তেলাওয়াত ও সরল অনুবাদঃ
﴿ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَ
السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَجَعَلَ الظُّلُمَاتِ وَالنُّورَ ۖ ثُمَّ الَّذِينَ
كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُونَ﴾
১) প্রশংসা
আল্লাহর জন্য, যিনি
পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং অন্ধকার ও আলোর উৎপত্তি ঘটিয়েছেন। তবুও সত্যের
দাওয়াত অস্বীকারকারীরা অন্যদেরকে তাদের রবের সমকক্ষ দাঁড় করাচ্ছে।
﴿هُوَ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن طِينٍ ثُمَّ
قَضَىٰ أَجَلًا ۖ وَأَجَلٌ مُّسَمًّى عِندَهُ ۖ ثُمَّ أَنتُمْ تَمْتَرُونَ﴾
২) তিনিই
তো তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। তারপর তোমাদের জন্য
নির্ধারিত করেছেন জীবনের একটি সময়সীমা এবং আর একটি সময়সীমাও আছে, যা তাঁর কাছে স্থিরীকৃত, কিন্তু তোমরা কেবল সন্দেহেই লিপ্ত রয়েছে।
﴿وَهُوَ اللَّهُ فِي السَّمَاوَاتِ وَفِي
الْأَرْضِ ۖ يَعْلَمُ سِرَّكُمْ وَجَهْرَكُمْ وَيَعْلَمُ مَا تَكْسِبُونَ﴾
৩) তিনিই
এক আল্লাহ আকাশেও আছেন এবং পৃথিবীতেও, তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সব অবস্থান জানেন এবং ভালো বা মন্দ
যা-ই তোমাদের উপার্জন করো তাও তিনি ভালোভাবেই অবগত।
﴿وَمَا تَأْتِيهِم مِّنْ آيَةٍ مِّنْ آيَاتِ
رَبِّهِمْ إِلَّا كَانُوا عَنْهَا مُعْرِضِينَ﴾
৪) মানুষের
অবস্থা দাঁড়িয়েছে এই যে, তাদের
রবের নিদর্শনসমূহের মধ্য থেকে এমন কোন নিদর্শন নেই যা তাদের সামনে আসার পর তারা তা
থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি।
﴿فَقَدْ كَذَّبُوا بِالْحَقِّ لَمَّا
جَاءَهُمْ ۖ فَسَوْفَ يَأْتِيهِمْ أَنبَاءُ مَا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ﴾
৫)
অনুরূপভাবে এখন যে সত্য তাদের কাছে এসেছে তাকেও তারা মিথ্যা বলেছে।ঠিক আছে, এতদিন পর্যন্ত যা নিয়ে তারা ঠাট্টা বিদ্রুপ করে এসেছে শীঘ্রই
সে সম্পর্কে কিছু খবর তাদের কাছে পৌঁছুবে।
﴿أَلَمْ يَرَوْا كَمْ أَهْلَكْنَا مِن
قَبْلِهِم مِّن قَرْنٍ مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ مَا لَمْ نُمَكِّن لَّكُمْ
وَأَرْسَلْنَا السَّمَاءَ عَلَيْهِم مِّدْرَارًا وَجَعَلْنَا الْأَنْهَارَ تَجْرِي
مِن تَحْتِهِمْ فَأَهْلَكْنَاهُم بِذُنُوبِهِمْ وَأَنشَأْنَا مِن بَعْدِهِمْ
قَرْنًا آخَرِينَ﴾
৬) তারা কি
দেখেনি তাদের পূর্বে এমনি ধরনের কত মানব গোষ্ঠীকে আমি ধ্বংস করেছি, যারা নিজ নিজ যুগে ছিল দোর্দণ্ড
প্রতাপশালী? পৃথিবীতে তাদেরকে এমন কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম,
যা তোমাদেরকেও দেইনি।তাদের ওপর আকাশ থেকে
প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম এবং তাদের পাদদেশে নদী প্রবাহিত করেছিলাম। (কিন্তু যখন তারা নিয়ামতের প্রতি অকৃজ্ঞতা প্রকাশ
করলো তখন) অবশেষে তাদের গোনাহের কারণে তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছি এবং তাদের জায়গায়
পরবর্তী যুগের মানবগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছি৷
﴿وَلَوْ نَزَّلْنَا عَلَيْكَ كِتَابًا فِي
قِرْطَاسٍ فَلَمَسُوهُ بِأَيْدِيهِمْ لَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ هَٰذَا
إِلَّا سِحْرٌ مُّبِينٌ﴾
৭) হে নবী!
যদি তোমরা প্রতি কাগজে লেখা কোন কিতাবও নাযিল করতাম এবং লোকেরা নিজেদের হাত দিয়ে
তা স্পর্শ করেও দেখে নিতো, তাহলেও
আজ যারা সত্যকে অস্বীকার করছে তারা তখন বলতো, এটা সুস্পষ্ট
যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়।
﴿وَقَالُوا لَوْلَا أُنزِلَ عَلَيْهِ مَلَكٌ
ۖ وَلَوْ أَنزَلْنَا مَلَكًا لَّقُضِيَ الْأَمْرُ ثُمَّ لَا يُنظَرُونَ﴾
৮) তারা
বলে, এ নবীর কাছে কোন
ফেরেশতা পাঠানো হয় না কেন? যদি ফেরেশতা পাঠাতাম, তাহলে এতদিনে কবেই ফায়সালা হয়ে যেতো, তখন তাদেরকে আর
কোন অবকাশই দেয়া হতো না ।
﴿وَلَوْ جَعَلْنَاهُ مَلَكًا لَّجَعَلْنَاهُ
رَجُلًا وَلَلَبَسْنَا عَلَيْهِم مَّا يَلْبِسُونَ﴾
৯) যদি
ফেরেশতা পাঠাতাম তাহলেও তাকে মানুষের আকৃতিতেই পাঠাতাম এবং এভাবে তাদেরকে ঠিক
তেমনি সংশয়ে লিপ্ত করতাম যেমন তারা এখন লিপ্ত রয়েছে।
﴿وَلَقَدِ اسْتُهْزِئَ بِرُسُلٍ مِّن
قَبْلِكَ فَحَاقَ بِالَّذِينَ سَخِرُوا مِنْهُم مَّا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ﴾
১০) হে মুহাম্মাদ!
তোমরা পূর্বেও অনেক রসূলের প্রতি বিদ্রূপ করা হয়েছে।কিন্তু বিদ্রূপকারীরা যে অকাট্য সত্য নিয়ে বিদ্রূপ করতো, সেটাই অবশেষে তাদের ওপর চেপে বসেছিল।
নামকরণঃ
§
আনআম বলা হয় গৃহপলিত পশুকে। সূরার ১৬ ও ১৭ নম্বর রুকুতে কোন কোন আনআমের হারাম হওয়া
এবং কোন কোনটি হালাল হওয়া বিষয়ে আরবের মানুষের কাল্পনিক ও কুসংস্কারমূলক ধারণা বিশ্বাসকে
খন্ডন করা হয়েছে। তাই বিষয় বস্তুর বিবেচনায় সূরার নাম করণ করা হয়েছে আল-আনআম।
§
সূরার ১৬ ও ১৭ রুকুতে যা বলা হয়েছেঃ
وَقَالُوۡا
هٰذِهٖۤ اَنۡعَامٌ وَّحَرۡثٌ حِجۡرٌۖ لَّا يَطۡعَمُهَاۤ اِلَّا مَنۡ نَّشَآءُ
بِزَعۡمِهِمۡ وَاَنۡعَامٌ حُرِّمَتۡ ظُهُوۡرُهَا وَاَنۡعَامٌ لَّا يَذۡكُرُوۡنَ
اسۡمَ اللّٰهِ عَلَيۡهَا افۡتِرَآءً عَلَيۡهِؕ سَيَجۡزِيۡهِمۡ بِمَا كَانُوۡا
يَفۡتَرُوۡنَ
১৩৮) তারা বলে, এ পশু ও
এ ক্ষেত-খামার সুরক্ষিত। এগুলো একমাত্র তারাই খেতে পারে যাদেরকে আমরা খাওয়াতে চাই।
অথচ এ বিধি-নিষেধ তাদের মনগড়া। তারপর কিছু পশুর পিঠে চড়া ও তাদের পিঠে মাল বহন করা
হারাম করে দেয়া হয়েছে আবার কিছু পশুর ওপর তারা আল্লাহর নাম নেয় না। আর এসব
কিছু আল্লাহ সম্পর্কে তাদের মিথ্যা রটনা। শীঘ্রই
আল্লাহ তাদেরকে এ মিথ্যা রটনার প্রতিফল দেবেন।
وَقَالُوۡا
مَا فِىۡ بُطُوۡنِ هٰذِهِ الۡاَنۡعَامِ خَالِصَةٌ لِّذُكُوۡرِنَا وَمُحَرَّمٌ
عَلٰٓى اَزۡوٰجِنَاۚ وَاِنۡ يَّكُنۡ مَّيۡتَةً فَهُمۡ فِيۡهِ شُرَكَآءُؕ
سَيَجۡزِيۡهِمۡ وَصۡفَهُمۡؕ اِنَّهٗ حَكِيۡمٌ عَلِيۡمٌ
১৩৯) আর তারা বলে, এ
পশুদের পেটে যা কিছু আছে তা আমাদের পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট এবং আমাদের স্ত্রীদের
জন্য সেগুলো হারাম। কিন্তু যদি তা মৃত হয় তাহলে উভয়েই তা খাবার ব্যাপারে শরীক হতে
পারে। তাদের এ মনগড়া কথার প্রতিফল আল্লাহ তাদেরকে অবশ্যি দেবেন।
অবশ্যি তিনি প্রজ্ঞাময় ও সবকিছু জানেন।
قَدۡ
خَسِرَ الَّذِيۡنَ قَتَلُوۡۤا اَوۡلَادَهُمۡ سَفَهًۢا بِغَيۡرِ عِلۡمٍ
وَّحَرَّمُوۡا مَا رَزَقَهُمُ اللّٰهُ افۡتِرَآءً عَلَى اللّٰهِؕ قَدۡ ضَلُّوۡا
وَمَا كَانُوۡا مُهۡتَدِيۡنَ
১৪০) নিঃসন্দেহে
তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যারা নিজেদের সন্তানদেরকে নির্বুদ্ধিতা ও অজ্ঞতাবশত
হত্যা করেছে এবং আল্লাহর দেয়া জীবিকাকে আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা ধারণাবশত হারাম
গণ্য করেছে নিঃসন্দেহে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং তারা কখনোই সত্য পথ লাভকারীদের
অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
وَمِنَ
الۡاَنۡعَامِ حَمُوۡلَةً وَّفَرۡشًاؕ كُلُوۡا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللّٰهُ وَلَا
تَتَّبِعُوۡا خُطُوٰتِ الشَّيۡطٰنِؕ اِنَّهٗ لَكُمۡ عَدُوٌّ مُّبِيۡنٌۙ
১৪২) আবার তিনিই
গবাদী পশুর মধ্যে এমন পশুও সৃষ্টি করেছেন, যাদের
সাহায্যে যাত্রী ও ভারবহনের কাজ নেয়া হয় এবং যাদেরকে খাদ্য ও বিছানার কাজেও
ব্যবহার করা হয়। খাও এ জিনিসগুলো থেকে, যা
আল্লাহ তোমাদের দান করেছেন এবং শয়তানের অনুসরণ করো না, কারণ সে
তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।
مٰنِيَةَ
اَزۡوٰجٍۚ مِّنَ الضَّاۡنِ اثۡنَيۡنِ وَمِنَ الۡمَعۡزِ اثۡنَيۡنِؕ قُلۡ
اٴٰلذَّكَرَيۡنِ حَرَّمَ اَمِ الۡاُنۡثَيَيۡنِ اَمَّا اشۡتَمَلَتۡ عَلَيۡهِ
اَرۡحَامُ الۡاُنۡثَيَيۡنِؕ نَبِّـُٔوۡنِىۡ بِعِلۡمٍ اِنۡ كُنۡتُمۡ صٰدِقِيۡنَۙ
১৪৩) এ আটটি নর ও
মাদী, দু’টি মেষ শ্রেণীর ও দু’টি ছাগল শ্রেণীর। হে
মুহাম্মাদ! এদেরকে জিজ্ঞেস করো, আল্লাহ এদের নর দু’টি হারাম করেছেন, না মাদী
দু’টি অথবা মেষ ও ছাগলের পেটে যে বাচ্চা আছে সেগুলো? যথার্থ
জ্ঞানের ভিত্তিতে আমাকে জানাও যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো।
وَمِنَ
الۡاِبِلِ اثۡنَيۡنِ وَمِنَ الۡبَقَرِ اثۡنَيۡنِؕ قُلۡ اٴٰلذَّكَرَيۡنِ حَرَّمَ
اَمِ الۡاُنۡثَيَيۡنِ اَمَّا اشۡتَمَلَتۡ عَلَيۡهِ اَرۡحَامُ الۡاُنۡثَيَيۡنِؕ
اَمۡ كُنۡتُمۡ شُهَدَآءَ اِذۡ وَصّٰٮكُمُ اللّٰهُ بِهٰذَاۚ فَمَنۡ اَظۡلَمُ
مِمَّنِ افۡتَرٰى عَلَى اللّٰهِ كَذِبًا لِّيُضِلَّ النَّاسَ بِغَيۡرِ عِلۡمٍؕ
اِنَّ اللّٰهَ لَا يَهۡدِىۡ الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِيۡنَ
১৪৪) আর এভাবে দু’টি উট
শ্রেণীর ও দু’টি গাভী শ্রেণীর মধ্য থেকে। জিজ্ঞেস করো, আল্লাহ
এদের নর দু’টি হারাম করেছেন, না মাদী দু’টি, না সেই
বাচ্চা যা উটনী ও গাভীর পেটে রয়েছে? তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে যখন আল্লাহ তোমাদেরকে
এদের হারাম হুকুম দিয়েছিলেন? কাজেই তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হবে যে আল্লাহর নামে
মিথ্যা কথা বলে? তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সঠিক
জ্ঞান ছাড়াই মানুষকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করা। নিঃসন্দেহে আল্লাহ এহেন জালেমদের
সত্য-সঠিক পথ দেখান না।
قُل لَّاۤ
اَجِدُ فِىۡ مَاۤ اُوۡحِىَ اِلَىَّ مُحَرَّمًا عَلٰى طَاعِمٍ يَّطۡعَمُهٗۤ اِلَّاۤ
اَنۡ يَّكُوۡنَ مَيۡتَةً اَوۡ دَمًا مَّسۡفُوۡحًا اَوۡ لَحۡمَ خِنۡزِيۡرٍ
فَاِنَّهٗ رِجۡسٌ اَوۡ فِسۡقًا اُهِلَّ لِغَيۡرِ اللّٰهِ بِهٖۚ فَمَنِ اضۡطُرَّ
غَيۡرَ بَاغٍ وَّلَا عَادٍ فَاِنَّ رَبَّكَ غَفُوۡرٌ رَّحِيۡمٌ
১৪৫) হে
মুহাম্মাদ! এদেরকে বলে দাও, যে ওহী আমার কাছে এসেছে তার মধ্যে তো আমি এমন কিছু
পাই না যা খাওয়া কারো ওপর হারাম হতে পারে, তবে মরা, বহমান
রক্ত বা শুয়োরের গোশ্ত ছাড়া। কারণ তা নাপাক। অথবা যদি অবৈধ হয় আল্লাহ ছাড়া অন্য
কারোর নামে যবেহ করার কারণে। তবে অক্ষম অবস্থায় যে ব্যক্তি (তার মধ্য থেকে কোন
জিনিস খেয়ে নেবে) নাফরমানীর ইচ্ছা না করে এবং প্রয়োজনের সীমা না পেরিয়ে, সেক্ষেত্রে
অবশ্যি তোমার রব ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী।
§
তাফসীরে তাওযীহুল কুরআনে বলা হয়েছেঃ
-
আনআম মানে চতূষ্পদ জন্তু। আরবের মুশরিকদের মাঝে চতূষ্পদ
জন্তু সম্পর্কে ছিল ভ্রান্ত ধারণা। তারা মূর্তির নামে পশু ওয়াকফ করে তাকে খাওয়া হারাম মনে
করতো। সূরাতে সেই সব ভ্রান্ত নীতির মূলোৎপাটন করা হয়েছে। বিধায় এই সূরার নাম রাখা হয়েছে
সূরা আল আনআম।
§
সূরা আল আনআমের বৈশিষ্ট্য
-
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, কয়েকটি আয়াত
ছাড়া পুরো সুরা একসাথে মক্কায় নাযিল হয়েছে। সত্তর হাজার ফেরেশতা তাসবীহ
পড়তে পড়তে এই সুরা অবতরণ করেছিলেন।
-
সূরা আল আনআম নাযিল হওয়ার পর তাসবীহ পড়তে শুরু করেন
এবং বলেনঃ এই সূরাকে ঘিরে ফিরিশতারা আসমান থেকে জমীন পর্যন্ত ঘিরে
-
আবু ইসহাক ইসফারায়িনি বলেন,
o সূরাতে তাওহীদের সমস্ত মূলনীতি
ও পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে।
o সূরাটি আলহামদুলিল্লাহ দ্বারা
শুরু করা হয়েছে। যার মাধ্যমে এই ম্যাসেজ দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ কারো প্রশংসার মুখাপেক্ষী নন।
নাযিলের সময়কালঃ
§
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর বর্ণনা অনুযাযী সূরাটি একই সাথে মক্কায় নাযিল
হয়েছে।
§
হযরত আসমা বিনতে ইয়াযীদ-যিনি হযরত মুআয বিন জাবাল রা. এর চাচাত বোন। তিনি বলেনঃ রাসূল সা. উটনীর পিঠে আরোহিত অবস্থায় এই সূরাটি নাযিল হতে থাকে। যখন আমি উটনীটির লাগাম ধরে ছিলাম। তখন উটনীটির অবস্থা এমন হয়েছিল যে, বোঝার ভারে মনে হচ্ছিল এই বুঝি উটনীর
হাড়গোড় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে।
§
হযরত আসমার বর্ণনা অনুযাযী যে, রাতে এই সূরাটি নাযিল হয়, রাসূল সা.
সেই রাতেই সূরাটি লিপিবদ্ধ করান।
§
সূরা বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করলে মনে হয় যে, সূরাটি মক্কী যুগের শেষের দিকে নাযিল হয়েছে। আর হযরত আসমার বর্ণনাও সেই কথার সত্যতা প্রমাণ করে। কারণ তিনি ছিলেন আনসারদের
অন্তর্ভূক্ত, যিনি হিজরতের
পর ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি যদি ভক্তি শ্রদ্ধার কারণে সেই সময়ে মক্কায় গিয়ে থাকেন, তাহলে তা মক্কী জীবনের শেষ দিকেই হওয়ার
কথা। তাছাড়া এর আগে রাসূল সা. এর সাথে মদীনাবাসীদের এমন ঘনিষ্ট সম্পর্ক হয়নি যে, একজন
মহিলা তার খেদমতে হাজির হবেন।
শানে নুযুল বা নাযিলের উপলক্ষঃ
§
সূরাটি যে প্রেক্ষাপটে নাযিল হলোঃ
- রাসূল সা. দাওয়াতী
কাজের ১২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।
-
কুরাইশদের বাঁধা ও নির্যাতন চরমে পৌছেছিল।
-
দাওয়াত কবুলকারীদর একটা অংশ নির্যাতন থেকে বাঁচতে হাবশায় হিজরত
করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
-
রাসূল সা.কে সাহায্যকারী আবু তালিব ও হযরত খাদিজা ইনতিকাল করেছেন।
-
সকল ধরণের পার্থিব সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়ে কঠোর প্রতিবন্ধকতার
মধ্য দিয়ে রাসূল সা. ইসলামের প্রচার ও রিসালাতের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
-
রাসূল সা. এর দাওয়াতে সাড়া দিয়েছিল কিছু সৎ লোক। আর সামগ্রিক ভাবে ইসলামের প্রতি একটা ঝোঁক ছিল।
-
যার মাঝে সেই ঝোঁক দেখা যেতো, তাকে তিরস্কার, গালিগালাজ, শারিরিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক
নির্যাতনে জর্জরিত করা হতো।
-
পুরো মেঘাচ্ছন্ন আকাশে-অন্ধকার বিভীষিকাময় পরিবেশে
ইয়াসরিব তথা মদীনার দিক থেকে পাওয়া গেলো একটুখানি হালকা আশার আলো।
-
মদীনার আওস ও খাযরাজ গোত্রের প্রভাবশালী মানুষেরা রাসূল সা. এর হাতে
আকবা নামক স্থানে বাইয়াত গ্রহণ করে গিয়েছেন।
-
মদীনায় কোন ধরণের বাঁধা ছাড়াই ইসলামের প্রসার লাভ শুরু হয়েছিল। এর এই মদীনার ক্ষুদ্র প্রারম্ভিক বিন্দুর মাঝে ছিল ভবিষ্যতের
বিপুল সম্ভাবনা, তা সাধারণ দৃষ্টিতে বুঝা সম্ভব ছিল না।
- রাসূল সা. এর আন্দোলনকে বাহ্যিক ভাবে মনে করা হতোঃ
1. ইসলাম একটি দূর্বল আন্দোলন।
2. যার পিছনে কোন বৈষয়িক ও বস্তুগত শক্তি
নাই।
3. এর উদ্যোক্তার পিছনে পরিবার আর বংশের
দূর্বল সমর্থন ছাড়া কোন সমর্থন নাই।
4. ইসলাম যারা গ্রহণ করেছে, তাদের সংখ্যা
মুষ্টিমেয়, তারা অসহায় ও বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন।
5. অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, গাছের মরা
পাতা যেমন মাটিতে ঝরে পড়ে, একই ভাবে জাতির বিশ্বাস, মত ও পথ
থেকে সরে গিয়ে কিছু মানুষ সমাজ থেকে দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
আলোচ্য বিষয় সমূহঃ
§
আলোচ্য বিষয় ৭টি। যথাঃ
একঃ শিরকের খণ্ডন, তাওহীদের প্রতি ঈমান আনার আহবান।
দুইঃ আখেরাতের প্রতি ঈমানের প্রচার ও দুনিয়ার জীবন সবকিছু এই চিন্তার অপনোদন।
তিনঃ জাহেলীয়াতের সকল কাল্পনিক বিশ্বাস ও কুসংস্কারের প্রতিবাদ।
চারঃ ইসলামের মৌলিক নৈতিক বিধানের শিক্ষা।
পাঁচঃ রাসূল সা. এবং তার দাওয়াতের বিরুদ্ধে উত্থাপিত আপত্তি ও প্রশ্নের জবাব।
ছয়ঃ দাওয়াতী কাজের দীর্ঘ সফরে সফলতা না আসায় রাসূল সা. ও মুসলমানদের অস্থিরতা ও
হতাশার কারণে সান্তনা প্রদান।
সাতঃ অস্বীকারকারী ও বিরোধী পক্ষকে উপদেশ দেয়া, ভয় দেখানো, সতর্ক করা।
§
মক্কী জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ঃ
-
মাদানী সূরা গুলো নাযিলের সময়কাল প্রায় জানা অথবা সমান্য
চেষ্ট করলে সময়কাল চিহ্নিত করা যায়।
-
মাক্কী সূরা নাযিলের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। খুব কম সংখ্যক মক্কী সূরা রয়েছে, যার নাযিলের সময়কাল ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে নির্ভুল ও
নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যায়। কারণঃ
§ মক্কী যুগের খুটিনাটি আলোচনা
ইতিহাসে কম হয়েছে। তুলনামূলক ভাবে মাদানী যুগের আলোচনা বেশী হয়েছে।
§ মক্কী সূরা গুলোতে ঐতিহাসিক
সাক্ষ্য প্রমানের বদলে সূরার বিষয়বস্তু, আলোচ্য বিষয় ও বর্ণনা পদ্ধিতি, নাযিলের পটভূমি
সংক্রান্ত ইংগিত ইত্যাদির
উপর নির্ভর করতে হয়েছে।
§ বিধায় মক্কী সূরার গুলো নাযিলের
সুনির্দিষ্ট সময় ও প্রেক্ষাপট বলা মুশকিল।
§ গবেষণা ও অনুসন্ধানের
পদ্ধতি অনুসরণ করে নবী সা.এর মক্কী জীবনের ইলামী দাওয়াতের দৃষ্টিকোণ থেকে চারটি
প্রধান প্রধান ও উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে লক্ষ করা যায়ঃ
১. তিন বছরঃ নবুওয়াতের সূচনা থেকে নবুওয়াতের
প্রকাশ্য ঘোষণা পর্যন্ত।
- এ সময় গোপনে দাওয়াতী কাজ
চলে।
- বিশেষ ব্যক্তিদেরকে
দাওয়াত দেয়া হয়।
- মক্কার সাধারণ লোকেরা এ দাওয়াত
সম্পর্কে কিছুই জানতো না।
২. দুই বছরঃ নবুওয়াতের প্রকাশ্য ঘোষণার পর থেকে জুলুম-নির্যাতনের
শুরু পর্যন্ত।
- এ সময় বিরোধিতা শুরু হয়।
- বিরোধীতা প্রতিরোধের রূপ
নেয়।
- বিরোধীতা ঠাট্টা, বিদ্রুপ, উপহাস,
দোষারোপ, গালিগালাজ, মিথ্যা
প্রচারণা এবং জোটবদ্ধভাবে বিরোধিতা পর্যায়ে পৌঁছে।
- মুসলমানদের ওপর
জুলুম-নির্যাতন শুরু হয়ে যায়।
- যারা তুলনামূলকভাবে বেশী
গরীব, দুর্বল ও আত্মীয় বান্ধবহীন
ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে তারাই হয় সর্বাধিক নির্যাতনের শিকার।
৩. পাঁচ বছরঃ চরম বিরোধীতার সূচনা তথা নবুয়াতের ৫ম বছর থেকে ১০ বছর পর্যন্ত।
- এ সময় আবু তালিব ও হযরত
খাদীজা রা. ইন্তিকাল করেন।
- এ সময়ে বিরোধীতা চরম আকার
ধারণ করতে থাকে।
- কাফেরদের
জুলুম-নির্যাতনের কারণ মুসলমানদের আবিসিনিয়া হিজরত।
- নবী সা. তাঁর পরিবারবর্গ
ও অন্যান্য মুসলমানদেরসহ আর্থনৈতিক ও সামাজিক বয়কট। রাসূল সা. তাঁর সমর্থক ও
সংগী-সাথীদের নিয়ে শিয়াবে আবু তালিবে অবরুদ্ধ হওয়া।
৪. তিন বছরঃ নবুওয়াতের দশম বছর থেকে ১৩শ বছর পর্যন্ত।
- যা ছিল নবী সা. ও তাঁর সাথীদের জন্য সবচেয়ে কঠিন ও বিপজ্জনক
সময়। যখন মুসলমানদের জন্য মক্কায় জীবন যাপন করা কঠিন হয়ে উঠেছিল।
- দাওয়াতের জন্য রাসূল সা. তায়েফে গেলেন। সেখানেও আশ্রয় পেলেন না।
- হজ্জের সময় আরবের সকল গোত্রকে
দাওয়াত দেয়া হলো। কিন্তু কোন সাড়া মিলল না।
- মক্কাবাসী রাসূল সা.কে হত্যা বা বন্দী করা বা এলাকা থেকে বিতাড়িত
করার ফন্দি করলো।
- অবশেষে আল্লাহ আনসারদের মনের
দুয়ার খুলে দিলেন। রাসূল সা. মদীনায় হিজরত
করলেন।
§
উপরোক্ত পর্যায় সমূহে কুরআনে হাকীমের বিভিন্ন আয়াতে নাযিল
হয়। এসব আয়াতে যে সব ইংগিত পাওয়া যায়, তা থেকে সেই সময়কার পটভূমি ফোটে উঠে। আর সেই সব প্রেক্ষাপট থেকে আয়াত বা সূরাকে মক্কী বলে নির্ধারণ করা হয়েছে।
ব্যাখ্যাঃ
﴿ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ
وَجَعَلَ الظُّلُمَاتِ وَالنُّورَ ۖ ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ
يَعْدِلُونَ﴾
১) প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং অন্ধকার ও আলোর উৎপত্তি ঘটিয়েছেন।তবুও সত্যের দাওয়াত অস্বীকারকারীরা অন্যদেরকে তাদের
রবের সমকক্ষ দাঁড় করাচ্ছে।
§
এ আয়াত মুশরিকদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে।
-
মুশরিকরা স্বীকার করতো যে, আকাশ আর পৃথিবীর স্রষ্টা হচ্ছেন আল্লাহ
তায়ালা। আল্লাহই রাতে ও দিনের উদ্ভব ঘটান। আল্লাহই চন্দ্র ও সূর্যকে অস্তিত্ব দান করেন।
-
মুশরিকরা মনে করতো যে, তাদের উপাস্য লাত বা উযযা
কিংবা হোবল অথবা অন্য কোন দেবদেবী এই কাজ করতে অক্ষম এবং তারা তা করতেছে না।
-
তাই এখানে সেই বিশ্বাসী মুশরিকদের উদ্দেশ্য করা হচ্ছেঃ
হে মূর্খরা! তোমরা যেখানে
নিজেরাই স্বীকার করো যে, পৃথিবী ও আসমানের স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা
এবং দিন রাত তারই ইশারায় হয়। তাহলে কেন তোমরা তিনি ছাড়া অন্যের সামনে সিজদা করো? কেন তাদেরকে নযরানা দাও? কেন তাদের কাছে প্রার্থনা করো? কেন তাদের কাছে অভাব-অভিযোগ পেশ করো?
-
এদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হয়েছে সূরা ফাতহঃ টিকা-২, সূরা বাকারা টীকা-১৬৩
§
الظُّلُمَاتِ আলোর মোকাবিলায় 'অন্ধকার' শব্দটিকে বহুবচনে উপস্থাপিত করা
হচ্ছে। কেন?
-
কারণ, অন্ধকার বলা হয় আলোবিহীনতাকে আর আলোবিহীনতার রয়েছে অসংখ্যা
পর্যায়। তাই আলো এক বা একক এবং অন্ধকার একাধিক, বহু।
-
ভাল জিনিসকে এক বচনে এবং খারাপ জিনিসকে বহু বচনে
ব্যবহার কুরআনের রেওয়াজ। যেমনঃ
﴿أَوَلَمْ
يَرَوْا إِلَىٰ مَا خَلَقَ اللَّهُ مِن شَيْءٍ يَتَفَيَّأُ ظِلَالُهُ عَنِ
الْيَمِينِ وَالشَّمَائِلِ سُجَّدًا لِّلَّهِ وَهُمْ دَاخِرُونَ﴾
আর তারা কি আল্লাহর
সৃষ্ট কোনো জিনিসই দেখে না, কিভাবে তার ছায়া ডাইনে বাঁয়ে ঢলে পড়ে আল্লাহকে সিজদা
করছে? সবাই এভাবে দীনতার প্রকাশ করে চলছে।(সূরা আন নাহল: ৪৮)
﴿وَأَنَّ
هَٰذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ
فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ ۚ ذَٰلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ لَعَلَّكُمْ
تَتَّقُونَ﴾
এ ছাড়াও
তাঁর নির্দেশ হচ্ছে এইঃ এটিই আমার সোজা পথ।তোমরা এ পথেই চলো এবং অন্য পথে চলো
না।কারণ তা তোমাদের তাঁর পথ থেকে সরিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেবে। এ হেদায়াত তোমাদের রব তোমাদেরকে দিয়েছেন, সম্ভবত
তোমরা বাঁকা পথ অবলম্বন করা থেকে বাঁচতে পারবে।
(সূরা আল-আনআম: ১৫৩)
-
আলোর আগে অন্ধকার উল্লেখ করা হয়েছে এজন্য যে, অন্ধকারটা হচ্ছে আসল রূপ। স্বাভাবিকতায় সব কিছু
অন্ধকার। আর আলো যেখানে অনুপস্থিত থাকে, সেখানে জায়গাটা অটোমেটিক
অন্ধকারই থাকে।
§
السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ আকাশকে বহু বচন আর জমীনকে এক বচনে কেন ব্যবহার করা হয়েছে?
-
আকাশ যেমন ৭টি, জমিনও ৭টি।
-
আকাশ সমূহ আকার ও প্রকৃতির দিক দিয়ে একটি থেকে অন্যটি
ভিন্ন। কিন্তু জমীন সবক‘টি সমআকৃতি
ও বৈশিষ্ট সম্পন্ন।
§
خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَجَعَلَ الظُّلُمَاتِ وَالنُّورَ এখানে السَّمَاوَاتِ
وَالْأَرْضَ এর সাথে خَلَقَ ব্যবহার করা হয়েছে। আর الظُّلُمَاتِ
وَالنُّورَ এর সাথে جَعَلَ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কেন?
-
আকাশ ও যমীন হচ্ছে স্বতন্ত্র ও স্বনির্ভর বস্তু-যা পরিবর্তন হবে না। আর আলো এবং অন্ধকার পরনির্ভর, আনুষাঙ্গিক ও গুণবাচক বিষয়-যা যে কোন সময় পরিবর্তন হতে পারে।
§
ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُونَ তবুও সত্যের দাওয়াত অস্বীকারকারীরা অন্যদেরকে তাদের রবের
সমকক্ষ দাঁড় করাচ্ছে।
- রবের সমকক্ষ কিভাবে দাড় করায়? যেমন:
o মুজুসী বা অগ্নিপূজকরা দুই
স্রষ্টায় বিশ্বাসী। ১. ভালোর স্রষ্টা-ইয়াজদা বা ইয়াজদান। ২. খারাপের স্রষ্টা-আহরেমান বা আহরামান। তাদের মতে এই দুই স্রষ্টা হলো নূর ও জুলুমাত। ইয়াজদান হলো মঙ্গলের স্রষ্টা
আর আহরামান হলো অমঙ্গলের স্রষ্টা।
o ভারতের মুশেরেকরা ৩৩ কোটি দেবতায় বিশ্বাসী। আর্য সমাজের মতে আল্লাহ সৃষ্টি ও গুনাবলী দুই বস্তুর মুখাপেক্ষী।
o খৃষ্টানরা পিতা পুত্রের ক্ষমতার
ভারসাম্য রক্ষা করতে তিনের এক এবং একের তিন মতবাদে বিশ্বাসী।
o ইহুদীরা আল্লাহর এমন সব গুনাবলী
সাবস্ত করেছে, যার মাধ্যমে
সাধারণ মানুষ আল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ট হতে পারে।
o আরবের মুশরেকরা খোদায়ী বন্টন
করেছে উদার হস্তে। তারা পাহাড়ের প্রতিটি পাথর, আগুন-পানি, সূর্য-তারা, গাছ-পাথর, জন্তু-জানোয়ার এমন কিছুই বাদ রাখেনি। সব কিছুকে খোদায়ীর অংশ দিয়েছে।
- রবের সমকক্ষ কিভাবে দাড় করায়? এটা কাদের উদ্দেশ্য করা হয়েছে?
o ইবনে আবযা রাহ. এর মতেঃ কিতাবীদের উদ্দেশ্যে।
o কাতাদাহ রাহ. আহলুস সুরাহিয়্যাহদের উদ্দেশ্যে।
o ইমাম সুদ্দী রাহ. মুশরিকদের উদ্দেশ্যে।
o ইবনে ওয়াহাব বলেন ইবনে যায়েদ
বলেছেনঃ তারা যে সব দেবতার পূজা করে এবং সে গুলোকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে ফেলে।
﴿هُوَ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن طِينٍ ثُمَّ قَضَىٰ أَجَلًا ۖ
وَأَجَلٌ مُّسَمًّى عِندَهُ ۖ ثُمَّ أَنتُمْ تَمْتَرُونَ﴾
২) তিনিই তো তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। তারপর তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন জীবনের একটি সময়সীমা এবং আর একটি
সময়সীমাও আছে, যা তাঁর কাছে স্থিরীকৃত, কিন্তু তোমরা কেবল সন্দেহেই লিপ্ত
রয়েছে। মাটি থেকে
§ مِّن طِينٍ মাটি থেকে।
-
মানুষের শরীরের পুরো অংশ মাটি থেকে। এর সামান্যতম অংশও মাটি ছাড়া নয়। তাই এখানে বলা হয়েছে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে- خَلَقَكُم مِّن طِينٍ
-
আদম আ.কে যে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে পৃথিবীর
সকল অংশের মাটির অংশ রয়েছে। যার কারণে আদম সন্তানের বর্ণ, আঁকার, চরিত্র,
অভ্যাস বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। যেমনঃ কৃষ্ণ, স্বত, লাল,
কঠোর, নম্র, পবিত্র স্বভাবের,
অপবিত্র স্বভাবের ইত্যাদি। (মাযহারী)
-
মাটি থেকে সৃষ্টি হয় খাদ্য, খাদ্য থেকে বীর্য আর বীর্য থেকে মানুষ।
-
১ম আয়াতে বড় জগত সৃষ্টির কথা বলা হলো। ২য় আয়াতে বলা হচ্ছে ছোট জগত-মানুষ সৃষ্টি কথা। বড় জগত ধবংসের মাধ্যমে বড় কিয়ামত শুরু হবে। আর ছোট জগত তথা মানুষের মৃত্যুর মাধ্যমে ছোট কিয়ামত শুরু হবে: مَنْ
مَاتَ فَقَدْ قَامَتْ قِيَامَتُهُ
§ وَأَجَلٌ مُّسَمًّى عِندَهُ এবং আর একটি সময়সীমাও আছে, যা তাঁর কাছে স্থিরীকৃত।
-
এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে কিয়ামতের সময়কে। যখন আগের ও পরের সকল মানুষকে নতুন করে জীবিত করা হবে এবং তাদের সমস্ত কাজের হিসাব
দেয়ার জন্য তাদের মালিকের সামনে উপস্থিত করা হবে।
-
وَأَجَلٌ
مُّسَمًّى দ্বারা মানুষের মৃত্যুকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ মানুষের স্থায়িত্ব ও হায়াত
নির্ধারণ করে রেখেছেন। মানুষের হায়াত সম্পর্কে মানুষের জানা নেই। কিন্তু
ফেরেশতাদের জানা রয়েছে।
-
وَأَجَلٌ
مُّسَمًّى দ্বারা কিয়ামত বুঝানো হয়েছে। এই
সম্পর্কে মানুষের যেমন জানা নেই, ফেরেশতাদেরও তেমন জানা
নেই।
﴿وَهُوَ اللَّهُ فِي السَّمَاوَاتِ وَفِي الْأَرْضِ ۖ يَعْلَمُ
سِرَّكُمْ وَجَهْرَكُمْ وَيَعْلَمُ مَا تَكْسِبُونَ﴾
৩) তিনিই এক আল্লাহ আকাশেও আছেন এবং পৃথিবীতেও, তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সব অবস্থান জানেন এবং ভালো বা মন্দ
যা-ই তোমাদের উপার্জন করো তাও তিনি ভালোভাবেই অবগত।
- যে আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীর
সকল বিষয় অবগত, সেই আল্লাহ
ভাল করেই অবগত যে, তোমাদের কোন পথে কল্যাণ আর কোন পথে অকল্যান।
﴿وَمَا تَأْتِيهِم مِّنْ آيَةٍ مِّنْ آيَاتِ رَبِّهِمْ إِلَّا
كَانُوا عَنْهَا مُعْرِضِينَ﴾
৪) মানুষের অবস্থা দাঁড়িয়েছে এই যে, তাদের রবের নিদর্শনসমূহের মধ্য থেকে এমন কোন নিদর্শন নেই যা
তাদের সামনে আসার পর তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি।
-
এখানে অমনযোগী মানুষের হঠকারিতা ও সত্যবিরোধী জেদ-এর উল্লেখ করা হয়েছে।
-
آيَاتِ رَبِّهِمْ
বলতে এখানে প্রাকৃতিকও হতে
পারে আবার নাযিলকৃত আয়াতও হতে পারে।
﴿فَقَدْ كَذَّبُوا بِالْحَقِّ لَمَّا جَاءَهُمْ ۖ فَسَوْفَ
يَأْتِيهِمْ أَنبَاءُ مَا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ﴾
৫) অনুরূপভাবে এখন যে সত্য তাদের কাছে এসেছে তাকেও তারা মিথ্যা বলেছে। ঠিক আছে, এতদিন পর্যন্ত যা নিয়ে তারা ঠাট্টা বিদ্রুপ করে এসেছে
শীঘ্রই সে সম্পর্কে কিছু খবর তাদের কাছে পৌঁছুবে।
§ فَقَدْ كَذَّبُوا بِالْحَقِّ لَمَّا
جَاءَهُمْ অনুরূপভাবে এখন যে সত্য তাদের কাছে
এসেছে তাকেও তারা মিথ্যা বলেছে।
-
এখানে সত্য বলতে দুইটি হতে পারে। ১. আল কুরআন। ২. রাসূল সা. এর ব্যক্তিত্ব।
-
রাসূল সা. ৪০ বছর থেকে তাদের মাঝে আছেন। তারা জানতো যে নবী সা. একজন অক্ষর জ্ঞানহীন মানুষ। যারা সাথে লেখা পড়া, সাহিত্য চর্চা,
কবিতা ইত্যাদির কোন সম্পর্ক নাই। তিনি হঠাৎ করে নিগুড় তত্ত্ব, আধ্যাত্মবিদ্যা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের দার্শনিক তথ্য, উচ্চাঙ্গের কবিতা ও সাহিত্য উপস্থাপন করছেন। কুরআন সে সব বর্ণনা করছে। তার নবী হওয়া বা কুরআন আসমানী কিতাব হওয়ার ব্যাপারে এর চেয়ে বড় সত্য আর কি হতে
পারে।
§ فَسَوْفَ يَأْتِيهِمْ أَنبَاءُ শীঘ্রই সে
সম্পর্কে কিছু খবর তাদের কাছে পৌঁছুবে।
-
এর দ্বারা হিজরত এবং হিজরত পরবর্তী সময়ে একের পর এক ইসলামের
বিজয়ের দিকে ইংগিত করা হয়েছে।
-
এই ইংগিতের মাধ্যমে কোন ধরণের খবর বুঝানো হয়েছে, তা তখনকার কাফেররা কল্পনা করতে পারেনি। এমনকি মুসলমানদেরও এ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলনা। শুধু তাই নয়, নবী সা.ও ভবিষ্যতের
এই সম্ভাবনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না।
﴿أَلَمْ يَرَوْا كَمْ أَهْلَكْنَا مِن قَبْلِهِم مِّن قَرْنٍ
مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ مَا لَمْ نُمَكِّن لَّكُمْ وَأَرْسَلْنَا السَّمَاءَ
عَلَيْهِم مِّدْرَارًا وَجَعَلْنَا الْأَنْهَارَ تَجْرِي مِن تَحْتِهِمْ
فَأَهْلَكْنَاهُم بِذُنُوبِهِمْ وَأَنشَأْنَا مِن بَعْدِهِمْ قَرْنًا آخَرِينَ﴾
৬) তারা কি দেখেনি তাদের পূর্বে এমনি ধরনের কত মানব গোষ্ঠীকে আমি ধ্বংস করেছি, যারা নিজ নিজ যুগে ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপশালী? পৃথিবীতে তাদেরকে এমন কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম, যা তোমাদেরকেও দেইনি।তাদের ওপর আকাশ থেকে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম এবং তাদের পাদদেশে নদী
প্রবাহিত করেছিলাম। (কিন্তু যখন তারা
নিয়ামতের প্রতি অকৃজ্ঞতা প্রকাশ করলো তখন) অবশেষে তাদের গোনাহের কারণে তাদেরকে
ধ্বংস করে দিয়েছি এবং তাদের জায়গায় পরবর্তী যুগের মানবগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছি।
§ قَرْنٍ এর অনেক অর্থ রয়েছে। যেমনঃ
-
সম্প্রদায়।
-
সম সাময়িক লোক সমাজ।
-
সূদীর্ঘ কাল।
-
১০ বছর থেকে ১০০ বছর সময়কাল।
-
এক শতাব্দি।
-
নবী সা. সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে বিশর মায়োনী রা. কে বলেছিলেনঃ তুমি এক কারণ পর্যন্ত জীবিত থাকবে। উল্লেখ্য যে, তিনি পুরো
১০০ বছর জীবিত ছিলেন।
-
কোন এক বালকের জন্য রাসূল সা. দোয়া করেছিলেনঃ তুমি ১০০ বছর জীবিত থাকো। বালকটি পূর্ণ ১০০ বছর জীবিত ছিল।
-
خيرُ القرونِ قرْني,
ثمَّ الَّذين يلونَهم, ثمَّ الَّذين يلونَهم এই হাদীসের তরজমা অধিকাংশ
উলামায়ে কিরাম ১ শতাব্দি করেছেন।
§ এখানে
সেই সব জাতির উদাহরণ পেশ করা হয়েছে, যাদেরকে আল্লাহ দুনিয়ার জীবনে শক্তি দিয়েছিলেন এবং জীবন যাপনের
সাজ-সরঞ্জাম দিয়েছিলেন, যা তাদের পরবর্তীদের
দেননি। কিন্তু তারা সেই সময়ে
রাসূলদের আনুগত্য করেনি। ফলে তাদের প্রতি আযাব
এসেছিল। তখন তাদের সেই সব
শক্তি ও সরঞ্জাম তাদের রক্ষা করতে পারেনি।
§ মক্কাবাসীদের
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যে, আদ-সামুদের মতো শক্তিবল তাদের নেই। সিরিয়া
ও ইয়ামানের মতো স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবনের অধিকারীও তারা নয়। বিধায়, অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো। বিরোধীতা করার আগে
অতীতের সেই সব জাতির পরিণতি চিন্তা করো।
﴿وَلَوْ نَزَّلْنَا عَلَيْكَ كِتَابًا فِي قِرْطَاسٍ فَلَمَسُوهُ
بِأَيْدِيهِمْ لَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ هَٰذَا إِلَّا سِحْرٌ مُّبِينٌ﴾
৭) হে নবী! যদি তোমরা প্রতি কাগজে লেখা কোন কিতাবও নাযিল করতাম এবং লোকেরা
নিজেদের হাত দিয়ে তা স্পর্শ করেও দেখে নিতো, তাহলেও আজ যারা সত্যকে অস্বীকার করছে তারা তখন বলতো, এটা সুস্পষ্ট যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়।
§ হেদায়াত প্রদান বিষয়টি
আল্লাহর একান্তু মেহেরবানী। কেউ হেদায়াত গ্রহণ
করতে চাইলেও আল্লাহ
দেন না। আবার
কেউ হেদায়াত গ্রহণ
করবেনা বলে দৃষ্টতা
দেখালেও তাকে আল্লাহ
হেদায়াত দিয়ে দেন।
§ হেদায়াতের পক্ষে লিখিত
কিতাব আনার দাবী
পুরণ করলেও এক
পক্ষ বলবে, إِنْ هَٰذَا إِلَّا سِحْرٌ
مُّبِينٌ এটা
সুস্পষ্ট যাদু ছাড়া
আর কিছু নয়।
§ অপর দিকে দৃষ্টতা
দেখানো ব্যক্তিকেও আল্লাহ
হেদায়াত দেন। যেমন:
আব্দুল্লাহ ইবনে আবী
উমাইয়া রা. ইসলাম
গ্রহণের আগে রাসূল
সা. এর কাছে
হঠকারিতামূলক উক্তি করে
বলেন: আমি আপনার
প্রতি ততক্ষণ পর্যন্ত
ঈমান আনতে পারিনা,
যে পর্যন্ত না
আপনাকে আকাশে আরোহন
করে একটি কিতাব
নিয়ে আসতে না
দেখবো। কিতাবের মধ্যে
আমার নাম উল্লেখ
করে লিখা থাকবে:
হে আব্দুল্লাহ! রাসূলের প্রতি
বিশ্বাস স্থাপন করো। আপনি এগুলো করে
দেখালেও আমার মুসলমান
হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীন।
উল্লেখ্য
যে, আসমান থেকে
নাম লিখা কিতাব
আনতে হয়নি। কিন্তু
আব্দুল্লাহ এক সময়
ইসলাম গ্রহণই শুধু
করেননি। সারা জীবন
ইসলামের পক্ষে যুদ্ধ
করতে করতে গাজী
হয়ে অবশেষে তায়েফ
যুদ্ধে শাহাদাত বরণ
করেন।
§ ফেরেশতা দেখাঃ
-
যা মানুষের জন্য সম্ভব না। যদি ফেরেশতারা নিজ সুরতে মানুষের
সামনে আসে, তাহলে মানুষ
তা এক মিনিটও সহ্য করতে পারবেনা। ভয়ে আতংকে তাদের প্রাণ বের হয়ে যাবে।
-
ফেরেশতাদের আসল সুরতে দেখা কেবল নবীদের পক্ষে সম্ভব।
-
নবী সা. সারা জীবনে মাত্র ২বার জিব্রিলকে আসল সুরতে দেখেছেন।
﴿وَقَالُوا لَوْلَا أُنزِلَ عَلَيْهِ مَلَكٌ ۖ وَلَوْ أَنزَلْنَا
مَلَكًا لَّقُضِيَ الْأَمْرُ ثُمَّ لَا يُنظَرُونَ﴾
৮) তারা বলে, এ নবীর কাছে কোন
ফেরেশতা পাঠানো হয় না কেন? যদি ফেরেশতা পাঠাতাম, তাহলে এতদিনে কবেই ফায়সালা হয়ে যেতো, তখন তাদেরকে আর কোন অবকাশই দেয়া হতো না।
§ ا لَوْلَا أُنزِلَ عَلَيْهِ مَلَكٌ এ নবীর কাছে কোন ফেরেশতা পাঠানো হয় না কেন?
-
কাফেরদের অভিমত: আল্লাহর পক্ষ থেকে যেহেতু নবী হিসাবে পাঠানো হয়েছে, তাহলে সাথে আকাশ থেকে একজন ফেরেশতাও পাঠানো উচিত ছিল। যে ফেরেশতা লোকদের ডেকে ডেকে বলবে: ইনি আল্লাহ নবী, তার কথা মেনে চলো,
নাহলে শাস্তি পেতে হবে।
-
কাফেরদের কাছে অবাক করা বিষয় ছিল: মহাশক্তিশালী আল্লাহ একজনকে রাসূল নিযুক্ত
করবেন, আর সে মানুষের গালিগালাজ ও নির্যাতন সহ্য করবে-এমন অসহায় অবস্থান আল্লাহ তাকে ছেড়ে দেবেন-এটা কেমন করে
হতে পারে? এতো মহীয়ানের দূত, তার সাথে থাকবে
রাজকীয় বহর, আমলা-কর্মচারী-আরদালী হিসাবে থাকবে ফেরেশতা, যারা কাতে হেফাজক করবে। মানুষের উপর প্রভাব বিস্তারে যা সাহায্য করতো। মানুষ অটোমেটিক বুঝে ফেলতো। আর সে অলৌকিক ভাব তার দায়িত্ব সম্পাদন করবে।
§ وَلَوْ أَنزَلْنَا مَلَكًا لَّقُضِيَ
الْأَمْرُ ثُمَّ لَا يُنظَرُونَ যদি ফেরেশতা
পাঠাতাম, তাহলে এতদিনে কবেই
ফায়সালা হয়ে যেতো, তখন তাদেরকে আর কোন অবকাশই দেয়া হতো না।
-
এটা হলো ا لَوْلَا
أُنزِلَ عَلَيْهِ مَلَكٌ এর প্রথম জবাব। এর অর্থ হচ্ছে:
o অবকাশ ততক্ষণ দেয়া হয়, যতক্ষণ সত্য অদৃশ্য থাকে, পর্দার অন্তরালে গোপন থাকে।
o সত্য প্রকাশিত হওয়ার সাথে
সাথে অবকাশের সুযোগ শেষ হয়ে যায়।
o সত্য প্রকাশের পর যা বাকী
থাকে, তাহলে কেবল হিসাব নেয়া।
o দুনিয়ার জীবন হলো পরীক্ষা
কাল আর পরীকার বিষয় হলো:
§
প্রকৃত সত্যকে না দেখে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির
ব্যবহার করে উপলব্দি করতে পারো কি না।
§
সত্যকে জানার পর নফস আর কামনা বাসনাকে
নিয়ন্ত্রন করে প্রকৃত সত্যের আলোকে নিজের কাজ করতে পারো কি না।
§
এই পরীক্ষার জন্য অদৃশ্য বস্তু অদৃশ্য
থাকাটা একটা অপরিহায্য শর্ত।
§
দুনিয়াতে যে অবকাশ দেয়া হচ্ছে, তা পরীক্ষার অবকাশ
ছাড়া আর কিছু নয় আর তা অদৃশ্য অদৃশ্য থাকা অবধি থাকবে।
§
অদৃশ্য যখন দৃশ্যমান হয়ে যাবে, তখন পরীক্ষার সময়
শেষ হয়ে যাবে।
§
এখন অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা তথা ফেরেশতাদের
আসল চেহারায় দাঁড় করিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। কারণ
আল্লাহ পরীক্ষার জন্য সময় দিতে চান।
-
এ সম্পর্কে আরো কথা বলা হয়েছে সূরা বাকারার ২১০ নম্বর
আয়াতে
﴿هَلْ
يَنظُرُونَ إِلَّا أَن يَأْتِيَهُمُ اللَّهُ فِي ظُلَلٍ مِّنَ الْغَمَامِ
وَالْمَلَائِكَةُ وَقُضِيَ الْأَمْرُ ۚ وَإِلَى اللَّهِ تُرْجَعُ الْأُمُورُ﴾
(এই সমস্ত উপদেশ ও হিদায়াতের পরও যদি লোকেরা সোজা পথে
না চলে, তাহলে) তারা কি এখন এই অপেক্ষায় বসে আছে যে, আল্লাহ
মেঘমালার ছায়া দিয়ে ফেরেশতাদের বিপুল জমায়েত সংগে নিয়ে নিজেই সামনে এসে যাবেন এবং
তখন সবকিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে? সমস্ত ব্যাপার তো শেষ পর্যন্ত আল্লাহরই সামনে
উপস্থাপিত হবে।
﴿وَلَوْ جَعَلْنَاهُ مَلَكًا لَّجَعَلْنَاهُ رَجُلًا وَلَلَبَسْنَا
عَلَيْهِم مَّا يَلْبِسُونَ﴾
৯) যদি ফেরেশতা পাঠাতাম তাহলেও তাকে মানুষের আকৃতিতেই পাঠাতাম এবং এভাবে
তাদেরকে ঠিক তেমনি সংশয়ে লিপ্ত করতাম যেমন তারা এখন লিপ্ত রয়েছে।
- এটা হলো ا لَوْلَا أُنزِلَ عَلَيْهِ مَلَكٌ এর দ্বিতীয় জবাব। এর অর্থ হচ্ছে:
o ফেরেশতারা তাদের আসল আকৃতি
তথা অদৃশ্য আকৃতিতে আসতে পারতো। কিন্তু তার সময় হয়নি।
o ফেরেশতারা মানুষের রূপ ধারণ
করেও আসতে পারতো।
o যদি মানুষের রূপ ধরে আসতো, তাহলে তারা যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত
হয়ে এসেছে একথার ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হতো। মানে তারা বিশ্বাস করতো না।
o
একই ভাবে মুহাম্মদ সা. এর নিযুক্তির ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।
﴿وَلَقَدِ اسْتُهْزِئَ بِرُسُلٍ مِّن قَبْلِكَ فَحَاقَ بِالَّذِينَ
سَخِرُوا مِنْهُم مَّا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ﴾
১০) হে মুহাম্মাদ ! তোমরা পূর্বেও অনেক রসূলের প্রতি বিদ্রূপ করা হয়েছে।কিন্তু বিদ্রূপকারীরা যে অকাট্য সত্য নিয়ে বিদ্রূপ
করতো, সেটাই অবশেষে তাদের ওপর চেপে
বসেছিল৷
শিক্ষাঃ
1.
আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি আর আলো অন্ধকারের নিয়মতান্ত্রিকতা
একথার প্রমাণ করে এর বর বা মালিক একজন। অতএব সেই মালিকের একক গোলামী করতে হবে। তার সাথে কাউকে অংশীদার করা যাবে না।
2.
আমরা সাধারণ মাটি থেকে সৃষ্টি এবং ফিরে যেতে হবে সেই মাটিতে। তাই আমাদের গর্ব অহংকারের কিছু নাই।
3.
আমাদের স্রষ্টা এমন এক সত্ত্বা, যিনি সর্বত্র বিরাজমান এবং আমাদের প্রতিটি
পদক্ষেপ তাঁর পর্যবেক্ষণের অধীন। আমাদেরকে সেই অনুভূতি নিয়ে সকল কাজ করতে হবে।
4.
এই জীবনই আমাদের শেষ নয়। আমাদেরকে এই জীবনের প্রতিটি
পদক্ষেপের জবাবদিহিতা করতে হবে আরেকটি জীবনে। জবাবদিহিতার সেই অনুভূতি নিয়ে
আমাদেরকে চলতে হবে।
5.
আমরা সর্ববস্তায় আল্লাহর নির্দেশের কাছে নিঃশর্ত মাথা
নত করতে হবে।
6.
দাওয়াতের কাজে বিরুধীতা করা ইসলামী আন্দোলনের চিরন্তন
নিয়ম। সকল যুক্তি এবং উপস্থাপনার বিরোদ্ধে বিরুধীতা আসবেই। একটি বিরোধীতার খন্ডন করার
সাথে সাথে আরেকটি বিরোধীতা আসা স্বাভাবিক। অতএব বিরোধীতা কি আসলো তা বিবেচনায় না নিয়ে আমাদেরকে দাওয়াত
অব্যাহত রাখতে হবে।
7. বিরোধীদের বিষয়টি আল্লাহর
জিম্মায়। একদিন তারা পাকড়াও হবেই। অতএব, তাদেরকে শায়েস্তা করার কাজটি আমাদেরকে না নিয়ে আমাদেরকে আমাদের
কাজ করে যেতে হবে।
0 Comments