মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ দুইজন মানুষকে দেখতে আমার কাছে প্রায় একই ধরণের মনে হতো।
স্মৃতির পাতা হাতড়াতে মাঝে মাঝে ঘুলিয়ে ফেলতাম। দুইজন একই পথের পথিক। দুইজনই জাতি
গড়ার কারিগর মহান শিক্ষক। দুইজন সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নিবেদিত
প্রাণ। দুইজনই ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সাদামাটা। দুইজনই ত্যাগ ও কুরবানী এক উজ্জল
উদাহরণ। দুইজনের ভালবাসা ছিল সহকর্মী আর সহযোদ্ধাদের প্রতি সাগরসম। সেই দুইজনই এখন
আমাদের কাছে অতীত। দুইজনই চলে গেছেন দুনিয়ার সফর শেষ করে তাদের মালিকের কাছে
অপারের সুন্দর ভূবনে। জান্নাতি চেহারা, জান্নাতি
ব্যবহার, জান্নাতি আমলের ধারক এই মানুষ দূ’টি আশা করি
জান্নাতের সুন্দর বাগানে একসাথে বিচরণ করছেন।
সেই দুই মহান ব্যক্তিত্বঃ ১. বিয়ানী বাজারের প্রবীন শিক্ষক জনাব আব্দুর রহীম
ভাই। আর ২. বড়লেখার প্রবীন শিক্ষক জনাব ফখরুল ইসলাম ভাই।
ছাত্র জীবনে পাশের থানা বিয়ানী বাজারের দায়িত্বশীল হওয়ার কারণে জনাব আব্দুর
রহীম ভাইকে চিনি জানি। সাপ্তাহিক সোনার বাংলা আর দৈনিক সংগ্রামে কপি বগলদাবা করা
একজন সাদা মনের মানুষ। তার সাথে যতবার দেখা হয়েছে একজন নিবেদিত আল্লাহ ওয়ালা
ভালবাসা মাখা মানুষ হিসাবে তাকে দেখেছি।
জনাব ফখরুল ইসলাম। যাকে ফকু ভাই বলে আমরা চিনতাম এবং জানতাম। যাদের হাত ধরে শত
শত মানুষ সত্য ও সুন্দরের এই কাফেলায় নাম লিখিয়েছে, জনাব ফখরুল ইসলাম তাদের
অন্যতম। কর্দমাক্ত গায়ের রাস্তা মাড়িয়ে, বাই সাইকেলে
চড়ে বছরের পর বছর বড়লেখার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যারা দ্বীনের দাওয়াতের ভিত্তি স্থাপন
করেছেন, জনাব ফখরুল ইসলাম ভাই তাদের অন্যতম। জীবনের
প্রথম দিন তাকে যেভাবে দেখেছিল, জীবনের শেষ দিন অবধি
তাকে একই ভাবে দেখেছি।
তার সাথে প্রথম দেখা তার বিয়ের ওয়ালিমা অনুষ্ঠানে। তখন আমি শিবিরের কর্মী।
বড়লেখা উপজেলা শিবিরের দায়িত্বশীলদের আশে পাশে থাকতাম বলে এই ওয়ালিমাতে আমার অংশ
নেয়ার সুযোগ হয়েছিল। সাদা ‘টরে’ পানজাবী পরা ফখরুল ভাইয়ের চেহারাটা আজও ভেসে উঠে
মানসপটে। তিনি বিয়ে করেন বড়লেখার তারাদরমে। মাওলানা আব্দুল হান্নান মরহুম উনার
শশুড়। আমাদের অতিপরিচিত আজিজুল ইসলামের দুলাভাই। জনাব মাওলানা ছমর উদ্দিন, বদরুল ইসলাম গংদের বোনকে
উনি বিয়ে করেন।
আমি যখন বড়লেখা উপজেলায় দায়িত্বশীল, তখন আজিজুল ইসলাম উপজেলা দায়িত্বশীল
হওয়ার সিড়িতে প্রথম ধাপে। তাই আজিজুল ইসলামের সাথে দহরম মহরম বেশী বেশী। ছাত্র
জীবন শেষ করে সেই দহরম মহরমটা আরো বেড়ে যায়। তাই প্রায়ই আড্ডার ঠিকানা হতো
তারাদরমে আজিজুল ইসলামের বাড়ীতে। আজিজুল ইসলামের সাথে এতো সখ্যতার সুবাদে এক সময়
ফখরুল ভাই জাতীয় দুলাভাই হিসাবে আত্ম প্রকাশ করলেন।
উনার ছেলে আরিফ, ইসলামী ছাত্র শিবিরের মৌলভী বাজার জেলা শাখার বড় দায়িত্বশীল। এক সময় সে
বড়লেখা উত্তর অঞ্চলের দায়িত্বশীল ছিল। কাতার থেকে দেশে গিয়েছি। আরিফ জানতে পেরে
ফোন দিল। কথা বলতে বলতে দেখা হয়ে গেল। সে আমাকে ভাই ভাই বলে সম্বোধন করছিল।
বিস্তারিত ভাবে জানতে গিয়ে জানলাম সে ফখরুল ভাইয়ের ছেলে। তখনই পরিচয় বদল করে
দিলাম। দুলাভাইয়ের ছেলেতো ভাগনাই হবে। সেই থেকে আজ অবধি আরিফ মামা বলেই ডাকে।
ফখরুল ভাইয়ের সাথে সুন্দর ও দীর্ঘ একটা সময় কাটে আজিজুল ইসলামের বিয়েতে। বিয়ের
আগের রাতে দীর্ঘ সময় ধরে তারাদরমে আজিজুল ইসলামের বাড়ীতে আড্ডা চলে ফখরুল ভাইয়ের
সাথে। সম্মানিত দুলাভাই হিসাবে তার ভূমিকা রাখতে গিয়ে কখনো উনি উনার দায়িত্বশীল
অবস্থানটাকে ভূলে যাননি। কিন্তু আমাদের মনোরঞ্জনে একটুও ব্যত্যয় ঘটেনি। সেই
অনুষ্ঠানে আরেকজন ব্যক্তি আমাদেরকে ভাল সংগ দিয়েছিলেন, তিনিও আমাদের মাঝে নাই।
মাত্র কিছু দিন আগে তিনি চলে গেলেন। তিনি হলেনঃ মাওলানা আতাউর রহমান।
ফখরুল ভাইয়ের সাথে দুলাভাই সুলভ সম্পর্কের আগে থেকেই উনাকে দেখেছি। বড়লেখা
হাতেগোনা কয়েকজন রুকন ছিলেন, তাদের মাঝে একজন ছিলেন জনাব ফখরুল ইসলাম। প্রায় প্রতি
সপ্তাহে তাকে দেখা যেতো ডায়েরী হাতে বড়লেখাতে কোন না কোন প্রোগ্রামে। দাসের বাজার
এলাকার জামায়াতের দায়িত্বশীল হওয়াতে নির্বাচনে, সমাবেশে, দাওয়াতী বৈঠকে কিংবা তাফসীর মাহফিলে সব খানে তার নিরব দায়িত্বশীল সুলভ
উপস্থিতি। কেয়ারটেকার সরকার আন্দোলন ও এরশাদ হঠাও আন্দোলনে তার উপস্থিতি ছিল
প্রতিটি মিছিলে। মিছিলের শেষ ভাগে দেখা যেতো জনাব ফখরুল ইসলামকে। সেই ফখরুল ভাই
অসম্ভব ধরণের ভালবাসতেন আমাকে। তার ভালবাসা উপস্থাপনের ব্যতিক্রমী প্রকাশ কপি করা
আমার অথবা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ সেই ভালবাসা আন্তরিক ভালবাসা, অন্তর নিগড়ানো ভালবাসা, দিল উজাড় করা ভালবাসা, এই ভালবাসা কেবল আল্লাহর জন্য ভালবাসা।
দীর্ঘদিন এক ভাবে নিরলস হয়ে কাজ করে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু একই
ধারাবাহিকতায় সরকারী চাকুরীর পাশাপাশি সংগঠনে দায়িত্ব পালন করে গেছেন জনাব ফখরুল
ইসলাম ভাই। দায়িত্ব পালনে সহকর্মীদের সাথে মনোমালিন্য স্বাভাবিক একটি বিষয়। কিন্তু
জনাব ফখরুল ইসলামের ব্যাপারে এমনটা পাওয়ার কোন সুযোগ নাই।
ধীরে ধীরে সোনার পাখিরা সব চলে যাচ্ছে। আমরা ধীরে ধীরে হয়ে পড়ছি অভিভাবক
শুন্য। জননেতা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মালিক ও জননেতা ইঞ্জিনিয়ার কমর উদ্দিন থেকেও নাই।
তারা সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে। আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন একে একে শ্রদ্ধেয় মাষ্টার
বশির উদ্দিন, মাষ্টার মোস্তাফা উদ্দিন, আলহাজ্ব শাহাবুদ্দিন, মাষ্টার কুতুব উদ্দিন, মাষ্টার আব্দুর রহীম এবং
অতি সম্প্রতি মাষ্টার আব্দুল মান্নান। সোনার পাখিদের সাথে সাক্ষাত করতে এখন চলে
গেলেন মাষ্টার ফখরুল ইসলাম। বড়লেখার সংগঠনের ছিল মাষ্টারদের মেলা। সকল মাষ্টারেরা
ছিলেন আমাদের আধ্যাত্মিক মাষ্টার। তাদের চলে যাওয়াতে শহীদের এই জনপদ ধীরে ধীরে
অভিভাবক শুন্য।
হে আরশের মালিক! আমাদের অভিভাবকদেরকে তোমার অভিভাকত্বে সপোর্দ করলাম।
জান্নাতের সুন্দর বাগানে তুমি তোমার কাছে তাদের জন্য একেকটি ঘর বানিয়ে দিয়ে প্রভূ।
তাদের এই রেখে যাওয়া বাগানে যোগ্য অভিভাবক সৃষ্টি করে দিও।
৩রা অক্টোবর, ২০২১
0 Comments