মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ সবেমাত্র সাথী হয়েছি। ১৯৮৭ সালের শুরুর কথা।
থাকতাম বড়লেখার দক্ষিণ ভাগে। তখনকার সময় দক্ষিণভাগের টিলাবাজার
মসজিদ ছিল আমাদের সকল প্রোগ্রামের কেন্দ্রস্থল। কারণ তখনকার থানা সভাপতি ও
সেক্রেটারী জনাব গৌছ উদ্দিন ভাই ও ইসলাম উদ্দিন ভাই ঐ এলাকায়ই থাকতেন, গাংকুল মাদ্রাসায় পড়তেন। সেই সময় আমাদের যাতায়াতের বাহন ছিল লাতুর ট্রেন আর বাই সাইকেল অথবা
পায়ে হাটা। সারা উপজেলায় মাত্র ১টা বাই সাইকেল ছিল।
কোন কারণে আমি আগের দিন সুজাউল এলাকায় চলে গেলাম। পর দিন ছিল সাথী বৈঠক। জেলা সভাপতি আনোয়ার ভাই সে বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন এমনই কথা আছে। তিনি লাতুর ট্রেনে এসে দক্ষিণ ভাগে পৌছবেন আর ফিরতি ট্রেনে সুজাউল বড়লেখা এলাকার সাথীরা বৈঠকে হাজির হবেন।
আমি সুজাউল থেকে পরদিন সকালে মুড়াউল
স্টেশনে পৌছলাম। কিন্তু ডাক্তার আসিবার পূর্বে যেমন রুগী মারা যায়, আমি স্টেশনে পৌছবার পূর্বেই লাতুর ট্রেইন স্টেশন ছেড়ে চলে গেল।
আমি তখন নতুন সাথী। শরীরে গরম রক্ত। মনে
দারুন আবেগ। সাথে সাথে সিদ্ধান্ত। পায়ে হেটে দক্ষিণ ভাগের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
মুড়াউল থেকে বড়লেখা তার পর কাঠালতলী, তার পর গাংকুল হয়ে ঠিলাবাজার মসজিদ। একটুও ক্লান্ত
হচ্ছিলাম বটে। তবে মনের মাঝে দারুন আবেগ। জেলা সভাপতি যখন জানবেন তার একজন সাথী প্রায় ১০/১২ মাইল
পায়ে হেটে বৈঠকে উপস্থিত হয়েছে, তখন সাংঘাতিক খুশী হবেন, সীমাহীন
বাহবা দেবেন-এমন চিন্তা নিয়ে জোর কদমে হাটছি।
এক সময় দীর্ঘ পথ ফাঁড়ি দিয়ে আমি
ঠিলাবাজার সমজিদে পৌছলাম। যখন পৌছলাম তখন বৈঠক শেষ হয়ে গেছে।
সবাই মুনাজাত করছেন। আমিও মুনাজাতে শরীক হলাম। আর ভাবতে থাকলাম, কিছুক্ষণ পরই জেলা সভাপতি আনোয়ার ভাইয়ের
শুভেচ্ছা আর অভিনন্দনে আমি অভিষিক্ত হবো।
মুনাজাত শেষ হলো। জেলা সভাপতি আনোয়ার ভাই আমার দিকে তাকালেন। বৈঠকে উপস্থিতি হতে
দেরী হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আমি স্ববিস্তারে পুরো
ঘটনা খুলে বললাম। বললাম ১০/১২ মাইল পায়ে হেটে বৈঠকে
উপস্থিত হতে গিয়ে আমার দেরী হয়ে গেলো।
তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, যে ট্রেইনটা আপনি মিস করলেন,
সেই ট্রেইন কি মুড়াউল স্টেশন থেকে খালি এসেছে?
নাকি মুড়াউল স্টেশনে আরো পেসেঞ্জার ট্রেইনে উঠেছে? আমি বললামঃ অবশ্যই অনেক পেসেঞ্জার উঠেছে। তিনি
বললেনঃ যারা ট্রেইনে উঠেছে, তারা তাদের কাজকে গুরুত্ব দিয়েছে বলে তারা ট্রেইন ছাড়ার আগেই স্টেশনে পৌছেছে। আর আপনি বৈঠককে ততটুকু
গুরুত্ব দেননি বলে আপনি স্টেশনে পৌছার পূর্বেই ট্রেইন
ছেড়ে দিয়েছে।
তার এই বক্তব্য আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। ১০/১২ মাইল হাটা বাহবা আর অভিনন্দন
প্রত্যাশী এক কিশোরের মুখে এক বিশাল চপোটাঘাত। এমন আঘাত,
যা আমার জীবনে বিশাল এক টনিকের কাজ করলো। আমার জীবনের দৃষ্টিভংগীকে উল্টে দিল। আমার জীবনের জন্য বিরাট একটা শিক্ষা
হয়ে গেল।
সেই শিক্ষার কারণে আমি আজ দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করতে পারি যে, সেই দিন থেকে আজ অবধি আমি কোন বৈঠকে ১মিনিট
দেরী করেছি, এমন নজির নাই। আমি দেখেছি, যদি সময় মতো উপস্থিত হওয়ার নিয়ত থাকে, তাহলে শত সমস্যার মাঝেও যথা সময়ে উপস্থিত হওয়া যায়।
আনোয়ার ভাইয়ের একদিনের এই কড়াকড়ি সারা
জীবনের জন্য শিক্ষা হয়ে রইল। আজও যখন কাউকে প্রোগ্রামে দেরীতে উপস্থিত হতে দেখি, তখন আনোয়ার ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। জীবনের বাঁকে বাঁকে আনোয়ার ভাইকে স্মরণ হয়। আজ আনোয়ার ভাই
সিলেট জেলা উত্তরের আমীর। অনেক বছর আগে আনোয়ার ভাইয়ের সাথে উনার অফিসে একবার সাক্ষাৎ
হয়েছিল। আনোয়ার ভাইয়ের কালো চুল আর কালো দাড়ি সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু আনোয়ার ভাইয়ের সেই চলা,
বলার ধরণ আর প্রকৃতি, সেই ভালবাসা, সেই আন্তরিকতা সেই
আগের মতোই রয়ে গেছে।
২০২০, মার্চ ৩১
0 Comments