জামায়াতের সমাবেশ, বিরোধী দলের ভূমিকা অতঃপর…….


মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ
জামায়াতে ইসলামী ১০ বছর পর রাজধানীতে বড় ধরণের শোডাউন করে এখন ফুরফুরে মেজাজে। সোসাল মিডিয়াতে জামাতী সুনামী আর শিবির ঝড়ে মনে হচ্ছে, যেন নির্বাচনে বড় ধরণের একটা বিজয় অর্জন করেছে জামায়াতে ইসলামী।

জামায়াতে ইসলামী তাদের সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে মিডিয়া কাভারেজ অর্জন করেছে, তা যে কোন সময়ের তুলায় অনেক অনেক বেশী। সোসাল মিডিয়া-বিশেষ করে ফেইসবুক ও ইউটিউবের কারণে মেইনস্ট্রীম মিডিয়া গুলো মিডিয়া কাভারেজ না দিয়ে উপায় ছিল না। টিভি চ্যানেল গুলোর টিআরপি বৃদ্ধির জন্য এর বিকল্পও ছিলনা। একধরণের বাধ্য হয়ে টিভি চ্যানেল গুলোকে জামায়াতের সমাবেশের খবর পরিবেশন করতে হয়েছে। আমার জানা মতে এই প্রথম জামায়াতের কোন দায়িত্বশীলকে এটিএন বাংলা তাদের টকশোতে আমন্ত্রণ করেছে।

সমাবেশের দিন সমাবেশ শুরুর আগে থেকে নিয়ে সমাবেশ শেষ হওয়া এবং তৎপরবর্তী রাত অবধি ফেইসবুকের টাইমলাইন ছিল জামায়াতের দখলে। যে যে দিক থেকে পেরেছে এই পিকআওয়ারকে জামায়াতের প্রচারে ব্যবহার করে নিজেদের পেইজ ও আইডির প্রচারে ব্যস্ত হয়েছে। কেবলমাত্র জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলদের নিজস্ব ফেইসবুক সমূহের লাইভের ভিউ হিসাব করলে অনলাইনে থাকা দর্শকদের সংখ্যা ২০ লাখের উপরে ছড়িয়ে যায়। তন্মধ্যে জামায়াতের ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারী ও শিবিরের প্রাক্তণ কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের পেইজ থেকে লাইভে দর্শক ছিলেন ১লক্ষ ১৫ হাজার মানুষ।

জামায়াতের সমাবেশের আগে পরে বেশ কয়েকটি লাইভ টকশো দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। যাতে বিরোধী দলের বিভিন্ন নেতাদের বক্তব্য আমার কাছে অত্যন্ত সতর্কতামূলক প্রতিক্রিয়া হিসাবে গন্য হয়েছে। বিরোধী দলের কোন একজন নেতাও তাদের আলোচনায় জামায়াতকে সমাবেশ করার অনুমতি প্রদানের দাবী জানাননি। বরং তাদের সকলের আলোচনায়ই এসেছে “জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়নি” বিষয়টি। ভাবখানা এমন যে, জামায়াতকে কেন নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না! জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে না পারা সরকারের একটি ব্যর্থতা!! কিন্তু একজন নেতাও সাহস করে বলতে পারেননি যে, জামায়াতে ইসলামীকে কেন নিষিদ্ধ করা হবে!!!

জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ড. শফিকুল ইসলামের এটিএন বাংলায় প্রদত্ত বক্তব্য অত্যন্ত বুদ্ধিভিত্তিক। তিনি বলেছেনঃ যে আদালত জামায়াতে ইসলামীকে যুদ্ধাপরাধীদল ঘোষনা করেছে, সেই আদালত একটি বিতর্কিত আদালত। যে আদালতের গ্রহণযোগ্যতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে নাই। বাংলাদেশের মানুষ এই আদালতের রায়কে প্রত্যাখ্যান করেছে। জুডিশিয়াল কিলিং এর মাধ্যমে জামায়াত নেতাদের হত্যা করা হয়েছে।

জামায়াতের সমাবেশে ভারপ্রাপ্ত আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান উপস্থিত না হয়ে লিখিত বক্তব্য প্রেরণ করেছেন এবং তার পরবর্তী নেতা ডা. সাইয়েদ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরকে প্রধান অতিথি করেছেন। যা খুবই সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত দুইটি কারণে। একঃ যদি কোন কারণে সমাবেশে কোন অঘটন ঘটতো, তাহলে একসাথে দু’জনই আসামী হতেন এবং একসাথেই জেলে যেতে হতো। দুইঃ ময়দানের রাজনৈতিক বক্তা হিসাবে ডা. তাহের উপযোগী। সেই উপযোগীতাকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ১০ বছরের বন্ধ্যাত্বের পর ডা. আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরের বক্তৃতায় সেই পুরাতন ডং, অনলবর্ষিতা, বলিষ্টতা ও উদ্দীপনা পাওয়া যায়নি। বরং তার পরিবর্তে পাওয়া গেছে বয়সের চাপ, দায়িত্বের আলোকে রিজার্ভনেস এবং গ্রহণযোগ্যতা ও দায়িত্বশীলতা। বক্তৃতার শুরুতেই তার বারবার আল্লাহ আকবারের তাকবীর বক্তৃতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

সমাবেশের একটি উল্লেখ যোগ্য দিক ছিল শহীদ আলী আহসান মুহাম্মদ মুহাহিদের ছেলে আলী আহমদ মাবরুর ও আল্লামা দেলাওয়ার হোসাঈন সাইদী পুত্রদ্বয় শামীম সাঈদী ও মাসুদ সাঈদীর উপস্থিতি। তাদের উপস্থিতি জামায়াতের জনশক্তিকে উদ্দীপিত করেছে। শিবিরের প্রাক্তণ কেন্দ্রীয় সভাপতি হাফেজ রাশেদুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশের সদস্যদের মাঝে রজনীগন্ধা আর গোলাপ বিতরণ রাজনীতির ময়দানের একটি নতুন সংযোজন বলতে হবে।

বহুল আলোচিত সমাবেশ শেষ হয়েছে। জামায়াতের উদ্দীপিত জনশক্তি আবার ঘরে ফিরে গেছে। কিন্তু এখন কি হবে?

বিএনপি তাদের চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী আওয়ামীলীগের উত্থাপিত টপিক নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত রয়েছে। আওয়ামীলীগ সংলাপের কথা এনেছে, বিএনপি তাদের সকল সমাবেশে সেই সংলাপ নিয়ে কথা বলছে। আওয়ামীলীগ বলেছে, জামায়াতের সমাবেশের বক্তব্য বিএনপির শিখিয়ে দেয়া কথা। বিএনপি সেই অভিযোগের জবাব দিতে ব্যস্ত। বিএনপির কাছে নিজেদের কোন কথা নেই। অথচ হওয়ার কথা ছিল এমন যে, বিএনপি একের পর এক নতুন নতুন টপিক নিয়ে আসবে, আওয়ামীলীগ সে সব কথার জবাব দেবে। কিন্তু এমন মেধা সম্পন্ন নেতৃত্ব বিএনপিতে অনুপস্থিত। অথবা যাদের মেধা আছে, তাদেরকে বিএনপি প্রথম সারিতে এসে কথা বলতে না দিয়ে ল্যাং মেরে পিছনে ফেলে রেখেছে। এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী ব্যতিক্রম। গত দিনের সমাবেশে মঞ্চে উপবিষ্টদের সকলেই নতুন, ডায়নামিক, মেধাবী-মাওলানা, ডক্টর, ডাক্তার, এডভোকেট ইত্যাদি।

জামায়াতে ইসলামী এখন ফুরফুরে মেজাজে। কিন্তু আমার মনে হয় এই মেজাজটা বেশীদিন দীর্ঘায়িত হবে না। এই মেজাজে উনারা যদি আরো কিছু দিন থাকেন, তাহলে সহসাই এই মেজাজে উনারা একটা ঘরোয়া বৈঠক আয়োজন করবেন। আওয়ামীলীগ অত্যন্ত সুকৌশলে সেই মেজাজে রাখার জন্য জামায়াত বিষয়ে প্রয়োজনীয় নিরবতা ও কৌশল অবলম্বন করবে। ফুরফুরে মেজাজে নেতৃবৃন্দ সেই বৈঠকে উপস্থিত হবেন। বলা হয়ে থাকে, জামায়াতের প্রথম সারির নেতারা শাহাদাত বরণ করেছেন। দ্বিতীয় সারির নেতারা আদালত কর্তৃক দন্ডিত হয়ে কারাগারে। আমীর ডা. শফিকুর রাহমান সহ তৃতীয় সারির নেতারা মিথ্যা অভিযোগে কারাবন্দি। আর দল চালাচ্ছেন চতূর্থ সারির নেতারা। সেই চতূর্থ সারির নেতারা যখন ফুরফুরে মেজাজে বৈঠকে উপস্থিত হবেন, তখনই চারদিক থেকে পুলিশ উপস্থিত হবে। সকলকে একসাথে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠাবে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য ইঞ্জিনিয়ার ইন্সটিটিউটের অনলবর্ষী বক্তারা কারাগারে অন্তরীন থাকবেন।

তাহলে জামায়াতকে কি করতে হবে?

জামায়াতের নেতাদেরকে ভাবতে হবে, তারা ৫ বছর আগের সেই দূঃসহ দিন গুলোতেই আছেন। বিধায়, একসাথে মিটিং করা যেমন পরিহার করতে হবে। একই ভাবে নিজেদের অবস্থানকে জানান না দিয়ে সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে।

বিএনপিমুখী না হয়ে নিজেদের জনশক্তি ও জনগনের প্রতি আস্থা রেখে কৌশলী হয়ে ময়দানে কর্মসূচী নিতে হবে। শত নির্যাতন আর শাহাদাতের পর বাংলাদেশের মানুষের কাছে জামায়াত কতটুকু জনপ্রিয় তার একটি হিসাব জাতিকে দিতে হবে।

জামায়াতে ইসলামীকে বিএনপিমুখিতার বদলে ইসলামী দলমুখী হতে হবে। বাংলাদেশের সকল ইসলামী দলকে নিয়ে নূন্যতম ঐক্যের ভিত্তিকে ইসলামী মোর্চা গঠন করতে হবে।

জামায়াতে ইসলামীকে সামাজিক কাজে মানবতার ফেরিওয়ালা ডা. শফিকুর রাহমানের শুরু করা কাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। মানবসেবাই রাজনীতি-জাতির সামনে জামায়াতের ভিন্ন পরিচয় উপস্থাপন করতে হবে।

১২ই জুন ২০২৩

Post a Comment

0 Comments