মুহাসাবা বনাম জনকন্ঠ রোধ

মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ মুহাসাবা ইসলামের একটি ঐতিহ্য, সৌন্দয্য ও সমাজ সংশোধনের অনবদ্য হাতিয়ার।

মুহাসাবা হলো সংশোধনের উদ্দেশ্যে গঠন মূলক সমালোচনা। যার প্রচলন ইসলামী সংগঠন গুলো এবং তার জনশক্তির মাঝে রয়েছে। তবে এর প্রেকটিস সফল ভাবে রয়েছে জামায়াতে ইসলামীতে। জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে নিদারুণ মেসাকার-হামলা, মামলা, খুন, সবকিছুকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে জামায়াতে ইসলামী এখনো আপন মহিমায় ময়দানে ঠিকে আছে দুইটি কারণে। ১. নেতৃত্বের প্রতি আন্তরিক আনুগত্য এবং ২. মুহাসাবা।

প্রশ্ন হলোঃ ইসলামী সংগঠন গুলোতে পরিচালিত মুহাসাবার পদ্ধতি কি ইসলাম সমর্থিত?

এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। ঘটনার বর্ণনাটা এই ভাবেঃ

قام عمر بن الخطاب رضي الله عنه خطيباً فقال: أيها الناس اسمعوا وأطيعوا، فقام له سلمان الفارسي يقول: لا سمع لك اليوم علينا ولا طاعة، فلم يغضب عمر رضي الله عنه، ولم يقل لسلمان: كيف تكلمني بهذه اللهجة وأنا الخليفة، وإنما سأله في هدوء راض: ولم؟ قال سلمان: حتى تبين لنا من أين لك هذا البرد الذي ائتزرت به، وقد نالك برد واحد كبقية المسلمين، وأنت رجل طوال لا يكفيك برد واحد، فلم يغضب عمر مرة أخرى وسلمان كاد يوجه إليه الاتهام باستغلال النفوذ والافتئات على أموال المسلمين، ولم يقل له: أنا ولي الامر أتصرف في الأمر كما أشاء وليس من حقك أن تسائلني، وإنما نادى: يا عبدالله بن عمر: قال لبيك، يا أمير المؤمنين، قال: نشدتك الله، هذا البرد الذي ائتزرت به، أهو بردك؟ قال: نعم، والتفت إلى المسلمين فقال: إن أبي قد ناله برد واحد كما نال بقية المسلمين وهو رجل طوال لا يكفيه برد واحد، فأعطيته بردي ليئتزر به. فقال: سلمان الآن مر، نسمع ونطع.

বাংলাতে যার সারমর্ম হলোঃ

হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. মসজিদের নাবাউয়ীর মিম্বরে দাড়িয়ে বক্তব্য শুরুর প্রাক্ষালে বললেনঃ হে উপস্থিত জনতা!  আমার কথা শোন এবং মান। তখন প্রসিদ্ধ সাহাবী সালমান ফারসী রা. দাড়িয়ে বললেনঃ আজ আপনার কথা শুনবো না এবং মানবোও না। হযরত সালমান ফারসী রা. এর এমন আচরণে অর্ধপৃথিবীর শাসক হযরত উমরা রা. কোন রাগ করলেন না, কিংবা তাকে একথাও বললেন না যে, তুমি কিভাবে এই ভাষায় আমার সাথে কথা বলছো, (জান! আমি কে) আমি খলিফাতুল মুসলিমীন। বরং হযরত উমর রা. অত্যন্ত সন্তুষ্ট চিত্তে শান্তভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ কেন? তখন হযরত সালাম ফারসী রা. বললেনঃ যতক্ষণ না আমাদের কাছে এটা পরিস্কার হবে যে, আপনি যে চাদর খানা পরিধান করেছেন তা কোথা থেকে জোগাড় করলেন। আপনি তো অন্যান্য সকল মুসলমানদের মতো একটি চাদর পেয়েছেন। আপনি লম্বা মানুষ, বিধায় এই এক খন্ড চাদর দিয়ে (আপনার শরীরের উপযোগী লম্বা) চাদর বানানো সম্ভব না।  আপনি পরিধান করেছেন (দুই কাপড়ের) বড় চাদর। একথা শুনে হযরত উমরা রা. কোন রাগ করলেন না। হযরত সালমান ফারসি রা. মূলতঃ হযরত উমরের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সম্পত্তিতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজে বেশী গ্রহণের অভিযোগ করলেন। অথচ হযরত উমর রা. তাকে কিছু বললেন না। বললেন না যে, আমি শাসক, আমি আমার ইচ্ছামতে যেভাবে খুশী বিষয়টি নিষ্পত্তি করবো। এব্যাপারে আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করার অধিকার রাখেন না। বরং তিনি নিজপুত্র ডাক দিলেনঃ হে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.। উপস্থিত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. তাঁর তাকে সাড়ে দিয়ে বললেনঃ ইয়া আমীরুল মুমিনীন-আমি হাজির। তখন উমর রা. বললেনঃ আল্লাহর কসম করে আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, এই যে চাদর, এটাতে যে অতিরিক্ত কাপড় রয়েছে তা কি তোমার নয়? হযরত ইবনে উমর রা. বললেনঃ হ্যাঁ! এটি আমার। তারপর হযরত ইবনে উমর রা. মুসলমানদের দিকে ফিরে বললেনঃ আমার আব্বা সকল মুসলমানদের মতো একটিমাত্র চাদর পেয়েছিলেন। তিনি লম্বা মানুষ, যার কারণে প্রাপ্ত চাদরের এই খন্ডটি তার জন্য যথেষ্ট ছিল না বলে আমি আমার প্রাপ্ত চাদরটিও তাকে দিয়ে দিয়েছি, যাতে তার শরীরের উপযোগী একটি চাদর হয়ে যায়। হযরত সালাম ফারসী রা. ইবন্ উমর রা. এর এই কথা শুনে বললেনঃ এখন পরিস্কার হয়েছে, আপনি পাশ করেছেন, আমরা আপনার জবাবদিহিতে সন্তুষ্ট হয়েছি। আপনি আপনার বক্তব্য শুরু করুন, এখন আমরা আপনার কথা শুনবো এবং মানবো।

এই দীর্ঘ ঘটনা উল্লেখ করার কারণ হলো, ইতিহাসে কোথাও এই তথ্য পাওয়া যায় না যে, হযরত উমর রা. বা অন্য কোন সাহাবী তখন বলেছেনঃ আপনি কি ব্যক্তিগত ভাবে হযরত উমর রা. এর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেছেন? আপনি কি ব্যক্তিগত পর্যায়ে মুহাসাবা করেছিলেন? বরং আমরা দেখতে পাই, তিনি জনসমক্ষে হযরত সালমান ফারসি রা. আনিত অভিযোগের যথাযথ জবাব প্রদান করেছেন।

কিন্তু আমাদের মাঝে এই পদ্ধতিটি প্রচলিত আছে যে, বৈঠকীয় ভাবে কারো মুহাসাবা করার আগে ব্যক্তিগত ভাবে মুহাসাবা করে নিতে হবে। যদি ব্যক্তিগত ভাবে মুহাসাবা না করে বৈঠকে উপস্থাপন করেন বা করতে চান, তাহলে বৈঠকের পরিচালক তার অনুমতি দেন না এবং এব্যাপারে বাড়াবাড়ি করাকে সাংগঠনিক শৃংখলা লংঘন হিসাবে গন্য করা হয়।

আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই পদ্ধতিটাকে পছন্দ করি এবং এটা সাংগঠনিক শৃংখলার জন্য একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি বলে স্বীকার করি। কিন্তু এই পদ্ধতিটি ইসলামের অনুসৃত পদ্ধতি আর ঐতিহ্যের সাথে মিলে কি না, তা আমার জানা নেই।

মুহাসাবাকে আমরা গঠনমূলক সমালোচনা ও সংশোধনের হাতিয়ার হিসাবে উল্লেখ করলেও, যিনি মুহাসাবা করেন তাকে কল্যাণকামী বিবেচনা করে তাকে ধন্যবাদ প্রদানের জন্য আমরা নসিহতপ্রাপ্ত হলেও আমরা কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল জীবনে তা করিনা। বরং আমার মুহাসাবা করা হলে আমি নিজেকে অপমাণিত বোধ করি, যিনি মুহাসাবা করেন তাকে ধন্যবাদ দেয়াতো দূরের কথা, তারপ্রতি বিরক্ত ও বিরাগবাজন হই এবং আমরা এটাকে অপমান বিবেচনা করে এটা কখনো ভূলিনা।

সাংগঠনিক জীবনে মুহাসাবা একটি ভাল প্র্যাকটিস হলেও মুহাসাবার ফলাফল নির্ভর করে যিনি মুহাসাবা করছেন এবং যার মুহাসাবা করা হচ্ছে, তাদের দুইজনের আন্তরিক উপলব্দির উপর। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, জনশক্তিকে সেই উপলব্দির মানে নিয়ে যেতে আমরা ব্যর্থ।

মুহাসাবার পদ্ধতি কি ইসলাম সমর্থিত? এই প্রশ্নের উত্তরে আমি কিছুই বলিনি। কারণ আমার লেখাপড়ার দৌড় আমাকে সেই সিদ্ধান্তে পৌছানোর মতো সামর্থ দেয়নি। কিন্তু যাদের অনেক লেখাপড়া আছে, তারা তথ্য ভিত্তিক জবাব দেবেন এমন প্রত্যাশাতো করতে পারি।

আবারও উল্লেখ করছি যে, আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই পদ্ধতিটাকে পছন্দ করি এবং এটা সাংগঠনিক শৃংখলার জন্য একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি বলে স্বীকার করি। কিন্তু এই পদ্ধতিটাকে একমাত্র পদ্ধতি বিবেচনা করি না। আমার বিবেচনায় (লেখাপড়ায় নয়) মুহাসাবা অপেন হলে দায়িত্বশীলদের সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়, স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়, সাংগঠনিক শৃংখলা বিধানে দায়িত্বশীলের যোগ্যতা বাড়ে। কিন্তু সমস্যা আরেক জায়গায়। যেসব দায়িত্বশীলদের কথা ও কাজের গরমিল রয়েছে, যে সব দায়িত্বশীল ব্যক্তিগত জীবনে স্বচ্ছ নন, যে সব দায়িত্বশীল পরিস্থিতিকে কন্ট্রোল করার যোগ্যতা রাখেন না, তাদের জন্য অপেন মুহাসাবা পদ্ধতি বিপদ জনক বটে।

উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত একজন দায়িত্বশীল সাধারণ জনশক্তির সমাবেশে জেলা বা কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলের ব্যাপারে কোন কথা বলে বা অভিযোগ করে পরের দিন তিনি সে দায়িত্বে থাকবেন, এমন নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারি না। অথচ ইসলামী শরীয়াতে প্রকাশ্যে এই ধরণের কথা বলা-এটা বড় ধরণের কোন গোনাহ বলে আমার কাছে বিবেচিত হয় না। বরং এর মাধ্যমে জনকন্ঠ রোধ করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে স্বেচ্ছাচারের গোড়াপত্তণ করা হচ্ছে।

(লেখাটির ব্যাপারে গঠনমূলক মন্তব্য কাম্য)

মুহাসাবা সম্পর্কে আমার লিখনি সমূহঃ

১. আলোচনা নোট -আনুগত্য ও মুহাসাবা

২. বই নোট -ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন

মুহাসাবা সম্পর্কে আরো লিখাঃ

১. মুহাসাবা - মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ

. আলোচনা - ইসলামী সংগঠনে আনুগত্য, পরামর্শ ও ইহ্তিসাব-মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন

Post a Comment

1 Comments

মুহাসাবাকে আমরা গঠনমূলক সমালোচনা ও সংশোধনের হাতিয়ার হিসাবে উল্লেখ করলেও, যিনি মুহাসাবা করেন তাকে কল্যাণকামী বিবেচনা করে তাকে ধন্যবাদ প্রদানের জন্য আমরা নসিহতপ্রাপ্ত হলেও আমরা কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল জীবনে তা করিনা। বরং আমার মুহাসাবা করা হলে আমি নিজেকে অপমাণিত বোধ করি, যিনি মুহাসাবা করেন তাকে ধন্যবাদ দেয়াতো দূরের কথা, তারপ্রতি বিরক্ত ও বিরাগবাজন হই এবং আমরা এটাকে অপমান বিবেচনা করে এটা কখনো ভূলিনা।
আমিও ব্যক্তিগত ভাবে এই পদ্ধতিটাকে পছন্দ করি এবং এটা সাংগঠনিক শৃংখলার জন্য একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি বলে স্বীকার করি।
তবে সাহাবা আজমাঈনদের যুগের মত অপেন মুহাসাবার পক্ষে নই। এতে আমার মনে হয় অপব্যবহার, সৌন্দর্য, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির বা শৃঙ্খলা জনীত সমস্যার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু উত্তরণের কোন কি পথ ও পদ্ধতি নেই। হৃদয়ের বিশালতা কি বই পুস্তকের ভাষা?