সত্য ও সুন্দরের পথে অবিরাম পথ চলা-১১
মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ ১৯৮৬ সালের কথা। তখন শিবিরে পুরো একটিভ হলেও ফুলতলীর মুরিদ
হান্ডেডে হানডেড। সেই সুবাধে গতকাল গিয়েছিলাম তালিমপুরের ওয়াজ মাহফিলে।
যেখানকার প্রধান অতিথি ছিলেন ফুলতলী সাহেব কিবলা। তালিমপুরের জাহিদ
চাচার বাড়ীতে রাতে থাকা এবং খাওয়া দুইটাই হয়েছে। কারণ উনার ছেলেদের একজন আমার
ক্লাশমিট আর আরেকজন বাল্যবন্ধু। তালিমপুরের ওয়াজের পরদিন ফুলতলী সাহেবের মাহফিল
চান্দগ্রামে। তখনকার সময়ে আর এখনকার সময়ে চান্দগ্রাম ফুলতলী সাহেবের বড় মারকায। এবারের
চান্দগ্রামের মাহফিলের একটি বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে। আর তা হলোঃ এখানে দূ’জন
ব্যতিক্রমী অতিথি আছেন। একজন ফরিদপুরের মাওলানা এমদাদুল হক আর আরেকজন সিলেট
আলীয়া মাদ্রাসার কিংবদন্তী মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল মালিক সাহেব। আব্দুল
মালিক সাহেবের বিষয়টি তেমন আলোচিত না হলেও এমদাদুল হক সাহেব আপাদমস্তক
জামায়াতী ঘরনার ওয়ায়েজ হিসাবে সর্বমহলে পরিচিতি। সাধারণতঃ সেই সময়ে
এমদাদুল হক সাহেব যেখানে যান, সেখানে তিনি প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন।
কিন্তু চান্দগ্রামে আজ তিনি বিশেষ অতিথি। আর প্রধান অতিথি হলেন ফুলতলী
সাহেব কিবলা। এমদাদুল হক সাহেব চান্দগ্রামের মাহফিলে আসা স্বাভাবিক
বিষয় নয়। কিন্তু সেই সময়ে চান্দগ্রামে প্রচন্ড প্রতাপশালী ২জন মুরব্বীর
একজন জনাব আলহাজ্ব মুহিবুর রাহমান এবং অপর জন জনাব আব্দুল ওয়াহিদ গ্রাম
সরকার (আমার আব্বা) উদ্যোগী হয়েছেন তাদেরকে মেহমান করতে। উনাদের কথা ফেলা
যাবে, তদানিন্তন
সময়ে এমন দূঃসাহসী মানুষ চান্দগ্রামে ছিলেন না। সেই সময়ে ভিতরে
ভিতরে কলকাটি নাড়ছিলেন ডা. লুৎফুর রহমান। এই
বিশেষ আকর্ষণে চান্দগ্রামের মাহফিলটা বিশেষ আকর্ষণীয় এবং সেই সাথে লোকে লোকারণ্য
হয়ে উঠে। আমার জানামতে চান্দগ্রামের ইতিহাসে ওটাই সর্বাধিক লোকের উপস্থিতিতে
মাহফিল। মাওলানা এমদাদুল হক সাহেব জোহর নামাযের পরপরই বক্তব্য রাখার
কথা। আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম যে, মাহফিলে মারামারি হবে। আর মারামারি উপভোগ
করার লোভে একদম মঞ্চের কাছেই আসন নিয়ে বসে পড়লাম। চান্দগ্রামের
মাহফিলের একটা রেওয়াজ আছে। আর তা হলো, যে বক্তা যখনই বক্তব্য রাখেন
না কেন, যখন
ফুলতলী সাহেব মঞ্চে পৌছবেন, তখন ঐ বক্তা সাথে সাথে তার বক্তব্য
শেষ করে ফুলতলী সাহেবের চেয়ারের পাশে মেঝেতে বসে পড়বেন। ফুলতলী সাহেব
মঞ্চে আসার পর তাকে এহতেরাম করে কাচুমাচু করবেন। আর ফুলতলী সাহেব আনলিমিটেড
সময় ওয়াজ করবেন। যথারীতি জোহরের নামাযের পরপর এমদাদুল হক সাহেব আসলেন।
মঞ্চে আরোহন করলেন। শুরুতেই তদান্তিন সময়ের মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল মাওলানা
আব্দুর রাহমান (বর্ণির হুজুর) ভূমিকা প্রদান করলেন। বললেন, ঈমান
আমল সম্পর্কে বয়ান রাখান জন্য। এমদাদুল হক সাহেব তার স্বাভাব সুলভ নিয়মে ওয়াজ শুরু
করলেন। কুরআন দেখে দেখে প্রথমে তেলাওয়াত করলেন এবং তেলাওয়াতকৃত আয়াত
গুলোর উপরে আলোচনা করলেন। তার আলোচনার এক পর্যায়ে উপস্থিত জনতা আন্দোলিত
হয়ে তার সমর্থনে বারবার শ্লোগান দিল। হঠাৎ
করে মাহফিলের চিত্র পালটে গেল। দেখা গেল কিছু অতি উৎসাহী পাবলিক মঞ্চে উঠে
গেলো। মঞ্চে একধরণের বিশৃংখল অবস্থা সৃষ্টি হয় হয় অবস্থা। লক্ষ্য করে দেখা
গেল জনাব ফুলতলী সাহেব এসে গেছেন। দূর থেকে তার গাড়ীর বহর দেখা যাচ্ছে।
এখন তাকে ইসতিক্ববাল করে শ্লোগান দিতে হবে “ফুলতলী সাহেবের আগমন-শুভেচ্ছা
স্বাগতম, সাহেব
কিবলার আগমন-শুভেচ্ছা স্বাগতম”। তাই
আশেকান ও মুরিদানরা মঞ্চে উঠে গেছে। রীতি অনুযায়ী এখন মাওলানা
এমদাদুল হক বক্তব্য বন্ধ করে আশেকানদের মাইক দিয়ে ইনি সাহেব কিবলাকে
কদমবুছি করে তার চেয়ারের পাশে মেঝেতে বসে যাওয়া। কিন্তু এমদাদ সাহেব তা করলেন
না। বরং শত বছরের রীতির বদলে তিনি নিজেই শ্লোগান ধরলেন। উপস্থিত জনতা
তার সাথে গলা মিলিয়ে সাহেব কিবলাকে স্বাগতম জানালো। ফুলতলী সাহেব মঞ্চে
আসন গ্রহণ করলেন। মাওলানা এমদাদুল হক তার চেয়ারে আসন নিলেন এবং ফুলতলী
সাহেবকে পাশে বসিয়ে তার অসমাপ্ত বক্তব্যের দিকে চলে গেলেন। যথারীতি তার
বক্তব্য এগুতে থাকলো, আর ফুলতলী সাহেব রীতিমতো রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন।
চান্দগ্রাম মাদ্রাসার ইতিহাসে এই প্রথম কোন বক্তা তার নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সাথেই তাকে
বক্তব্য শেষ করতে হলো। যখন এমদাদুল হক সাহেবের বক্তব্যের সময়
শেষ হলো, সাথে
সাথে বর্ণির হুজুর কানে কানে সময় শেষ হয়ে গেছে বলে আওয়াজ দিয়ে
তাকে শেষ করতে বললেন। কিন্তু ওখানেও রীতিমতো আরেকটি বেয়াদবী করলেন
এমদাদ সাহেব। প্রথম বেয়াদবী হলো সাহেব কিবলার পাশে চেয়ারে বসে ওয়াজ করা।
আর এখনকার বেয়াদবী হলো সাহেব কিবলার উপস্থিতিতে নিজে মুনাজাত পরিচালনা করা। এমদাদুল
হক সাহেবের ওয়াজ শেষ হলো। তিনি তার আবাসে চলে গেলেন। যাওয়ার সময়ে দেখলাম
শতাধিক লোক তাকে অনুসরণ করে তার পিছুপিছু যাচ্ছে। আমি একজন মুরিদে ফুলতলী
হিসাবে মাহফিলে বসে থাকলাম। ফুলতলী সাহেব আসন গ্রহণ করলেন। ইতিমধ্যে তাকে নিয়ে
বেশী সম্মাণ দেখাতে গিয়ে তার একজন মুরিদ এমদাদুল হক সাহেব যে কুরআন শরীফ দেখে
কুরআন তিলওয়াত করেছিলেন, সেই কুরআন শরীফের উপরে মাহফিলে ব্যবহৃত টেবিল গড়িটি
রেখে দিয়েছে। ফুলতলী সাহেব বক্তব্যের শুরতেই সেই কুরআন শরীফ হাতে
নিলেন এবং বললেন, ওটা নিয়ে যাও, শিয়ারা আল্লাহর রাসুলের যুগে কুরআন দেখিয়ে দেখিয়ে
ওয়াজ করতো। সেদিনের মাহফিল চান্দগ্রামের অন্যান্য মাহফিলের ন্যায়
মাহফিল ছিল না। ওখানে ফুলতলীকে ভালবাসেন না এমন মানুষ অনেক ছিলেন। উপস্থিত
জনতার মাঝে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম। বিশাল সংখ্যক মানুষ
তার এই বক্তব্য শুনার পরপর মাহফিল থেকে উঠে গেলো। আমি
তখন কম বয়সী ও আশেক এবং মুরিদ শ্রোতা হিসাবে বসে থাকলাম। কিন্তু আমার কম
জানার মাঝে এমন জানা ছিল যে, শিয়া সম্প্রদায়ের শুরু হয়েছে হযরত আলী রা. এর
সময়ে। তাহলে আল্লাহর রাসূল সা. এর সময়ে শিয়া কোথা থেকে আসলো? আমি এ প্রশ্ন
করার মতো সাহসী ছিলাম না। আজ অবধি কাউকে সে প্রশ্ন করার সুযোগ পাইনি।
0 Comments