তোমার বাবা ছিল এলাকার যুবকদের মাঝে প্রভাবশালী। সে কাউকে কোন কথা বললে, তা কেউ ফিরিয়ে দেবে এমন সাহস কারো ছিল না। তাই গ্রামের মুরব্বীরা মিলে সিদ্ধান্ত দিলেন, গ্রাম থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধে যাবে, তাদেরকে আত্মগোপনে থাকার ব্যবস্থা করা তোমার বাবার দায়িত্ব।
আমাদের বাড়ীতে একটা গরুর গাভী ছিল। গাভীটা দুধ দিতো। এজন্য তাকে প্রচুর পরিমাণে টাটকা সবুজ ঘাস দিতে হতো। গরুর ঘাস খাওয়ার জায়গাটাকে বলা হয় গোয়ালা। সেই গোয়ালাতে পড়ে থাকতো গরুর খাওয়ার পর না খাওয়া উচ্চিষ্ট ঘাস। সেই ঘাসের নিচে থাকতো মুক্তিযুদ্ধাদের অস্র। সেখানে লুকিয়ে রাখা হতো অপারেশন শেষে ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্র গুলো।
তোমার বাবার কাজ ছিল, প্রতি রাতে কোন মুক্তিযোদ্ধা অপারেশন শেষ করে এসে কার বাড়ীতে লুকাবে এবং ঘুমাবে-সেই ব্যবস্থা করা। প্রতিদিন বিকাল বেলা এই রুটিন বন্টন করতেন তোমার বাবা অত্যন্ত সংগোপনে। নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কানে কানে বলে দিতেনঃ রাতে দরজা খোলে রাখবেন। বাড়ীতে মেহমান আসতে পারে। মেহমানের ঘরে খাবার দিয়ে রাখবেন। যাকে বলতেন, সে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে ম্যাসেজ সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন করতো। নাম না জানা এমন অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ আর সহযোগিতা লুকিয়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পরতে পরতে।
রাতের বেলা প্রায় দিনই আমাদের বাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের পালা পড়তো। মা তার অসুস্থতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার রান্না করতেন। গ্রামের যুবকেরা যুদ্ধে যাবে, দেশমাতৃকার জন্য স্বাধীনতার জন্য লড়বে-তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা কত তৃপ্তির। মায়ের এই অভ্যাসটা আর বদলায়নি। আমরা যখন বড় হলাম, তখন সময়ে অসময়ে যে কেউ বাড়ীতে আসলে জিজ্ঞেস করতেন-খাবার খেয়ে এসেছে কি না এবং খাবারের ইনতেজাম করতেন।
মা বলেছেন, একদা খবর আসলো পাক হানাদার বাহিনী বাজারে চলে এসেছে। যে কোন সময়ে গ্রামে ঢুকে পড়বে। তাই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়া জরুরী। তার শারিরিক অসুস্থতার সাথে আমাকে কুলে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলেন। অনেক কষ্টে একটি গোপন গুহা জাতীয় জায়গায় পৌছে দেখেন আগেই সেখানে পৌছে গেছেন আশপাশের ফুফু চাচি অনেকেই। সবার মাঝে পিনপতন নিরবতা। এমন সময় আমাকেসহ যখন সেখানে পৌছলেনঃ তখন আমার শখ উঠলো মুখ দিয়ে গাড়ী চালানোর আওয়াজ করার। আমি চিৎকার করতে করতে গাড়ী চালনা শুরু করলাম। আর সবাই আমার প্রতি বিরক্ত ও আতংকিত হতে থাকলো। কি দূঃসহ যন্ত্রনা নাকি আমি দিয়েছি মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সময় গুলোতে। অবশেষে শোনা গেল-পাকহানাদার বাহিনী (যাদেরকে আমাদের এলাকায় পানজাবী বলা হতো)
গ্রামে আর ঢুকেনি, চলে গেছে থানা সদরের দিকে।
মা বললেন, তোমার বাবার তৎপরতা এক সময় প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং কে বা কারা সেই খবর পৌছে দেয় পাক হানাদার বাহিনীর কাছে। ফলে বাবার নামে সমন আসে-শাহবাজপুর এলাকায় অবস্থিত হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে হাজিরা দেয়ার জন্য।
বাবার নামে যে সমন এসেছে, এমন সমন আমাদের গ্রামের কারো নামে না আসলেও বাবা খবর নিয়ে জানলেন, যারাই সমন অনুযায়ী হাজিরা দিতে যাচ্ছে, তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়া হচ্ছে। মৃত্যুদন্ডের ধরণ হচ্ছেঃ কুয়ার মতো করে গর্ত তৈরী করা হচ্ছে। সেই সব কুয়াতে মাথা নিচু আর পা উপরে করে ঝুলিয়ে দেয়ার পর মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করা হচ্ছে। ফলে মাটি চাপায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যু হচ্ছে।
বাবাকে অনেকে পরামর্শ দিলেন, পলায়ন করার জন্য। কিন্তু বাবা খবর নিয়ে জানলে, পাক হানাদারদের সমন অনুযায়ী হাজিরা না দিলে তারা বাড়ীতে হামলা করছে, স্ত্রী সন্তানদের ধর্ষণ করছে এবং হত্যা করছে।
আমাদেরকে বাঁচাতে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি সমন অনুযায়ী হাজিরা দেবেন। কপালে যা ঘটে ঘটবে। কিন্তু স্ত্রী সন্তানদের বিপদে ফেলা যাবে না।
মা বললেন, দিনটি ছিল শুক্রবার। সেই দিন সকালে তোমার বাবা পাক হানাদারদের ক্যাম্পে হাজিরা দেয়ার কথা। তাই তিনি সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন। তোমার নানাবাড়ীর এলাকায় গেলেন। সেখানে তার আত্মীয় স্বজন বন্ধুদের থেকে বিদায় নিলেন। নিজ বাড়ীতে আসলেন, বাজার করলেন, পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল কিছু কিনে আনলেন। গ্রামের মসজিদে সকলের সামনে বিদায় চাইলেন। বাচ্ছাদের দেখে রাখার অনুরোধ করলেন। ভূল ত্রুটির জন্য ক্ষমা চাইলেন। পরিবারের সব প্রয়োজন শেষ করে নিজেকে রেডি করলেন।
বাবার চলে যাওয়ার শেষ প্রস্তুতিতে হঠাৎ খেয়াল হলো, সেই গাভীর কথা। ভাবলেন, সময় যেভাবে চলে চলবে। কমপক্ষে সপ্তাহ দিন যাতে কষ্ট করতে না হয় এজন্য বাবা বৃহস্পতিবার সকলে চলে গেলেন মাঠে গাভীর জন্য সবুজ ঘাস আনতে। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। বাবা বেশী করে ঘাস কাটার কাজে আত্মনিমগ্ন। যাতে বেশীদিন গাভীর কষ্ট না হয়।
হঠাৎ গাড়ীর শব্দ। বাবা দেখলেন, তীব্র গতিতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গাড়ীর বহর এগিয়ে চলছে থানা সদরের দিকে। বুকে ধুরু ধুরু ভাগ। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, কোথাও কোন জনপদকে পুড়িয়ে দেয়ার রণ প্রস্তুতি
নিয়ে তারা এগিয়ে চলছে দূর্বার বেগে।
বিষয় কি জানার জন্য বাবা অগ্রসর হলেন। জানলেন, জানলেন এমন খবর,
যা তার মনকে প্রশান্তি করে দিলে। এই খবর অত্যন্ত প্রশান্তির খবর, এই খবর সুখময় খবর, এই খবর রাতের আঁধার চিঁড়ে নিয়ে এলো আলোকিত সুপ্রভাত। আর তা হলো, বাংলাদেশের বিজয় হয়েছে, আমার দেশ
স্বাধীন হয়েছে। এখন আর আমার মাকে স্বামী হারা হতে হবে না, আমাদেরকে পিতা হারা হতে
হবে না, বেচারা কালো গাভীকে অনাহারে থাকতে হবে না, আর এলাকা উদীয়মান এক সমাজ সেবক
যুবককে হারাতে হবে না। পাক হানাদার বাহিনীর সমন অনুযায়ী শুক্রবারে বাবাকে হাজিরা
দিতে হবে না। অন্ধকার কুপে উল্টা করে তাকে ফেলে মাটিচাপা দেয়া হবেনা। কারণ, ওরা পলায়ন করছে,
ওরা আত্মসমর্পণ করেছে।
বাবা, আনন্দে আপ্লুত হয়ে ফিরলেন বাড়ীতে। খবর দেবেন বাংলাদেশের বিজয়ের এবং তার মুক্তির। কিন্তু বিজয়ের খবর দেয়ার আগেই তাকে খবর দেয়া হলো, তার ঘরকে উজ্জল করে এসেছে এক নবজাতক শিশু কন্যা। খুশীর উপরে খুশী। ৭১ এর আমাদের পরিবারে এলো দু’টি বিজয়ের আনন্দ।
2 Comments