মুহাম্মদ নজরুল ইসলামঃঃ শিবিরের মিছিলের
আমি এখন একজন নিয়মিত কর্মী। ১৯৮৬ সালের ঘটনা। আমার ক্লাশমিট জনাব মুজিবুর
রহমানের কুমন্ত্রনায় “লাভ ইন সিঙ্গাপুর” ছবিটি দেখেছিলাম কুলাউড়ার পুবালী
সিনেমা হলে। যে কথাটা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। এর পর থেকে প্রায় প্রতি
শুক্রবার আমি কুলাউড়ার যাত্রী ছিলাম। মুড়াউল থেকে জুমুয়ার সময়ে আমি লাতুর
ট্রেনে কুলাউড়াগামী হতাম। ফলে দীর্ঘদিন জুমুয়ার নামায কি মিস দেয়া স্বাভাবিক
হয়ে গিয়েছিল। আমার সংগী ছিলেন আমার পাশের বাড়ীতে থাকা শহীদ,
যার বাড়ী
তালিমপুরে। আরেকজন সাথী ছিলেন, যিনি আমার ছাত্র জামানার বন্ধু,
যিনি এখন
সমাজে আমার চেয়ে বেশী পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত বলে তার নামটা নিতে পারছিনা। আমরা
তিন বন্ধু জমিয়ে সিনেমা দেখতাম সেই জামানায়। বলা যায় সিনেমা জ্বরে আক্রান্ত
হয়ে আমরা অন্য যে কোন দুনিয়া থেকে ছিলাম বিচ্ছিন্ন, আর বিষয়টা
আমাদের
ক্লাশমিটদের সকলের জানা ছিল। আমার দায়িত্বশীলদের প্রায় সকলের জানা থাকলেও
তাদের হাবভাব এমন ছিল যে, তারা বিষয়টি জানেন না।
শিবিরের দায়িত্বশীলরা
সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমাকে শিবিরের সাথী করবেন। কিন্তু আমি যে
সিনেমা দেখি। আর
সিনেমা দেখলে যে সাথী হওয়া যায়না, তা আমার জানা ছিল। বিধায় আমি
সাথী হওয়ার প্রতি তেমন আগাচ্ছিলাম না। আমি না আগালে কি
হবে, আমাকে এগিয়ে
নেয়ার জন্য উনারা ভিতরে ভিতরে যুদ্ধ শুরু করেছেন।
শিবিরের সাথী
হওয়ার জন্য প্রথম শর্ত “নামায কাযা বন্ধ করা”। এই শর্ত যাতে আমি পুরোপুরি পালন করতে পারি,
সে জন্য শিবিরের
দায়িত্বশীলরা আমাকে রীতিমতো পাহারা দিতে শুরু করলেন। আমি যেখানে মাসে
মাত্র ১৫/২০ ওয়াক্ত নামায পড়তাম, এককথায় যখন সকলের সাথে থাকতাম-তখন নামায
পড়তাম, সেখান
থেকে পাহারা দিতে দিতে তারা জোহর আসর মাগরিব এবং এশার নামায জামায়াতে আদায়
করিয়েই ছাড়লেন। কিন্তু বাকী থাকলো ফজর। একদিন আমার প্রতি শমন জারি হলোঃ
রাতের খাবার শেষ করে ঘুমাতে হবে হাফেজ নিজাম ভাইয়ের রুমে। একই রুমে গৌছ ভাইও
থাকতেন। আমাকে বাধ্য হয়ে সেই নির্দেশ মানতে হলো। উনারা মূলতঃ পড়ালেখার
তত্ত্বাবধানের কথা বলে আমাকে রাতে উনাদের ওখানে নিয়ে যেতেন। কিন্তু তাদের মূল
টার্গেট ছিল পরবর্তী ফজরের নামায জামাতে পড়ানো। ধীরে ধীরে আমি ০৫ ওয়াক্ত
পাক্কা নামাযী হয়ে গেলাম।
বাকী থেকে
গেলো সিনেমা দেখা। শুক্রবারে যেহেতু আমি সিনেমা দেখতে যাই,
তাই দায়িত্বশীলরা
কৌশলে প্রতি শুক্রবারে আমার জন্য একটা কাজ রেডি করে রাখতেন।
আমি সাইকেল
চালনায় আগ্রহী ছিলাম। তারা আমাকে সাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে
যেতেন। তখনকার থানা সেক্রেটারী জনাব গৌছভাই সাইকেল চালাতে জানতেন না। তাকে
সাইকেলের ডান্ডায় বসিয়ে কত জায়গায় যে নিয়ে গিয়েছি, তার হিসাব কে
দেবে। বড়লেখার
রাস্তা গুলো তখন এখনকার মতো পিচঢালা ছিলনা। ভাঙা, কাদাযুক্ত, মাটির সড়ক দিয়ে আমরা দক্ষিণ ভাগ থেকে
সুড়িকান্দি এবং চান্দগ্রামে সফর করেছি নিয়মিত।
প্রতি শুক্রবারে
একটা না একটা কাজ থাকতোই। ভাবটা এমন যে, নজরুল ছাড়া এই কাজ হবেই না।
কিন্তু ভিতরে অবস্থা ছিল এমনঃ খোকা, দেখি এখন কিভাবে সিনেমা দেখতে যাও।
এই ভাবে চলতে চলতে দীর্ঘদিন আমার সিনেমা দেখাতে যাওয়া হচ্ছেনা। এদিকে দায়িত্বশীলদের
সাথে চলতে চলতে এবং উনাদের অশ্লীলতা ও বেহায়পনা বিরুধী এবং
পর্দা রক্ষা না
করার পরিনাম সংক্রান্ত মটিভেশনের একদিন আমি সত্যিই ধরা
খেলাম। নিজেকে
একদিন আবিস্কার করলাম সিনেমার বিরুদ্ধে একজন বক্তা হিসাবে।
কোন এক বৈঠকে
আমাকে অশ্লীলতার বিপক্ষে এবং পর্দা বিষয়ে কথা বলতে দেয়া হলো।
তখন আমি সিনেমার
বিরুদ্ধে কথা বললাম। এই দিনই দায়িত্বশীল এক সময় কানে কানে
বললেন,
লিমা তাকুলুনা
মা লা তাফয়ালুন-যা করোনা, তা বলো কেন? বললেন, আজ যা
বললে-তা তোমাকেই
প্রথম আমল করতে হবে।
এভাবেই
আমি একদিন সিনেমার মোহ ছেড়ে শামীল হলাম অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা বিরুধী মিছিলে। সেই
মিছিল চলছিলো, চলছে এবং তা যেন তাকে অব্যাহত।
0 Comments