শিবিরের পাঁচ দফা কর্মসূচী এবং দক্ষিণ দিকে নামায – মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম


সত্য ও সুন্দরের পথে অবিরাম পথ চলা-০৩

মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ ইতিমধ্যে আমি শিবিরে এগিয়ে চলছি। আমার বাড়ী চান্দগ্রাম এলাকায়। সেখানে একটি মাদ্রাসা আছে। মাদ্রাসাটির নাম সেই সময়ে ছিল চান্দগ্রাম আনোয়ারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা আমি সেই মাদ্রাসায় দ্বিতীয় থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি। এলাকার প্রায় সকল মানুষ মরহুম ফুলতলী সাহেবের ভক্ত। ফুলতলী সাহেবের প্রতিষ্ঠিত আনজুমানে আল ইসলাহ বা আনজুমানে তালামিয়ে ইসলামীয়া তখনও প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। চান্দগ্রাম মাদ্রাসায় পড়ালেখার সুবাদে বা চান্দগ্রামে বাড়ী হওয়ার প্রভাবে আমি আদ্যোপান্ত ফুলতলীর মুরিদ। যখন শিবিরে ভর্তি হয়েছি, তখনো আমি ফুলতলীর মুরিদ। সুজাউল মাদ্রাসায় পড়া অবস্থায় আশে পাশে কোথাও ফুলতলী সাহেবের ওয়াজ মাহফিল আছে, আর আমি যাইনি-এমন কাহিনী খুব একটা নাই। তারাদরম, তালিমপুর, শিমুলিয়া, বিয়ানী বাজার, সুবহানীঘাট ইত্যাদি অনেক মাহফিলে আমি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ফুলতলী সাহেবের উচ্ছিষ্ট খাবার আমি বার কয়েক খেয়েছি বরকতের আশায় বা রোগ মুক্তির প্রত্যাশায়। ফুলতলী সাহেব সম্পর্কে আমি আরেকটি লেখায় লিখার চেষ্টা করতে পারি। ফুলতলী সাহেব তখন শিবিরের বিরুদ্ধে বা জামায়াতের বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য দিতেন না। আর সত্য কথা হলো, ফুলতলী সাহেবের মুখে আমি কখনো জামায়াত বা শিবিরের বিরুদ্ধে বক্তব্য কখনো শুনিনি। কারণ, যখন থেকে তিনি এ ধরণের বক্তব্য প্রদান শুরু করেছেন, তার অনেক আগে থেকেই তার মাহফিলে যাওয়া আমি বন্ধ করে দিয়েছে। ফুলতলী সাহেব যেহেতু শিবিরের বিরুদ্ধে কোন কথা বলেন না, সেহেতু চান্দগ্রাম মাদ্রাসাতেও শিবিরের কাজে কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল না। তবে চান্দগ্রাম মাদ্রাসার শিক্ষকদের প্রতি নসিহত ছিল, ছাত্ররা যাতে রাজনীতিতে না জড়ায়।

সেই চান্দগ্রাম, আমার নিজের গ্রাম চান্দগ্রাম, আমার জন্মভূমি চান্দগ্রামে একদিন শিবিরের প্রোগ্রাম হলো। জনাব ফয়জুর রহমান জিহাদী সাহেব আমাকে বললেন, আগামীকাল আমরা চান্দগ্রামে যাবো, তুমি সফর সংগী। আমার গ্রামে উনি যাবেন, আর আমি সফর সংগী হতে অপারগতা প্রকাশ করা-কত বড় রখিলী তা তো বুঝারই কথা। সাথে সাথে রাজী হয়ে গেলাম। সে অনুযায়ী পরদিন পায়ে হেটে মুড়াউল হয়ে চান্দগ্রামে পথে যাত্রা গল্লাসাংগনের মাঝ দিয়ে। জনাব ফয়জুর রাহমান পায়ে হাটা এই সময়টাকে সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করে হঠাৎ করে আমাকে প্রশ্ন করলেনঃ দেখি বলতো, শিবিরের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি? আমি বলতে পারলাম না। বললেন, বলতোঃ শিবিরের ৫দফা কর্মসূচী কি কি? আমি বলতে ব্যর্থ হলাম। তিনি আমাকে বললেন, আমার সাথে সাথে বলো। আমি উনার সাথে সাথে বলতে বলতে চান্দগ্রাম পৌছা পর্যন্ত আমি শিবিরের লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং ০৫ দফা কর্মসূচী মুখস্ত করে ফেললাম। আমি জনাব ফয়জুর রহমান সাহেবের কাছে বিভিন্ন ভাবে কৃতজ্ঞ-তার একটি হলো, তিনি আমাকে এই বিষয়টি অত্যন্ত আকর্ষণীয় পন্থায় খুব কম সময়ে মুখস্ত করিয়ে ছাড়লেন। আমি জানিনা এখন আমার কাছে তা কন্ঠস্ত আছে কি না। আমি এ পর্যায়ে সেই মুখস্ত করা বিষয়গুলো পত্রস্ত করবো এই উদ্দেশ্যে যে শিবিরের লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং ৫ দফা কর্মসূচী যাদের মুখস্ত আছে বা শিবিরের সংবিধান যাদের হাতের কাছে রয়েছে, তারা মিলিয়ে দেখবেন যে, ফয়জুর রহমান জিহাদী সাহেবের সেই চেষ্টার বরকত কত বছর পর্যন্ত গড়িয়েছে।

শিবিরের লক্ষ্য উদ্দেশ্যঃ আল্লাহ প্রদত্ত রাসূল সা. প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী মানব জীবনের সার্বিক পূণর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহর সন্তুষ অর্জন।

শিবিরের ০৫ দফা কর্মসূচীঃ

প্রথম দফা-দাওয়াতঃ তরুন ছাত্র সমাজের কাছে ইসলামের আহবান পৌছিয়ে তাদেরকে ইসলামী জ্ঞানার্জন এবং বাস্তব জীবনে ইসলামের পূর্ণ অনুশীলনের দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা।

দুই-সংগঠনঃ যে সব ছাত্র ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে প্রস্তুত, তাদেরকে সংগঠনের অধীনে সংঘবদ্ধ করা।

তিন-প্রশিক্ষণঃ এই সংগঠনের অধীনের সংঘবদ্ধ ছাত্রদের ইসলামী জ্ঞান প্রদান এবং আদর্শ চরিত্রবান রূপে গড়ে তুলে জাহেলিয়াতের সমস্ত চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় ইসলামের শ্রেষ্টত্ব প্রমাণের যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মী হিসাবে গড়ার কার্যকরী ব্যবস্থা করা।

চার-শিক্ষা আন্দোলন ও ছাত্র সমস্যাঃ আদর্শ নাগরিক তেরী উদ্দেশ্যে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধনে সংগ্রাম এবং ছাত্র সমাজের প্রকৃত সমস্যা সমাধানে নেতৃত্ব প্রদান।

পাঁচ-বিপ্লবঃ অর্থনৈতিক শোষন, রাজনৈতি নিপীড়ন এবং সাংস্কৃতিক গোলামী হতে মানবতার মুক্তির জন্য ইসলামী বিপ্লব সাধনের সর্বাত্তক প্রচেষ্টা চালানো।

এক সময় আমরা চান্দগ্রামে পৌছলাম। কমপক্ষে ৪০/৪৫ জনের প্রোগ্রাম হলো চান্দগ্রাম বাজার মসজিদে। ইতিমধ্যে জনাব ফয়জুর রহমান জিহাদী ফাকি দিয়ে আমি বাড়ীতে গিয়েছি এবং আমার আম্মাকে খাবার রেডি করার জন্য বলে এসেছি। কারণ প্রোগ্রাম যখন শেষ হবে, তখন আছর হয়ে যেতে পারে। খাবারের সময়। আমার গ্রামে ফয়জুর রহমান সাহেব আসলেন আর উপোস যাবো, তাতো হতে পারেনা। আম্মাকে বলেছি, আমাদের মাদ্রাসার সবচেয়ে সেরা ছাত্র যিনি-তিনি আসবেন। আম্মা সেই বিবেচনায় ভাল খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। প্রোগ্রামে প্রচুর লোকের উপস্থিতি দেখে আমি অভিভূত। প্রোগ্রামে সবাই আমি শিবির করি দেখে অভিভূত। প্রোগ্রাম শেষে প্রোগ্রামের আয়োজকরা জানালেন, মেহমানের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাধারণ খাবার নয়, রীতিমতো বাহারী খাবার আয়োজন। আমি শতবার বললাম, আমার আম্মা খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু যেহেতু আগেই এক বাড়ীতে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাই উনাকে সেখানেই খেতে হলো, আমাকেও সেখানে খেতে হলো। খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল চান্দগ্রামের বাদে কিদুর এলাকায় কুতুব উদ্দিন মেস্তরীর বাড়ীতে বাবুল মিয়ার তত্ত্বাবধানে। ওখানে লজিং থাকতেন শফিকুর রহমান ভাই, সেই সুবাদে এই আয়োজন।

খাবার শেষ করে আমরা আমাদের বাড়ীতে আসলাম। সেখানেই ঘটনাটা দূর্ঘটনায় রূপ নিল। আমার বাড়ীতে পৌছে যখন বললাম, আমরা খেয়ে এসেছি। তখন আম্মা তো অগ্নিশর্মা। কারণ উনি প্রিয় ছেলের সম্মাণের দিকে খেয়াল রেখে সাথে সাথে মুরগী জবাই করেছেন। ভাল খাবারের আয়োজন করেছেন। কিন্তু তখন আর করার কিছু ছিল না। আমি ফয়জুর রহমান সাহেবকে অজুর পানি দিয়ে ভিতরের ঘরে চলে গেলাম নিজে অজু করতে। অজু করে যখন ফিরলাম, তখন দেখি ফয়জুর রাহমান সাহেব নামাযে মুসাল্লাতে। তিনি নামায পড়ছেন। কিন্ত এ কি!!! তিনিতো দক্ষিণ মুখী হয়ে নামায আদায় করছেন। আমি নামায শেষে তাকে প্রশ্ন করলাম, পশ্চিম তো ওদিকে, আপনি এদিকে কেন নামায পড়লেন। তিনি আশ্চর্য, কি বলো নজরুল! পশ্চিম ওদিকে। তিনি বাহিরে বের হলেন, দিকটা ভাল ভাবে দেখলেন, সূর্যটাকেও ভালভাবে দেখে নিলেন। এর পর আবার পশ্চিমমুখী হয়ে আবার আছরের নামায আদায় করলেন।

ততক্ষণে চা রেডি হয়ে গেছে। দুধ চা নয়। সে সময়ে আমাদের বাড়ীতে দুধের গাভী ছিলনা। এখনকার সময়ের গুড়ো দুধ তখনকার সময়ে সহজলভ্য ছিলনা। সেই সময়ে বাড়ীতে গুড়োদুধ রাখার মতো আর্থিক সামর্থ আমাদের ছিলনা। লাল চা আর মুড়ি দিয়ে আপ্যায়িত হয়ে ফয়জুর রহমান জিহাদী সাহেব এবং আমি ফিরলাম সুজাউলের পথে। পথে সেই লক্ষ্য উদ্দেশ্য আর পাঁচ দফা কর্মসূচীর রিভিশন। দেখা গেলো, আমি পুরোটাই বলতে পারছি। সেই যে বলা শুরু হলো। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তা কতবার বলেছি, তার হিসাব নাই। এখনো মনের মাঝে বাজে সেই সুর….তরুন ছাত্র সমাজের কাছে ইসলামের আহবান……………

২২ জুলাই ২০১৭

Post a Comment

0 Comments