মাওলানা ফয়জুর রহমান সাহেবের সাথে পরিচয়ঃ মাওলানা ফয়জুর রহমান ছাত্র
জামানা থেকে আমাদের মাঝে ‘জিহাদী’ নামে পরিচিত ছিলেন। তার সাথে আমার প্রথম পরিচয়
১৯৮২ সালে। ফেব্রুয়ারী মাসে যখন আমি চান্দগ্রাম আনওয়ারুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা থেকে
সুজাউল আলিয়া মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হই। তিনি তখন ছাত্র ও এলাকাবাসীর
মধ্যে বিশাল ধরণের সেলিব্রেটি। সদ্য সমাপ্ত ফাজিল পরিক্ষায় তিনি ভাল ফলাফল অর্জন
করেছিলেন। দেখতে খুব সুন্দর নয়, চেহারা ফর্সা
নয়,
১০জন দাড়ালে আলাদা ১জন-এমন মনে হয় না। কিন্তু লোকটাকে সবাই
সমীহ করে চলে, পাশে ভীড়তে চায়-লোকটা কে? সেই ধরণের আগ্রহ থেকে তার সাথে সাথে পরিচয়। তদানিন্ত সময়ে
বুখারী শরীফের বিশাল ভলিয়ম হাতে নিয়ে মাদ্রাসায় উপস্থিত হওয়া আমার দেখা প্রথম
ব্যক্তি মরহুম মাওলানা ফয়জুর রহমান।
কৈশোরের আইকনঃ পূর্বেই বলেছি ভাল ছাত্র হিসাবে তখন তার জয়জয়কার-এমন একটি অবস্থা তিনি আমার
আকর্ষণের বস্তুতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। এমনই সময়ে ১৯৮২ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের
মধ্যে একটি আভ্যন্তরিন সমস্যা দেখা দেয়। তদানিন্তন শিবির সভাপতি জনাব আব্দুল কাদের
বাচ্চু (বর্তমান নামঃ ড. আহমেদ আব্দুল কাদের-মহাসচিব, খেলাফত মজলিস) এর নেতৃত্ব শিবিরের কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলদের
বড় একটি অংশকে নিয়ে জামায়াতের ইসলামীর লেজুড় ভিত্তি না করার ঘোষণা দেন। এমন
অবস্থায় তার এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে শিবিরে রীতিমতো ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
কিন্তু শিবিরের অধিকাংশ সদস্য তার মতের পক্ষে না থাকায় তার ব্যবস্থাপনায় তার
অনুসারীদের নিয়ে ভিন্ন দু’টি সংগঠনের সূচনা করা হয়। একটি বাংলাদেশ ইসলামী
ছাত্রশিবির এবং অপরটি বাংলাদেশ ইসলামী যুবশিবির। তখনকার শ্লোগান ছিল “একই
আন্দোলনের দু’টি স্থর-ছাত্রশিবির যুবশিবির।”
আমার পাঠক যারা এই লেখাটি পড়ছেন, তখন এই যুগের কথা চিন্তা করে পড়লে বিভ্রান্তিতে পড়বেন। তখন
যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো কঠিন ছিল যে, জাতীয় পত্রিকা সুজাউলে পৌছাতো পত্রিকা প্রকাশের পরদিন সন্ধ্যা বেলা। সুজাউল
থেকে বড়লেখা যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল পয়দল বা পায়ে হাটা। সেই সময়ে আমরা অষ্টম
শ্রেণীতে পড়ুয়ারা এখনকার মতো রাজনীতি স্বচেতন ছিলাম না। বক্তারা বক্তৃতা দিতে গিয়ে
সংগঠন বা রাজনীতি বিষয়টা বুঝাতেই অনেক বেগ পেতে হতো। তখন আমাদের কাজ ছিল, “ভাল ছাত্ররা যা করে-আমরা তা করাই ভাল” এমন পর্যায়ে। বিধায়, শিবিরের আভ্যন্তরিণ এই সমস্যাটা সুজাউল মাদ্রাসাতে পৌছতে পৌছতে ১৯৮৪ পর্যন্ত
গড়ায়।
আমাদের দেখা অনুযায়ী সেই সময়ে মাওলানা ফয়জুর
রহমান ভাই শিবিরে যুক্ত ছিলেন না। তদানিন্তন সময়ে ফাজিল শ্রেণী পড়ুয়া মেধাবী ছাত্র
হাফিজ নিজাম উদ্দিন-তিনি তো রীতিমত
কুরআন শরীফ দেখিয়ে শিবির করা ভাইদের কাফির ফতোয়া দেখাতেন। কিন্তু আমরা ১৯৮৪ সালে
দেখি মাওলানা ফয়জুর রহমান, হাফিজ নিজাম
উদ্দিন-উনারা নিজেদেরকে শিবিরের সাথী পরিচয় দিচ্ছেন। তাদের সাথে আছেন আলিম শ্রেণীর
ফাস্ট বয় গৌছ উদ্দিন। সেই সময়ে বড়লেখাতে শিবিরের কার্যক্রম মূলত ছিল সুজাউল
মাদ্রাসা কেন্দ্রীক। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সেই সময়ে বড়লেখা শিবিরের যারা সাথী ছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ছাড়া সকলেই আব্দুল কাদের বাচ্চু ভাইয়ের সাথে চলে যান। তখন
সাগরনাল এলাকায় বাড়ী সুজাউল মাদ্রাসার ছাত্র মুদরিস ভাই, শিবিরের একমাত্র সাথী যিনি আব্দুল কাদের বাচ্চু ভাইয়ের সাথে
না গিয়ে তথাকথিত জামায়াতের লেজুড় ভিত্তিতেই থেকে যান (পরে তিনি উপজেলা শিবিরের
সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন)। কিন্তু শিবিরের দূর্যোগে এই সময়ে এগিয়ে আসেন মাওলানা
ফয়জুর রহমান, হাফিজ নিজাম উদ্দিন (বড়লেখা
উপজেলা শিবিরের প্রাক্তণ সভাপতি ও বিয়ানী বাজার কামিল মাদ্রাসার সাবেক আরবী
প্রভাষক, মরহুম), সাইফুল ইসলাম
(গল্লাসাংগন-ছয়ফুল ভাই বলে পরিচিত, দৌলতপুর মাদ্রসার প্রাক্তণ শিক্ষক, মরহুম)
গংরা। পরে জানতে পারি যে, উনারা
আন্তরিকতার সাথেই শিবিরের সাথে ছিলেন। কিন্তু শিবির করার চেয়ে পড়ালেখাকে উনারা
গুরুত্বপূর্ণ মনে করে শিবিরে অগ্রসর হোননি। কিন্তু যখন শিবিরে দূর্যোগ এসেছে, তখন বসে না থেকে হাল ধরেছেন এবং সাথী শপথ নিয়েছেন।
আমরা যারা সাধারণ ছিলাম, তারা তখন দুই শিবিরের প্রোগ্রামেই উপস্থিত হতাম। সংগঠনে লোক ভীড়ানোর জন্য দুই
শিবিরই তৎপর ছিল এবং সেই সময়ে দুই প্রোগ্রামেই ভাল ভাল খাবারের আয়োজন থাকতো। আমরা
কোন প্রোগ্রামে খাবারের মান ভাল, সেই বিষয়
বিবেচনা করে সেই প্রোগ্রামে উপস্থিত হতাম। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ১০ম শ্রেণীতে
পড়ার সময় সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় হয়ে গেল একমুখী হওয়ার। তখন জিহাদীর মতো ছাত্র যে
সংগঠনে আছেন, সেই সংগঠনে যোগদানেরই সিদ্ধান্ত
নিলাম।
দিনটা ছিল সম্ভবতঃ ২১শে সেপ্টেম্বর ১৯৮৪, সুজাউল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি প্রোগ্রাম ছিল।
সেখানে উপস্থিত হলেন তদানিন্তন জেলা সভাপতি ডা. ফরিদ উদ্দিন খান। তার উপস্থিতিতে
ফয়জুর রহমান ভাইদের ব্যবস্থাপনায় সমর্থক ফরম পুরণ করে আনুষ্ঠানিক ভাবে শিবিরে
যোগদান করলাম। তারপরেই ২৭শে
সেপ্টেম্বর ১৯৮৪; বড়লেখায়
কেয়ারটেকার সরকারের দাবীতে এবং জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে মিছিল। সেই মিছিলে অংশ
নিলাম। আমার জীবনের প্রথম মিছিলে আমি মাওলানা ফয়জুর রহমান জিহাদীকে নেতৃত্বে
দেখলাম। ১৯৮৪ সালে
সুজাউল আলিয়া মাদ্রাসাতে ছাত্রদের দীর্ঘ মেয়াদী একটি আন্দোলন হয়। তখন ফয়জুর রহমান
জিহাদী কামিল ক্লাশের পড়ালেখা শেষ করেছেন। সম্ভবতঃ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বা
পরীক্ষাও শেষ করেছেন। সেই সময়ে মাওলানা মঈনুদ্দীন (পকুয়ার হুজুর) সুজাউল আলিয়া
মাদ্রাসায় অতিরিক্ত আরবী প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। তার নিয়োগের বিরুদ্ধে
ছাত্রদের একটি আন্দোলন চলে। সেই আন্দোলনে মাদ্রাসার সকল ভাল ছাত্ররা সামনে ছিলেন
এবং পিছনে আমাদের মতো হাটুভাঙা ছাত্ররা। সেই আন্দোলনে সাথে থাকতে গিয়ে ফয়জুর রহমান
সাহেবের সাথে সম্পর্ক আন্তরিকতায় রূপান্তরিত হয়। দাখিল পাশ করে আন্দোলনের অংশ হিসাবে আমরা প্রায় ৮০জন ছাত্র
হিজরত করে চলে যাই পাথারিয়া গাংকুল মনসুরিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায়। সেখানে গিয়ে তাকে
উস্তাদ হিসাবে পাই।
উস্তাদ মাওলানা ফয়জুর রহমানঃ ১৯৮৫ সাল। আমরা দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিলাম। কেন্দ্র ছিল
মৌলভী বাজার টাউন সিনিয়র মাদ্রাসা। দাখিল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর সামান্য দিন
চান্দগ্রাম আনোয়ারুল উলুম দাখিল মাদ্রাসার নতুন শুরু হওয়া আলিম ক্লাশে পড়লাম।
কিন্তু আমার মন পড়ে আছে গাংকুল মাদ্রাসায়। কারণ বিগত আন্দোলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী
আমাদের সহযোদ্ধা প্রায় ৮০জন ভাই ওখানে চলে গেছেন। মাত্র দেড় দুইমাস চান্দগ্রামে
ক্লাশ করে চলে গেলাম গাংকুল মাদ্রাসায়। ভর্তি হলাম আলিম শ্রেণীতে। সেখানে গিয়ে
শিক্ষক হিসাবে পেলাম আমার কৈশোরের আইকন জনাব মাওলানা ফয়জুর রহমানকে আরবী প্রভাষক
হিসাবে। তখন সেখানে প্রিন্সিপাল হিসাবে ছিলেন আমার আরেক উস্তাদ মরহুম আব্দুস শাকুর
সাহেবকে-যিনি বেশ কিছু দিন সুজাউল আলিয়া মাদ্রাসায় শাইখুল হাদীস হিসাবে দায়িত্ব
পালন করেছিলেন। দীর্ঘ দুই বছর উনার কাছে আলিম শ্রেণীর পাঠ নিলাম। পরীক্ষার সময়
তিনি নিজে কমলগঞ্জের ভানুগাছ মাদ্রাসার পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হলেন, আমাদের বিভিন্ন ধরণের সহযোগিতা করলেন, নানাবিধ নসিহত করলেন। এই সময়ে আমি শিবিরের সাথী শপথ গ্রহণ
করলাম। সংগঠন থেকে ডাক আসলো মৌলভী বাজার চলে যেতে। তাই গাংকুল মাদ্রাসায় ফাজিল
পড়ার সুযোগ হলো না। চলে যেতে হলো মৌলভী বাজার টাউন সিনিওর মাদ্রাসায়-যেখানে
প্রিন্সিপাল ছিলেন মরহুম উস্তাদ তারাদরমের মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম সিদ্দিকী।
উস্তাদ হিসাবে মাওলানা ফয়জুর রহমান ছিলেন
জ্ঞানের সাগর। নানান এঙ্গেলের জ্ঞানের ভান্ডার ছিল তার সংরক্ষণে। তিনি ইলমে ছারফ ও
ইলমে নাহু শিখাতেন গতানুগতিক ধারার বিপরীতে ভিন্ন এক আঙ্গিকে। ইলমে ছরফ ও নাহু
বুঝাতে গিয়ে তিনি কুরআন থেকে আয়াত কোড করতেন এবং কোন আয়াতে মাজী (অতীত কাল) এবং
সেই একই শব্দে কোন আয়াতে মজারা (বর্তমান ও ভবিষ্যত কাল) ব্যবহার করা হয়েছে তা
দেখিয়ে দিতেন। তাকীদের শব্দাবলী কুরআন থেকে উচ্চারণ করতেন নিঁপুণ ভাবে। এতে করে
ছাত্রদের হৃদয়ে গেঁথে যেতো।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথী ছিলেন তিনি। শিবিরকে প্রোগ্রাম
করতে নানাবিধ সুযোগ উনি দিতেন ঠিকই। কিন্তু তার মাদ্রাসার ছাত্ররা ক্লাস ফাঁকি
দিয়ে সংগঠনের কাজে যাবে, এমনটা তিনি
পছন্দ করতেন না। তার সোজাসাপটা বক্তব্যঃ আগে ছাত্র, পরে শিবির। আগামী দিনের ইসলামী আন্দোলনের প্রয়োজনে শিবিরের ছেলেদেরকে ভাল আলেম
হতে হবে।
তার ছাত্র হিসাবে যারা এই মুহুর্তে মনে পড়ে, তাদের মধ্যে আছেন, মাওলানা গৌছ উদ্দিন সিদ্দিকী (বড়লেখা শিবিরের সাবেক উপজেলা সভাপতি, বর্তমানে আল আরাফা ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা), মাওলানা ইসলাম উদ্দিন (হবিগঞ্জ শিবিরের সাবেক জেলা সভাপতি, বর্তমানে গ্রামতলা জামেয়ার প্রিন্সিপাল), মাওলানা উসমান আলী (গ্রামতলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান
শিক্ষক),
মাওলানা সেলিম উদ্দিন (ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রাক্তণ
কেন্দ্রীয় সভাপতি, জামায়াতে ইসলামীর
ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর), মাওলানা আমীনুল
ইসলাম (বড়লেখা আসনে জামায়াতে ইসলামী মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী)। আরো অনেকে আছেন, পরিসর বড় হওয়ার ভয়ে নাম উল্লেখ করলাম না-ক্ষমা সুন্দর
দৃষ্টিতে দেখবেন।
নোট করার ক্ষেত্রে তার দক্ষতা ছিল অসাধারণ।
লেখার স্পিরিট ছিল অতুলনীয়। হাতের লেখা খুব সুন্দর না হলেও যখন কলম চালাতেন, তখন নিমিশেই কাগজের সাদা চত্বর কালো হয়ে উঠতো। তার কলমে এতো
ধার ছিলে যে, গাংকুল মাদ্রাসা থেকে তিনি যখন
তিনি ঢাকায় কোন একটি মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করলেন, তখন তিনি বিভিন্ন ক্লাসের গাইড বই রচনা করতেন। আল বারাকা
পাবলিকেশন্স নামে বিখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠানের গাইড বই তিনি নিয়মিত লিখতেন। এক সময় তিনি যখন সুজাউলে চলে এলেন, তখন তিনি এইসব গাইড রচনা ছেড়ে দিলেন। আমি তাকে বললাম, কেন ছেড়ে দিলেন। তিনি বললেনঃ এই ময়দানে কাজ করার লোক অনেক
আছে। আমি বিষয় ভিত্তিক বই লিখতে চাই। দারসুল কুরআন জাতীয় বই লিখার আগ্রহ দেখালেন।
আমি বললামঃ এটা অনেক কঠিন ও সময় সাপেক্ষ কাজ। মাদ্রাসার বিষয় গুলো আপনি পড়াচ্ছেন, তাই অনেক বিষয় আপনার কাছে আয়নার মতো পরিস্কার। কিন্তু বিষয়
ভিত্তিক কিছু লিখতে রেফারেন্স বই পড়তে হবে, অনেক ঘুচিয়ে লিখতে হবে। অধ্যক্ষের দায়িত্বের বিশাল ব্যস্ততার মাঝে আপনি তা
পারবেন না। তিনি বললেন, আল্লাহ আমাকে
একদিনে ২৪ ঘন্টা সময় দিয়েছেন। ২৪ ঘন্টা অ----------নে-----------ক লম্বা সময়। আমি
পারবো ইনশাআল্লাহ। তারপর আমি বারবার তাকে তাগিদও দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি অধ্যক্ষের
দায়িত্বের চাপে সেই কাজ হাত দিতে পারেননি।
মুফাস্সিরে কুরআন মাওলানা ফয়জুর রহমানঃ ছাত্রজীবন শেষ করার পর যখন মাওলানা ফয়জুর রহমান শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ
করলেন,
তখন একই সাথে আরো ২টি কাজ করলেন। ১. ইসলামী আন্দোলনের
সংগঠনে সময় দেয়া এবং ২. তাফসীর মাহফিলের মাধ্যমে দাওয়াতী কাজ। অল্প সময়ে তিনি জামায়াতে ইসলামীর রুকন শপথ গ্রহণ করেন। আবার
বিভিন্ন এলাকা থেকে তার তাফসীরুল কুরআন মাহফিলের দাওয়াত আসতে থাকে। কিন্তু তিনি
সকল মাহফিলের দাওয়াত কবুল না করে বিশেষ করে শিক্ষকতা পেশায় আঘাত আসে এমন সময়ে
দাওয়াত কবুল না করে তাফসীর মাহফিল সমূহে উপস্থিতি শুরু করলেন। কয়েকদিনের মধ্যে
মাওলানা ফয়জুর রহমানের তাফসীরের সুবাস ছড়িয়ে পড়লো চতূর্দিকে।
তার তাফসীর পেশের ধারাবাহিকতা ও উপস্থাপনা
এমন ছিল,
যা বুঝানোর জন্য একটি ঘটনার উল্লেখ করি। একবার কাঠালতলীর
টাকি এলাকায়-কাঠালতলী বাজারের পূর্বপাশের ধানক্ষেতের মাঠে দুই দিন ব্যাপী এক
তাফসীর মাহফিলের আয়োজন করা হয়। যতদূর মনে পড়ে সেই তাফসীর মাহফিল আয়োজনের নেতৃত্বে
ছিলেন কাঠালতলীর আব্দুর রহমান রফিক ভাই (বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী) । মাহফিলের
মধ্যমনি ছিলেন সেই সময়ের সাড়া জাগানো মুফাস্সির মাওলানা আবুল কালাম আযাদ। আল্লামা
সাঈদী ও কামাল উদ্দিন জাফরীর পরেই আবুল কালাম আযাদ সাহেবের নাম নেয়া হতো। তার
মাহফিলের বৈশিষ্ট ছিল, তিনি প্রতিটি
মাহফিলে স্রোতাদের প্রশ্নের উত্তর প্রদান করতেন। সম্ভবতঃ প্রশ্নোত্তরের এই সিলসিলা
তার মাধ্যমেই শুরু। তার মাহফিল গুলোতে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুধু মানুষ
আসতো এমন নয়-পার্শবর্তী উপজেলা থেকেও অনেকে উপস্থিত হতেন আগ্রহ ভরে। তাফসীর মাহফিল লোকে লোকারণ্য। কিন্তু হঠাৎ খরব আসলো, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ মাহফিলে আসবেন না। ওয়াজের মাওসুম।
এই সময়ে হঠাৎ করে অন্য মেহমান ব্যবস্থা চাট্টিখানি কথা নয়। কারণ তখনকার যোগাযোগ
ব্যবস্থা সম্পর্কে ইতিপর্বে আমি আলোচনা করেছি। মোবাইল ফোন তো দূরের কথা, তখন বড়লেখায় ল্যান্ড ফোনও চলতো এনালগ পদ্ধতিতে। অবশেষে
দায়িত্ব এসে পড়ে মাওলানা ফয়জুর রহমানের উপর তাফসীর মাহফিল সামলানোর। তিনি দিনের
বেলা এই মাহফিলে ওয়াজ করার কথা, আর রাতের বেলা
মাওলানা আবুল কালাম আযাদের সিডিউল। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে মাওলানা ফয়জুর রহমানের
সিডিউল চেঞ্জ হয়ে চলে গেল মাওলানা আবুল কালাম আযাদের সময়ে-রাতের বেলা।
যথা সময়ে মাওলানা ফয়জুর রহমান তার হালকা লাল
কভারের ডায়েরী সামনে নিয়ে তাফসীরুল কুরআন শুরু করলেন। তার শ্রোতাদের পিনপতন
নিরবতায় রেখে প্রায় দুই ঘন্টা ধারাবাহিক তাফসীর পেশ করলেন। সেই সময়ে আমি গাংকুল
মাদ্রাসার ছাত্র এবং উঠন্তি বয়সের সদ্য শপথ নেয়া শিবিরের সাথী। তাফসীর মাহফিলের
প্রথম দিন শেষ হলো অত্যন্ত সুন্দর ভাবে। শ্রোতাদের অনেককেই বলতে শুনা গেল, আগামীকাল যদি মাওলানা আবুল কালাম আযাদ নাও আসেন, তাহলে কোন সমস্যা নাই। ফয়জুর রহমান সাহেবের পারফর্মেন্স ছিল
অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক।
তাফসীরের মাহফিলে তার এই ব্যতিক্রমী আগমন শুরু হলেও তিনি
দুইটি কারণে এই দিকে অগ্রসর হোননি। ১. তাফসীরের দিকে অগ্রসর হলে তার ছাত্ররা তার
থেকে বঞ্চিত হবে। পক্ষান্তরে ইলমে দ্বীন ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ২. এই দিকে অগ্রসর হলে
হাদীয়া তোহফার লোভ সামলানো মুশকিল। পরে নিজের অবস্থানে থাকা যাবে না।
এই কথা গুলো সেই সময়ের কথা, যখন আমি এবং আমরা, কিংবা জননেতা আমীনুল ইসলাম অথবা এমাদুল ইসলাম-আমরা সকলেই কৈশোরে এবং ছাত্রজীবনে। তখনকার ইসলামী রাজনীতির মাঠে ছিলেন মাষ্টার আব্দুল মান্নান মরহুম এবং ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মালিক, ডা. হিফজুর রহমান, মাষ্টার বশির উদ্দিন, মাষ্টার আব্দুর রহীম, মাষ্টার ফখরুল ইসলাম গং। তখনকার সময়ে আমরা যারা আগামীকে নিয়ে চিন্তা করতাম, তারা মাওলানা ফয়জুর রহমানকে আগামী দিনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড়লেখা থেকে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসাবে স্বপ্ন দেখতাম।
কলিগ মাওলানা ফয়জুর রহমানঃ ১৯৯৫ সালের কোন এক সময়। মাওলানা ফয়জুর রহমান সাহেবের সাথে
আমার দেখা। বড়লেখার কিংবদন্তি নায়ক, নেতা ও শিক্ষাবিদ জনাব আজির উদ্দিন ভাইয়ের অনুরোধে তখন আমি গ্রামতলা দাখিল
মাদ্রাসায় সহকারী সুপার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছি। মাদ্রাসাটির বয়স দীর্ঘদিনের
হলেও সরকারী কোন ধরণের আনুষ্ঠানিকতা তখনো পায়নি। মরহুম মাওলানা আব্দুল হান্নান
পানিধারী সুচনালগ্ন থেকে এই মাদ্রাসায় মুহতামিম হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। আজির
উদ্দিন সাহেব এবং আব্দুল হান্নান সাহেবের প্রত্যাশা আমার হাতের ছোঁয়া আর একাডেমিক
কাগজপত্রের মাধ্যমে মাদ্রাসাটি সরকারী খাতায় নাম লিখাবে।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে কোন ধরণের চাকুরী নকরী
করার পক্ষপাতি নই। আমার জীবনের লক্ষ্য সব সময় বলে এসেছি ব্যবসা করবো। আমার বাবাও
চান না যে আমি চাকুরী করি। উনার বক্তব্য হলো, চাকুরী নকরী করলে হক কথা বলা যায় না। তাই ব্যবসা করে পয়সা উপার্জন করো, ইলম দিয়ে দ্বীনের খেদমত করো। তাই আমি টাইম পাস করার জন্য
ওখানে কাজ করছি। কিন্তু ঐ মাদ্রাসার স্টাফ এবং ছাত্রছাত্রী সবাইকে এই ধারণা দেয়া
হয়েছে যে,
আগামী দিনে এই মাদ্রাসায় প্রিন্সিপাল হবো আমি। এমন
পরিস্থিতিকে একদিন মাওলানা ফয়জুর রহমানের সাথে আমার দেখা। তিনি গাংকুল মাদ্রাসায়
একটি চাকুরীর খবর দিয়ে আমাকে সেখানে যোগদান করার প্রস্তাব করলেন। তার প্রস্তাবে
তাৎক্ষনিক দরখাস্ত লিখা, সিডিউল অনুযায়ী
ইন্টারভিউ প্রদান এবং সবশেষে চাকুরীতে যোগদান করলাম। গাংকুল মাদ্রাসায় চাকুরীতে
যোগদান করে তার কলিগ হয়ে গেলাম।
চাকুরীটা ছিল গ্রন্থাগারিক কাম শিক্ষক পদ।
তিনি তখন গাংকুল মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল হলেও প্রিন্সিপালের যত ফাংশন ছিল, তারমধ্যে প্রিন্সিপালের স্বাক্ষর ছাড়া সবই তিনি সম্পাদন
করতেন। কিন্তু চাকুরীতে যোগদানের পর পুরো অফিস তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। তার এই কর্মকান্ড
আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল সুজাউল মাদ্রাসায় কামিল পড়াকালীন এক সময়ের কথা। এখানে বলে
রাখা দরকার যে, আমি দাখিল সুজাউল মাদ্রাসা থেকে
উত্তীর্ণ হয়ে সুজাউল ছেড়ে চলে গেলেও ১৯৯১ সালে আবার ফিরে আসি সুজাউল মাদ্রাসায়
কামিল পড়তে। তখন টিচার ছিলেন আমাদের খলিল স্যার। যিনি পরে শাহবাজপুর উচ্চ
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন। সুজাউল মাদ্রাসায় বিষম প্রতাপশালী এই টিচারকে
আমি চিনতাম কিরানী স্যার হিসাবে। কারণ পুরোটা সময় তিনি অফিসে পড়ে থাকতেন এবং
দাফতরিক কাজ সম্পাদন করতেন। একদিন কারো কাছে তাকে কিরানী স্যার হিসাবে উল্লেখ করলে, তখন আমাকে বলা হয়ঃ তিনি কিরানী স্যার নন-তিনি মাদ্রাসার
ইংরেজী শিক্ষক। গাংকুল মাদ্রাসায় যখন ফয়জুর রহমান সাহেব আমাকে মাদ্রাসার পুরো দাফতরিক কাজ
বুঝিয়ে দিলেন, তখন আমিও ঐ খলিল স্যারের মতো পড়ে
থাকতাম অফিসে। বিধায় মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে আমার পরিচয় দাড়ায় কিরানী স্যার
হিসাবে।
চাকুরীকালীন সময়ে আমি ফয়জুর রহমান সাহেব থেকে
নানাবিধ সুযোগ সুবিধা পেয়েছি। বিশেষ করে সাংগঠনিক যে কোন প্রোগ্রামে উপস্থিত হওয়ার
দরকার হলে ছুটিটা অনিবার্য হিসাবে পেয়ে যেতাম। দাফতরিক কাজে বা প্রশাসনিক কাজে
ফয়জুর রহমান সাহেবের বুঝাপড়া ছিল অতুলনীয়। কোন জায়গায় ভূল হতে পারে, অডিট কোন কোন বিষয়ে জোর দিতে পারে, অডিট টীমকে কিভাবে ম্যানেজ করতে হবে, কখন কোন মিটিং তলব করতে হবে-ইত্যাদি বিষয় তার ছিল নখদর্পনে।
তার সাথে আমার ভালবাসা, সম্পর্ক, আস্থা ইত্যাদি কারণে আমার পরামর্শকে তিনি বিশেষ বিবেচনায়
নিতেন। চাকুরী সংক্রান্ত ট্রেনিং-এর কারণে আমাকে একাধারে ৬মাস ঢাকায় অবস্থান করতে
হয়। সেই সময়ে মাদ্রাসার সকল অফিসিয়েল কাজ আমাকেই করতে হয়েছে। একবারের জন্যও তাকে
বা অধ্যক্ষ মহোদয়কে ঢাকা যেতে হয়নি। মাদ্রাসার ডকুমেন্ট রেডি করা হতো ফয়জুর রহমান
সাহেবের হাত দিয়ে। কিন্তু তিনি কখনো মাদ্রাসা বোর্ডে যেতেন না। মাদ্রাসা বোর্ড সে
সময় ছিল দূর্নীতির আখড়া। বিধায়, কোন টেবিলে কত
হাদিয়া দিতে হবে, তার নাম উল্লেখ
করে আমাকে আলাদা খাম দেয়া হতো। কিন্তু দীর্ঘ ৬ মাস আমি সেই আখড়া সমূহে কোন ধরণের
হাদীয়া ছাড়াই কাজ সম্পাদন করে ৬ মাস পর তাদের প্রেরিত নানাবিদ খাম সমূহ যখন ফেরত
দিলাম। তখন তিনি এবং অধ্যক্ষ আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, কিভাবে হাদীয়া ছাড়া আমি কাজ সম্পাদন করলাম। সেটা জানতে
পারলাম আরো ৬মাস পরে যখন মাদ্রাসা বোর্ডে গেলাম। সংশ্লিষ্ট টেবিলের কর্মকর্তাদের
থেকে আমি বুঝতে পারলাম যে, আমার এটিচিউট
থেকে ওরা মনে করতো যে আমি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র। বিধায়, আমাকে না জ্বালিয়ে ওরা কাজ করে দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা
নিশ্চিত করতো।
আমি দিল উজাড় করে আমার মনে আসা সকল পরামর্শ
ফয়জুর রহমান সাহেবকে বলতাম। তিনিও চোঁখ বন্ধ করে তা মেনে নিতেন। গাংকুল মাদ্রাসাতে
উপfধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনে তিনি সকল বিষয়ে আমার সাথে পরামর্শ করলেও একটি বিষয় আমার
কাছে গোপন রেখে পরামর্শ ছাড়াই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বড়ই সমস্যায় পড়ে যান। বিষয়টি
আমার কাছে পৌছতে পৌছতে পানি অনেক দূর গড়িয়ে গিয়েছিল। ঘটনার ধারাবাহিকতায় তিনি আমার
সাথে পরামর্শ না করেই উপাধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং তার পরপরই আমাকে জানালে
আমি পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের অনুরোধ করি। কিন্তু তখন তার আর ফিরে আসার কোন সুযোগ
ছিল না। কারণ, এতদিন যারা ফয়জুর রহমান সাহেব
থেকে বিভিন্ন ধরণের সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেছিলেন, তারা (টপ টু বটম) পরিস্থিতির পরিবর্তনে তাদের চেহারা পাল্টিয়ে নেন। এই ঘটনার
পর আমিও সিদ্ধান্ত নেই আমি আর গাংকুল মাদ্রাসায় চাকুরী করবো না। তিনি যে তারিখ
থেকে পদত্যাগ করেন, ঠিক একই তারিখ
থেকে আমিও পদত্যাগের দরখাস্ত দিয়ে গাংকুল মাদ্রাসা ত্যাগ করি।
উপাধ্যক্ষ পদ থেকে মাওলানা ফয়জুর রহমানের পদত্যাগ তার জন্য যে, বড় ধরণের একটি আশির্বাদ হয়ে কাজ করবে, তা তদানিন্তন সময়ে কেউ কল্পনা করতে পারেননি। কারণ যোগ্যতা যেখানে আলোচ্য বিষয়, সেখানে অন্য কোন কিছুই কাজ করেনা। কিছু দিনের মধ্যে তিনি ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসাবে পরিচিত হলেন, যে পরিচয় ধারণ করতে গাংকুল মাদ্রাসায় বসে তাকে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হতো। (আমিও দেশ থেকে প্রবাসী হয়ে যাই-তাই এনালগ যুগের যোগাযোগ বাঁধাগ্রস্থ হয়। বলা যায় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়)। অপর দিকে গ্রামের পরিবেশ থেকে ঢাকা শহর কেন্দ্রীক পরিবেশে তিনি দেখতে পান সম্ভবনার অপার দিগন্ত। এক সময় তিনি ফিরে আসেন আপন নীড়ে, নিজ জন্মভূমি, নিজ শিক্ষালয়, নিজ শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের স্মৃতিময় স্থান-সুজাউল আলীয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হয়ে। যে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার হাতেখড়ি, সেই প্রতিষ্ঠানেই অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন-এ যেন সুখকর অনুভূতি। সেই অনুভূতিকে ধারণ করে, মাদ্রাসাকে আপন সন্তানের মতো ভালবেসে মাদ্রাসার উন্নয়নে নানাবিদ চিন্তাকে ধারণ করে নেন নানাবিদ পদক্ষেপ। সুজাউল মাদ্রাসার বর্তমান অবকাঠামো কি অবস্থায় আছে জানিনা। কিন্তু সোস্যাল মিডিয়াতে আসা ছবিগুলো দেখে মনে হয় মাদ্রাসাটিকে অবকাঠামোগত দিক দিয়ে একটি সুন্দর অবয়বে রূপান্তর করেছিলেন মাওলানা ফয়জুর রহমান মরহুম।
প্রশিক্ষক মাওলানা ফয়জুর রহমানঃ ১৯৮৪ সালের শেষ দিকে কোন একদিন বৃহস্পতিবার। তখন আমি ইসলামী ছাত্রশিবিরের সমর্থক হয়েছি মাত্র। হাফেজ নিজাম উদ্দিন ভাই আমাকে বললেনঃ নজরুল তোমার আগামীকালের কর্মসূচী কি? সেই সময়ে ছিল এরশাদ সাহেবের জামানা। শুক্র-শনি দুই দিন মাদ্রাসা বন্ধ। বিধায়, বৃহস্পতিবার হলেই আমি মুড়াউলের লজিং বাড়ী ছেড়ে নিজ বাড়ী চান্দগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই এবং মাগরিব নামায চান্দগ্রামেই আদায় করি। কর্মসূচী তাকে জানালে তিনি বললেন, না! তোমার বাড়ীতে যাওয়া হবেনা। তুমি আগামীকাল চান্দগ্রামে যাবে-জনাব ফয়জুর রহমান জিহাদীর সাথে। সেখানে শিবিরের একটি প্রোগ্রাম আছে। তুমি শায়বালা (সফরসঙ্গী)। সাথে সাথে রাজী হয়ে গেলাম। পরদিন মুড়াউল রেলওয়ে স্টেশনের নির্ধারিত সময়ে ফয়জুর রহমান সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ। যৎসামান্য ব্যক্তিগত আলাপচারিতার পরই প্রশ্ন করলেনঃ তুমি তো শিবির করো। বলতো! শিবিরের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি? শিবিরের পাঁচ দফা কর্মসূচী মুখস্ত বলো? আমি তো সেই সময়ে হুশে নয়-জোশে শিবির। তখন পর্যন্ত শিবিরের একটি বইও পড়িনি। তাই আমি বলতে পারলাম না। সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল ফয়জুর রহমান সাহেবের প্রশিক্ষণ কর্মসূচী। মুড়াউল থেকে গল্লাসাংগনের পায়ে হাটা পথ দিয়ে চলতে চলতে বাহাদুরপুরের শেষ সীমায় আসা পর্যন্ত আমার মুখস্ত হয়ে গেল শিবিরের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও পাঁচ দফা কর্মসূচী। তিনি বললেন, আমি পূণরাবৃত্তি করলাম। এইভাবে চলতে চলতে মাত্র একদিনের মধ্যেই পুরোটা কন্ঠস্ত হয়ে গেল। আমি আমার সাংগঠনিক জীবনে এই প্রক্রিয়াতে অনেক অনেককে এইভাবে তা মুখস্ত করিয়েছি। প্রশিক্ষণের অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এই প্রক্রিয়া আমার মনে ধরেছিল। তাই আমি আমার সাংগঠনিক জীবনের সফর গুলোতে সব সময় একজন জুনিয়রকে সাথে নিতাম এবং মাওলানা ফয়জুর রহমানের এই প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করে সংগঠনের মুখস্ত করার বিষয় গুলো মুখস্ত করাতাম। আজ ৪০ বছরের বেশী সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। কিন্তু শিবিরের লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং পাঁচ দফা কর্মসূচী আমার সেভাবেই মুখস্ত রয়েছে, যেমনটা শিখিয়েছিলেন মাওলানা ফয়জুর রহমান।
(২২শে জুলাই ২০১৭ তারিখে এই বিষয়ে আমার ব্লগে একটি লেখা লিখেছিলাম “শিবিরের পাঁচ দফা কর্মসূচী ও দক্ষিণ দিকে নামায” শিরোনামে। পাঠকরা ইচ্ছা করলে তা পড়তে পারেন এখানে ক্লিক করে)
বিয়ের দিনের বিড়ম্বনাঃ ফয়জুর রহমান সাহেব বিয়ে করেছেন তার প্রথম কর্মস্থল গাংকুল মাদ্রাসার এলাকা দক্ষিণভাগের সফরপুর এলাকায় পীর সাহেব হযরত সুলাইমান শাহজলী রাহি. এর মেয়েকে। শাহজলী সাহেবের বড় সন্তান সঈদুল হাসান সাহেব এক সময় কাতারে ছিলেন এমন পেশায়, যে পেশার অনুজ হিসাবে আমি কাতারে প্রায় পাঁচ বছর কাজ করেছি। তার দ্বিতীয় সন্তান সুবক্তা মাওলানা ফয়সল আহমদ শাহজলী গদিনশীন পীর-যিনি নারায়নগঞ্জের মদনপুর এলাকায় একটি বড় মাদ্রাসায় প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করছেন এবং তার আব্বার অধিকাংশ মুরিদান ঐ এলাকায়ই রয়েছেন। তার তৃতীয় সন্তান মিসবাহুদ্দোজা আমার ক্লাশমেট-আলিম শ্রেণীতে একসাথে লেখাপড়া করেছি। ফেইসবুকের কল্যাণে তার সাথে আমার যোগাযোগ রয়েছে। তারপর শাব্বির আহমদ, সাজিদুর রহমান, এমদাদুর রহমান-ওরা সবাই ছোট। আমি যখন বড়লেখায় শিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করি, সাজিদকে শিবিরের সাথী প্রার্থী ফরম আমিই দিয়েছিলাম। সেই সময় কনিষ্ঠ সাথীদের মাঝে দুইজন ছিলেনঃ ১. রফিকুল ইসলাম হায়দার-বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা (চালবন্দের নুরুদ্দীন স্যারের ছেলে-যিনি এক সময় বড়লেখা উত্তর থানা শিবিরের সভাপতি ছিলেন) আর ২. সাজিদুর রহমান-বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। বলছিলাম ফয়জুর রহমান সাহেবের বিয়ে নিয়ে। তার বিয়ে, আর আমি যাবো না, তা হতে পারে না। আমি তখন সুজাউল মাদ্রাসার জিএস। যতটুকু মনে পড়ে বিয়েতে উপস্থিত হতে কনিষ্ঠ সফরসংগী নির্বাচন করলাম গল্লাসাংগনের বুলবুল আর শাহবাগের মিফতাহকে। যথা সময়ে আমরা রওয়ানা দিলাম। সেই সময়ে বড়লেখা-শাহবাজপুর সড়ক পাকা ছিল না। বিশেষ করে চন্ডিনগরের লেচু বাংলা এলাকার রাস্তা এতোই খারাপ ছিল যে, দুই ধারের পাহাড় থেকে পানি এসে এই জায়গাকে ১২ মাস কাঁদাযুক্ত করে রাখতো। ফয়জুর রহমান সাহেব যখন বরের বেশে, তখন তাকে বহনকারী কার যখন গিয়ে পৌছলো লেচু বাংলা এলাকায়, তখন গাড়ী আর সামনে আগাতে নারাজ হয়ে বসলো। ফয়জুর রহমান সাহেবকে গাড়ী থেকে নামাতে বাধ্য করলাম। তিনি নামার পর গাড়ী হালকা হলো আমাদের মতো ছোট ছোট মানুষের হালকা ধাক্কা অনেক কসরতের পর এক সময় সামনের দিকে অগ্রসর হলো এবং ফয়জুর রহমান সাহেব এখনকার লেচু বাংলা মসজিদ পর্যন্ত হেটে হেটে চলতে বাধ্য হলেন। এরপর ফিরার পথে কনেকে নিয়ে ফয়জুর রহমান সাহেব কিভাবে বাড়ী ফিরলেন, তা আমার অজানা। কারণ ফিরার পথে তার সংগী হওয়ার সাহস আমার ছিল না। তার মৃত্যু সংবাদ শুনে ফ্রান্স থেকে বুলবুল ফোন করে বিষয়টি আমাকে স্মরণ করে দিলেন।
অতিথি পরায়ন মাওলানা ফয়জুর রহমানঃ ফয়জুর রহমান
সাহেব ছিলেন সীমাহীন অতিথি পরায়ন ব্যক্তি। তার অতিথি পরায়নতা জীবনে চলার পথে
বারবার দেখা হয়েছে। খাওয়াতে পছন্দ যেমন করতেন, সবচেয়ে ভালটা খাওয়াতেও চেষ্টা করতেন। তবে এখনকার সময়ে অঁজো পড়াগায়ে যেমন
নানাবিদ খাবার পাওয়া যায়, তখনকার সময়ে
তেমনটা ছিল না। গাংকুল মাদ্রাসায় ভাল কিছু খাওয়ানো মানে সর্বোচ্চ রসগোল্লাই ছিল। একবারের ছুটিতে কাতার থেকে দেশে পৌছলে সুজাউল মাদ্রাসার
দুইদিন ব্যাপী ওয়াজ মাহফিলের দাওয়াত পেলাম। সুজাউল মাদ্রাসার ওয়াজ মাহফিল মানে
একটি লোভনীয় অফার। কারণ মাহফিলে গেলে পুরাতন সকলের সাথে দেখা হয়ে যায়-যেন একটি
মিলন মেলা। সাথে অফিস বাজারে আয়াছ আলীর ছানার স্বাদ নেয়ার লোভ তো আছেই। যথারীতি
মাহফিলে উপস্থিত হলাম। প্রথম দিন সকালে ছিল মহিলা মাহফিল। আমি স্বপরিবারে আমার
স্ত্রী-সন্তান এবং বোনদের নিয়েই হাজির হলাম। ফয়জুর রহমান সাহেব তখন স্বাভাবিকভাবে
বিষম ব্যস্ত। কিন্তু এর ফাঁকে তিনি তার বাড়ীতে দুপুরের খাবারের দাওয়াত দিতে ভূললেন
না। কিন্তু আমার ওজরখাহির কারণ যখন জানলেন যে, আমার ফ্যামেলী সাথে আছে, তখন আর কে
ছাড়ে। তখন সাথে সাথে বাড়ীতে জানিয়ে দিলেন আমি স্বপরিবারে আসতেছি। ভাল ভাল খাবারের
আয়োজন করতে। আমার অন্যত্র একটি দাওয়াত থাকায় তার কাছে ক্ষমা চাইতে হলো। কিন্তু তখন
ফয়জুর রহমান সাহেব এতো বিরক্ত হলেন, যা তার চেহারায় ভেসে উঠলো। এই বিষম ব্যস্ততার মাঝে আমি হলে স্বাভাবিক ভাবে
খুশীই হতাম উঠকো ঝামেলা থেকে বাঁচার খুশীতে। কিন্তু তার চিরাচরিত অতিথি পরায়নতা
তাকে বিরক্ত করলো আমি দাওয়াত কবুল না করার কারণে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা
জান্নাতে তাকে উত্তম অতিথির মর্যাদা দেবেন আশা করি।
একবারের ঘটনা। আমি, ইসলাম ভাই (বড়লেখা জামেয়ার প্রিন্সিপাল) গংরা ফয়জুর রহমান
সাহেবের কাছে বায়না ধরলামঃ চুঙ্গাপুড়া খাবো। মাত্র কয়েকদিনের ভিতর তার বাড়ীতে
চূঙ্গাপুড়ার দাওয়াত। রাতের বেলা। আমরা ৮/১০জন পৌছলাম তার বাড়ীতে। পুরো রাত জমিয়ে
আড্ডা দিলাম। নানান রকমের খাবার দিয়ে আপ্যায়িত করা হলো। এরপর শুরু হলো বাড়ীর
বাহিরে রাস্তার পাশে বিশাল চুঙ্গা পুড়ানোর আসর। চুঙ্গা গুলোর অনেকটা শক্ত করে
ঝাকানো না হওয়াতে ভিতরে বাতাস রয়ে গিয়েছিল। ফলে পরিণতি কি হয়, তা চুঙ্গাপুড়া বিশেষজ্ঞরা ভাল বলতে পারবেন। আগুন দেয়া হলো।
কিছু সময়ের মধ্যে শুরু হলো যুদ্ধ। চুঙ্গাপুড়ার ব্রাশ ফায়ার। আর আমরা আমাদের গায়ের
চাদর ও লুঙ্গি দিয়ে তা আটকানোর চেষ্টা। এই পরিস্থিতি আমাদের আনন্দকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে
দিয়েছিল। চূঙ্গাপুড়ার চেয়ে আরো বেশী আনন্দময় ছিল দাওয়াতপ্রাপ্ত সবাই ছিলাম কোন না
কোন ভাবে ফয়জুর রহমান সাহেবের ছাত্রজীবনের সহচর। তাই সকল অতীতরা মিলে ছিল সীমাহীন
আড্ডা। আড্ডায় আড্ডায় কখন যে, ফজরের আযান হয়ে
গেল কেউ টের পাইনি। ফজরের পর সামান্য ঘুমিয়ে এরপর সকালে পেটভর্তি ভাত খেয়ে ফয়জুর
রহমান সাহেবের বাড়ী থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। তার এই অতিথি পরায়নতা আমাদের কাছে
চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এভাবে আরো
কতদিন যে,
ফয়জুর রহমান সাহেবের মেহমানদারী গ্রহণ করেছি, তার কোন হিসাব নেই। সব সময় তাকে আমরা পেয়েছি আন্তরিক
হিসাবে।
ফয়জুর রহমান সাহেব চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
রেখে গেছেন হাজারো স্মৃতি। তার অনুজ হিসাবে আমরা যারা আছি, তারা তাকে শ্রদ্ধা আর ভালবাসার সাথে স্মরণ করছি। আর ভাবছি, আমাদের মৃত্যুর পর আমাদের ভাল কাজ গুলো আমাদের সহকর্মীরা
স্মরণ করবে-এমন কোন ভাল কাজতো করিনি। প্রতিটি মৃত্যুই আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে
দেয়-আমাদেরকেও চলে যেতে হবে দুনিয়ার এই সফর শেষ করে সীমাহীন এক জীবনে। কিন্তু সেই
সফরের কি সম্বল আমরা রেডি করে রেখেছি, তাই প্রশ্ন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা সেই কথাটাই তার গোলামদের স্মরণ করিয়ে
দিতে বলেনঃ “হে ঈমানদাররা, আল্লাহকে ভয় করো। আর প্রত্যেকেই যেন লক্ষ রাখে, সে আগামীকালের জন্য কি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। আল্লাহকে ভয় করতে থাক। আল্লাহ
নিশ্চিতভাবেই তোমাদের সেই সব কাজ সম্পর্কে অবহিত যা তোমরা করে থাক।” (সূরা আল
হাশরঃ ১৮)
0 Comments