দারসুল কুরআন – সূরা আত তাওবাহ – আয়াত ১৭-২৪ – মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম


দয়া করে কুরআনের আয়াত সমূহ মূল কুরআনের সাথে মিলিয়ে পড়ুন। ফন্ট সংক্রান্ত সমস্যার কারণে আয়াত সমূহের শব্দাবলী আগপিছ হওয়ার আশংকা রয়েছে।

তেলাওয়াতঃ

﴿مَا كَانَ لِلْمُشْرِكِينَ أَن يَعْمُرُوا مَسَاجِدَ اللَّهِ شَاهِدِينَ عَلَىٰ أَنفُسِهِم بِالْكُفْرِ ۚ أُولَٰئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ وَفِي النَّارِ هُمْ خَالِدُونَ﴾

১৭ মুশরিক যখন নিজেরাই নিজেদের কুফরীর সাক্ষ্য দিচ্ছে তখন আল্লাহর মসজিদসমূহের রক্ষণাবেক্ষণকারী ও খাদেম হওয়া তাদের কাজ নয় তাদের সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে গেছে এবং তাদেরকে চিরকাল জাহান্নামে থাকতে হবে  

﴿إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ ۖ فَعَسَىٰ أُولَٰئِكَ أَن يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ﴾

১৮ তারাই হতে পারে আল্লাহর মসজিদ আবাদকারী (রক্ষণাবেক্ষণকারী ও সেবক) যারা আল্লাহর ও পরকালকে মানেনামায কায়েম করেযাকাত দেয় এবং আল্লাহ কে ছাড়া আর কাউকে ভয় করেনা তাদেরই ব্যাপারে আশা করা যেতে পারে যেতারা সঠিক সোজা পথে চলবে

﴿أَجَعَلْتُمْ سِقَايَةَ الْحَاجِّ وَعِمَارَةَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ كَمَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَجَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۚ لَا يَسْتَوُونَ عِندَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾

১৯ তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো এবং মসজিদে হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করাকে এমন ব্যক্তিদের কাজের সমান মনে করে নিয়েছ যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি এবং সংগ্রাম-সাধনা করেছে আল্লাহর পথে? উভয় দল আল্লাহর কাছে সমান নয়।

﴿الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِندَ اللَّهِ ۚ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ﴾

২০ এ উভয় দল আল্লাহর কাছে সমান নয় আল্লাহ জালেমদের পথ দেখান না আল্লাহর কাছে তো তারাই উচ্চ মর্যাদার অধিকারীযারা ঈমান এনেছে এবং তার পথে ঘর-বাড়ি ছেড়েছে ও ধন-প্রাণ সমর্পন করে জিহাদ করেছে তারাই সফলকাম

﴿يُبَشِّرُهُمْ رَبُّهُم بِرَحْمَةٍ مِّنْهُ وَرِضْوَانٍ وَجَنَّاتٍ لَّهُمْ فِيهَا نَعِيمٌ مُّقِيمٌ﴾

২১ তাদের রব তাদেরকে নিজের রহমতসন্তোষ ও এমন জান্নাতের সুখবর দেনযেখানে তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী সুখের সামগ্রী

﴿خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۚ إِنَّ اللَّهَ عِندَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ﴾

২২ সেখানে তারা চিরকাল থাকবে অবশ্যি আল্লাহর কাছে কাজের প্রতিদান দেবার জন্য অনেক কিছুই রয়েছে

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا آبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنِ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الْإِيمَانِ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ﴾

২৩ যে ঈমানদারগণ! তোমাদের বাপ ও ভাইয়েরা যদি ঈমানের ওপর কুফরীকে প্রাধান্য দেয় তাহলে তাদেরকেও নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে তারাই জালেম

﴿قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ﴾

২৪ হে নবী! বলে দাওযদি তোমাদের পিতাতোমাদের সন্তান ও তোমাদের ভাই তোমাদের স্ত্রী,তোমাদের আত্মীয়-স্বজনতোমাদের উপার্জিত সম্পদতোমাদের যে ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাক এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ কর-এসব যদি আল্লাহ ও তার রসূল এবং তার পথে জিহাদ করার চাইতে তোমাদের কাছে বেশী প্রিয় হয়তাহলে আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর আল্লাহ ফাসেকদেরকে কখনো সত্য পথের সন্ধান দেন না 

নামকরণঃ

এই সূরার ২টি প্রসিদ্ধ নামঃ

1.   সূরা আত-তাওবাঃ

সূরার একটি স্থানে মুমিনদের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে, এজন্য তাওবা।

﴿ثُمَّ يَتُوبُ اللَّهُ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ عَلَى مَنْ يَشَاءُ﴾

তারপর (তোমরা এও দেখছো) এভাবে শাস্তি দেবার পর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাওবার তাওফীকও দান করেন (আয়াতঃ ২৭)

﴿أَلَم يَعلَموا أَنَّ اللَّـهَ هُوَ يَقبَلُ التَّوبَةَ عَن عِبادِهِ وَيَأخُذُ الصَّدَقاتِ وَأَنَّ اللَّـهَ هُوَ التَّوّابُ الرَّحيمُ﴾

তারা কি জানে না, আল্লাহই তার বান্দাদের তাওবা কবুল করেন, তাদের দান -খয়রাত গ্রহণ করেন এবং আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, ও করুণাময়? (আয়াতঃ ১০৪)

2.  সূরা আল বারায়াতঃ

সূরার শুরুতেই মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষনা দিয়ে সুরা শুরু হয়েছে, এজন্য বারাআত।  بَرَاءَةٌ বারাআত মানে সম্পর্কচ্ছেদ।

﴿بَراءَةٌ مِنَ اللَّـهِ وَرَسولِهِ إِلَى الَّذينَ عاهَدتُم مِنَ المُشرِكينَ﴾

সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষনা করা হলো আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে, যেসব মুশরিকের সাথে তোমরা চুক্তি করেছিলে তাদের সাথে (আয়াতঃ ১)

এই সূরার অন্যান্য নামঃ

-      সূরা ফাতিহার পর সবচেয়ে বেশী নাম সম্পন্ন সূরা এটি।

-      এই সূরার ১০ এর অধিক নাম রয়েছেঃ

1.   السورة الفاضحة (আল ফাদিহাহ) সূরায় মুনাফিকদের পর্দা এবং তাদের কর্মকে উম্মোচন করা হয়েছে, গোপনীয়তা ফাঁস হয়েছেঃ

قُلتُ لِابْنِ عَبَّاسٍ: سُورَةُ التَّوْبَةِ، قالَ: التَّوْبَةُ هي الفَاضِحَةُ، ما زَالَتْ تَنْزِلُ: ومِنْهُمْ... ومِنْهُمْ... حتَّى ظَنُّوا أنَّهَا لَنْ تُبْقِيَ أحَدًا منهمْ إلَّا ذُكِرَ فِيهَا.

2.  سورة العذاب (আল আযাব) সূরায় আযাবের কথা বারবার এসেছে।

3.  السورة المُقشقشة (আল মুকাশকাশাহ) সূরায় মুনাফিকদের কাজ ও গুণাবলীর বর্ণনা করা হয়েছে যে ঐসব গুণ থেকে বেঁচে যাবে, সে মুনাফিকি থেকে মুক্তি পাবে

4.   السورة المنقرة (আল মুনকিরাহ) সূরা মুনাফিক ও মুশরিকদের অন্তরে কি আছে তা অনুসন্ধান করে

5.  سورة البحوث (আল বাহুস) সূরাটি মুনাফিকের অন্তরে কি আছে, তা সার্চ করে।

6.  سورة الحافرة সূরাটি মুনাফিকের অন্তরকে খনন করে অনুসন্ধান করে।

7.  سورة المثيرة (আল মুবাইছিরাহ)সূরাটি মুনাফিকের লজ্জাকে বাড়িয়ে দিয়েছে

8.  سورة المدمدمة আল মুদামদিমা বা ধ্বংসকারী সূরা।

9.  سورة المُخزية  (আল মুখযিয়াহ) যা মুনাফিকদের শাস্তি প্রদান করেছে।

10. لسورة المشردة  (আল মুশাররিদাহ) যার মাধ্যমে মুনাফিকদের একত্রিত করে বিচ্ছিন্ন ও বহিস্কার করা হয়েছে

এই সূরার একটি অন্যতম বৈশিষ্টঃ

§ সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ নেই।

عن ابن عباس رضي الله عنهما، قالسألت علي بن أبي طالب رضي الله عنه لم لم تكتب في براءة بسم الله الرحمن الرحيم، قال: لأن بسم الله الرحمن الرحيم أمان وبراءة نزلت بالسيف.

হযরত আলী রা.কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, সূরা বারায়াত এর শুরুতে কেন বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম লেখা হলো না? উত্তরে তিনি বলেনঃ কেননা, বিসমিল্লাহরি রাহমানির রাহীম শান্তির জন্য কিন্তু সূরা বারায়াত নাযিল হয়েছে তলওয়ারের জন্য-তথা শান্তির জন্য নয়

عن ابن عباس أنه سأل عثمان رضي الله عنهم جميعاً عن سبب قرن الأنفال بالتوبة بدون البسملة في أولها، فكان مما قال: كانت الأنفال من أوائل ما نزل بالمدينة وكانت براءة من آخر القرآن نزولاً، وكانت قصتها شبيهة بقصتها فظننت أنها منها وقبض رسول الله صلى الله عليه وسلم ولم يبين لنا أنها منها، فمن أجل ذلك قرنت بينهما ولم أكتب بينهما سطر بسم الله الرحمن الرحيم

দীর্ঘ হাদীসের শেষে বলা হয়েছেঃ ………আমি এ দু’সূরাকে একত্রে মিলিয়ে দিয়েছি। ’বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ লাইনও (এ দু’ সূরার মধ্যে) লিখিনি

§ ইমাম রাযীর লিখেছেনঃ

নবী সা. নিজে এর শুরুতে বিসমিল্লাহ লিখাননি, বিধায় সাহাবায়ে কিরামও লিখাননি আর পরবর্তীতে এই রীতিকে অনুসরণ করা হয়েছে

§ মুফাস্সিরীনে কিরাম এটাকে কুরআনের বিশুদ্ধতা ও পরিবর্তন না হওয়ার দলীল হিসাবে পেশ করেছেন।

§    هذه السورة الكريمة من أواخر ما نزل على رسول الله صلى الله عليه وسلم

রাসূল সা. এর উপর নাযিলকৃত সর্বশেষ সূরা সমূহের অন্যতম।(ইবনে কাসীর)

নাযিলের সময়-কাল ও সূরা অংশ সমূহঃ

§ এটি আদ্যোপান্ত একটি মাদানী সূরা, যাতে অনেক আহকাম বর্ণনা করা হয়েছে।

§ বিশেষতঃ

o যাকাতের হুকুম এই সুরাতে বর্ণিত হয়েছে।

o আর জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কথা খোলে খোলে বর্ণনা করা হয়েছে।

§ কুরআনে হাকীমের ধারাবাহিকতায় এটি কুরআনের ৯ম সূরা। এতে মোট ১২৯টি আয়াত আর ১৬টি রুকু রয়েছে।

এই সূরার ৩টি ভাষণের সমষ্টিঃ

§ নাযিল ধারাবাহিকতা অনুযায়ী মনে হবে যে, প্রথম ভাষণটি সূরার সবশেষে হওয়া উচিত ছিল

§ কিন্তু বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনায় শেষে নাযিল হওয়া ভাষণ নিয়ে আসা হয়েছে সূরার শুরুতে

§ কুরআনকে কিতাব আঁকারে সাজাবার সময় নবী সা. শেষে নাযিল হওয়া ভাষণকে প্রথমে রাখেন

প্রথম ভাষণঃ

§ শুরু থেকে পঞ্চম রুকুর শেষ পর্যন্ত-নাযিল হয়েছে সব শেষে

§ ৯ম হিজরীর যিলকদ মাস বা তার কাছেকাছি সময়ে।

§ ঠিক তখন, যখন হযরত আবু বকর রা.কে আমীরুল হজ্জ করে সাহাবীরা মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন। 

§ এই ভাষণে এমন কিছু কর্মপদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে, যা সেই সময়ে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে ঘোষনা আসা দরকার। তাই হযরত আলী রা.কে তাদের পিছনে পাঠানো হয়, যাতে তিনি হজ্জের সময়ে আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা প্রতিনিধিদের সমাবেশে তা শুনিয়ে দেন।

§ এই সময় রাসূল সা. তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসছিলেনযখন হজ্জের মওসুম ছিলরাসূল সা. এর ইচ্ছা ছিল হজ্জে গমন করবেনকিন্তু সেই সময়ে মুশরিকরা নিজেদের অভ্যাস মতো উলংগ হয়ে কাবাঘর তাওয়াফ করতোরাসূল সা. বিষয়টি অপছন্দ করতেন বলে আবু বকর রা.কে হজ্জের আমীর করে হজ্জে প্রেরণ করেনযাতে তিনি হজ্জের আহকাম মানুষদের শিখান এবং মুশরিকদের জানিয়ে দেন যে, তারা যেন আগামী বছর হজ্জ করতে না আসে

দ্বিতীয় ভাষণঃ

§ ৬ থেকে ৯ রুকুর শেষ পর্যন্ত

§ নাযিল হয়েছে ৯ম হিজরীর রজব মাসে বা তার কিছু আগে।

§ যখন তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। এখানে মুমিনদের জিহাদের জন্য উদ্বোদ্ধ করা হয়েছে। আর মুনাফিক আর দূর্বল ঈমানদারদেরকে তিরষ্কার করা হয়েছে।

তৃতীয় ভাষণঃ

§ ১০ থেকে শেষ পর্যন্ত

§ নাযিল হয়েছে তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর।

§ যাতে মুনাফিকদের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে।

§ তাবুক যুদ্ধে যারা অংশ নেয়নি, তাদের তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করা হয়েছে।

§ সাচ্ছা ঈমানদার যারা তাবুক যুদ্ধে অংশ নেননি, তাদের তিরস্কার ও ক্ষমা ঘোষনা করা হয়েছে। 

ঐতিহাসিক পটভূমিঃ

§ এই সূরার পটভূমির শুরু হুদায়বিয়ার সন্ধি থেকে। যাকে কুরআনে বলা হয়েছে ফাতহুম মুবিন।

﴿إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحاً مُّبِيْناً﴾

 হে নবী! আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি।” (ফাতহঃ ০১)

§ শত বিপদ আর মুসিতবত মোকাবেলা করে হুদায়বিয়া পর্যন্ত ইসলাম মাত্র ৬ বছরে আরবের এক তৃতীয়াংশ এলাকায় শুধু পৌছেনি, বরং একটি সুসংঘটিত ও সংঘবদ্ধ সমাজের ধর্ম, একটি পূর্ণাঙ্গ সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।

§ হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেল। দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য সৃষ্টি হলো চারদিকে নিরাপদ আর নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশ। এর পরিণতিতে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল মুসলমানরা অর্জন করতে সক্ষম হলোঃ

১. আরব বিজয়।

২. তাবুক অভিযান।

আরব বিজয়ঃ

§ আরব বিজয়ের এই বিষয়টির মধ্যে রয়েছেঃ

ক. মক্কা বিজয়।

খ. হোনাইন।

গ. তাবুক অভিযান।

ঘ. তাবুক পরবর্তী ঘটনা।

ক. মক্কা বিজয়ঃ

§ হোদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত সম্প্রসারণ ও সাংগঠনিক মজবুতি অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর ফলে মাত্র ২ বছরে ইসলামের প্রভাব এত বাড়ে, এর শক্তি এতই পরাক্রান্ত ও প্রতাপশালী হয়ে উঠে যে, পুরাতন জাহেলিয়াত ইসলামের মোকাবেলায় অসহায় আর শক্তিহীন হয়ে পড়ে।

§ অসহায় কুরাইশদের উৎসাহী কিছু লোক পরাজয় আসন্ন দেখে তারা নিজেরাই হুদায়বিয়ার সন্ধি ভংগ করে

§ সন্ধির বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধ করতে তারা চাচ্ছিল।

§ নবী সা. তাদেরকে গুছিয়ে উঠার সুযোগ না দিয়ে সন্ধি ভংগের দায়ে ৮ম হিজরীর রমযান মাসে আকস্মিক মক্কা আক্রমন করে দখল করে নেন। বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় সংঘটিত হয়।

খ. হোনাইনের যুদ্ধঃ

§ মক্কা বিজয়ের পর পুরাতন জাহেলী শক্তি হোনাইনে মরণ কামড় দেয়। বেশ কতিপয় জাহেলিয়াতপন্থী গোত্র তাদের পূর্ণ শক্তির সমাবেশ ঘটায়। আর এর মাধ্যমে তারা মক্কা বিজয়ের সুফল প্রাপ্তি ও পূর্ণতা অর্জনের পথে বাঁধা হয়ে দাড়ায়।

§ মক্কা বিজয়ের পর সারা আরবে শুরু হয়েছিল সংস্কার বিল্পব। আর সেই বিপ্লব ষোলকলায় পূর্ণ হয়ে এগিয়ে চলছিল পূর্ণতার পথে। সেই পূর্ণতার পথে তারা বাঁধার সৃষ্টি করে।

§ কিন্তু তাদের সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। হোনায়নে তাদের পরাজয়ের মাধ্যমে আরবের নেতৃত্ব কারা দেবে সে ভাগ্যের ফায়সালাও হয়ে যায়। ফায়সালা হয়ে যায় যে, আরব বিশ্ব এখন দারুল ইসলাম হিসাবে ঠিকে থাকবে।

§ হোনায়েনের যুদ্ধের ১ বছরের মধ্যে আরবের বেশীর ভাগ লোক ইসলাম গ্রহণ করে। আর যারা ইসলাম কবুল করেনি, তারা বিচ্ছিন্ন ভাবে আরবের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।

§ রোম সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকায় নবী সা. ৩০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী হাজির হন তাবুকের প্রান্তরেরোমীয়রা মুসলমানদের মুখোমুখী হবার সাহস পায়নি, তাই পিছু হঠে। আর এতে করে তাদের যে দূর্বলতা প্রকাশ পায়, তাতে নবী সা. এবং তার দ্বীনের অপ্রতিরোধ্য ও অজেয় ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

§ এর ধারাবাহিকতায় তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সাথে সাথে আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৭০ এর মতো প্রতিনিধি দল মদীনায় আসে । ইসলাম গ্রহণ করে, নবী সা. এর নেতৃত্বের আনুগত্য স্বীকার করে।

§ কুরআনে যে কথাটা বলা হয়েছে এই ভাবেঃ

﴿إِذَا جَاء نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ﴾﴿وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُوْنَ فِيْ دِيْنِ اللَّهِ أَفْوَاجاً﴾

যখন আল্লাহর সাহায্য এসে গেলো ও বিজয় লাভ হলো এবং তুমি দেখলে লোকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করছে।

গ. তাবুক অভিযানঃ

§ তাবুকের এই অভিযান পরিচালিত হয়েছিল রোম সামাজ্যের মোকাবেলায়।

§ রোম সামাজ্যের সাথে সংঘর্ষের শুরু সেই মক্কা বিজয়েরও আগে।

§ হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে প্রাপ্ত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নবী সা. আরবের বিভিন্ন স্থানে দাওয়াতী গ্রুপ পাঠিয়ে ছিলেন। দাওয়াতী গ্রুপের সাথে ছিল নবী সা. এর পক্ষ থেকে দাওয়াতী চিঠি।

§ সিরিয়া সীমান্তবর্তী গোত্র গুলো ছিল বেশীর ভাগ খৃষ্টান এবং রোম সাম্রাজ্যের প্রভাবাধীন।

§ যাতুত তালাহ নামক স্থানে ঐ সব দাওয়াতী গ্রুপের ১৫জন সদস্যকে হত্যা করা হয়। কেবল মাত্র গ্রুপ লিডার কাব বিন উমাইর গিফারী রা. প্রাণে বেঁচে ফিরে আসেন।

§ বুসরার গবর্ণর শুরাহবিল ইবনে আমর, যে ছিল খৃষ্টান ও রোম সম্রাট কাইসারের অনুগততার কাছে নবী সা. এর প্রতিনিধি হারিছ বিন উমাইর রা. দাওয়াত নামা নিয়ে হাজির হলে সে তাকে হত্যা করে।

§ সিরিয়া সীমান্ত মুসলমানদের জন্য নিরাপদ করা, ভবিষ্যতে যাতে লোকেরা মুসলমানদের দূর্বল মনে না করে এবং মুসলমানদের উপর জুলুম ও বাড়াবাড়ি করার সাহস না করে সেই উদ্দেশ্যে ৮ হিজরীর শুরুর দিকে নবী সা. ৩ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী সিরিয়া সীমান্তে পাঠান।

§ মাআন নামক স্থানে পৌছে মুসলমান বাহিনী জানতে পারলো ২টি খবরঃ

1.   শুরাহবীল ইবনে আমর ১ লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে মুসলামদের মোকাবেলা করতে আসছে।

2.  রোমের কাইসার হিমস নামক স্থানে সশরীরে উপস্থিতি। সে তার ভাই থিয়েডরের নেতৃত্বে আরো ১লাখ সৈন্যের বাহিনী রওয়ানা হয়ে গেছে।

§ এসব আতংক জনক খবর পাওয়ার পরও মুসলমানদের ৩ হাজারের বাহিনী কোন পরওয়া না করে সামনে অগ্রসর হয়।

§ মুতা নামক স্থানে শুরাহবিলের বাহিনীর সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। ৩৩ জন কাফের-এর মৃত্যু হয় বনাম ১ জন মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন।

§ মুসলমানরা চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সারা আরব বিশ্ব বিস্ময়ের সাথে দেখলো এত শক্তি সত্ত্বে কাফেররা বিজয়ী হতে পারলো না।

§ এই বিজয়ের প্রভাব যে কাজ করলো তাহলো, সিরিয়া ও তার নিকটবর্তী এলাকার আধা স্বাধীন আরব গোত্র এমনকি ইরাকের নিকটবর্তী এলাকায় বসবাসকারী পারস্য প্রভাবাধীন নজদী গোত্রের লোকেরা পর্যন্ত ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হাজার হাজার লোক ইসলাম গ্রহণ করলো।

§ এই সময় রোম সাম্রাজ্যের আরবীয় সৈন্য দলের একজন সেনাপতি ইসলাম কবুল করেন, যার নাম ছিল ফারওয়া ইবনে আমর আল জুযামীতিনি তার ঈমানের অকাট্য প্রমাণ পেশ করেন, যা দেখে আশপাশের এলাকার লোক হতচকিত হয়ে পড়ে। আর তাহলোঃ

ফারওয়ান ইসলাম গ্রহণের খবর যখন কাইসার শুনলেন, তখন তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসলেন দরবারে। তাকে দুইটি জিনিসের প্রস্তাব দিয়ে একটি গ্রহণের সুযোগ দেয়া হলো।

১. ইসলাম ত্যাগ করো, তাহলে মুক্তি এবং পূর্ব পদে বহাল।

২. মুসলমান থেকো, কিন্তু এর ফলে মৃত্যুদন্ড।

তিনি অত্যন্ত ধীর স্থির ভাবে ইসলামকেই নির্বাচিত করলেন এবং শাহাদাত বরণ করলেন।

§ ফারওয়ানের শাহাদাত কাইসারকে চিন্থায় ফেলে দিল। তিনি তার সাম্রাজ্যের বিরোদ্ধে এক ভয়াবহ হুমকি উপলব্দি করলেন-যা আরবের মাটি থেকে তার সাম্রাজ্যের দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে।

§ পরের বছর কাইসার সিরিয়া সীমান্তে সামরিক প্রস্তুতি শুরু করেন, উদ্দেশ্য মুসলমানদের মুতা যুদ্ধের শাস্তি প্রদান। আর তার অধীনে আরবের বিভিন্ন সরদাররা সৈন্য সমাবেশ ঘটায়।

§ নবী সা. এ খবর পাওয়ার পর দেরী না করে কাইসারের বিশাল শক্তির সাথে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ এহেন পরিস্থিতি সামান্য দূর্বলতা প্রদর্শন মানে এতদিনের মেহনত আর পরিশ্রম বরবাদ হয়ে যাওয়া।

§ তখনকার পরিস্থিতিটা ছিল এমন, যদি সামান্য দূর্বলতা দেখা যায়, তাহলে-

1.   হোনায়েনে আরবের ক্ষয় হওয়ার পথে ও চরম মুমুর্ষ অবস্থার জাহেলিয়াতের বুকে যে শেষ আঘাত আনা হয়েছিল, তারা আবার মাথা ছাড়া দিয়ে উঠবে।

2.  মদীনায় মুনাফেকরা তলে তলে গাস্সানের খৃষ্টান বাদশা আর কাইসারের সাথে গোপন যোগাযোগ করে, আর তাদের দূষ্কর্মের অফিস হিসাবে মসজিদে দ্বিরারনির্মাণ করেছিল, তারা মুসলমানদের পিঠে ছুরি বসিয়ে দিন।

3.  সামনে কাইসারের আক্রমণ। যে ইরানীদের পরাজিত করার মাধ্যমে দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছিল অত্যন্ত প্রতাপশালী।

§ এসব কারণে বর্তমান পর্যন্ত বিজয়ী ইসলাম আকস্মাত পরাজিত হয়ে যেতে পারতো। বিধায় নবী সা এটাকে সত্যের দাওয়াতের জন্য জীবন-মৃত্যুর ফায়সালা কার সময় মনে করে প্রস্তুতির সাধারণ ঘোষনা দিলেন

§ তখনকার সময়ে সমস্যা যা ছিলঃ

১. চরম দূর্ভিক্ষ

২. আবহাওয়া প্রচন্ড গরম।

৩. ফসল পাকার সময় কাছে।

৪. সওয়ারী ও সাজ-সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা ছিল কঠিন।

৫. অর্থের অভাব ছিল প্রকট।

৬. দুনিয়ার দুইটি বৃহৎ পরাশক্তির মোকাবেলা।

§ নবী সা. এর যুদ্ধ যাত্রার নিয়ম ছিলঃ

o  কোথায় যাবেন তা কাউকে বলতেন না,

o  কার সাথে মোকাবেলা করতে হবে, তা কাউকে জানাতেন না।

o  যেখানে যাবার কথা সেই পথে না গিয়ে বাঁকা পথে যেতেন।

কিন্তু এই অভিযানে তিনি কোন গোপনীয়তা অবলম্বন না করে পরিষ্কার বলে দিলেন যে, রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, যেতে হবে সিরিয়ার দিকে।

§ সেই সময়কার পরিস্থিতির নাজুকতা-যা সবাই অনুভব করছিল। যেমনঃ

1.   মুশরিকঃ প্রাচীন জাহেলিয়াত প্রেমিকরা যারা তখনো বেঁচে ছিল, তাদের জন্য এটা ছিল আশার আলো। তারা ইসলাম আর  রোম সংঘাত কোন দিকে যায় তার দিকে অধীর আগ্রহে দৃষ্টি নিবন্ধ করে রেখেছিল।

2.  মুনাফিকঃ মুনাফেকরা এর পিছনে সকল প্রচেষ্টা নিয়োজিত করে, মসজিদে দ্বিরার বানায়, আর অপেক্ষা করে সিরিয়াতে মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয় হইবা মাত্র দেশের ভিতর গোমরাহী আর অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দেবে। এজন্য এই অভিযান ব্যর্থ করার জন্য সম্ভাব্য সকল কৌশল তারা গ্রহণ করলো।

3.  মুসলমানঃ মুসলমানেরা অনুভব করছিলেন যে, ২২বছর থেকে তারা যে প্রাণান্তকর সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন, এখন তার চড়ান্ত ফায়সালার সময়। সাহস দেখাতে পারলে সারা দুনিয়ার জন্য এ আন্দোলনের দোয়ার খোলে যাবে, আর না পারলে খোদ আরব দেশেই পাততাড়ি গুটাতে হবে

§ মুসলমানরা পরিস্থিতি অনুভব করে চরম উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আর্থিক ভাবে সবাই সর্বোচ্চ ত্যাগ প্রদর্শণ করেন।

§ আবু বকর, উমর, উসমান, আব্দুর রাহমান বিন আউফ, মজদুর সাহাবীরা, নারীরা সীমাহীন আর্থিক ত্যাগের উত্তম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন।

§ ৯ম হিজরীর রজব মাসে নবী সা. ৩০ হাজার মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে রওয়ানা হন সিরিয়ার পথে। সাথে ১০ হাজার সাওয়ার। এক উটে পালাক্রমে কয়েকজন। গ্রীষ্মের প্রচন্ডতা, পানির স্বল্পতা।

§ মুসলমানরা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধতার পরিচয় দেন।

§ তাবুক পৌছে জানা যায় কাইসার তার সেনা বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে নিয়ে আসার সাহস করতে পারেনি, তাই সীমান্ত থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। সীমান্তে কোন দুশমন নেই। যুদ্ধেরও প্রয়োজন নেই।

§ উল্লেখ্য যে,

কাইসারের প্রস্তুতি শেষ হবার আগেই রাসূল সা. সেখানে পৌছে যান। মুতার যুদ্ধের স্মৃতি তার চোখের সামনে, সাথে নবী সা. এর সরাসরি নেতৃত্ব, আবার সৈন্য সংখ্যা ৩ হাজারের পরিবর্তে ৩০ হাজার। বিধায় তার ২লাখ সৈন্য নিয়েও মুকাবিলার সাহস ছিল না।

§ বিনা রক্তপাতে অভিযান সফল হওয়ায় নৈতিক বিজয় লাভ হলো। নবী সা. এটাকে যথেষ্ট মনে করলেন।

§ রাসূল সা. এ বিজয় থেকে রাজনৈতিক ও সামরিক ফায়দা নেয়াকে অগ্রাধিকার দিলেন।

§ তাবুকে ২০দিন অবস্থান করে পার্শবর্তী রাজ্য সমূহ যা রোম সাম্রাজ্যের অধীন ছিল, তাদেরকে ইসলামী সাম্রাজ্যের অধীন করে করদ রাজ্যে পরিণত করলেন। আর এর মাধ্যমে ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমা রোম সাম্রাজ্যের সীমা পর্যন্ত পৌছে যায়।

ঘ. তাবুক পরবর্তী ঘটনাঃ

§ তাবুক যুদ্ধ হতে ফিরে এসে নবী সা. প্রথম যে কাজটা করলেন, তা হলো মসজিদে দ্বিরার ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দিলেন।

§ এর পর সাচ্ছা মুমিনদের মধ্যে যারা তাবুকের অভিযানে শামীল হতে পারেননি, তাদের বিষয়ে হাত দিলেন নবী সা.। কারণ, ইসলাম এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে, ইসলাম নেতৃত্ব দেবে সারা বিশ্বময়। তাই ঘরের মধ্যে দূর্বলতা  না রাখা। তাদের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের জন্য দৃঢ় কন্ঠে জানিয়ে দেয়া হলো যে, আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করার সংগ্রাম, কাফের আর মুসলমানের সংঘাতই হচ্ছে মুমিনের ঈমানের দাবী যাচাই করার আসল মানদন্ড। এই সংঘর্ষে যে ব্যক্তি ইসলামের জন্য ধন-প্রাণ, সময় ও শ্রম ব্যয় করতে ইতস্তত করবে, তার ঈমান নির্ভরযোগ্য হবেনা।

এ প্রসংগে কাব বিন মালিকের ঘটনাঃ

§ নবী সা. তাবুক থেকে মদীনায় ফিরে আসলে যারা যুদ্ধে যেতে পারেননি, তারা ওজর পেশ করার জন্য হাজির হলো। যাদের মাঝে ৮০ জনেরও বেশী মুনাফিক ছিল। রাসূল সা. তাদের মিথ্যা ওজর শুনছিলেন এবং মেনে নিচ্ছিলেন।

§ এ পর্যায়ে আসলো ৩জন মুমিনের পালা, পরিষ্কার ভাবে নিজেদের দোষ স্বীকার করলেন। আর রাসূল তাদের ৩জনের ব্যাপারে ফায়সালা মুলতবি রাখলেন। যাদের সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছেঃ

﴿وَعَلَى الثَّلاَثَةِ الَّذِينَ خُلِّفُواْ حَتَّى إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنفُسُهُمْ وَظَنُّواْ أَن لاَّ مَلْجَأَ مِنَ اللّهِ إِلاَّ إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوبُواْ إِنَّ اللّهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ﴾

আর যে ৩জনের ব্যাপার মুলতবি করে দেয়া হয়েছিল, তাদেরকে তিনি মাফ করে দিয়েছেন। পৃথিবী তার সমগ্র ব্যাপকতা সত্তেও যখন তাদের জন্য সংকির্ণ হয়ে গেল, তাদের নিজেদের প্রাণও তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাড়ালো এবং তারা জেনে নিল যে, আল্লাহর হাত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর নিজের রহমতের আশ্রয় ছাড়া আর কোন আশ্রয় স্থল নেই। তখন আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের দিকে ফিরলেন যাতে তারা তাঁর দিকে ফিরে আসে। অবশ্যই আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুনাময়।” (আত তাওবাঃ ১১৮)

§ এই ৩জনের ব্যাপারে সাধারণ ঘোষনা প্রদান করা হলো যে, আল্লাহর নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তাদের সাথে কোন ধরনের সামাজিক সম্পর্ক রাখা যাবেনা।

§ এই তিনজন সাহাবী ছিলেনঃ

১. কাব ইবনে মালিক।

২. হিলাল ইবনে উমাইয়াহ।

৩. মুরারাহ ইবনে রুবাই।

§ এই তিনজন সাহাবী ছিলেন সাচ্চা মুমিন। তাদের আন্তরিকতার ব্যাপারে তাদের পূর্বের তৎপরতাই পরিস্কার করে দেয়। যেমনঃ ৩জন সাহাবী ওহুদ, খন্দক, হুনাইন সহ অনেক যুদ্ধে রাসূল সা. এর সাথী ছিলেন। আর হিলাল বিন উমাইয়াহ ও মুরারাহ ইবনে রুবাই বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। বিধায় তাদের ঈমানের সত্যতা ছিল সব রকমের সন্দেহের উর্ধে।

§ এ তিন জনের অতীত ফাইল খুবই ভাল। এ প্লাস অথবা গোল্ডেন এ প্লাস। এত ত্যাগী হওয়া সত্ত্বেও নাজুক সময়ে গাফলতির পরিচয় দিলেন, তখন তাদের পাকড়াও করা হয়েছিল।

§ নবী সা. তাবুক থেকে ফিরে এসে মুসলমানদের কড়া নির্দেশ দিলেন যে, এদের সাথে সালাম করতে পারবে না। এমনকি ৪০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর তাদের স্ত্রীদের থেকেও আলাদা হয়ে বসবাসের অর্ডার করা হলো। অবশেষে ৫০তম দিবসে তাদের তাওবা কবুল করা হলো এবং আয়াত নাযিল হলো।

ঘটনার বিবরণ কাব বিন মালিকের মুখেঃ

§ কাব বিন মালিকের মুখে। যিনি বৃদ্ধ বয়সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তার পুত্র আব্দুল্লাহর কাছে তিনি বর্ণনা করেছেন।

§ তাবুকের যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য যখন ঘোষনা দেয়া হলো, সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমিও মনে মনে চিন্থা করলাম প্রস্তুতি নেবো।

§ আমাকে কেন জানি অলসতায় পেয়ে বসলো। মনে মনে বলতাম-এত তাড়াহুড়া কিসের, রওয়ানা হওয়ার সময় যখন আসবে, তখন ঠিকই প্রস্তুত হয়ে যাবো। তৈরী হতে আর কতক্ষণ লাগে।

§ আমি প্রস্তুতিতে পিছিয়ে পড়লাম। একদিন সেনাবাহিনী রওয়ানা হয়ে গেল। আমি ভাবলাম, অসুবিধা নাই-আমি দুদিন পর তাদের সাথে যোগ দিব। তারা চলে গেল। আমাকে অলসতা পেয়ে বসলো। সময় চলে গেল। আমি যেতে পারলাম না।

§ আমি মদীনায় থেকে গেলাম। মদীনায় যখন হাটতাম তখন আমার চোখে শুধু তাদেরই পড়তো, যারা হয়তো মুনাফিক, নয়তো দূর্বল ও অক্ষম ব্যক্তি। যাদেরকে আল্লাহ অব্যাহতি দিয়েছেন।

§ তাবুক থেকে ফিরে এসে নবী সা. নিয়ম মতো মসজিদে দূরাকাত নফল নামায পড়েলেন এবং লোকদের সাথে সাক্ষাত করতে বসলেন।

§ মুনাফিকরা, যাদের সংখ্যা ৮০ জনের চেয়েও বেশী ছিল, তারা এসে লম্বা লম্বা কসম খেয়ে তারা তাদের ওজর পেশ করতে লাগলো। তাদের সকলের ওজর ছিল বানোয়াট ও সাজানো। রাসূল সা. তাদের লোক দেখানো সব ওজর মেনে নিলেন। তাদের অন্তরের ব্যাপার আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে বললেন আল্লাহ তোমাদের মাফ করুন।

§ কাব বিন মালিক বলছেন, এর পর আসলো আমার পালা। আমি সামনে গিয়ে সালাম দিলাম। রাসূল সা. আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন, বললেনঃ আসুন! আপনাকে কিসে আটকে রেখেছিল?

§ আমি বললামঃ আল্লাহর কসম, যদি আমি কোন দুনিয়াদারের সামনে হাজির হতাম, তাহলে কোন না কোন কথা বানিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতো। আর বানিয়ে কথা বলার কৌশলও আমি জানি।

§ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি কোন মিথ্যা ওজর উপস্থাপন করে আমি আপনাকে সন্তুষ্ট করেও নেই, তাহলে আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনাকে আমার প্রতি আবার নারাজ করে দেবেন। আর আমি যদি সত্য বলি, আর আপনি নারাজ হয়েও যান, আশা রাখি আল্লাহ আমার জন্য ক্ষমার কোন পথ তৈরী করে দেবেন।

§ আসলে পেশ করার মতো কোন ওজর আমার নেই। আমি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি সক্ষম ছিলাম।

§ রাসূল সা. বললেন এ ব্যক্তি সত্য কথা বলছে।  ঠিক আছে, চলে যাও এবং আল্লাহর ফায়সালার অপেক্ষা করতে থাকো।”

§ আমি উঠে গিয়ে আমার গোত্রের লোকদের মাঝে বসলাম। সবাই আমার পিছনে লাগলো, তিরস্কার করলো এই বলে যে, কেন তুমি মিথ্যা ওজর পেশ করলেনা।

§ তাদের কথা শুনে রাসূলের কাছে গিয়ে কিছু বানোয়াট ওজর পেশ করতে আগ্রহ সৃষিট হলো। কিন্তু যখন শুনলাম মুরারাহ ইবনে রুবাই আর হেলাল ইবনে উমাইয়া আমার মতো সত্য কথা বলেছে, তখন আমার কথার উপর অটল থাকলাম।

বয়কটঃ

§ এর পর নবী সা. হুকুম জারি করলেন, আমাদের ৩জনের সাথে কেউ কথা বলতে পারবেনা।

§ অন্য ২জন ঘরের মধ্যে বসে রইল।

§ আমি বাহিরে বের হতাম, জামায়াতে নামায পড়তাম, বাজারে ঘোরাফেরা করতাম।

§ কেউ আমার সাথে কথা বলতো না। মনে হতো দেশটা বদলে গেছে। আমি এখানে এক অপরিচিত আগন্তুক। কেউ আমাকে চেনেনা, জানেনা

§ মসজিদে নামাযে গিয়ে রাসূল সা. কে সালাম করতাম। সালামের জবাবে তাঁর ঠোঁট নড়ে উঠছে কিনা তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতাম। কিন্তু অপেক্ষাই সার হতো।

§ রাসূল সা. এর নজর আমার উপর কিভাবে পড়ছে দেখার জন্য আঁড় চোখে তাকাতাম। অবস্থা ছিল এই যে, আমি যতক্ষণ নামায পড়তাম, ততক্ষণ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আমি যখন নামায শেষ করতাম, সাথে সাথে চোঁখ সরিয়ে নিতেন।

§ একদিন আমার চাচাত ভাই ও বন্ধু আবু কাতাদার নিকট গেলাম। তাকে সালাম দিলাম। তিনি আমার সালামে জবাব দিলেন না।

§ আমি বললামঃ হে আবু কাতাদাহ! আমি তোমাকে আল্লাহ কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, আমি কি আল্লাহ ও তার রাসূলকে ভালবাসি না?

§ সে কোন জবাব দিলনা। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম। সে নিরব রইল। তৃতীয় বার জিজ্ঞেস করলাম। সে তখন শুধু বললো, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন।

§ আমার চোঁখে পানি এসে গেল। আমি তার থেকে চলে গেলাম।

কাফেরদের লোভনীয় প্রস্তাবঃ

§ একদিন বাজারে যাচ্ছিলাম। সিরিয়ার নবতী বংশের এক লোকের সাথে দেখা। সে গাস্সান রাজার একটি চিঠি আমাকে দিল। আমি চিঠিটি পড়লাম। যাতে লিখা রয়েছে “আমরা শুনেছি, তোমার নেতা তোমার উপর উৎপীড়ন করছে। তুমি কোন নগন্য ব্যক্তি নও। তোমাকে ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। আমাদের কাছে চলে এসো। আমরা তোমাকে মর্যাদা দান করবো।

§ আমি ভাবলাম এতো আরেক আপদ। আমি সাথে সাথে চিঠি খানা চুলোর আগুনে ফেলে দিলাম।

৪০দিন পরঃ

§ এভাবে ৪০দিন কেটে গেল।

§ রাসূল সা. এর নিকট থেকে দূত আরো কঠোর নির্দেশ নিয়ে এলো।

§ নিজের স্ত্রী থেকে আলাদা হয়ে যাও।

§ আমি জিজ্ঞেস করলামঃ তাকে কি তালাক দিয়ে দেবো? জবাব এলো, না তালাক নয়। শুধু আলাদা থাকো আমি আমার স্ত্রীকে তার বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিলাম। আল্লাহ সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললাম।

৫০তম দিবসেঃ

§ ৫০তম দিবসে ঘরের ছাদে বসেছিলাম।

§ নিজের জীবনের প্রতি ধিক্কার জাগছিল।

§ হঠাৎ এক ব্যক্তি চেঁচিয়ে উঠলোঃ কাব ইবনে মালিক, তোমাকে অভিনন্দন।

§ একথা শুনেই আমি সেজদায় নত হয়ে গেলাম। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম, আমার ক্ষমার ঘোষনা জারি হয়ে গেছে।

§ লোকেরা দলে দলে ছুটে আসতে লাগলো। সবাই আমাকে মোবারকবাদ দিচ্ছে। তারা বললো, তোমার তাওবা কবুল হয়েছে।

অতঃপরঃ

§ আমি সোজা মসজিদে নবীর দিকে গেলাম।

F দেখলাম নবী সা. এর চেহারা আনন্দে উজ্জল।

F আমি সালাম দিলাম। তিনি বললেন, তোমাকে মোবারকবাদ।  আজকের দিনটি তোমার জীবনের সর্বোত্তম দিন।

F আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ ক্ষমা কি আপনার পক্ষ থেকে, না আল্লাহর পক্ষ থেকে। তিনি বললেন, আল্লাহ পক্ষ থেকে আর শুনিয়ে দিলেন সেই আয়াতঃ

﴿وَعَلَى الثَّلاَثَةِ الَّذِينَ خُلِّفُواْ حَتَّى إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنفُسُهُمْ وَظَنُّواْ أَن لاَّ مَلْجَأَ مِنَ اللّهِ إِلاَّ إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوبُواْ إِنَّ اللّهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ﴾

আর যে ৩জনের ব্যাপার মুলতবি করে দেয়া হয়েছিল, তাদেরকে তিনি মাফ করে দিয়েছেন। পৃথিবী তার সমগ্র ব্যাপকতা সত্ত্বেও যখন তাদের জন্য সংকির্ণ হয়ে গেল, তাদের নিজেরদের প্রাণও তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাড়ালো এবং তারা জেনে নিল যে, আল্লাহর হাত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর নিজের রহমতের আশ্রয় ছাড়া আর কোন আশ্রয় স্থল নেই। তখন আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের দিকে ফিরলেন যাতে তারা তাঁর দিকে ফিরে আসে। অবশ্যই আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুনাময়।” (আত তাওবাঃ ১১৮)

§ আমি বললাম,

হে আল্লাহর রাসূল। আমার সমস্ত ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে সাদাকাহ করে দিতে চাই। এটা আমার তাওবার অংশ বিশেষ।

§ রাসূল সা. বললেন, কিছু রেখে দাও, এটা তোমার জন্য ভাল।

§ রাসূলের কথা অনুযাী আমার খয়বরের সম্পত্তিটা রেখে বাকী সব সাদাকাহ করে দিলাম।

§ আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করলাম,

যে সত্য কথা বলার কারণে আল্লাহ আমাকে মাফ করে দিয়েছেন, সেই সত্যের উপর সারা জীবন প্রতিষ্ঠিত থাকবো।

কাজেই আজ পর্যন্ত আমি জেনে বুঝে যথার্থ সত্য ও প্রকৃত ঘটনা বিরোধী কোন কথা বলিনি। আশা আল্লাহ আগামীতেও আমাকে বাঁচাবেন।

তাবুকের অভিযানে যে সুদূর প্রসারী ফয়দা হলো, তাহলোঃ

1.   আরবদের মধ্যে যারা আরবদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতো, তারা রোমানদের মোকাবেলায় ইসলামের সহযোগী হয়ে গেল

2.  ইসলাম সমগ্র আরবে নিজের নিয়ন্ত্রন ও বাঁধন মজবুত করে নিল

3.  এতদিন যারা মুশরিকদের সাহায্য করছিল মুসলমানদের দলে থেকে, সেই সব মুনাফিকদের কোমর ভেঙে গেল। ফলে তারা হতাশ হয়ে ইসলামের কোলে আশ্রয় নিল

4.  এরপর একটি নামমাত্র গোষ্ঠী শিরক ও জাহেলী কার্যক্রমে অবিচল থাকলো।

ব্যাখ্যাঃ

﴿مَا كَانَ لِلْمُشْرِكِينَ أَن يَعْمُرُوا مَسَاجِدَ اللَّهِ شَاهِدِينَ عَلَىٰ أَنفُسِهِم بِالْكُفْرِ ۚ أُولَٰئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ وَفِي النَّارِ هُمْ خَالِدُونَ﴾

১৭ মুশরিক যখন নিজেরাই নিজেদের কুফরীর সাক্ষ্য দিচ্ছে তখন আল্লাহর মসজিদসমূহের রক্ষণাবেক্ষণকারী ও খাদেম হওয়া তাদের কাজ নয় তাদের সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে গেছে এবং তাদেরকে চিরকাল জাহান্নামে থাকতে হবে

مَا كَانَ لِلْمُشْرِكِينَ أَن يَعْمُرُوا مَسَاجِدَ اللَّهِ شَاهِدِينَ عَلَىٰ أَنفُسِهِم بِالْكُفْرِ - মুশরিক যখন নিজেরাই নিজেদের কুফরীর সাক্ষ্য দিচ্ছে তখন আল্লাহর মসজিদসমূহের রক্ষণাবেক্ষণকারী ও খাদেম হওয়া তাদের কাজ নয়

§  এখানে مَسَاجِدَ শব্দটিকে কেউ কেউ مَسجِدَ মসজিদ পড়েছেন। আর তখন তার মানে হয়ঃ মাসজিদুল হারাম।

- যখন মাসাজিদ পড়া হবে, তখন বুঝাবে দুনিয়ার সকল মসজিদ।

- যখন মাসজিদ পড়া হবে, তখন বুঝাবে মাসজিদুল হারাম।

§  মাসজিদুল হারামঃ

- যা পৃথিবীর বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ মসজিদ।

- যার তৈরীর প্রথম দিন থেকেই কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য বরাদ্ধ।

- যার প্রতিষ্ঠা করেন আল্লাহর খলিল-ইব্রাহীম আ.

§  মসজিদ তৈরী করা হয় এক আল্লাহর গোলামী করার জন্য বিধায় মসজিদের মুতাওয়াল্লী, খাদেম তারা হবেনা, যারা শিরক করে-আল্লাহর গুণাবলী, অধিকার ও ক্ষমতা-ইখতিয়ারে অন্যদের শরিক করে

§  নিজে থেকেই যারা তাওহীদের দাওয়াত অস্বীকার করে ঘোষনা করেছে যে তারা গোলামী কেবল আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট, সেহেতু যে ঘর কেবল আল্লাহর ইবাদতের জন্য বানানো হয়েছে, তার মুতাওয়াল্লী বা খাদেম হওয়ার অধিকার তাদের কোথায়?

§  ইমাম আল সুদ্দী রাহি বলেনঃ

لو سألت النصراني ما دينك؟ لقال نصراني، ولو سألت اليهودي ما دينك؟ لقال يهودي، والصابىء لقال صابىء، والمشرك لقال مشرك

তুমি যদি খৃষ্টানকে প্রশ্ন করো-তোমার ধর্ম কি? তারা বলবেঃ আমি খৃষ্টান ধর্মের লোক। যদি কোন ইহুদীকে প্রশ্ন করো-তোমার ধর্ম কি? তারা বলবেঃ আমি ইহুদী ধর্মাবলম্বী। সাবীয়ীকে জিজ্ঞেস করলে সে বলবেঃ আমি সাবিয়ী। আর মুশরিককে জিজ্ঞেস করলে বলবেঃ আমরা মুশরিক। আল্লাহ বলেনঃ أُوْلَـٰئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَـٰلُهُمْ - তাদের সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে গেছে

§  এই আয়াতের মাধ্যমে স্থায়ী ভাবে মুশরিকদের জন্য মসজিদুল হারামের মুতাওয়াল্লী হওয়ার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে।

§  এই আয়াতের মাধ্যমে স্থায়ী ভাবে মসজিদুল হারামের মুতাওয়াল্লী বা খাদেমের দায়িত্ব তাওহীদবাদীদের দেয়া হয়েছে।

§  সূরা আল আনফালে আল্লাহ বলেনঃ

وَمَا لَهُمْ أَلَّا يُعَذِّبَهُمُ اللَّهُ وَهُمْ يَصُدُّونَ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَا كَانُوا أَوْلِيَاءَهُ ۚ إِنْ أَوْلِيَاؤُهُ إِلَّا الْمُتَّقُونَ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ

“কিন্তু এখন কেন তিনি তাদের ওপর আযাব নাযিল করবেন না যখন তারা মসজিদে হারামের পথ রোধ করেছেঅথচ তারা এ মসজিদের বৈধ মুতাওয়াল্লীও নয় এর বৈধ মুতাওয়াল্লী হতে পারে একমাত্র তাকওয়াধারীরাই কিন্তু অধিকাংশ লোক একথা জানে না।” (আয়াতঃ ৩৪)

§  তাফসীরে জালালাইনে বলা হয়েছেঃ

মুশরিকদের জন্য একাকী বা দলবদ্ধভাবে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করা বা সেখানে অবস্থান করা কোনটাই গ্রহণযোগ্য নয়।

§  মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণ অর্থ কি?

তাফসীরে মাযহারীতে বলা হয়েছেঃ

-         মসজিদে ইবাদত বন্দেহী করা। মসজিদ আবাদ করার এটি আসল অর্থ। এটা অধিকাংশ তাফসীরকারকদের মত।

-         ইমরাত নির্মাণ ও সংস্কার।

-         মসজিদে প্রবেশ করা, মসজিদের ভিতর বসা।

أُولَٰئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ - তাদের সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে গেছে

§  ইবাদত হতে হবে শিরকের মিশ্রণমুক্তযে ইবাদতের সাথে শিরকের ছোঁয়া আছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।

§  শিরকের মিশ্রণে এদের আমল নষ্ট হয়ে গেছে।

§  মুশরিকরা পূর্বে মসজিদুল হারামের খেদমত করে যে সওয়াব তারা অর্জন করেছিল, তার সাথে ছিল শিরকের মিশ্রণ। বিধায় তাদের ভাল কাজ তারা নিজেরাই নষ্ট করে ফেলেছে।

وَفِي النَّارِ هُمْ خَالِدُونَ - এবং তাদেরকে চিরকাল জাহান্নামে থাকতে হবে  

§  خَالِدُونَ শব্দটি ‍কুরআনে কমপক্ষে ২৫বার এসেছে। যা জান্নাতের জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে, জাহান্নামের জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে।

﴿إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ ۖ فَعَسَىٰ أُولَٰئِكَ أَن يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ﴾

১৮ তারাই হতে পারে আল্লাহর মসজিদ আবাদকারী (রক্ষণাবেক্ষণকারী ও সেবক) যারা আল্লাহর ও পরকালকে মানেনামায কায়েম করেযাকাত দেয় এবং আল্লাহ কে ছাড়া আর কাউকে ভয় করেনা তাদেরই ব্যাপারে আশা করা যেতে পারে যেতারা সঠিক সোজা পথে চলবে

إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ - তারাই হতে পারে আল্লাহর মসজিদ আবাদকারী (রক্ষণাবেক্ষণকারী ও সেবক) যারা আল্লাহর ও পরকালকে মানে

عن أبي سعيد الخدري أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال إذا رأيتم الرجل يعتاد المسجد، فاشهدوا له بالإيمان

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেনঃ যখন তোমরা কোন লোককে দেখতে পাও যে, সে মসজিদের যেতে আসতে অভ্যস্ত হয়েছে তখন তোমরা তার ঈমানের সাক্ষ্য প্রদান কর। অতঃপর তিনি এই আয়াতটি পাঠ করেনঃ إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَـٰجِدَ ٱللَّهِ مَنْ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلأَخِرِ তারাই হতে পারে আল্লাহর মসজিদ আবাদকারী (রক্ষণাবেক্ষণকারী ও সেবক) যারা আল্লাহর ও পরকালকে মানে(তিরমিযি)

সূরা নূরঃ ৩৬, ৩৭

মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণকারীর মর্যাদাঃ

§  হযতর আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেনঃ

 إنما عمار المساجد هم أهل الله

মসজিদ সমূহের রক্ষণাবেক্ষণকারী হলোঃ আহলুল্লাহ - আল্লাহর ওয়ালা।

§  হযরত আনাস রা. হতে মারফু সূত্রে বর্ণিত হয়েছেঃ

 إذا أراد الله بقوم عاهة، نظر إلى أهل المساجد، فصرف عنهم

যখন আল্লাহ কোন জাতির উপর কোন শাস্তির প্রদানের ইচ্ছা পোষণ করেন, কিন্তু যখন আমি আহলে মাসাজিদ এর প্রতি নজর দেয়া হয়, তখন এই শাস্তি সরিয়ে ফেলা হয়।

§  হযরত আনাস রা. হতে মারফু সূত্রে আরো বর্ণিত হয়েছে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وعزتي وجلالي إني لأهم بأهل الأرض عذاباً، فإذا نظرت إلى عمار بيوتي، وإلى المتحابين في، وإلى المستغفرين بالأسحار، صرفت ذلك عنهم্তু যানের ইচ্ছা পোষণ করেন, তখে

আমার সম্মান ও মর্যাদার কসম! আমি যখণ পৃথিবীবাসীর উপর শাস্তি দেয়ার ইচ্ছা করি, অতঃপর যখন আমার ঘর সমূহের রক্ষনাবেক্ষণকারীদের প্রতি দৃষ্টি দেই, আমার ভালবাসা লাভের উদ্দেশ্যে যারা পরস্পর পরস্পরকে ভালভাবে এমন লোকদের প্রতি যখন নজর দেই এবং ভোরবেলা যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদের প্রতি যখন দৃষ্টিপাত করি, তখন ঐ আযাব তাদের উপর থেকে সরিয়ে নেই।

§  হযরত মুয়ায বিন জাবাল রা. নবী সা. থেকে বর্ণনা করেন। নবী সা. বলেছেনঃ

 إن الشيطان ذئب الإنسان، كذئب الغنم، يأخذ الشاة القاصية والناحية، فإياكم والشعاب، وعليكم بالجماعة والعامة والمسجد

শয়তান হচ্ছে মানুষের জন্য নেকড়ে স্বরূপ-যেমন বকরীর শত্রু হলো নেকড়ে বাঘ। নেকড়ে বাঘ যেমন পৃথক ও বিচ্ছিন্ন বকরীকে ধরে ফেলে। সূতরাং তোমাদের উপর কর্তব্য হলো, দলাদলী থেকে বেঁচে থাকা। তোমাদের কর্তব্য হলো, জামায়াতবদ্ধ আঁকড়ে ধরা, সর্বসাধারণকে আঁকড়ে ধরা, মসজিদকে আঁকড়ে ধরা।

§  আমর বিনে মায়মূন আল আওদী রাহি. বলেনঃ

أدركت أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم وهم يقولون إن المساجد بيوت الله في الأرض، وإنه حق على الله أن يكرم من زاره فيها

আমি মুহাম্মদ সা. এর সাহাবীদেরকে বলতে শুনেছিঃ জমীনের মাঝে মসজিদগুলো হলো আল্লাহর ঘর। আর আল্লাহ হক হচ্ছে, যারা এখানে আসবে-তাদেরকে সম্মাণ প্রদান করা।

জামায়াতে নামায ইমারাতে মাসাজিদের অংশঃ

§  ইবনে আব্বাস রা. বলেনঃ

من سمع النداء بالصلاة، ثم لم يجب، ولم يأت المسجد ويصلي، فلا صلاة له، وقد عصى الله ورسوله

যে সালাতের আযান শুনলো। অতঃপর তাকে কর্তব্য হিসাবে গ্রহণ করলো না এবং মসজিদের আসলোনা, নামায আদায় করলো না, তার কোন সালাত নেই। সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করলো। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَـٰجِدَ ٱللَّهِ مَنْ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلأَخِرِ

وَأَقَامَ الصَّلَاةَ - নামায কায়েম করে

§  আল্লামা ইবনে কাসীর বলেনঃ

 التي هي أكبر عبادات البدن নামায হলো শারিরিক ইবাদতের মধ্যে সবচেয় বড় ইবাদত।

§  يعني الصلوات الخمس  মানে ৫ ওয়াক্ত নামায।

وَآتَى الزَّكَاةَ এবং যাকাত দেয়

§  আল্লামা ইবনে কাসীর বলেনঃ

التي هي أفضل الأعمال المتعدية إلى بر الخلائق যাকাত হলো আর্থিক ইবাদত। যার কল্যাণ নিজেদের জন্য এবং মাখলুকের জন্যও।

وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ - এবং আল্লাহ কে ছাড়া আর কাউকে ভয় করেনা 

§  আল্লামা ইবনে কাসীর বলেনঃ

ولم يخف إلا من الله تعالى، ولم يخش سواه সব সময় এই ধারণা পোষণ করে যে, আল্লাহর কাছে কোন কিছু গোপন থাকে না-সকল বিষয়ে আল্লাহ অবগত এবং সেই বিবেচনায় সকল বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করে। আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না।

§  لم يعبد إلا الله মানে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না।

فَعَسَىٰ أُولَٰئِكَ أَن يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ - তাদেরই ব্যাপারে আশা করা যেতে পারে যেতারা সঠিক সোজা পথে চলবে

§  কুরআনে عسى শব্দটি মোট ২৮ বার এসেছে। যেমনঃ

আল বাকারাঃ ২১৬, আন নিসাঃ ১৯, ৮৪, ৯৯, আল মায়িদাহঃ ৫২, আল আরাফঃ ১২৯, ১৮৫, আত তাওবাঃ ১৮, ১০২, ইউসুফঃ ২১, ৮৩, বনী ইসরাইলঃ ৮, ৫১, ৭৯, আল কাহফঃ ২৪, ৪০, মারইয়ামঃ ৪৮, আন নামলঃ ৭২, আল কাসাসঃ ৯, ২২, ৬৭, মুহাম্মদঃ ৮, ২২, আল হুজুরাতঃ ১১, আল মুমতাহানাহঃ ৭, আত তাহরীমঃ ৫, , আল কালামঃ ৩২

আল বাকারাঃ ২১৬

1.     كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَّكُمْ وَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَعَسَىٰ أَن تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

আন নিসাঃ ১৯

2.     يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَحِلُّ لَكُمْ أَن تَرِثُوا النِّسَاءَ كَرْهًا وَلَا تَعْضُلُوهُنَّ لِتَذْهَبُوا بِبَعْضِ مَا آتَيْتُمُوهُنَّ إِلَّا أَن يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍ وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِن كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا

আন নিসাঃ ৮৪

3.     فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ وَحَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَسَى اللَّهُ أَن يَكُفَّ بَأْسَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَاللَّهُ أَشَدُّ بَأْسًا وَأَشَدُّ تَنكِيلًا

আন নিসাঃ ৯৯

4.     فَأُولَـٰئِكَ عَسَى اللَّهُ أَن يَعْفُوَ عَنْهُمْ وَكَانَ اللَّهُ عَفُوًّا غَفُورًا

আল মায়িদাহঃ ৫২

5.     فَتَرَى الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ يُسَارِعُونَ فِيهِمْ يَقُولُونَ نَخْشَىٰ أَن تُصِيبَنَا دَائِرَةٌ فَعَسَى اللَّهُ أَن يَأْتِيَ بِالْفَتْحِ أَوْ أَمْرٍ مِّنْ عِندِهِ فَيُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا أَسَرُّوا فِي أَنفُسِهِمْ نَادِمِينَ

আল আরাফঃ ১২৯

6.     قَالُوا أُوذِينَا مِن قَبْلِ أَن تَأْتِيَنَا وَمِن بَعْدِ مَا جِئْتَنَا قَالَ عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَن يُهْلِكَ عَدُوَّكُمْ وَيَسْتَخْلِفَكُمْ فِي الْأَرْضِ فَيَنظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ

আল আরাফঃ ১৮৫

7.     أَوَلَمْ يَنظُرُوا فِي مَلَكُوتِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا خَلَقَ اللَّهُ مِن شَيْءٍ وَأَنْ عَسَىٰ أَن يَكُونَ قَدِ اقْتَرَبَ أَجَلُهُمْ فَبِأَيِّ حَدِيثٍ بَعْدَهُ يُؤْمِنُونَ

আত তাওবাঃ ১৮

8.     إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ فَعَسَىٰ أُولَـٰئِكَ أَن يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ

আত তাওবাঃ ১০২

9.     وَآخَرُونَ اعْتَرَفُوا بِذُنُوبِهِمْ خَلَطُوا عَمَلًا صَالِحًا وَآخَرَ سَيِّئًا عَسَى اللَّهُ أَن يَتُوبَ عَلَيْهِمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

ইউসুফঃ ২১

10. وَقَالَ الَّذِي اشْتَرَاهُ مِن مِّصْرَ لِامْرَأَتِهِ أَكْرِمِي مَثْوَاهُ عَسَىٰ أَن يَنفَعَنَا أَوْ نَتَّخِذَهُ وَلَدًا وَكَذَٰلِكَ مَكَّنَّا لِيُوسُفَ فِي الْأَرْضِ وَلِنُعَلِّمَهُ مِن تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ وَاللَّهُ غَالِبٌ عَلَىٰ أَمْرِهِ وَلَـٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

ইউসুফঃ ৮৩

11. قَالَ بَلْ سَوَّلَتْ لَكُمْ أَنفُسُكُمْ أَمْرًا فَصَبْرٌ جَمِيلٌ عَسَى اللَّهُ أَن يَأْتِيَنِي بِهِمْ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ

বনী ইসরাইলঃ ৮

12. عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَن يَرْحَمَكُمْ وَإِنْ عُدتُّمْ عُدْنَا وَجَعَلْنَا جَهَنَّمَ لِلْكَافِرِينَ حَصِيرًا

বনী ইসরাইলঃ ৫১

13. أَوْ خَلْقًا مِّمَّا يَكْبُرُ فِي صُدُورِكُمْ فَسَيَقُولُونَ مَن يُعِيدُنَا قُلِ الَّذِي فَطَرَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ فَسَيُنْغِضُونَ إِلَيْكَ رُءُوسَهُمْ وَيَقُولُونَ مَتَىٰ هُوَ قُلْ عَسَىٰ أَن يَكُونَ قَرِيبًا

বনী ইসরাইলঃ ৭৯

14. وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَّكَ عَسَىٰ أَن يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُودًا

আল কাহফঃ ২৪

15. إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ وَاذْكُر رَّبَّكَ إِذَا نَسِيتَ وَقُلْ عَسَىٰ أَن يَهْدِيَنِ رَبِّي لِأَقْرَبَ مِنْ هَـٰذَا رَشَدًا

আল কাহফঃ ৪০

16. فَعَسَىٰ رَبِّي أَن يُؤْتِيَنِ خَيْرًا مِّن جَنَّتِكَ وَيُرْسِلَ عَلَيْهَا حُسْبَانًا مِّنَ السَّمَاءِ فَتُصْبِحَ صَعِيدًا زَلَقًا

মারইয়ামঃ ৪৮

17. وَأَعْتَزِلُكُمْ وَمَا تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ وَأَدْعُو رَبِّي عَسَىٰ أَلَّا أَكُونَ بِدُعَاءِ رَبِّي شَقِيًّا

আন নামলঃ ৭২

18. قُلْ عَسَىٰ أَن يَكُونَ رَدِفَ لَكُم بَعْضُ الَّذِي تَسْتَعْجِلُونَ

আল কাসাসঃ ৯

19. وَقَالَتِ امْرَأَتُ فِرْعَوْنَ قُرَّتُ عَيْنٍ لِّي وَلَكَ لَا تَقْتُلُوهُ عَسَىٰ أَن يَنفَعَنَا أَوْ نَتَّخِذَهُ وَلَدًا وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ

আল কাসাসঃ ২২

20. وَلَمَّا تَوَجَّهَ تِلْقَاءَ مَدْيَنَ قَالَ عَسَىٰ رَبِّي أَن يَهْدِيَنِي سَوَاءَ السَّبِيلِ

আল কাসাসঃ ৬৭

21. فَأَمَّا مَن تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَعَسَىٰ أَن يَكُونَ مِنَ الْمُفْلِحِينَ

মুহাম্মদঃ ৮

22. وَالَّذِينَ كَفَرُوا فَتَعْسًا لَّهُمْ وَأَضَلَّ أَعْمَالَهُمْ

মুহাম্মদঃ ২২

23. فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِن تَوَلَّيْتُمْ أَن تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ

আল হুজুরাতঃ ১১

24. يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ عَسَىٰ أَن يَكُونُوا خَيْرًا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِّن نِّسَاءٍ عَسَىٰ أَن يَكُنَّ خَيْرًا مِّنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوا أَنفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ وَمَن لَّمْ يَتُبْ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ

আল মুমতাহানাহঃ ৭

25. عَسَى اللَّهُ أَن يَجْعَلَ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَ الَّذِينَ عَادَيْتُم مِّنْهُم مَّوَدَّةً وَاللَّهُ قَدِيرٌ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

আত তাহরীমঃ ৫

26. عَسَىٰ رَبُّهُ إِن طَلَّقَكُنَّ أَن يُبْدِلَهُ أَزْوَاجًا خَيْرًا مِّنكُنَّ مُسْلِمَاتٍ مُّؤْمِنَاتٍ قَانِتَاتٍ تَائِبَاتٍ عَابِدَاتٍ سَائِحَاتٍ ثَيِّبَاتٍ وَأَبْكَارًا

আত তাহরীমঃ ৮

27. يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَّصُوحًا عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يَوْمَ لَا يُخْزِي اللَّهُ النَّبِيَّ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ نُورُهُمْ يَسْعَىٰ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

আল কালামঃ ৩২

28. عَسَىٰ رَبُّنَا أَن يُبْدِلَنَا خَيْرًا مِّنْهَا إِنَّا إِلَىٰ رَبِّنَا رَاغِبُونَ

§  ইবনে আব্বাস রা. বলেনঃ

وكل عسى في القرآن فهي واجبة  কুরআন হাকীমে যত জায়গায় عَسَىٰ শব্দ এসেছে, সব নিশ্চিত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, আশা অর্থে নয়। যেমন, সূরা বনী ইসরাঈলের ৭৯ নম্বর আয়াতে রাসূল সা. সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ عَسَىٰ أَن يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَاماً مَّحْمُودًا

§  ইবনে ইসহাক রাহি. বলেনঃ শব্দটি সত্য ও নিশ্চয়তার জন্য ব্যবহৃত হয়।

أُولَٰئِكَ أَن يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ - তারা সঠিক সোজা পথে চলবে

§  কুরআনে যারা সফলতা প্রাপ্ত মানুষের কথা যেখানে বলা হয়েছে, সেখানে যে সব কোয়ালিটি বলা হয়েছে,তা হলোঃ

û  গায়েবে বিশ্বাস করা

û  নামায কায়েম করা।

û  দান করা।

û  কিতাবে বিশ্বাস।

û  আখেরাতে বিশ্বাস।

û  দাওয়াতের কাজ করা।

û  সত্য কাজের আদেশ দেয়া।

û  অসৎ কাজের নিষেধ করা।

û  পাল্লাকে ভারী করা।

û  নবীর অনুসরণ।

û  জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ

û  আল্লাহর আনুগত্য।

û  প্রতিবেশীর হক আদায়।

û  মিসকীনের হক আদায়।

û  মুসাফিরের হক আদায়।

û  নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করা।

﴿أَجَعَلْتُمْ سِقَايَةَ الْحَاجِّ وَعِمَارَةَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ كَمَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَجَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۚ لَا يَسْتَوُونَ عِندَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾

১৯ তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো এবং মসজিদে হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করাকে এমন ব্যক্তিদের কাজের সমান মনে করে নিয়েছ যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি এবং সংগ্রাম-সাধনা করেছে আল্লাহর পথে? উভয় দল আল্লাহর কাছে সমান নয়। আল্লাহ জালেমদের পথ দেখান না

أَجَعَلْتُمْ سِقَايَةَ الْحَاجِّ وَعِمَارَةَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ كَمَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَجَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ  - তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো এবং মসজিদে হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করাকে এমন ব্যক্তিদের কাজের সমান মনে করে নিয়েছ যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি এবং সংগ্রাম-সাধনা করেছে আল্লাহর পথে?

§  শানে নুযুলঃ

তাফসীরে ইবনে আব্বাসে বলা হয়েছেঃ বদরের যুদ্ধের একজন বন্দি হযরত আলী রা. অথবা অন্য কোন একজন বদরী সাহাবীর প্রতি দম্ভ করতে লাগল এবং বলতে লাগল, আমরা হাজীদের পানি পান করাই ও মসজিদুল হারামের সেবা যত্ন করি এবং অন্যান্য জনহিতকর কাজ সম্পাদন করি। এর জবাবে আল্লাহ বলেনঃ

أَجَعَلْتُمْ سِقَايَةَ الْحَاجِّ وَعِمَارَةَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ كَمَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَجَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۚ لَا يَسْتَوُونَ عِندَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

§  উত্তরাধিকার সূত্রে কোন ধর্মীয় স্থানের তত্ত্বাবধায়ক হওয়া, কোন ধর্মীয় স্থান রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করার অথবা লোক দেখানো কোন কোন ধর্মীয় কাজ করা-ইত্যাদির মাধ্যমে দুনিয়াতে মানুষের নিকট অনেক মর্যাদা সৃষ্টি হয় এবং মানুষ ঐ ব্যক্তিকে অনেক পবিত্র ও মুত্তাকী আমলদার মনে করে।

§  আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিকট এই সব কিছু কোন দাম নেই, কোন মূল্য নেই।

§ আল্লাহর কাছে মূল্যবান ও মর্যাদাসম্পন্ন বিষয় হলোঃ

. আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা।

. আল্লাহর পথে কুরবানী ও ত্যাগ স্বীকার করা।

§ আল্লাহর কাছে মূল্যবান ও মর্যাদাসম্পন্ন হওয়ার জন্য জরুরী নয়ঃ

. উচ্চ বংশ ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের হওয়া।

. কপালে কোন বিশেষ গুণের তকমা আটা।

§  কেউ যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান ও আল্লাহর পথে কুরবানীর গুণের অধিকারী না হয়ে নিম্নোক্ত কাজ গুলো করে তাহলে সে আল্লাহর নিকট মর্যাদার অধিকারী হবে নাঃ

. সম্মাণিত ও বুজর্গ ব্যক্তির সন্তান।

. দীর্ঘকাল থেকে পারিবারিক ভাবে গদিনশীল হওয়ার প্রথায় গদিনশীল।

. কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান ধুমধাম করে পালন করা

§  এই সব কাজকে স্বীকৃতি দিয়ে পবিত্র ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য এবং অনুপযুক্ত লোকদের হাতে ছেড়ে দেয়া বৈধ নয়।

§  আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন,

قال إن المشركين قالوا عمارة بيت الله، وقيام على السقاية، خير ممن آمن وجاهد، وكانوا يفخرون بالحرم، ويستكبرون به من أجل أنهم أهله وعماره، فذكر الله استكبارهم وإعراضهم، فقال لأهل الحرم من المشركين

মুশরিকরা বলতোঃ বাইতুল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং হাজীদের পানি পান করানোর কাজটি ঈমান ও জিহাদ থেকে উত্তম। আর তারা এজন্য নিজেরা গর্ববোধ করতো এবং অহংকার করে বলতোঃ যেহেতু আমরা এই দুটির খেদমত আনজাম দিচ্ছি, সেহেতু আমরাই উত্তমআমাদের চেয়ে উত্তম আর কেউ হতে পারে না। আল্লাহ তাদের এই গর্ব অহংকারের জবাব দিলেন। মুশরিকদের মাঝে যারা আহলে হরম, তাদের উদ্দেশ্যে সূরা আল মুমিনুনের ৬৬-৬৭ আয়াতে বললেনঃ  قَدْ كَانَتْ آيَاتِي تُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ فَكُنتُمْ عَلَىٰ أَعْقَابِكُمْ تَنكِصُونَ، مُسْتَكْبِرِينَ بِهِ سَامِرًا تَهْجُرُونَ আমার আয়াত তোমাদের শোনানো হতোতোমরা তো (রাসূলের আওয়াজ শুনতেই) পিছন ফিরে কেটে পড়তেঅহংকারের সাথে তা অগ্রাহ্য করতেনিজেদের আড্ডায় বসে তার সম্পর্কে গল্প দিতে ও আজেবাজে কথা বলতে 

لَا يَسْتَوُونَ عِندَ اللَّهِ - উভয় দল আল্লাহর কাছে সমান নয়।

§  আল্লামা ইবনে কাসির বলেনঃ

يعني الذين زعموا أنهم أهل العمارة، فسماهم الله ظالمين بشركهم، فلم تغن عنهم العمارة شيئاً.

অর্থাৎ যারা গর্ব করে আমরা আহলুল ইমারাহ (আমরা আল্লাহর ঘরের রক্ষণাবেক্ষণকারী), তাদের সেই ভাল কাজ শিরক খেয়ে ফেলেছে। শিরক করার মাধ্যমে নিজেরা নিজেদের উপর জুলুম করেছে। বিধায় তারা জালেম হয়ে গেছে। তাদের এই ভাল কাজ কোন কাজে আসবে না।

§  রাসূল সা. এর চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব রা. যখন বদরে বন্দি করা হয়, তখন মুসলমানরা, বিশেষ করে তার আত্মীয় স্বজন তাকে তিরস্কার করছিল যে, তিনি এখনো শিরকের মাঝে রয়েছেনতখন হযরত আব্বাস রা. বলেনঃ

لئن كنتم سبقتمونا بالإسلام والهجرة والجهاد، لقد كنا نعمر المسجد الحرام، ونسقي، ونفك العاني

তোমরা যদি ইসলাম ও জিহাদে থেকে থাকো  তবে আমরাও তো কাবা ঘরের খিদমত এবং হাজীদেরকে পানি পান করানো এবং হাজীদের কষ্ট দূর করার কাজে ছিলাম। এমনি প্রেক্ষিতে এই আয়াত নাযিল হয়।

§   আরেকটি বর্ণনাঃ

একদিন তালহা ইবনে শায়বা রা., আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব রা., এবং আলী ইবনে আবি তালিব রা. বসে প্রত্যেকে নিজ নিজ গৌরবের কথা বর্ণনা করছিলেন।

তালহা রা. বলেনঃ

أنا صاحب البيت، معي مفتاحه، ولو أشاء بت فيه  - আমি বাইতুল্লাহর চাবি রক্ষক। আমি চাইলে সেখানে রাতে ঘুমাতে পারি।

আব্বাস রা. বলেনঃ

أنا صاحب السقاية والقائم عليها، ولو أشاء بت في المسجد - আমি হাজীদেরকে যমযমের পানি পান করাই, আমি যমযমের রক্ষক। আমি চাইলে সারারাত মসজিদুল হারামে কাটিয়ে দিতে পারি

আলী রা. বলেনঃ

ما أدري ما تقولان، لقد صليت إلى القبلة ستة أشهر قبل الناس، وأنا صاحب الجهاد  - তোমরা দুজন যা করছো, তা আমার কাছে কিছুতেই বুঝে আসতেছেনা। আমি মানুষের ৬মাস আগে থেকে কেবলামুখী হয়ে সালাত পড়েছি। অপরদিকে আমি মুজাহিদও বটে। তখন এ আয়াত নাযিল হয়।

এই আয়াত নাযিলের পর আব্বাস রা. বলেনঃ ما أراني إلا أني تارك سقايتنا আমি আশংকা করছিলাম, না জানিক আমাকে যমযম কূপের দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়। রাসূল সা. বললেনঃ أقيموا على سقايتكم فإن لكم فيها خيراً না, না, আপনি এ পদেই অধিষ্ঠিত থাকুন। আপনার জন্য এতেই কল্যাণ রয়েছে।

§  একটি মারফু হাদীসঃ

হযরত নুমান ইবনে বশীর আল আনসারী রা. বলেনঃ আমি একদিন রাসূল সা. এর একদল সাহাবীর সাথে তাঁর মিম্বরের পাশে বসা ছিলাম। সাহাবীদের মধ্য থেকে একজন বললেনঃ ما أبالي أن لا أعمل عملاً بعد الإسلام إلا أن أسقي الحاج  ইসলাম গ্রহণের পর হাজীদেরকে পানি পান করানো ছাড়া আমি আর কোন আমল না করলেও আমার কোন পরওয়া নেই। অন্য একজন বললেনঃ ما أبالي أن لا أعمل عملاً بعد الإسلام إلا أن أعمر المسجد الحرام মসজিদে হারাম এর রক্ষনাবেক্ষণের কথা। তৃতীয়জন বললেনঃ  الجهاد في سبيل الله أفضل مما قلتم তোমরা যে আমলের কথা বলছো, তার চেয়ে ‍উত্তম হলো জিহাদ। এমন অবস্থায় হযরত উমর রা. তাদেরকে ধমক দিয়ে বলেনঃ لا ترفعوا أصواتكم عند منبر رسول الله صلى الله عليه وسلم তোমরা আল্লাহর রাসূলের মিম্বরের কাছে উঁচু আওয়াজে কথা বলো না। দিনটি ছিল জুমুয়ার দিন। হযরত উমর বললেনঃ জুমুয়ার সালাতের পর আমি এ বিষয়ে রাসূল সা.কে জিজ্ঞেস করবো এবং সে অনুযায়ী তিনি জিজ্ঞেস করলেন। তখন এই আয়াত নাযিল হয়ঃ

أَجَعَلْتُمْ سِقَايَةَ الْحَاجِّ وَعِمَارَةَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ ك----------وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ - আল্লাহ জালেমদের পথ দেখান না

§  তাফসীরে জালালাইনে জালেম শব্দের অর্থ করা হয়েছে-কাফের।

§  আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে সঠিক পথের সন্ধান দেন না-এই কথাটা হুবহু করআনে বলা হয়েছে-১০ বার। যেমনঃ

û  সূরা আল বাকরাঃ ২৫৮

û  সূরা আলে ইমরানঃ ৮৬

û  আল মায়িদাঃ ৫১

û  সূরা আল আনআমঃ ১৪৪

û  সূরা আত তাওবাঃ ১৯, ১০৯

û  সূরা আল কাসাসঃ ৫০

û  আল আহকাফঃ ১০

û  সূরা আস সাফঃ ৭

û  সূরা আল জুমুয়াঃ ৫

§  এজন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের দোয়া শিখিয়েছেনঃ

رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ

“হে আমাদের রব! এ জালেমের সাথে আমাদের শামিল করো না” (আল আরাফঃ ৪৭)

§  হযরত হারুন আ. তার ভাই মুসা আ.কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেনঃ

وَلاَ تَجْعَلْنِي مَعَ ٱلْقَوْمِ ٱلظَّٰلِمِينَ

আর আমাকে তুমি এ জালিম কাওমের মাঝে শামীল মনে করো না।(আল আরাফঃ ১৫০)

§  নুহ আ.কে আল্লাহ দোয়া শিখালেনঃ

فَإِذَا ٱسْتَوَيْتَ أَنتَ وَمَن مَّعَكَ عَلَى ٱلْفُلْكِ فَقُلِ ٱلْحَمْدُ للَّهِ ٱلَّذِي نَجَّانَا مِنَ ٱلْقَوْمِ ٱلظَّالِمِينَ

তারপর যখন আপনি ও আপনার সাথীগন নৌকায় সওয়ার হয়ে যাবেন, তখন বলবেনঃ সকল প্রশংসা ঐ আল্লাহর জন্য যিনি আমাদেরকে জালিম কাওম থেকে নাজাত দিয়েছেন।

§  ফিরাউনের স্ত্রী হযরত আছিয়া আ. দোয়া করেছিলেনঃ

وَضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلاً لِّلَّذِينَ آمَنُواْ ٱمْرَأَتَ فِرْعَوْنَ إِذْ قَالَتْ رَبِّ ٱبْنِ لِي عِندَكَ بَيْتاً فِي ٱلْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِن فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي مِنَ ٱلْقَوْمِ ٱلظَّالِمِينَ

হে আমার মালিক! আমার জন্য আপনার কাছে বেহেশতের একটা বাড়ি বানিয়ে দিন, আমাকে ফিরাউন ও তার আমল থেকে উদ্ধার করুন এবং জালিম কাওম থেকে আমাকে নাজাত দিন।” (আত তাহরীমঃ ১১)

§  আল্লাহর কুরআনকে নিয়ে যারা অহেতুক আলোচনা করে তাদেরকে জালেম বলে আখ্যা দিয়ে কুরআন এসব লোক থেকে দূরে থাকার জন্য রাসূলকে নির্দেশ দিচ্ছেঃ

وَإِذَا رَأَيْتَ ٱلَّذِينَ يَخُوضُونَ فِيۤ ءَايَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّىٰ يَخُوضُواْ فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنسِيَنَّكَ ٱلشَّيْطَٰنُ فَلاَ تَقْعُدْ بَعْدَ ٱلذِّكْرَىٰ مَعَ ٱلْقَوْمِ ٱلظَّٰلِمِينَ

“(হে রাসূল!) যখন আপনি দেখতে পান, লোকেরা আমার আয়াত নিয়ে বেহুদা আলোচনায় লিপ্ত হয়েছে, তখন আপনি তাদের কাছ থেকে সরে যান, যতক্ষণ না তারা এ বিষয় বাদ দিয়ে অন্য বিষয়ে আলাপ জুড়ে দেয়। আর যদি কোনো সময় শয়তান আপনাকে একথা ভূলিয়ে দেয়, তাহলে যখনই ভূল বুঝতে পারেন তারপর এ জালিম লোকদের সাথে আর বসবেন না।” (আনআমঃ ৬৮)

§  ফিরাউনী আদর্শে বিশ্বাসীরা হলো জালেম কওম। কারণ ফিরাউনের কওমকে আল্লাহ বলেছেন জালিমদের কাওম।

وَإِذْ نَادَىٰ رَبُّكَ مُوسَىٰ أَنِ ٱئْتِ ٱلْقَوْمَ ٱلظَّالِمِينَ

“(হে নবী! তাদের ঐ সময়ে কাহিনী শুনিয়ে দিন) যখন আপনার রব মুসাকে ডেকে বলেছিলেন, জালিমদের কাওমের কাছে যান-ফিরাউনের কাওমের কাছে। তারা কি ভয় করে না?” (আশ শুআরাঃ ১০-১১)

§  মুসা আ.কে হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা যখন উনি অবগত হলেন, তখন দোয়া কলেনঃ

فَخَرَجَ مِنْهَا خَآئِفاً يَتَرَقَّبُ قَالَ رَبِّ نَجِّنِي مِنَ ٱلْقَوْمِ ٱلظَّالِمِينَ

হে আমার বর! আামকে জালিম কাওম থেকে নাজাত দাও।” (আল কাসাসঃ ২১)

§  মুসা আ. যখন ষড়যন্ত্রকারীদের কবল থেকে বেঁচে গেলেন, তখন যে জনপদে পৌছলেন, সেখানকার সরদার তাকে উদ্দেশ্য করে বললোঃ

فَجَآءَتْهُ إِحْدَاهُمَا تَمْشِي عَلَى ٱسْتِحْيَآءٍ قَالَتْ إِنَّ أَبِي يَدْعُوكَ لِيَجْزِيَكَ أَجْرَ مَا سَقَيْتَ لَنَا فَلَمَّا جَآءَهُ وَقَصَّ عَلَيْهِ ٱلْقَصَصَ قَالَ لاَ تَخَفْ نَجَوْتَ مِنَ ٱلْقَوْمِ ٱلظَّالِمِينَ

তুমি কোন ভয় করো না। এখন তুমি জালিম কাওমের হাত তেকে বেঁচে গেছো।” (আল কাসাসঃ ২৫)

§  নবী মুহাম্মদ সা.কে আল্লাহ বললেন দোয়া করতেঃ

رَبِّ فَلاَ تَجْعَلْنِي فِي ٱلْقَوْمِ ٱلظَّالِمِينَ

হে আমাদের মালিক! আমাকে ঐ জালিমদের সাথে শামিল করোনা।” (আল মুমিনুনঃ ৯৪)

﴿الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِندَ اللَّهِ ۚ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ﴾

২০ এ উভয় দল আল্লাহর কাছে সমান নয় আল্লাহ জালেমদের পথ দেখান না আল্লাহর কাছে তো তারাই উচ্চ মর্যাদার অধিকারীযারা ঈমান এনেছে এবং তার পথে ঘর-বাড়ি ছেড়েছে ও ধন-প্রাণ সমর্পন করে জিহাদ করেছে তারাই সফলকাম

أَعْظَمُ دَرَجَةً عِندَ اللَّهِ - আল্লাহর কাছে তো তারাই উচ্চ মর্যাদার অধিকারী

§  دَرَجَةً মানেঃ رتبة অর্থাৎ মর্যাদা।

§  আগের আয়াতে আল্লাহ বলেছেনঃ لَا يَسْتَوُونَ عِندَ اللَّهِ মানে ২টি দল কখনো সমান নয়। এর মানে হলোঃ একদলের মর্যাদা উপরে, আরেকদলের মর্যাদা নিচে

§  আল্লাহর পথে জিহাদ এর গুরুত্ব বর্ণনা করা হচ্ছে এখানে। বলা হচ্ছেঃ

হাজীদের পানি পান করানো, কিংবা মসজিদের হারামের রক্ষণাবেক্ষনের বিষয়টি ভাল কাজ, গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলেও তা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজের চেয়ে মর্যাদা সম্পন্ন নয়। বরং জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহতে যারা যুক্ত, তাদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেক উচ্চ।

§  আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেনঃ

তারা আল্লাহর নিকট মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ, আর তারাই সফলকাম। তারা জান্নাত অর্জন করেছে এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়েছে।

§  তাফসীরে ইবনে কাসীর এর বলা হয়েছেঃ এই আয়াত থেকে জানা গেলঃ চারটি গুণের অধিকারী, যাদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অধিক আর তা হলোঃ

. ঈমান।

. হিজরত।

. জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ।

. জিহাদ বিন নাফস।

﴿يُبَشِّرُهُمْ رَبُّهُم بِرَحْمَةٍ مِّنْهُ وَرِضْوَانٍ وَجَنَّاتٍ لَّهُمْ فِيهَا نَعِيمٌ مُّقِيمٌ﴾

২১ তাদের রব তাদেরকে নিজের রহমতসন্তোষ ও এমন জান্নাতের সুখবর দেনযেখানে তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী সুখের সামগ্রী

§  আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেনঃ তাদের মালিক তাদেরকে-

-          আযাব থেকে মুক্তির সুসংবাদ দিচ্ছেন।

-          নিজ দয়া ও সন্তুষ্টি ও জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছেন।

-          এমন জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছেন, যেখানে রয়েছে বিরতিহীন স্থায়ী সুখ ও শান্তি।

§  তাফসীর উসমানীতে বলা হয়েছেঃ

-          আবু হাইয়ান বলেছেনঃ ঈমানের ফলে রহমত লাভ হয়, ঈমান না থাকলে আখেরাতে আল্লাহর কোন রহমত পাবে না।

-          রেদওয়ান অনেক উঁচু মর্যাদা, যা কেবল জিহাদের বিনিময় অর্জিত হয়।

-          হিজরত হলো, নফসের সকল কামনা বাসা ত্যাগ করা, সকল সম্পর্ক ছিন্ন করা, আল্লাহর রাস্তায় জান ও মাল উৎসর্গ করা, নিজের জন্মভূমি ও বাড়ী ঘর ত্যাগ করা। এই সবই হিজরতের অন্তর্ভূক্ত। আর হিজরতকারী যা ত্যাগ করেছে তা দেয়া হবে আরো শ্রেষ্ট করে। এবং এমন আবাস দেয়া হবে, যা থেকে হিজরতের আর দরকার হবে না।

﴿خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۚ إِنَّ اللَّهَ عِندَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ﴾

২২ সেখানে তারা চিরকাল থাকবে অবশ্যি আল্লাহর কাছে কাজের প্রতিদান দেবার জন্য অনেক কিছুই রয়েছে

§ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেনঃ

-          তারা সেখানে হবে চিরস্থায়ী।

-          তারা সেখানে মৃত্যুবরণ করবে না।

-          তারা সেখান থেকে বহিস্কৃত হবে না।

-          আল্লাহর নিকট তাদের জন্য থাকবে মহাপুরস্কার।

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا آبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنِ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الْإِيمَانِ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ﴾

২৩ যে ঈমানদারগণ! তোমাদের বাপ ও ভাইয়েরা যদি ঈমানের ওপর কুফরীকে প্রাধান্য দেয় তাহলে তাদেরকেও নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে তারাই জালেম

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا آبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنِ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الْإِيمَانِ  যে ঈমানদারগণ! তোমাদের বাপ ও ভাইয়েরা যদি ঈমানের ওপর কুফরীকে প্রাধান্য দেয় তাহলে তাদেরকেও নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না 

§  শানে নুযুলঃ

বদরের যুদ্ধের ঘটনা। জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত সাহাবী হযরত আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ যুদ্ধে অংশ নেন মুসলমানদের পক্ষে আর তার পিতা অংশ নেন কাফিরদের পক্ষে। তার পিতা তার সামনে এসে মূর্তির প্রশংসা শুরু করলে হযরত আবু উবাইদাহ বারবার তার পিতাকে তা হতে বিরত রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হোন। যা এক সময় পিতাপুত্রের যুদ্ধে রূপ নেয়। এক সময় হযরত আবু উবাইদাহ তার পিতাকে কাবু করেন এবং হত্যা করে দেনএমতাবস্থায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আয়াত নাযিল করেনঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا آبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنِ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الْإِيمَانِ

§  আল্লামা ইবনে কাসীর বলেনঃ أمر تعالى بمباينة الكفار به، وإن كانوا آباء أو أبناء، ونهى عن موالاتهم এখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে নিষেধ করছেন-যদি তারা মুমিনদের পিতাও হয় কিংবা সন্তানও হয়। আর এখানে পিতা ও সন্তান বলতে সকল প্রকারের আত্মীয় স্বজন বুঝানো হয়েছে।

§  إِنِ اسْتَحَبُّوا বলতে  أي اختاروا الكفر على الإيمان ঈমানের উপর কুফরীকে প্রাধান্য দেয়া।

§  আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

لَّا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ ۚ أُولَٰئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُم بِرُوحٍ مِّنْهُ ۖ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ

হে নবী! আপনি এমন কোন কাওম পাবেন না, যারা আল্লাহর উপর ও আখেরাতের দিনের উপর ঈমান এনেছে, তারা বন্ধুত্ব রাখবে এমন ব্যক্তিদের সাথে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা. এর সাথে শত্রুতা রাখে, যদিও তারা তাদের পিতা হয় বা ছেলে সন্তান হয় অথবা ভাই কিংবা নিজের গোত্রীয় কেউএরা তারা, যাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং নিজের বিশেষ রূহ দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করেছেন। তিনি তাদেরকে এমন জান্নাত সমূহে প্রবেশ করাবেন, যার নিচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত। (সূরা আল মুজাদালাহঃ ২২)

§  তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনঃ

-          ইসলামী আকীদা বিশ্বাস মনের ভিতরেও কোন শিরক সহ্য করে না।

-          ইসলামকে হয় একনিষ্ট ভাবে গ্রহণ করতে হবে, নতুবা বর্জন করতে হবে। মাঝখানে কোন জায়গা ইসলামে নেই।

-          মনের সাথে যেখানে ইসলামের সম্পর্ক ছিন্ন হবে, সেখানে রক্ত ও বংশের সম্পর্কও ছিন্ন হবে।

-          এর মানে এই নয় যে, মা-বাবা-স্বজন, ঘর-বাড়ী, সুখ আনন্দ ত্যাগ করে বৈরাগী হতে হবে। বরং সবকিছু থাকবে। কিন্তু ইসলামের প্রতি ভালবাসা হবে একনিষ্ট ও বিশুদ্ধ।

-          এই ভালবাসা বুঝা যাবেঃ

ইসলাম ও বৈষয়িক স্বার্থ-কোনটি অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

ধন সম্পদ বনাম অহংকারী ও অপব্যয়ী-নাকি কৃতজ্ঞ।

§  তাফসীরে উসমানীতে বলা হয়েছেঃ

-          জিহাদ ও হিজরতের মতো শ্রেষ্ঠ আমলে বাঁধা হয়ে দাড়ায় আত্মীয়-স্বজন, সমাজ-পরিবেশ।

-          যে সম্পর্ক জিহাদ ও হিজরতে বিরত রাখে বা বাঁধার সৃষ্টি করে, সে সম্পর্ক গোনাহের এবং কুফরীর। বিধায় তারা গোনাহগার হয়ে নিজেদের উপর জুলুম করে।

وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ - তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে তারাই জালেম

§  তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনঃ

-          এখানে জালেম মানে মুশরিক।

-          আত্মীয়তা ও কুফরীকে ঈমানের উপরে স্থান দেয়া কুফরী।

-          যে আত্মীয় কুফরীকে ঈমানের উপর স্থান দেয়, সে আত্মীয়কে আত্মীয় হিসাবে গ্রহণ করা শিরক এবং ঈমানের পরিপন্থী।

﴿قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ﴾

২৪ হে নবী! বলে দাওযদি তোমাদের পিতাতোমাদের সন্তান ও তোমাদের ভাই তোমাদের স্ত্রী,তোমাদের আত্মীয়-স্বজনতোমাদের উপার্জিত সম্পদতোমাদের যে ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাক এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ কর-এসব যদি আল্লাহ ও তার রসূল এবং তার পথে জিহাদ করার চাইতে তোমাদের কাছে বেশী প্রিয় হয়তাহলে আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর আল্লাহ ফাসেকদেরকে কখনো সত্য পথের সন্ধান দেন না 

قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ - হে নবী! বলে দাওযদি তোমাদের পিতাতোমাদের সন্তান ও তোমাদের ভাই তোমাদের স্ত্রী,তোমাদের আত্মীয়-স্বজনতোমাদের উপার্জিত সম্পদতোমাদের যে ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাক এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ কর-এসব যদি আল্লাহ ও তার রসূল এবং তার পথে জিহাদ করার চাইতে তোমাদের কাছে বেশী প্রিয় হয়

§  বদরে আবু উবাইদাহ রা. এর পিতা হত্যার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর আল্লাহ তার রাসূলকে আদেশ দেন, যাতে তিনি সকল মুসলমানদের জানিয়ে দেন, সতর্ক করে দেন যে, তারা যেন মুমিনরা তাদের পরিবার, আত্মীয় স্বজন ও কাওমের উপর আল্লাহর, তার রাসূল ও জিহাদকে প্রাধান্য দেয়।

§  যদিও কাজটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তুবও তা করতে হবে।

اقْتَرَفْتُمُوهَاযা তোমরা উপার্জন করেছো

§  ইবনে কাসির বলেনঃ

أي اكتسبتموها وحصلتموها  - অর্থাৎ যা তোমরা উপার্জন করেছে এবং অর্জন করেছো।

تَرْضَوْنَهَا - তোমরা যা খুবই পছন্দ কর

§  ইবনে কাসির বলেনঃ

أي تحبونها لطيبها وحسنها - অর্থাৎ তা সুন্দর ও উত্তম হওয়ার কারণে তোমরা যাকে ভালবাস।

§  যুহাইর বিন মাবাদ তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি তথা তার দাদা বলেনঃ

عن زهرة بن معبد عن جده قال كنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم وهو آخذ بيد عمر بن الخطاب، فقال والله يا رسول الله لأنت أحب إلي من كل شيء إلا من نفسي، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم " لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من نفسهفقال عمر فأنت الآن والله أحب إليّ من نفسي، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم " الآن يا عمرانفرد بإخراجه البخاري،

আমরা রাসূল সা. এর সাথে ছিলাম। রাসূল সা. হযরত উমর রা. এর হাত ধরেছিলেন। হযরত উমর রা. তাঁকে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল সা.! আল্লাহর কসম! আপনি আমার নিকট আমার প্রাণ ছাড়া অন্য সবকিছু থেকে প্রিয়।” তখন রাসূল সা. বললেনঃ “তোমাদের কেউই পূর্ণ মুমিন হতে পারে না, যে পর্যন্ত আমি তার কাছে তার প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয় না হই।” হযরত উমর রা. তখন বললেনঃ “আপনি এখন আমার কাছে আমার জীবন থেকেও প্রিয়।” তখন রাসূল সা. তাকে বললেনঃ “হে উমর! তুমি এখন পূর্ণ মুমিন হলে। (বুখারী)

§  আবি আকিল জাহরাহ বিন মা’বাদ রা. তার দাদা আব্দুল্লাহ বিন হিশাম থেকে শুনে বর্ণা করেন এবং যা বিশুদ্ধ হাদীস বলে স্বীকৃত। রাসূল সা. বলেছেনঃ

عن أبي عقيل زهرة بن معبد أنه سمع جده عبد الله بن هشام عن النبي صلى الله عليه وسلم بهذا، وقد ثبت في الصحيح عنه صلى الله عليه وسلم أنه قال " والذي نفسي بيده لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده وولده والناس أجمعينوروى الإمام أحمد وأبو داود

যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তাঁর শপথ! তোমাদের কেউই পূর্ণ মুমিন হতে পারে না যে পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান এবং সমস্ত লোক অপেক্ষা প্রিয় না হই।” (আবু দাউদ)

§  আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সা.কে বলতে শুনেছিঃ

عن ابن عمر قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول " إذا تبايعتم بالعينة، وأخذتم بأذناب البقر، ورضيتم بالزرع، وتركتم الجهاد، سلط الله عليكم ذلاً لا ينزعه حتى ترجعوا إلى دينكموروى الإمام أحمد

যখন তোমরাআয়নএর ক্রয়-বিক্রয় শুরু করবে, বলদ-গাভীর লেজ ধারণ করবে এবং জিহাদ ছেড়ে দেবে। তখন আল্লাহ তোমাদেরকে লাঞ্ছনায় পতিত করবেন। আর তা ততক্ষণ পর্যন্ত দূর হবে না, যতক্ষণ না তোমরা নিজেদের দ্বীনের দিকে ফিরে আসবে।” (মুসনাদে আহমদ)

فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ – তাহলে আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর

§  ইবনে কাসির বলেনঃ

أي إن كانت هذه الأشياء أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُواْ যদি এই সব জিনিস হয় তোমাদের কাছে প্রিয় আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল এবং জিহাদ-এর চেয়ে, তাহলে অপেক্ষা করো।

فَتَرَبَّصُواْ  أي فانتظروا ماذا يحل بكم من عقابه ونكاله بكم - যে দলের প্রতি এই কথা বলা হচ্ছে, তাদেরকে সরিয়ে অন্য কোন নতুন দলকে দ্বীনের নিয়ামত দান করা হবে।

§  নতুন দলকে দ্বীনের ধারক ও বাহকের মর্যাদা প্রদান করা হবে।

§  নতুন দলকে মানুষকে সৎপথে পরিচালনা করার জন্য তাদের হাতে নেতৃত্ব প্রদান করা হবে।

وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَআল্লাহ ফাসেকদেরকে কখনো সত্য পথের সন্ধান দেন না 

§  কুরআনে কমপক্ষে ৪বার কথাটি এসেছে। যেমনঃ

-          সূরা আল মায়িদাহঃ ১০৮

-          সূরা আত তাওবাঃ ২৪, ৮০

-          সূরা আস সাফঃ ৫

§  কাওমাল ফাসিকীন কথাটা কুরআনে এসেছে কমপক্ষেঃ ৭বার। যেমনঃ

-          সূরা আল মায়িদাহঃ ২৫, ২৬, ১০৮

-          সূরা আত তাওবাঃ ২৪, ৮০, ৯৬

-          সূরা আস সাফঃ ৫

উপসংহারঃ

 




Post a Comment

0 Comments