তেলাওয়াত ও
অনুবাদঃ
﴿
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ﴾
১. নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে মু’মিনরা।
﴿الَّذِينَ
هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ﴾
২. যারা নিজেদের নামাযে বিনয়াবনত হয়।
﴿وَالَّذِينَ
هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ﴾
৩. বাজে কথা থেকে দূরে থাকে।
﴿وَالَّذِينَ
هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ﴾
৪. যাকাতের পথে সক্রিয় থাকে।
﴿وَالَّذِينَ
هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ﴾
৫. নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।
﴿إِلَّا
عَلَىٰ أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ﴾
৬. নিজেদের স্ত্রীদের ও অধিকারভূক্ত বাঁদীদের
ছাড়া, এদের কাছে (হেফাজত না করলে) তারা তিরস্কৃত
হবে না।
﴿فَمَنِ
ابْتَغَىٰ وَرَاءَ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْعَادُونَ﴾
৭. তবে যারা এর বাইরে আরো কিছু চাইবে তারাই
হবে সীমালংঘনকারী।
﴿وَالَّذِينَ
هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ﴾
৮. নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।
﴿وَالَّذِينَ
هُمْ عَلَىٰ صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ﴾
৯. এবং নিজেদের নামাযগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করে।
﴿أُولَٰئِكَ
هُمُ الْوَارِثُونَ﴾
১০. তারাই এমন ধরনের উত্তরাধিকারী যারা।
﴿الَّذِينَ
يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾
১১. নিজেদের উত্তরাধিকার হিসেবে ফিরদাউস লাভ
করবে এবং সেখানে তারা থাকবে চিরকাল।
সূরার নামকরণ
§ প্রথম আয়াত﴿ قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ﴾ এর الْمُؤْمِنُونَ শব্দকে নাম
হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে।
নাযিল
§ বর্ণনাভংগি ও বিষয়বস্তু বলে সূরাটি মক্কী যুগের মাঝামাঝি সময়ের।
§ প্রেক্ষাপট বলে দেয়ঃ তখনকার সময়, যখন নবী সা. আর কাফেরদের মাঝে ভীষণ সংঘাত
চলছিল। তবে নিপীড়ন চরমে পৌছেনি।
§ ৭৫-৭৬ নম্বর আয়াতের সাক্ষ্য-মক্কী যুগের মধ্যবর্তী সময়ে যখন ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ
দেখা দেয়, তখন সূরাটি নাযিল হয়।
§ ৭৫ নং আয়াত-﴿وَلَوْ رَحِمْنَاهُمْ وَكَشَفْنَا مَا بِهِم
مِّن ضُرٍّ لَّلَجُّوا فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ﴾ যদি আমি তাদের
প্রতি করূণা করি এবং বর্তমানে তারা যে দুঃখ-কষ্টে ভূগছে তা দূর করে দেই, তাহলে
তারা নিজেদের অবাধ্যতার স্রোতে একেবারেই ভেসে যাবে।
§ ৭৬ নং আয়াত-﴿وَلَقَدْ أَخَذْنَاهُم بِالْعَذَابِ فَمَا اسْتَكَانُوا
لِرَبِّهِمْ وَمَا يَتَضَرَّعُونَ﴾ তাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, আমি
তাদেরকে দুঃখ কষ্টে ফেলে দিয়েছি, তারপরও তারা নিজেদের রবের
সামনে নত হয়েছি এবং বিনয় ও দীনতাও অবলম্বন করে না।
§ উরওয়াহ ইবনে যুবাইরের বর্ণনা মতে-হযরত উমর রা.এর ইসলাম গ্রহণের পূর্বে এ সূরা
নাযিল হয়।
§ আব্দুর রহমান ইবনে আব্দুল কারীর বরাত দিয়ে হযরত উমর রা.এর উক্তি-এ সূরাটি তাঁর
সামনে নাযিল হয়। ওহী নাযিলের সময় নবী সা.এর অবস্থা কি রকম হয়, তা তিনি
স্বচক্ষে দেখেছিলেন। এ অবস্থা অতিবাহিত হবার পর নবী সা. বলেন, এ সময় আমার উপর এমন দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে যে, যদি
কেউ সে মানদন্ডে পুরোপুরি উতরে যায়, তাহলে সে নিশ্চিত
জান্নাতে প্রবেশ করবে। তার পর তিনি এ সূরার প্রাথমিক আয়াতগুলো শোনেন।
আলোচ্য বিষয়
§ সূরার কেন্দ্রীয় কথা-রাসূল সা.এর আনুগত্য।
§ যা আলোচিত হয়েছেঃ
১. সূরার সূচনা হলো, নবীর কথা
যারা মেনে নেবে, তাদের মাঝে যে সব গুণ সৃষ্টি হবে। আর এরা
দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভের অধিকারী।
২. নবী সা. এর দাওয়াতঃ তাওহীদ ও পরকাল
মেনে নেয়ার দাওয়াত। এই দাওয়াতের পক্ষে সাক্ষ্য হিসাবে নিজেদের সত্তা ও
বিশ্ব-ব্যবস্থাকে অকাট্য সাক্ষ্য দেখানো হয়েছে। উদাহরণ দেয়া হয়েছে-মানুষ, আসমান-যমিন,
উদ্ভিদ, জন্তু জানোয়ার ও বিশ্বলোকের অন্যান্য
নিদর্শনাবলী সৃষ্টিকে।
৩.পূর্ববর্তী নবী ও
তাদের উম্মতদের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। যদিও তা কিস্সা-কাহিনী, কিন্তু
আসল লক্ষ্য জরুরী কিছু কথা শ্রোতাদের কান পর্যন্ত পৌছানো। যেমনঃ
ক. মুহাম্মদ সা.এর
ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ, প্রশ্ন ও আপত্তি-এগুলো পুরাতন জিনিস। পূর্ববর্তী নবীদের তোমরা
আল্লাহ প্রেরিত বলে বিশ্বাস করো। ইতিহাস বলে প্রশ্ন উত্তাপানকারীরা হকপন্থী ছিল
না।
খ. তাওহীদ ও পরকাল
সম্পর্কে মুহাম্মদ সা.এর শিক্ষা পূর্ববর্তী সকল নবীদের শিক্ষার মতই।
গ. যারা নবীদের কথা
না শুনে বিরোধীতা করেছে, তারাই শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছে।
ঘ. আল্লাহর নিকট
থেকে সব সময় একই দ্বীন এসেছে। দুনিয়ার যত ধর্ম দেখা যাচ্ছে, তা সবই
মনগড়া। এ সবের কোনটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে নাই।
৪. কাহিনী বলার পর
বলা হয়েছে, দুনিয়ার ভাল অবস্থা বা স্বচ্ছলাতা যেমন হকপন্থী হওয়ার প্রমাণ নয়, একই ভাবে দুনিয়ার খারাপ অবস্থা বা আর্থিক অস্বচ্ছলতা একথার প্রমাণ নয় যে,
আল্লাহ তার আচার আচরণে অসন্তুষ্ট। রবং এসব ঈমান, আনুগত্য ও ন্যায়বাদিতার উপর নির্ভরশীল। আর এ কথা বলার কারণ অবস্থা
সম্পন্নরা ঈমান আনে নাই, কিছু গরীব ঈমান এনেছিল।
৫. নবী সা. এর
নবুয়াতের প্রতি মক্কাবাসীর আশ্বস্তি ও বিশ্বাস তৈরীর চেষ্টা করা হয়েছে। সতর্ক করা হয়েছে দূর্ভিক্ষের প্রতি এই বলে যে, এটি একটি
হুশিয়ারী। আর তা দেখে সতর্ক হওয়া উচিত। নতুবা কঠিন শাস্তি নামিয়া আসবে, তখন আত্মরক্ষা করা যাবেনা।
৬. দুনিয়াব্যাপী
ছড়িয়ে থাকা এবং নিজের মাঝে অবস্থিত নিদর্শন সমূহের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে
যে, তাওহীদ আর আখেরাতের প্রতি নবী সা. যে দাওয়াত দিচ্ছেন, দুনিয়ার নিদর্শন সমূহ থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
৭. নবী সা. এর প্রতি
হেদায়াত-খারাপ আচরণের প্রতিরোধ হবে ভাল পন্থায়। খারাবের জওয়ার খারাব দিয়ে দেবার
জন্য শয়তান উত্তেজিত করতে পারে, এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
৮. উপসংহার টানা
হয়েছে, সত্য ও হক দ্বীন বিরোধী লোকদের
পরকালের জবাবদিহি সম্পর্কে ভয়
দেখিয়ে। আর তাদের সাবধান করে বলা হয়েছে যে,
দ্বীনের দাওয়াত ও তার অনুসারীদের সাথে যা করতেছো, একদিন শক্ত করেই তার হিসাব নিকাশ নেয়া হবে।
ব্যাখ্যা
﴿ قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ﴾
১. নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে মু’মিনরা।
§ الْمُؤْمِنُونَ ঈমান গ্রহণকারী মানেঃ
১. যারা মুহাম্মদ সা.এর দাওয়াত কবুল করেছে।
২. যারা মুহাম্মদ সা.কে পথ প্রদর্শক ও নেতা মেনে নিয়েছে।
৩. যারা মুহাম্মদ সা. উপস্থাপিত জীবন যাপন পদ্ধতি অনুসরণ করে চলতে প্রস্তুত।
§ قَدْ
أَفْلَحَ
১. أفلح
কল্যাণ অর্থ সাফল্য ও স্বাচ্ছন্দ।
২. أفلح
এর বিপরীত শব্দ خسران বা ক্ষতি ও ব্যর্থতা।
৩. ভাংড়া-চোরা,
ক্ষতি-নোকসান ও বঞ্চনার উল্টা অর্থ বুঝাতে أَفْلَحَ শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন- أَفْلَحَ
الرجل
বলতে সফল ব্যক্তিকে বুঝাই।
৪. قَدْ أَفْلَحَ মানে নিশ্চয়ই
নিঃসন্দেহে সাফল্য পাইয়াছে।
§ قَدْ
أَفْلَحَ
বলে ভাষণ শুরুর কারণঃ
১. সে সময় ইসলামী দাওয়াতের বিরোধী ছিল মক্কার সরদারেরা। ব্যবসা, ধন-সম্পদ, জীবন
যাত্রার মান ছিল উন্নত মানের।
২. ইসলামী দাওয়াত গ্রহণকারীদের অবস্থা ছিল- তারা ছিলেন গরীব, অস্বচ্ছল।
আর যারা ছিল স্বচ্ছল,
তারা প্রথমোক্ত লোকদের বিরোধীতার কারণে খারাপ অবস্থার
সম্মূখীন হয়ে যায়।
৩. ভাষণের শুরুতেই قَدْ أَفْلَحَ বলে ব্যর্থতা ও সফলতার বর্তমান প্রতিষ্ঠিত মানদন্ডে আঘাত করা হলো যে, এটা
সম্পূর্ণ ভূল। বরং সুদূর প্রসারী দৃষ্টি না থাকার কারণেই মূলতঃ এ দৃষ্টিভংগীর
সৃষ্টি হয়েছে।
৪. قَدْ أَفْلَحَ বলে বুঝানো
হয়েছে যে, মুহাম্মদ সা.এর অনুসরণই দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের মাধ্যম। তার অনুসরণের মাঝে
কোন ব্যর্থতা নেই।
৫. قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ এ সূরা
কেন্দ্রীয় কথা। বাকী সব আলোচনা মূলত এই
বিষয়টি বুঝানোর জন্য আলোচিত হয়েছে।
﴿الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ﴾
২. যারা নিজেদের নামাযে
বিনয়াবনত হয়।
§ الذين তথা যারা বলতে ৯ম
আয়াত পর্যন্ত ঐ মুমিনদের কথা বলা হচ্ছে, যারা সফল হয়ে গেছে। এখানে ঐ মুমিনদের গুণাবলী আলোচনা শুরু
হচ্ছে। আর তার কারণঃ
১. এটা “মুমিনরা সফল হয়ে গেছে” নামক দাবীর প্রমাণ বিশেষ। অর্থাৎ ঈমান গ্রহণ
করে প্রকৃত পক্ষে ঐ সব গুনাবলী অর্জন করা কারণে মহা কল্যাণের অধিকারী হয়েছে।
২. এটা একটা দৃষ্টি আকর্ষণ যে, যাদের মাঝে এসব গুণ আছে, তারা সফল হবেনা তো কে সফল হবে। এসব গুণের অধিকারী কেহ
ব্যর্থ বা অসফল হতে পারেনা।
§ خشعون
o خشــوع অর্থ কারো সামনে বিনয়াবনত হওয়া, বিনীত হওয়া, লুন্ঠিত হওয়া,
নিজের
কাতরতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করা।
o خشوع নামক অবস্থার সম্পর্ক দিল ও দেহ দূ’টির সাথে।
o দিলের খুশুঃ দিলের খুশু হয় তখন,
যখন
কারো ভীতি, মহানত্ব, বড়ত্ব ও দাপটে দিল ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে।
o দেহের খুশুঃ দেহের খুশু হয়ে তখন,
যখন
বড় কারো সামনে গেলে মস্তিষ্ক অবনমিত হওয়া,
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ
শিথিল হওয়া, চক্ষু অবনমিত
হওয়া, আওয়াজ ক্ষীন হওয়ার অবস্থা
হয়।
o খুশুর বুঝাতে হাদীসঃ
رأى رسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليهِ
وسلَّم رجلًا يعبثُ بلحيتِه في الصلاةِ فقال: لوخشع قلبُ هذا لخشعتْ جوارحُه .
এক ব্যক্তির নামাযে দাড়ি নিয়ে খেলা করছিল। রাসূল সা. বললেনঃ “এ ব্যক্তির দিলে
যদি খুশু থাকতো, তাহলে তার অংগ প্রতংগের উপর খুশু
পরিলক্ষিত হতো।
o দেহের খুশুর জন্যঃ ইসলামী শরিয়াত নামাযের জন্য শারিরিক কিছু নিয়ম নির্দিষ্ট
করেছে, তা দিলের খুশুর অনুকুল।
o দিলের খুশুর জন্যঃ নামাযের বাহিরের অপ্রাসঙ্গিক বিষয় চিন্থা না করা। সব সময়
দিলকে আল্লাহর দিকে রাখা। দোয়া কালাম দিল থেকে বলা। কোন চিন্থা মনে আসলে দিলকে
ফিরাইয়া আনা।
﴿وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ﴾
৩. বাজে কথা থেকে দূরে থাকে।
§
لغو হলো এমন সব কথা, যা অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন, নিষ্ফল।
§ معرضون
১. এর অর্থ তাফহীমে করা হয়েছে “দূরে সরিয়া থাকে”। অর্থাৎ তারা বাজে বেহুদা কাজ
বা জিনিসের প্রতি খেয়াল দেয় না।বাজে বেহুদা জিনিসের দিকে যায়না। আকৃষ্ট হয়না। বাজে জিনিসের মূখামুখী হলে আত্মরক্ষা করে।
২. সূরা ফুরকানে বলা হয়েছেঃ ﴿ وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا
كِرَامًا﴾ মানে ‘তারা যদি এমন কোন স্থানে চলে যায়, যেখানে বেহুদা কাজ বা কথা হচ্ছে, তা হলে
সেখান থেকে তারা আত্মমর্যাদা রক্ষা করে চলে।
৩. এটি মুমিনের একটি চরিত্র বৈশিষ্ট। প্রকৃত মুমিন সব সময় দায়িত্ববোধ সম্পন্ন।
বিধায় সে তার সময়কে গুরুত্ব দেয় পরীক্ষার হলের মতো। দুনিয়াকে পরীক্ষাগার মনে করে।
তার কাছে সময় অমূল্য সম্পদ, যা হেলায় ব্যয়
করার সুযোগ নেই। সে পরীক্ষাথীর মতো দায়িত্ববোধের সাথে তা ব্যয় করে। কারণ
পরীক্ষার্থীর পরীক্ষার মাধ্যমেই তার ভবিষ্যত নির্ধারিত হয়।
৪. মুমিন হয় সুস্থ স্বভাবের লোক। বেহুদা কাজে সময় ব্যয় করার মত মানসিকতা
সম্পন্ন হবে না। মুমিন হবে উয়েটফুল ব্যক্তিত্ব, তার পারসনালিটি থাকবে, বেহেশতের বাসিন্দাদের মতো তার
গুণ হবেঃ﴿لَّا تَسْمَعُ فِيهَا لَاغِيَةً﴾
‘সেখানে কোন অর্থহীন বেহুদা
কথাবর্তা তারা শুনবেনা।’
﴿وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ﴾
৪. যাকাতের পথে সক্রিয় থাকে।
§ يُؤْتُونَ الزَّكَاةَ যাকাত দেয়া ও لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ যাকাতের পন্থায় কর্মতৎপর হওয়ার অর্থ এক নয়।
§ زكوة শব্দের দুইটি অর্থ।
(১) পবিত্রতা। এ
মাল যা পবিত্র সাধনের জন্য আলাদা করে নেয়া।
(২)
ক্রমবিকাশ/ক্রমবর্ধমান।
§ يؤتون الزكوة
পবিত্রতা অর্জনের জন্য নিজেদের মাল সম্পদ প্রদান করা।
§ للزكوة فاعلون বলতে পবিত্রতা বিধান। এর দ্বারা কেবল যাকাত প্রদান বুঝায়
না। বরং মনের পবিত্রতা, চরিত্রের পবিত্রতা, জীবনের
পবিত্রতা, ধন মালের পবিত্রতা, তথা সর্বমূখী
পবিত্রতা বুঝায়। বিধায় এ আয়াতের অর্থ হবে-
“তারা পবিত্রতা বিধানের কাজ করে।” মানে নিজেকে পবিত্র রাখে, অন্যকে
পবিত্র করে।
§ সূরা আ’লাতে বলা হয়েছেঃ قَدْ أَفْلَحَ
مَن تَزَكَّىٰ﴾﴿وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّىٰ﴾ “কল্যাণ আর সফলতা লাভ করলো সে, যে
পবিত্রতা অবলম্বন করল এবং নিজের রব এর নাম স্মরণ কওে নামায পড়লো।
§ সূরা আশ শামস-এ বলা হয়েছেঃ ﴿قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا﴾﴿وَقَدْ
خَابَ مَن دَسَّاهَا﴾ “সফল হলো সে, যে
নফসের পবিত্রতা সাধন করল। আর ব্যর্থ হলো সে, সে উহাকে অবদমিত
করল।”
﴿وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ﴾
৫. নিজেদের লজ্জাস্থানের
হেফাজত করে।
§ লজ্জাস্থানের হেফাজত এ দুইটি অর্থঃ
১. নিজের দেহের লজ্জাস্থান সমূহকে ঢেকে রাখা, নগ্নতাকে প্রশ্রয় না দেয়া, নিজ লজ্জাস্থানকে অপর
লোকদের সামনে প্রকাশ না করা।
২. নিজের পবিত্রতা ও সতীত্ব রক্ষা
করা। উশৃংখল যৌনতার আশ্রয় প্রশ্রয় না
দেয়া। পাশবিক প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করার জন্য অবাধ ও নিয়ম লংঘন না করা।
﴿إِلَّا عَلَىٰ أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ
غَيْرُ مَلُومِينَ﴾
৬. নিজেদের স্ত্রীদের ও
অধিকারভূক্ত বাঁদীদের ছাড়া, এদের
কাছে (হেফাজত না করলে) তারা তিরস্কৃত হবে না।
﴿فَمَنِ ابْتَغَىٰ وَرَاءَ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْعَادُونَ﴾
৭. তবে যারা এর বাইরে আরো কিছু
চাইবে তারাই হবে সীমালংঘনকারী।
§ এ বাকাংশ উপরের বাক্যের একটি ব্যাখ্যা। ভূল ধারণার অপনোদনের
জন্য এ বাক্য বলা হয়েছে। যেমনঃ অতীত হতে বর্তমান পর্যন্ত এক শ্রেণীর লোক যৌন
শক্তিকে একটি খারাপ জিনিস মনে করে। তাদের মতে এগুলো দ্বীনদার ও আল্লাহ ওয়ালা
লোকদের কাজ হতে পারেনা। যদি বলা হতো ﴿وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ
حَافِظُونَ﴾ তাহলে ঐ লোকদের ভূল ধারনাকেই সমর্থণ করা হতো। মানে আল্লাহ ওয়ালারা
বিয়ে শাদী নামক জিনিস থেকে দূরে থেকে সৈন্যাসী জীবন যাপন করবে। মাঝ খানে إِلَّا
শব্দ দিয়ে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, বৈধ
স্থানে বিধিসম্মত উপায়ে নফসের খাহেশ পূর্ণ করা কোন দোষের কাজ নয়।
§ এ বাক্য থেকে কয়েকটি মাসয়ালা পাওয়া যায়ঃ
১. দুই ধরনের মেয়ের
নিকট লজ্জাস্থানের হেফাজত করা বাদ দেয়া হয়েছে।
একঃ স্ত্রী। স্ত্রী-যার আরবী-زوج মানে যার সহিত যথারীতি বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে।
দুইঃ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ অর্থাৎ ক্রীতদাসী। সেই মেয়েলোক, যে
পুরুষের মালিকানাভূক্ত। এ আয়াত থেকে ক্রীতদাসীদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন জায়েজ করা
হয়েছে।
দ্রষ্টব্যঃ
অনেক মুফাস্সির ক্রীতদাসীদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে জায়েজ মনে করেন না।
তাদের যুক্তি সূরা নিসার আয়াত- ﴿وَمَن لَّمْ يَسْتَطِعْ مِنكُمْ طَوْلًا أَن
يَنكِحَ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ ﴾“যে লোক মুমিন
সতী মেয়েদের বিয়ে করতে সমর্থ নয়।” আর এ
আয়াতে বিপরীতে যুক্তি অন্য আয়াত فَانكِحُوهُنَّ
بِإِذْنِ أَهْلِهِنَّ وَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ “অতএব তাদেরকে
(ক্রীতদাসীদেরকে) বিবাহ করো তাদের মালিকদের অনুমতিক্রমে এবং প্রচলিত নিয়মে তাদের
মোহরানা তাদেরকে দাও।”)
২. এ আয়াত إِلَّا عَلَىٰ
أَزْوَاجِهِمْ কেবলমাত্র পুরুষদের জন্য।
নারীরা তাদের ক্রীতদাসের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবেনা। সাহাবায়ে কিরামদের
সর্বসম্মত ফায়সালা-تأولت كتاب الله على غير تأويله
“সে আল্লাহর কিতাবের ভূল অর্থ বুঝিয়াছে।
৩. ﴿فَمَنِ
ابْتَغَىٰ وَرَاءَ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْعَادُونَ﴾ “অবশ্য এদের ছাড়া অন্য কিছু চাইলে তারাই সীমালংঘনকারী
হবে।” বা “অবশ্য যে লোক ইহা ব্যতিত অন্য কিছু চায়, সে-ই বাড়াবাড়ি
করে” এ আয়াতের মাধ্যমে উপরোক্ত দুই স্থান- স্ত্রী ও ক্রীতদাসী ছাড়া আর সকল ধরনের
যৌন আচরণ হারাম করা হয়েছে। যেমন-যেনা-ব্যভিচার, সমকামিতা,
পশুর সাথে যৌনাচার ইত্যাদি।
o
হস্ত মৈতুনঃ
-
ইমাম আহমদের মতে জায়েজ।
-
ইমাম মালিক ও ইমাম শাফেয়ীর
মতে হারাম।
-
ইমাম আবু হানিফা-হারাম, তবে কোন
কোন ক্ষেত্রে মাফ যোগ্য।
৪. কেহ কেহ এ আয়াত
দ্বারা মুতয়া বিবাহ (Contract
Marrage) হারাম প্রমান
করেছেন। কারণ মুতয়া বিবাহের নারীটি না স্ত্রী হবে, না দাসী। দাসী
নয় তা স্পষ্ট। স্ত্রীর জন্য যে বৈশিষ্ট দরকার তার কিছু তার মাঝে নাই, যেমন-সে ঐ পুরুষের উত্তরাধিকারী হতে পারবেনা। ইদ্দত, তালাক, নাফকা, ইলা, যেহার, লেয়ান ইত্যাদি কোন কিছু তার জন্য প্রযোজ্য
নয়। চার স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি সীমার সে বাহিরে।সে যেহেতু স্ত্রী নয়, আবার দাসী নয়। বিধায় সে “ইহা ছাড়া অন্য কোন উপায়” এর মধ্যে।
মাওলানার জবাবঃ
মাতয়া বিবাহ হারাম একথা সত্য। কিন্তু তা এ আয়াত দিয়ে হারাম হয় নাই। হারাম হয়েছে
নবী সা. এর হাদীস দিয়ে। কারণ, এ আয়াত নাযিল হয়েছে মক্কী
জিন্দেগীতে। আর মুতয়া হারাম হয়েছে মক্কা বিজয়ের বছর, যা সহীহ
হাদীস দিয়ে প্রমাণিত।
মুতয়া সম্পর্কে কথাঃ
ক. ইহা হারাম হওয়ার কথা নবী সা, কর্তৃক
প্রামণিত। ইহা হযরত উমর রা. হারাম করেন নাই।
খ. একশ্রেণীর শীয়া মতাবলম্বিরা ইহাকে শর্তহীন অবাধ জায়েজ ও মুবাহ মনে করেন, যার কোন দলীল কোরআন ও সুন্নাহে নাই।
﴿وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ﴾
৮. নিজেদের আমানত ও
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।
§
এ ব্যাপারে হাদীসে বলা
হয়েছেঃ
عن أَنَسِ بْنِ مَالِك (رضـ) قَالَ مَا خَطَبَنَا نَبِيُّ اللَّهِ (صـ)
إِلاَّ قَالَ: لاَ إِيمَانَ لِمَنْ لاَ أَمَانَةَ لَهُ، وَلاَ دِينَ لِمَنْ لاَ عَهْدَ
لَهُ.
যার আমানতদারীর গুণ নাই, তার ঈমান
নাই। আর যে ওয়াদা রক্ষা করে না, তার দ্বীন নাই।
§ أمانات শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমনঃ আল্লাহ অথবা বান্দা
কর্তৃক কারো কাছে কোন কিছু রাখা, ওয়াদা, চুক্তি,
প্রতিশ্রেুাতি।
§ হাদীসের বর্ণনা মতে চারটি অভ্যাস যার মাঝে পাওয়া যাবে, সে
খালিছ মুনাফিক। আর যার মাঝে চারটির একটি পাওয়া যাবে, তার মুনাফিকির
খাসলত রয়েছে, যতক্ষণ না তা ত্যাগ করে। আর তা হলোঃ
১. তার নিকট যখন
কোন আমানত প্রদান করা হয়, তখন খিয়ানত করে।
২. যখন কথা বলে, মিথ্যা
বলে।
৩. ওয়াদা করলে, ভংগ
করবে।
৪. আর যখন কারো
সাথে ঝগড়া করবে, তখন সীমা লংগন করে।
﴿وَالَّذِينَ هُمْ عَلَىٰ صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ﴾
৯. এবং নিজেদের নামাযগুলোর
রক্ষণাবেক্ষণ করে।
§ অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মানুযায়ী নামায আদায় করে।
﴿أُولَٰئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ﴾
১০. তারাই এমন ধরনের
উত্তরাধিকারী যারা।
﴿الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾
১১. নিজেদের উত্তরাধিকার
হিসেবে ফিরদাউস লাভ করবে এবং সেখানে তারা থাকবে চিরকাল।
§ الْفِرْدَوْسَ জান্নাতের একটি নাম।
সকল ভাষায় এর অস্তিত্ব রয়েছে। মানে কয়েকটি বাগানের সমষ্টি।
§ ফিরদাউস সম্পর্কে সূরা কাহাফে বলা হয়েছেঃ﴿
كَانَتْ لَهُمْ جَنَّاتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلًا﴾ “তাদের মেহমানদারীর জন্য ফিরদাউসে একটি বড় ও বিশাল জায়গা।
শিক্ষা
§ আমাদের শিক্ষনীয় চারটিঃ
১. যারা কুরআন ও
মুহাম্মদ সা. এর কথা মেনে নেবে এবং নিজেদের মাঝে এসব গুণ সৃষ্টি করবে-এসব আচরণের
ধারক হবে, তারা দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভ
করবে-তারা যে বংশ আর দেশের হউক না কেন।
২. কেবল ঈমান বা
কেবল চরিত্র ও আমলের ফলে কল্যাণ ও সাফল্য পাওয়া যাবেনা। সাফল্য আসবে এই দুটির
সমন্বয়ে।
৩. বৈষয়িক, বস্তুগত,
স্বাচ্ছন্দ ও সীমাবদ্ধ সময়ের সাফল্যের নাম কল্যাণ নয়। বরং এটি একটি
দীর্ঘকালীন কল্যাণের নাম। দুনিয়া ও আখেরাত উভয়টি যার মাঝে গন্য। ঈমান ও নেক আমল
ব্যতিত যার অর্জন সম্ভব নয়।
৪. উপরোক্ত গুনাবলী
গুলো নবী সা. এর দাওয়াতের সত্যতার প্রমাণ।
সমাপ্ত
0 Comments