আমি শিবিরের মুড়াউল আবাসিক শাখার সহকারী প্রচার সম্পাদক – মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম


সত্য ও সুন্দরের পথে অবিরাম পথ চলা-০৪

মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ ১৯৮৪ সালের কথা। তখন কি আমার এই বুঝ ছিল যে, শিবিরের সহকারী প্রচার সম্পদক বিষয়টা কি? তাও যদি হয় একটি আবাসিক উপশাখার প্রচার সম্পাদক, তাহলে কতটুকু বিশাল পদ আর দায়িত্ব তাতো বড়রা বুঝার কথা। কিন্তু সেই সময়ে আমি যেহেতু শিবির নামক বিষয়টাই কিছুই বুঝিনি, সেখানে সেই সংগঠনের দায়িত্ব, দায়িত্বের পরিধি, মর্যাদা অথবা সেই আবাসিক উপশাখার সহকারী প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব কি তাতো বুঝার কথা না। কিন্তু আমি বুঝি বা না বুঝি, আমি হয়ে গেলাম সহকার প্রচার সম্পাদক-একটি গ্রামের একটি আবাসিক উপশাখার প্রচার সম্পাদক।

আমি তখনকার সময়ে শিবিরে যোগদান করেছি কেবল এই চিন্তা থেকে যে, শিবির হলো প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের একটি প্লাটফর্ম-একটি মিলনমেলা-সেই বিবেচনা থেকে। সেই সময়ে একটা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংখ্যাই বা কত ছিল? সেই সময়ে মুড়াউল হাই স্কুল শুরু হয়নি বা এই মাত্র শুরু হয়েছে এমন। পুরো এলাকাতে ৬ষ্ট শ্রেণীর উপরে পড়ালেখা করা ছাত্র সংখ্যা হাতে গুনা। তখন বড়লেখা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, হয়নি পার্শবর্তী গল্লাসাংগন মাদ্রাসার কার্যক্রমও।

এমন অবস্থায় হঠাৎ একদিন দাওয়াত পেলাম মুড়াউল বাজার মসজিদে বাদ আসর হাজির হওয়ার। সংগঠনের প্রোগ্রাম আছে। যথারীতি প্রোগ্রামে হাজির হলাম এবং সবার আগেই হাজির হলাম। টিনের ছাউনি, টিনের বেড়া-এই নিয়ে মুড়াউল বাজার মসজিদ। এই মুহুর্তে মনে করা খুবই কঠিন যে সেই প্রোগ্রামে কে কে উপস্থিত ছিলেন। তবে এতো টুকু মনে আছে যে, আমি সাংঘাতিক ধরণের পুলকিত হয়ে সন্ধ্যার পর যখন বাসায় পৌছলাম, তখন আমি একটি বিশেষ খাতা তৈরী করলাম আর সেই খাতার কাভার পেজে লিখলাম মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম, সহকারী প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, মুড়াউল আবাসিক উপশাখা

সময়ের সাথে ব্যস্ততা ইত্যাদি মিলিয়ে চলে গেলো অনেক দিন। মুড়াউল উপশাখার কোন প্রোগ্রামে কেউ কোন দিন আমাকে দাওয়াত দেয়নি। তাই মুড়াউল উপশাখার আর কোন প্রোগ্রামে আমার উপস্থিত হওয়া হয়নি। এরই মাঝে আমার আবাস স্থল পরিবর্তন হয়ে গেলো। মুড়াউল উপশাখা ইনতেকাল করলো বা বেঁচে থাকলো, সেই খবর আমার কাছে থাকলো না। আর এ ধরণের খবর নেয়ার মতো দায়িত্বানুভূতি আমার মানসিকতায় তখনো সৃষ্টি হয়নি। এরই মাঝে বিদায়ের সুর বেজে উঠলো আমাদের অংগনে। দাখিলের নির্বাচনী পরীক্ষা দিয়ে আমরা চূড়ান্ত পরীক্ষা দেয়ার জন্য মাদ্রাসা ছাড়া হয়ে গেলাম। শিবির নামক বস্তুটা ধামাচাপা দিয়ে দেয়া হলো জীবনের এই পৃষ্ঠা থেকে। সাথে সাথে বিলিন হয়ে গেলো সহকারী প্রচার সম্পাদকের পদবীও।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, আমি শিবিরে ভর্তি হয়েছি শিবিরের আদর্শ দেখে বা বুঝে নয়, বরং শিবিরে একদন মেধাবী ছাত্রের সমাবেশ দেখে। আর আমি যেহেতু ফূলতলী সাহেবের মুরিদ, সেহেতু শিবির করার সাথে সাথে ফুলতলী সাহেবের ওয়াজ মাহফিলে উপস্থিত হওয়ার রীতি অব্যাহত থাকলো। মুড়াউল এলাকায় আমি যখন লজিং ছিলাম, তখন পশ্চিমের বাড়ীতে থাকতেন তালিমপুরের শহীদ। আমার ক্লাশমিট আব্দুল মালিক ভাইয়ের ছোট ভাই। বয়স এবং সাইজের দিক দিয়ে আমি আমার ক্লাশের সকল ছাত্রের চেয়ে তুলনামুলক ছোট থাকার কারণে আমার ক্লাশের ছাত্রদের সাথে ক্লাশের বাহিরে আমার খুব যোগাযোগ ছিলনা। ফাস্টবয় হিসাবে জিয়াউর রহমানের সাথে পড়ালেখার আদান প্রদানের একটি স্বার্থবাদী সম্পর্ক ছিল মাত্র। একই কারণে শহীদ এর সাথে আমার সুগভীর সম্পর্ক ছিল। বড়লেখার ব্যবসায়ী জাহিদ চাচার ছেলে আব্দুল মালিক ও আব্দুশ শহীদ।

সম্পর্কের সুবাদে শহীদের বাড়ী এবং মামার বাড়ী পর্যন্ত আমার যাতায়াত ছিল। শহীদের মামা বড়খলা দারুল উলুম মাদ্রাসার মুহতামীম (নাম সম্ভবতঃ মাওলানা আলা উদ্দিন), যেখানে গেলে আমি মিলাদ কিয়ামের বিরুদ্ধে দীর্ঘ বক্তব্য শুনতাম। মুহতামীম সাহেবের এক আত্মীয় আমারই নামে নাম মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম-যিনি এখন বড় মাওলানা, যিনি দেখা হলে এখনো আমাকে মাখরাজের সাথে চাচাজি ডাকেন। আর তালিমপুর বাড়ী হওয়ার কারণে সেখানে গেলে চান্দগ্রামের একটা স্বাদ পাওয়া যেতো বলে সব সময়ই তালিমপুর যাওয়া হতো। তালিমপুরে ফুলতলী সাহেবের ওয়াজ খুব একটা বাদ পড়েনি আমার কখনো। আর এই সব ওয়াজ মাহফিলে উপস্থিত থাকার সুবাদে আমি আকীদা বিশ্বাসে একদম খাটি ফুলতলী পন্থী ছিলাম।

অপর দিকে সুজাউল মাদ্রাসায় পড়ার সুবাদে আমি শিবিরের একজন বলিষ্ট নেতা আবাসিক উপশাখার সহকারী প্রচার সম্পাদক হলাম। আমি বা আমরা শিবির থেকে নিজেকে গায়েব করে নিলেও দায়িত্বশীলদের মন থেকে আমরা দূরে সরে যাইনি। তার প্রমাণ পেলাম যে দিন আমরা দোয়া নিতে আসলাম সুজাউল মাদ্রাসায় পরীক্ষার মাত্র কদিন আগে। দেখলাম নিজাম ভাই, গৌছ ভাই, ইসলাম ভাই, উসমান ভাই সহ সবাই উপস্থিত আছেন আমাদের বিদায় দিতে এবং দোয়া দিতে।

বড় ভাই এবং উস্তাদদের দোয়া নিয়ে আমরা উপস্থিত হলাম পরীক্ষা কেন্দ্রে। দাখিল পরীক্ষার সময় আমরা থাকলাম চৌমূহনাতে একটা হোটেলে। জিয়া ভাই, আব্দুল মালিক ভাই মারহুম, আকমল ভাই এবং শামসু ভাই গংরা থাকতাম। আমাদের পরীক্ষার হল তদানিন্তন মৌলভী বাজার টাউন সিনিয়র মাদ্রাসায়যা পশ্চিম বাজার মসজিদের দক্ষিণে ছিল, যেখানে আমি ফাজিল পড়েছি। মাদ্রাসাটি এখন স্থান বদল করে শাহ মোস্তফা রোডে চলে এসেছে। পরীক্ষার ফাঁকে ফাঁকে মৌলভী বাজারের শিবিরের নিতৃবৃন্দ আমাদের সাথে পরিচিত হতেন। পরীক্ষার শেষ নিয়ে মৌলভী বাজারের পশ্চিম বাজার মসজিদে সকল পরীক্ষার্থীদের নিয়ে সংবর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে আমাদেরকে প্রচুর সম্মান প্রদান করা হয় এবং নাস্তারও ব্যবস্থা করা হয়। জিয়া ভাই আমাকে সেই প্রোগ্রামের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, হেই নজরুল-খানিও আছে (খাবারের ব্যবস্থাও আছে) সেই সংবর্ধনা সভা শিবিরের সেই সময়ের শেষ অনুষ্ঠান। আলিম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত শিবিরের আর কোন প্রোগ্রামে উপস্থিত হইনি। সহকারী প্রচার সম্পাদকে দায়িত্ব এভাবেই সমাপ্ত করলাম।

২৩ জুলাই ২০১৭

Post a Comment

0 Comments