পর্ব-০১
ফেইসবুকের আমার ফলোয়ার এবং ফ্রেন্ডসরা সকলেই জানেন যে, আমি ৯ তারিখ
রাতে সংক্ষিপ্ত বাংলাদেশ সফর শেষে কাতার পৌছলাম। সেই সফরে আমার এক পুরাতন বন্ধুর (৪র্থ শ্রেণীর ক্লাশমেট) ভিমরি খাওয়া এক প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম।
তিনি বলেলেনঃ “আমার
বাবা! আমি জানি, তিনি জন্মসূত্রে আমার অতিশ্রদ্ধা ও
সম্মানের পাত্র। ইসলামী শরীয়াতের সুত্রে তার হক আমার উপরে মায়ের পরই। সামাজিক ভাবে
আমি তার সম্মান শ্রদ্ধা প্রদর্শনে
যেমন বাধ্য, তেমনি তার এই বৃদ্ধ বয়সে তার সকল প্রয়োজন পুরণ ও খেদমত করতে বাধ্য।
আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আমি তা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।
জন্মের পর আমার বুঝতে শেখার বয়স পর্যন্ত আমার বাবা আমাকে কতটুকু আদর করেছেন, তা আমার জানা নেই। কিন্তু বুঝতে শেখার পর থেকে আমি আমার বাবার হিংসার শিকার হয়ে বড় হয়েছি। প্রাইমারীর দরজা পেরুতে না পেরুতেই বাবা আমাকে
বাড়ী থেকে বের করে দিলেন প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে এক
লজিং বাড়ীতে। লজিং মাষ্টার আমার বাবার পরিচিত জনও বটে।
চোঁখের জলে বুক ভাসিয়ে সেদিন বেড বিছানা সহ আমি লজিং বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের পরিবারে খাবার দাবারের কোন অভাব না থাকলেও আমাকে
ডাল শুটকি আর সবজি খেয়ে বড় হতে হয়েছে। ছুটির এই দিনটা
বাবার চোঁখ থেকে দূরে থাকতাম। ভয় ছিল কখন বাবার চোঁখে
পড়ি আর তিনি প্রশ্ন করেন, কেন বাড়ীতে এসেছি। পড়ালেখার সাড়ে ১২টা বাজানোর
জন্য বাড়ীতে এসেছি নাকি।
বাবার চরম শাসনের কারণে ফুটবল, বলিবল, বিডমিন্টন, কবাডি ইত্যাদি খেলা কেবল দেখেই
তৃপ্ত থেকেছি, কখনো খেলা হয়নি। শিশু অধিকারের ১ ভাগও আমার
জীবনে ভোগ করার সুযোগ হয়নি।
আমি যে লজিং বাড়ীতে থাকতাম, তিনি আমার সকল
প্রয়োজন পুরণ করেছেন। যদিও পুরণ করার জন্য আমার বাবার
পক্ষ থেকে কোন তাগাদা ছিলনা। তিনি যখনই আমার প্রতি কোন
করুণা করেছেন, তখন আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, আমার বাবা খুব ভাল মানুষ-তাই তিনি
আমার প্রতি এ সদয় আচরণ করছেন।
লজিং বাড়ীর মা (লজিং বাড়ীর বাবার স্ত্রী) আমাকে পুত্র স্নেহ প্রদান করেছেন সব সময়। তিনি আমার মাঝে তার মৃত
সন্তানের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতেন। তারা গরীব ছিলেন বলে
প্রতিদিন মাছ মাংস ব্যবস্থা করার মতো অবস্থা ছিল না।
কিন্তু যখনই ভাল কোন খাবার বাড়ীতে আসতো, তখন সবচেয়ে ভাল অংশটা আমাকে প্রদান করতেন।
দেখতে দেখতে তাদের আর্থিক অবস্থাটা ভাল হয়ে গেলে। তারা তখন আমাকে আর্থিক সহযোগিতাও করতে থাকলেন। আমার সব
প্রয়োজন পুরণ করলেন। আমাকে ভাল ভাল খাবার পরিবেশন
করলেন। নিজের ছেলেকে যা আদর করার দরকার, তার সব করলেন।বাড়ী থেকে দূরে থাকার কারণে যে মাতৃস্নেহ থেকে আমি বঞ্চিত ছিলাম, তার সবটুকু আমি লজিং বাড়ীর মা থেকে পেলাম। আর লজিং বাড়ীর বাবা সব সময় সে সব বিষয়ে খবর
নিলেন। রাতে খাবার খেতে বসে আমি খেয়েছি কি না, আমাকে মাছের মাথা দেয়া হয়েছে কিনা, স্কুলে যাওয়ার সময় আমাকে দুধের গ্লাস দেয়া হয়েছে কিনা, রাতে আগে আগে ঘুমিয়ে পড়লে অসুখ করেছে কিনা, চলা ফেরায় পকেট খরচের টাকার দরকার
আছে কিনা, দীর্ঘদিন হতে বাড়ী যাই নাই-বাড়ী যাওয়া
দরকার-ইত্যাদি সকল বিষয়ে লজিং এর বাবা খবর নিতেন।
ঈদের
সময়ে বাড়ীতে গিয়ে এক ঈদে জামা (যা আমার বাবা আমার পছন্দ ছাড়াই নিয়ে আসতেন) পেলেও অন্য ঈদে জামার ব্যবস্থা হতো না। সেখানে লজিং বাড়ীর
বাবা তার সন্তানদের সাথে সাথে আমার জন্য জামার ব্যবস্থা
করে রাখতেন।
আমার
বাবা আমাকে সব সময় দৌড়ের উপর রাখতেন।
আমার বাবা থেকে আমি কোন দিন সুখ এবং আদর নামক বস্তুটার স্পর্শ পাইনি। সেখানে লজিং এর বাবা আমাকে সব ধরণের সুখ দিয়ে আদরে বড় করেছেন। অধিকার বলতে
যা বুঝায় তার ১ ভাগও আমি আমার বাবা থেকে পাইনি। কিন্তু
লজিং এর বাবার আদর পেয়েছি শত ভাগ। এমন অবস্থায় সময়ের
প্রয়োজনে আমি অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাই। লজিং বাড়ীর বাবা আমার সার্বক্ষনিক খবর নিয়েছেন। এই এবং সেই খবর নিয়েছেন দীর্ঘ ৬ বছর। এর
মাঝে আমার বাবা আমাকে শুধু হিংসুটে ব্যবহার ছাড়া কিছুই
দেননি। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমার প্রয়োজনীয় অর্থের
দাবীতে যখন আবদার করেছি, তখন বিদ্রুপাত্মক চোঁখ রাঙানীর সাথে
সাথে প্রয়োজনের ১০ ভাগ সহযোগিতা পেয়েছি। টিউশনী করেও
আমার প্রয়োজন মিটেনি। পুরাতন লজিং বাড়ীর বাবা আমার ৫০
ভাগ প্রয়োজন পুরণ করেছেন।
পড়ালেখা শেষ করে আমি যখন বেকার অবস্থায় চাকুরীর সন্ধানে বাড়ীতে অবস্থান করছি, তখন আমার বাবা প্রতিদিনকার বিরক্তিকর লেকচার শুনতে শুনতে বিষিয়ে উঠেছি। মাত্র ১মাসের বেকার জীবনের মাথায় তিনি বলেছেনঃ আমি পড়ালেখা
বেকার করেছি। আসলে আমি কোন পড়ালেখা করিইনি। নাহলে ১মাস
চলে গেলো, চাকুরী কেন হয়না? আমি আর কতদিন বাবার হোটেলে অবস্থান
করবো? লেখাপড়া
করিয়ে বড় করেছেন, এখন আর উনার কোন দায়িত্ব নাই। নিজের খাবারের
ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে।
পড়ালেখা শেষে নিজ বাড়ীটা আমার কাছে যখন এক কারাগার, তখন লজিং বাড়ীর বাবা আমাকে তলব পাঠালেন। কি করছি না করছি ইত্যাদি জানলেন। একটা ভাল
চাকুরীর সন্ধান দিলেন এবং চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিলেন।
যার কারণে আমি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে আনন্দিত হয়ে
আমার বাবাকে খবরটা দিতেই তিনি বেতন কত জানতে চাইলেন। আমি বললাম ১৭০০ টাকা। বাবা তাচ্ছিল্যের সাথে এমন ভাবে বিষয়টা নিলেন যে, আমি রীতিমতো বিষিয়ে উঠলাম।
চলবে.................................
পর্ব-০২
প্রথম মাসের বেতন পেয়ে ৯০ টাকা কেজি দরে ২ কেজি মিষ্টি ক্রয় করে ১ কেজি নিয়ে গেলাম লজিং মাষ্টারের বাড়ীতে।
লজিং মাষ্টার কি যে খুশী হলেন, তা বুঝানো মুশকিল। আমাকে অনেক অনেক দোয়া দিলেন।
বললেনঃ এই ১৭শ টাকাই একদিন ১৭ হাজার হবে, এর পর তা ১লাখ ৭০ হাজার হবে। অতএব
মনোযোগের সাথে বেতন কত তা বিবেচনায় না নিয়ে কাজ করে
যেতে।
৯০ টাকা দরের আরেক কেজি মিষ্টি নিয়ে বাড়ীতে আসলাম। মা বিষম খুশী। বাবা বাড়ী আসলেন রাতের বেলা। মা তাকে মিষ্টি
দিলেন। আর আমি ১৭শ টাকা থেকে বেঁচে যাওয়া ১৫২০ টাকা
বাবার হাতে উঠিয়ে দিলাম। তিনি টাকা গুনলেন। ১৭শ টাকা না
পেয়ে অগ্নিশর্মা হয়ে টাকা ছুড়ে ফেলে দিলেন। বাকী টাকা কোথায় জানতে চাইলে মিষ্টি কিনার কথা বললাম। তিনি লজিং বাড়ীতে মিষ্টি দেয়ার কথা
শুনে বললেনঃ ঐ বেটা তোমাকে জনম দিয়েছে। তাই তুমি সেখানে
মিষ্টি দিয়েছো। এই বলে তিনি রাগান্বিত হয়ে মিষ্টি না
খেয়ে চলে গেলেন। পরদিন ভোর সকালে মায়ের কাছ থেকে আমার দেয়া
১৫২০ টাকা চেয়ে নিয়ে বাড়ী ত্যাগ করলেন।
লজিং বাড়ীতে আমি একটা মেয়েকে পড়াতাম। সে চতূর্থ শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। লজিং বাড়ীতে থাকা অবস্থায় সে প্রেম পিরীতি
বুঝার বয়স হয়নি এমন অবস্থা আমাকে তাদের বাড়ী ছাড়তে
হয়েছে। আমার ১৭শ টাকার চাকুরী ইতিমধ্যে ১৭ হাজারে
পৌছেছে। চলে গেছে অনেক দিন। উনার মেয়েটাও এখন বড় হয়েছে। একদিন লজিং বাড়ীর বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং তার পরমা সুন্দরী মেয়েটাকে আমার কাছে বিয়ে
দিতে চাইলেন। আমি বিষয়টা নিয়ে আমার বাবার সাথে কথা বলতে
বললাম। তিনি বাবার সাথে কথা বললেন। বাবা রাজী হয়ে
গেলেন। বাবা বাড়ীতে এসে উল্টো সুরে বললেনঃ লজিং বাড়ীতে পড়ার জন্য পাঠিয়ে ছিলাম, না পিরিতি
করতে পাঠিয়েছিলাম। অনেক বকাঝকা। বাবা চলে গেলেন। আমি মাকে বললামঃ যে মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কথা হচ্ছে, তাকে আমি ছোট্ট খুকি অবস্থায় দেখিছি। ওদের
বাড়ীতে আমি অনেক গিয়েছি। কিন্তু মেয়ে বড় হওয়ার পর তার সাথে আমার কোন সাক্ষাৎ পর্যন্ত হয়নি। কারণ মেয়ের বাবা একজন প্রচন্ড মৌলবাদী। ঐ মেয়ের
সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই এবং ছিলনা এবং আমি ঐ মেয়েকে
কখনো বিয়ে করবো না।
আমার বিয়ের বয়স হয়েছে। বিয়ের বয়স হয়েছে আমার পরমা সুন্দরী ছাত্রীর। এক সময় বাবা ঐ মেয়ের সাথে আমার বিয়ের আয়োজন করলেন আমার সাথে কোন ধরণের আলোচনা ব্যতিরেখে। আমার কাছে যখন খবর পৌছলো।
তখন আমি বেঁকে বসলাম। আমি ঐ মেয়েকে বিয়ে করবো না। লজিং
বাড়ীর বাবা আমাকে খবর পাঠালেন। আমি গেলাম। তিনি আমাকে
বিয়েতে সম্মত না হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললামঃ লোকে মনে করবে আমি প্রেম করে বিয়ে করেছি। যেহেতু এই ধরণের কিছু নাই, সেহেতু আমার জীবনে এই ধরণের তকমা লাগাতে চাইনা।
তিনি বিষয়টা খুব গুরুত্ব সহকারে নিলেন এবং তার মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিলেন। বাবার সাথে কোন ধরণের যোগাযোগ না করেই বিয়ে দিয়ে দিলেন।
দাওয়াত থাকলেও আমি সেই বিয়ের আসরে পরিকল্পিত ভাবে
অনুপস্থিত থাকলাম। বাবা এই বিয়ের খবর পেয়ে তড়িগড়ি করে
আমার বিয়ের আয়োজন করলেন। আমি কোন দিকে না তাকিয়ে বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে বাবার কাছে ভাল থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। যথা সময়ে বিয়ে হয়ে গেলো।
আমার সংসারটা অত্যন্ত বিষময় এক জাহান্নাম। আমি একজন মাষ্টার ডিগ্রীধারীর স্ত্রী ৫ম শ্রেণী পাশ করা
ফুটফুটে এক সুন্দরী। আমি যা আলোচনা করতে চাই, তো সে বুঝেনা। সে যে সব বিষয় আলোচনার বিষয় বস্তু নির্ধারণ করে, তা আমার জন্য সেকেলে এবং অপ্রয়োজনীয়
বলে মনে হয়। তাই তার সাথে আমার শারিরিক সম্পর্ক ছাড়া আর
কোন সম্পর্ক নাই।
আমার বাবা পরম সুখে আছেন। কারণ আমার স্ত্রী সারাদিন পরিবারের জন্য হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে বিনা প্রশ্নে। প্রতিদিন
ভোর ফজরে উঠে অজুর জন্য গরম পানি করে দেয়। প্রতি রাতে
বাবার মশারী টাঙ্গিয়ে দেয়। সারাদিন হাড়ভাংগা খাটুন
পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ে। আমি সারারাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে ফজরের পুর্বমুহুর্তে আমার ঘুম
আসে। তাই প্রতিদিন ফজর পড়তে পারিনা। আমি একজন বড় মাপের
কর্মকর্তা। আমার মাসিক ইনকাম এখন ২লক্ষ টাকার মতো। আমার
ইনকামের পুরোটাই আমি পরিবারের জন্য খরচ করি। বাবা অবশ্য জানেন না যে, আমি এতো বড়
অংক ইনকাম করি। তিনি মনে করেন, আমার পুরো ইনকামই তার কাছে জমা দিয়ে দেই।
কিন্তু ভালবাসা নামক জিনিসটা বাবার থেকে আমি এখনো পাইনি।
লজিং বাড়ীর বাবা এখনো আমার খোঁজ খবর নেন। ১মাস না দেখলে খবর দেন বা ফোন করেন। প্রচন্ড রকমের ভালবাসা দিয়ে
ভরিয়ে দেন আমাকে। যা আমি আমার বাবা থেকে পাইনি, তার ১৬ আনাই আমি আমার লজিং বাড়ীর বাবা থেকে পাই।”
“নজরুল ভাই, আপনি তো
দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ান। অনেক ধরণের সংস্কৃতির সাথে আপনার পরিচয়। এখন আমি অনেক টাকার মালিক। কিন্তু এর পিছনে আমার সেই ১৭শ টাকার চাকুরী। নজরুল ভাই আমি আমার জীবনে বাবার আদর বলতে আমার লজিং বাড়ীর বাবা থেকে পেয়েছি। এখন নজরুল
ভাই আপনিই বলুনঃ বাবাকে সম্মান দেয়া বনাম লজিং
মাস্টারকে সম্মান, আমি পরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি। বলুন আমি কাকে
সম্মাণ করবো? কার হক আমার প্রতি বেশী? কেবলমাত্র জন্ম দেয়া ছাড়া বাবা
আমাকে কিছুই দেয়নি। যা দিয়েছে, তার সবই আমার লজিং বাড়ীর বাবা। আমার জন্ম দাতা বাবা থেকে কিছুই পাইনি। এখন আমি কাকে সম্মান জানাবো? জন্ম দাতা বাবাকে না লজিং বাড়ীর
বাবাকে?” বিষয়টি
নিয়ে আমার বন্ধুকে কি পরামর্শ দিয়েছিলাম, তা এখানে শেয়ার করলাম। কে কি ভাবছেন?
চলবে.....................................
পর্ব-০৩
আমার ছোট্টকালের বন্ধুটি মনের গহীনে থাকা আকুতি গুলো আমাকে সীমাহীন ভারাক্রান্ত করলো। দীর্ঘ ১ যুগ তার সাথে
চলাফেরা। সে আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছে। আমরা তার অনুগত
কর্মী হিসাবে জীবন বাজি রেখে তার সাথে থেকেছি। সত্য ও
সুন্দরের পথে তার নেতৃত্বে মানুষদের আহবান করেছি। এখন অবশ্য সেই মিছিলে তাকে আর দেখা যায় না। তার হাসিমাখা মুখ খানা সব সময় আমার মানসপটে
ভাসে। মানুষকে কি ভাবে ভালবাসতে হয়, তা শিখেছি তার কাছ থেকে। অথচ তার মনের গহীনে এতো দূঃখ লুকিয়ে ঘুমরে কাঁদছে, তা কে জানে। তার প্রতি পরম মমতায় মন
ভরে উঠলো। কিন্তু তাকে কি বলে সান্তনা দেবো, তার ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছিনা।
আল্লাহর কাছে নিরবে প্রার্থনা করছি, হে মাবুদে আমার যবান দিয়ে এমন কিছু বের করে দাও, যা আমার বন্ধুটির সান্তনার কারণ হতে পারে।
আল্লাহর উপর ভরসা করে তার উদ্দেশ্যে আমি কথা শুরু করলাম। যার সারমর্ম নিম্নরূপঃ
১. যে কারো প্রতি সম্মাণ, স্নেহ বা ভালবাসা
এসব কোন দানের প্রতিদান হিসাবে নয়, নিজস্ব দায়িত্বানুভূতি থেকে করতে
হয়। কিছু পেয়েছি বলে কিছু দেবো এমন হওয়া যেমন উচিত নয়, কিছু পাইনি
বলে কিছু দেবো না এমনও হওয়া উচিত নয়।
২. জন্মসূত্রে বাবা শ্রদ্ধা, ভালবাসা এবং
অধিকার পাওয়ার অধিকারী। তা খন্ডন করার এখতিয়ার কোন
জন্মগ্রহণকারীর নাই।
৩. একজনকে ভালবাসতে হবে বলে অন্যজনকে বঞ্চিত করতে হবে, এই সরল অংক
ভূলে যেতে হয়। তাই বাবা এবং লজিং মাষ্টার দুইজনকেই একসাথে ভালবাসা যায়।
৪. বাবা তার সন্তানকে কতটুকু ভালবাসলেন
বা সন্তানের অধিকার কতটুকু আদায় করলেন, তার জবাবদিহি তিনি তার মালিক (রব)
এর কাছে প্রদান করবেন। তার সে দায়িত্ব সম্পর্কে বাবাকে
বাবার বন্ধুদের মাধ্যমে সচেতন করা উচিত। এজন্য ইসলামের পারিবারিক
জীবন বইটি তার বালিশের পাশে রাখা যেতে পারে। আপনার এলাকায় আপনি নেপথ্যে থেকে পিতা মাতা ও সন্তানের অধিকার বিষয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করুন। সেখানে
ভাল জ্ঞানী বক্তার ব্যবস্থা করুন। আপনার বাবার বন্ধুর
মাধ্যমে সে প্রোগ্রামে বাবার উপস্থিতি নিশ্চিত করুন।
আপনি পরিকল্পিত ভাবে সেই অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকুন।
৫. সন্তান বাবার হক কতটুকু আদায় করলো বা বাবাকে কতটুকু ভালবাসলো, সে সম্পর্কে সন্তানকে তার মালিকের
কাছে জবাবদিহি করতে হবে। বিধায় বাবা থেকে কতটুকু পেলাম
সে বিষয় মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বাবাকে ভালবাসতে হবে এবং সম্মাণ দিতে হবে।
৬. সকল বাবার শাসন পদ্ধতি একই ধরণের হয়না। বাবার শাসনের সমীকরণ সন্তানকে বুঝতে হবে এমন কোন নিয়ম নেই। বাবা
আপনাকে ভালবাসেন বলেই শিশু বয়সে ভাল একটা প্রতিষ্ঠানে
আপনাকে ভর্তি করে দিয়েছেন। যার কারণে সপ্তাহে ৬দিন আপনি
আপনার তথাকথিত বিরক্তিকর আচরণ থেকে বেঁচে গেছেন। যা আপনার অন্যান্য ভাইবোন সপ্তাহের ৭দিনই সহ্য করেছেন। আর সেই সুবাদে আপনি এখন ভাল
টাকা পয়সা রোজগার করছেন। আপনাকে এই কঠোর শাসন প্রদর্শন
না করলে হয়তো আপনি বাড়ীতে থাকতেন। কয়দিন বাবা বকাজকা
করে নিরব হয়ে যেতেন। আপনি পড়ালেখা শেষ অবধি করতে পারতেন না। হালের গরু নিয়ে মাঠে “রাখাল” ডিগ্রি ধারণ করতেন।
৭. আপনার লজিং এর বাবা আপনার বাবার কারণেই আপনাকে ভালবাসে এবং আপনার লজিং এর বাবা আপনার বাবাকে একজন ভালমানুষ
হিসাবে জানে। যার জন্য আপনার বাবার পরিবারে তার আদরের
মেয়েকে বিয়ে দিতে চায়। অতএব আপনার বাবা একজন ভাল মানুষ।
আপনার বাবার জীবনের ঐ পৃষ্ঠাটি আপনার চোঁখে ধরা পড়েনি।
৮. বাবাদের জীবনে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে, যা সন্তানকে বলতে পারেনা, যা কারো সাথে শেয়ার করতে পারেনা। আপনার বাবা কি ধরণের সীমাবদ্ধতার মাঝে অবস্থান করে আপনাকে এবং আপনাদেরকে লালন পালন করেছেন, তা আলিমুল গাইবই বলতে পারবেন।
৯. আপনার লজিং এর যে মেয়েটিকে বিয়ে করতে বাবা আপনার প্রতি বিরক্ত হলেন, সেই মেয়েকে বাবা ঘরের বউ করে ঘরে
তুলতে চেয়েছিলেন। এর মানে বাবার বিরক্তি প্রকাশের
মাধ্যমে আপনি বাবার ভাষা পড়তে পারেননি। আপনি তার অবাধ্য হয়ে ভূল করেছিলেন।
১০. লজিং বাড়ীর মেয়েটার প্রতি আপনার দূর্বলতা ছিলনা, কথাটা সত্য
নয়। আপনি মনের অজান্তে মেয়েটাকে ভালবেসেছিলেন। যা এখনো আপনাকে কুরে কুরে মারছে। যখনই আপনার সুখী বন্ধুদের দেখেন, তখনই ঐ মেয়েটির প্রতিচ্ছবি আপনার মনে ভেসে উঠে। আপনি আপনার বন্ধুকে সুখী হিসাবে ভাবেন।
কিন্তু বন্ধুটি আপনার মতো কত যন্ত্রনায় আছে, তা আপনি জানেন না। যেমনঃ আপনি মনে করেন, কাতারে অবস্থান করি বলে এখন আমি প্রচুর জায়গা
জমির ও বাসা বাড়ীর মালিক। কিন্তু আপনার এই ধারণাটি ভূল।
১১. যে মেয়েটাকে আপনি বিয়ে করেছেন, তার শিক্ষাগত
যোগ্যতার কমতি তার কোন অপরাধ নয়। তাকে আপনার সাথে বিয়ে দেয়া তার অভিভাবকের অপরাধ হতে পারে।
কিন্তু স্ত্রী হিসাবে সে আপনার কাছ থেকে পূর্ণ ভালবাসা পাওয়ার হকদার। কিন্তু আপনি তাকে বঞ্চিত করছেন, বঞ্চিত করছেন আপনার মনের অজান্তে। আপনার বাবা হয়তো এমনি ভাবে আপনাকে বঞ্চিত করছেন।
১২. আপনার স্ত্রী আপনার জন্য বড় এক নিয়ামত। কারণ লজিং বাড়ীর মেয়েকে বিয়ে করলে সে আপনার বাবা মায়ের খেদমত করতো
না। আর আপনি বাবার প্রতি যে মন মানসিকতা নিয়ে আছেন, তাতে আপনার বাবা পূর্ণ খেদমত হতে বঞ্চিত হতো।
১৩. আপনার স্ত্রী আর যাই হোক না কেন, কিন্তু সে আপনার
একান্ত অনুগত এবং আপনাকে ভালবাসে এমন একজন ভদ্র মহিলা।
কিন্তু আপনার লজিং বাড়ীর সেই মেয়েটা আপনার ততটুকু অনুগত
হতো না। তার ভালবাসায় খাদ থাকতো। কোন এক সময়ে দাম্পত্য জীবনের বাঁকে সে আপনাকে খোঁটা দিতো এই বলে যে, তার বাবার খেয়ে বড় হয়েছেন।
১৪. শরীয়াতে বাবার অধিকার সম্পর্কে আপনার পড়ালেখার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আপনি ছাত্রজীবনে সীমাহীন বইয়ের পোঁকা
ছিলেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, ছাত্রজীবনে যে সব বই আপনি আমাদেরকে পড়িয়েছেন, সেই সব বই আপনি এখন আর পড়েন না। সে সব বইয়ের শিক্ষা আপনি ভূলে গেছেন।
১৫. আপনি আপনার জীবনকে টেনশন যুক্ত জীবন বানিয়ে ফেলেছেন। আপনি কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ুন। এমন ব্যস্ত হোন, যাতে বাবা আপনাকে হক দিল কিনা, সেই প্রসংগটি চিন্তা করার সময় আপনার
না থাকে। আপনি সত্য ও সুন্দরের পথে মানুষকে আহবান
করতেন। সেই আহবান এখন বন্ধ। তা আবার চালু করুন। সত্য ও সুন্দরের কাফেলায় শপথ নিন।
আরো বেগবান হোন। জাহিলিয়াতের চক্ষুশুল হোন। কারাগারে চলে যান। দেখবেন, আপনার বাবা আপনাকে কতটুকু ভালবাসে।
১৬. আপনার সাথে সাক্ষাতের বিবরণ দিয়ে আমি ফেইসবুকে লিখবো। আমি আব্দুস শহীদ নাসিম লিখিত ইসলামের
পারিবারিক জীবন বইটির লিংক দেবো। আপনি বইটি একবার পড়ে
নেবেন। পড়ে পড়ে আপনি একজন আদর্শ বাবা হবেন এই প্রত্যাশা
করি।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা
আমাদেরকে সকলের হক আদায়ে তাওফীক দিন। আমীন।
(লেখাটি
১১ই জুলাই ২০১৮ তারিখ ফেইসবুকে পোষ্ট করি। হঠাৎ করে ফেইসবুকের টাইমলাইনে লেখাটি চোঁখে পড়ায় সেই সময়ে বক্তব্য ও
মন্তব্য গুলোও চোঁখে পড়লো। লেখাটি সংরক্ষণের নিয়তে এখানে কপি করা
হলো)
0 Comments