আল্লাহর রাসূল সা. এর একটি হাদীস দিয়ে শুরু
করা যাক। হযরত উমর রা. বর্ণনা করছেন যে, আমি একদা নবী সা. এর সাথে বসা ছিলাম। এমন
অবস্থায়-
عَنْ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ كُنْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى
اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَالِسًا، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَتَدْرُونَ أَيُّ أَهْلِ الْإِيمَانِ أَفْضَلُ إِيمَانًا؟
قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ الْمَلَائِكَةُ؟ قَالَ هُمْ كَذَلِكَ وَيَحِقُّ
ذَلِكَ لَهُمْ وَمَا يَمْنَعُهُمْ وَقَدْ أَنْزَلَهُمُ اللَّهُ الْمَنْزِلَةَ
الَّتِي أَنْزَلَهُمْ بِهَا، بَلْ غَيْرُهُم، قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ
فَالْأَنْبِيَاءُ الَّذِينَ أَكْرَمَهُمُ اللَّهُ تَعَالَى بِالنُّبُوَّةِ
وَالرِّسَالَةِ، قَالَ هُمْ كَذَلِكَ وَيَحِقُّ لَهُمْ ذَلِكَ وَمَا يَمْنَعُهُمْ
وَقَدْ أَنْزَلَهُمُ اللَّهُ الْمَنْزِلَةَ الَّتِي أَنْزَلَهُمْ بِهَا، بَلْ
غَيْرُهُمْ، قَالَ قُلْنَا فَمَنْ هُمْ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ أَقْوَامٌ
يَأْتُونَ مِنْ بَعْدِي فِي أَصْلَابِ الرِّجَالِ فَيُؤْمِنُونَ بِي وَلَمْ
يَرَوْنِي وَيَجِدُونَ الْوَرَقَ الْمُعَلَّقَ فَيَعْمَلُونَ بِمَا فِيهِ
فَهَؤُلَاءِ أَفْضَلُ أَهْلِ الْإِيمَانِ إِيمَانًا
রাসূল (সা.) একবার তাঁর সাহাবিদের প্রশ্ন
করলেন, কাদের ঈমান সবচেয়ে বেশি স্বস্তিদায়ক বলে
তোমরা মনে করো? একজন বললেন, সম্ভবত
ফেরেশতাদের ঈমান সবচেয়ে নিখুঁত। নবিজি শুনে বললেন, তাঁরা
আল্লাহর ওপর ঈমান কেন আনবে না, যখন তাঁরা প্রতিনিয়তই
আল্লাহর সাথে থাকে? আরেকজন বললেন, সম্ভবত
নবিদের ঈমান সর্বোত্তম । রাসূল (সা.) বললেন, কিন্তু তাঁরা কেন
আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে না, যখন সরাসরি তাঁদের ওপরই ওহি নাজিল
হয়? এ কথা শুনে আরেকজন সাহাবি বললেন, আমরা
যারা এ প্রজন্মের ঈমানদার, তাঁদের ঈমান সবচেয়ে উত্তম। নবিজি
বললেন, তোমরা কেন ঈমান আনবে না, যেখানে
স্বয়ং আমি নিজে তোমাদের মাঝে উপস্থিত আছি । নবিজি তারপর সাহাবিদের উদ্দেশ্য করে
বললেন, যে মানুষগুলোর ঈমানের মান আমাকে সবচেয়ে বেশি স্বস্তি
দেয়, তাঁরা আমার সময়ের পরে আসবে। তাঁরা ওহিকে কাগজের
পাতায় অধ্যয়ন করবে এবং কুরআনে যে বার্তাগুলো রয়েছে, সবগুলোই
বিশ্বাস করবে।’ (তিরমিযি)
আমরা লিখিত সূত্রে ইসলাম পাওয়ার সূত্র রয়েছে। সূত্রের ক্রমধারা রয়েছে। সেই ক্রমধারার শীর্ষে যারা রয়েছেন তাদের মাঝে শীর্ষে রয়েছেনঃ হযরত আবু হুরায়রা রা., হযরত আয়শা রা.,
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমরা রা.,
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.,
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.
গং রা। এই সব সাহাবী উলামায়ে কিরাম সত্য ও সঠিক দ্বীনকে টিকিয়ে রাখা ও প্রচার প্রসারে ছাত্র তৈরী করেছেন। দ্বীনের ইলম নিয়ে চর্চার জগত তৈরী করেছেন। তারা কখনো ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন না। যারা নেতৃত্বে ছিলেন, তারা তাদের আনুগত্য করেছেন।
(প্রিয় পাঠক,
আমি সব সময় নেতৃত্বের সাথে শীর্ষ শব্দটি ব্যবহার করছি, যা মনযোগের সাথে লক্ষ্য করবেন)
খুলাফায়ে রাশেদার সময়ে ১১-৪১ হিজরী পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন হযরত আবুব বকর রা., হযরত উমর রা., হযরত উসমান রা. ও হযরত আলী রা.। তারা কি সেই সময়ের সবচেয়ে বড় আলেম ছিলেন। তাদের নেতৃত্বে আমরা ইসলাম পেয়েছি। কিন্তু তাদের মাধ্যমে কি আমরা ইসলাম পেয়েছি? সেই সময়ের বড় আলেম ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস,
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ প্রমূখ। তারা নেতৃত্বে ছিলেন।
হিজরী ৪১-১৩২ সাল অবধি ১৩জন শাসক উমাইয়া সাম্রাজ্যে শীর্ষ নেতৃত্বে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। হযরত মুয়াবিয়া রা. থেকে মারওয়ান বিন মুহাম্মদ পর্যন্ত এই শাসকদের কে সে যুগের সবচেয়ে বড় আলেম ছিলেন? সেই সময়ে উলামায়ে কিরামদের মাঝে ছিলেন সাহাবায়ে কিরামদের সাথে সাথে তাদের ছাত্র ছিলেন আনাস বিন মালিক, আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আওফা, ইমাম মালিক,
কাতাদাহ, আতা ইবনে আবু রিবাহ, ইমাম আবু হানিফা প্রমূখ।
আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে ৩৭জন শাসক শাসন পরিচালনা
করেছেন। ১৩২ হিজরী থেকে ৬৫৬ হিজরী চলমান আব্বাসীয় খেলাফতে নেতৃত্ব দিয়েছেনঃ আবুল
আব্বাস থেকে শুরু করে আল মানসুর, মাহদী, হারুন রশীদ,
মুতাসিম, মুতাওয়াক্কিল, মুতামিদ, মুতাজিদ, মুকতাদির, মুত্তাকি, থেকে মুসতাসিম
বিল্লাহ পর্যন্ত। তারা কেউ সেই সময়ের আলেম ছিলেন না। সেই সময়ের শীর্ষ আলেম ছিলেন ইমাম শাফয়ী।
তুরস্কের নেতৃত্বাধীন উসমানীয় খেলাফতের স্বপ্নদ্রষ্টা আর্তূগোল গাজী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন, তদানিন্তন সময়ের শীর্ষ আলেম ইবনুল আবারী ছিলেন তার উপদেষ্টা। প্রতিষ্ঠা উসমান গাজী ছিলেন আন্দোলনের নেতৃত্বে, সে সময়ের শ্রেষ্ঠ আলেম শায়খ এদেবালী ছিলেন তার উপদেষ্টা। ৬৯৮ থেকে ১৩৪২ হিজরী পর্যন্ত এই উসমানীয় সাম্রাজ্য ৩৭জন
শাসকের দেখা পেয়েছে। কিন্তু কেউ সেই সময়ের
বড় আলেম ছিলেন না।
যুগে যুগে ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহি. ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিযি, ইমাম নাসায়ী, ইমাম ইবনে মাযাহ, ইমাম আবু দাউদ রাহি. ইমাম তাবারী, ইমাম ইবনে কাসির, ইমাম ইবনে তাইমিয়া গংরা সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখেছেন ইলমে দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে। কিন্তু তারা কেউই ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন না।
যে উরদোগানকে নিয়ে এতো মাতামাতি, সেই উরদোগান ও তার সংগীদের উস্তাদ নুর মৌরিশী কখনো নেতৃত্বে ছিলেন না। সম্প্রতি ইনতিকাল করেছেন উরদোগানের সরাসরি উস্তাদ, যার লাশের কফিন বহন করেছেন স্বয়ং উরদোগান। সেই উস্তাদ যিনি
উরদোগানদের তৈরী করেছেন বটে, তবে কখনো ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন না। বরং হযরত আবু হুরায়রা, ইবনে আব্বাস রা.
এর মতো সাহাবীরা যে কাজ করেছেন, ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম বুখারীর মতো আলেমরা যে কাজ করেছেন, সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন।
ইখওয়ানুর মুসলিমিন এর প্রতিষ্ঠাতা ও শীর্ষ নেতা ছিলেন শহীদ হাসান আল বান্না। কিন্তু তার চেয়ে বড় আলেম শহীদ মুহাম্মদ কুতুব সাইয়েদ কুতুব।
জামায়াতে ইসলামীতে প্রতিষ্ঠাকালে একমাত্র
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রাহি. ছিলেন বড় আলেম। বাকী কেউ বড় আলেম নেতৃত্বে ছিলেন
না। শহীদ মতিউর রহমান নিজামী একজন বড় আলেম
ছিলেন। কিন্তু তিনি জামায়াতীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আলেম ছিলেন না।
এই আলোচনা থেকে আমরা কি উপসংহার পেলাম।
ইলিমের জগত খুবই কঠিন জগত। এই জগতে গবেষকের
মত লেগে থাকতে হয়। যারা লেগে থাকেন, তারা উম্মাহকে বিষয় ভিত্তিক নির্দেশনা দিতে
সক্ষম হোন। যেমন হাদীস বিষয়ক নির্দেশনা হযরত আবু হুরায়রা থেকে শুরু হয়ে সিহাহ
সিত্তার ইমামদের হাত ধরে এখন অবধি বিস্তৃত রয়েছে। হযরত ইবনে মাসউদ আর ইবনে উমর
থেকে শুরু হওয়া ফিকহের নির্দেশনা ইমাম আবু হানিফা সহ চার ইমামের হাত ধরে আজ অবধি
বিস্তুত।
এই জগতে যারা কাজ করেন, তারা শীর্ষ নেতৃত্বের
উপদেষ্টা হতে পারেন। কিন্তু তারা শীর্ষ নেতৃত্বে গেলে জাতি বড় ধরণের গবেষণা থেকে
বঞ্চিত হয়।
নেতৃত্ব বিষয়টি বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয়। সকল
সেকটরের সাথে কিছু না কিছু সম্পর্ক ও জ্ঞান অভিজ্ঞতা যার আছে, তাকেই নেতৃত্বে আসতে
হয়। যা একমূখী বা বই মূখী ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে কোন অবস্থায় সম্ভব নয়। আর যদি কোন
পরিস্থিতিতে কোন বড় মাপের আলেম নেতৃত্বে চলে আসেন, তাহলে তিনি দ্বীনি ইলমের চর্চা
ও গবেষণার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেন না।
আর সে
কারণেই কোন কালে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বে সেই যুগের কোন বড় আলেম ছিলেন না।
0 Comments