সত্য ও সুন্দরের পথে অবিরাম পথ চলা-১৬
বোবারথল। যেখানে আমার দুইবার যাওয়া হয়েছে।
একবার ভ্রমনে আর আরেকবার দায়িত্ব পালনে। বোবারথল বলতে আমাদের সিনিয়র ভাই মাওলানাআব্দুস শাকুর সাহেব এর বাড়ী। ছাত্র জীবন শেষে উনি নিজের দূর্গম এলাকাকে শিক্ষার
আলো দেয়ার জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, সেই বিদ্যালয়ের তিনি শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন শুরু করে বিদ্যালয়কে
সরকারী করণ করে এখনো সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন বলে
দূর অতীতে জানি।
১৯৯১ সাল। কামিল পড়ার জন্য মৌলভী বাজারের
মুলিবাশের বেড়া দিয়ে তৈরী দেওয়ান মনজিলের আবাসস্থল ছেড়ে আমাকে চলে আসতে হলো সুজাউল
আলিয়া মাদ্রাসায়। মৌলভী বাজারে আগামীর অনেক সম্ভাবনাকে পিছনে ফেলে চলে আসতে হলো
নিজের এলাকার পাশে। তদানিন্তন জেলা আমীর দেওয়ান সিরাজুল ইসলাম মতলিব তার স্বভাবসুলব “একটু খানি মিষ্টি হাসি” দিয়ে আমাকে নিয়ে একান্ত বৈঠক করে মৌলভী বাজারেসেটেল হওয়ার নসিহত করলেও বাস্তবতা আমাকে নিয়ে আসলো আমার চেরচেনা ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ এর স্মৃতিময় আঙ্গিনায়। যেখানে আমি ৮ম, ৯ম ও ১০ম শ্রেণীতে অধ্যয়নপর্ব শেষে চলে গিয়েছিলাম পাথারিয়া গাংকুল মনসুরিয়া ফাজিল মাদ্রাসায়। সেখান থেকে আলিম পড়ে বড়লেখা উপজেলা সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে তদানিন্তন জেলা জেলা সভাপতি জনাব নজরুল ইসলাম শোয়েব এর নির্দেশ পালন করতে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৮৯ সালে মৌলভী বাজার টাউন সিনিয়র মাদ্রাসায় (যার বর্তমান নাম সম্ভবতঃ হযরত শাহ মোস্তাফা সিনিয়র মাদ্রাসা)। ১৯৯০ সালের শেষ অবধি স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন পর্যন্ত সেখানে রাজপথ কেন্দ্রীক ছিল তৎপরতা।
১৯৯০ সালের ফাজিল পরীক্ষা সেখান থেকে দেয়া। তারপর কামিল পড়ার তাগিদে আবার সুজাউল আলিয়া মাদ্রাসায়। মৌলভী বাজার শহর শাখার বায়তুলমাল সম্পাদক দিয়ে আমার দায়িত্ব শুরু হলেও কয়েকদিন পর আমাকে মৌলভী বাজার টাউন সিনিয়র মাদ্রাসার সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন সেক্রেটারী ছিলেন এখনকার ঢাকা মহানগরী উত্তর জামায়াতে ইসলামীর আমীর জনাব সেলিম উদ্দিনকে। তারপর আমি মৌলভী বাজার শহরের সেক্রেটারীর দায়িত্ব পাই। মাত্র মাস খানিক দায়িত্ব পালনের পর আমাকে মৌলভী বাজার সদর উপজেলা সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনের জন্য স্থানান্তর করা হয়। সেই দায়িত্বে জনাব হাফিজ ফারুক ভাইকে প্রদান করে আমি প্রত্যাবর্তন করি সুজাউল মাদ্রাসায়। হাফিজ ফারুক আহমদ এখন কানাডা প্রবাসী এবং সেখানে একটি প্রসিদ্ধ মসজিদের ইমাম ও খতিব।
সুজাউলে কামিল ক্লাসে ভর্তির সাথে সাথে ২টা
দায়িত্ব আমাকে দিয়ে দেয়া হলো।
একঃ বড়লেখা
উপজেলাকে ভেঙে দুই টুকরা করে বড়লেখা উত্তর আর দক্ষিণ করা হলো। আমাকে দেয়া হলো
উত্তর সাথী শাখার সভাপতির দায়িত্ব। সেখানে সাথী হিসাবে ছিলেন হাতে গোনা মাত্র
কয়েকজন। ১. বজলুর রহমান ফয়সল (মাইজগ্রাম, যিনি এখন লন্ডন প্রবাসী), ২. ফারুক উদ্দিন (কুমারশাইল, যিনি এখন আমেরিকার মিশিগানে প্রবাসী) আর ৩. আজীম উদ্দিন (সুজাউল, যিনি এখন অস্ট্রেলিয়াতে প্রবাসী)।
দুইঃ ছাত্র সংসদ সুজাউল মাদ্রাসা জিএস পদটি শুন্য ছিল। হাফিজ লুৎফুর রহমান (মরহুম) তখন ফাজিল শ্রেণীর ছাত্র হিসাবে এজিএস হিসাবে জিএস এর দায়িত্ব পালন করছিলেন। আমাকে শুণ্য সেই পদে দায়িত্ব পালন করার জন্য তদানিন্তন অধ্যক্ষ মাওলানা আজিজুর রহমান শাহবাগী হুজুর দায়িত্ব প্রদান করলেন।
একসাথে দুই দায়িত্ব পালন করতে আমাকে সাধারণ
ছাত্রছাত্রীদের মাঝে পরিচিত হতে সময় লাগেনি। তার মাঝে একজন ছাত্র ছিলেন, যার নাম নাসির উদ্দিন। যিনি ১০ম শ্রেণীতে পড়তেন। তার বাড়ী ছিল বোবারথলে।
কোন এক কারণে তাকে মাদ্রাসা থেকে তাকে বহিস্কার করা হয়। সেই সময়ে সুজাউল মাদ্রাসায়
এখনকার মতো শিবিরের একচেটিয়া প্রভাব ছিল না। ৯০শতাংশ ছাত্র শিবিরেকে ভালবাসলেও
পরিকল্পিত ভাবে ছিল আনজুমানে তালামিযে ইসলামিয়া ও ইসলামী ছাত্র মজলিসের তৎপরতা।
নাসির ছিলেন ছাত্র মজলিসের ডানপিঠে একজন কর্মী। যার কারণে পরিকল্পিত ভাবে আমার
থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। তিনি তার বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য অনেক
দুয়ারে ধর্ণা দিয়ে যখন ব্যর্থ হলেন, তখন আমার কাছে এলেন। আমি
তার বিষয়টা বিবেচনায় নিয়ে তার জন্য সুন্দর করে যতন করে একটি দরখাস্ত লিখলাম
মাদ্রাসা অধ্যক্ষ বরাবরে। দরখাস্তটা এমন ভাবে লিখা হলো যে, এটা
যেন বিফল হয়ে ফিরে না আসে।
মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের জন্য ৩ ধরণের সমস্যা
ছিল এই দরখাস্তটি। ১. শিবিরের স্থানীয় সভাপতির পক্ষ থেকে দরখাস্ত। ২. মাদ্রাসার
জিএস এর পক্ষ থেকে দরখাস্ত। ৩. দরখাস্তকারীর সাধারণ ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক মন্ডলী ও এলাকাবাসীর কাছে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা। অধ্যক্ষ
শাহবাগী হুজুর (মরহুম আজিজুর রহমান) সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য শিক্ষকদের মিটিং
ডাকলেন। তারাদরমের তৈয়বুর রহমান (ময়না স্যার) মনের মাধুরী মিশিয়ে দরখাস্তটি পড়লেন।
পড়ার পর দরখাস্ত লেখকের প্রশংসায় আরো নানান কথা বললেন। তার বক্তব্যের পর সকল
শিক্ষক আবেদন মনজুরের পক্ষে মত দিলেন। অধ্যক্ষ আমাকে ডাকলেন এবং বললেন, অভিযুক্ত নাসির এই ধরণের আচরণ ভবিষ্যতে করবে না, এই
মর্মে আমি নজরুল ইসলামকে লিখিত গ্যারান্টি দিতে হবে। আমি গ্যারান্টি দিলাম। সাথে
বলে দিলাম, এই মাদ্রাসার কোন ছাত্রের বিরুদ্ধে যখন কোন
অভিযোগ যাবে, তখন যেন তিনি প্রথমে তা নিষ্পত্তির জন্য
মাদ্রাসার জিএস এর কাছে পাঠিয়ে দেন। জিএস ব্যর্থ হলে উনার স্মরণাপন্ন হবেন। তিনি
অত্যন্ত খুশী হলেন এবং উনার অধ্যক্ষ জীবনের রেকর্ড হচ্ছেঃ আমি জিএস হিসাবে দায়িত্ব
পালনকালীন সময়ে উনাকে কোন ছাত্রের বিচার ফায়সালা করতে হয়নি।
অভিযুক্ত নাসিরকে নিয়ে আমার নিয়মিত চলাচল এখন
রুটিন ওয়ার্কে পরিণত হলো। ইতিমধ্যে নাসিরের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হলো।
কিন্তু নাসির আমার পিছু ছাড়লেন না। সব সময় আমার পিছনে থাকতে থাকতে এক সময় নিজেকে
ইসলামী ছাত্রশিবিরে আবিস্কার করলেন। শুনেছি শেষ সময় অবধি তিনি শিবিরের সাথী শপথও
নিয়েছিলেন। তার সাথে জীবনের সামগ্রিক ব্যস্ততায় পরে আর যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়ে
উঠেনি।
নাসির একদিন বায়না ধরলেন, তার সাথে তার বাড়ী বোবারথলে যেতে হবে। তার আম্মা নাকি আমাকে দাওয়াত
করেছেন। নাসিরের আম্মার মত কত আম্মার দাওয়াত আমার ক্ষুদ্র জীবনে কবুল করতে হয়েছে,
তার হিসাব বলা মুশকিল। অনেক আম্মাকে রাত ১২টার পর ঘুম থেকে উঠিয়ে
খাবার তৈরী করায়ে খেতে হয়েছে, অনেক আম্মাই পরম আদরে আমাকে
খাইয়ে তৃপ্তি পেয়েছেন। অনেক আম্মাই অভিযোগ করেছেন তার সন্তানের কাছে এই বলে যে,
ফুয়াটা অনেক দিন থেকে আসেনা। তুই দাওয়াত দেছ না কেন?
বোবারথল দেখার অনেক আগ্রহ আমার আগে থেকেই।
নাসিরের দাওয়াতটা পাওয়ার পর আগ্রহটা আরো বেড়ে গেল। একদিন পায়ে হেটে যাত্রা শুরু
করলাম বোবারথলে উদ্দেশ্যে, সাথে সুপ্রিয় নাসির। কিছু পথ হাটার পর যখন
উঁচু উঁচু টিলা আর পাহাড়ী দূর্গম পথ ফাঁড়ি দিতে গেলাম, তখন
ভাবলামঃ কতইনা ভূল করেছি দাওয়াতটা কবুল করে। কিন্তু যতদূর এসেছি, পিছনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নাই। এক সময় নাসির আমাকে নিয়ে হাজির হলেন এমন এক
জায়গায়, যেখানে দূর্গম পথও শেষ হয়ে গেছে। সামনে উঁচু পাহাড়,
পাহাড়ের উপরে একজন চলার মতো ছোট পথ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু পাহাড়ে উঠার কোন ব্যবস্থা নেই। তিনি দেখালেন, একটি গাছের লতা জাতীয় ডাল নেমে এসেছে পাহাড় থেকে রাস্তার নিচ পর্যন্ত। সেই
ডালকে শাঁকোর হাতলের মতো করে ধরতে হবে এবং তাকে ধরে বিল্ডিং এর নিচ থেকে রশি বেয়ে
উপরে উঠার মতো উঠতে হবে। নাসির এক ঝলকে উঠে গেলেন। কিন্তু আমি সাহস করতে
পারতেছিনা। অবশেষে উনার সাহস প্রদানের পর অনেক চেষ্টার পর পাহাড়ে উঠলাম। পাহাড়ে
অনেকখানি গিরিপথ ফাঁড়ি দিয়ে একটি প্রান্তরে পৌছলাম। সেখানে বিশাল সমতল প্রান্তর।
দেখে বুঝার উপায় নাই যে, এর আগে আমরা বিশাল পাহাড় অতিক্রম
করে এসেছি এবং যে সমতলে আমরা অবস্থান করছি, তাও এক বিরাট
পাহাড়ের উপর। তারপর আমরা আরো অনেক খানি হাটলাম। কিন্তু সেই জায়গাটা আর পাহাড় নয়।
বরং গ্রামের আঁকাবাঁকা ছায়াদার পথই মনে হলো। কিছুক্ষণ পরই চোঁখ পড়লো বিভিন্ন
ঘরবাড়ী।
পর্বঃ ২
লিখছিলাম বোবারথল এলাকায় প্রথম সফর নিয়ে। আর
আমরা চলতে চলতে এসে পৌছেছিলাম দূর্গম পাহাড় পেরিয়ে পাহাড়ের উপরের সমতল ভূমিতে, যেখানে রয়েছে গ্রামের আঁকাবাঁকা ছায়াদার পথ। দূর থেকে চোঁখে নজরে আসে
বিভিন্ন ঘরবাড়ী। নাসির ভাই আমার সংগী। নাসির ভাই একটু পর এক একটি এলাকার নাম বলে
যাচ্ছিলেন। সময়ের ব্যবধানে এর প্রত্যেকটি নামই আমি ভূলে গেছি। (প্রথম পর্ব পড়ার পর
কানাডা প্রবাসী হাফেজ ফারুক ভাই নাম গুলো স্মরণ করে দিলেন। আর তাহলোঃ ময়নার উটনি,
দশঘরি, ষাইটঘরি, গান্দাই,
বাশ মহাল, অর্তকি টিলা, আত্তিয়ালা
টিলা ইত্যাদি)।
(পাঠকের সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি, প্রথম পর্ব লিখার পর জীবনের বড় একটি পাওনা হাসিল হয়ে গেল। যে নাসিরকে নিয়ে
লিখছি, সেই নাসির আমার লেখাতে কমেন্ট করলেন। আমার সন্দেহ হলো,
সেই নাসির কিনা। পরে যোগাযোগ হলো, ফোন নম্বর
প্রদান করলেন, অনেক অনেক কথা হলো। তিনি এখন আমিরাতের রা’সুল
খিমায় প্রবাসী। একটি লিখার পর প্রায় ৩০ বছর পর একজন ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ হয়ে গেল)
বোবারথলের এক জায়গায় দাড়িয়ে তিনি বললেনঃ এই
যে এলাকাটি দেখা যাচ্ছে, ওটা বাংলাদেশ নয়-ওটা ভারত। দেখতে দেখতে
আমরা ভারতের সীমান্তে পৌছে গেলাম। ভারতে সীমান্তে নিয়মিত বিএসএফ পাহারা দেয়।
বোবারথলের গৃহ পালিত পশু-যেমন গরু ছাগল ইত্যাদি মাঝে মাঝে ভারতে চলে যায়। তখন তা
ফিরিয়ে আনার জন্য দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনী তথা বিডিআর ও বিএসএফ এর মধ্যে পতাকা
বৈঠক হয়। পতাকা বৈঠকের ধরণটাও তিনি বিস্তারিত বর্ণনা করলেন।
বোবারথলে যারা বাস করেন, তারা ডান দিকে অফিস বাজার (সুজাউল) আর বাম দিকে বড়লেখাতে যাতায়াত করেন।
অফিস বাজার যাওয়ার জন্য তারা বড়লেখা থেকে অফিস বাজার পৌছার আগেই দেওছড়া ব্রিজ
ফাঁড়ি দেয়ার পর ডান দিকে বালিশকোনার দিকে একটি চা বাগানের রাস্তা আছে। সেই চা
বাগানের ভিতর দিয়ে তারা অফিস বাজারে পৌছেন। এক সময় অফিস বাজার ছিল বোবারথলবাসীর
প্রধান বাজার। বোবারথলে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরণের ফলমূল ও সবজি বিক্রি হতো অফিস
বাজারে। আর বোবারথলবাসীও তাদের প্রয়োজনীয় বাজার সদাই করতেন অফিস বাজার থেকে। তখন
পুরো বড়লেখার যাতায়াতের একমাত্র বাহন ছিল মানুষের দুই পা।
অপর দিকে সময়ের ব্যবধানে ধীরে ধীরে মানুষ
বড়লেখামূখী হতে থাকেন। বড়লেখা থেকে শাহবাজপুর সড়ক দিয়ে গ্রামতলা অতিক্রম করলে ডান
দিকে ছোট লিখা চা বাগানের সড়ক পাওয়া যায়। যার শুরুতে বিডিআর ক্যাম্পের দিক
নির্দেশক পাকা করা একটি নামফলক রয়েছে। সড়ক দিয়ে চাবাগানের মধ্য দিয়ে বোবারথলে
পৌছতে হয়। ইদানিংকালে অফিস বাজার কেন্দ্রীক বোবারথলের মানুষের যাতায়াত একদম নাই
বললেই চলে। কারণ ছোটলিখা চা বাগানের রাস্তা দিয়ে গাড়ীতে করে বোবারথলের অনেক নিকটে
পৌছা যায়।
বোবারথল হলো বাংলাদেশের ফরমালিনমুক্ত সবজি আর
ফলমুলের অন্যতম যোগান দাতা। প্রতিদিন সকাল বেলা বড়লেখা বাজারে রাস্তার দুই ধারে
বিশাল সবজি বাজার বসে। যার প্রায় সকল বিক্রেতাই বোবারথলের। বোবারথলের শাক-সবজি, ফল-মূল অত্যন্ত টাটকা পাওয়া যায় ওখানে। পাইকাররা এখান থেকে ক্রয় করে বড়
ধরণের লট প্রেরণ করেন ঢাকার ব্যবসায়ীদের। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন
স্থানে।
নাসির ভাই এইসব বয়ান শুনাতে শুনাতে এক সময়
উনার বাড়ীতে নিয়ে আসলেন। উনার আম্মা নানাপদ খাবার দিয়ে সাজিয়ে দিলেন দস্তরখান। পরম
তৃপ্তিতে এসব খাবার খেলাম। সেখানে কি ধরণের আন্তরিকতা পেলাম, তা শুধু উপলব্দি করা যায় ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
কোন ভাবেই থাকা যাবে না এমন শর্তে আমি
বুবারথলে গিয়েছি। পরদিন জরুরী প্রোগ্রাম আছে। তাই চলে আসতে হবে। যেতে যেতেই খাবার
সময় হয়ে গেছে। খাওয়ার পর সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরতে না পারলে ফিরা কঠিন। তাই
বোবারথলে অনেক সময় থাকার সুযোগ হলো না। সময়ের দারিদ্রতায় সবটুকু দেখা হলো না। তৃপ্তি
রেখেই আবার নাসির ভাইকে সংগী করে ফিরে আসা। কিন্তু পথিমধ্যে অনুভব করলামঃ নাসির
ভাই তার মায়ের কাছে থেকে যেতে চায়। কিন্তু ভদ্রতার কারণে অথবা আমাকে একা কিভাবে
দেবে এই কারণে মুখ ফোটে বলতে পারছে না। আমি এই ভাষাটা ভাল পড়তে পারি বলে অনেকে
আমাকে বলেছেন। ঠিক এই কারণে আমি তা পড়ে ফেললাম। কিন্তু আমিও সমস্যায়। কারণ এই
দূর্গম পথ আমি একার পক্ষে ফাঁড়ি দেয়া সম্ভব নয়। এই ভাবে চলতে চলতে সেই পুরাতন
জায়গায় পৌছলাম। যেখানে এসে অনেক কষ্ট করে পাহাড়ে উঠেছিলাম। এখন নামার পালা। কিন্তু
নামার সময় অত্যন্ত সহজে নেমে গেলাম। নামার সাথে সাথে আমার বুকে সাহস তৈরী হলো।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এখান থেকে অফিস বাজার পৌছতে পৌছতে মাগরিরে
পর হয়ে যাবে। কিন্তু চা বাগান এলাকয় মাগরিবের সময় পৌছে যাবো। নাসির ভাইকে বললামঃ
আপনি ফিরে যান। আমি একাএকা চলে যাবো। আপনি ২/৪দিন বাড়ীতে বেড়িয়ে তারপর আসবেন।
নাসির ভাই আবেগাফ্লুত হয়ে পড়লেন। তার মনের কথা আমি কেমনে জানলাম। তাকে জোর করে
রেখে একাএকা অফিস বাজারের উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলাম। এভাবেই আমার প্রথম দফা
বোবারথল সফর শেষ হলো।
শুরুতেই বলেছিলাম, নাসির ভাই ছাত্র মজলিসের ডানপিঠে একজন কর্মী। তার সাথে বোবারথল সফরের আমার
গোপনীয় একটি কারণ ছিল। আমাদেরকে সেই সময়ে নসিহত করা হতো, দাওয়াতী
কাজে একটা উপাদান হলো ‘ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার ও সম্প্রীতি স্থাপন’। নাসির ভাইয়ের
সাথে এতো দিনের যোগাযোগের মাধ্যমে সম্প্রীতি স্থাপন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দাওয়াতী
কাজে আমার একটা ব্যক্তিগত টিপস ছিল, তাহলোঃ হয় আপনি তার
খাবার খাবেন, না হয় আপনি তাকে খাওয়াবেন। এতদিন আমি তাকে অনেক
খাইয়েছি, এখন তার খাওয়াটা আমার উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য সাধন
করতে লম্বা সময় তার সাথে অতিবাহিত করার মাধ্যমে ওয়াজের মাধ্যমে নয়, ব্যবহারের মাধ্যমে দাওয়াত প্রদান। এই সফরে সেই কাজটা আমার হয়ে গেল। এরপর
নাসির ভাইয়ের সাথে আমি যোগাযোগ করতে হয়নি। নাসির ভাই বিভিন্ন সময় খোঁজে খোঁজে
আমাকে বের করেছে।
দ্বিতীয় বারে বোবারথলে গিয়েছিলাম অতিথি হয়ে
একটি নির্বাচনী জনসভাতে। বড়লেখার মাটি ও মানুষের নেতা বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী
ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মালিক ভাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্ধন্দিতা করলেন বড়লেখা
আসন থেকে। আর তার সমর্থনে আয়োজিত হলো নির্বাচনী জনসভা। আমি সেখানে বিশেষ অতিথি।
তারুণ্যের সময়ে উলুবনে শিয়াল রাজা ছিলাম-বক্তাদের দূর্ভিক্ষের সময় মুটামুটি ভাল
বক্তা ছিলাম। তাই প্রায়ই মালিক ভাইয়ের সাথে আমাকে বিশেষ বক্তা রাখা হতো। আর মালিক
ভাইও আমাকে সাথে রাখতেন। তার বক্তৃতার আগে আমার বক্তৃতাটা তার বক্তৃতার পরিবেশ
তৈরীতে ভাল ভূমিকা রাখতো।
আমি যখন বড়লেখার দক্ষিণের সভাপতির দায়িত্ব
পালন করি, তখন দায়িত্ব পালনকালীন মালিক ভাইয়ের যে
সাপোর্ট পেয়েছি, তা সম্ভবত আর কোন সভাপতি পাননি। দায়িত্বপালনকালীন
সময়ে এবং তার পরে মালিক ভাইয়ের আনকুল্য পেয়েছি নানাপদে। মনে পড়ে তখন খালেদা জিয়ার
বিরুদ্ধে কেয়ারটেকার সরকারের আন্দোলন চলেছে। জলি ম্যানশনে তখন লিয়াজোঁ কমিটির
মিটিং হতো মকদ্দছ ভাইয়ের অফিসে। জাতীয় পার্টির উপজেলা সভাপতি হিসাবে একমাত্র তিনি
উপস্থিত থাকতেন। আওয়ামীলীগ থেকে উপস্থিত থাকতেন মরহুম সিরাজুল ইসলাম আর বর্তমান
এমপি তদানিন্তন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন ভাই। আর জামায়াতের পক্ষ থেকে
ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মালিক নামক বটবৃক্ষের সাথে আমি নজরুল ইসলাম নামক জোনাকি। জননেতা
ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মালিক আদ্যোপান্ত একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। তার সময়ের সিরাজ মিয়া,
শাহাবুদ্দিন ভাই, ফারুক ভাই এদেরকে কিভাবে
তিনি নাচাতেন, ওরা একটুও বুঝতো না। রাজনৈতিক ভাবে দল হিসাবে
বড়লেখায় জামায়াত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মালিক এর সময়ে।
ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মালিক সম্পর্কে আরেকটা কথা
বলতেই হয়। (শোনা কথা, তথ্যে একটু এদিক সেদিক হতে পারে) তিনি যখন
উপজেলা আমীর, তখন সংগঠনের পক্ষ থেকে আইকিউ টেস্ট বা সাধারণ
জ্ঞান ধরণের একটি পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। জনাব ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মালিক সেই টেস্টে
সারা দেশে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ফলে তাকে স্থানান্তরিত হয়ে ঢাকায় চলে গিয়ে
সেখানে কেন্দ্রীয় ইউনিটে দায়িত্ব পালন করার জন্য অধ্যাপক গোলাম আযম প্রস্তাব
পাঠিয়েছিলেন তদানিন্তন আঞ্চলিক দায়িত্বশীল অধ্যাপক ফজলুর রহমানের মাধ্যমে। কিন্তু
পারিবারিক সমস্যার কারণে মালিক ভাই সে প্রস্তাব থেকে রুখসত চেয়েছিলেন। এই ঘটনার
মাধ্যমে আমি বুঝাতে চাচ্ছি, মালিক ভাইয়ের মেধা কতটুকু সার্প
ছিল। চলে আসি বুবারথলে। সেই মালিক ভাইয়ের নির্বাচনী জনসভায় দাঁড়ি পাল্লার
সমর্থনে বোবারথল পৌছলাম। এবার গিয়েছি হোন্ডায় চড়ে, পায়ে হেটে
সব মিলিয়ে। নির্বাচনী জনসভায় গিয়ে আমি হতবাক। বোবারথলে বিদ্যুতের আলো ঝলমল করছে।
খবর নিয়ে দেখলামঃ জেনারেটর ব্যবহার করে বিদ্যুৎবাতি জ্বালানো হয় এখানে। এখানে গড়ে
উঠেছে প্রতিদিনকার বাজার। রাস্তাঘাটেরও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।
এই লেখার প্রথম পর্ব পড়ার পর ইনবক্সে অনেক
ভাই ভিডিও ক্লিপ পাঠালেন, যাতে দেখা যায় বোবারথল আর আগের সেই বোবারথল
নেই। অনেক এগিয়ে গেছে। একদিন পাকা রাস্তা মাড়িয়ে বোবারথল থেকে মানুষ যাবে দূর
দিগন্তে। আমরাও বোবারথল বেড়াতে যাবো পায়ে হেঁটে, ময়নার উঠনি
ফাঁড়ি দিয়ে নয়, সোজা গাড়ীতে করে।
দ্রষ্টব্যঃ আগামীতে যখন বাংলাদেশ সফরে যাবো, তখন গিয়েই Afm Shamsuddin এরসাথে যোগাযোগ করবো। উনার ব্যবস্থাপনায় একদিন আমরা পিকনিক করবো বোবারথলে। আমরা মেহমান হবো মাওলানা আব্দুস শাকুর ভাইয়ের। যারা যারা যেতে চান আমাদের সাথে, এই পোষ্টে লাইক দিয়ে রাখুন।
(ছবিঃ দৈনিক বাংলাদেশ আমার)
0 Comments