দারসুল কুরআন – সূরা আত তাওবাহ – আয়াত ০১-০৬ – মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম

দয়া করে কুরআনের আয়াত সমূহ মূল কুরআনের সাথে মিলিয়ে পড়ুন। ফন্ট সংক্রান্ত সমস্যার কারণে আয়াত সমূহের শব্দাবলী আগপিছ হওয়ার আশংকা রয়েছে।

তেলাওয়াত ও অনুবাদঃ

﴿بَرَاءَةٌ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى الَّذِينَ عَاهَدتُّم مِّنَ الْمُشْرِكِينَ﴾

সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষনা করা হলো আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে, যেসব মুশরিকের সাথে তোমরা চুক্তি করেছিলে তাদের সাথে

﴿فَسِيحُوا فِي الْأَرْضِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ ۙ وَأَنَّ اللَّهَ مُخْزِي الْكَافِرِينَ﴾

কাজেই তোমরা দেশের মধ্যে আরো চার মাসকাল চলাফেরা করে নাও এবং জেনে রেখো তোমরা আল্লাহকে অক্ষম ও শক্তিহীন করতে পারবে না আর আল্লাহ সত্য অস্বীকারকারীদের অবশ্যই লাঞ্ছিত করবেন

﴿وَأَذَانٌ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ أَنَّ اللَّهَ بَرِيءٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ ۙ وَرَسُولُهُ ۚ فَإِن تُبْتُمْ فَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ وَإِن تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ ۗ وَبَشِّرِ الَّذِينَ كَفَرُوا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ﴾

আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে বড় হজ্জের দিনে সমস্ত মানুষের প্রতি সাধারন ঘোষণা করা হচ্ছেঃ “আল্লাহর মুশরিকদের থেকে দায়িত্বমুক্ত এবং তাঁর রসূলও এখন যদি তোমরা তাওবা করে নাও তাহলে তো তোমাদেরই জন্য ভাল আর যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে খুব ভাল করেই বুঝে নাও, তোমরা আল্লাহকে শক্তি সামর্থহীন করতে পারবে না আর হে নবী! অস্বীকারকারীদের কঠিন আযাবের সুখবর দিয়ে দাও  

﴿إِلَّا الَّذِينَ عَاهَدتُّم مِّنَ الْمُشْرِكِينَ ثُمَّ لَمْ يَنقُصُوكُمْ شَيْئًا وَلَمْ يُظَاهِرُوا عَلَيْكُمْ أَحَدًا فَأَتِمُّوا إِلَيْهِمْ عَهْدَهُمْ إِلَىٰ مُدَّتِهِمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ﴾

তবে যেসব মুশরিকের সাথে তোমরা চুক্তি করেছো তারপর তারা তোমাদের সাথে নিজেদের চুক্তি রক্ষায় কোন ক্রুটি করেনি আর তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্যও করেনি তাদের ছাড়া এ ধরনের লোকদের সাথে তোমরাও নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পালন করবে কারণ আল্লাহ তাকওয়া তথা সংযম অবলম্বকারীদেরকে পছন্দ করেন

﴿فَإِذَا انسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدتُّمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ ۚ فَإِن تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾

অতএব, হারাম মাসগুলো অতিবাহিত হয়ে গেলে মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা করো এবং তাদের ধরো, ঘেরাও করো এবং প্রত্যেক ঘাঁটতি তাদের জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাকো তারপর যদি তারা তাওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তাহলে তাদের ছেড়ে দাও আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়

﴿وَإِنْ أَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّىٰ يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَّا يَعْلَمُونَ﴾

আর যদি মুশরিকদের কোন ব্যক্তি আশ্রয় প্রার্থনা করে তোমার কাছে আসতে চায়( যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পারে) তাহলে তাকে আল্লাহর কালাম শোনা পর্যন্ত আশ্রয় দাও, তারপর তাকে তার নিরাপদ জায়গায় পৌছিয়ে দাও এরা অজ্ঞ বলেই এটা করা উচিত

নামকরণঃ

এই সূরার ২টি প্রসিদ্ধ নামঃ

1.   সূরা আত-তাওবাঃ

সূরার একটি স্থানে মুমিনদের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে, এজন্য তাওবা।

﴿ثُمَّ يَتُوبُ اللَّهُ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ عَلَى مَنْ يَشَاءُ﴾

তারপর (তোমরা এও দেখছো) এভাবে শাস্তি দেবার পর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাওবার তাওফীকও দান করেন (আয়াতঃ ২৭)

﴿أَلَم يَعلَموا أَنَّ اللَّـهَ هُوَ يَقبَلُ التَّوبَةَ عَن عِبادِهِ وَيَأخُذُ الصَّدَقاتِ وَأَنَّ اللَّـهَ هُوَ التَّوّابُ الرَّحيمُ﴾

তারা কি জানে না, আল্লাহই তার বান্দাদের তাওবা কবুল করেন, তাদের দান -খয়রাত গ্রহণ করেন এবং আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, ও করুণাময়? (আয়াতঃ ১০৪)

2.  সূরা আল বারায়াতঃ

সূরার শুরুতেই মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষনা দিয়ে সুরা শুরু হয়েছে, এজন্য বারাআত।  بَرَاءَةٌ বারাআত মানে সম্পর্কচ্ছেদ।

﴿بَراءَةٌ مِنَ اللَّـهِ وَرَسولِهِ إِلَى الَّذينَ عاهَدتُم مِنَ المُشرِكينَ﴾

সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষনা করা হলো আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে, যেসব মুশরিকের সাথে তোমরা চুক্তি করেছিলে তাদের সাথে (আয়াতঃ ১)

এই সূরার অন্যান্য নামঃ

-      সূরা ফাতিহার পর সবচেয়ে বেশী নাম সম্পন্ন সূরা এটি।

-      এই সূরার ১০ এর অধিক নাম রয়েছেঃ

1.   السورة الفاضحة (আল ফাদিহাহ) সূরায় মুনাফিকদের পর্দা এবং তাদের কর্মকে উম্মোচন করা হয়েছে, গোপনীয়তা ফাঁস হয়েছেঃ

قُلتُ لِابْنِ عَبَّاسٍ: سُورَةُ التَّوْبَةِ، قالَ: التَّوْبَةُ هي الفَاضِحَةُ، ما زَالَتْ تَنْزِلُ: ومِنْهُمْ... ومِنْهُمْ... حتَّى ظَنُّوا أنَّهَا لَنْ تُبْقِيَ أحَدًا منهمْ إلَّا ذُكِرَ فِيهَا.

2.  سورة العذاب (আল আযাব) সূরায় আযাবের কথা বারবার এসেছে।

3.  السورة المُقشقشة (আল মুকাশকাশাহ) সূরায় মুনাফিকদের কাজ ও গুণাবলীর বর্ণনা করা হয়েছে যে ঐসব গুণ থেকে বেঁচে যাবে, সে মুনাফিকি থেকে মুক্তি পাবে

4.   السورة المنقرة (আল মুনকিরাহ) সূরা মুনাফিক ও মুশরিকদের অন্তরে কি আছে তা অনুসন্ধান করে

5.  سورة البحوث (আল বাহুস) সূরাটি মুনাফিকের অন্তরে কি আছে, তা সার্চ করে।

6.  سورة الحافرة সূরাটি মুনাফিকের অন্তরকে খনন করে অনুসন্ধান করে।

7.  سورة المثيرة (আল মুবাইছিরাহ)সূরাটি মুনাফিকের লজ্জাকে বাড়িয়ে দিয়েছে

8.  سورة المدمدمة আল মুদামদিমা বা ধ্বংসকারী সূরা।

9.  سورة المُخزية  (আল মুখযিয়াহ) যা মুনাফিকদের শাস্তি প্রদান করেছে।

10. لسورة المشردة  (আল মুশাররিদাহ) যার মাধ্যমে মুনাফিকদের একত্রিত করে বিচ্ছিন্ন ও বহিস্কার করা হয়েছে

এই সূরার একটি অন্যতম বৈশিষ্টঃ

§ সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ নেই।

عن ابن عباس رضي الله عنهما، قالسألت علي بن أبي طالب رضي الله عنه لم لم تكتب في براءة بسم الله الرحمن الرحيم، قال: لأن بسم الله الرحمن الرحيم أمان وبراءة نزلت بالسيف.

হযরত আলী রা.কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, সূরা বারায়াত এর শুরুতে কেন বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম লেখা হলো না? উত্তরে তিনি বলেনঃ কেননা, বিসমিল্লাহরি রাহমানির রাহীম শান্তির জন্য কিন্তু সূরা বারায়াত নাযিল হয়েছে তলওয়ারের জন্য-তথা শান্তির জন্য নয়

عن ابن عباس أنه سأل عثمان رضي الله عنهم جميعاً عن سبب قرن الأنفال بالتوبة بدون البسملة في أولها، فكان مما قال: كانت الأنفال من أوائل ما نزل بالمدينة وكانت براءة من آخر القرآن نزولاً، وكانت قصتها شبيهة بقصتها فظننت أنها منها وقبض رسول الله صلى الله عليه وسلم ولم يبين لنا أنها منها، فمن أجل ذلك قرنت بينهما ولم أكتب بينهما سطر بسم الله الرحمن الرحيم

দীর্ঘ হাদীসের শেষে বলা হয়েছেঃ ………আমি এ দু’সূরাকে একত্রে মিলিয়ে দিয়েছি। ’বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ লাইনও (এ দু’ সূরার মধ্যে) লিখিনি

§ ইমাম রাযীর লিখেছেনঃ নবী সা. নিজে এর শুরুতে বিসমিল্লাহ লিখাননি, বিধায় সাহাবায়ে কিরামও লিখাননি আর পরবর্তীতে এই রীতিকে অনুসরণ করা হয়েছে

§ মুফাস্সিরীনে কিরাম এটাকে কুরআনের বিশুদ্ধতা ও পরিবর্তন না হওয়ার দলীল হিসাবে পেশ করেছেন।

§ هذه السورة الكريمة من أواخر ما نزل على رسول الله صلى الله عليه وسلم

রাসূল সা. এর উপর নাযিলকৃত সর্বশেষ সূরা সমূহের অন্যতম।(ইবনে কাসীর)

নাযিলের সময়-কাল ও সূরা অংশ সমূহঃ

§ এটি আদ্যোপান্ত একটি মাদানী সূরা, যাতে অনেক আহকাম বর্ণনা করা হয়েছে।

§ বিশেষতঃ

o যাকাতের হুকুম এই সুরাতে বর্ণিত হয়েছে।

o আর জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কথা খোলে খোলে বর্ণনা করা হয়েছে।

§ কুরআনে হাকীমের ধারাবাহিকতায় এটি কুরআনের ৯ম সূরা। এতে মোট ১২৯টি আয়াত আর ১৬টি রুকু রয়েছে।

এই সূরার ৩টি ভাষণের সমষ্টিঃ

§ নাযিল ধারাবাহিকতা অনুযায়ী মনে হবে যে, প্রথম ভাষণটি সূরার সবশেষে হওয়া উচিত ছিল

§ কিন্তু বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনায় শেষে নাযিল হওয়া ভাষণ নিয়ে আসা হয়েছে সূরার শুরুতে

§ কুরআনকে কিতাব আঁকারে সাজাবার সময় নবী সা. শেষে নাযিল হওয়া ভাষণকে প্রথমে রাখেন

১. প্রথম ভাষণঃ

§ শুরু থেকে পঞ্চম রুকুর শেষ পর্যন্ত-নাযিল হয়েছে সব শেষে

§ ৯ম হিজরীর যিলকদ মাস বা তার কাছেকাছি সময়ে।

§ ঠিক তখন, যখন হযরত আবু বকর রা.কে আমীরুল হজ্জ করে সাহাবীরা মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন। 

§ এই ভাষণে এমন কিছু কর্মপদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে, যা সেই সময়ে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে ঘোষনা আসা দরকার। তাই হযরত আলী রা.কে তাদের পিছনে পাঠানো হয়, যাতে তিনি হজ্জের সময়ে আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা প্রতিনিধিদের সমাবেশে তা শুনিয়ে দেন।

§ এই সময় রাসূল সা. তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসছিলেনযখন হজ্জের মওসুম ছিলরাসূল সা. এর ইচ্ছা ছিল হজ্জে গমন করবেনকিন্তু সেই সময়ে মুশরিকরা নিজেদের অভ্যাস মতো উলংগ হয়ে কাবাঘর তাওয়াফ করতোরাসূল সা. বিষয়টি অপছন্দ করতেন বলে আবু বকর রা.কে হজ্জের আমীর করে হজ্জে প্রেরণ করেনযাতে তিনি হজ্জের আহকাম মানুষদের শিখান এবং মুশরিকদের জানিয়ে দেন যে, তারা যেন আগামী বছর হজ্জ করতে না আসে

২. দ্বিতীয় ভাষণঃ

§ ৬ থেকে ৯ রুকুর শেষ পর্যন্ত

§ নাযিল হয়েছে ৯ম হিজরীর রজব মাসে বা তার কিছু আগে।

§ যখন তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। এখানে মুমিনদের জিহাদের জন্য উদ্বোদ্ধ করা হয়েছে। আর মুনাফিক আর দূর্বল ঈমানদারদেরকে তিরষ্কার করা হয়েছে।

৩. তৃতীয় ভাষণঃ

§ ১০ থেকে শেষ পর্যন্ত

§ নাযিল হয়েছে তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর।

§ যাতে মুনাফিকদের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে।

§ তাবুক যুদ্ধে যারা অংশ নেয়নি, তাদের তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করা হয়েছে।

§ সাচ্ছা ঈমানদার যারা তাবুক যুদ্ধে অংশ নেননি, তাদের তিরস্কার ও ক্ষমা ঘোষনা করা হয়েছে।

ঐতিহাসিক পটভূমিঃ

§ এই সূরার পটভূমির শুরু হুদায়বিয়ার সন্ধি থেকে। যাকে কুরআনে বলা হয়েছে ফাতহুম মুবিন।

﴿إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحاً مُّبِيْناً﴾

 হে নবী! আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি।” (ফাতহঃ ০১)

§ শত বিপদ আর মুসিতবত মোকাবেলা করে হুদায়বিয়া পর্যন্ত ইসলাম মাত্র ৬ বছরে আরবের এক তৃতীয়াংশ এলাকায় শুধু পৌছেনি, বরং একটি সুসংঘটিত ও সংঘবদ্ধ সমাজের ধর্ম, একটি পূর্ণাঙ্গ সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।

§ হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেল। দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য সৃষ্টি হলো চারদিকে নিরাপদ আর নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশ। এর পরিণতিতে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল মুসলমানরা অর্জন করতে সক্ষম হলোঃ

১. আরব বিজয়।

২. তাবুক অভিযান।

আরব বিজয়ঃ

§ আরব বিজয়ের এই বিষয়টির মধ্যে রয়েছেঃ

ক. মক্কা বিজয়।

খ. হোনাইন।

গ. তাবুক অভিযান।

ঘ. তাবুক পরবর্তী ঘটনা।

ক. মক্কা বিজয়ঃ

§ হোদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত সম্প্রসারণ ও সাংগঠনিক মজবুতি অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর ফলে মাত্র ২ বছরে ইসলামের প্রভাব এত বাড়ে, এর শক্তি এতই পরাক্রান্ত ও প্রতাপশালী হয়ে উঠে যে, পুরাতন জাহেলিয়াত ইসলামের মোকাবেলায় অসহায় আর শক্তিহীন হয়ে পড়ে।

§ অসহায় কুরাইশদের উৎসাহী কিছু লোক পরাজয় আসন্ন দেখে তারা নিজেরাই হুদায়বিয়ার সন্ধি ভংগ করে

§ সন্ধির বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধ করতে তারা চাচ্ছিল।

§ নবী সা. তাদেরকে গুছিয়ে উঠার সুযোগ না দিয়ে সন্ধি ভংগের দায়ে ৮ম হিজরীর রমযান মাসে আকস্মিক মক্কা আক্রমন করে দখল করে নেন। বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় সংঘটিত হয়।

খ. হোনাইনের যুদ্ধঃ

§ মক্কা বিজয়ের পর পুরাতন জাহেলী শক্তি হোনাইনে মরণ কামড় দেয়। বেশ কতিপয় জাহেলিয়াতপন্থী গোত্র তাদের পূর্ণ শক্তির সমাবেশ ঘটায়। আর এর মাধ্যমে তারা মক্কা বিজয়ের সুফল প্রাপ্তি ও পূর্ণতা অর্জনের পথে বাঁধা হয়ে দাড়ায়।

§ মক্কা বিজয়ের পর সারা আরবে শুরু হয়েছিল সংস্কার বিল্পব। আর সেই বিপ্লব ষোলকলায় পূর্ণ হয়ে এগিয়ে চলছিল পূর্ণতার পথে। সেই পূর্ণতার পথে তারা বাঁধার সৃষ্টি করে।

§ কিন্তু তাদের সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। হোনায়নে তাদের পরাজয়ের মাধ্যমে আরবের নেতৃত্ব কারা দেবে সে ভাগ্যের ফায়সালাও হয়ে যায়। ফায়সালা হয়ে যায় যে, আরব বিশ্ব এখন দারুল ইসলাম হিসাবে ঠিকে থাকবে।

§ হোনায়েনের যুদ্ধের ১ বছরের মধ্যে আরবের বেশীর ভাগ লোক ইসলাম গ্রহণ করে। আর যারা ইসলাম কবুল করেনি, তারা বিচ্ছিন্ন ভাবে আরবের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।

§ রোম সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকায় নবী সা. ৩০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী হাজির হন তাবুকের প্রান্তরেরোমীয়রা মুসলমানদের মুখোমুখী হবার সাহস পায়নি, তাই পিছু হঠে। আর এতে করে তাদের যে দূর্বলতা প্রকাশ পায়, তাতে নবী সা. এবং তার দ্বীনের অপ্রতিরোধ্য ও অজেয় ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

§ এর ধারাবাহিকতায় তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সাথে সাথে আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৭০ এর মতো প্রতিনিধি দল মদীনায় আসে । ইসলাম গ্রহণ করে, নবী সা. এর নেতৃত্বের আনুগত্য স্বীকার করে।

§ কুরআনে যে কথাটা বলা হয়েছে এই ভাবেঃ

﴿إِذَا جَاء نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ﴾﴿وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُوْنَ فِيْ دِيْنِ اللَّهِ أَفْوَاجاً﴾

যখন আল্লাহর সাহায্য এসে গেলো ও বিজয় লাভ হলো এবং তুমি দেখলে লোকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করছে।

তাবুক অভিযানঃ

§ তাবুকের এই অভিযান পরিচালিত হয়েছিল রোম সামাজ্যের মোকাবেলায়।

§ রোম সামাজ্যের সাথে সংঘর্ষের শুরু সেই মক্কা বিজয়েরও আগে।

§ হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে প্রাপ্ত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নবী সা. আরবের বিভিন্ন স্থানে দাওয়াতী গ্রুপ পাঠিয়ে ছিলেন। দাওয়াতী গ্রুপের সাথে ছিল নবী সা. এর পক্ষ থেকে দাওয়াতী চিঠি।

§ সিরিয়া সীমান্তবর্তী গোত্র গুলো ছিল বেশীর ভাগ খৃষ্টান এবং রোম সাম্রাজ্যের প্রভাবাধীন।

§ যাতুত তালাহ নামক স্থানে ঐ সব দাওয়াতী গ্রুপের ১৫জন সদস্যকে হত্যা করা হয়। কেবল মাত্র গ্রুপ লিডার কাব বিন উমাইর গিফারী রা. প্রাণে বেঁচে ফিরে আসেন।

§ বুসরার গবর্ণর শুরাহবিল ইবনে আমর, যে ছিল খৃষ্টান ও রোম সম্রাট কাইসারের অনুগততার কাছে নবী সা. এর প্রতিনিধি হারিছ বিন উমাইর রা. দাওয়াত নামা নিয়ে হাজির হলে সে তাকে হত্যা করে।

§ সিরিয়া সীমান্ত মুসলমানদের জন্য নিরাপদ করা, ভবিষ্যতে যাতে লোকেরা মুসলমানদের দূর্বল মনে না করে এবং মুসলমানদের উপর জুলুম ও বাড়াবাড়ি করার সাহস না করে সেই উদ্দেশ্যে ৮ হিজরীর শুরুর দিকে নবী সা. ৩ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী সিরিয়া সীমান্তে পাঠান।

§ মাআন নামক স্থানে পৌছে মুসলমান বাহিনী জানতে পারলো ২টি খবরঃ

1.   শুরাহবীল ইবনে আমর ১ লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে মুসলামদের মোকাবেলা করতে আসছে।

2.  রোমের কাইসার হিমস নামক স্থানে সশরীরে উপস্থিতি। সে তার ভাই থিয়েডরের নেতৃত্বে আরো ১লাখ সৈন্যের বাহিনী রওয়ানা হয়ে গেছে।

§ এসব আতংক জনক খবর পাওয়ার পরও মুসলমানদের ৩ হাজারের বাহিনী কোন পরওয়া না করে সামনে অগ্রসর হয়।

§ মুতা নামক স্থানে শুরাহবিলের বাহিনীর সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। ৩৩ জন কাফের-এর মৃত্যু হয় বনাম ১ জন মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন।

§ মুসলমানরা চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সারা আরব বিশ্ব বিস্ময়ের সাথে দেখলো এত শক্তি সত্ত্বে কাফেররা বিজয়ী হতে পারলো না।

§ এই বিজয়ের প্রভাব যে কাজ করলো তাহলো, সিরিয়া ও তার নিকটবর্তী এলাকার আধা স্বাধীন আরব গোত্র এমনকি ইরাকের নিকটবর্তী এলাকায় বসবাসকারী পারস্য প্রভাবাধীন নজদী গোত্রের লোকেরা পর্যন্ত ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হাজার হাজার লোক ইসলাম গ্রহণ করলো।

§ এই সময় রোম সাম্রাজ্যের আরবীয় সৈন্য দলের একজন সেনাপতি ইসলাম কবুল করেন, যার নাম ছিল ফারওয়া ইবনে আমর আল জুযামীতিনি তার ঈমানের অকাট্য প্রমাণ পেশ করেন, যা দেখে আশপাশের এলাকার লোক হতচকিত হয়ে পড়ে। আর তাহলোঃ

ফারওয়ান ইসলাম গ্রহণের খবর যখন কাইসার শুনলেন, তখন তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসলেন দরবারে। তাকে দুইটি জিনিসের প্রস্তাব দিয়ে একটি গ্রহণের সুযোগ দেয়া হলো।

১. ইসলাম ত্যাগ করো, তাহলে মুক্তি এবং পূর্ব পদে বহাল।

২. মুসলমান থেকো, কিন্তু এর ফলে মৃত্যুদন্ড।

তিনি অত্যন্ত ধীর স্থির ভাবে ইসলামকেই নির্বাচিত করলেন এবং শাহাদাত বরণ করলেন।

§ ফারওয়ানের শাহাদাত কাইসারকে চিন্থায় ফেলে দিল। তিনি তার সাম্রাজ্যের বিরোদ্ধে এক ভয়াবহ হুমকি উপলব্দি করলেন-যা আরবের মাটি থেকে তার সাম্রাজ্যের দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে।

§ পরের বছর কাইসার সিরিয়া সীমান্তে সামরিক প্রস্তুতি শুরু করেন, উদ্দেশ্য মুসলমানদের মুতা যুদ্ধের শাস্তি প্রদান। আর তার অধীনে আরবের বিভিন্ন সরদাররা সৈন্য সমাবেশ ঘটায়।

§ নবী সা. এ খবর পাওয়ার পর দেরী না করে কাইসারের বিশাল শক্তির সাথে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ এহেন পরিস্থিতি সামান্য দূর্বলতা প্রদর্শন মানে এতদিনের মেহনত আর পরিশ্রম বরবাদ হয়ে যাওয়া।

§ তখনকার পরিস্থিতিটা ছিল এমন, যদি সামান্য দূর্বলতা দেখা যায়, তাহলে-

1.   হোনায়েনে আরবের ক্ষয় হওয়ার পথে ও চরম মুমুর্ষ অবস্থার জাহেলিয়াতের বুকে যে শেষ আঘাত আনা হয়েছিল, তারা আবার মাথা ছাড়া দিয়ে উঠবে।

2.  মদীনায় মুনাফেকরা তলে তলে গাস্সানের খৃষ্টান বাদশা আর কাইসারের সাথে গোপন যোগাযোগ করে, আর তাদের দূষ্কর্মের অফিস হিসাবে মসজিদে দ্বিরারনির্মাণ করেছিল, তারা মুসলমানদের পিঠে ছুরি বসিয়ে দিন।

3.  সামনে কাইসারের আক্রমণ। যে ইরানীদের পরাজিত করার মাধ্যমে দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছিল অত্যন্ত প্রতাপশালী।

§ এসব কারণে বর্তমান পর্যন্ত বিজয়ী ইসলাম আকস্মাত পরাজিত হয়ে যেতে পারতো। বিধায় নবী সা এটাকে সত্যের দাওয়াতের জন্য জীবন-মৃত্যুর ফায়সালা কার সময় মনে করে প্রস্তুতির সাধারণ ঘোষনা দিলেন

§ তখনকার সময়ে সমস্যা যা ছিলঃ

১. চরম দূর্ভিক্ষ

২. আবহাওয়া প্রচন্ড গরম।

৩. ফসল পাকার সময় কাছে।

৪. সওয়ারী ও সাজ-সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা ছিল কঠিন।

৫. অর্থের অভাব ছিল প্রকট।

৬. দুনিয়ার দুইটি বৃহৎ পরাশক্তির মোকাবেলা।

§ নবী সা. এর যুদ্ধ যাত্রার নিয়ম ছিলঃ

o  কোথায় যাবেন তা কাউকে বলতেন না,

o  কার সাথে মোকাবেলা করতে হবে, তা কাউকে জানাতেন না।

o  যেখানে যাবার কথা সেই পথে না গিয়ে বাঁকা পথে যেতেন।

কিন্তু এই অভিযানে তিনি কোন গোপনীয়তা অবলম্বন না করে পরিষ্কার বলে দিলেন যে, রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, যেতে হবে সিরিয়ার দিকে।

§ সেই সময়কার পরিস্থিতির নাজুকতা-যা সবাই অনুভব করছিল। যেমনঃ

1.   মুশরিকঃ প্রাচীন জাহেলিয়াত প্রেমিকরা যারা তখনো বেঁচে ছিল, তাদের জন্য এটা ছিল আশার আলো। তারা ইসলাম আর  রোম সংঘাত কোন দিকে যায় তার দিকে অধীর আগ্রহে দৃষ্টি নিবন্ধ করে রেখেছিল।

2.  মুনাফিকঃ মুনাফেকরা এর পিছনে সকল প্রচেষ্টা নিয়োজিত করে, মসজিদে দ্বিরার বানায়, আর অপেক্ষা করে সিরিয়াতে মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয় হইবা মাত্র দেশের ভিতর গোমরাহী আর অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দেবে। এজন্য এই অভিযান ব্যর্থ করার জন্য সম্ভাব্য সকল কৌশল তারা গ্রহণ করলো।

3.  মুসলমানঃ মুসলমানেরা অনুভব করছিলেন যে, ২২বছর থেকে তারা যে প্রাণান্তকর সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন, এখন তার চড়ান্ত ফায়সালার সময়। সাহস দেখাতে পারলে সারা দুনিয়ার জন্য এ আন্দোলনের দোয়ার খোলে যাবে, আর না পারলে খোদ আরব দেশেই পাততাড়ি গুটাতে হবে

§ মুসলমানরা পরিস্থিতি অনুভব করে চরম উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আর্থিক ভাবে সবাই সর্বোচ্চ ত্যাগ প্রদর্শণ করেন।

§ আবু বকর, উমর, উসমান, আব্দুর রাহমান বিন আউফ, মজদুর সাহাবীরা, নারীরা সীমাহীন আর্থিক ত্যাগের উত্তম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন।

§ ৯ম হিজরীর রজব মাসে নবী সা. ৩০ হাজার মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে রওয়ানা হন সিরিয়ার পথে। সাথে ১০ হাজার সাওয়ার। এক উটে পালাক্রমে কয়েকজন। গ্রীষ্মের প্রচন্ডতা, পানির স্বল্পতা।

§ মুসলমানরা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধতার পরিচয় দেন।

§ তাবুক পৌছে জানা যায় কাইসার তার সেনা বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে নিয়ে আসার সাহস করতে পারেনি, তাই সীমান্ত থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। সীমান্তে কোন দুশমন নেই। যুদ্ধেরও প্রয়োজন নেই।

§ উল্লেখ্য যে,

কাইসারের প্রস্তুতি শেষ হবার আগেই রাসূল সা. সেখানে পৌছে যান। মুতার যুদ্ধের স্মৃতি তার চোখের সামনে, সাথে নবী সা. এর সরাসরি নেতৃত্ব, আবার সৈন্য সংখ্যা ৩ হাজারের পরিবর্তে ৩০ হাজার। বিধায় তার ২লাখ সৈন্য নিয়েও মুকাবিলার সাহস ছিল না।

§ বিনা রক্তপাতে অভিযান সফল হওয়ায় নৈতিক বিজয় লাভ হলো। নবী সা. এটাকে যথেষ্ট মনে করলেন।

§ রাসূল সা. এ বিজয় থেকে রাজনৈতিক ও সামরিক ফায়দা নেয়াকে অগ্রাধিকার দিলেন।

§ তাবুকে ২০দিন অবস্থান করে পার্শবর্তী রাজ্য সমূহ যা রোম সাম্রাজ্যের অধীন ছিল, তাদেরকে ইসলামী সাম্রাজ্যের অধীন করে করদ রাজ্যে পরিণত করলেন। আর এর মাধ্যমে ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমা রোম সাম্রাজ্যের সীমা পর্যন্ত পৌছে যায়।

তাবুক পরবর্তী ঘটনাঃ

§ তাবুক যুদ্ধ হতে ফিরে এসে নবী সা. প্রথম যে কাজটা করলেন, তা হলো মসজিদে দ্বিরার ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দিলেন।

§ এর পর সাচ্ছা মুমিনদের মধ্যে যারা তাবুকের অভিযানে শামীল হতে পারেননি, তাদের বিষয়ে হাত দিলেন নবী সা.। কারণ, ইসলাম এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে, ইসলাম নেতৃত্ব দেবে সারা বিশ্বময়। তাই ঘরের মধ্যে দূর্বলতা  না রাখা। তাদের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের জন্য দৃঢ় কন্ঠে জানিয়ে দেয়া হলো যে, আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করার সংগ্রাম, কাফের আর মুসলমানের সংঘাতই হচ্ছে মুমিনের ঈমানের দাবী যাচাই করার আসল মানদন্ড। এই সংঘর্ষে যে ব্যক্তি ইসলামের জন্য ধন-প্রাণ, সময় ও শ্রম ব্যয় করতে ইতস্তত করবে, তার ঈমান নির্ভরযোগ্য হবেনা।

এ প্রসংগে কাব বিন মালিকের ঘটনাঃ

§ নবী সা. তাবুক থেকে মদীনায় ফিরে আসলে যারা যুদ্ধে যেতে পারেননি, তারা ওজর পেশ করার জন্য হাজির হলো। যাদের মাঝে ৮০ জনেরও বেশী মুনাফিক ছিল। রাসূল সা. তাদের মিথ্যা ওজর শুনছিলেন এবং মেনে নিচ্ছিলেন।

§ এ পর্যায়ে আসলো ৩জন মুমিনের পালা, পরিষ্কার ভাবে নিজেদের দোষ স্বীকার করলেন। আর রাসূল তাদের ৩জনের ব্যাপারে ফায়সালা মুলতবি রাখলেন। যাদের সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছেঃ

﴿وَعَلَى الثَّلاَثَةِ الَّذِينَ خُلِّفُواْ حَتَّى إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنفُسُهُمْ وَظَنُّواْ أَن لاَّ مَلْجَأَ مِنَ اللّهِ إِلاَّ إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوبُواْ إِنَّ اللّهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ﴾

আর যে ৩জনের ব্যাপার মুলতবি করে দেয়া হয়েছিল, তাদেরকে তিনি মাফ করে দিয়েছেন। পৃথিবী তার সমগ্র ব্যাপকতা সত্তেও যখন তাদের জন্য সংকির্ণ হয়ে গেল, তাদের নিজেদের প্রাণও তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাড়ালো এবং তারা জেনে নিল যে, আল্লাহর হাত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর নিজের রহমতের আশ্রয় ছাড়া আর কোন আশ্রয় স্থল নেই। তখন আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের দিকে ফিরলেন যাতে তারা তাঁর দিকে ফিরে আসে। অবশ্যই আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুনাময়।” (আত তাওবাঃ ১১৮)

§ এই ৩জনের ব্যাপারে সাধারণ ঘোষনা প্রদান করা হলো যে, আল্লাহর নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তাদের সাথে কোন ধরনের সামাজিক সম্পর্ক রাখা যাবেনা।

§ এই তিনজন সাহাবী ছিলেনঃ

১. কাব ইবনে মালিক।

২. হিলাল ইবনে উমাইয়াহ।

৩. মুরারাহ ইবনে রুবাই।

§ এই তিনজন সাহাবী ছিলেন সাচ্চা মুমিন। তাদের আন্তরিকতার ব্যাপারে তাদের পূর্বের তৎপরতাই পরিস্কার করে দেয়। যেমনঃ ৩জন সাহাবী ওহুদ, খন্দক, হুনাইন সহ অনেক যুদ্ধে রাসূল সা. এর সাথী ছিলেন। আর হিলাল বিন উমাইয়াহ ও মুরারাহ ইবনে রুবাই বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। বিধায় তাদের ঈমানের সত্যতা ছিল সব রকমের সন্দেহের উর্ধে।

§ এ তিন জনের অতীত ফাইল খুবই ভাল। এ প্লাস অথবা গোল্ডেন এ প্লাস। এত ত্যাগী হওয়া সত্ত্বেও নাজুক সময়ে গাফলতির পরিচয় দিলেন, তখন তাদের পাকড়াও করা হয়েছিল।

§ নবী সা. তাবুক থেকে ফিরে এসে মুসলমানদের কড়া নির্দেশ দিলেন যে, এদের সাথে সালাম করতে পারবে না। এমনকি ৪০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর তাদের স্ত্রীদের থেকেও আলাদা হয়ে বসবাসের অর্ডার করা হলো। অবশেষে ৫০তম দিবসে তাদের তাওবা কবুল করা হলো এবং আয়াত নাযিল হলো।

ঘটনার বিবরণ কাব বিন মালিকের মুখেঃ

§ কাব বিন মালিকের মুখে। যিনি বৃদ্ধ বয়সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তার পুত্র আব্দুল্লাহর কাছে তিনি বর্ণনা করেছেন।

§ তাবুকের যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য যখন ঘোষনা দেয়া হলো, সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমিও মনে মনে চিন্থা করলাম প্রস্তুতি নেবো।

§ আমাকে কেন জানি অলসতায় পেয়ে বসলো। মনে মনে বলতাম-এত তাড়াহুড়া কিসের, রওয়ানা হওয়ার সময় যখন আসবে, তখন ঠিকই প্রস্তুত হয়ে যাবো। তৈরী হতে আর কতক্ষণ লাগে।

§ আমি প্রস্তুতিতে পিছিয়ে পড়লাম। একদিন সেনাবাহিনী রওয়ানা হয়ে গেল। আমি ভাবলাম, অসুবিধা নাই-আমি দুদিন পর তাদের সাথে যোগ দিব। তারা চলে গেল। আমাকে অলসতা পেয়ে বসলো। সময় চলে গেল। আমি যেতে পারলাম না।

§ আমি মদীনায় থেকে গেলাম। মদীনায় যখন হাটতাম তখন আমার চোখে শুধু তাদেরই পড়তো, যারা হয়তো মুনাফিক, নয়তো দূর্বল ও অক্ষম ব্যক্তি। যাদেরকে আল্লাহ অব্যাহতি দিয়েছেন।

§ তাবুক থেকে ফিরে এসে নবী সা. নিয়ম মতো মসজিদে দূরাকাত নফল নামায পড়েলেন এবং লোকদের সাথে সাক্ষাত করতে বসলেন।

§ মুনাফিকরা, যাদের সংখ্যা ৮০ জনের চেয়েও বেশী ছিল, তারা এসে লম্বা লম্বা কসম খেয়ে তারা তাদের ওজর পেশ করতে লাগলো। তাদের সকলের ওজর ছিল বানোয়াট ও সাজানো। রাসূল সা. তাদের লোক দেখানো সব ওজর মেনে নিলেন। তাদের অন্তরের ব্যাপার আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে বললেন আল্লাহ তোমাদের মাফ করুন।

§ কাব বিন মালিক বলছেন, এর পর আসলো আমার পালা। আমি সামনে গিয়ে সালাম দিলাম। রাসূল সা. আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন, বললেনঃ আসুন! আপনাকে কিসে আটকে রেখেছিল?

§ আমি বললামঃ আল্লাহর কসম, যদি আমি কোন দুনিয়াদারের সামনে হাজির হতাম, তাহলে কোন না কোন কথা বানিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতো। আর বানিয়ে কথা বলার কৌশলও আমি জানি।

§ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি কোন মিথ্যা ওজর উপস্থাপন করে আমি আপনাকে সন্তুষ্ট করেও নেই, তাহলে আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনাকে আমার প্রতি আবার নারাজ করে দেবেন। আর আমি যদি সত্য বলি, আর আপনি নারাজ হয়েও যান, আশা রাখি আল্লাহ আমার জন্য ক্ষমার কোন পথ তৈরী করে দেবেন।

§ আসলে পেশ করার মতো কোন ওজর আমার নেই। আমি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি সক্ষম ছিলাম।

§ রাসূল সা. বললেন এ ব্যক্তি সত্য কথা বলছে।  ঠিক আছে, চলে যাও এবং আল্লাহর ফায়সালার অপেক্ষা করতে থাকো।”

§ আমি উঠে গিয়ে আমার গোত্রের লোকদের মাঝে বসলাম। সবাই আমার পিছনে লাগলো, তিরস্কার করলো এই বলে যে, কেন তুমি মিথ্যা ওজর পেশ করলেনা।

§ তাদের কথা শুনে রাসূলের কাছে গিয়ে কিছু বানোয়াট ওজর পেশ করতে আগ্রহ সৃষিট হলো। কিন্তু যখন শুনলাম মুরারাহ ইবনে রুবাই আর হেলাল ইবনে উমাইয়া আমার মতো সত্য কথা বলেছে, তখন আমার কথার উপর অটল থাকলাম।

বয়কটঃ

§ এর পর নবী সা. হুকুম জারি করলেন, আমাদের ৩জনের সাথে কেউ কথা বলতে পারবেনা।

§ অন্য ২জন ঘরের মধ্যে বসে রইল।

§ আমি বাহিরে বের হতাম, জামায়াতে নামায পড়তাম, বাজারে ঘোরাফেরা করতাম।

§ কেউ আমার সাথে কথা বলতো না। মনে হতো দেশটা বদলে গেছে। আমি এখানে এক অপরিচিত আগন্তুক। কেউ আমাকে চেনেনা, জানেনা

§ মসজিদে নামাযে গিয়ে রাসূল সা. কে সালাম করতাম। সালামের জবাবে তাঁর ঠোঁট নড়ে উঠছে কিনা তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতাম। কিন্তু অপেক্ষাই সার হতো।

§ রাসূল সা. এর নজর আমার উপর কিভাবে পড়ছে দেখার জন্য আঁড় চোখে তাকাতাম। অবস্থা ছিল এই যে, আমি যতক্ষণ নামায পড়তাম, ততক্ষণ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আমি যখন নামায শেষ করতাম, সাথে সাথে চোঁখ সরিয়ে নিতেন।

§ একদিন আমার চাচাত ভাই ও বন্ধু আবু কাতাদার নিকট গেলাম। তাকে সালাম দিলাম। তিনি আমার সালামে জবাব দিলেন না।

§ আমি বললামঃ হে আবু কাতাদাহ! আমি তোমাকে আল্লাহ কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, আমি কি আল্লাহ ও তার রাসূলকে ভালবাসি না?

§ সে কোন জবাব দিলনা। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম। সে নিরব রইল। তৃতীয় বার জিজ্ঞেস করলাম। সে তখন শুধু বললো, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন।

§ আমার চোঁখে পানি এসে গেল। আমি তার থেকে চলে গেলাম।

কাফেরদের লোভনীয় প্রস্তাবঃ

§ একদিন বাজারে যাচ্ছিলাম। সিরিয়ার নবতী বংশের এক লোকের সাথে দেখা। সে গাস্সান রাজার একটি চিঠি আমাকে দিল। আমি চিঠিটি পড়লাম। যাতে লিখা রয়েছে “আমরা শুনেছি, তোমার নেতা তোমার উপর উৎপীড়ন করছে। তুমি কোন নগন্য ব্যক্তি নও। তোমাকে ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। আমাদের কাছে চলে এসো। আমরা তোমাকে মর্যাদা দান করবো।

§ আমি ভাবলাম এতো আরেক আপদ। আমি সাথে সাথে চিঠি খানা চুলোর আগুনে ফেলে দিলাম।

৪০দিন পরঃ

§ এভাবে ৪০দিন কেটে গেল।

§ রাসূল সা. এর নিকট থেকে দূত আরো কঠোর নির্দেশ নিয়ে এলো।

§ নিজের স্ত্রী থেকে আলাদা হয়ে যাও।

§ আমি জিজ্ঞেস করলামঃ তাকে কি তালাক দিয়ে দেবো? জবাব এলো, না তালাক নয়। শুধু আলাদা থাকো আমি আমার স্ত্রীকে তার বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিলাম। আল্লাহ সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললাম।

৫০তম দিবসেঃ

§ ৫০তম দিবসে ঘরের ছাদে বসেছিলাম।

§ নিজের জীবনের প্রতি ধিক্কার জাগছিল।

§ হঠাৎ এক ব্যক্তি চেঁচিয়ে উঠলোঃ কাব ইবনে মালিক, তোমাকে অভিনন্দন।

§ একথা শুনেই আমি সেজদায় নত হয়ে গেলাম। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম, আমার ক্ষমার ঘোষনা জারি হয়ে গেছে।

§ লোকেরা দলে দলে ছুটে আসতে লাগলো। সবাই আমাকে মোবারকবাদ দিচ্ছে। তারা বললো, তোমার তাওবা কবুল হয়েছে।

অতঃপরঃ

§ আমি সোজা মসজিদে নবীর দিকে গেলাম। দেখলাম নবী সা. এর চেহারা আনন্দে উজ্জল।

§ আমি সালাম দিলাম। তিনি বললেন, তোমাকে মোবারকবাদ।  আজকের দিনটি তোমার জীবনের সর্বোত্তম দিন।

§ আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ ক্ষমা কি আপনার পক্ষ থেকে, না আল্লাহর পক্ষ থেকে। তিনি বললেন, আল্লাহ পক্ষ থেকে আর শুনিয়ে দিলেন সেই আয়াতঃ

﴿وَعَلَى الثَّلاَثَةِ الَّذِينَ خُلِّفُواْ حَتَّى إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنفُسُهُمْ وَظَنُّواْ أَن لاَّ مَلْجَأَ مِنَ اللّهِ إِلاَّ إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوبُواْ إِنَّ اللّهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ﴾

আর যে ৩জনের ব্যাপার মুলতবি করে দেয়া হয়েছিল, তাদেরকে তিনি মাফ করে দিয়েছেন। পৃথিবী তার সমগ্র ব্যাপকতা সত্ত্বেও যখন তাদের জন্য সংকির্ণ হয়ে গেল, তাদের নিজেরদের প্রাণও তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাড়ালো এবং তারা জেনে নিল যে, আল্লাহর হাত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর নিজের রহমতের আশ্রয় ছাড়া আর কোন আশ্রয় স্থল নেই। তখন আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের দিকে ফিরলেন যাতে তারা তাঁর দিকে ফিরে আসে। অবশ্যই আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুনাময়।” (আত তাওবাঃ ১১৮)

§ আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল। আমার সমস্ত ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে সাদাকাহ করে দিতে চাই। এটা আমার তাওবার অংশ বিশেষ।

§ রাসূল সা. বললেন, কিছু রেখে দাও, এটা তোমার জন্য ভাল।

§ রাসূলের কথা অনুযাী আমার খয়বরের সম্পত্তিটা রেখে বাকী সব সাদাকাহ করে দিলাম।

§ আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করলাম, যে সত্য কথা বলার কারণে আল্লাহ আমাকে মাফ করে দিয়েছেন, সেই সত্যের উপর সারা জীবন প্রতিষ্ঠিত থাকবো।

§ কাজেই আজ পর্যন্ত আমি জেনে বুঝে যথার্থ সত্য ও প্রকৃত ঘটনা বিরোধী কোন কথা বলিনি। আশা আল্লাহ আগামীতেও আমাকে বাঁচাবেন।

তাবুকের অভিযানে যে সুদূর প্রবাসী ফয়দা হলো, তাহলোঃ

1.   আরবদের মধ্যে যারা আরবদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতো, তারা রোমানদের মোকাবেলায় ইসলামের সহযোগী হয়ে গেল

2.  ইসলাম সমগ্র আরবে নিজের নিয়ন্ত্রন ও বাঁধন মজবুত করে নিল

3.  এতদিন যারা মুশরিকদের সাহায্য করছিল মুসলমানদের দলে থেকে, সেই সব মুনাফিকদের কোমর ভেঙে গেল। ফলে তারা হতাশ হয়ে ইসলামের কোলে আশ্রয় নিল

4.  এরপর একটি নামমাত্র গোষ্ঠী শিরক ও জাহেলী কার্যক্রমে অবিচল থাকলো।

ব্যাখ্যাঃ

﴿بَرَاءَةٌ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى الَّذِينَ عَاهَدتُّم مِّنَ الْمُشْرِكِينَ﴾

 সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষনা করা হলো আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে, যেসব মুশরিকের সাথে তোমরা চুক্তি করেছিলে তাদের সাথে

بَرَاءَةٌ - সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষনা করা হলো

§ এই আয়াত ৯ম হিজরীতে তখন নাযিল হয়েছে, যখন নবী সা. সাইয়্যিদুনা আবু বকর রা. কে আমীরে হজ্জ নিযুক্ত করে সাহাবায়ে কিরামদের হজ্জের উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন হযরত আবু বকর রা. এর কাফেলা মদীনা থেকে রওয়ানা হবার পর তা নাযিল হয়

§ সাহাবায়ে কিরাম তখন নবী সা. কে পরামর্শ দেনঃ তিনি যেন মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের এই ঘোষনাটি যেন হযরত আবু বকর রা. এর নিকট পাঠিয়ে দেন যাতে তিনি হজ্জের সময় উপস্থিত লোকদের মাঝে ঘোষনাটি শুনিয়ে দেন

§ রাসূল সা. ঘোষণাটির গুরুত্ব উপলব্দি করে বলেনঃ এই ঘোষনাটি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, এটি আমার ঘরের একজন তা ঘোষণা করা উচিত তাই তিনি হযরত আলী রা. এই ঘোষনা প্রদানের জন্য নিযুক্ত করেন

§ হযরত আলী রা. কে নির্দেশ প্রদান করা হয় এই ঘোষণাটি যেন হাজীদের সাধারণ সমাবেশে শুনিয়ে দেয়া হয় এবং সাথে আরো ৪টি কথা ঘোষনা করা হয়ঃ

1.  দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করতে যারা অস্বীকার করবে, তাদের কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা

2. চলতি বছরের পর আর কোন মুশরিক হজ্জে আসতে পারবে না

3.   বাইতুল্লাহর চারদিকে উলংগ অবস্থায় তাওয়াফ করা নিষিদ্ধ

4.   যারা চূক্তি ভংগ করেনি, তাদের চূক্তি চূক্তির মেয়াদসীমা অবধি পূর্ণ করা হবে

§ হযরত আবু বকর রা. যে হজ্জের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়, তা ছিল মুসলমানদের দ্বিতীয় হজ্জ

-         মক্কা বিজয়ের পর প্রথম হজ্জ অনুষ্ঠিত হয় ৮ম হিজরীতে

-         ৮ম হিজরীর হজ্জ অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন পদ্ধতিতে

-         ৯ম হিজরীর এই হজ্জটি হয় মুসলমানরা নিজস্ব পদ্ধতিতে আর মুশরিকরা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে

-         ১০ম হিজরীতে হজ্জ অনু্ষ্ঠিত হয় খালেস ইসলামী পদ্ধতি

-         ১০ হিজরীতে ইসলামী পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হজ্জকে বলা হয় বিদায় হজ্জ

-         রাসূল সা. প্রথম দুই বছর হজ্জে যাননি  তৃতীয় বছর হজ্জ আদায় করেন শিরক সম্পূর্ণরূপে বিদায় নেয়ার পর

بَرَاءَةٌ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِসম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষনা করা হলো আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে

§ তিনটি কারণ ছাড়া চূক্তি লংঘন করা জায়েজ নয়

. যাদের সাথে চূক্তি করা হয়েছে, তাদের পক্ষ থেকে চূক্তির শর্ত খেয়ানতের লক্ষণ দেখা দিলে এবং যদি মনে করা হয় যে, তারা চূক্তি ভংগ করতে যাচ্ছে যেমনঃ সূরা আল আনফালে বলা হয়েছেঃ

﴿وَإِمَّا تَخَافَنَّ مِن قَوْمٍ خِيَانَةً فَانبِذْ إِلَيْهِمْ عَلَىٰ سَوَاءٍ﴾

আর যদি কখনো কোন জাতির পক্ষ থেকে তোমাদের খেয়ানত আশংকা থাকে তাহলে তার চুক্তি প্রকাশ্যে তার সামনে ছুড়ে দাও (আল আনফালঃ ৫৮)

﴿الَّذِينَ عَاهَدتَّ مِنْهُمْ ثُمَّ يَنقُضُونَ عَهْدَهُمْ فِي كُلِّ مَرَّةٍ﴾

বিশেষ করে তাদের মধ্যে থেকে এমন সব লোক যাদের সাথে তুমি চুক্তি করছো তারপর তারা প্রত্যেকবার তা ভংগ করে এবং একটুও আল্লাহর ভয় করে না(আল আনফালঃ ৫৬)

২. যদি চূক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়ঃ

مَنْ كَانَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ قَوْمٍ عَهْدٌ فَلَا يَحُلَّنَّ عُقْدَةً حَتَّى يَنْقَضِيَ أَمَدُهَا أَوْ يَنْبِذَ إِلَيْهِمْ عَلَى سَوَاءٍ

কোন জারিত সাথে কারোর কোন চূক্তি থাকলে চূক্তির মেয়াদ শেষ হবার আগে তার চূক্তি লংঘন করা উচিত নয়। এক পক্ষ চূক্তি ভংগ করলে উভয় পক্ষের সমতার ভিত্তিতে অপর পক্ষ চূক্তি বাতিল করার কথা জানাতে পারে। (আবু দাউদ ও তিরমিযি)

لا تَخُنْ من خانَك

যে ব্যক্তি তোমার সাথে খেয়ানত বিশ্বাসঘাতকতা করে তুমি তার সাথে খেয়ানত করো না (আবু দাউদ)

. দ্বিতীয় পক্ষ যদি কোন ঘোষনা ছাড়াই চূক্তি ভংগ করেঃ

যেমনঃ বনী খুযাআর ঘটনা-যারা হুদায়বিয়ার সন্ধি চূক্তি ভংগ করে রাসূল সা. তখন কোন ঘোষনা ছাড়াই আক্রমন করেন

الَّذِينَ عَاهَدتُّم مِّنَ الْمُشْرِكِينَ - যেসব মুশরিকের সাথে তোমরা চুক্তি করেছিলে তাদের সাথে

§ সূরা আল আনফালের ৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ

﴿وَإِمَّا تَخَافَنَّ مِن قَوْمٍ خِيَانَةً فَانبِذْ إِلَيْهِمْ عَلَىٰ سَوَاءٍ﴾

আর যদি কখনো কোন জাতির পক্ষ থেকে তোমাদের খেয়ানত আশংকা থাকে তাহলে তার চুক্তি প্রকাশ্যে তার সামনে ছুড়ে দাও  

অর্থাৎ কোন জাতির পক্ষ থেকে যখন তোমাদের খেয়ানত করার তথা অঙ্গীকার ভংগ ও বিশ্বাসঘাতকতা করার আশংকা দেখা দেয় তখন প্রকাশ্যে তার চুক্তি মুখের ওপর ছুঁড়ে দাও এবং তাকে এ মর্মে সতর্ক করে দাও যে, এখন তোমাদের সাথে আমাদের আর কোন চুক্তি নেই

§ চূক্তি ভংগের ঘোষনা না দিয়ে চূক্তিবদ্ধ কোন জাতির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করা ইসলামী শরীয়াতে বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর

§ উপরোক্ত চূক্তিভংগের ঘোষনা কেবল তাদের জন্য যারাঃ

. চূক্তিবন্ধ হওয়ার পর ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছিল

. অপেক্ষায় ছিল অঙ্গিকার বা চূক্তি ভংগ করে শত্রুতার সুযোগের

. যারা ছিল না তারা হলোঃ কিনানাহ গোত্র, বনী দ্বামরাহ গোত্র এবং ছোটখাটো আরো দুই একটি গোত্র

§ এই ঘোষনার মাধ্যমেঃ

. আরবে শিরক ও মুশরিক আইন বিরোধী হয়ে গেল

. তখন আরবের বেশীর ভাগ এলাকা ইসলামী শাসনের আওতাধীনে চলে যাওয়ার মুশরিকদের কোন আশ্রয়স্থল রইল না

§ রোম ও পারস্য তখন ইসলামী হুকুমাতের অধীনে আসেনি বিধায় মুশরিকরা আশায় ছিলঃ

. রোম ও পারস্য কখন ইসলামী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে

. আল্লাহর রাসূল সা. কখন ইনতিকাল করেন

§ তারা আশায় ছিল, উপরোক্ত দুই কারণের কোন একটি ঘটলে তারা আকস্মিক ভাবে চূক্তি ভংগ করে দেশে গ্রহযুদ্ধ শুরু করবে

§ তারা আশায় আশায় দিন অতিবাহিক করার সময়ই আল্লাহ তাদের পরিকল্পনার ছককে উল্টে দিলেন এমতাবস্থায় তাদের সা. তিনটি পথ খোলা থাকলোঃ

. তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবে এর তখনকার অবস্থা ছিল ইসলামী শক্তির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া মানে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া

. তাদেরকে দেশান্তর হতে হবে

. তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার অধীনে নিজেকে এবং নিজেদের এলাকাকে ন্যস্ত করে দিতে হবে

§ এই ঘটনার মাত্র দেড় বছর পর রাসূল সা. যখন ইনতেকাল করলেন, তখন আমরা দেখি এই সময়ে চূক্তি ভংগের ঘোষনা কতটুকু যথার্থ ছিল রাসূল সা. এর ইনতিকালের পরপরঃ

. আরবের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্রোহ ও গোলযোগ শুরু হয়

. হযরত আবু বকর রা. এর শাসনামলে মুরতাদ হওয়ার হিড়িক লাগে

যদি মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের এই ঘোষনা আগে প্রদান না করা হতো, তাহলে সেই সময় বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধ দশগুণ বেশী দেখা যেতো

﴿فَسِيحُوا فِي الْأَرْضِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ ۙ وَأَنَّ اللَّهَ مُخْزِي الْكَافِرِينَ﴾

 কাজেই তোমরা দেশের মধ্যে আরো চার মাসকাল চলাফেরা করে নাও এবং জেনে রেখো তোমরা আল্লাহকে অক্ষম ও শক্তিহীন করতে পারবে না আর আল্লাহ সত্য অস্বীকারকারীদের অবশ্যই লাঞ্ছিত করবেন  

فَسِيحُوا فِي الْأَرْضِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ - কাজেই তোমরা দেশের মধ্যে আরো চার মাসকাল চলাফেরা করে নাও

§ যেহেতু এই ঘোষনাটি ৯ম হিজরীতে হজ্জের সাধারণ সমাবেশে প্রদান করা হয়েছে, সেহেতু তা হবে আরাফাতের দিবস তথা ৯ই জিলহজ্ব আর যদি ইয়াওমুননাহার বিবেচনা করা হয়, তাহলে ১০ই জিলহজ্ব

§ কাফেরদেরকে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার জন্য ৪ মাস সময় দেয়া হয়, মানে ১০ হিজরীর ৯ বা ১০ রবিউস সানী যাতে তারাঃ

. যুদ্ধ করতে চাইলে প্রস্তুতি নিতে পারে

. দেশ ত্যাগ করতে চাইলে ভাল আশ্রয়স্থল খুঁজে নিতে পারে

. ইসলাম গ্রহণ করতে চাইলে স্থির মস্তিস্কে ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে গ্রহণ করতে পারে

﴿وَأَذَانٌ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ أَنَّ اللَّهَ بَرِيءٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ ۙ وَرَسُولُهُ ۚ فَإِن تُبْتُمْ فَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ وَإِن تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ ۗ وَبَشِّرِ الَّذِينَ كَفَرُوا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ﴾

 আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে বড় হজ্জের দিনে সমস্ত মানুষের প্রতি সাধারন ঘোষণা করা হচ্ছেঃ “আল্লাহর মুশরিকদের থেকে দায়িত্বমুক্ত এবং তাঁর রসূলও এখন যদি তোমরা তাওবা করে নাও তাহলে তো তোমাদেরই জন্য ভাল আর যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে খুব ভাল করেই বুঝে নাও, তোমরা আল্লাহকে শক্তি সামর্থহীন করতে পারবে না আর হে নবী! অস্বীকারকারীদের কঠিন আযাবের সুখবর দিয়ে দাও

وَأَذَانٌ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ - আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে বড় হজ্জের দিনে

§ দিনটি ১০ই যিলহাজ্জ

§ দিনটিকে ইয়াওমুন নাহর বা যবেহ করার দিন বলা হয়

§ হাদীসঃ

عن ابن عمر أن رسول الله صلى الله عليه وسلم وقف يوم النحر بين الجمرات في الحجة التي حج فقال أي يوم هذا قالوا يوم النحر قال هذا يوم الحج الأكبر

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বির্ণত আল্লাহর রাসূল সা. হজ্জের সময় ইয়াওমুন নাহার এর দিনে জামারাতে কাছে দাড়ালেন এবং জিজ্ঞেস করলেনঃ আজ কোন দিন? সকলে বললোঃ ইয়াওমুন নাহার তিনি বললেনঃ هذا يوم الحج الأكبر আজ হচ্ছে হজ্জে আকবার বা বড় হজ্জের দিন

§ আরববাসী উমরাহকে ছোট হজ্জ বলে থাকে সেই শব্দের বিপরীতে তথা উমরার পরিবর্তে বড় হজ্জ শব্দাবলী ব্যবহার করা হয়েছে

﴿إِلَّا الَّذِينَ عَاهَدتُّم مِّنَ الْمُشْرِكِينَ ثُمَّ لَمْ يَنقُصُوكُمْ شَيْئًا وَلَمْ يُظَاهِرُوا عَلَيْكُمْ أَحَدًا فَأَتِمُّوا إِلَيْهِمْ عَهْدَهُمْ إِلَىٰ مُدَّتِهِمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ﴾

তবে যেসব মুশরিকের সাথে তোমরা চুক্তি করেছো তারপর তারা তোমাদের সাথে নিজেদের চুক্তি রক্ষায় কোন ক্রুটি করেনি আর তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্যও করেনি তাদের ছাড়া এ ধরনের লোকদের সাথে তোমরাও নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পালন করবে কারণ আল্লাহ তাকওয়া তথা সংযম অবলম্বকারীদেরকে পছন্দ করেন

إِلَّا الَّذِينَ عَاهَدتُّم مِّنَ الْمُشْرِكِينَ ثُمَّ لَمْ يَنقُصُوكُمْ شَيْئًا وَلَمْ يُظَاهِرُوا عَلَيْكُمْ أَحَدًا فَأَتِمُّوا إِلَيْهِمْ عَهْدَهُمْ إِلَىٰ مُدَّتِهِمْ   - তবে যেসব মুশরিকের সাথে তোমরা চুক্তি করেছো তারপর তারা তোমাদের সাথে নিজেদের চুক্তি রক্ষায় কোন ক্রুটি করেনি আর তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্যও করেনি তাদের ছাড়া এ ধরনের লোকদের সাথে তোমরাও নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পালন করবে

§ কেহ কেহ বলেন, এই চূক্তির কোন মেয়াদ ছিলনা বা এই ঘোষনাকালীন সময়ের চেয়ে ৪মাস কম ছিল

§ এই বক্তব্যের মাধ্যমে যাদের সাথে চূক্তির মেয়াদ বাকী ছিল, তারা বাদ পড়ে যায়

إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ  - আল্লাহ তাকওয়া তথা সংযম অবলম্বকারীদেরকে পছন্দ করেন

§ যারা চূক্তি ভাঙনি, তাদের সাথে চুক্তি ভংগ করা তাকওয়া বিরোধী

§ আল্লাহর কাছে এমন সব কাজ পছন্দনীয় প্রিয়-যা তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত

﴿فَإِذَا انسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدتُّمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ ۚ فَإِن تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾

 অতএব, হারাম মাসগুলো অতিবাহিত হয়ে গেলে মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা করো এবং তাদের ধরো, ঘেরাও করো এবং প্রত্যেক ঘাঁটতি তাদের জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাকো তারপর যদি তারা তাওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তাহলে তাদের ছেড়ে দাও আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়  

فَإِذَا انسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ - অতএব, হারাম মাসগুলো অতিবাহিত হয়ে গেলে 

§ হারাম মাস বলতে হজ্জ বা উমরাহ করার জন্য যে মাসগুলোকে হারাম গন্য করা হয়েছে

§ এখানে বর্ণিত হারাম মাস সে গুলো নয় বরং মুশরিকদের যে চার মাসের অবকাশ দেয়া হয়েছে, তার কথা বলা হয়েছে

§ যুদ্ধ বিরতি বা অবকাশকালীন সময়ে আক্রমন জায়েজ নয় বিধায় হারাম বলা হয়েছে

فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدتُّمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ- মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা করো এবং তাদের ধরো, ঘেরাও করো এবং প্রত্যেক ঘাঁটতি তাদের জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাকো

§ حَيْثُ وَجَدتُّمُوهُمْ এটি একটি সাধারণ নির্দেশ। কিন্তু আল্লাহর প্রসিদ্ধ নির্দেশ হলোঃ হারাম শরীফে যুদ্ধ চলতে পারে না। যেমন আল্লাহ বলেনঃ

﴿وَلَا تُقَاتِلُوهُمْ عِندَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ حَتَّىٰ يُقَاتِلُوكُمْ فِيهِ ۖ فَإِن قَاتَلُوكُمْ فَاقْتُلُوهُمْ﴾

আর মসজিদে হারামের কাছে যতক্ষণ তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ না করে, তোমরাও যুদ্ধ করো না কিন্তু যদি তারা সেখানে যুদ্ধ করতে সংকোচবোধ না করে, তাহলে তোমরাও নিসংকোচে তাদেরকে হত্যা করো (আল বাকারাহঃ ১৯১)

§ এই আয়াতের মাধ্যমে মসজিদে হারামের ব্যাপারে যে বাধ্যবাধতা ছিল, তা উঠিয়ে দিয়ে বলা হলোঃ

-         তোমরা ইচ্ছা করলে তাদের হত্যা করতে পারো

-         তাদেরকে বন্দী করতে পারো

-         তাদের দূর্গ অবরোধ করতে পারো

-         তাদের ঘাটিতে ওঁত পেতে বসে থাকতে পারো

-         তাদেরকে সামনে পেলে মেরে ফেলতে পারো

-         অর্থাৎ আক্রমন, পথরোধ এবং যুদ্ধ সকল ধরণের অনুমিত প্রদান করা হচ্ছে

فَإِن تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ - তারপর যদি তারা তাওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তাহলে তাদের ছেড়ে দাও 

§ কুফরী শিরক থেকে নিছক তাওবাই এর সমাধান নয় বরং সত্যিকার মুমিন হওয়ার জন্য প্রেকটিস চালু করতে হবে আর তা হলো নামাযা কায়েম করা যাকাত দেয়া

§ কুফুরী শিরক ত্যাগের প্রমাণ হলো নামায যাকাত

§ হযরত আবু বকর রা. তার সময়ে মুরতাদ ফিতনায় তথা যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এই আয়াত থেকে যুক্তি নিয়ে

§ হযরত আবু বকরের সময় কিছমানুষ ইসলামকে স্বীকার করে, নামায পড়ে কিন্তু যাকাত দেবেনা বলে সাহাবায়ে কিরাম বিব্রত ছিলেন, কিভাবে তাদের উপর তরবারী উঠাবেন হযরত আবু বকর তখন এই আয়াত বরাত হিসাবে পেশ করেন বলেনঃ যারা কেবল ৩টি শর্ত পুরণ করবে, তারাই মুক্তি পাবে তথাঃ

. শিরক থেকে তাওবা করা

. নামায কায়েম করা

, যাকাত দেওয়া

§ ইবনে উমরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেনঃ আমি আদিষ্ট হয়েছি যে, আমি লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবো যে যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয়ে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই এবং মুহাম্মদ সা. আল্লাহর রাসূল আর সালাত কায়েম করে যাকাত দেয় (বুখারী মুসলিম)

§ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেনঃ সালাত কায়েম করা যাকাত আদায় করার জন্য তোমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিধায়, যে যাকাত দেবে না, তার সালাতও হবে না

§ আব্দুর রাহমান ইবনে সায়েদ ইবনে আসলাম রাহ. বলেনঃ আল্লাহ কারো সালাত কখনো কবুল করবেন না, যতক্ষণ না সে যাকাত প্রদান করে আল্লাহ হযরত আবু বকর রা. এর প্রতি রহম করুন, তিনি সবচেয়ে জ্ঞানী ছিলেন

§ হযরত আলী ইবনে আবি তালিব রা. বলেনঃ আল্লাহ স্বীয় নবী সা.কে চারটি তরবারীসহ পাঠিয়েছেন

. প্রথম তরবারী আরবের মুশরিকদের জন্যঃ

﴿فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدتُّمُوهُمْ﴾

মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা করো (আত তাওবাঃ )

. দ্বিতীয় তরবারী হলে আহলে কিতাবের সাথে যুদ্ধের জন্যঃ

﴿قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حَتَّىٰ يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَن يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ﴾

আহলি কিতাবদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহ ও পরকালের ঈমান আনে না যা কিছু আল্লাহ ও তার রসূল গণ্য করেছেন তাকে হারাম করো না এবং সত্য দীনকে নিজেদের দীনে পরিণত করে না, তাদের সাথে যুদ্ধ করো যে পর্যন্ত না তারা নিজের হাতে জিযিয়া দেয় ও পদানত হয়ে থাকে (আত তাওবাঃ  ২৯)

. তৃতীয় তরবারী হলো মুনাফিকদের সাথে যুদ্ধের ব্যাপারেঃ

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ ۚ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ ۖ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ﴾

হে নবী! পূর্ণ শক্তি দিয়ে কাফের ও মুনাফিক উভয়ের মোকাবিল করো এবং তাদের প্রতি কঠোর হও শেষ পর্যন্ত তাদের আবাস হবে জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট অবস্থান স্থল (আত তাওবাঃ ৭৩

. চতূর্থ তরবারী হলো বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধের জন্যঃ

﴿وَإِن طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ۖ فَإِن بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيءَ إِلَىٰ أَمْرِ اللَّهِ ۚ فَإِن فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا ۖ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ﴾

ঈমানদারদের মধ্যকার দু’টি দল যদি পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও তারপরও যদি দু’টি দলের কোন একটি অপরটির বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করে তবে যে দল বাড়াবাড়ি করে তার বিরুদ্ধে লড়াই করো যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে এরপর যদি তারা ফিরে আসে তাহলে তাদের মাঝে ন্যায় বিচারের সাথে মীমাংসা করিয়ে দাও এবং ইনসাফ করো আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন (আল হুজুরাতঃ ৯)

§ মুফাস্সির যহহাক রাহ. সুদ্দী রাহ. বলেছেনঃ তরবারীর এই আয়াতটি সূরা মুহাম্মদের নম্বর আয়াত (فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاءً- অতঃপর হয় অনুগ্রহ করে ছেড়ে দাও বা ফিদইয়া নিয়ে ছেড়ে দাও) দ্বারা রহিত বা মানসুখ হয়ে গেছে আর মুফাস্সির কাতাদাহ রাহি. এর বিপরীত মত পেশ করেছেন

﴿وَإِنْ أَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّىٰ يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَّا يَعْلَمُونَ﴾

 আর যদি মুশরিকদের কোন ব্যক্তি আশ্রয় প্রার্থনা করে তোমার কাছে আসতে চায় (যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পারে) তাহলে তাকে আল্লাহর কালাম শোনা পর্যন্ত আশ্রয় দাওতারপর তাকে তার নিরাপদ জায়গায় পৌছিয়ে দাও এরা অজ্ঞ বলেই এটা করা উচিত  

وَإِنْ أَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّىٰ يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ - আর যদি মুশরিকদের কোন ব্যক্তি আশ্রয় প্রার্থনা করে তোমার কাছে আসতে চায় (যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পারে) তাহলে তাকে আল্লাহর কালাম শোনা পর্যন্ত আশ্রয় দাও

§ আমি ইসলামকে জানতে চাই, বুঝতে চাই-এমন লোকদের যুদ্ধ চলাকালীন সময়েও নিরাপত্তা দিয়ে নিজের কাছ আনা ও ইসলাম বুঝানো উচিত

§ যদি বুঝানোর পর ইসলাম গ্রহণ না করে, তাহলে এমন ব্যক্তিদের নিরাপত্তার সাথে তাদের আবাসস্থলে পৌছে দেয়া উচিত

§ নিরাপত্তা নিয়ে যারা ইসলামী রাষ্ট্রে বা দারুল ইসলামে আসে, ইসলামী ফিকহ তাদেরকেমুস্তায়িনবলে মুস্তায়িন মানে নিরাপত্তা প্রার্থী

উপসংহারঃ

 



Post a Comment

0 Comments