী
কল্যাণ ও উন্নয়নের পথ সুগম করেছে।
o বস্তুত : উপরোক্ত বিষয়গুলির সমষ্টিফলই হচ্ছে একটি সুখী, অভাবমুক্ত
ও সমৃদ্ধশালী সমাজ।
o আইয়ামে জাহেলিয়াত ও তার পূর্ববর্তী সমাজ ব্যবস্থাসমূহ হতে
ক্রমে ক্রমে যে পংকিলতা ও অনাচার অর্থনীতিতে সংক্রমিত হয়েছিল সেসব দূর করার জন্যেই
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশিত পথে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম কাজ করে গেছেন।
o তাঁর সে পথ অনুসরণ করেছেন মহান খুলাফায়ে রাশেদীন (রা)। ফলে
অর্থনীতিতে সূচিত হয়েছিল বিপ্লব।
o প্রয়োগ ও সাফল্যে সৃষ্টি হয়েছিল উন্নয়নের গতিবেগ।
o তারই সুদূরপ্রসারী ফল হিসেবে এক সুখী ও সমৃদ্ধশালী, সাহিত্য-শিল্পকলা
ও বিজ্ঞানে উন্নত সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল।
উপরের আলোচনা হতে একথা
পরিস্কার হয়ে গেছে যে মানবতার বন্ধু, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী এবং সফলতম
সমাজ সংস্কারক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র দশ বছরের
প্রচেষ্টায় সমকালীন অর্থনীতিতে এমন পরিবর্তন এনেছিলেন যা ছিল এক কথায় অনন্য। তিনি
অর্থনীতিতে এমন পরিবর্তন এনেছিলেন যা ছিল অশ্রুতপূর্ব। এই কর্মসূচীর মাধ্যমেই
মাধ্যমেই তিনি একদিকে অত্যাচার ও শোষণের পথ রুদ্ধ করেছিলেন। দাসভিত্তিক অর্থনীতির
মূলে তিনি কুঠারাঘাত করেছেন, বিলাসিতা ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবন উৎখাত করেছেন, অবৈধ পথে উপার্জনের মাধ্যমে বিপুল
বিত্তের মালিক হয়ে সাধারণ লোকের উপর ছড়ি ঘোরাবার পথ রুদ্ধ করেছেন, সুদের মত ঘৃণ্য প্রথার মাধ্যমে জোঁকের
মত সমাজদেহ হতে জীবনীশকক্তি শুষে নেবার পথ ধ্বংস করেছেন। এরই পাশাপাশি যাকাত
ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, প্রচলিত
কৃষি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার, বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিটি নাগরিকের আর্থিক নিরাপত্তা
ও কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধান করে আপামর জনসাধারণের জীবনে যে স্বস্তি ও নিরাপত্তা
বিধান করেছেন সমকালীন বিশ্ব ইতিহাসে তার তূল্য কোন নজীর নেই।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবী মুসা (আ) আল্লাহর সংগে তুর পাহাড়ে
সাক্ষাৎ করতে গেলে তাঁর কাছ থেকে দশ দফা নির্দেশ পেয়েছিলেন। খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ
বাইবেলে এই দশ দফা নির্দেশ বা Ten Commandments এর উল্লেখ রয়েছে। এরপর দীর্ঘ সময়
পরিক্রমায় নানা জনে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ-প্রভৃতি ক্ষেত্রে নানা ধরণের কর্মসূচী দিয়েছেন, সমাজ জীবনে কোন না কোন দিকের সংস্কার
বা উন্নয়নের জন্য দিয়েছেন নানা দফা বা দিক নির্দেশনামূলক প্রস্তাব। পৃথিবীর বহু
রাজনীতিবীদ, সমাজ
সংস্কারক, অর্থনীতিবিদ
তাদের প্রস্তাবিত দফার সাফল্য জীবদ্দশায় দেখে যাওয়া দুরে থাক সেসবের বাস্তবায়ন
পর্যন্ত করে যেতে পারেননি। কিন্তু আল্লাহর হাবীব ছিলেন পৃথিবীর সকল কালের সকল
মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সফল রাষ্ট্রনেতাও সমাজ সংস্কারক। তিনি যে দশ দফা
কর্মসূচীর ঘোষণা দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়নও করে দেখিয়েছেন। এখানেই তাঁর সবচেয়ে বড়
কৃতিত্ব, তাঁর
অসাধারণ সাফল্য।
বিশ্বের বঞ্চিত নির্যাতিত
মানুষ তাঁর গৃহীত অর্থনৈতিক কর্মসূচীর মাধ্যমে যে শোষণমুক্ত নবজীবন লাভ করেছিল, have nots আর have দের যের দূরতিক্রম্য
ব্যবধান অপসারিত হয়েছিল, রাষ্ট্রেরই
পক্ষপুটে অসহায়দের আশ্রয়ের যে অভাবিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল পৃথিবীর আর কোন
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতেই তার কোন নজীর নেই। পরিতাপের বিষয় আজকের মুসলমান আত্মভোলা, নিজেদের ইতিহাস বিস্মৃত। সে বিজাতীয়
জীবনাদর্শ ও কর্মকৌশল আকঁড়ে ধরে ভুল পথে উন্নতি লাভের চেষ্টা করছে। ফলে না তার
ইহজাগতিক উন্নতি হচ্ছে, না তার
আখিরাতের জীবনের কল্যাণ হচ্ছে। এই অবস্থা হতে পরিমাণ পেতে হলে নিজেদের স্বকীয়তা
নিয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে, সামনে এগুবার জন্যে সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। রাসূলের
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দশ দফা অর্থনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমেই
তার পক্ষে সম্ভব ইহজাগতিক কল্যাণ একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
প্রদশিত জীবন ব্যবস্তা অনুসরণেই তার মুক্তি এই বোধ-বিশ্বাসে তাকে উজ্জীবিত হতে
হবে। তবেই ইহকালীন সাফল্যের সাথে নিশ্চিত হবে তার পারলৌকিক মুক্তি।
— সমাপ্ত—
0 Comments