আজ আমার জন্মদিন-১
ফেইসবুকের
কল্যাণে আজকাল জন্মদিনের শুভেচ্ছা নামক বস্তুটার সাথে আমরা ব্যাপক ভাবে পরিচিত ও
জড়িত। এর মধ্যে অনেক ক্যাটাগরির ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন। যেমনঃ
১. যারা
ঘটা করে জানিয়ে দেন-আজ আমার জন্মদিন।
২. যারা
তার জন্মদিনের কথা কাউকে না জানালেও ফেইসবুক তাকে ভূলেনা। তাই তার ফেইসবুক
বন্ধুদের কাছে নোটিফিকেশন চলে যায়। তাই তিনি শুভেচ্ছার ডিজিটাল ফুলে পুস্পিত হোন।
৩. যারা
ব্যক্তিগত ভাবে জন্মদিন পালন করেন না। কিন্তু ফেইসবুকে জন্ম দিন দেখে সংশ্লিষ্ট
ব্যক্তিকে শুভেচ্ছা জানাতে ভূল করেন না। যে ভূলটা আমিও করতাম।
৪. যারা
পোষ্টদেন-জন্মদিন পালনের রেওয়াজ তার পরিবারে নাই। কিন্তু ফেইসবুক স্মরণ করে দিল।
তাই যারা শুভেচ্ছা জানয়েছেন, তাদের
প্রতি কৃতজ্ঞ।
৫. একদল
মুত্তাকী রয়েছেন, যারা ঘটা করে
নিজের সন্তানদের জন্মদিন পালন করেন, কোয়ার্টার উলংগ সন্তানের মা সহ ছবি শেয়ার করেন অত্যন্ত গর্বের সাথে। যাদের
বাসায় গেলে তাদের মা-বোন, স্ত্রী-মেয়েদের
ছায়াটাও দেখা যায় না, সেই সব
মা-বোনদের পুরো দুনিয়ায় প্রদর্শণ করেন।
পাঠক!
আমি আশংকা করি আমার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে অনেকেই আমাকে শুভেচ্ছা জানাবেন।
কারণ তারা হচ্ছে সেই সব ফেইসবুকার-যারা কেবল শিরোনাম দেখেই মন্তব্য করতে অভ্যস্ত।
ফেইসবুকে যোগদানের পর থেকে আজ অবধি কেউ আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাননি। কারণ
আমাকে নিয়ে যাতে এই আগগুবি ব্যাপারটাতে কেউ ট্রল না করেন, তার জন্য আমি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আমার জন্ম তারিখটা
কাস্টমাইজ করে “অনলি মি” করে রেখেছি।
প্রশ্নটা
হচ্ছে, জন্ম দিন নিয়ে এতো মাতামাতি কেন? এই নিয়ে লিখবো পরের পর্বে।
আজ আমার জন্মদিন-২
জন্মদিন।
রাসূল
সা. এর জন্মদিন বলতে আমরা বুঝি “ঈদে মিলাদুন্নবী”।
ঈসা আ.
এর জন্মদিন বলে খৃষ্টানরা দিনটাকে যীশু খৃষ্টের জন্মদিন হিসাবে পালন করে, তাকে বলা হয় খৃষ্টমাস।
হিন্দুদের
কৃষ্ঞ-এর জন্মদিন পালন করে তারা শুভ জন্ম অষ্টমী বলে।
আমরা
একে অপরে যে জন্মদিন পালন করি, তাকে
বলি বার্থ ডে।
কয়েকদিন
আগে শুনেছিলাম, কোথায় নাকি ঈদে মিলাদুন্নবী
উপলক্ষে বিশাল কেক সাজানো হয়েছিল এবং “হেপি বার্থ ডে ইয়া রাসূলাল্লাহ” বলা হয়েছে।
যারা
রাসূলের জন্মদিন পালনকে বিদায়াত মনে করি, তাদের কয়েকজন আমরা নিজের বা নিজেদের সন্তানদের জন্মদিন বা বার্থ যে উদযাপন
করি। যেখানে আব্দুল্লাহ পুত্র মুহাম্মদ-যিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট মানব-তার জন্মদিন
যদি বিদায়াত হয়ে থাকে, তাহলে আপনি আমি
(কটাই মযর) এর জন্মদিন পালন তো বড় বড় দাঁত হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা সেই বিষয়টা
বিবেচনায় নেই না।
রাসূল
সা. এর জন্মদিন পালন বিষয়ে আমাদের সমাজে মতবিরোধ রয়েছে। কিন্তু আমি যদি অনায়াসে
অমুক তমুকের জন্মদিন পালন করতে পারি, তাহলে আমার প্রিয় নবী সা. এর জন্মদিন পালন করতে সমস্যাটা কোথায়? এমনই এক প্রশ্নের জবাবে উলামায়ে কিরাম দুইটি মত প্রকাশ
করেন।
প্রথম
মত হচ্ছেঃ জন্মদিন একটি বিধর্মীদের উৎসব। যা মুসলমানরা পালন করতে পারে না। তারা এর
পক্ষে একটি হাদীস উপস্থাপন করেন। হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে সুনানে আবু দাউদে সহীহ
সনদে। হযরত ইবনে উমর রা. রাসূল সা.থেকে বর্ণনা করেন। রাসূল সা. বলেছেনঃ এবং যে
ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক রাখলো, সে ঐ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত বলে গন্য।
দ্বিতীয়
মত হচ্ছেঃ দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু যুক্ত করা, যা রাসূল সা. এর হেদায়াতের মধ্যে নেই। যা সাহাবায়ে কিরামের আমলের মধ্যে নেই।
তাহলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। তারা বলেন, জন্মদিন পালনের এই রেওয়াজ রাসূল সা. এর সময়ে ছিল না, সাহাবায়ে কিরামের সময়ে ছিল না, তৃতীয় শতাব্দি পর্যন্ত এই প্রেকটিসটি ছিল না। তারা এর পক্ষে
যে হাদীসটি উল্লেখ করেন, তা বর্ণিত
হয়েছে হযরত আয়েশা রা. থেকে। রাসূল সা. বলেনঃ যদি কেউ আমার নির্দেশনার সাথে এমন
কিছু নতুন করে সংযোজন করে, যা আমার
নির্দেশনার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়, তাহলে
তা পরিত্যাজ্য।
আমার এ
লিখনির মাকসুদ রাসূল সা. এর জন্মদিন বা ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে নয়। আমার লেখার বিষয়, আপনার আমার জন্মদিন।
ইদানিংকালে
আমরা জন্মদিন পালনের ভাইরাসে আক্রান্ত। নিজেদের সন্তানদের জন্মদিন উপলক্ষে আমরা
ঘরকে রঙ বেরঙে সাজাই, মোমবাতি জালাই, কেক কাটি আর এক সাথে গেয়ে উঠি হেপী বার্থ যে টু ইউ।
সন্তানের ফ্রেন্ড বন্ধু স্বজনরা হাজির হোন অনুষ্ঠানে মনোরম গিফট প্যাকেট নিয়ে।
অনুষ্ঠানে নাচ হয়, গান হয়, বিকট ভলিউমে হিন্দিগান বাজে, হয় খাওয়া দাওয়া, হৈ হোল্লোড়।
জন্মদিনকে
ভাইরাস কেন বললাম, সে প্রসংগে পরে
আসি। তার আগে উল্লেখ করে নেই আরেক ধরণের লোকদের জন্মদিন পালন নিয়ে। আর তা হলো বড়
ভাইদের জন্মদিন। মাঝে মাঝে অমুক ভাই, তমুক ভাই, বা অমুক মেডাম, তমুক আপার জন্মদিন পালনের শুভেচ্ছায় সয়লাব হয়ে যায় সোস্যাল
মিডিয়া অঙ্গন। আমাদের আপোষহীন নেত্রীর জন্মদিন নিয়ে তো রয়েছে বিশাল রাজনৈতিক
বিতর্ক। জাতির আব্বার মৃত্যুর তারিখে তিনি জন্ম নিয়েছেন, এটা কোন অবস্থায়ই মেনে নেয়া যায় না। আমার জিজ্ঞাসাঃ জন্মদিন
আমরা কেন পালন করি? জন্মদিনের এই
শুভেচ্ছা প্রেরণের রসুম আমরা কতদিন থেকে পালন করি? এই সংস্কৃতিটা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি না আমদানী করা সংস্কৃতি?
জন্মদিনকে
আমি ইতিমধ্যে ভাইরাস বলে উল্লেখ করেছি। ভাইরাস এজন্য উল্লেখ করলাম যে, অত্যন্ত নামকরা শ্রদ্ধাভাজন আমাদের একজন মুরহুম মুরব্বীর
সকল সন্তানেরা লন্ডনে থাকেন। তাদের সকলেই ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামী অনুশাসন মেনে
চলেন বলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে জানি এবং উনাদের তাকওয়ার অবস্থান আমার চেয়ে কমপক্ষে
হাজার গুণ উপরে। সেই মুরব্বীর সবচেয়ে ছোট ছেলের ১০ বছর বয়সী নাতনীর জন্মদিনটা
অত্যন্ত সাদামাটা ভাবে কেক কাটা, মোমবাতি
জালানো ইত্যাদি ছাড়াই পালিত হলো। কিন্তু পারিবারিক ভাবে একটা ছোট্ট আয়োজন হলো এবং
তার একটা সাদামাটা ছবি ফেইসবুকে শেয়ার করা হলো। অথচ এযাবত কালে ঐ মুরব্বীর জন্মদিন
অথবা তার ৫ সন্তানের জন্মদিন অথবা তার অনেক অনেক নাতি নাতনী পাতনী কারো জন্মদিন
পালনের খবর আমরা দেখিনি। আমি মনে করি অত্যন্ত অবচেতন ভাবে জন্মদিন ভাইরাসে উনি
আক্রান্ত হয়েছেন।
জন্মদিনকে
ভাইরাস এজন্য বলছি যে, এই চিজটি
আমাদের দেশে এবং আমাদের সংস্কৃতিতে ছিল না। ৩০ থেকে ৩৫ বছর যাদের বয়স, তাদের কেউ বলতে পারবেন না যে, তাদের বাবা মা ছোট্টকালে তাদের জন্মদিন পালন করেছেন। আমাদের বাবা মাকে তাদের
বা আমাদের জন্মদিন পালনের প্রয়োজন কখনও পড়েনি। পড়েনি মোমবাতি জালিয়ে আমাদেরকে উইশ
করার। তাহলে এই বস্তুটা আমাদের মাঝে কেমনে আসলো? এসেছে করোনার মতো ভাইরাস হয়ে। চীনে করোনা ধরা পড়ার পর যদি সাথে সাথে চীনের
সাথে লকডাউন হয়ে যেতো, তাহলে করোনা
মহাশয় বিশ্বব্যাপী ছড়ানোর সুযোগ পেতেন না। কিন্তু দেখি দেখি করে একে একে সেই
ভাইরাসের ছোবল ছড়িয়েছিল সারা বিশ্বময়। তারপরও যারা যত বেশী লকডাউন কড়া করতে পেরেছে, তারা ততই উপকৃত হয়েছেন। জন্মদিন নামক ভাইরাসকেও আমরা যদি
লকডাউন দিতে পারি, তাহলে যে যত
কড়া লকডাউন দিতে পারবেন, তিনি ততবেশী
জন্মদিন ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে নিরাপদ থাকবেন।
আল্লাহ
পাক আমাকে যে ছোট্ট একটি মেমোরী দান করেছেন, তার থেকে বলছি, মরহুম এরশাদ
সাহেব জবরদখল করে ক্ষমতায় আসার পর যখন বাংলাদেশের আকাশকে উম্মুক্ত করে দিলেন, তখন ভারতীয় টিভি চ্যানেল গুলোর নাটক সিনেমা এবং সিরিয়াল
আমাদের বাসা গুলোতে প্রবেশ করলো। আর এরই ফলশ্রুতিতে জন্মদিন নামক ভাইরাস ভারত থেকে
রপ্তানী হলো বাংলাদেশে। সেই ভাইরাস ধীরে ধীরে প্রসার হতে হতে এই অবস্থা অবধি
পৌছেছে। তারা তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতিতে জন্মদিন পালন করে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে
অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। ওটা দেখতে দেখতে আমরা নিজেদের অজান্তে তা অনুসরণ
করা শুরু করি এবং এক সময় আমরা জন্মদিনকে আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে
ফেলি।
ভারতের
মানুষ কেন জন্মদিন পালন করে? ভারতে
মানুষ জন্মদিনকে তাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে। তারা তাদের ধর্মীয় একটি
অনুষ্ঠান মনে করে। তাই তারা এটাকে গুরুত্ব দেয়। কেক কাটা, মোমবাতি জালানো, গিফট দেয়া, উইশ করা, শুভেচ্ছা কার্ড প্রদান, ঘটা করে অনুষ্ঠানের আয়োজন, নাচ-গান, মদ, আড্ডা, ফুর্তি ইত্যাদি সব কিছু তাদের ধর্মীয় ইবাদত মনে করেই করে।
কিন্তু আমরা তা জানিনা। আর জানিনা বলেই আমরা তা অনায়াসে অনুসরণ করি।
বড়
মাপের একজন ছাত্র নেতা, যিনি এখন ডক্টর
হয়ে সম্ভবত লন্ডনে অবস্থান করছেন। তার একটি বক্তব্য এখনো সোস্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল
হয়ে আছে। মির্যা গালিব নামক ঐ ছাত্র নেতা তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, আমরা পরদেশ থেকে খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ, টেকনলজি সব আমদানী করতে পারি। কিন্তু সংস্কৃতি আমদানী করার
বস্তু নয়-তা আমদানী করা যাবে না। কিন্তু দূর্ভাগ্য জনক হলেও সত্য যে, আমরা সব কিছু বাছবিচার না করে আমদানী করে ভাইরাসে আক্রান্ত
হচ্ছি।
তাহলে
কি আমরা জন্মদিন পালন করবো না? আমার
প্রথম এবং একমাত্র উত্তর হচ্ছেঃ না, পালন করবো না। বয়সে ৫০ এর কোটা পেরিয়ে এসেছি। আজ অবধি কখনো জন্মদিন পালন
করিনি। কিন্তু আপন জন আর বন্ধু স্বজনের ভালবাসা ও শুভেচ্ছা কম পাইনি। ফেইসবুকের
জন্মের কয়েক মাস পর থেকেই ওখানে যুক্ত হয়েছি। কিন্তু জন্মদিন নামক অপসনটাকে
জন্মলগ্ন থেকে হাইড করে রেখেছি। তাই বছরে একবার আমাকে আর বলতে হয়না, “আমাদের পরিবারে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ নেই, কিন্তু ফেইসবুকের কল্যাণে জানতে পারলাম আজ আমার জন্মদিন।
যারা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, তাদের প্রতি
কৃতজ্ঞ।”
আল্লামা
ইউসুফ কারযাভী জন্মদিন পালনের একটি প্রেকসিপশন দিয়েছেন। তার মতে জন্মদিন যদি পালন
করতে হয়, তাহলে ঐ দিনে আপনি জীবনের অতীতের ফেলে আসা বছর গুলোর কর্মের
পর্যালোচনা করুন, আত্মসমালোচনা
করুন। ভূল গুলোকে চিহ্নিত করুন। সংশোধনের অঙ্গিকার করে নব উদ্দমে আগামীর জন্য কাজ
করুন। আগামীর ১টি বছর কিভাবে কাটাবেন, তার পরিকল্পনা গ্রহণ করুন।
সুপ্রিয়
পাঠক! জন্মদিন একটি অপচয় দিবস। জন্মদিন একটি অসংস্কৃতি চর্চা দিবস। জন্মদিন একটি
বিদায়াতী দিবস। অতএব, জন্মদিন পালনকে
না বলুন।
(পূনশ্চঃ অনেকেই-যাদের পোষ্ট না পড়ে মন্তব্য করার অভ্যাস, তারা আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন আমার বিগত পোষ্টে।
তাদের প্রতি করুণা। উল্লেখ্য যে, আমার
২টি জন্মদিন রয়েছে। একটি আমার প্রকৃত জন্মদিন-যা আমার আব্বা কর্তৃক লিখিত একটি
রেশন কার্ডে আমি পেয়েছি। আর অপরটি মাধ্যমিক পরিক্ষার সময় আমাদের শ্রদ্ধেয় ময়না
স্যার দিয়েছিলেন। যা-ই আমার অফিসিয়েল জন্মদিন। সংগত কারণে ২টি জন্মদিনের কোনটিই
উল্লেখ করলাম না। ধন্যবাদ)
0 Comments