মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ দিনটা ছিল
সম্ভবতঃ বৃহস্পতিবার। ২৭শে সেপ্টেম্বর ১৯৮৪ হওয়ার কথা। শিবিরে যোগদানের
এক সপ্তাহ পূর্তি। গত সপ্তাহে ২১ সেপ্টেম্বর তারিখে আমি শিবিরে যোগদান
করেছি। এখন শরীরের মধ্যে একটা পুলক পুলক ভাব। শিবিরের আদ্যোপান্ত কিছুই
না জানলেও নিজেকে শিবিরের একজন ভাবতে ভালই লাগছে। এতো দিন পরে কেন জানি
মনে হচ্ছে আমি ফয়জুর রাহমান ভাই, হাফেজ নিজাম ভাই এবং গৌছ ভাইদের নিজেদের
লোক।
মাদ্রাসা
শেষে জনাব হাফেজ নিজাম ভাইয়ের সাথে দেখা। বললেনঃ নজরুল, আগামীকাল তোমাকে মিছিলে যেতে হবে। কি মিছিল?
কেয়ারটেকার
সরকারের দাবীতে মিছিল? কি মিছিল? স্বৈরাচরী এরাশাদের বিরুদ্ধে মিছিল। এই
মুহুর্তে দরকার-কেয়ারটেকার সরকার। বললেন,
নাম লিখবো?
বললামঃ লিখেন।
পরদিন
হাজির হলাম মিছিলে। বড়লেখা থানা সদরে। মিছিলের বেশীর ভাগ লোককে চিনিনা।
যথারীতি মিছিল হলো। মিছিল শহর ঘুরে চলে গেলো বড়লেখা রেলওয়ে
স্টেশনে। সেই
সময়ে মিছিলের কালচার ছিলঃ বেশীর ভাগ মিছিল শুরু হতো ঐতিহাসি
শিরিশতলা থেকে।
শিরিশতলার সেই শিরিশ গাছ এখান আর নেই। বড়লেখা হাজিগঞ্জ
বাজার মসজিদের
সামনে ছিল সেই গাছটি। বড়লেখার হাজার হাজার মিছিল আর সমাবেশের
সাক্ষী এই
শিরিশতলা। মিছিল শিরিশতলা থেকে শুরু হয়ে বড়লেখা পিসি হাই স্কুলের শেষ
প্রান্ত অবধি গিয়ে ফিরে আসতো উত্তর দিকে। চলে যেতো ডাক বাংলো পেরিয়ে
খাদ্য গুদাম পর্যন্ত। এর পর ফিরে এসে বড়লেখা স্টেশন রোডে গিয়ে রেলওয়ে
স্টেশন থেকে ঘুরে আবার শিরিশতলায় এসে পথ সভার মাধ্যমে শেষ হতো। বয়সের
স্বল্পতার কারণে সেদিন কি ঘটেছিল তা জানা নেই বা মনে নেই। হঠাৎ করে গুলির
শব্দ শুনলাম। এর পর ভোঁ দৌড়। সবার মতো আমিও দৌড় দিলাম। কোন দিকে থেকে কোন
দিক থেকে এসেছি-আমার মনে নেই।
হঠাৎ
একটি বাসার গেইট থেকে লোকজন আশ্রয় নেয়ার জন্য ডাকলো। সাথে সাথে বাসায় ঢুকে
গেলাম। বাসায় ঢুকেছি ঠিকেই, কিন্তু বের হওয়ার নাম নেই। আমি এখন শিবিরের
পলাতক একজন কর্মী। কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করলাম আমার সাথে আরো ক’জন আছেন। এর মাঝে একজন সুড়িকান্দির আহমদ ভাই
(মাওলানা আহমদ ভাই) আর অপর জন মাইজ পাড়ার আহমদ ভাই। আরো অনেকে ছিলেন,
যাদের কথা আমি
মনে করতে পারছিনা। ২/৩ঘন্টার এখানে বসার পর আহমদ ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে চলে
গেলাম পূর্ব দিকে। হাটবন্দ এলাকার গলিপথ ধরে গিয়ে উঠলাম জফরপুরের রাস্তা
হয়ে বড়লেখা উত্তর চৌমুহনায়। গন্তব্য সুজাউল। আহমদ ভাইয়ের সাথে একই
মাদ্রাসার ছাত্র হিসাব পরিচিতি ছিল। উনি আমাকে অভয় দিলেও দেখলাম উনিও ভয়ে
কম্পমান। পরে জানতে পারলাম, পুলিশ মিছিলে গুলি চালিয়েছিল। পুলিশ
অনেককে মারধর করেছে। একই দিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গুলাগুলি হয়েছে।
আওয়ামীলীগ নেতা মইজ উদ্দিন এই দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সেই
সময়ের বয়সে কার খবর কে রাখে। চাচা, আপনা জান আপনে বাঁচা। নিজের জান বাচিয়ে
পায়ে হেটে চলে এলাম নিজের থাকার আবাসে।
এদিকে
হাফেজ নিজাম উদ্দিন গুলির মুখে খোঁজছেন আমাকে। তিনি আমাকে মিছিলে নিয়ে
এসেছেন। এখন আমি উনাকে না বলে চলে এলাম। এটাতো সাংঘাতিক কথা। তিনি ভয় ভীতি
উপেক্ষা করে একবার হাসপাতালে যাচ্ছেন, আরেকবার থানাতে যাচ্ছেন,
অন্যবার বড়লেখা
বাজারে আসছেন। এক সময় উনাকে কে জানি খবর দিলো, আমাকে সে
নাকি মুড়াউলে
দেখেছে। ফলে তিনি রণে ভংগ দিয়ে বাসায় ফিরলেন।
আমি
যে পলাতক, আমাকে যে কেউ খোঁজতে পারে, এই অনুভূতিটুকু তখন আমার ছিলনা। আমার
কেবল একটাই চিন্তা-আমি একজন পলাতক কর্মী।
পরদিন মাদ্রাসায়
হাজির হয়ে জনাব নিজাম ভাইয়ের সাথে দেখা। মিষ্টি সুরে তিনি
দুষ্টু একটা বকা
দিলেন।
এর
পর ঘটনা যদি এখানেই শেষ হয়ে যেতো, তাহলে হয়তো
আমার স্মৃতি
থেকে এই ঘটনা হারিয়ে যেতো। কিন্তু পরের কাহিনী আমাকে আরো
অপরাধী করে
দিলো। ২/৪দিন পর আবার ঘোষনা আসলো, বড়লেখার শিরিশতলায় গতদিনের ঘটনার
প্রতিবাদে প্রতিবাদ সমাবেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে। “আমি যাবো” সাথে সাথে ঘোষনা
দিয়ে দিলাম।
কিন্তু তখনকার দিনের বড়রা আমাকে নিবেন না। সরাসরি নিষেধ করলেন। বললেন,
প্রোগ্রাম রাত
পর্যন্ত চলবে, তাই ছোটদের নেয়া হচ্ছে না। আমি তখন
বড়লেখাকে
ভালভাবে চিনি। কারণ তখনকার দিনে আমি লাতুর গাড়ীর নিয়মিত
প্যাসেঞ্জার
ছিলাম। রেলগাড়ীর হকারদের বাদাম আর চানাচুরের আমি নিয়মিত ক্রেতা ছিলাম।
স্টেশন রোডে আলু বাজি (আলু বিরান) হলে তো আর কথাই নাই।
উনারা আমাকে
নেবেন না। কিন্তু আমি কি উনাদের সাথে যাচ্ছি? প্রতিবাদ সমাবেশে
সেদিন আমাকে
ঠিকমতোই দেখা গেল।
বিশাল
প্রতিবাদ সমাবেশ। মঞ্চ বলতে যা ছিল, তা হলো চয়নিকা গার্মেন্টস-এর সামনে
তদানিন্তন সময়ের কামাল সাবানের একটা লাকড়ির কাটূন বসানো হলো। বক্তা সেখানে
দাড়িয়ে বক্তব্য দিলেন। বক্তব্য যারা দিলেন, তাদের সংখ্যা অনেক ছিল। এখনকার বড়লেখা
জামায়াতে ইসলামীর আমীর সে সময়ে বড়লেখা বা কুলাউড়া থানা শিবিরের
সভাপতি হিসাবে বক্তব্য রেখেছিলেন-এটা আমার মনে আছে। মনে আছে জনাব আব্দুল
মান্নান ভাইয়ের কথা, যিনি সে সময় ছিলেন থানা জামায়াতের আমীর। আজকের এই দিনে তিনি
অসুস্থ আছেন, চিকিৎসাধিন আছেন। আর ছিলেন জনাব ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মালিক,
যিনি সে সময়ে
জামায়াতের সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং মাত্র কিছু দিনের পরে তিনি রুকন হন এবং পরবর্তীতে
তিনি দীর্ঘ সময় বড়লেখা থানা জামায়াতের আমীর ছিলেন। বর্তমানে তিনি আমেরিকা
প্রবাসী। অতিথিদের মাঝে বক্তব্য রেখেছিলেন বর্তমান জামায়াতে ইসলামীর
কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল জনাব ডা. শফিকুর রাহমান (তিনি তখন কোন
দায়িত্বে ছিলেন, জামায়াতে ছিলেন না শিবিরে ছিলেন,
তা আমার জানা
ছিল না)। ছিলেন মৌলভী বাজার জেলা জামায়াতের আমীর সিরাজুল ইসলাম মতলিব
এবং সিলেট জেলা জামায়াতের আমীর অধ্যাপক ফজলুর রাহমান।
বিনা
অনুমতিতে প্রোগ্রামে হাজির হয়ে হাসি মুখে নিজাম ভাই সহ সকলের সাথে মুসাফাহা
করে নিলাম। উনাদের জানান দিলাম “আমি চলে এসেছি”। সন্ধ্যা পূর্ববাসর সাথে সাথে আমি আমার এক সংগীকে
সাথে নিয়ে চলে আসলাম-প্রোগ্রাম তখনো চলছিল।
প্রোগ্রাম
কখন শেষ হয়ে হলো জানিনা। কিন্তু নিজাম ভাইতো আমাকে
খোঁজায় ব্যস্ত।
খোঁজতে খোঁজতে পেরেশান হয়ে হতাশ মন নিয়ে তিনি যখন বাসায়
ফিরলেন,
তখন হয়তো আমার
ঘুমের এক তৃতীয়াংশ শেষ হয়ে গেছে। পরদিন মাদ্রাসায় গিয়ে আবিস্কার করলাম যে,
আমি নাকি গতকালও
পলাতক শিবির কর্মী ছিলাম। এই বিষয়টা দায়িত্বশীলদের অনেক ভূগিয়েছে বটে।
কিন্তু বিষয়টি আমার জীবনে একটা ভাল উপকার করছে। আমি যখন বড় ভাই হয়ে গেলাম,
তখন একই ভাবে নিজাম
ভাইয়ের ভূমিকা রাখতে ভূলিনি কখনো। সব সময় মনে পড়তো “আমি এক সময়কার শিবিরের পলাতক কর্মী”
। বিধায় পলাতক কর্মী আমার মতো আরো কেউ
থাকতে পারে।
২১
জুলাই ২০১৭
0 Comments