তেলাওয়াত ও অনুবাদঃ
﴿الر ۚ كِتَابٌ أُحْكِمَتْ آيَاتُهُ ثُمَّ
فُصِّلَتْ مِن لَّدُنْ حَكِيمٍ خَبِيرٍ﴾
১। আলিফ-লাম-র। একটি ফরমান। এর আয়াতগুলো পাকাপোক্ত এবং বিস্তারিতভাবে
বিবৃত হয়েছে, এক পরম
প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ থেকে।
﴿أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا اللَّهَ ۚ
إِنَّنِي لَكُم مِّنْهُ نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ﴾
২। (এতে বলা
হয়েছে) তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারোর বন্দেগী করবে না। আমি তাঁর
পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য সতর্ককারীও এবং সুসংবাদদাতাও।
﴿وَأَنِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ
تُوبُوا إِلَيْهِ يُمَتِّعْكُم مَّتَاعًا حَسَنًا إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى
وَيُؤْتِ كُلَّ ذِي فَضْلٍ فَضْلَهُ ۖ وَإِن تَوَلَّوْا فَإِنِّي أَخَافُ
عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ كَبِيرٍ﴾
৩। আরো বলা
হয়েছেঃ তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে এসো, তাহলে তিনি একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তোমাদের উত্তম জীবন সামগ্রী দেবেন এবং অনুগ্রহ লাভের যোগ্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অনুগ্রহ দান করবেন। তবে যদি
তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আমি তোমাদের ব্যাপারে একটি অতীব ভয়াবহ দিনের আযাবের ভয়
করছি।
﴿إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ ۖ وَهُوَ عَلَىٰ
كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾
৪। তোমাদের সবাইকে আল্লাহর দিকে
ফিরে যেতে হবে এবং তিনি সবকিছুই করতে পারেন।
﴿أَلَا إِنَّهُمْ يَثْنُونَ صُدُورَهُمْ
لِيَسْتَخْفُوا مِنْهُ ۚ أَلَا حِينَ يَسْتَغْشُونَ ثِيَابَهُمْ يَعْلَمُ مَا
يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ ۚ إِنَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ﴾
৫। দেখো, এরা তাঁর কাছ থেকে আত্মগোপন করার জন্য বুক ভাঁজ করছে। সাবধান!
যখন এরা কাপড় দিয়ে নিজেদেরকে ঢাকে তখন তারা যা গোপন করে এবং যা প্রকাশ করে তা সবই
আল্লাহ জানেন। তিনি তো অন্তরে যা সংগোপন আছে
তাও জানেন।
﴿وَمَا مِن دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا
عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا ۚ كُلٌّ فِي
كِتَابٍ مُّبِينٍ﴾
৬। ভূপৃষ্ঠে
বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই যার রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর বর্তায় না এবং যার
সম্পর্কে তিনি জানেন না, কোথায় সে থাকে এবং কোথায় তাকে
সোপর্দ করা হয়। সবকিছুই একটি পরিষ্কার কিতাবে
লেখা আছে।
﴿وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ
وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ لِيَبْلُوَكُمْ
أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا ۗ وَلَئِن قُلْتَ إِنَّكُم مَّبْعُوثُونَ مِن بَعْدِ
الْمَوْتِ لَيَقُولَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ هَٰذَا إِلَّا سِحْرٌ مُّبِينٌ﴾
৭। তিনিই
আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, -যখন এর আগে তাঁর আরশ
পানির ওপর ছিল, -যাতে তোমাদের পরীক্ষা করে দেখেন তোমাদের
মধ্যে কে ভালো কাজ করে। এখন যদি হে মুহাম্মদ!
তুমি বলো, হে লোকেরা, মরার
পর তোমাদের পুনরুজ্জীবিত করা হবে, তাহলে অস্বীকারকারীরা
সংগে সংগেই বলে উঠবে। এতো সুস্পষ্ট যাদু।
﴿وَلَئِنْ أَخَّرْنَا عَنْهُمُ الْعَذَابَ
إِلَىٰ أُمَّةٍ مَّعْدُودَةٍ لَّيَقُولُنَّ مَا يَحْبِسُهُ ۗ أَلَا يَوْمَ
يَأْتِيهِمْ لَيْسَ مَصْرُوفًا عَنْهُمْ وَحَاقَ بِهِم مَّا كَانُوا بِهِ
يَسْتَهْزِئُونَ﴾
৮। আর যদি
আমি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের শাস্তি পিছিয়ে দেই তাহলে তারা বলতে থাকে, কোন্ জিনিস শাস্তিটাকে আটকে রেখেছে? শোনো!
যেদিন সেই শাস্তির সময় এসে যাবে সেদিন কারো ফিরানোর প্রচেষ্টা তাকে ফিরাতে পারবে
না এবং যা নিয়ে তারা বিদ্রূপ করছে তা-ই তাদেরকে ঘেরাও করে ফেলবে।
সূরা নামকরণঃ
§ এই সূরায় হযরত হূদ আ. সম্পর্কে আলোচনা এসেছে। বিধায় এই সূরার
নাম করণ করা হয়েছে সূরা হূদ। এর অর্থ এই নয় যে, এই সূরায় শুধু হূদ আ. সম্পর্কে আলোচনা
এসেছে। বরং অন্যান্য নবী এবং অন্যান্য বিষয়েও এই সূরায় আলোচনা হয়েছে। তা থেকে হূদ শব্দটাকে
নাম হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে।
§ সকল ধরণের মাসহাফ এবং তাফসীর গ্রন্থে সূরা হূদের নাম “হূদ‘ উল্লেখ
করা হয়ে। আর এই সূরাতে মোট ৫বার হূদ শব্দটি এসেছে। আর এই সূরাতে কাওমে হূদ এরও উল্লেখ
করা হয়েছে। যার বিবরণ এসেছে ৬০ নম্বর আয়াতেঃ ﴿أَلَا
بُعْدًا لِّعَادٍۢ قَوْمِ هُودٍۢ﴾ “শোন! দূরে নিপেক্ষ
করা হয়েছে হূদের জাতি
আদকে।”
হযরত হূদ আ. ও তার জাতি সম্পর্কে কিছু কথাঃ
§ হূদ আ. হচ্ছেনঃ
১. প্রথম
রাসূল, যিনি কাওমে আদ এর প্রতি
প্রেরিত হয়েছিলেন।
২. আরবী ভাষাভাষী ৫জন নবীর মাঝে একজন।
o আরবী ভাষাভাষী ৫জন নবী হলেনঃ ১. হূদ আ. ২. সালেহ আ. ৩. ইসমাঈল আ. ৪. শুয়াইব আ. ৫. মুহাম্মদ সা.
§ আদ জাতি হলোঃ
o নূহ আ. পুত্র সাম এর বংশের
প্রথম প্রজন্ম।
o আদ জাতির বসবাস আহকাফ
এলাকায়। আহকাফ এলাকাটি
এ্যারাবিয়ান প্যানিনসুলার দক্ষিণে
তথা ইয়ামানের হাজারা মাউত
এলাকায় অবস্থিত। যাকে
কুরআনে ইরামও বলা হয়।
o আধুনিক পত্নতথ্যবিদের মতে
নব আবিষ্কৃত ‘ওভার সিটি’ হলো
আদ জাতির এলাকা।
o নূহ আ. এর মহাপ্লাবনের পর প্রথম
মূর্তিপূজক জাতি এবং প্রথম
শিরককারী জাতি।
o পৃথিবীর প্রথম জাতি, যেসব জাতিকে
আল্লাহ ধ্বংস করেছেন।
o এই জাতিকে সূরা আল আরাফে “খুলাফা
মিন বা’দি কাওমী
নুহ”
বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
o যাদের সম্পর্কে কুরআনের সূরা
আল আরাফের ৬৯ নম্বর
আয়াত বলছেঃ
﴿وَاذكُرُواْ إِذْ جَعَلَكُمْ خُلَفَاء مِن
بَعْدِ قَوْمِ نُوحٍ﴾
স্মরণ করো, যখন তিনি (আল্লাহ) নূহ
সম্প্রদায়ের পর তোমাদেরকে খলিফা
করা হয়েছে।
o যাদের সম্পর্কে কুরআনের সূরা
আল মুমিনুনে ৩১ নম্বর
আয়াতে বলা হয়েছেঃ
﴿ثُمَّ أَنشَأْنَا مِن بَعْدِهِمْ قَرْنًا
آخَرِينَ﴾
তারপর আমি তাদের পরে আরেকটি প্রজন্ম সৃষ্টি
করেছি।
o এই জাতি ছিল প্রচন্ড
শক্তিশালী ও ভয়ংকার বিদ্রেুাহী। তারা ছিল ধনী ও বিলাসী জীবন যাপনকারী, তাদের
অসংখ্য বাগান ছিল, তাদের অগনিত ঝর্ণাধারা ছিল, পশু সম্পদের অধিকারী ছিল তারা, তারা ছিল উচ্চ ইমারত ও টাওয়ারের অধিকারী। তারা ছিল মারাত্মক অহংকারী।
o এই জাতির জন্য তাদের
ভাই হূদকে প্রেরণ করা
হয়েছিল, যাতে তিনি তাদেরকে আল্লাহর
গোলামীর নির্দেশ প্রদান করেন
এবং একক ভাবে কেবলমাত্র
তাই ইবাদত করে আর তার
সাথে কাউকে শরীক না করে। তারা যাতে আল্লাহর আনুগত্য
করে,
তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা
করে এবং তারা অঙ্গিকারাবদ্ধ
হয় দুনিয়া আর আখেরাতের
কল্যাণের লক্ষ্যে। তিনি
তাদেরকে সতর্ক করেন অবাধ্যতার
জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের
শাস্তির। কিন্তু আদ জাতি
হূদ আ.কে মিথ্যা প্রতিপন্ন
করেছিল।
§ এই সূরায় হূদ আ. ও তার
জাতির কাহিনী বিস্তারিত আলোচিত
হয়েছে।
§ কুরআনে হূদ শব্দটি ইয়াহুদী
জাতিদেরকে বুঝাতে এবং হূদ
আ.কে বুঝাতে
ব্যবহৃত হয়েছে।
§ কুরআনে নিম্নোক্ত আয়াত সমূহে
হূদ আ. বর্ণনা এসেছেঃ
সূরা
আল আরাফঃ ৬৫
﴿وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمْ
هُودًا ۗ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ
غَيْرُهُ ۚ أَفَلَا تَتَّقُونَ﴾
আর আদ (জাতি)র কাছে আমি পাঠাই তাদের ভাই হূদকে। সে বলেঃ “হে আমার সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা!তোমরা
আল্লাহর ইবাদত করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। এরপরও কি তোমরা ভুল পথে চলার ব্যাপারে
সাবধান হবে না?”
সূরা
হূদঃ ৫০
﴿وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا ۚ قَالَ
يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ ۖ إِنْ أَنتُمْ
إِلَّا مُفْتَرُونَ﴾
আর আদের কাছে আমি তাদের ভাই
হূদকে পাঠালাম। সে বললোঃ
“হে আমার স্বজাতীয় ভাইয়েরা! আল্লাহর বন্দেগী করো, তিনি
ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা নিছক মিথ্যা
বানিয়ে রেখেছো।
সূরা
হূদঃ ৫৩
﴿قَالُوا يَا هُودُ مَا جِئْتَنَا
بِبَيِّنَةٍ وَمَا نَحْنُ بِتَارِكِي آلِهَتِنَا عَن قَوْلِكَ وَمَا نَحْنُ لَكَ
بِمُؤْمِنِينَ﴾
তারা জবাব দিলঃ “হে হূদ! তুমি
আমাদের কাছে কোন সুস্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে আসোনি। তোমার
কথায় আমরা আমাদের মাবুদদেরকে ত্যাগ করতে পারি না। আমরা
তোমার প্রতি ঈমান আনছি না।
সূরা
হূদঃ ৫৮
﴿وَلَمَّا جَاءَ أَمْرُنَا نَجَّيْنَا هُودًا
وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ بِرَحْمَةٍ مِّنَّا وَنَجَّيْنَاهُم مِّنْ عَذَابٍ
غَلِيظٍ﴾
তারপর যখন আমার হুকুম এসে
গেলো তখন নিজের রহমতের সাহায্যে হূদও তার সাথে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে আমি রক্ষা
করলাম এবং একটি কঠিন আযাব থেকে বাঁচালাম।
সূরা
হূদঃ ৬০
﴿وَأُتْبِعُوا فِي هَٰذِهِ الدُّنْيَا
لَعْنَةً وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ ۗ أَلَا إِنَّ عَادًا كَفَرُوا رَبَّهُمْ ۗ أَلَا
بُعْدًا لِّعَادٍ قَوْمِ هُودٍ﴾
শেষ পর্যন্ত এ দুনিয়ায় তাদের
রবের সাথে কুফরী করেছিল। শোনো! আদ তাদের রবের
সাথে কুফরী করেছিল। শোনো! দূরে নিক্ষেপ
করা হয়েছে হূদের জাতি আদকে।
সূরা
হূদঃ ৮৯
﴿وَيَا قَوْمِ لَا يَجْرِمَنَّكُمْ شِقَاقِي
أَن يُصِيبَكُم مِّثْلُ مَا أَصَابَ قَوْمَ نُوحٍ أَوْ قَوْمَ هُودٍ أَوْ قَوْمَ
صَالِحٍ ۚ وَمَا قَوْمُ لُوطٍ مِّنكُم بِبَعِيدٍ﴾
আর হে আমার সম্প্রদায়ের
ভাইয়েরা! আমার বিরুদ্ধে তোমাদের একগুঁয়েমি যেন এমন পর্যায়ে না পৌঁছে যার যে, শেষ
পর্যন্ত তোমাদের ওপরও সেই একই আযাব এসে পড়ে, যা এসেছিল
নূহ, হূদ বা সালেহের সম্প্রদায়ের ওপর। আর লূতের
সম্প্রদায় তো তোমাদের থেকে বেশী দূরের নয়।
সূরা
আশ শুআরাঃ ১২৪
﴿إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوهُمْ هُودٌ أَلَا
تَتَّقُونَ﴾
স্মরণ করো, যখন তাদের
ভাই হূদ তাদেরকে বলেছিলঃ তোমরা ভয় করছো না।
সূরা নাযিল হওয়ার সময়-কালঃ
§ সূরা হূদ কুরআনে হাকীমের ১১তম সূরা।
§ সূরা হূদ একটি মাক্কী সূরা।
§ সূরা হূদে ১২৩টি আয়াত রয়েছে।
§ সূরা হূদে ১০টি রুকু রয়েছে।
§ সূরা হূদ একটি মক্কী
সূরা এবং ব্যাপারে কোন
দ্বিমত নাই।
§ আলোচ্য বিষয়ের দিকে দৃষ্টি
দিলে মনে হয় সূরাটি
নাযিল হয়েছে, সূরা ইউনূসের
সমসাময়িক সময়ে অথবা তার
পরে।
§ এই সূরার মূল বক্তব্য
আর সূরা ইউনূসের বক্তব্য
একই ধরণের।
§ এই সূরা আর সূরা
ইউনুসের বক্তব্যের মাঝে পার্থক্য
হলোঃ সূরা ইউনূসের সতর্ক
করার ধরণের চেয়ে এই সূরার
সতর্ক করার ধরণ তুলনামূলক
ভাবে কড়া।
§ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন-সূরা হূদের একটি আয়াত
ছাড়া পুরো সূরা মক্কী। কেবলমাত্র ১১৪ নম্বর আয়াতটি মাদানী। যেখানে বলা হয়েছেঃ ﴿وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ
وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ﴾ “আর দেখো, নামায কায়ে
করো দিনের দু’প্রান্তে এবং
রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত
হবার পর।”
§ হযরত আবু বকর রা. নবী
সা.কে বলেনঃ “আমি
দেখছি আপনি বুড়ো হয়ে
যাচ্ছেন, এর কারণ কি?” জবাবে তিনি বললেনঃ
সূরা হূদ ও তারই
মতো বিষয়বস্তু সম্বলিত সূরা
গুলো আমাকে বুড়ো করে
দিয়েছে।”
§ অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে
এই ভাবেঃ
عن
ابن عباس رضي الله عنهما، أنه قال: قال أبو بكر رضي الله عنه: يا رسول الله! قد
شبت، قال: شيبتني هود، والواقعة، والمرسلات، وعم يتساءلون، وإذا الشمس كورت. )
رواه الترمذي، وقال: حسن غريب (
ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
আবু বকর রা. জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল সা.! কিসে আপনাকে বৃদ্ধ করে দিলো?
উত্তরে রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ আমাকে সূরা হুদ,
ওয়াকিয়া, আল মুরসালাত, আম্মা
ইয়াতাসাআলুন এবং ওয়া ইযাশশামসু কিউউয়িরাত বৃদ্ধ করে ফেলেছ।” (তিরমিযি)
§ এই সূরা নাযিলের সময়কাল
কতটুকু কঠিন ছিল? একদিকে কুরাইশ
কাফেররা তাদের সকল শক্তি
দিয়ে রাসূল সা. এর দাওয়াতকে
বন্ধ করে দিতে চাচ্ছিল। অপরদিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে
তার জন্যে একের পর এক সতর্কবাণী
নাযিল হচ্ছি। আশংকা
দেখা দিয়েছিল যে, কখন আল্লাহর
দেয়া অবকাশের সময় শেষ
হয়ে যায় এবং জাতির
প্রতি আযাব নাযিল হয়ে
পড়ে।
§
মাওলানা মওদূদী
রাহি. বলেনঃ এই সূরাটি পড়ার
সময় মনে হয়, যেন একটি
বন্যার বাঁধ ভেংগে পড়া
উপক্রম হয়েছে এবং অসতর্ক
জনবসতিকে বন্যার গ্রাস সম্পর্কে
শেষ সতর্কবাণী শোনানো হচ্ছে।
সূরার বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয়ঃ
§ সূরার বিষয়বস্তু সূরা ইউনুসের
বিষয়বস্তুর অনুরূপ। মানে
এখানেও দাওয়াত, উপদেশ আর সতর্কবানী
আলোচিত হয়েছে। তবে
ইউনুসের তুলনায় এখানে দাওয়াতের
অংশ সংক্ষিপ্ত, উপদেশে যুক্তি
কম-ওয়াজ
নসিহত বেশী আর সতর্কবাণী
গুলো বিস্তারিত ও বলিষ্ঠ।
§ এই সূরার দাওয়াতের ধরণ
হলোঃ
-
নবীর কথা
মেনে নাও।
-
শিরক থেকে
বিরত হও।
-
সকল ধরণের
গোলামী ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর গোলাম হও।
-
দুনিয়ার জীবনের
সকল তৎপতা গড়ে তোল
আখেরাতের জবাবদিহির অনুভূতির ভিত্তিতে।
§ এই সূরায় উপদেশ দেয়া
হয়েছেঃ
-
দুনিয়ার
জীবনের বাহ্যিক দিক দেখে তার উপর ভরসা করে যে সব কওম আল্লাহর নবীদের দাওয়াত কবুল করেনি, তারা অত্যন্ত ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে।
-
ইতিহাস থেকে
প্রমাণিত হয়েছে এই প্রত্যাখ্যানের পথ ধবংসের পথ।
-
আর প্রশ্ন
রাখা হয়েছেঃ সেই একই পথে চলার মাঝে কোন বাধ্যবাধকতা আছে কি?
§ এই সূরায় সতর্কবাণী শোনানো
হয়েছেঃ
-
আযাব আসতে
দেরী হওয়া আসলে একটি অবকাশ মাত্র।
-
আল্লাহর
পক্ষ থেকে অবকাশ দেয়া আল্লাহর অনুগ্রহ মাত্র।
-
অবকাশ দেয়া
হয় সংশোধিত ও সংযত হওয়ার জন্য।
-
অবকাশের
পরও সংশোধিত বা সংযত না হলে আযাবকে হঠিয়ে দেয়ার ক্ষমতা কারো নাই।
-
আযাব আসলে
তা ঈমানদাদের ছোট্ট দল ছাড়া পুরো জাতিকে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।
§ এই সূরায় বিষয়বস্তু উপলব্দি
করানোর জন্য সরাসরি কথা
না বলে নূহ আ. এর জাতি, আদ জাতি, সামুদ
জাতি, লুত আ. এর জাতি, মাদায়েনবাসী ও ফেরাউনের
জাতির ঘটনা সমূহের উল্লেখ
করা হয়েছে।
§ উপরের জাতি সমূহের আলোচনায়
যেসব বিষয় বেশী স্পষ্ট
করে তুলে ধরা হয়েছেঃ
-
আল্লাহ যখন
কোন বিষয়ের চূড়ান্ত মিমাংসা করেত যান, তখন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ
পদ্ধতিতে মিমাংসা করেন।
-
আল্লাহর
মিমাংসার ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেয়া হয়না। দেখা হয় না, কে কার সন্তান বা আত্মীয়, কে নবী পুত্র বা নবী পত্মী। রহমত আসে কেবলমাত্র সঠিক পথের অনুসারীদের ক্ষেত্রে।
-
আল্লাহর
মিমাংসার আরো গভীর বিষয় হলো, ঈমান ও কুফরীর ফায়সালায় মুমিনও
নিজের পিতা-পত্র এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক
ভূলে যায়। আল্লাহর ইনসাফের তরবারী দিয়ে
সে নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করে। তার তরবারী সামনে সত্য ছাড়া সব কিছু কেটে ছিড়ে দূরে নিক্ষেপ করে।
-
আল্লাহর
মিমাংসার উসুল হলো, বংশ ও রক্ষ সম্পকের জন্য সামান্যতম পক্ষপাতিত্ব
না করা। যার প্রকৃত প্রদর্শণী হয়ে
ছিল সূরা নাযিলের তিন চার বছর পর বদরের ময়দানে।
আয়াত সমূহের ব্যাখ্যাঃ
﴿الر ۚ
كِتَابٌ أُحْكِمَتْ آيَاتُهُ ثُمَّ فُصِّلَتْ مِن لَّدُنْ حَكِيمٍ خَبِيرٍ﴾
১। আলিফ-লাম-র। একটি ফরমান। এর আয়াতগুলো পাকাপোক্ত এবং বিস্তারিতভাবে
বিবৃত হয়েছে, এক পরম
প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ থেকে।
§ الر (আলিফ লাম রা)
-
এর ব্যাখ্যা
অন্যান্য সূরার শুরুতে প্রদত্ত ব্যাখ্যায় আলোচিত হয়েছে।
-
ইবনে আব্বাস রা. বলেনঃ এখানে الر
অর্থ আমি আল্লাহ প্রত্যক্ষ করছি। অথবা এটা একটি শপথ বাক্য, যা দিয়ে শপথ করা হয়েছে।
§ كِتَابٌ
أُحْكِمَتْ آيَاتُهُ ثُمَّ فُصِّلَتْ (এটি ফরমান। এর আয়াত গুলো পাকাপোক্ত এবং বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়েছে)
-
তাফহীমূলকুরআনে “কিতাব” শব্দটির অনুবাদ
করা হয়েছে “ফরমান”।
-
কিতাব শব্দের
অর্থ গ্রন্থ বা লিপি। কিন্তু আরবী
ভাষায় কেবলমাত্র এই অর্থে ব্যবহৃত হয় না। বরং হুকুম, বাদশাহী ফরমান ইত্যাদি অর্থেও কিতাব শব্দটি
ব্যবহৃত হয়।
-
فُصِّلَتْ অর্থ হচ্ছেঃ
আকার ও অর্থে দিক দিয়ে এই আয়াত গুলো পরিপূর্ণ।
-
ফরমানের
মাঝে যে কথা গুলো বলা হয়েছে,
§ সেই কথাগুলো পাকা কথা, অকাট্য কথা এবং কথা
গুলো এমন কথা-যে কথার কোন নড়চড় নেই।
§ কথা গুলো বলা হয়েছে ভালভাবে যাচাই ও পর্যালোচনা করে।
§ নিছক বড় বড় বুলি আওড়াবার জন্য কথাগুলো বলা হয়নি।
§ কথাগুলোতে বক্তার বক্তৃতার যাদু নেই, ভাব-কল্পনার কবিত্ব নেই। যা বর্ণনা করা হয়েছে, তা হুবহু এবং প্রকৃত
সত্য বর্ণনা।
§ এখানে প্রকৃত সত্যের চেয়ে কম বা বেশী একটি শব্দও নাই। আর তা
বিস্তারিত-এমন বিস্তারিত যে প্রতিটি কথা খুলে খুলে
স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। এখানে কোন কথা জটিল, বাঁকা
বা অস্পষ্ট নাই।
§ ইবনে আব্বাস রা. এ আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ এ কিতাব কুরআন তার
নিকট হতে-এটার আয়াত সমূহ হালাল ও হারাম, আদশ ও নিষেধ বর্ণনায় সুস্পষ্ট,
সুবিন্যাস্ত করা হয়েছে এবং তা রহিত হয়নি। এই আয়াতে أُحْكِمَتْ শব্দটি منسوخ শব্দের বিপরীতে ব্যবহৃত হয়েছে।
§ مِن لَّدُنْ
حَكِيمٍ خَبِيرٍ (এক পরম প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ থেকে)
-
মানে এই কিতাব
বা এর আয়াত ঐ আল্লাহর
পক্ষ থেকে যিনি হাকীম
আর যিনি তার কথা
ও ফরমানে খবির।
﴿أَلَّا
تَعْبُدُوا إِلَّا اللَّهَ ۚ إِنَّنِي لَكُم مِّنْهُ نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ﴾
২। (এতে বলা
হয়েছে) তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারোর বন্দেগী করবে না। আমি তাঁর
পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য সতর্ককারীও এবং সুসংবাদদাতাও।
§ أَلَّا
تَعْبُدُوا إِلَّا اللَّهَ (এতে বলা
হয়েছে) তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারোর বন্দেগী করবে না)
-
এখানে নির্দেশ
প্রদান করা হচ্ছে যে, আল্লাহ
ছাড়া আর কারো ইবাদত
করো না।
-
আল্লাহ সুবহানাহু
ওয়াতায়ালা বলেনঃ
﴿وَمَآ أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن
رَّسُولٍ إِلاَّ نُوحِىۤ إِلَيْهِ أَنَّهُ لاۤ إِلَـٰهَ إِلاَّ أَنَاْ
فَٱعْبُدُونِ﴾
“এর পূর্বেও
যে কোন রাসূলের কাছে
আমি যে ওহী পাঠিয়েছিলাম
তা ছিল এটাই-আমি আল্লাহ
এক। সুতরাং তোমরা
একমাত্র আমারই ইবাদ করো।
(সূরা আল আম্বিয়াঃ ২৫)
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِى كُلِّ أُمَّةٍ
رَّسُولاً أَنِ ٱعْبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجْتَنِبُواْ ٱلْطَّـٰغُوتَ﴾
“আমি প্রত্যেক
কওমের মধ্যে নবী পাঠিয়ে
নির্দেশ দিয়েছিলাম-তোমরা শুধু
আল্লাহ ইবাদত করো এবং
তাগুত থেকে দূরে থাকো।”
(সূরা আন নাহলঃ ৩৬)
§ إِنَّنِي لَكُم
مِّنْهُ نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ (আমি তাঁর
পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য সতর্ককারীও এবং সুসংবাদদাতাও)
-
نَذِيرٌ শব্দটির অর্থ ‘ভীতি
প্রদর্শণকারী’। কিন্তু শব্দটি
ভীতি প্রদর্শণকারী শত্রু
বা হিংস্র জন্তু বা অন্য
কোন অনিষ্টকারীর জন্য
ব্যবহৃত হয়না। বরং
এমন ব্যক্তিকে نَذِيرٌ বলা হয়, যিনি নিজের
প্রিয় পাত্রকে স্নেহের সাথে
এমন বস্তু ও কাজ
থেকে বিরত রাখেন ও ভয় দেখান, যা তার
জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে
ক্ষতিকর।
-
তিনি তোমাদের
জন্য আযাবের ব্যাপারে
সতর্ককারী, যদি তোমরা কেরলমাত্র তার
ইবাদতের বিপরীত চলো।
-
তিনি তোমাদের
জন্য সওয়াবের ক্ষেত্রে সুসংবাদদাতা। যদি তোমরা কেবলমাত্র তার
ইবাদতের ক্ষেত্রে তার আনুগত
হও।
-
হাদীসের বর্ণনাঃ
রাসূলুল্লাহ সা. সাফা পাহাড়ের
উপর চড়ে কুরায়েশের গোত্রগুলিকে
ডাক দিয়ে বললেনঃ
يا
معشر قريش أرأيتم لو أخبرتكم أن خيلاً تصبحكم ألستم مصدقي؟
“হে কুরাইশের
দল!
আমি যদি তোমাদেরকে সংবাদ
দেই যে, সকালে তোমাদের
উপর শত্রুরা আক্রমণ চালাবে, তবে
কি তোমরা আমার কথা
বিশ্বাস করবে?”
সবাই
সমস্বরে বলে উঠলোঃ ما
جربنا عليك كذباً আপনি যে কোন
দিন মিথ্যা কথা বলেছেন
তা তো আমাদের জানা
নেই। তখন তিনি
বললেনঃ فإني نذير لكم بين يدي عذاب
شديد তাহলে জেনে
রেখো যে, আমি তোমাদেরকে
আল্লাহ কঠিন শাস্তি থেকে
ভয় প্রদর্শন করছি।
-
এ শাস্তি
অবশ্যই হবে। সুতরাং
এখনও তোমরা আল্লাহর কাছে
ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং
তাওবা করে না। এরূপ
করলে আল্লাহ তোমাদের সাথে
উত্তম ব্যবহার করবেন এবং
যে ব্যক্তি অনুগ্রহ লাভের
যোগ্য তার প্রতি তিনি
অনুগ্রহ করবেন। তিনি
দুনিয়াতেও তোমাদের সাথে ভাল
ব্যবহার করবেন এবং আখিরাতেও।
﴿وَأَنِ
اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُمَتِّعْكُم مَّتَاعًا حَسَنًا
إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى وَيُؤْتِ كُلَّ ذِي فَضْلٍ فَضْلَهُ ۖ وَإِن تَوَلَّوْا
فَإِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ كَبِيرٍ﴾
৩। আরো বলা
হয়েছেঃ তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে এসো, তাহলে তিনি একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তোমাদের উত্তম জীবন সামগ্রী দেবেন এবং অনুগ্রহ লাভের যোগ্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অনুগ্রহ দান করবেন। তবে যদি
তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আমি তোমাদের ব্যাপারে একটি অতীব ভয়াবহ দিনের আযাবের ভয়
করছি।
§ وَأَنِ
اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ (আরো বলা হয়েছেঃ তোমরা
তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে এসো)
-
আল্লাহ সুবহানাহু
ওয়াতায়ালা এই আয়াতের মাধ্যমে অতীতের পাপসমূহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করার নির্দেশ দিচ্ছেন। সাথে সাথে আল্লাহর কাছে তাওবা করার এবং আল্লাহর
দিকে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে এবং তা অব্যাহত রাখার কথা বলা হচ্ছে।
-
ক্ষমার
সম্পর্ক পূর্বে করা গোনাহের সাথে, তাওবার
সম্পর্ক ভবিষ্যতে একই ধরণের গোনাহ না করার অঙ্গিকারের সাথে। বিধায় সত্যিকার তাওবা
হলো আগে করা গোনাহের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাওয়া আর ভবিষ্যতে এই ধরণের
গোনাহ না করার জন্য দৃঢ় সংকল্প হওয়া।
-
ভবিষ্যতে গোনাহ না করার সংকল্প ছাড়া মৌখিক তাওবাকে বলা হয় توبة الكذابين মিথ্যাবাদীদের তাওবা। (কুরতুবী)
§ يُمَتِّعْكُم
مَّتَاعًا حَسَنًا إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى (তাহলে তিনি একটি দীর্ঘ সময়
পর্যন্ত তোমাদের উত্তম জীবন সামগ্রী দেবেন)
-
যারা
উপরোক্ত মানদন্ডে তাওবা করে তাদের জন্য ইহকাল এবং পরকালের সাফল্য ও সুখ-শান্তির সুসংবাদ
দেয়া হচ্ছে।
-
যদি তা করা
হয়, তাহলে দুনিয়াতে “উত্তম জীবন সমাগ্রী প্রদান
করা হবে আর আখেরাতেও।
-
দুনিয়ার
থাকার জন্য যে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, দুনিয়ার সফরের এই
সময়ে তিনি তোমাদের খারাপ ভাবে রাখবেন না। বরং ভালভাবেই রাখবেন।
-
দুনিয়ার
সফরকালীন আল্লাহ তার নিয়ামত সমূহ বর্ষণ করবেন। তার নিয়ামত ভাল করে ধন্য করা হবে, স্বচ্ছল ও সুখী-সমৃদ্ধশালী জীবন দেয়া হবে, জীবনকে শান্তিময় ও নিরাপদ করা হবে।
-
দুনিয়ার
সফরে লাঞ্ছনা, হীনতা বা দীনতার সাথে নয়, বরং সম্মান মর্যাদার সাথে জীবন যাপন করবে। যে খাতগুলো বলা হয়েছে কুরআনে এই ভাবেঃ
﴿مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا مِّنۡ ذَكَرٍ اَوۡ
اُنۡثٰى وَهُوَ مُؤۡمِنٌ فَلَنُحۡيِيَنَّهٗ حَيٰوةً
طَيِّبَةًۚ وَّلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ اَجۡرَهُمۡ بِاَحۡسَنِ مَا كَانُوۡا يَعۡمَلُوۡنَ﴾
“যে ব্যক্তিই
ঈমান সহকারে সৎকাজ করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করবো।” (সূরা আন
নাহলঃ ৯৭)
﴿يُّرۡسِلِ السَّمَآءَ عَلَيۡكُمۡ
مِّدۡرَارًا﴾﴿وَّيُمۡدِدۡكُمۡ بِاَمۡوَالٍ وَّبَنِيۡنَ وَيَجۡعَل لَّكُمۡ جَنّٰتٍ
وَّيَجۡعَل لَّكُمۡ اَنۡهٰرًا﴾
“তিনি
আকাশ থেকে তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষাবেন। সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে
সাহায্য করবেন, তোমাদের জন্য বাগান সৃষ্টি করবেন আর নদী-নালা প্রবাহিত করে
দিবেন।” (সূরা নুহঃ ১১-১২)
-
হযরত সায়াদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. বর্ণিত দীর্ঘ একটি হাদীসের বিবরণীতে জানা যায় যে, রাসূল সা. সা’দ রা.কে বলেনঃ
وَإِنَّكَ
لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجهَ اللَّه إلاَّ أُجِرْتَ بِهَا حَتَّى
مَا تَجْعلُ في فيِّ امرأَتِكَ
“তুমি যদি
একমাত্র আল্লাহর সুন্তুষ্টি লাভের আশায় কারো উপর কিছু খরচ করো, তবে অবশ্যই তুমি তার প্রতিদান পাবে। এমন কি তুমি তোমার স্ত্রীর উপর যা খরচ করবে, তারও প্রতিদান তুমি পাবে।” (বুখারী-মুসলিম)
-
এই আয়াতের
মাধ্যমে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে থাকা একটি বিভ্রান্তি দূর করা হয়েছে। বিভ্রান্তিটি হলোঃ আল্লাহভীতি, সততা, সাধুতা ও দায়িত্বানুভূতির চললে মানুষে আখেরাত লাভবান
হলেও দুনিয়া একদম বরবাদ হয়ে যাবে।
§ এটি একটি শয়তানী মন্ত্র। যার মাধ্যমে শয়তান দুনিয়ামুখী মানুষের মনে ওয়াসওয়াসা দেয়। সে বলেঃ যদি তুমি আল্লাহ ভীরু হও, সৎ জীবন যাপন করো, তাহলে দুনিয়াতে দারিদ্র, অভাব এবং অনাহার হবে তোমার সংগী।
-
এ আয়াতের
মাধ্যমে সেই দৃষ্টিভংগীর প্রতিবাদ করে বলা হয়েছেঃ যদি কেউ সঠিক পথ অবলম্বন করে, তাহলে সে আখেরাতে তো লাভাব হবেই, সাথে দুনিয়াতেও সমৃদ্ধ
হবে। আখেরাতের মতো দুনিয়াতেও মর্যাদা
ও সাফল্যের অধিকারী হবে।
- مَّتَاعًا
حَسَنًا বা উত্তম জীবন সামগ্রীর আরেকটি দিকঃ
§ কুরআনে হাকীমের দৃষ্টিতে দুনিয়ার জীবন সামগ্রী দুই প্রকার।
1.
متاع غرور - যা আল্লাহ বিমুখ মানুষদেরকে ফিতনায় ফেলার জন্য দেয়া হয়ে থাকে। ফলে তারা প্রতারিত হয়ে দুনিয়া পূজা ও আল্লাহ ভূলে
যাওয়ার মাঝে হারিয়ে যায়। সাধারণ চোঁখে
এটাকে নিয়ামত মনে করা হলেও এটা আল্লাহর নালত ও আযাবের কারণ হয়ে থাকে। যাকে কুরআনে متاع غرور বা প্রতারণার সামগ্রী বলা হয়েছে।
2. مَّتَاعًا
حَسَنًا - যা মানুষকে আরো বেশী সচ্ছল, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করে। বান্দাকে আরো বেশী শুকর গোজার করে। ফলে সেই ব্যক্তি আল্লাহর, আল্লাহর বান্দাদের এবং নিজের
অধিকার আরো বেশী আদায় করে। আল্লাহর দেয়া নিয়ামত ব্যবহার করে
শক্তি বাড়ায়, ভাল-ন্যায়-কল্যাণের উন্নয়ন করে এবং খারাপ, বিপর্যয় ও অকল্যাণের
পথ বন্ধ করতে আরো বেশী প্রভাবশালী ও কার্যকর চেষ্টা চালাতে থাকে। এটা এমন জীবন সামগ্রী, যা দুনিয়ার আরাশ আয়েশের মাঝে শেষ হয়ে যায় না। বরং আখেরাতের শান্তির উপকরণ হয়ে দাড়ায়। যাকে কুরআনে مَّتَاعًا حَسَنًا বলা হয়েছে।
§ হযরত সাহল ইবনে আব্দুল্লাহ বলেনঃ مَّتَاعًا حَسَنًا দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টির দিক থেকে সরে স্রষ্টার প্রতি মানুষে দৃষ্টি নিবদ্ধ
হওয়া।
§ আকারিবদের মতে, এর অর্থ হলোঃ যা
আছে তাতে সন্তুষ্ট থাকা, যা খোয়া গেছে তার জন্য বিষন্ন না হওয়া।
§ وَيُؤْتِ كُلَّ
ذِي فَضْلٍ فَضْلَهُ (এবং অনুগ্রহ লাভের যোগ্য
প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অনুগ্রহ দান করবেন)
-
এটা ইস্তেগফার
ও তাওবারীদের জন্য দ্বিতীয় খোশখবরী।
-
যে ব্যক্তি
নিজের চরিত্র আর কাজ
দিয়ে নিজেকে যেরূপ মর্যাদার
অধিকারী করে গড়ে তুলবে, আল্লাহ
তাকে সে মর্যাদা অবশ্যই
প্রদান করবেন।
-
আল্লাহর রাজ্যে-আরবী
ঘোড়ার পিঠে জরাজীর্ণ জিন
প্রদান করা হয়না, গাধার গলায়
সোনার শৃংখল পরানো হয় না।
-
আল্লাহর নিয়মে
কারো কৃতিত্ব ও ভাল
কাজ যেমন নষ্ট করা
হয় না, তেমনি খারাপ
কাজেরও কোন মর্যাদা নাই।
-
হযরত
ইবনে মাসউদ রা. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ
من
عمل سيئة كتبت عليه سيئة، ومن عمل حسنة كتبت له عشر حسنات، فإن عوقب بالسيئة التي
كان عملها في الدنيا بقيت له عشر حسنات، وإن لم يعاقب بها في الدنيا أخذ من
الحسنات العشر واحدة، وبقيت له تسع حسنات، ثم يقول هلك من غلب آحاده على أعشاره
-
যখন কেউ
একটি খারাপ কাজ করে, তখন
তার জন্য একটি পাপ
লিখে দেয়া হয়। অপরদিকে
যেখন কোন ব্যক্তি একটি
ভাল কাজ করে, তখন জন্য
দুশটি সওয়াব লিখে দেয়া
হয়। দুনিয়ায় যদি
একটি খারাপ আমলের শাস্তি
প্রদান করা হয়, তবে তার
পক্ষে দশটি পুণ্য থেকে
যায়। আর যদি
দুনিয়অয় তাকে শাস্তি দেয়া
না হয় তবে দশটি
পুণ্যের মধ্যে মাত্র একটি
পুণ্য খোয় যায় বা নষ্ট
হয়। নয়টি পুণ্য
তার পক্ষে থেকেই যায়। এরপর বলেনঃ ঐ ব্যক্তি
বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত যার
একটি পাপ দশটি পুণ্যের
উপর জয়যুক্ত হয়। (ইবনে
কাসীর)
-
এই আয়াতাংশের
প্রথম فَضْل দ্বারা মানুষের নেক আমল
এবং দ্বিতীয় فَضْل দ্বারা আল্লাহর
অনুগ্রহ ও জান্নাত বুঝানো
হয়েছে। অর্থাৎ তারা
দুনিয়াতে সুখে স্বাচ্ছন্দে বসবাস
করবে এবং আখেরাতেও তাদেরকে
চিরসুখের জান্নাত প্রদান করা
হবে। (মাআরিফুল কুরআন)
§ وَإِن تَوَلَّوْا
فَإِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ كَبِيرٍ (তবে যদি তোমরা
মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আমি তোমাদের ব্যাপারে একটি অতীব ভয়াবহ দিনের আযাবের ভয় করছি)
-
এটা তাদের
জন্য হুমকী বার্তা, যাদেরকে উপরের
কথা গুলো বলা হলো। এখন যদি তারা আল্লাহর
থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়
এবং রাসূলের কথা অস্বীকার
করে।
-
যারা আল্লাহ
থেকে মুখ ফেরায়, রাসূলকে মিথ্যা
প্রতিপন্ন করে, তাদের জন্য
শাস্তি হলোঃ কিয়ামতের দিন
তার উপর আযাব অবধারিত
ভাবে পতিত হবে।
-
يَوْمٍ كَبِيرٍ বা বড় দিন বা
মহা দিন বলতে কিয়ামতের দিন বুঝানো হয়েছে। যে দিন হবে দুনিয়ার হাজার বছরের সমান। আর
যদি ভয়াবহতার দিক বিবেচনা করা হয়, তাহলে
এর চেয়ে বড় ভয়াবহ দিন আর নেই।
﴿إِلَى
اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ ۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾
৪) তোমাদের সবাইকে আল্লাহর
দিকে ফিরে যেতে হবে এবং তিনি সবকিছুই করতে পারেন।
§ إِلَى اللَّهِ
مَرْجِعُكُمْ ۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (তোমাদের সবাইকে আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে
হবে এবং তিনি সবকিছুই করতে পারেন)
-
অর্থা’ কিয়ামতের দিনে
তার কাছে প্রত্যাবর্তন করতেই
হবে।
-
এটাও এক সতর্কবানী
যে,
আল্লাহ তার বন্ধুদের প্রতি
যেমন এহসান করতে পারেন, তেমনি
ভাবে শত্রুদেরকে শাস্তি দিতেও
সক্ষম এবং তিনি আরেকবার
সৃষ্টি করার ক্ষেত্রেও ক্ষমতাবান। বিধায়, যেহেতু তোমরা তার দিকে
ফিরে যেতে হবে এবং
কিয়ামতের দিনে তার সাথে
সাক্ষাত হবেই-তাই সতর্ক
হয়ে যাও।
﴿أَلَا
إِنَّهُمْ يَثْنُونَ صُدُورَهُمْ لِيَسْتَخْفُوا مِنْهُ ۚ أَلَا حِينَ
يَسْتَغْشُونَ ثِيَابَهُمْ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ ۚ إِنَّهُ
عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ﴾
৫। দেখো, এরা তাঁর কাছ থেকে আত্মগোপন করার জন্য বুক ভাঁজ করছে। সাবধান!
যখন এরা কাপড় দিয়ে নিজেদেরকে ঢাকে তখন তারা যা গোপন করে এবং যা প্রকাশ করে তা সবই
আল্লাহ জানেন। তিনি তো অন্তরে যা সংগোপন আছে
তাও জানেন।
§ أَلَا إِنَّهُمْ
يَثْنُونَ صُدُورَهُمْ لِيَسْتَخْفُوا مِنْهُ (দেখো, এরা
তাঁর কাছ থেকে আত্মগোপন করার জন্য বুক ভাঁজ করছে)
-
রাসূল সা. যখন
মক্কায় দাওয়াত দিচ্ছিলেন, তখন রাসূলের
আন্দোলন নিয়ে আলোচনা সমালোচনা
শুরু হলো। একদল
লোক,
যারা প্রকাশ্যে চরম বিরোধিতা
করতো। কিন্তু আরেকদল
ছিল,
যারা প্রকাশ্য বিরোধিতা করতো
না। কিন্তু তারা
মনে মনে ছিল রাসূলের
দাওয়াতের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ
ও বিরূপভাবাপন্ন। যারা রাসূলকে
পাশ কাটিয়ে চলতো, তার কথা
শুনতে চাইতো না। দূর
থেকে রাসূলকে দেখলে মুখ
লুকিয়ে চলে যেতো এই কথা
মনে করে যে মুখোমুখি
হলে যদি উনি তার
দাওয়াতী বক্তব্য শুরু করে
দেন।
-
কুরআনের এই আয়াতাংশে
সেই সব লোকদের দিকে
ইংগিত করে বলা হয়েছেঃ
এরা হকের মুখোমুখি হতে
ভয় পায়। উটপাখির
উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, ওরা
মুখ লুকিয়ে মনে করে
তারা হককে প্রত্যাখ্যান করেছে। অথচ হক তার নিজের
জায়গায় দাড়িয়ে তাদের এই তামাশা
দেখছে যে, নির্বোধেরা হক থেকে
বাঁচার জন্য কিভাবে নিজেদের
মুখ লুকাচ্ছে।
- তাফসীরে ইবনে কাসিরে ভিন্ন দৃষ্টিভংগী উল্লেখ করে ইবনে
আব্বাস বর্ণিত কিছু বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে। যা নিম্নরূপঃ
§ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এই يَثْنُونَ শব্দটাকে يَثْنُونِيْ পড়তেন। হযরত ইবাদ ইবনে জাফর রাহি. তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ يا أبا العباس ما يَثْنُونِيْ صُدُورَهُمْ অর্থ কি? তিনি বললেনঃ الرجل كان يجامع امرأته فيستحي، أو يتخلى
فيستحي، فنزلت: ألا إنهم تثنوني صدورهم এর দ্বারা ঐ লোকদের বুঝানো হয়েছে, যে স্ত্রী সহবাস
করতে লজ্জাবোধ করে অথবা নির্জনতায়ও লজ্জা পায়। তখন এই আয়াত নাযিল হয়।
§
হযরত আব্দুল্লাহ
ইবনে আব্বাস বলেনঃ
أناس
كانوا يستحيون أن يتخلوا فيفضوا إلى السماء، وأن يجامعوا نساءهم فيفضوا إلى
السماء، فنزل ذلك فيهم
লোকেরা খোলা আকাশের নিচে নির্জনে থাকতে এবং সহবাস করতে শরম করতো এবং মুখ ফিরিয়ে
নিতো। বিশেষ করে ঐ সময়ে, যখন বিছানা পেতে শুয়ে পড়তো এবং মাথা ঢেকে নিতো। তারা মনে করতো-তারা যদি বাড়ীতে
থাকে বা কাপড় গায়ে দিয়ে কোন খারাপ কাজ করে, তাহলে আল্লাহ থেকে
তারা তাদের পাপকে গোপন করতে পারবে। আল্লাহ তাদেরকে খবর দিচ্ছেন যে, তারা রাতের আঁধারে
শোয়ার সময় কাপড় গায়ে জড়িয়ে দেয়। কিন্তু আল্লাহ তা জানেন, যা তারা প্রকাশ্যে করে এবং গোপনে
করে। এমনকি দিলের নিয়ত, মনের ইচ্ছা ও গুপ্ত রহস্য সম্পর্কেও আল্লাহ ওয়াকিফহাল।
§
তাফসীরে ইবনে কাসীরে নবীকে দেখে মুশরিকদের মুখ ফিরিয়ে নেয়া বা মস্তক ঢেকে ফেলার বিষয়টিও উল্লেখ
করা হয়েছে। তবে ইবনে কাসির বলেছেনঃ পরের
আয়াত এবং ইবনে আব্বাসের পঠন পদ্ধতি দাবী করে এই আয়াত আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত।
§ أَلَا حِينَ
يَسْتَغْشُونَ ثِيَابَهُمْ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ ۚ إِنَّهُ
عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ (সাবধান!
যখন এরা কাপড় দিয়ে নিজেদেরকে ঢাকে তখন তারা যা গোপন করে এবং যা প্রকাশ করে তা সবই
আল্লাহ জানেন। তিনি তো অন্তরে যা সংগোপন
আছে তাও জানেন)
-
ইবনে কাসিরের
মতেঃ يَسْتَغْشُونَ ثِيَابَهُمْ এর
অর্থ يغطون رؤوسهم মাথা ঢেকে রাখা।
-
তাফসীরেমাআরিফুল কুরআনে বিষয়টি মুনাফিকদের দিকে ইংগিত করে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে
মুনাীফকদের তারা রাসূল সা. এর সাথে
বৈরিতা ও বিদ্বেষকে গোপন রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে তারা তাদের অন্তরের হিংসা ও
কুটিলতার আগুনকে ছাইচাপা দেয়ার চেষ্টা করতো।তাদের অবস্থা বর্ণা করা হয়েছে।
﴿وَمَا
مِن دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ
مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا ۚ كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ﴾
৬। ভূপৃষ্ঠে
বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই যার রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর বর্তায় না এবং যার
সম্পর্কে তিনি জানেন না, কোথায় সে থাকে এবং কোথায় তাকে
সোপর্দ করা হয়। সবকিছুই একটি পরিষ্কার কিতাবে
লেখা আছে।
§ وَمَا مِن
دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا
وَمُسْتَوْدَعَهَا (ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই যার রিযিকের
দায়িত্ব আল্লাহর ওপর বর্তায় না এবং যার সম্পর্কে তিনি জানেন না, কোথায় সে থাকে এবং কোথায় তাকে সোপর্দ করা হয়)
-
এই আয়াতের
মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা খবর
দিচ্ছেন যে, আল্লাহর সকল
সৃষ্টি-যারা অবস্থান করে জলে
কিংবা স্থলে, তারা হোক
বড় কিংবা ছোট-তাদরে সকলের
রিযিকের জিম্মা আল্লাহর। বিধায়, তাদের
চলা-ফেরা, আসা-যাওয়া, থাকার
অবস্থান, মৃত্যুর স্থান এমন কি গর্ভের
মধ্যে তাদের অবস্থান সকল
বিষয়ে আল্লাহ অবহিত।
-
এই আয়াতের
সাথে উপরের আয়াতের একটি
যোগসূত্রমূলক বক্তব্য এটি।
-
دَابَّة এমনসব প্রাণীকে
বলে,
যা পৃথিবীতে বিচরণ করে। আর পৃথিবী বলতে পৃথিবী
বলতে ভূপৃষ্টের উপরিভাগ, অভ্যন্তর ও নিচের
ভাগ সকল অংশ বুঝানে
হয়েছে। বিধায় পৃথিবীতে
অভ্যন্তরে, উপরে নিচে জল স্থল
সবেই এর অন্তভূক্ত।
-
رِزْق শব্দের
আভিধানিক অর্থ এমন বস্তু, যা কোন
প্রাণী খাবার হিসাবে গ্রহণ
করে এবং এর মাধ্যমে
দৈহিক শক্তি সঞ্চয়, প্রবৃদ্ধি সাধন
ও জীবন রক্ষা করে। রিযিক
যে গ্রহণ করে সে রিযকের
মালিক হওয়া শর্ত নয়। যেমনঃ শিশুরা খাবার গ্রহণ
করে,
কিন্তু তার মালিক তারা
নয়। বড় হওয়ার
পর রিযিক হালাল পন্থায়
গ্রহণ করতে হয়। মানুষ
আল্লাহ রিযিক দাতা এই কথা
ভূলে যায় বলে হারাম
পন্থা গ্রহণ করে। সে হারাম
পন্থা গ্রহণ না করলেও
যে কোন উপায়ে তার
নিকট আল্লাহ রিযিক পৌছাবেন-এটাই
ইসলামী আকীদা।
- রিযিক সম্পর্কিত কিছু কথাঃ
1.
আল্লাহ রিযিক
দাতা হলে না খেয়ে
মানুষের মৃত্যুর কারণঃ আল্লাহর
রিযিক নির্ধারিত। তাই
যখন মানুষের রিযিক শেষ
হয়,
তখন মানুষ মৃত্যু বরণ
করে। রিযিক না পাওয়া
কারণে নয়, মৃত্যুর সময়
আসার কারণে।
2.
ইমাম কুরতুবী
রাহি. বর্ণিত তাফসীরে হযরত আবু
মুসা ও হযরত আবু
মালিক রা. সহ আশআরী
গোত্রের ঘটনাঃ
তারা
ইয়ামান হতে মদীনায় এসে
একজনকে রাসূল সা. এর নিকট
পাঠালেন তাদের খাবারের ব্যবস্থা
করার আবেদন জানিয়ে। ঐ ব্যক্তি
রাসূল সা. এর ঘরের
কাছে শুনলেন তিনি তিলাওয়াত
করছেনঃ وَمَا مِن دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ
رِزْقُهَا এই আয়াত শুনে আগত
সাহাবী মনে করলেন, যেহেতু আল্লাহ
সকলের রিযিকের দায়িত্ব নিয়েছেন, আমরা
তো মানুষ-তাহলে আমাদেরও
ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করবেন। এই কথা মনে করে
তিনি রাসূল সা. এর সাথে
সাক্ষাৎ না করে নিজেদের
সমস্যার কথা না বলেই
নিজ গোত্রের কাছে ফিরে
আসলেন এবং সাথীদের বললেনঃ
শুভ সংবাদ, তোমাদের জন্য
আল্লাহর সাহায্য আসছে। তার
সাথীরা মনে করেলনঃ নিশ্চয়
রাসূল সা. তাদের খাবারের
ব্যবস্থা করেছেন। কিছুক্ষণ
পর দুই ব্যক্তি বড় প্লেটে
করে তাদের জন্য রুটি
ও গোশত নিয়ে আসলেন, যার পরিমাণ
এতো ছিল যে, তারা খাওয়া
দাওয়া করার পরও প্রচুর
পরিমাণে বয়ে গেল। তারা
মনে করেছিলেন যে, রাসূল সা. তার
প্রতিনিধির মাধ্যমে এই খাবার
পাঠিয়েছেন। তাই তারা
অতিরিক্ত খাবার রাসূল সা. এর নিকট
ফিরিয়ে নিয়ে আসলেন এবং
বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ সা.! আপনার
পাঠানো গোশত রুটি খুবই
সুস্বাদু এবং উপাদেয় এবং
তা প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত
হয়েছে। রাসূল সা. বললেনঃ
আমি তো তোমাদের জন্য
কোন খাবার প্রেরণ করিনি। তাদের কাছ থেকে রাসূল
সা.
পুরো ঘটনা শোনার পর বললেনঃ
আমি নই, বরং ঐ পবিত্র
সত্তা তা প্রেরণ করেছেন-যিনি
সকল প্রাণীর রিযিকের দায়িত্ব
নিয়েছেন।
3.
মুসা আ. এর ঘটনাঃ
হযরত
মুসা. আগুনের খোঁজে তুর পাহাড়ে
পৌছে সেখানে নবুয়াত ও রিসালাত
প্রাপ্ত হয়ে ফিরাউন ও তার
কওমের হিদায়াতের জন্য মিসরে
গমনের জন্য নির্দেশিত হলেন, তখন
তিনি চিন্তা করলেনঃ জনমানবহীন
মরুভূমিতে নিজ স্ত্রীকে একা
রেখে এসেছেন। তার
দায়িত্ব কে গ্রহণ করবে? আল্লাহ
তাকে তার সামনে থাকা
পাথরে আঘাত করার নির্দেশ
দিলেন। ফলে পাথর
ফেটে তার ভিতরে আরেকটা
পাথর বের হলো। তাকে
সেই পাথরে আঘাত করার
নির্দেশ দেয়া হলো। তিনি
সেই পাথরে আঘাত করলে
তৃতীয় আরেকটি পাথর বের
হলো। তিনি তৃতীয়
পাথরে আঘাত করার নির্দেশ
পেলেন। সেই পাথরে
আঘাত করলে সেই পাথরের
ভিতরে একটি জীবন্ত পোকা
দেখতে পেলেন, যার মুখে
তরতাজা একখানা ঘাসের টুকরা
ছিল। মুসা আ. এই অবস্থা
দেখে পরিবারের চিন্তা না করে
সরাসরি মিশরে চলে গেলেন।
-
এখানে বলা
হয়েছেঃ আল্লাহ এমন সুক্ষজ্ঞানী
যে,
প্রত্যেকটি পাখির বাসা, পোকা-মাকড়ের গর্ত
সবেই তার জানো এবং
সবার কাছে তিনি রিযিক
পাঠান। সকল ধরণের
প্রাণী কে কোথায় থাকছে, কোথায়
মৃত্যু বরণ করছে, তার খবর
আল্লাহ রাখেন।
-
যোগসূত্র টানা
হচ্ছে এই ভাবে যে, যে আল্লাহ
এই ধরণের খবর রাখেন, তিনি
তোমরা তার সম্পর্ক যে ধারণা
পোষণ করো, কিংবা মুখ
লুকিয়া বা কানে আঙ্গুল
দিয়ে বা চোঁখ বন্ধ
করে থেকে তার পাকড়াও
থেকে বাঁচতে চাও, তোমরা মনে
রাখো-তোমাদের এই অবস্থাও তিনি
জানেন। তোমরা বড়ই
বোকা। কারণ যিনি
তোমাদেরকে সত্যের সাথে পরিচিত
করার চেষ্টা করছেন, আর তোমরা
তা যাতে কানে না পৌছে
সে জন্য পালিয়ে যাচ্ছো।
-
এ ব্যাপারে
কুরআন হাকীম আরো বলছেঃ
﴿وَمَا
مِن دَآبَّةٍ فِى ٱلأَرْضِ وَلاَ طَائِرٍ يَطِيرُ بِجَنَاحَيْهِ إِلاَّ أُمَمٌ أَمْثَـٰلُكُمْ
مَّا فَرَّطْنَا فِى ٱلكِتَـٰبِ مِن شَىْءٍ ثُمَّ إِلَىٰ رَبِّهِمْ يُحْشَرُونَ﴾
যমীনের উপরে
চলাচলকারী যে কোন প্রাণী
রয়েছে এবং যে পাখি
তার ডানার সাহায্যে উড়ে
থাকে, সবগুলো তোমাদের মতো এক একটি
জাতি। কিতাবের মধ্যে
কোন কিছুই আমি লিখতে
ছাড়িনি। তারপর সবকিছুকেই
তাদের মালিকের একত্রিত করা
হবে। (সূরা আল আনআমঃ
৩৮)
﴿وَعِندَهُ مَفَاتِحُ ٱلْغَيْبِ لاَ
يَعْلَمُهَآ إِلاَّ هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِى ٱلْبَرِّ وَٱلْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ
مِن وَرَقَةٍ إِلاَّ يَعْلَمُهَا وَلاَ حَبَّةٍ فِى ظُلُمَـٰتِ ٱلأَرْضِ وَلاَ رَطْبٍ
وَلاَ يَابِسٍ إِلاَّ فِى كِتَـٰبٍ مُّبِينٍ﴾
তার
কাছে রয়েছে গাইবের চাবি, তিনি
ছাড়া তা আর কেউ
জানে না, সমুদ্র এবং
ডাংগায় তথা জলে ও স্থলে
যা কিছু রয়েছে, তার খবর
তিনিই জানেন। তারা
জানা ছাড়া একটি পাতাও
ঝরে না, যমীনের অন্ধাকারে
একটি দানাও এমন নেই
কিংবা ভিজা কিংবা শোকনো
এমন কোন জিনিস নেই, যা সুস্পষ্ট
কিতাবে নাই। (সূরা আল আনআমঃ
৫৯)
-
আয়াতে উল্লেখিত
مُسْتَقَر ও مُسْتَوْدَع শব্দদু’টি সম্পর্কে তাফসীর কাশশাফে বলা হয়েছেঃ
-
مُسْتَقَر (মুসতাকার) হলোঃ স্থায়ী বাসস্থান বা বাসভূমি।
- مُسْتَوْدَع (মুসতাওদা) হলোঃ অস্থায়ী ও সাময়িক আবাস স্থল।
§ كُلٌّ فِي
كِتَابٍ مُّبِينٍ (সবকিছুই
একটি পরিষ্কার কিতাবে লেখা আছে)
-
অর্থাৎ দুনিয়ার
সকল তথ্য তা ছোট
হোক কিংবা বড়-সবকিছু কিতাবের
মাঝে লেখা রয়েছে।
-
আল্লাহ
সুবহানাহু ওয়াতায়ালার ইলমের মাঝে সকল বিষয় থাকলেও তা পৃথকভাবে লিখিত রয়েছে
সুবিন্যাস্ত কিতাবে তথা লাওহে মাহফুজে।
-
হযরত
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইনুল আস রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.কে বলতে
শুনিছি,
তিনি বলেনঃ
كَتَبَ اللَّهُ مَقَادِيرَ الْخَلاَئِقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ، قَالَ وَعَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ.
‘‘আল্লাহ্ তাআলা আসমান ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে সমস্ত
মাখলুকের তাকদীর লিখে দিয়েছেন। তাঁর আরশ পানির উপরে’’। (বুখারী)
-
কুরআন ও হাদীসে এ সম্পর্কে আরো বলা হয়েছেঃ
﴿وَكُلَّ
شَىۡءٍ اَحۡصَيۡنٰهُ فِىۡۤ اِمَامٍ مُّبِيۡنٍ﴾
‘‘আমি প্রত্যেক জিনিষকে সুস্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষিত করে রেখেছি’’। (সূরা
ইয়াসীনঃ ১২)
﴿إِنَّ ذَلِكَ فِي كِتَابٍ﴾
‘‘নিশ্চয়ই এবিষয়টি কিতাবে লিখিত আছে’’। (সূরা হজ্জঃ ৭০)
﴿قَالَ فَمَا بَالُ الْقُرُونِ الأولَى *
قَالَ عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّي فِي كِتَابٍ لاَ يَضِلُّ رَبِّي وَلاَ يَنْسَى﴾
‘‘ফিরআউন বললঃ তাহলে অতীত যুগের লোকদের অবস্থা কি? মুসা
বললেনঃ এর জ্ঞান আমার প্রতিপালকের নিকট লিপিবদ্ধ আছে। আমার প্রতিপালক ভ্রান্ত হন
না ও বিস্মৃতও হন না’’। (সূরা তোহাঃ ৫১-৫২)
﴿وَمَا تَحْمِلُ مِنْ أُنْثَى وَلاَ تَضَعُ
إِلاَّ بِعِلْمِهِ وَمَا يُعَمَّرُ مِنْ مُعَمَّرٍ وَلاَ يُنْقَصُ مِنْ عُمُرِهِ
إِلاَّ فِي كِتَابٍ إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ﴾
‘‘আল্লাহর অজ্ঞাতসারে কোন নারী গর্ভধারণ করে না এবং প্রসবও করে না। কোন
দীর্ঘায়ু ব্যক্তির আয়ু বৃদ্ধি করা হয় না এবং তাঁর আয়ু কমানো হয় না, কিন্তু তা তো কিতাবে রয়েছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর জন্যে সহজ’’। (সূরা ফাতিরঃ
১১)
مَا
مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ مَا مِنْ نَفْسٍ مَنْفُوسَةٍ إِلَّا كُتِبَ مَكَانُهَا مِنْ
الْجَنَّةِ وَالنَّارِ وَإِلَّا قَدْ كُتِبَ شَقِيَّةً أَوْ سَعِيدَة
‘‘তোমাদের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি নেই, যার ঠিকানা জান্নাত
কিংবা জাহান্নামে লেখা হয়নি এবং সে সৌভাগ্যবান না দুর্ভাগা’’। (বুখারী)
সুরাকা বিন মালেক (রাঃ) বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে দ্বীন শিক্ষা দিন।
মনে হচ্ছে, আমাদেরকে এমুহূর্তে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই
যদি হয়, তাহলে আজ আমরা কোন্ বিষয়ে আমল করব? এমন বিষয়ে যা লিখার পর কলমের কালি শুকিয়ে গেছে এবং ভাগ্য লিখিত হয়ে গেছে?
না ঐ বিষয়ের, যা আমরা ভবিষ্যতে সম্মুখীন হবো?
তিনি বললেনঃ না; বরং এমন বিষয়ে যা লিখার পর
কলমের কালি শুকিয়ে গেছে এবং ভাগ্য লিখিত হয়ে গেছে। সুরাকা বললেনঃ তাহলে আমল করে
লাভ কি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তোমরা
আমল করতে থাক। কেননা প্রত্যেক আমলকারীর জন্যই তার আমল সহজ করে দেয়া হয়’’। (বুখারী)
﴿مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الأَرْضِ
وَلاَ فِي أَنْفُسِكُمْ إِلاَّ فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا﴾
‘‘পৃথিবীতে এবং তোমাদের শরীরে এমন কোন বিপদ আপতিত হয় না, যা সৃষ্টি করার পূর্বেই একটি কিতাবে লিপিবদ্ধ রাখি নি’’। (সূরা হাদীদঃ ২২)
إِنَّ
أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ فَقَالَ: لَهُ اكْتُبْ قَالَ: رَبِّ
وَمَاذَا أَكْتُبُ قَالَ: اكْتُبْ مَقَادِيرَ كُلِّ شَيْءٍ حَتَّى تَقُومَ
السَّاعَةُ
‘‘আল্লাহ্ তাআলা কলম সৃষ্টি করে সর্বপ্রথম তাকে বললেনঃ লিখ। কলম বললঃ হে
আমার প্রতিপালক! কী লিখব? আল্লাহ্ বললেনঃ কিয়ামত পর্যন্ত
আগমণকারী প্রতিটি বস্ত্তর তাকদীর লিখ’’। (তিরমিযী)
يا
أبا هريرة جَفَّ الْقَلَمُ بِمَا هُوَ كَائِنٌ
‘‘হে আবু হুরায়রা! পৃথিবীতে যা সৃষ্টি হবে তা লিখার পর কলমের কালি শুকিয়ে
গেছে। (বুখারী)
﴿وَهُوَ
الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ وَكَانَ عَرْشُهُ
عَلَى الْمَاءِ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا ۗ وَلَئِن قُلْتَ
إِنَّكُم مَّبْعُوثُونَ مِن بَعْدِ الْمَوْتِ لَيَقُولَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا
إِنْ هَٰذَا إِلَّا سِحْرٌ مُّبِينٌ﴾
৭। তিনিই
আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, -যখন এর আগে তাঁর আরশ
পানির ওপর ছিল, -যাতে তোমাদের পরীক্ষা করে দেখেন তোমাদের
মধ্যে কে ভালো কাজ করে। এখন যদি হে মুহাম্মদ!
তুমি বলো, হে লোকেরা, মরার
পর তোমাদের পুনরুজ্জীবিত করা হবে, তাহলে অস্বীকারকারীরা
সংগে সংগেই বলে উঠবে। এতো সুস্পষ্ট যাদু।
§ وَهُوَ الَّذِي
خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى
الْمَاءِ (তিনিই আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে
সৃষ্টি করেছেন, -যখন এর আগে তাঁর আরশ পানির ওপর ছিল)
-
মানুষের মাঝে
একটা প্রশ্ন বিদ্যমান ছিল
যে,
যদি আকাশ ও পৃথিবী
প্রথমে না থেকে থাকে, তাহলে
প্রথমে কি ছিল। সেই
প্রশ্নের জবাব এখানে দেয়া
হচ্ছে যে, প্রথমে পানি
ছিল।
-
আল্লাহর আরশ
বা সাম্রাজ্য পানির উপর
প্রতিষ্ঠিত ছিল।
-
পানি বলতে
আমরা যে পানি চিনি
সেই ধরণের পানি, না পানির
পূর্ববর্তী Fluid বা দ্রবীভূত রূপ, আর তা নিছক
রূপক অর্থে বুঝানে হয়েছে
তা পরিস্কার নয়।
-
কাতাদাহ
রাহি. বলেনঃ আসমান ও যমীন সৃষ্টির আগে মাখলুকের সূচনা কিরূপ ছিল, আল্লাহ তা মানুষদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন।
-
ইবনে কাসির
বলেনঃ আল্লাহ খরব দিচ্ছেন
যে,
প্রতিটি জিনিসের উপর তার
ক্ষমতা রয়েছে। আসমান
ও যমীনকে তিনি ৬দিনে সৃষ্টি
করেছেন। এর আগে
তা পানির উপর ছিল।
- আল্লাহর আরশ পানির
উপরে ছিল এমন
বিষয়ে হাদীসে রয়েছেঃ
o হযরত ইমরান ইবনে
হোছাইন বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ
اقبلوا
البشرى يا بني تميم (হে বনী তামীম! তোমরা
সুসংবাদ গ্রহণ করো।) তারা
বললোঃقد بشرتنا، فأعطنا
(আপনি
আমাদেরকে তো সুসংবাদ প্রদান
করলেন। অতএব আমাদেরকে
তা দিয়ে দিন।) তিনি
আবার বললেনঃ اقبلوا
البشرى يا أهل اليمن (হে ইয়ামানবাসী! তোমরা সুসংবাদ
গ্রহণ করো।) তারা বললোঃ
قد
قبلنا. فأخبرنا عن أول هذا الأمر كيف كان؟ (আমরা গ্রহণ করলাম। সুতরাং সৃষ্টির সূচনা কি ভাবে
হয়েছে, তা আমাদেরকে শুনিয়ে দিন।)
তিনি বললেনঃ كان
الله قبل كل شيء، وكان عرشه على الماء، وكتب في اللوح المحفوظ ذكر كل شيء
(সর্বপ্রথম
আল্লাহই ছিলেন এবং তাঁর
আরশ ছিল পানির উপর। তিনি লাওহে মাহফুযে সবকিছুর
বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন।)
বর্ণনাকারী
ইমরান রা., বলেনঃ রাসূল
সা.
এই পর্যন্ত বলার পর আমার
কাছে খবর আসে যে, আমার
উট দড়ি ছিড়ে পালিয়ে
গেছে। ফলে আমি
উটের খোঁজে বেরিয়ে পড়ি। বিধায়, তারপর রাসূল সা. কি বলেছিলেন, তা আমার
জানা নেই।
o হযরত আমর ইবনুল
আস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃإن الله قدر مقادير الخلائق قبل أن يخلق السموات
والأرض بخمسين ألف سنة، وكان عرشه على الماء (আসমান ও যমীন
সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর
আগে আল্লাহ তায়ালা সমস্ত
সৃষ্টির ভাগ্য লিখে রাখেন
আর তার আরশটি ছিল
পানির উপর।)
o হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত একটি হাদীসে
কুদসী থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ
সা.
বলেনঃ قال الله عز وجل أنفق أنفق عليك
আল্লাহ বলেনঃ (হে আমার
বান্দা)! তুমি খরচ করো, আমি তোমার
জন্য খরচ করবো। রাসূলুল্লাহ
সা.
বলেনঃ يد الله ملأى لا يغيضها نفقة،
سحاء الليل والنهار (আল্লাহর হাত পরিপূর্ণ
রয়েছে। রাত দিনের
খরচ তার কিছুই কমাতে
পারে না।) রাসূল সা. বলেনঃ
أفرأيتم
ما أنفق منذ خلق السموات والأرض؟ فإنه لم يغض ما في يمينه، وكان عرشه على الماء،
وبيده الميزان يخفض ويرفع (তোমরা কি দেখ
না যে, আসামান ও যমীনের
সৃষ্টি থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত
কি পরিমাণ খরচ করে
আসছেন? অথচ তাঁর ডান হাতে
যা ছিল তার এতটুকুও
কমে নাই। তাঁর
আরশটি ছিল পানির উপর, তাঁর
হাতে মীযান রয়েছে যা তিনি
কখনো উঁচু করছেন এবং
কখনো নিচু করছেন।)
o হযরত রাবী ইবনে
আনাস রাহি. বলেনঃ وَكَانَ
عَرْشُهُ عَلَى ٱلْمَآءِ فلما خلق السموات والأرض، قسم ذلك الماء قسمين، فجعل
نصفاً تحت العرش، وهو البحر المسجور (আল্লাহর আরশ পানির
উপরে ছিল। তারপর
যখন তিনি আসমান আর যমীন
সৃষ্টি করলেন, তখন ঐ পানিকে
দুই ভাগে ভাগ করলেন। একভাগ রাখলেন আরশের নিচে, আর এটাই
হলোঃ রাহরে মাসজুর বা ভূতুড়ে
সমুদ্র।)
o হযরত মুহাম্মদ ইবনু
ইসহাক রাহি. বলেনঃ فكان
كما وصف نفسه تعالى، إذ ليس إلا الماء، وعليه العرش، وعلى العرش ذو الجلال
والإكرام، والعزة والسلطان، والملك والقدرة، والحلم والعلم، والرحمة والنعمة،
الفعال لما يريد (আল্লাহ এভাবেই ছিলেন, যেভাবে
তিনি তার নিজের পবিত্র
ও মহান নফসের বর্ণা দিয়েছেন। অর্থাৎ পানি ছাড়া আর কিছুই
ছিল না এবং তাঁর
আরশ পানির উপর ছিল। আরশের উপর ছিল মহত্ত্ব, দয়া, মর্যাদা, সাম্রাজ্য, রাজত্ব, ক্ষমতা, জ্ঞান, সহষ্ঞিুতা, করুণা
এবং নিয়ামতের অধিপতি আল্লাহ। যিনি যা ইচ্ছা তা-ই করে
থাকেন।)
§ لِيَبْلُوَكُمْ
أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا (যাতে তোমাদের পরীক্ষা করে
দেখেন তোমাদের মধ্যে কে ভালো কাজ করে)
-
সূরা মুলক-এ আল্লাহ সুবহানাহু
ওয়াতায়ালা বলেছেনঃ জীবন আর মৃত্যুকে তিনি সৃষ্টি
করেছেন, যাতে পরীক্ষা
করতে পারেন যে,
কে তোমাদের মাঝে ভাল কাজ করে-
ٱلَّذِي
خَلَقَ ٱلْمَوْتَ وَٱلْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلاً﴾
(আয়াত-০২)
-
প্রথম কথা
হলোঃ আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি
করবেন, এজন্য আকাশ ও পৃথিবী
সৃষ্টি করেছেন। তথা মানুষের উপকারের জন্য আসমান ও যমীন সৃষ্টি করা হয়েছে।
-
আর
মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে, আল্লাহর
শিরক মুক্ত ইবাদত করার জন্য।
-
মানুষকে সৃষ্টি
করা হয়েছে, তাদের উপর
নৈতিক বোঝা বা দায়িত্ব
দেয়ার জন্য। আর সেই
দায়িত্ব হলো খেলাফাতের দায়িত্ব।
-
আল্লাহ মানুষদেরকে
খেলাফতের দায়িত্ব দিয়ে দেখতে
চান বা পরীক্ষা করতে
চান যে, কে সেই
এখতিয়ার এবং নৈতিক দায়িত্ব
পালন করে।
-
এই পরীক্ষা, হিসাব-নিকাশ, জবাবদিহি, শাস্তি-পুরস্কার
যদি না থাকতো, নৈতিক ভাবে
দায়িত্বশীল হওয়ার পরও যদি
মানুষ কোন পরিণাম ভোগ
না করে এমনি এমনি
মরে যেতো, তাহলে এই সৃষ্টি
কর্মটা হতো অর্থহীন, খেলা-তামাশা।
-
আল্লাহর পরীক্ষা
না থাকলে তা সৃষ্টি
কর্ম একটি বাজে কাজ
ছাড়া কোন মর্যাদা পেতো
না।
-
আল্লাহ
সুবাহানুহ ওয়া তায়ালা কুরআনের অন্যান্য আয়াতে এ বিষয়ে বলছেনঃ
﴿وَمَا
خَلَقْنَا ٱلسَّمَآءَ وَٱلأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا بَـٰطِلاً ذَٰلِكَ ظَنُّ
ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَوَيْلٌ لِّلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنَ ٱلنَّارِ﴾
আমি আসমান, যমীন এবং এরই দুইয়েল মাঝখানে অবস্থিত বস্তুকে অনর্থক সৃষ্টি করি নাই। এটা হচ্ছে কাফেরদের ধারণা, আর কাফিরদেরকে জাহান্নামে দূর্ভোগ পোহাতেই হবে। (সূরা ছোয়াদঃ ২৭)
﴿أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَـٰكُمْ
عَبَثاً وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لاَ تُرْجَعُونَ فَتَعَـٰلَى ٱللَّهُ ٱلْمَلِكُ
ٱلْحَقُّ لاَ إِلَـٰهَ إِلاَّ هُوَ رَبُّ ٱلْعَرْشِ ٱلْكَرِيمِ ﴾
তোমরা কি তবে এই ধারণা করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি? আর এটাও যে, তোমাদেরকে আমার কাছে আসতে হবে না? অতএব আল্লাহ অতি উচ্চ মর্যাদাবান, আল্লাহই প্রকৃত বাদশাহ, তিনি ছাড়া ইবাদতের যোগ্য আর কেউ নেই, তিনি আরশে কারিমের মালিক। (সূরা আল মুমিনুনঃ ১১৫-১১৬)
﴿وَمَا خَلَقْتُ ٱلْجِنَّ وَٱلإِنسَ إِلاَّ
لِيَعْبُدُونِ﴾
আমি
জিন আর মানুষদেরকে সৃষ্টি
করেছি আমার ইবাদত করার
জন্য। (সূরা আল যারিয়াত” ৫৬)
§ أَحْسَنُ عَمَلًا
(উত্তম আমল) কি?
-
উত্তম আমলের
মাঝে দুইটি জিনিস থাকতে
হয়। ১. সহীহ নিয়াত। ২.
রাসূল সা. এর তারিকা। এই দুইটি জিনিস না থাকলে
সকল আমল-তা যতই
উত্তম হোক, তা বৃথা
ও মূল্যহীন।
§ وَلَئِن قُلْتَ
إِنَّكُم مَّبْعُوثُونَ مِن بَعْدِ الْمَوْتِ لَيَقُولَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا
إِنْ هَٰذَا إِلَّا سِحْرٌ مُّبِينٌ (এখন যদি
হে মুহাম্মদ! তুমি বলো, হে লোকেরা, মরার পর তোমাদের পুনরুজ্জীবিত করা হবে, তাহলে
অস্বীকারকারীরা সংগে সংগেই বলে উঠবে। এতো
সুস্পষ্ট যাদু)
-
আল্লাহর পক্ষ
থেকে পরীক্ষার বিষয়টি মানুষের
কর্মবহুল জীবনের নিরেট উদ্দেশ্য
এবং তাদের অস্তিত্বের যুক্তিসংগত
উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
-
কিন্তু কাফেররা
এই বিষয়ে শোচনীয় ভাবে
অজ্ঞ ও মূর্খ। তারা
মনে করছে দুনিয়াটা একটা
খেলাঘর আর তারা হচ্ছে
একটি খেলনা এবং আল্লাহ
খেলওয়াড়। তারা নির্বোধ
কল্পনাবিলাসে মগ্ন।
-
কাফেরদের এই মগ্নতার
কারণে তারা এই উদ্দেশ্যটাকে
বুঝতে পারছে না। ফলে
রাসূল যখন এই উদ্দেশ্য
বুঝাতে যাচ্ছেন তা অট্টহাসি
দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে এবং
বিদ্রুপ করে রাসূলের কথাকে
যাদুকরের মতো কথা বলে
উল্লেখ করছে।
-
আখেরাতের
অনিবার্যতা বুঝানোর জন্য কুরআনের দুইটি আয়াত উল্লেখ যোগ্যঃ
﴿وَلَئِن
سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ ٱللَّهُ﴾
আর যদি তুমি তাদেরকে প্রশ্ন করো যে, তাদেরকে কে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই উত্তরে বলবেঃ আল্লাহ। (সূরা আয যুখরূফঃ ৭৮)
﴿وَلَئِن سَأَلْتَهُمْ مَّنْ خَلَقَ
ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلأَرْضَ وَسَخَّرَ ٱلشَّمْسَ وَٱلْقَمَرَ لَيَقُولُنَّ ٱللَّهُ﴾
আর যদি তুমি তাদেরকে প্রশ্ন করো যে, আসমান আর যমীন কে সৃষ্টি করেছেন আর চন্দ্র আর সূর্যকে মানুষের খেদমতে কে নিয়োজিত রেখেছেন? তারা অবশ্যই তার উত্তরে বলবেঃ আল্লাহ। (সূরা আল আনকাবুতঃ ৬১)
-
তাফসীরে ইবনে কাসীরে উপরোক্ত দুইটি আয়াত উল্লেখ করে বলা হচ্ছেঃ যারা মানুষের সৃষ্টি আর চন্দ্র সূর্যের প্রদক্ষিণকে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে একথা অকপটে স্বীকার করছে, তারাই আখেরাতের পূণরুত্থানকে অস্বীকার করছে। অথচ যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন, তিনি দ্বিতীয়বারও সৃষ্টি করা কঠিন নয়, বরং সহজ বটে। এজন্য আল্লাহ বলেনঃ
﴿وَهُوَ ٱلَّذِى يَبْدَأُ ٱلْخَلْقَ ثُمَّ
يُعِيدُهُ وَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِ﴾
তিনি এমন যে, তিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই আবার সৃষ্টি করবেন, আর এটা তার কাছে খুবই সহজ। (সূরা আর রূমঃ ২৭)
﴿مَّا خَلْقُكُمْ وَلاَ بَعْثُكُمْ إِلاَّ
كَنَفْسٍ وَٰحِدَةٍ﴾
তোমাদেরকে সৃষ্টি করা এবং তোমাদেরকে পূণরায় উত্থিত করা তেমনই সহজ, যেমন একটি প্রাণ সৃষ্টি করা সহজ। (সূরা লুকমানঃ ২৮)
§ لَيَقُولَنَّ
الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ هَٰذَا إِلَّا سِحْرٌ مُّبِينٌ (তাহলে
অস্বীকারকারীরা সংগে সংগেই বলে উঠবে। এতো
সুস্পষ্ট যাদু)
-
এটা মুশরিক
ও কাফেরদের উক্তি, যা তারা
তাদের অস্বীকারের মানসিকতা ও বিরোধীতার
মানসিকতা ও মগ্নতার কারণে
বলে।
-
কাফেরদের এই মগ্নতার
কারণে তারা এই উদ্দেশ্যটাকে
বুঝতে পারছে না। ফলে
রাসূল যখন এই উদ্দেশ্য
বুঝাতে যাচ্ছেন তা অট্টহাসি
দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে এবং
বিদ্রুপ করে রাসূলের কথাকে
যাদুকরের মতো কথা বলে
উল্লেখ করছে।
﴿وَلَئِنْ أَخَّرْنَا عَنْهُمُ الْعَذَابَ
إِلَىٰ أُمَّةٍ مَّعْدُودَةٍ لَّيَقُولُنَّ مَا يَحْبِسُهُ ۗ أَلَا يَوْمَ
يَأْتِيهِمْ لَيْسَ مَصْرُوفًا عَنْهُمْ وَحَاقَ بِهِم مَّا كَانُوا بِهِ
يَسْتَهْزِئُونَ﴾
৮। আর যদি
আমি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের শাস্তি পিছিয়ে দেই তাহলে তারা বলতে থাকে, কোন্ জিনিস শাস্তিটাকে আটকে রেখেছে? শোনো!
যেদিন সেই শাস্তির সময় এসে যাবে সেদিন কারো ফিরানোর প্রচেষ্টা তাকে ফিরাতে পারবে
না এবং যা নিয়ে তারা বিদ্রূপ করছে তা-ই তাদেরকে ঘেরাও করে ফেলবে।
§ وَلَئِنْ
أَخَّرْنَا عَنْهُمُ الْعَذَابَ إِلَىٰ أُمَّةٍ مَّعْدُودَةٍ لَّيَقُولُنَّ مَا
يَحْبِسُهُ (আর যদি
আমি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের শাস্তি পিছিয়ে দেই তাহলে তারা বলতে থাকে, কোন্
জিনিস শাস্তিটাকে আটকে রেখেছে?)
§ কুরআন ও হাদীসে
أُمَّةٍ শব্দটি
কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে যেমনঃ
১. সময়
বা সময়ের দৈর্ঘ
বুঝানো হয়েছে।
যেমনঃ
o এই সূরাতে - إِلَىٰ أُمَّةٍ مَّعْدُودَةٍ
o সূরা ইউসুফে বলা হয়েছেঃ ﴿وَقَالَ ٱلَّذِى نَجَا مِنْهُمَا وَٱدَّكَرَ
بَعْدَ أُمَّةٍ﴾ (বন্দীদের মাজে যে ব্যক্তি মুক্তি
পেয়েছিল এবং বহুদিন পর তার
হলো,
সে বললো..। (আয়াত ৪৫)
২. অনুসরণীয় ইমামের
অর্থ বুঝাতে।
যেমনঃ
o হযরত ইব্রাহীম আ. এর ব্যাপারে সূরা আন নাহলে বলা হয়েছেঃ ﴿إِنَّ إِبْرَٰهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَـٰنِتًا
لِلَّهِ حَنِيفًا وَلَمْ يَكُ مِنَ ٱلْمُشْرِكِينَ﴾ প্রকৃতপক্ষে ইব্রাহীম
নিজেই ছিল একটি পরিপূর্ণ
উম্মত, আল্লাহর হুকুমের অনগত এবং
একনিষ্ঠ। সে কখনো
মুশরিক ছিল না। (আয়াত
১২০)
৩. মিল্লাত ও দ্বীন
অর্থ বুঝাতে।
যেমনঃ
o মুশরিকদের ব্যাপারে খবর দিতে গিয়ে বলা হয়েছেঃ
﴿إِنَّا وَجَدْنَآ ءَابَآءَنَا عَلَىٰ
أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَىٰ ءَاثَـٰرِهِم مُّقْتَدُونَ﴾
নিশ্চয় আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেকে একটি দ্বীনের উপর পেয়েছি এবং আমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করি। (সূরা আয যুখরূফঃ ২৩)
৪. জামায়াত ও দল
অর্থ বুঝাতে।
যেমনঃ
﴿وَلَمَّا وَرَدَ مَآءَ مَدْيَنَ وَجَدَ
عَلَيْهِ أُمَّةً مِّنَ ٱلنَّاسِ يَسْقُونَ﴾
যখন সে (তথা মুসা আ.) মাদইয়ানের পানির (কূপের) নিকট পৌছলো, ততখন সেখানে একদল লোকদের দেখতে পেলো, যারা নিজেদের পশুগুলিকে পানি পান করাচ্ছিল। (সূরা আল কাসাসঃ ২৩)
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِى كُلِّ أُمَّةٍ
رَّسُولاً أَنِ ٱعْبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجْتَنِبُواْ ٱلْطَّـٰغُوتَ﴾
আমি প্রত্যেক দলের মধ্যে (একথা বলঅর জন্য) রাসূল পাঠিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহরই ইবাদত করবে এবং তাগুতের থেকে দূরে অবস্থান করবে। (সূরা আন নাহলঃ ৩৬)
﴿وَلِكُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولٌ فَإِذَا جَآءَ
رَسُولُهُمْ قُضِىَ بَيْنَهُمْ بِٱلْقِسْطِ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُونَ﴾
প্রত্যেক দলের জন্য একজন রাসূল রয়েছেন। সুতরাং যখণ তাদরে রাসূল এসে পড়ে তখন সে তাদের মধ্যে ন্যায়ের সাথে ফায়সালা করে এবং তারা অত্যাচারিত হয় না। (সূরা ইউনুসঃ ৪৭)
والذي
نفسي بيده لا يسمع بي أحد من هذه الأمة يهودي ولا نصراني، ثم لا يؤمن بي، إلا دخل
النار
যার হাতে আমার প্রাণ, তার শপথ! এই উম্মতের যে ইহুদী ও খৃষ্টান আমার নাম শুনলো, অথচ ঈমান আনলেঅ না, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। (মুসলিম)
﴿كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ
لِلنَّاسِ﴾
তোমরা উত্তম সম্প্রদায়, যে সম্প্রদায়কে প্রকাশ করা হয়েছে মানবমন্ডলীর জন্য। (সূরা আলে ইমরানঃ ১১০)
সহীহ হাদীসে বলা হয়েছেঃ فأقول أمتي أمتي (আমি বলবোঃ আমার উম্মত আমার উম্মত)
৫. শ্রেণী
ও গোষ্ঠী অর্থ
বুঝাতে যেমনঃ
﴿ وَمِن قَوْمِ
مُوسَىٰ أُمَّةٌ يَهْدُونَ بِٱلْحَقِّ وَبِهِ يَعْدِلُونَ﴾
মুসা আ. এর কওমের মধ্যে এমন শ্রেণীর লোকও রয়েছে, যারা সত্যের পথে চলে এবং ওর মাধ্যমেই ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। (সূরা আল আরাফঃ ১৫৯)
﴿لَيۡسُوۡا سَوَآءًؕ مِنۡ
اَهۡلِ الۡكِتٰبِ اُمَّةٌ قَآٮِٕمَةٌ يَّتۡلُوۡنَ اٰيٰتِ اللّٰهِ اٰنَآءَ الَّيۡلِ
وَهُمۡ يَسۡجُدُوۡنَ﴾
কিন্তু সমস্ত আহলি কিতাব এক ধরনের নয়। এদের মধ্যে কিছু লোক রয়েছে সত্য পথের ওপর
প্রতিষ্ঠিত। তারা রাতে আল্লাহর আয়াত পাঠ করে এবং তাঁর সামনে
সিজদাবনত হয়। (সূরা আলে ইমরানঃ ১১৩)
(আল কুরআনে উম্মাহ-বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন)
§ أَلَا يَوْمَ
يَأْتِيهِمْ لَيْسَ مَصْرُوفًا عَنْهُمْ وَحَاقَ بِهِم مَّا كَانُوا بِهِ
يَسْتَهْزِئُونَ (শোনো!
যেদিন সেই শাস্তির সময় এসে যাবে সেদিন কারো ফিরানোর প্রচেষ্টা তাকে ফিরাতে পারবে
না এবং যা নিয়ে তারা বিদ্রূপ করছে তা-ই তাদেরকে ঘেরাও করে ফেলবে)
আয়াত সমূহ থেকে শিক্ষাঃ
§ হুদ জাতির ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, যাতে আল্লাহর আযাবের শিকার আমরা না হই। আর সেজন্য রাসূলের সতর্কবাণী অনুযায়ী আমাদেরকে হেদায়াতের পথে
চলতে হবে।
§ আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী আমাদেরকে চলতে হবে। এই আকীদা পোষণ করতে হবে যে, এই কিতাবে আমার সকল ধরণের বিষয় আছে। সেখান থেকে সমাধান গ্রহণ করতে হবে।
§ আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে, আমাদের সকল একটিভিটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নজরে রয়েছে।
§ আমাদের গোলামী হবে কেবল আল্লাহ জন্য। এজন্য রাসূল সা. এর দেখানো পথেই আমাদের
চলতে হবে। অন্য কোন পথে নয়।
§ জীবনে চলার পথে আমাদেরকে ক্ষমা চাইতে হবে এবং তাওবা করে ফিরে
আসতে হবে আল্লাহর পথে।
§ দুনিয়ার সকল নিয়ামতকে আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার হিসাবে গ্রহণ
করে ভোগ করতে হবে। আখেরাতকে স্মরণ করে দুনিয়াকে
গ্রহণ করতে হবে। দুনিয়া বিমুখ হলে চলবে না।
§ আমাদেরকে সব সময় স্মরণ রাখতে হবে যে, দিন শেষে আমাদের মালিকের কাছে ফিরে যেতে হবে এবং সেখানে সকল কাজের হিসাব দিতে
হবে।
§ আমাদের রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর-এই কথা মনের মধ্যে সব সময় জাগরুক রাখতে হবে। রিযিকের জন্য পেরেশান হওয়া চলবে না।
§ আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতে হবে। নাস্তিক্যবাদী সকল ধরণের প্রচারণায় বিভ্রান্ত হওয়া চলবে না।
0 Comments