যার পীর নেই তার পীর শয়তান-কথাটা তো সত্য! – মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম

মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ যার পীর নেই তার পীর শয়তান” এই কথাটা কিছুদিন আগে ভাইরাল হয়েছিল সোস্যাল মিডিয়াতে। সম্ভবতঃ জাহাজ পীর নামে খ্যাত একজন পীর সাহেবের নাতি (গদিনশীন পীর) অথবা তার মুরিদ এই বক্তব্যটি দিয়েছিলেন। সোস্যাল মিডিয়াতে বিষয়টি প্রচারের পর ফেইসবুক জিহাদী ভাইয়েরা ঐ পীর বা তার মুরিদকে একহাত নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নামকরা নামজাদা বিখ্যাত বেশ কিছু মুফাস্সির বা ওয়ায়েজীনে কিরামও প্রচুর সমালোচনা করেছেন এ পীর বা তার মুরিদের।

আমি ব্যক্তিগত ভাবে যার পীর নেই তার পীর শয়তান” এই বক্তব্যের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আজকের লেখাটা শুরু করছি।

যে দৃষ্টি কোন থেকে পীর সাহেব বা তার মুরিদ সাহেব এই বক্তব্যে প্রদান করেছেন, সেই দৃষ্টিকোন থেকে অসংখ্য অগনিত মানুষ তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, সেই দৃষ্টি কোনটা সঠিক। তবে যারা পীর সাহেবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তাদের অধিকাংশের নিজেদের অবস্থানের আমি চরম বিরোধী এবং আমি মনে করি তাদের অধিকাংশেরই পীর হচ্ছে শয়তান। বিষয়টা একটু খোলাসা করে বলি।

পীর মানে কি? 

বাংলা বা আরবী ভাষায় পীর নামে কোন শব্দ নাই। শব্দটি হচ্ছে ফারসী ভাষা থেকে কর্জ করে নিয়ে এসে বাংলা ভাষায় সফল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফলে শব্দটা বাংলা হয়ে গিয়েছে। এখন পীর বলতে আমরা কি বুঝি? পীর বুঝার ভাল এবং খারাপ দুইটা দিক আছে। যার সারকথা এইভাবেঃ

১. পীর হচ্ছেনঃ একজন আধ্যাত্মিক সাধক, যিনি মানুষের আত্মার সংশোধনের জন্য চেষ্টা করেন, নসিহত করেন এবং আত্মার সংশোধনে উদ্যোগী মানুষের নেতা বা মুরশিদ হিসাবে তিনি গ্রহণীয় ও বরণীয়। তার অনুসারীরা মনে করেন যে, ঐ সাধক তাদের চেয়ে ইলম ও আমলে শত শত গুণ উপরে অবস্থান করছেন। বিধায়, তাকে অন্ধ ভাবে অনুসরণ করেন। অপর দিকে সাধকও ব্যক্তিগত ভাবে প্রচুর ইলমের অধিকারী এবং ব্যক্তিগত ভাবে একজন মুত্তাকী ও মুহসিন হিসাবে পথহারা মানুষ গুলোকে তিনি আল্লাহমুখী করে রাখতে, তাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করা কাজ করেন। তিনি যা বলেন, নিজের জীবনে তা করেন। জাহেলিয়াতের সয়লাবে পরিপূর্ণ সামজে তিনি মানুষের কলবকে শয়তানের প্ররোচনা থেকে বাঁচানোর জন্য ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা হিসাবে এই পথটাকে গ্রহণ করেছেন। তার প্রত্যাশা, যদি কিছু মানুষকেও এই প্রচেষ্টায় শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে বাঁচানো যায়, তাহলে কম কি? কুরআনে বর্ণিত তাজকিয়ায়ে নাফস-এর উদ্দেশ্য সাধনই এই প্রচেষ্টার লক্ষ্য। তবে তার পদ্ধতি শতভাগ রাসূল সা. এর পদ্ধতির সাথে মিলেনা বলে ইসলামী স্কলারগন একে নিম-ইসলামী তাসাউফ নামে আখ্যায়িত করেছেন।

২. প্রথম পর্যায়ের সাধক বা পীরের এই প্রচেষ্টা বিস্তৃত হওয়ার সাথে সাথে তার অনুসারীদের মাঝে দুইটি ধারা তৈরী হয়েছে। একটি ধারা সাধকের সেই ধারার সাথে শতভাগ মিল রেখেই অগ্রসর হয়েছে এবং যা অদ্যাবধি বিদ্যমান। খোলাফায়ে রাশেদার যুগ শেষ হওয়ার পর সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠা, ইনসাফ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যারা তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, তাদের আধ্যাত্মিক গুরু হিসাবে তারা কাজ করেছেন। লড়াইয়ের নায়ক যারা, তারা সব সময় ময়দানে সময় দিয়েছেন, আর তাদের সত্যিকার জানবাজ সৈনিক গড়ার জন্য এই সব সাধকরা পর্দার আড়ালে থেকে লোক গঠন করেছেন। সময়ে অসময়ে ময়দানের নায়করা তাদের দারস্ত হয়েছেন, নসিহত গ্রহণ করেছেন, রুহানী দীক্ষা গ্রহণ করেছেন, সমস্যা সংকূল সময়ে দোয়া ও দিক নির্দেশনা গ্রহণ করেছেন, ময়দানের বাহিরে তাদেরকেই নেতা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এই সব সাধকদের কখনও যুদ্ধের ময়দানে বা রাষ্ট্রের কোন পদে দেখা যায়নি। কিন্তু তারা কখনো রাষ্ট্রশক্তি বা জাহেলী শক্তির হালুয়া রুটির অংশীদার হোননি। তারা সব সময় একদল তাওহীদবাদী মানুষ তৈরীর জন্য নিজের ঢোল না পিঠিয়ে আল্লার ঢোল বাজিয়েছেন।

৩. প্রথম পর্যায়ের সাধকের অনুসারীদের দ্বিতীয় ধারাটি সময়ের বিবর্তনে প্রতিষ্ঠিত জাহেলী শক্তি বা রাষ্ট্রশক্তির হালুয়া রুটির অংশীদার হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত শাসকরা উনাদের ব্যক্তি ইমেজকে কাজে লাগিয়েছে নিজেদের মসনদকে নিরাপদ রাখতে আর এজন্য তারা এই সব সাধকদের সীমাহীন সুযোগ সুবিধা প্রদান করেছে। প্রকাশ্যে তাদের প্রতি সীমাহীন আনুগত্য প্রদর্শন করেছে। কিন্তু কৌশলে তারা সুযোগ সুবিধা দিয়ে সাধককে কিনে নিয়েছে। সাধক সুবিধা গ্রহণ করতে করতে দুনিয়ার মজা নিতে নিতে এক সময় সত্য থেকে বিমুখ হয়েছে। ধীরে ধীরে নিজের আখের গোছানোই তাদের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। তাদের অনুসারীদের সামনে নানান ধরণের পর্দা ঢেলে দেয়া হয়েছে। আর পর্দার অন্তরালে তারা তাদের অপকর্ম চালিয়ে গিয়েছে।

৪. রাষ্ট্র শক্তি যখন ইসলাম রিরুধীদের হাতে চলে গেছে, তখন দ্বিতীয় পর্যায়ের এই সাধকেরা বংশ পরম্পরায় তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে মুরিদদের সত্যিকার তাওহীদ ও রেসালাত থেকে দূরে রেখেছে। মুসলমানদের কাজ হচ্ছে জাহেলিয়াতের সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুকাবেলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করার জন্য জীবনপন লড়াই করা-এই বিষয়টি তাদেরকে তারা ভূলিয়ে দিয়েছে। তারা মুসলমানদের কাছে এই মন্ত্র উপস্থাপন করেছে যে, সারা দুনিয়াতে আজ জাহিলিয়াতের থাবা। পুরো দুনিয়াটা আজ শয়তানী বাতাসে ভরপুর। এমন অবস্থায় নিজেদের ঈমান নিয়ে বাঁচাই কঠিন। অতএব, ঈমান নিয়ে যদি বাঁচতে চাও, তাহলে মসজিদে আশ্রয় নাও আর আখেরাতে মুক্তি পেতে হলে এই অবস্থায় পীর সাহেবের জাহাজে উঠো। “যার পীর নাই তার পীর শয়তান” বক্তব্য দাতারা এই পর্যায়ের লোক।

কথা বলছিলাম পীর শব্দ নিয়ে। পীর মানে কি? ফারসী পীর শব্দের অর্থ হচ্ছেঃ বয়োজৈষ্ঠ, সুফি, আধ্যাত্মিক শিক্ষক, আরবীতে যাকে বলা হয়: হযরত, শায়খ ইত্যাদি।

সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যিনি নেতৃত্ব দেন, সেই দায়িত্বশীলকে আমরা আমীর বলে থাকি। যদি আমরা ফারসীতে বলতাম, তাহলে পীরই বলতাম। সেই বিবেচনায় পীর মানে দায়িত্বশীল। আর দায়িত্বশীলের আনুগত্যের অধীন থাকতে হয় ঈমানের দাবীদার সকলকে। হাদীসে রাসূলের বিবরণ অনুযায়ী: “যে আনুগত্য ব্যবস্থার বাহিরে চলে গেল এবং জামায়াত বা সংগঠন পরিত্যাগ করলো, অতঃপর মৃত্যু বরণ করলো। প্রকৃতপক্ষে, তার মৃত্যু হলোঃ জাহেলিয়াতের মৃত্যু”। অতএব, আমি যে মত ও পথের অনুসারী হই না কেন-আমাকে একটি সুনির্দিষ্ট আনুগত্য ব্যবস্থার অধীনে থাকতেই হবে-একজন দায়িত্বশীলের আনুগত্যের অধীনে থাকতে হবে, আমার জবাবদিহিতার জায়গা থাকতে হবে। আমার জবাবদিহিতা যার হাতে ন্যস্ত করবো, তার হাতে আমার বাইয়াত থাকতে হবে। তিনিই আমার দায়িত্বশীল-তিনিই আমার পীর।

যার পীর নেই তার পীর শয়তান”-এই বক্তব্যটাকে বিবেচনায় নিয়ে আমরা যদি ফেইসবুক জিহাদী ভাইদের পীর বা দায়িত্বশীলের খোঁজ করি, তাহলে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখবো, ফেইসবুক জিহাদী ভাইদের কোন দায়িত্বশীল নাই। ফেইসবুক জিহাদী ভাইয়েরা নিজের মতো করে যে কোন বিষয় আলোচনা করেন, সমালোচনা করেন, ব্যাখ্যা করেন, প্রতিবাদ করেন। তার এই অবস্থানের ক্ষেত্রে কোন ধরণের কোন জবাবদিহিতা নাই। তাকে জবাবদিহির সম্মুখীন করবে, এমন কাউকে উনি মানেন না অথবা এমন কারো কাছে উনি নিজেকে সপে দেননি।

ঐ সব ফেইসবুক জিহাদী ভাইয়েরা প্রতিদিন শত শত কমেন্ট করেন, অনেক অনেক পোষ্ট করেন, অনেক আলোচনা সামালোচনা ও বিতর্কে অংশ নেন। এই সব কাজ করতে গিয়ে সময় মতো উনার নামাযটাও পড়া হয়না। প্রতিদিনের মুয়াজ্জিনের আহবানে উনাকে মসজিদে দেখা যায় না, নিজের আত্মগঠনের জন্য কুরআন অধ্যয়ন, হাদীস অধ্যয়ন, ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন ইত্যাদিতে উনার আমল নামা ফাঁকা। সত্য ও সুন্দরের পথে মানুষকে আহবান করার কাজে উনার অংশ গ্রহণ নাই মাসের পর মাস, বছরের পর বছর থেকে। জাহেলিয়াতের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে যখন মানুষ হুলিয়া মাথায় নিয়ে নির্বাসিত জীবন যাপন করে, যখন মানুষ কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিনাতিপাত করে, আদালতের বারান্দায় দৌড়াতে দৌড়াতে সেন্ডেল তলানিতে এসে যায়, আহত হয়ে স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করে অথবা হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর প্রহর গুনে, স্বামী স্ত্রী নিজের সকল উপার্জন সেই সব মানুষের সহায়তায় উজাড় করে দিয়ে এক ডিম দুই জনে ভাগ করে খায়, তখন তিনি এই সব খবর গর্বের সাথে ফেইসবুকে শেয়ার করে তৃপ্তির হাসি হাসেন। কিন্তু তার পশমে একটি বারের জন্য সেই সব আঁচর লাগেনা, এই সব মানুষের জন্য রাতের অন্ধকারে তার চোঁখ থেকে একদিনের জন্যও অশ্রু ঝরে না। সেই সব মানুষের সহায়তা বা চিকিত্সার জন্য উনার পকেটের একটি পয়সাও খরচ হয়না। উনি তখন দিব্যি আরামে স্বপরিবারে কোন দর্শনীয় স্থান উপভোগের ছবি আপলোড করতে ব্যস্ত।

আমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর দায়িত্বের ব্যাপারে জবাবদিহিতা রয়েছে, স্ত্রী জবাবদিহি করে তার স্বামীর কাছে, সন্তান তার অভিভাবকের কাছে, কর্মীর নেতার কাছে, দায়িত্বশীল তার উর্ধতনের কাছে। সকল আমীর (দায়িত্বশীল)কে জবাবদিহি করত হয় আমীরে জামায়াত (সংগঠনের মূল দায়িত্বশীল) এর কাছে। এমনকি আমীরে জামায়াতকেও জবাবদিহি করতে হয় মজলিসে শুরার কাছে।

সেই সব ফেইসবুক জিহাদী ভাইদের প্রতি জিজ্ঞাসাঃ আপনার পীরকে-আপনার দায়িত্বশীলকে, আপনার জবাবদিহিতার স্থানটা কোথায়? যার কোন জবাবদিহিতার কেন্দ্র নাই, তার জবাবদিহিতা শয়তানের কাছে। পীর সাহেব ঠিকই বলেছেনযার পীর নাই, তার পীর শয়তান।

১৩ মে ২০২১


Post a Comment

0 Comments