চান্দগ্রাম মাদ্রাসায় শিবিরের কার্যক্রম – মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম


সত্য ও সুন্দরের পথে অবিরাম পথ চলা-০৫

মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ ১৯৮৫ সালের মাঝামাঝি সময়। সুজাউল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করে আলিম ক্লাশে ভর্তি হওয়ার পালা। সুজাউল মাদ্রাসা থেকে কমপক্ষে ৮০জন ছাত্র একসাথে মাদ্রাসা ছেড়ে চলে গেছেন। ভর্তি হয়েছেন দক্ষিণভাগের গাংকুল মাদ্রাসায়। আমি যাদেরকে দেখে ছাত্রশিবিরে ভর্তি হয়েছি, তাদের অন্যতম জনাব ফয়জুর রাহমান জিহাদী এখন গাংকুল মাদ্রাসার আরবী প্রভাষক, হাফেজ নিজাম উদ্দিন ফাজেল শ্রেণীর ছাত্র, জনাব গৌছ উদ্দিন আলিম শ্রেণীর ছাত্র। ফয়জুর রহমান সাহেব ইতিমধ্যে কামিল পাশ করে চাকুরী নিয়েছেন গাংকুল মাদ্রাসায়। জনাব হাফেজ নিজাম বড়লেখা থানা শিবিরের সভাপতি আর গৌছ উদ্দিন সেক্রেটারী। তাদের সহকারী হিসাবে আছেন জনাব উসমান আলী ভাই এবং ইসলাম উদ্দিন ভাই। আছেন আমার ক্লাশমিট আকমল ভাইও । তিনি ইতিমধ্যে গাংকুল মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে গেছেন।

আমি গাংকুল মাদ্রাসায় ভর্তি হবো। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাড়ালেন আমার আব্বা। তিনি তখন চান্দগ্রাম আনোয়ারুল উলুম মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সদস্য। চান্দগ্রাম মাদ্রাসায় এ বছর আলিম শ্রেণীর ক্লাশ শুরু হবে। বিধায় গ্রামের সকল ছাত্রকে এখানে ভর্তি হতে হবে। সেই সুবাদে আমাকেও বাধ্য হয়ে এখানে ভর্তি হয়ে গাংকুল মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন ত্যাগ করতে হলো।

চান্দগ্রাম মাদ্রাসায় ভর্তি হলেও মন সব সময় গাংকুল মাদ্রাসায়। এমন অবস্থায় শিবিরের একদল দায়িত্বশীল আসলেন চান্দগ্রামে। তাদের মধ্যে মাত্র ১জনের নাম আমার মনে আছেতিনি জনাব উসমান আলী ভাই। লম্বা মানুষটা সব সময় আমাকে ভালবাসেন, এখনো সেই ছোট্টকালের মতো ভালবাসেন। তিনি আমার সাথে চান্দগ্রাম বাজার মসজিদে বসে দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন। এখন আমি বুঝি যে, তিনি আমার সাথে কন্টাক্ট করেছিলেন এবং সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাকে সাথী করার জন্য তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল-আমি ছিলাম তার সাথী টার্গেট। উনার বক্তব্য ছিলঃ

১. শপথ বিহীন মৃত্যু জাহেলিয়াতের মৃত্যু। অতএব নামায রোযা করে ইসলামী আন্দোলনে সময় দিয়ে জাহেলিয়াতের মৃত্যু কাম্য নয়।

২. নিজের আমল আর পড়ালেখা ঠিক রাখার জন্য একজন অভিভাবক দরকার। সংগঠন সেই অভিভাবক হবে তাদের জন্য, যারা সংগঠনের আনুগত্য করার শপথ নেবেন।

৩. সংগঠনের অনেক বিষয় আছে আমরা জানিনা, তা জানতে হলে সাথী হতে হবে।

৪. সিনেমা দেখা বাদ দিতে হবে।

৫. পরীক্ষায় নকল করার চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ালেখা করে পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। আর এজন্য নিজ জীবনকে একটি নিয়মের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। আর এজন্য সাথী শপথের বিকল্প নাই।
জনাব উসমান ভাই মনোরম ডিজাউনের একটি রিপোর্ট বই আমাকে প্রদান করলেন এবং রিপোর্ট রাখার গুরুত্ব ও ফজিলত এবং নিয়মাবলী ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, এখন তোমার কর্মক্ষেত্র হলো চান্দগ্রাম। তাই আমিও চান্দগ্রাম কেন্দ্রীক শিবিরের কার্যক্রম শুরু করলাম।

চান্দগ্রামে ১০ হাজারী পীরের মাজার সংলগ্ন মসজিদ তথা সরাজের বাড়ীর মসজিদ আর চান্দগ্রাম বাজার মসজিদ কেন্দ্রীক আমাদের কার্যক্রম শুরু হলো। আমি চান্দগ্রাম মাদ্রাসা শাখা শিবিরের সভাপতি।
মাত্র কয়েক দিনের প্রচেষ্টায় চান্দগ্রাম এলাকায় শিবিরের কাজ জমে উঠলো। প্রতিদিন বিকালে চান্দগ্রাম জামে মসজিদের মাঠে জমে উঠতো আডডা। এমনই ভাবে শিবিরকে নিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি।
তখনকার সময়ে ছাত্রদের আমরা কি বুঝাতাম, তা এই ক্ষণে একটুও মনে পড়ছেনা। কিন্তু চান্দগ্রামে শিবির করতে এসে হঠাৎ আমার মনে হলো, আমি আমার বাবার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এগিয়ে চলছি। বিষয়টা ছিল এভাবে,

আমার বাবা সব সময় ফুলতলী মসলকের উলামায়ে কিরামদের ভাল চোঁখে দেখতেন না। উনার বক্তব্য অনুযায়ী ওদের ইলিম কমতিনি সব সময় বরুনী, হাজিপুরী গ্রুপের উলামায়ে কিরামদের সাথে সম্পর্ক রেখে চলতেন। তারই প্রচেষ্ঠায় একবার চান্দগ্রাম আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে উপস্থিত হয়েছিল বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ জনাব মাওলানা এমদাদুল হক ফরিদপুরী। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে চাইতেছিলেন যেন আমি ফুলতলী মসলকের না হই।

১৯৭৮ সালে আমি যখন চতূর্থ শ্রেণীতে পড়ি তখন ফুলতলী সাহেব মারাত্মক আহত হয়েছিলেন হবিগঞ্জের সঈদপুরে। তিনির সাথে আহত হয়েছিলেন তার সেক্রেটারী জনাব আলতাফ (যাকে আমি আমার পুরো জীবন ফুলতলী সাহেবের খেদমত করতে দেখেছি এবং সব সময়ই তিনি ফুলতলী সাহেবের সুপারী কোটার দায়িত্বে ছিলেন) এবং কোনাগ্রামের গিয়াস কারী সাহেব। ফুলতলী সাহেবের আহত হবার খরব শুনে ফুঁসে উঠে চান্দগ্রাম। বের হয় মিছিল। আমি সেই মিছিলের একজন সহযাত্রী ছিলাম্ পায়ে হেটে মিছিল নিয়ে বড়লেখায় এসেছি। আবার সেখানে প্রতিবাদ সমাবেশ শেষ করে পায়ে হেটে তদানিন্তন সময়ে জয়াললিন এলাকা বলে পরিচিত সুড়িকান্দির মাঝ দিয়ে মিছিল করতে বাড়ীতে এসেছি। তখনকার সময়ের শ্লোগান ছিলঃ হৈ হৈ রৈ রৈ-জোয়াইল্লার পাঠা গেলো কই, ইসলামের শত্রুরা হুশিয়ার সাবধান ইত্যাদি। মিছিল শেষ করে বাড়ীতে এসে আব্বার হাতের মার খেয়ে আব্বাকে ইসলামের বড় ধরণের শত্রু মনে করে পরের দিনে আবার বিয়ানী বাজারে গিয়েছি মিছিল নিয়ে। পরদিন সিলেটের রেজিস্টারী মাঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ধরা খেয়ে বাড়ীতে ফিরে আসি।
আমি একদিন বাড়ীতে আগর গাছের ডাল দিয়ে তৈরী মিসওয়াক দিয়ে মিসওয়াক করছি। আব্বা বললেন, তুমি তো জোয়াল্লিন হয়ে গেছো। আমি বললাম, কিভাবে? তিনি বললেনঃ জোয়াল্লিনেরা মিসওয়াক করে। চান্দগ্রাম মাদ্রাসার পড়ার সময় দেখলাম, যখনই আমি শিবিরের কার্যক্রম শুরু করলাম, তখন আমি পুরো জোয়াল্লিন হয়ে গেলাম। এ ব্যাপারে একটি ঘটনা আছে, যা উল্লেখ করবো পরবর্তী পর্বে। সে পর্বে থাকবে জালাল সিদ্দিকী সাহেবের সাথে একটি বিতর্কের বিস্তারিত।

২৫ জুলাই ২০১৭

Post a Comment

0 Comments