রেশমাদের নিয়ে আমাদের যত খেলা – মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম


মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ রেশমা। আমার বিশ্বাস এখন সে লেবাননে অবস্থান করছে।
কে সেই রেশমা?
রেশমার সাথে আমার পরিচয় কাতারের দোহা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যেতে আমি প্লেনের অপেক্ষায়। এমন সময় এই হতভাগিনির সাথে আমার পরিচয়। বিমান বন্দরের একটি নিবৃত্ত স্থানে বসে রানওয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। মনের অবস্থা ভাল নেই। হঠাৎ করে হাজির হলো রেশমা। তার হাতে একটি বডিং পাস। বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে কোন কথা না বলে। বাংলাদেশী কোন মেয়ের সাথে কাতারের এয়ারপোর্টে দেখা হবে আর সে এমন করবে এধরণের অবস্থা আমার কাছে অকল্পনীয়, তাই শুরু করলাম হিন্দি ভাষায় বাতচিত-মেয়েটাকে ইন্ডিয়ান ভেবে। কিন্তু সাথে সাথে নজর পড়লো তার হাতে সবুজ বাংলাদেশী পাসপোর্টের দিকে। তাই ভাষার পরিবর্তন করে বাংলাতেই শুরু হলো আলাপ।
কে এই রেশমা?
রেশমা যাবে গৃহপরিচারিকার কাজ নিয়ে লেবাননে। ঢাকা থেকে এসেছে কাতার এয়ার ওয়েজের ফ্লাইটে। কিউআর ৩৪৫ যোগে ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে ৬ই সেপ্টেম্বর ২০১২ সকাল ৮টায়। এর মানে সে ঢাকা এয়ার পোর্টে পৌছেছে ভোর ৫টায়। কাতার সময় সকাল ১১:২৫ এ সে পৌছেছে কাতারে। অবস্থান করছে দোহা এয়ারপোর্টে। আমার সাথে সাক্ষাত বিকাল ৫টায়। এ পর্যন্ত এয়ারপোর্টের এখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকা পানির কুলারের পানিই তার একমাত্র খাদ্য বা পানীয়।
রেশমা যাবে বৈরতে-লেবাননের রাজধানীতে। চাকুরীর প্রত্যাশায়। সরকারী সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছে ইতিমধ্যে। রেশমা একজন মেয়ে মানুষ। শুধু মেয়ে মানুষ না। একজন উঠন্তি বয়সের যুবতী। তার চেহারা সুরত দেখে যে কোন যুবক আকর্ষিত হতে পারে এমন নয় কিন্তু। রোগা রোগা শরীর সাক্ষ্য দিচ্ছে তার অভাবের কথা। কিন্তু রোগা হোক আর স্বাস্থবতী হোক সে একজন মেয়ে, রূপবতী হোক আর বিশ্রী হোক সে একজন মেয়ে। সে যাচ্ছে বৈরুতে। আল্লাহই ভাল জানেন সে কতটুকু সতীত্ব নিয়ে যাচ্ছে, আর তার কতটুকু নিয়ে ফিরবে।
আমি তার বোডিং পাসটি দেখে থমকে গেলাম। কারণ তার বৈরুতের উদ্দেশ্যে ফ্লাইট হচ্ছে পরবর্তী দিন ৭ই সেপ্টেম্বর রাত ১১টায়।রেশমা  টিকেট নিয়েছে ঢাকার প্রসিদ্ধ ট্রাভেল এজেন্সী এস কে টুরিজম এন্ড ট্রাভেল থেকে। যার ডাইরেক্টর মিঃ নয়নের কার্ড রয়েছে রেশমার সাথে।
আমি একজন কাতার প্রবাসী হিসাবে বছরে প্রায় ২/৩বার কাতার এয়ারওয়েজে সফর করি বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইট সিডিউল বলা যায় আমার মুখস্ত। কাতার এয়ারওয়েজের ঢাকা থেকে দোহা অভিমুখে প্রতিদিনই ফ্লাইট রয়েছে। কোন কোনদিন রয়েছে একাধিক ফ্লাইট। কিন্তু রেশমারা জানেনা কখন কিভাবে কোন ফ্লাইটে যেতে হয়। তাই ট্রাভেল এজেন্সী গুলোর মর্জির উপর তাদেরকে ভরসা করতে হয়।
৭ই সেপ্টেম্বর দিনের বেলা ঢাকা থেকে যে ফ্লাইট দোহার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবে, তা রেশমার বৈরুতগামী প্লেন ছাড়ার বহু আগেই দোহা পৌছবে। তাহলে কেন রেশমাকে ৬ তারিখে দোহা এয়ারপোর্টে পাঠানো হলো তার প্লেন ছাড়ার মাত্র ৩৬ ঘন্টা আগে। রেশমাকে এই এয়ারপোর্টের চেয়ারেই কাটাতে হবে ৩৬ঘন্টা। রেশমারা ভাষা জানেনা, তাই ওখানের কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের সাথে কথা বলে খাবার দাবার জোগাড় করতে পারবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই। তাই তাদেরকে উপবাসী থেকেই ৩৬ঘন্টা অতিক্রম করতে হবে। আর কাতারের দোহা এয়ারপোর্টে পেসেঞ্জার ডেকে ডেকে খাদ্য বিতরণের কোন ব্যবস্থাও নেই।
তাহলে প্রশ্ন?
এস কে টুরিজম এন্ড ট্রাভেল কেন ৭তারিখ সকালের ফ্লাইটে রেশমাকে কাতারে না পাঠিয়ে কেন ২৪ঘন্টা আগে পাঠালো। অথচ তারা জানে একজন মেয়ে মানুষকে ৩৬ঘন্টার ট্রানজিটে কাঠানো কত কষ্টের। যদি ৭তারিখে কোন কানেকটিং ফ্লাইট না থাকতো, তাহলে ছিল ভিন্ন কথা। কিন্তু যেখানে ৭তারিখে ফ্লাইট রয়েছে, সেখানে একজন মেয়ে মানুষকে ৩৬ঘন্টা এয়ারপোর্টে বসিয়ে রাখা কত অমানবিকতা।
এস কে টুরিজম এন্ড ট্রাভেল এর মতো হাজারো ট্রাভেল এজেন্সী রেশমাদের নিয়ে খেলতে অভ্যস্ত। এই খেলা থেকে লাভবান হোন কতিপয় অর্থ লিপ্সু। যারা নীতি নৈতিকতাকে বৃদ্ধাংগুলী দেখিয়ে দিতে পারেন মাত্র কয়েকটি পয়সার জন্য। রেশমা যাবে ৭তারিখে। কিন্তু ঢাকা থেকে তার জন্য ৬তারিখের টিকেট দেয়া হয়েছে জেনে বুঝেই। কারণ ৩৬ঘন্টা ট্রানজিটের বিনিময়ে টিকেট পাওয়া যাবে সস্তায়। আর ঐ টাকা পকেটে যাবে এস কে টুরিজম ওয়ালাদের।

শেষ কথাঃ
মায়ের ইনতিকালের খবর পেয়ে দেশে যাচ্ছি। মনের অবস্থা নিশ্চয়ই উপলব্দি করছেন। কিন্তু ভাবলাম একজন অসহায় মেয়েকে সাহায্য করলে যদি আল্লাহ আমার মায়ের প্রতি রহম করেন।
মেয়েটাকে নিয়ে গেলাম এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরে একটি কাউন্টারে। তাকে হোটেল দেয়ার জন্য বললাম। কিন্তু সম্ভব হলো না। অবশেষে একজন কর্মকর্তা মেহেরবানী করে এয়ারপোর্টের ভিতরে নিবৃত স্থানে একটি খালি কক্ষ দেখিয়ে দিলেন। বললেন, হাতের বেগকে বালিশ বানিয়ে এখানের কার্পেটের উপর ঘুমানো সুযোগ নিতে। আমি রেশমাকে তা-ই করতে বললাম। ওর জন্য ৫ বেলা খাবারের স্লিট সংগ্রহ করা হলো। এয়ারপোর্টে খোজে একজন বাংলাদেশী কর্মচারী রেব করা হলো। যে কোন সমস্যার তার কাছে যাওয়ার জন্য বলা হলো। এরই মাঝে আমার প্লেইনের সময় চলে এলো। রেশমার ডকুমেন্ট গুলোর কয়েকটি ছবি উঠালাম সাথের মোবাইলে। রেশমাদের নিয়ে যত খেলার এখানেই সমাপ্ত হলো।

২০১২, ০৩ অক্টোবর

Post a Comment

0 Comments