দারসুল কুরআন – সূরা আন নাহল – আয়াত ০১-০৯ – মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম

দারসুল কুরআন

 

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

তেলাওয়াত ও অনুবাদঃ

﴿أَتَىٰ أَمْرُ اللَّهِ فَلَا تَسْتَعْجِلُوهُ ۚ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾

এসে গেছে আল্লাহর ফায়সালা এখন আর একে ত্বরান্বিত করতে বলো নাপবিত্র তিনি এবং এরা যে শিরক করছে তার ঊর্ধে তিনি অবস্থান করেন

﴿يُنَزِّلُ الْمَلَائِكَةَ بِالرُّوحِ مِنْ أَمْرِهِ عَلَىٰ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ أَنْ أَنذِرُوا أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاتَّقُونِ﴾

তিনি এ রূহকে তাঁর নির্দেশানুসারে ফেরেশতাদের মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যার ওপর চান নাযিল করেন (এ হেদায়াত সহকারে যে, লোকদের) “জানিয়ে দাও, আমি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই কাজেই তোমরা আমাকেই ভয় করো”

﴿خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ ۚ تَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾

তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে সত্য সহকারে সৃষ্টি করেছেন এরা যে শিরক করছে তাঁর অবস্থান তার অনেক ঊর্ধে

﴿خَلَقَ الْإِنسَانَ مِن نُّطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُّبِينٌ﴾

তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ছোট্ট একটি ফোঁটা থেকে তারপর দেখতে দেখতে সে এক কলহপ্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে

﴿وَالْأَنْعَامَ خَلَقَهَا ۗ لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَافِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ﴾

তিনি পশু সৃষ্টি করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য পোশাক, খাদ্য এবং অন্যান্য নানাবিধ উপকারিতাও

﴿وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ﴾

তাদের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সৌন্দর্য যখন সকালে তোমরা তাদেরকে চারণ ভূমিতে পাঠাও এবং সন্ধ্যায় তাদেরকে ফিরিয়ে আনো

﴿وَتَحْمِلُ أَثْقَالَكُمْ إِلَىٰ بَلَدٍ لَّمْ تَكُونُوا بَالِغِيهِ إِلَّا بِشِقِّ الْأَنفُسِ ۚ إِنَّ رَبَّكُمْ لَرَءُوفٌ رَّحِيمٌ﴾

তারা তোমাদের জন্য বোঝা বহন করে এমন সব জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে তোমরা কঠোর প্রাণান্ত পরিশ্রম না করে পৌঁছুতে পারো না আসলে তোমার রব বড়ই স্নেহশীল ও করুণাময়

﴿وَالْخَيْلَ وَالْبِغَالَ وَالْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوهَا وَزِينَةً ۚ وَيَخْلُقُ مَا لَا تَعْلَمُونَ﴾

তোমাদের আরোহণ করার এবং তোমাদের জীবনের শোভা-সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য তিনি ঘোড়া, খচ্চর এবং গাধা সৃষ্টি করেছেন তিনি (তোমাদের উপকারার্থে) আরো অনেক জিনিস সৃষ্টি করেছেন, যেগুলো তোমরা জানোই না

﴿وَعَلَى اللَّهِ قَصْدُ السَّبِيلِ وَمِنْهَا جَائِرٌ ۚ وَلَوْ شَاءَ لَهَدَاكُمْ أَجْمَعِينَ﴾

আর যেখানে বাঁকা পথও রয়েছে সেখানে সোজা পথ দেখাবার দায়িত্ব আল্লাহর ওপরই বর্তেছে তিনি চাইলে তোমাদের সবাইকে সত্য-সোজা পথে পরিচালিত করতেন

সূরার নামকরণঃ

    সূরার ৬৮ আয়াত ﴿وَأَوْحَىٰ رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ أَنِ اتَّخِذِي مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا وَمِنَ الشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ﴾ এর আন নাহল শব্দকে এর নাম হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে।

    সূরার নাম আন নাহল (النَّحْلِ) শব্দের অর্থ মৌমাছি।

-      কিন্তু এই সূরার আলোচ্য বিষয় মৌমাছি নয়। বরং সূরাতে ব্যবহৃত নাহল শব্দকে আলামত হিসাবে গ্রহণ করে এর নামকরণ করা হয়েছে।

-      তবে এই সূরাতে মৌমাছির অলৌকিক কার্যপ্রণালীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, যারা আল্লাহর সুবহানাহু তায়ালা প্রদত্ত ইলহামে অনুপ্রাণিত হয়ে কর্মসম্পাদন করে। এই ইলহাম হলো এক ধরণের অহী। যে অহীর নির্দেশনা অনুযায়ী মৌমাছি নির্ভূল কর্ম সম্পাদন করে, মৌচাকের কোষ তৈরী করণ, কিংবা তাদের নিজেদের মধ্যে কাজের বন্টন প্রক্রিয়া, কিংবা পাহাড় জঙ্গল মাঠ প্রান্তর পেরিয়ে ফুলে ফুলে বিচরণ করে তা থেকে মুধু সংগ্রহ করে তার ফিল্টারিং করে খাঁটি মধু তৈরী, কিংবা নিজেদের বসবাসের জন্য সুরম্য আবাসস্থল তৈরী, এই সকল কাজের মধ্যে রয়েছে তাদের একটি সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা, টীম স্পীরিট, আন্তরিকতা। আর এই সবকিছু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার একান্ত নির্দেশনার ফসল।

    এ সূরার আরেকটি নাম হলো সূরা আন নিআম (سورة النعم)

-      নিয়াম (نِعَم) মানে নিয়ামত। এই সূরায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা সেই নিয়ামতের উল্লেখ করেছেন, যে নিয়ামত তিনি তার গোলামদের দিয়েছেন। যেমনঃ পাহাড়, বৃষ্টি, সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, স্ত্রী, সন্তান, পশু-পাখি, রিযিক, গাছ-পালা ইত্যাদি। যার ইংগিত করে সূরার ১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ وَإِن تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا অর্থাৎ যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামতসমূহ গুণতে চাও তাহলে গুণতে পারবে না। সেই বিবেচনায় সূরার অপর নাম আন নিয়াম। হযরত কাতাদাহ রাহি. এই নাম উল্লেখ

আন নাহল সম্পর্কে কিছু কথাঃ

    এটি কুরআনুল কারীমের ১৬তম সূরা

    নাযিলের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী এই সূরা ৬৯তম সূরা

    এই সূরা সূরা আল কাহফ এর পরে নাযিল হয়েছে

    এই সূরাতে ১২৮টি আয়াত রয়েছে রয়েছে ২ হাজার ৮শত ৪০টি আয়াত আর ৭ হাজার ৭শত ৭টি হরফ

    হারাম ইবনে হাইয়ানকে তার মৃত্যুর সময়ে তাকে অসিওত করতে বলা হয়েছিল তিনি বললেন, অসিওত তো মাল দিয়ে করা হয়, আর আমার কাছে কোন মাল নেই আমি তোমাদেরকে সূরা আন নাহল তেলাওয়াত করার অসিওত করছি রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ «ومَن قرأَ سورةَ النحلِ لم يُحاسبْه اللهُ بالنعيمِ الذي أَنعمَ اللهُ عليه في دارِ الدُّنيا، وأُعطيَ مِن الأجرِ كالذي ماتَ فأَحسنَ الوصيةَ» যে ব্যক্তি সূরা আন নাহল পাঠ করবে, আল্লাহ দুনিয়াতে তাকে যে নিয়ামত দান করেছেন তার কোন হিসাব গ্রহণ করবেন না এবং তাকে এমন পুরস্কার প্রদান করা হবে যেমন একজন একজন ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করছে এমন অবস্থায় যে, সে উত্তম অসিওত করেছেঅন্য বর্ণনায় এসেছেঃ «من قرأ سورة النحل لم يحاسبه الله بما أنعم عليه في دار الدنيا وإن مات في يوم تلاها أو ليلته، كان له من الأجر كالذي مات وأحسن الوصية» আর যদি সে ঐ দিনে বা রাতে মারা যায়, তাহলে সে উত্তম অসিওতকারীর মতো সওয়াব পাবে

সূরা নাযিল হওয়ার সময়-কালঃ

    সূরার নাযিল হওয়ার সময়কাল সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা সূরার কয়েকটি আয়াতের দিকে নজর দেই। যেমনঃ

وَالَّذِينَ هَاجَرُوا فِي اللَّهِ مِن بَعْدِ مَا ظُلِمُوا لَنُبَوِّئَنَّهُمْ فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً ۖ وَلَأَجْرُ الْآخِرَةِ أَكْبَرُ ۚ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ

৪১ যারা জুলুম সহ্য করার পর আল্লাহর খাতিরে হিজরত করে গেছে তাদেরকে আমি দুনিয়াতেই ভালো আবাস দেবো এবং আখেরাতের পুরস্কার তো অনেক বড়

مَن كَفَرَ بِاللَّهِ مِن بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَٰكِن مَّن شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِّنَ اللَّهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ

১০৬ যে ব্যক্তি ঈমান আনার পর কুফরী করে, (তাকে যদি) বাধ্য করা হয় এবং তার অন্তর ঈমানের ওপর নিশ্চিন্ত থাকে (তাহলে তো ভালো কথা), কিন্তু যে ব্যক্তি পূর্ণ মানসিক তৃপ্তিবোধ ও নিশ্চিন্ততা সহকারে কুফরীকে গ্রহণ করে নিয়েছে তার ওপর আল্লাহর গযব আপতিত হয় এবং এ ধরনের সব লোকদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি

وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا قَرْيَةً كَانَتْ آمِنَةً مُّطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِّن كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللَّهِ فَأَذَاقَهَا اللَّهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ

১১২ আল্লাহ একটি জনপদের দৃষ্টান্ত দেন সেটি শান্তি ও নিরাপত্তার জীবন যাপন করছিল এবং সবদিক দিয়ে সেখানে আসছিল ব্যাপক রিযিক, এ সময় তাঁর অধিবাসীরা আল্লাহর নিয়ামতসমূহ অস্বীকার করলো তখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের স্বাদ আস্বাদন করালেন এভাবে যে, ক্ষুধা ও ভীতি তাদেরকে গ্রাস করলো

وَلَقَدْ جَاءَهُمْ رَسُولٌ مِّنْهُمْ فَكَذَّبُوهُ فَأَخَذَهُمُ الْعَذَابُ وَهُمْ ظَالِمُونَ

১১৩ তাদের কাছে তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে একজন রাসূল এলো কিন্তু তারা তাকে অমান্য করলো শেষ পর্যন্ত আযাব তাদেরকে পাকড়াও করলো, যখন তারা জালেম হয়ে গিয়েছিল

فَكُلُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ حَلَالًا طَيِّبًا وَاشْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ

১১৪ কাজেই হে লোকেরা! আল্লাহ তোমাদের যা কিছু পাক-পবিত্র ও হালাল রিযিক দিয়েছেন তা খাও এবং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করোযদি তোমরা সত্যিই তাঁর বন্দেগী করতে বদ্ধপরিকর হয়ে থাকো

إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ ۖ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

১১৫ আল্লাহ যাকিছু তোমাদের ওপর হারাম করেছেন তা হচ্ছে, মৃতদেহ, রক্ত, শূয়োরের গোশত এবং যে প্রাণীর ওপর আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর নাম নেয়া হয়েছে তবে যদি কেউ আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধাচরণ করার ইচ্ছা পোষণ না করে অথবা প্রয়োজনের সীমা না ছাড়িয়ে ক্ষুধার জ্বালায় বাধ্য হয়ে এসব খেয়ে নেয় তাহলে নিশ্চিতই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়

    উপরোক্ত ৪১ নম্বর আয়াতে যে হিজরতের কথা বলা হয়েছে, তা হাবশায় হিজরতের দিকে ইংগিত করা হয়েছে

    অপর দিকে ১০৬ নম্বর আয়াতে ইংগিত করা হয়েছে সেই অবস্থার দিকে, যখন জুলুম-নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল এবং প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল যে, যদি কেউ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কুফরী বাক্য উচ্চারণ করে ফেলে তাহলে তার ব্যাপারে শরীয়াতের বিধান কি হবে

    আর ১১২-১১৪ আয়াতে ইংগিত করা হয়েছে সেই সময়ের দিকে যখন রাসূল সা. এর নাবুয়াত লাবের পর মক্কায় বড় ধরণের দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল

    সূরার ১১৫ নম্বর আয়াতে যা আলোচনা হয়েছে, তেমনি আলোচনা করা হয়েছে সূরা আল আনআম ১১৯, ১৪৬ এবং এই সূরার ১১৮ নম্বর আয়াতে যেখানে বলা হয়েছেঃ

وَمَا لَكُمْ أَلَّا تَأْكُلُوا مِمَّا ذُكِرَ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَقَدْ فَصَّلَ لَكُم مَّا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلَّا مَا اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ ۗ وَإِنَّ كَثِيرًا لَّيُضِلُّونَ بِأَهْوَائِهِم بِغَيْرِ عِلْمٍ ۗ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِالْمُعْتَدِينَ

১১৯ যে জিনিসের ওপর আল্লাহর নাম নেয়া হয়েছে সেটি না খাওয়ার তোমাদের কি কারণ থাকতে পারে? অথচ যেসব জিনিসের ব্যবহার আল্লাহ নিরূপায় অবস্থা ছাড়া অন্য সব অবস্থায় হারাম করে দিয়েছেন সেগুলোর বিশদ বিবরণ ও তিনি তোমাদের জানিয়ে দিয়েছেন অধিকাংশ লোকের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা জ্ঞান ছাড়া নিছক নিজেদের খেয়াল খুশী অনুযায়ী বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলে থাকে তোমার রব এ সীমা অতিক্রমকারীদেকে খুব ভাল করেই জানেন। (আল আনআ)

وَعَلَى الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا كُلَّ ذِي ظُفُرٍ ۖ وَمِنَ الْبَقَرِ وَالْغَنَمِ حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ شُحُومَهُمَا إِلَّا مَا حَمَلَتْ ظُهُورُهُمَا أَوِ الْحَوَايَا أَوْ مَا اخْتَلَطَ بِعَظْمٍ ۚ ذَٰلِكَ جَزَيْنَاهُم بِبَغْيِهِمْ ۖ وَإِنَّا لَصَادِقُونَ

১৪৬ আর যারা ইহুদীবাদ অবলম্বন করেছে তাদের জন্য নখরধারী প্রাণী হারাম করেছিলাম এবং গরু ও ছাগলের চর্বিও, তবে যা তাদের পিঠে, অস্ত্র বা হাড়ের সাথে লেগে থাকে তা ছাড়া তাদের সীমালংঘনের দরুন তাদেরকে এ শাস্তিটি দিয়েছিলাম আর এই যা কিছু আমি বলছি সবই সত্য (আল আনআ)

وَعَلَى الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا مَا قَصَصْنَا عَلَيْكَ مِن قَبْلُ ۖ وَمَا ظَلَمْنَاهُمْ وَلَٰكِن كَانُوا أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ

১১৮ ইতিপূর্বে আমি তোমাকে যেসব জিনিসের কথা বলেছি সেগুলো আমি বিশেষ করে ইহুদীদের জন্য হারাম করেছিলাম আর এটা তাদের প্রতি আমার জুলুম ছিল না বরং তাদের নিজেদেরই জুলুম ছিল, যা তারা নিজেদের ওপর করছিল। (আন নাহল)

এই আলোচনা প্রমাণ করে যেম সূরা আল আনআম আর সূরা আন নাহল এর নাযিলের সময়ের ব্যবধান খুবই কম

    উপরোক্ত বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য-প্রমাণ একথা পরিস্কার জানা যায় যে, এ সূরটিও মক্কী জীবনের শেষের দিকে নাযিল হয় সূরার সাধারণ বর্ণনাভংগীও একথা সমর্থন করে

বিষয়বস্তু ও কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ঃ

    সূরার মূল বিষয়বস্তু ও কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ঃ

১. শিরককে বাতিল করে দেয়া

. তাওহীদকে সপ্রমাণ করা

৩. নবীর আহবানে সাড়া না দেবার অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা ও উপদেশ দেয়া

৪. হকের বিরোধিতা ও তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শন করা

আলোচনাঃ

    সূরা শুরু হয়েছে কোন ভূমিকা ছাড়া সরাসরি সতর্কতামূলক বাক্য দিয়ে বলা হয়েছেঃأَتَىٰ أَمْرُ اللَّهِ فَلَا تَسْتَعْجِلُوهُ “এসে গেছে আল্লাহর ফায়সালা এখন আর একে ত্বরান্বিত করতে বলো না।”

-      মক্কার কাফেররা বারবার বলতোঃআমরা যখন তোমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছি এবং প্রকাশ্যে তোমার বিরোধিতা করছি তখন তুমি আমাদের আল্লাহর যে আযাবের ভয় দেখাচ্ছো তা আসছে না কেন?”

-      মক্কার কাফেররা মনে করতোঃ মুহাম্মাদ সা. এর নবী না হওয়ার সবচেয়ে বেশী সুস্পষ্ট প্রমাণ হলো,  তারা বারবার একথাটি বলছে অথচ আযাব আসতেছেনা।

-      কাফেরদের এই চিন্তাভাবনার জবাবে বলা হয়েছেঃ নির্বোধের দল, আল্লাহর আযাব তো তোমাদের মাথার ওপর তৈরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখন তা কেন দ্রুত তোমাদের ওপর নেমে পড়ছে না এ জন্য হৈ চৈ করো না বরং তোমরা যে সামান্য অবকাশ পাচ্ছো তার সুযোগ গ্রহণ করে আসল সত্য কথাটি অনুধাবন করার চেষ্টা করো

    সতর্কতামূলক বাক্য বলার সাথে সাথে বুঝবার জন্য ভাষণ শুরু হয়ে গেছে এবং কয়েকটি বিষয় ধারাবাহিক ভাবে আসার শুরু হয়েছে। যেমনঃ

1.        শিরক মিথ্যা এবং তাওহীদই সত্য-এই বিষয়টি হৃদয়গ্রাহী যুক্তি এবং জগত ও জীবনের নিদর্শনসমূহের সুস্পষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণের সাহায্যে বুঝানো হয়েছে

2.        কাফেরদের সকল সন্দেহ, সংশয়, আপত্তি, যুক্তি ও টালবাহানার জবাব দেয়া হয়েছে

3.       মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরার গোয়ার্তুমি এবং সত্যে মোকাবিলায় অহংকার ও আষ্ফালনের খারাপ পরিণামের ভয় দেখানো হয়েছে

4.       মুহাম্মাদ সা. আনিত জীবন ব্যবস্থা যা মানুষের জীবনের নৈতিক ও বাস্তব পরিবর্তন সাধন করতে চায়, তা সংক্ষেপে এবং হৃদয়গ্রাহী ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে মুশরিকদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, তারা আল্লাহকে রব হিসেবে মেনে নেবার যে দাবী করে থাকে তা নিছক বাহ্যিক ও অন্তসারশূন্য দাবী নয় বরং এই দাবীর বেশ কিছু চাহিদাও রয়েছে তাদেরকে সেই দাবীর আলোকে আকীদা-বিশ্বাস, নৈতিক-চারিত্রিক ও বাস্তব জীবনে এগুলোর প্রকাশ হওয়া উচিত

5.       নবী সা. ও সাহাবায়ে কিরামদের মনে সাহস সঞ্চার করার সাথে সাথে কাফেরদের বিরোধিতা, প্রতিরোধ সৃষ্টি ও জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাদের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গী ও কর্মনীতি কি হতে হবে তা বলে দেয়া হয়েছে

আয়াত সমূহের ব্যাখ্যাঃ

﴿أَتَىٰ أَمْرُ اللَّهِ فَلَا تَسْتَعْجِلُوهُ ۚ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾

এসে গেছে আল্লাহর ফায়সালা এখন আর একে ত্বরান্বিত করতে বলো নাপবিত্র তিনি এবং এরা যে শিরক করছে তার ঊর্ধে তিনি অবস্থান করেন

    أَتَىٰ أَمْرُ اللَّهِ- এসে গেছে আল্লাহর সিদ্ধান্ত

-    আল্লাহর ফায়সালা আসাটা একদম নিকটে।

-    আল্লাহর ফায়সালা এতো নিকটে যে কেবল প্রকাশ ও প্রয়োগ সময় বাকী।

-    আল্লাহর ফায়সালা একেবারে অবধারিত ও সুনিশ্চিত।

-    একান্ত নিকটবর্তী এমনটা বুঝানোর জন্য আরবী অতীত কালের শব্দের (فعل ماضي) সাহায্য নেয়া হয়েছে।

-    কাফেরদের সবরের পেয়ালা কানায় কানায় ভরে উঠেছিল এবং শেষ ও চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করার সময় এসে গিয়েছিল বলেই অতীতকালের শব্দ (فعل ماضي) দ্বারা একথা বলা হয়েছে

-    “ফায়সালা” কি ছিল এবং কোন আকৃতিতে এসেছে?

o ফায়সালা বলতে হিজরত বুঝানো হয়েছে এ আয়াত নাযিলের কিছুদিন পরেই এ হিজরতের হুকুম দেয়া হয়

o যে সমাজে নবীর আগম ঘটে তাদের অস্বীকৃতি ও প্রত্যাখ্যান একেবারে শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলেই নবীকে হিজরতের হুকুম দেয়া হয় আর এই হিজরতের ফায়সালাই সমাজের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়

o ভাগ্য নির্ধারত দুই ভাবে হয়। ১. তাদের ওপর ধবংসাত্মক আযাব এসে যায়২. নবী ও তাঁর অনুসারীদের হাত দিয়ে তাদেরকে সমূলে উৎপাটিত করে দেয়া হয়

o হিজরতের ঘটনায় মক্কার কাফেররা মনে করলো ফায়সালা তাদের পক্ষেই হয়েছে কিন্তু ৮/১০ বছরের ব্যবধানে দুনিয়াবাসীরা দেখলো, শুধুমাত্র মক্কা থেকেই নয়, সমগ্র আরব থেকেই শিরক ও কুফরীকে শিকড়সহ উপড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে

-    ফায়সালাবলতে কিয়ামত বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা এখানে কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার খবর দিচ্ছেন। আর এজন্য অতীত কালের শব্দ ব্যবহার করতেছেন, যেমন তিনি বলেছেন কুরআনের অন্যত্রঃ

ٱقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَـٰبُهُمْ وَهُمْ فِى غَفْلَةٍ مُّعْرِضُونَ

মানুষের হিসাব নিকাশের সময় আসন্ন, কিন্তু তারা উদাসিনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে।” (আল আম্বিয়াঃ১)

ٱقْتَرَبَتِ ٱلسَّاعَةُ وَٱنشَقَّ ٱلْقَمَرُ

কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চন্দ্র বিদীর্ণ হয়ে গেছে।” (সূরা আল ক্বামারঃ ১)

-    হযরত যাহহাক রাহি. এই আয়াতের একটি বিস্ময়কর তরজমা করেছেন। তিনি বলেছেনঃ أَتَىٰ أَمْرُ اللَّهِ অর্থ-আল্লাহর ফরায়েয ও হুদুদ নাযিল হয়ে গেছে। তবে ইবনে জারীর রাহি. তা কঠিনভাবে খন্ডন করে বলেছেনঃ আমাদের মধ্যে তো এমন একজনও নেই, যে শরীয়াতের অস্তিত্বের পূর্বে এটা চাওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করছে। বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ আযাবের জন্য তাড়াহুড়া করা কাফিরদের অভ্যাস ছিল। কেননা, তারা ওটাকে মানতই না।যেমনটা কুরআনে বলা হয়েছেঃ

يَسْتَعْجِلُ بِهَا ٱلَّذِينَ لاَ يُؤْمِنُونَ بِهَا وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مُشْفِقُونَ مِنْهَا وَيَعْلَمُونَ أَنَّهَا ٱلْحَقُّ أَلاَ إِنَّ ٱلَّذِينَ يُمَارُونَ فَي ٱلسَّاعَةِ لَفِي ضَلاَلَ بَعِيدٍ

বেঈমানরা তো এর জন্য তাড়াতাড়ি করছে। অথচ ঈমানদাররা এর থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত রয়েছে। কেননা, তারা এটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে; প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহর শাস্তির ব্যাপারে সন্দেহ পোষণকারী দূরের বিভ্রান্তিতে পড়ে রয়েছে।” (সূরা আশ শুরাঃ ১৮)

    فَلَا تَسْتَعْجِلُوهُ ۚ - এখন আর একে ত্বরান্বিত করতে বলো না

-    تَسْتَعْجِلُوهُ এর (ه) যমীর বা সর্বনামটি যদি আল্লাহর হয়, তাহলে তার অর্থ হবেঃ তোমরা আল্লাহর নিকট ওটা তাড়াতাড়ি চেওনা।আর যদি (ه) যমীর বা সর্বনামটি আযাব এর দিকে হয়, তখন তার অর্থ হবেঃ আযাবের জন্য তাড়াতাড়ি করো না।এখানে দুইটি অর্থই বিবেচ্য। যেমন আল্লাহ বলেনঃ

وَيَسْتَعْجِلُونَكَ بِٱلْعَذَابِ وَلَوْلاَ أَجَلٌ مُّسَمًّى لَّجَآءَهُمُ ٱلْعَذَابُ وَلَيَأْتِيَنَّهُمْ بَغْتَةً وَهُمْ لاَ يَشْعُرُونَ يَسْتَعْجِلُونَكَ بِٱلْعَذَابِ وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمُحِيطَةٌ بِٱلْكَـٰفِرِينَ

“(হে নবী সা.) লোকেরা তোমার কাছে তাড়াতাড়ি শাস্তি চাচ্ছে, যদি শাস্তির জন্য একটা নির্ধারিত সময় না থাকতো, তবে অবশ্যই তা তাদের উপর চলে আসতো, কিন্তু তা অবশ্যই আকস্মাৎ তাদের উপর চলে আসবে এবং তারা তা বুঝতেই পারবে না। তারা মোতার কাছে আযাবের জন্য তাড়াতাড়ি করছে, নিশ্চয়ই জাহান্নাম কাফিরদেরকে পরিবেষ্টকারী।” (সূরা আল আনকাবুতঃ ৫৩-৫৪)

-    হযরত উকবা ইবনু আমির রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেনঃ

تَطْلُعُ عليكم عند الساعةِ سَحابةٌ سوداءُ من المغربِ مِثْلُ التُّرْسِ، فما تزالُ ترتفعُ في السماءِ، ثم يُنادِي مُنادٍ فيها: يا أيُّها الناسُ! فيُقْبِلُ الناسُ بعضُهم على بعضٍ: هل سَمِعْتم؟ فمنهم من يقولُ: نعم، ومنهم من يَشُكُّ، ثم يُنادِي الثانيةَ: يا أيُّها الناسُ! فيقولُ الناسُ بعضهم لبعض: هل سَمِعْتم؟ فيقولون: نعم، ثم يُنادِي الثالثة: أَيُّها الناسُ: ( أَتَى أَمْرُ اللهِ فَلَا تَسْتَعْجِلُوهُ )، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: فوالذي نفسي بيدِهِ! إن الرَّجُلَيْنِ لَيَنْشُرَانِ الثوبَ فما يَطْوِيَانِهِ أبدًا، وإن الرجلَ لَيَمْدُرُ حَوْضَه فما يُسْقَي فيه شيئًا أبداً، وإن الرجلَ لَيَحْلُبُ ناقتَهُ فما يَشْرَبُهُ أبدًا، قال ويَشْتَغِلُ الناسُ.

কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার নিকটবর্তী সময়ে পশ্চিম দিকহতে ঢালের মতো কালো মেঘ প্রকাশিত হবে এবং ওটা খুবই তাড়াতাড়ি আকাশের উপরে উঠে যাবে। অতঃপর ওর মধ্য থেকে একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করবে। লোকেরা বিস্মিত হয়ে একে অপরকে জিজ্ঞেস করবেঃ কিছু শুনতে পেয়েছো কি?” কেউ কেউ বলবেঃ হ্যাঁ! পেয়েছি।আর কেউ কেউ ওটাকে বাজে কথা বলে উড়িয়ে দেবে। আবার ঘোষণা দেয়া হবে এবং বলা হবেঃ হে লোক সকল!” এবার সবাই বলে উঠবে-হ্যাঁ, শব্দ শুনতে পেয়েছি।তৃতীয়বার ঐ ঘোষণাকারী ঘোষণা করবে; “হে লোক সকল! আল্লাহর হুকুম এসে গেছে। এখন তাড়াতাড়ি করো না।আল্লাহর কসম! এমন দুব্যক্তি যারা কাপড় ছড়িয়ে রাখতো তারা জড় কারা সময় পাবে না, কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে। কেউ হয়তো তার পানি হাউজ ঠিক করতে থাকবে, সেই পানি পান করতে পারবে না, কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে। দুধ দোহনকারী দুধ পান করার অবসর পাবে না, কিয়ামত হয়ে যাবে। লোকেরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

    سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ - পবিত্র তিনি এবং এরা যে শিরক করছে তার ঊর্ধে তিনি অবস্থান করেন

-    আল্লাহর রাসূলের বারবার আল্লাহর ফায়সালার ভয় দেখানোর পর ফায়সালা না আসার বিষয়টি কাফেররা রাসূলকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে আসছিল যে, যে পরিণামের ভয় দেখাচ্ছো, তা আসছে না কেন? তাদের এই চ্যালেঞ্জের পিছনের তাদের একটি চিন্তাও ছিল। আর তা হলোঃ তাদের মুশরিকী ধর্মই সত্য আর মুহাম্মদের ধর্ম ভ্রান্ত, এই ধর্মকে আল্লাহ অনুমোদন করেন না

-    কাফেরদের যুক্তি ছিল, আমরা যদি আল্লাহর পথে না থাকি, মুহাম্মদ যদি সত্যিই নবী হয়ে থাকেন, তাহলে তো আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হচ্ছেনা।

-    আল্লাহ ফায়সালার কথা বলার সাথে সাথে একথাও বলে দেয়া হচ্ছে যে, ফায়সালা বিলম্বিত হওয়ার যে কারণ তোমরা মনে করছো, তা সঠিক নয়। আল্লাহর সাথে কারো শরীক হবার প্রশ্ন ওঠে না তাঁর সত্তা এর অনেক উর্ধে এবং এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র

-    আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা তার নিজের সত্তাকে শিরক ও অন্যের ইবাদত হতে বহু উর্ধ্বে থাকার বর্ণনা দিচ্ছেন।

-    মুশরিক হলো তারা, যারা কিয়ামতের অস্বীকারকারী। আল্লাহ ঐ অস্বীকারকারীরা আল্লাহর সাথে শরীক করে। অথচ তিনি তা থেকে অনেক উর্ধ্বে এবং তা থেকে পাক পবিত্র।

﴿يُنَزِّلُ الْمَلَائِكَةَ بِالرُّوحِ مِنْ أَمْرِهِ عَلَىٰ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ أَنْ أَنذِرُوا أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاتَّقُونِ﴾

তিনি এ রূহকে তাঁর নির্দেশানুসারে ফেরেশতাদের মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যার ওপর চান নাযিল করেন  (এ হেদায়াত সহকারে যে, লোকদের) “জানিয়ে দাও, আমি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই কাজেই তোমরা আমাকেই ভয় করো”

    الرُّوحِ - রূহ

-    আমরা প্রসিদ্ধ ভাবে জানি যে, রূহ মানে কুরআনে জিব্রাঈল আ.কে বুঝানো হয়েছে সূরা আল কাদরে।

-    কিন্তু এই আয়াতে রূহ বলতে নবুওয়াতের রূহ বুঝানো হয়েছে। যে রূহ বা প্রাণসত্তায় উজ্জীবিত হয়েই নবী কাজ করেন ও কথা বলেন

-    স্বাভাবিক ও প্রাকৃতি জীবনে প্রাণের যেমন প্রয়োজন, তেমনি ভাবে নৈতিক জীবনের জন্য প্রয়োজন ওহী ও নবুওয়াতী প্রাণসত্তা।

-    কুরআনে বিভিন্ন স্থানে তার জন্য রূহ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে  কিন্তু খৃষ্টানরা মানব জীবনের দুইটি পর্যায় তথা প্রাকৃতিক ও নৈতিক পর্যায়টি না বুঝার কারণে রূহুল কুদুস বা তিন খোদা বানিয়ে নিয়েছে।

-    কোন কোন মুফাস্সির (যেমন ইবনে কাসীর) মনে করেন, এই রূহ মানে ওহী। ওহী আর নবুওয়াতের রূহ একই জিনিস।

-    কুরআনে الرُّوحِ শব্দটি এসেছে কমপক্ষে  ২৩বার। তন্মধ্যে ওহী বা নাবুয়াতের রূহ অর্থেঃ ৯বার, জিব্রাঈল আ.কে বুঝাতেঃ ৬বার, ফেরেশতা বা ফেরেশতাদেরকে বুঝাতেঃ ১বার, ঈসা আ.কে বুঝাতেঃ ১বার এবং ঈসা আ. এর প্রাণ বুঝাতেঃ ১বার, আল্লাহর রহমত বাঝাতেঃ ১বার এবং আল্লাহর গুনাবলী বুঝাতেঃ ৩বার রূহ শব্দটি এসেছে। যা নিম্নরূপঃ

o সূরা আল বাকারাহঃ ২বার (আয়াতঃ ৮৭, ২৫৩)

o সূরা আন নিসাঃ ১বার (আয়াতঃ ১৭১)

o সূরা আল মায়িদাহঃ ১বার (আয়াতঃ ১১০)

o সূরা ইউসুফঃ ২বার (আয়াতঃ ৮৭)

o সূরা আল হিজরঃ ১বার (আয়াতঃ ২৯)

o সূরা আন নাহলঃ ২বার (আয়াতঃ ২, ১০২)

o সূরা বনী ইসরাঈলঃ ২বার (আয়াতঃ ৮৫)

o সূরা মারইয়ামঃ ১বার (আয়াতঃ ১৭)

o সূরা আল আম্বিয়াঃ ১বার (আয়াতঃ ৯১)

o সূরা আশ শুআরাঃ ১বার (আয়াতঃ ১৯৩)

o সূরা আস সাদজদাহঃ ১বার (আয়াতঃ ৯)

o সূরা ছোয়াদঃ ১বার (আয়াতঃ ৭২)

o সূরা গাফির বা সূরা আল মুমিনঃ  ১বার (আয়াতঃ ১৫)

o সূরা আশ শুরাঃ ১বার (আয়াতঃ ৫২)

o সূরা আল মুজাদালাহঃ ১বার (আয়াতঃ ২২)

o সূরা আত তাহরীমঃ ১বার (আয়াতঃ ১২)

o সূরা আল মাআরিজঃ ১বার (আয়াতঃ ৪)

o সূরা আন নাবাঃ ১বার (আয়াতঃ ৩৮)

o আল ক্বাদরঃ ১বার (আয়াতঃ ৪)

    يُنَزِّلُ الْمَلَائِكَةَ بِالرُّوحِ مِنْ أَمْرِهِ عَلَىٰ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ - তিনি এ রূহকে তাঁর নির্দেশানুসারে ফেরেশতাদের মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যার ওপর চান নাযিল করেন

-    এই আয়াতের মর্ম বুঝার জন্যে আমাদেরকে কুরআন নাযিলের সেই প্রেক্ষাপটের দিকে নজর দিতে হবে। সেই সময়ে মূলতঃ মক্কার কাফেররা রাসূল সা. নাবুওয়াতের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলে এই ভাবে যে, তুমি আযাব আযাব বলতেছো, কিন্তু আযাব তো আসতেছে না। বিধায় আযাব আসাটাও যেমন সঠিক নয়, তোমার নবী হওয়ার দাবীটাও সঠিক নয়। যার কারণে আযাব আসার কথা বলেই শিরকের বিষয়ে আলোচনা করেই মুহাম্মদ সা. এর নাবুওয়াতের সত্যতার ঘোষনা করা হচ্ছেঃ এ ব্যক্তি হচ্ছে আমার পাঠানো রূহ এ রূহ ও প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হয়েই সে নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করছে

-    বান্দার উপর রূহ নাযিল করার কথা বলে মুলতঃ কাফেরদের কিছু আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে। কাফেরদের কথা ছিলঃ

. আল্লাহর যদি নবী পাঠাবেনেই তাহলে কেবলমাত্র আবদুল্লাহ পুত্র মুহাম্মাদই সা. কি এ কাজের যোগ্য সাব্যস্ত হয়েছিল?

২. মক্কা ও তায়েফের সমস্ত বড় বড় সরদাররা কি মরে গিয়েছিল? নবী করার জন্য তাদের কারোর উপর কি আল্লাহর দৃষ্টি পড়েনি?

-    আল্লাহ এই সব অর্থহীন ও অযৌক্তিক আপত্তির জবাব ঠিক সেভাবে দিয়েছেন, যেভাবে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এর এ জবাব দেয়া হয়েছেঃ

o আল্লাহ নিজের কাজ সম্পর্কে নিজেই অবগত আছেন

o আল্লাহ তাঁর কাজের ব্যাপারে তোমাদের কাছ থেকে তাঁর পরামর্শ নেবার প্রয়োজন নেই

o আল্লাহ নিজের বান্দাদের মধ্যে থেকে যাকেই সংগত মনে করেন নিজের কাজের জন্য নির্বাচিত করে নেন

-    এব্যাপারে কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

ٱللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ

“আল্লাহর নিজের রিসালতের কাজ কাকে দিয়ে কিভাবে নেবেন তা তিনি নিজেই ভাল জানেন।” (সূরা আল আনআমঃ ১২৪)

يُلْقِى ٱلرُّوحَ مِنْ أَمْرِهِ عَلَىٰ مَن يَشَآءُ مِنْ عِبَادِهِ لِيُنذِرَ يَوْمَ ٱلتَّلاَقِ يَوْمَ هُم بَـٰرِزُونَ لاَ يَخْفَىٰ عَلَى ٱللَّهِ مِنْهُمْ شَىْءٌ لِّمَنِ ٱلْمُلْكُ ٱلْيَوْمَ لِلَّهِ ٱلْوَٰحِدِ ٱلْقَهَّارِ

“তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যার কাছে ইচ্ছা নিজের হুকুমে ‘রূহ’ নাযিল করেন যাতে সে সাক্ষাতের দিন সম্পর্কে সাবধান করে দেয়সেটি এমন দিন যখন সব মানুষের সবকিছু প্রকাশ হয়ে পড়বে আল্লাহ‌র কাছে তাদের কোন কথাই গোপন থাকবে না (সেদিন ঘোষণা দিয়ে জিজ্ঞেস করা হবে) আজ রাজত্ব কার? (সমস্ত সৃষ্টি বলে উঠবে) একমাত্র আল্লাহর যিনি কাহ্‌হার। (সূরা গাফিরঃ ১৫, ১৬)

    أَنْ أَنذِرُوا أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاتَّقُونِ - “জানিয়ে দাও, আমি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই কাজেই তোমরা আমাকেই ভয় করো”

-    আয়াতের এই অংশের মাধ্যমে যে সত্যটাকে সুস্পষ্ট করা হলো, তা হচ্ছেঃ নবুওয়াতের রূহ যার উপর নাযিল হয়েছে, তিনি একটি দাওয়াত নিয়ে এসেছেন। আর তা হলোঃ

. সার্বভৌমত্ব আর কর্তৃত্ব কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত,

. ভয় করতে হবে কেবলমাত্র আল্লাহকে,

. আল্লাহ ছাড়া আর কারো অসন্তুষ্টির ভয়, শাস্তির আশংকা, নাফরমানির পরিণামের আতংক, মানবিক চরিত্র ও নৈতিকতার নিয়ন্ত্রক, মানবিক চিন্তা ও কর্মের কেন্দ্র বিন্ধু আর কেউ নেই।

এই দাওয়াতের মাধ্যমে তিনি আল্লাহর আল্লাহ ওয়াহদানিয়াতের ঘোষণা করবেন, মুশরিকদের ভয় দেখাবেন এবং জনগনকে বুঝাবেন, যাতে তারা আল্লাহকে ভয় করে।

﴿خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ ۚ تَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾

তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে সত্য সহকারে সৃষ্টি করেছেন এরা যে শিরক করছে তাঁর অবস্থান তার অনেক ঊর্ধে

    আবার আলোচনা মোড় ঘুরে যাচ্ছে শিরকের দিকে। শিরক ছেড়ে তাওহীদের বিশ্বাসী হবার জন্য আসমান আর যমীন সৃষ্টির দিকে দৃষ্টি নেয়া হচ্ছে।

    خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ ۚ تَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ - তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে সত্য সহকারে সৃষ্টি করেছেন এরা যে শিরক করছে তাঁর অবস্থান তার অনেক ঊর্ধে

-    আল্লাহর নবী যে শিরক পরিহান করার কিংবা তাওহীদে বিশ্বাসী হবার দাওয়াত দিচ্ছেন, আসমান ও যমীনের সকল সৃষ্টি তার সাক্ষ্য দিচ্ছে।

-    আসমান ও যমীনের মধ্যে বিরাজমান সৃষ্টি কারখানা কোন কাল্পনিক বিষয় নয়, বরং তা পুরোপুরি সত্য ব্যবস্থা।

-    আসমান ও যমীনের যে দিকে খুশী তাকাও, কোথাও কোন কিছুতে শিরকের পক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যাবে না।

-    বিধায় আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা-এই চিন্তাটা অনুমান নির্ভর। এর সাথে| বাস্তবতার কোন গন্ধমাত্র নাই।

-    বিশ্বজগত, মানুষের অস্তিত্ব এসবকিছু তাওহীদ আর রিসালাতের প্রমাণ পেশ করে।

-    কুরআনে অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

وَلِلَّهِ مَا فِى ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ لِيَجْزِىَ ٱلَّذِينَ أَسَـٰٓـُٔوا۟ بِمَا عَمِلُوا۟ وَيَجْزِىَ ٱلَّذِينَ أَحْسَنُوا۟ بِٱلْحُسْنَى

“যমীন ও আসমানের প্রতিটি জিনিসের মালিক একমাত্র আল্লাহ‌যাতে আল্লাহ্‌ অন্যায়কারীদেরকে তাদের কাজের প্রতিদান দেন এবং যারা ভাল নীতি ও আচরণ গ্রহণ করেছে তাদের উত্তম প্রতিদান দিয়ে পুরস্কৃত করেন” (সূরা আন নাজমঃ ৩১)

﴿خَلَقَ الْإِنسَانَ مِن نُّطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُّبِينٌ﴾

তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ছোট্ট একটি ফোঁটা থেকে তারপর দেখতে দেখতে সে এক কলহপ্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে

    خَلَقَ الْإِنسَانَ مِن نُّطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُّبِينٌ- তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ছোট্ট একটি ফোঁটা থেকে তারপর দেখতে দেখতে সে এক কলহপ্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে

-    এই কথার দুইটি অর্থ হতে পারে এবং এই দুইটি অর্থই এখানে প্রযোজ্য।

1.  আল্লাহ মানুষকে তৈরী করেছেন সামান্য এক শুক্রবিন্দু থেকে। অথচ এই মানুষ বিতর্ক করতে পারে, যুক্তি প্রদর্শণ করতে পারে, নিজের কথা পক্ষে সাক্ষ্য প্রমান দিতে পারি। যার কারণে এর পরের আয়াত সমূহেও আলোচনা ধারাবাহিকতা রক্ষা করে বিভিন্ন দলীল পেশ করা হয়েছে।

2.  সামান্য এক শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করা মানুষের অহংকারের মাত্রা দেখো, সে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে বিতর্কে নেমেছে। এর মাধ্যমে মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে যে বড় বড় কথা বলার আগে নিজের পরিচয়, নিজের অবস্থানের দিকে তাকাও। কোথায় ছিলা? কোথা থেকে কোথায় এসেছো? কিভাবে তোমাকে তৈরী করা হয়েছে? কোন পথ দিয়ে বের হয়ে দুনিয়াতে এসেছো? শিশুকাল থেকে কতটুকু পর্যায় অতিক্রম করে যৌবনে পৌছেছো? এখন সব কিছু ভূলে গিয়ে কার মুখের উপর কথার ফুলজুরি ফুটাচ্ছো? এসব চিন্তা করো।

-    কুরআনে হাকীমের অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

وَهُوَ ٱلَّذِى خَلَقَ مِنَ ٱلْمَآءِ بَشَراً فَجَعَلَهُ نَسَباً وَصِهْراً وَكَانَ رَبُّكَ قَدِيراً وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لاَ يَنفَعُهُمْ وَلاَ يَضُرُّهُمْ وَكَانَ ٱلْكَـٰفِرُ عَلَىٰ رَبِّهِ ظَهِيراً

“আর তিনিই পানি থেকে একটি মানুষ তৈরি করেছেনআবার তার থেকে বংশীয় ও শ্বশুরালয়ের দু’টি আলাদা ধারা চালিয়েছেন তোমার রব বড়ই শক্তি সম্পন্নএক আল্লাহকে বাদ দিয়ে লোকেরা এমন সব সত্তার পূজা করছে যারা না তাদের উপকার করতে পারেনা অপকার আবার অতিরিক্ত হচ্ছে এই যেকাফের নিজের রবের মোকাবিলায় প্রত্যেক বিদ্রোহীর সাহায্যকারী হয়ে আছে।” (সূরা আল ফুরক্বানঃ ৫৪, ৫৫)

أَوَلَمْ يَرَ ٱلإِنسَـٰنُ أَنَّا خَلَقْنَـٰهُ مِن نُّطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مٌّبِينٌ وَضَرَبَ لَنَا مَثَلاً وَنَسِىَ خَلْقَهُ قَالَ مَن يُحىِ ٱلْعِظَـٰمَ وَهِىَ رَمِيمٌ قُلْ يُحْيِيهَا ٱلَّذِىۤ أَنشَأَهَآ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ 

“মানুষ কি দেখে নাতাকে আমি সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু থেকে এবং তারপর সে দাঁড়িয়ে গেছে স্পষ্ট ঝগড়াটে হয়ে? এখন সে আমার ওপর উপমা প্রয়োগ করে এবং নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায় বলে, “এ হাড়গুলো যখন পচে গলে গেছে এতে আবার প্রাণ সঞ্চার করবে কে?” তাকে বলোএদেরকে তিনি জীবিত করবেন যিনি প্রথমে এদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন এবং তিনি সৃষ্টির প্রত্যেকটি কাজ জানেন” (সূরা ইয়াসিনঃ ৭৭-৭৯)

-    হযরত বুশর ইবনে জাহহাশ আল কুরাইশী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূল সা. তার হাতের তালুতে থুথু ফেললেন এবং বললেনঃ

يَقُولُ اللَّهُ تعالى ابْنَ آدَمَ أَنَّى تُعْجِزُنِي، وَقَدْ خَلَقْتُكَ مِنْ مِثْلِ هَذِهِ، حتى إذا سويتك فعدلتك، مشيت بين برديك، وللأرض منك وئيد، فجمعت ومنعت حتى إذا بلغت الحلقوم قُلْتَ: أَتَصَدَّقُ: وَأَنَّى أَوَانُ الصَّدَقَةِ

আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ হে মানুষ! তুমি কি আমাকে অপারগ করতে পার? অথচ আমি তোমাকে এইরূপ জিনিস থেকে সৃষ্টি করেছি। যখন সৃষ্টি পূর্ণ হয়ে গেল, ঠিকঠাক হলো, তোমরা পোষাক এবং ঘর বাড়ি পেয়ে গেলে তখন আমার পথ থেকে নিজে সরে যেতে এবং অপরকে সরিয়ে ফেলতে শুরু করে দিলে। আর যখন দম কন্ঠে আটকে গের তখন বলতে লাগলেঃ এখনআমি দান খয়রাত করছি, আল্লাহর পথে খরচ করছি। কিন্তু এখন দান খয়রাত করার সময় পার হয়ে গেছে।” (ইবনে মাযাহ)

﴿وَالْأَنْعَامَ خَلَقَهَا ۗ لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَافِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ﴾

তিনি পশু সৃষ্টি করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য পোশাক, খাদ্য এবং অন্যান্য নানাবিধ উপকারিতাও

    وَالْأَنْعَامَ خَلَقَهَا ۗ لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَافِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ - তিনি পশু সৃষ্টি করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য পোশাক, খাদ্য এবং অন্যান্য নানাবিধ উপকারিতাও

-    আলোচনার ধারাবাহিকতা চলছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা চারপায়া জন্তু সৃষ্টি করেছেন এবং এগুলোর মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন ধরণের উপকার হচ্ছে, এটা আল্লাহর নিয়ামত। সেই নিয়ামতের বর্ণা দেয়া হচ্ছে। সূরা আল আনআমে আল্লাহ যার বিস্তারিত উল্লেখ করেছেনঃ

﴿وَمِنَ الْأَنْعَامِ حَمُولَةً وَفَرْشًا ۚ كُلُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ۚ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ﴾﴿ثَمَانِيَةَ أَزْوَاجٍ ۖ مِّنَ الضَّأْنِ اثْنَيْنِ وَمِنَ الْمَعْزِ اثْنَيْنِ ۗ قُلْ آلذَّكَرَيْنِ حَرَّمَ أَمِ الْأُنثَيَيْنِ أَمَّا اشْتَمَلَتْ عَلَيْهِ أَرْحَامُ الْأُنثَيَيْنِ ۖ نَبِّئُونِي بِعِلْمٍ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾﴿وَمِنَ الْإِبِلِ اثْنَيْنِ وَمِنَ الْبَقَرِ اثْنَيْنِ ۗ قُلْ آلذَّكَرَيْنِ حَرَّمَ أَمِ الْأُنثَيَيْنِ أَمَّا اشْتَمَلَتْ عَلَيْهِ أَرْحَامُ الْأُنثَيَيْنِ ۖ أَمْ كُنتُمْ شُهَدَاءَ إِذْ وَصَّاكُمُ اللَّهُ بِهَٰذَا ۚ فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا لِّيُضِلَّ النَّاسَ بِغَيْرِ عِلْمٍ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾

১৪২ আবার তিনিই গবাদী পশুর মধ্যে এমন পশুও সৃষ্টি করেছেন, যাদের সাহায্যে যাত্রী ও ভার বহনের কাজ নেয়া হয় এবং যাদেরকে খাদ্য ও বিছানার কাজেও ব্যবহার করা হয় খাও এ জিনিসগুলো থেকে, যা আল্লাহ তোমাদের দান করেছেন এবং শয়তানের অনুসরণ করো না, কারণ সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু

১৪৩ এ আটটি নর ও মাদী, দু’টি মেষ শ্রেণীর ও দু’টি ছাগল শ্রেণীর হে মুহাম্মাদ! এদেরকে জিজ্ঞেস করো, আল্লাহ এদের নর দু’টি হারাম করেছেন, না মাদী দু’টি অথবা মেষ ও ছাগলের পেটে যে বাচ্চা আছে সেগুলো? যথার্থ জ্ঞানের ভিত্তিতে আমাকে জানাও যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো

১৪৪ আর এভাবে দু’টি উট শ্রেণীর ও দু’টি গাভী শ্রেণীর মধ্য থেকে জিজ্ঞেস করো, আল্লাহ এদের নর দু’টি হারাম করেছেন, না মাদী দু’টি, না সেই বাচ্চা যা উটনী ও গাভীর পেটে রয়েছেতোমরা কি তখন কি উপস্থিত ছিলে যখন আল্লাহ তোমাদেরকে এদের হারাম হুকুম দিয়েছিলেন? কাজেই তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হবে যে আল্লাহর নামে মিথ্যা কথা বলে? তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সঠিক জ্ঞান ছাড়াই মানুষকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করা নিসন্দেহে আল্লাহ এহেন জালেমদের সত্য-সঠিক পথ দেখান না  

-    কুরআনে হাকীমে অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

﴿وَإِنَّ لَكُمْ فِي الْأَنْعَامِ لَعِبْرَةً ۖ نُّسْقِيكُم مِّمَّا فِي بُطُونِهَا وَلَكُمْ فِيهَا مَنَافِعُ كَثِيرَةٌ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ﴾

“আর প্রকৃতপক্ষে তোমাদের জন্য গবাদী পশুদের মধ্যেও একটি শিক্ষা রয়েছে তাদের পেটের মধ্যে যাকিছু আছে তা থেকে একটি জিনিস আমি তোমাদের পান করাই  এবং তোমাদের জন্যে তাদের মধ্যে আরো অনেক উপকারিতাও আছে, তাদেরকে তোমরা খেয়ে থাকো” (সূরা আল মুমিনুনঃ ২১)

﴿ٱللَّهُ ٱلَّذِى جَعَلَ لَكُمُ ٱلْأَنْعَـٰمَ لِتَرْكَبُوا۟ مِنْهَا وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ﴾

“আল্লাহই তোমাদের জন্য এসব গৃহপালিত পশু সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা এসব পশুর কোনটির পিঠে আরোহণ করতে পার এবং কোনটির গোশত খেতে পার” (সূরা আল মুমিনঃ ৭৯)

﴿أَوَلَمْ يَرَوْا۟ أَنَّا خَلَقْنَا لَهُم مِّمَّا عَمِلَتْ أَيْدِينَآ أَنْعَـٰمًۭا فَهُمْ لَهَا مَـٰلِكُونَ﴾﴿وَذَلَّلْنَـٰهَا لَهُمْ فَمِنْهَا رَكُوبُهُمْ وَمِنْهَا يَأْكُلُونَ﴾﴿وَلَهُمْ فِيهَا مَنَـٰفِعُ وَمَشَارِبُ ۖ أَفَلَا يَشْكُرُونَ﴾

“এরা কি দেখে না, আমি নিজের হাতে তৈরী জিনিসের মধ্য থেকে এদের জন্য সৃষ্টি করেছি গবাদি পশু এবং এখন এরা তার মালিক আমি এভাবে তাদেরকে এদের নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দিয়েছি যে, তাদের মধ্য থেকে কারো ওপর এরা সওয়ার হয়, কারো গোশত খায়এবং তাদের মধ্যে এদের জন্য রয়েছে নানা ধরনের উপকারিতা ও পানীয় এরপর কি এরা কৃতজ্ঞ হয় না?” (সূরা ইয়াসিনঃ ৭১-৭৩)

    دِفْءٌ وَمَنَافِعُ - শীতের পোষাক ও উপকারী অনেক বস্তু।

-    হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেনঃ دِفْءٌ এর অর্থে হলোঃ কাপড়। আর مَنَافِعُ দ্বারা বুঝানো হয়েছে পানাহার করা, বংশ লাভ করা, সওয়ার হওয়া, গোশতা খাওয়া, দুধ পান করা ইত্যাদি।

﴿وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ﴾

তাদের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সৌন্দর্য যখন সকালে তোমরা তাদেরকে চারণ ভূমিতে পাঠাও এবং সন্ধ্যায় তাদেরকে ফিরিয়ে আনো

    وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ - তাদের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সৌন্দর্য যখন সকালে তোমরা তাদেরকে চারণ ভূমিতে পাঠাও এবং সন্ধ্যায় তাদেরকে ফিরিয়ে আনো

﴿وَتَحْمِلُ أَثْقَالَكُمْ إِلَىٰ بَلَدٍ لَّمْ تَكُونُوا بَالِغِيهِ إِلَّا بِشِقِّ الْأَنفُسِ ۚ إِنَّ رَبَّكُمْ لَرَءُوفٌ رَّحِيمٌ﴾

তারা তোমাদের জন্য বোঝা বহন করে এমন সব জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে তোমরা কঠোর প্রাণান্ত পরিশ্রম না করে পৌঁছুতে পারো না আসলে তোমার রব বড়ই স্নেহশীল ও করুণাময়

    وَتَحْمِلُ أَثْقَالَكُمْ إِلَىٰ بَلَدٍ لَّمْ تَكُونُوا بَالِغِيهِ إِلَّا بِشِقِّ الْأَنفُسِ ۚ إِنَّ رَبَّكُمْ لَرَءُوفٌ رَّحِيمٌ - তারা তোমাদের জন্য বোঝা বহন করে এমন সব জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে তোমরা কঠোর প্রাণান্ত পরিশ্রম না করে পৌঁছুতে পারো না আসলে তোমার রব বড়ই স্নেহশীল ও করুণাময়

-    কুরআনে হাকীমে অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

﴿وَعَلَيْهَا وَعَلَى الْفُلْكِ تُحْمَلُونَ﴾

“এবং তাদের ওপর ও নৌযানে আরোহণও করে থাকো।” (সূরা আল মুমিনুনঃ ২২)

﴿وَلَكُمْ فِيهَا مَنَـٰفِعُ وَلِتَبْلُغُوا۟ عَلَيْهَا حَاجَةًۭ فِى صُدُورِكُمْ وَعَلَيْهَا وَعَلَى ٱلْفُلْكِ تُحْمَلُونَ﴾

“এসবের মধ্যে তোমাদের জন্য আরো অনেক কল্যাণ নিহিত আছে তোমাদের মনে যেখানে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভূত হয় এসবের পিঠে আরোহণ করে তোমরা সেখানে পৌঁছতে পার এসব পশু এবং নৌকাতেও তোমাদের আরোহণ করতে হয়।” (সূরা আল মুমিনঃ ৮০)

﴿وَٱلَّذِى خَلَقَ ٱلْأَزْوَٰجَ كُلَّهَا وَجَعَلَ لَكُم مِّنَ ٱلْفُلْكِ وَٱلْأَنْعَـٰمِ مَا تَرْكَبُونَ﴾﴿لِتَسْتَوُۥا۟ عَلَىٰ ظُهُورِهِۦ ثُمَّ تَذْكُرُوا۟ نِعْمَةَ رَبِّكُمْ إِذَا ٱسْتَوَيْتُمْ عَلَيْهِ وَتَقُولُوا۟ سُبْحَـٰنَ ٱلَّذِى سَخَّرَ لَنَا هَـٰذَا وَمَا كُنَّا لَهُۥ مُقْرِنِينَ﴾

“তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি সমস্ত জোড়া সৃষ্টি করেছেন যিনি তোমাদের জন্য নৌকা-জাহাজ এবং জীব-জন্তুকে সওয়ারি বানিয়েছেন যাতে তোমরা তার পিঠে আরোহণ করো এবং পিঠের ওপর বসার সময় তোমাদের রবের ইহসান স্মরন করে বলোঃ পবিত্র সেই সত্তা যিনি আমাদের জন্য এসব জিনিসকে অনুগত করে দিয়েছেন তা না হলে এদের আয়ত্বে আনার শক্তি আমাদের ছিল না।” (সূরা আয যখরূফঃ ১২, ১৩)

﴿وَالْخَيْلَ وَالْبِغَالَ وَالْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوهَا وَزِينَةً ۚ وَيَخْلُقُ مَا لَا تَعْلَمُونَ﴾

তোমাদের আরোহণ করার এবং তোমাদের জীবনের শোভা-সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য তিনি ঘোড়া, খচ্চর এবং গাধা সৃষ্টি করেছেন তিনি (তোমাদের উপকারার্থে) আরো অনেক জিনিস সৃষ্টি করেছেন, যেগুলো তোমরা জানোই না

    وَالْخَيْلَ وَالْبِغَالَ وَالْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوهَا وَزِينَةً ۚ وَيَخْلُقُ مَا لَا تَعْلَمُونَ - তোমাদের আরোহণ করার এবং তোমাদের জীবনের শোভা-সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য তিনি ঘোড়া, খচ্চর এবং গাধা সৃষ্টি করেছেন তিনি (তোমাদের উপকারার্থে) আরো অনেক জিনিস সৃষ্টি করেছেন, যেগুলো তোমরা জানোই না

-    আল্লাহর সৃষ্টি এমন বিপুল পরিমাণ জিনিস আছে, যা মানুষের উপকার করে যাচ্ছে।

-    কোথায় কোন সেবক মানুষের কি সেবা করে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে মানুষ কিছুই জানে না।

-    এই আয়াতের সুত্র ধরে উলামায়ে কিরামের একাংশ ঘোড়ার গোশতকে হারাম বলেছেন। তাদের যুক্তি হলোঃ

o এই আয়াতে খচ্চর এবং গাধার সাথে ঘোড়ার উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই দুইটি জন্তুর গোশত যেহেতু হারাম, সেহেতু গোড়ার গোশতও হারাম। তারা তাদের মতের পক্ষ ইবনে আব্বাস রা. এর একটি বর্ণনা দলীল হিসাবে পেশ করেন। যেখানে ইবনে আব্বাস রা. বলেনঃ

قال الله تعالى { وَٱلأَنْعَـٰمَ خَلَقَهَا لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَـٰفِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ } فهذه للأكل، { وَٱلْخَيْلَ وَٱلْبِغَالَ وَٱلْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوهَا } فهذه للركوب

এই আয়াত দ্বারা বুঝানো হয়েছে, যত ধরণের আনহাম আছে, তা খাওয়ার জন্য আর ঘোড়া, খচ্চর এবং গাধা আরোহনের জন্য তথা খাওয়ার জন্য নয়।

o হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. বর্ণিত একটি হাদীস থেকে জানা যায়তিনি বলেনঃ

نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن أكل لحوم الخيل والبغال والحمير.

রাসূলুল্লাহ সা. ঘোড়া, খচ্চর এবং গাধার গোশত খেতে নিষেধ করেছেন” (মুসনাদে আহমদ)

o উপরোক্ত হাদীসটির সনদে একজন রাবী রয়েছেন, যার নাম সালিহ ইবনে মিকদাদ-যার সম্পর্কে সমালোচনা রয়েছে বলে অনেকে হাদীসটি গ্রহণ করেন না। কারণ বুখারী ও মুসলিমে শক্ত সনদে একটি হাদীস রয়েছে যা হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ রা. বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ

ذبحنا يوم خيبر الخيل والبغال والحمير، فنهانا رسول الله صلى الله عليه وسلم عن البغال والحمير، ولم ينهنا عن الخيل

খায়বারের যুদ্ধের দিন আমরা ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা যবাহ করি। তখন রাসূল সা. আমাদেরকে খচ্চর ও গাধার গোশত খেতে নিষেধ করেন, কিন্তু ঘোড়ার গোশত খেতে নিষেধ করেন নাই।

o হযরত আসমা বিনতে আবু বকর রা. থেকে আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ

نحرنا على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم فرساً فأكلناه ونحن بالمدينة

আমরা রাসুলুল্লাহ সা. এর উপস্থিতিতে ঘোড়া যবাহ করে ওর গোশত ভক্ষণ করেছি। ঐ সময় আমরা মদীনায় অবস্থান করছিলাম।” (মুসলিম)

﴿وَعَلَى اللَّهِ قَصْدُ السَّبِيلِ وَمِنْهَا جَائِرٌ ۚ وَلَوْ شَاءَ لَهَدَاكُمْ أَجْمَعِينَ﴾

আর যেখানে বাঁকা পথও রয়েছে সেখানে সোজা পথ দেখাবার দায়িত্ব আল্লাহর ওপরই বর্তেছে তিনি চাইলে তোমাদের সবাইকে সত্য-সোজা পথে পরিচালিত করতেন

     وَعَلَى اللَّهِ قَصْدُ السَّبِيلِ وَمِنْهَا جَائِرٌ  - আর যেখানে বাঁকা পথও রয়েছে সেখানে সোজা পথ দেখাবার দায়িত্ব আল্লাহর ওপরই বর্তেছে

-    উপরের কথা গুলো বলা হয়েছে তাওহীদ, রহমত ও রবুবীয়াতের যু্‌ক্তি পেশ করতে গিয়ে এবং লক্ষ্য হলো নবুওয়াতের পক্ষেও একটি যুক্তি পেশ করা

-    যুক্তির সারকথা হলোঃ

1.  দুনিয়াতে মানুষের চিন্তার অনেক অনেক আলাদা আলাদা পথ আছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সকল পথ ও মত একই সাথে সত্য হতে পারেনা। বরং সত্য পথ একটিই হয়। যে জীবন আদর্শ সেই সত্য অনুযায়ী গড়ে উঠেছে, সেটাই একমাত্র সত্য জীবনাদর্শ।

2.  দুনিয়াতে মানুষের কাজেরও অনেক অনেক আলাদা আলাদা পথ আছে এবং থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু একই সাথে সকল পথ সঠিক নয়। সঠিক পথ একটি। যে পথ সঠিক জীবনাদর্শের ভিত্তিতে পরিচালত হয়, তাই একমাত্র সঠিক পথ।

3. মানুষের সবচেয়ে বড় ও মৌলিক প্রয়োজন হলো সঠিক আদর্শ ও সঠিক কর্মপদ্ধতি জানা। একটা পশুর যেমন প্রাণী হওয়ার কারণে তার কিছু প্রয়োজন থাকে, একই ভাবে মানুষ প্রাণী হওয়ার কারণে তার কিছু প্রয়োজন থাকে। এই সব প্রয়োজন পুরণ করা মানুষের জন্য জ্ঞান ছাড়াও সম্ভব। আর জ্ঞান অর্জন প্রয়োজন কেবল মাত্র মানুষ হবার কারণে। বিধায়, আদর্শ ও সঠিক কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে না জানা মানে মানুষের পুরো জীবন নিষ্ফল ও ব্যর্থ।

4. এখন ভেবে দেখার বিষয় হলোঃ যে আল্লাহ মানুষের অস্তিত্ব দেয়ার আগে তার প্রয়োজনীয় সকল বিষয় প্রস্তুত করে রাখলেন, অথচ তার মানবিক জীবনের সবচেয়ে বড় ও প্রয়োজনটির কোন ব্যবস্থা করলেন না-এমনটা কেমন করে হয়।

5. আল্লাহ নবুয়াতের মাধ্যমে মানুষের সেই ব্যবস্থাটিও করে রেখেছেন। এখন নবুয়াতকে না মানলে মানুষকেই বলতে হবে যে, আল্লাহ মানুষের হেদায়াতের জন্য কি ব্যবস্থা রেখেছেন?

o পথের সন্ধান করার জন্য আল্লাহ আমাদের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি দিয়ে” এমন কথা যারা বলবেন, তাদের জবাব হলোঃ মানুষ তার মানবিক বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি দিয়ে এমন অসংখ্য পথ উদ্ভাবন করে ফেলেছে যা তার সত্য-সরল পথের সঠিক উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে তার ব্যর্থতার সুস্পষ্ট প্রমাণ।

o “আল্লাহ আমাদের পথ দেখাবার কোন ব্যবস্থা করেননি” এমন কথা যারা বলবে, তাদের জবাব হলোঃ আল্লাহর ব্যাপারে এরচেয়ে বড় কোন কুধারণা হতেই পারে না যে, তিনি মানুষকে প্রাণী হবার দিক দিয়ে বিস্তারিত ও পূর্ণাংগ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন অথচ মানুষ হবার ক্ষেত্রে একেবারে অন্ধকারের বুকে পথ হারিয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়াবার ও পদে পদে ঠোকর খাবার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন

-    কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ خَلَقَ ٱلْإِنسَـٰنَ-عَلَّمَهُ ٱلْبَيَانَ তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে কথা শিখিয়েছেন। (আর রাহমানঃ ৩,)

o দুনিয়ার চিরন্তন নিয়ম হলো, যে ব্যক্তি যে জিনিস তৈরী করে সে ব্যক্তি তা পরিচালনা করার নিয়মও দেখিয়ে দেয়। যাকে আমরা ক্যাটালগ বা ইউজার ম্যানুয়্যাল বলি।

o বিধায়, আল্লাহ মানুষকে যে উদ্দেশ্যে তৈরী করেছেন, সেই উদ্দেশ্য সাধনে মানুষ কিভাবে চলবে, তারও বিধান দিয়েছেন-এটা স্বাভাবিকতা। আর বিধান না দেয়া অস্বাভাবিকতা।

o কুরআনে অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

إِنَّ عَلَيْنَا لَلْهُدَى  পথ প্রদর্শন করা আমার দায়িত্ব” (সূরা আল লাইলঃ ১২)

وَعَلَى اللَّهِ قَصْدُ السَّبِيلِ وَمِنْهَا جَائِرٌ  সরল সোজা পথ দেখিয়ে দেয়া আল্লাহর দায়িত্ব বাঁকা পথের সংখ্যা তো অনেক” (সূরা আন নাহলঃ ৯)

ফেরাউন মূসার মুখে রিসালাতের পয়গাম শুনে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ তোমার সেই ‘রব’ কে যে আমার কাছে দূত পাঠায়? জবাবে হয়রত মূসা বললেনঃ رَبُّنَا الَّذِي أَعْطَى كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهُ ثُمَّ هَدَىতিনিই আমার রব যিনি প্রতিটি জিনিসকে একটি নির্দিষ্ট আকার-আকৃতি দান করে পথ প্রদর্শন করেছেন” (সূরা ত্বা-হাঃ৫০)

o জীবনের সকল ক্ষেত্রে মানুষ নিজেও শিক্ষক, বই পুস্তক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রচার-প্রোপাগাণ্ডা ও ধর্মীয় শিক্ষা, লেখা, বক্তৃতা, বিতর্ক ও যুক্তি প্রমাণের মত উপায় উপকরণকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকার করে এবং শুধু জন্মগতভাবে লব্ধ জ্ঞানকে যথেষ্ট মনে করে নাতাহলে মানুষের স্রষ্টার ওপরে তাদের পথ প্রদর্শনের যে দায়িত্ব বর্তায় তা সম্পাদন করার জন্য যখন তিনি রাসূল ও কিতাবকে শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন তখন তা বিস্ময়ের ব্যাপার হবে কেন? عَلَّمَهُ ٱلْبَيَانَ দ্বারা আল্লাহ সেই বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন।

-    দুনিয়ার পথ সমূহে চলার জন্য আল্লাহ উপকরণ দিলেন, এখন আখেরাতের পথ কিভাবে চলবে?

o হজ্জের সফরের পাথেয় বর্ণনা করে আল্লাহ তাকওয়ার পাথেয়ের কথা বললেন, যা আখেরাতে কাজে লাগবে। যেমনঃ

وَتَزَوَّدُواْ فَإِنَّ خَيْرَ ٱلزَّادِ ٱلتَّقْوَىٰ

“হজ্জ সফরের জন্য পাথেয় সংগে নিয়ে যাও আর সবচেয়ে ভালো পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া।” (সূরা বাকারাহঃ ১৯৭)

o বাহ্যিক পোষাকের বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহ তাকওয়ার পোষাকের কথা বললেন। যেমনঃ

يَـٰبَنِىۤ آدَمَ قَدْ أَنزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَٰرِى سَوْءَٰتِكُمْ وَرِيشًا وَلِبَاسُ ٱلتَّقْوَىٰ ذَٰلِكَ خَيْرٌ

 হে বনী আদম! তোমাদের শরীরের লজ্জাস্থানগুলো ঢাকার এবং তোমাদের দেহের সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বিধানের উদ্দেশ্যে আমি তোমাদের জন্য পোশাক নাযিল করেছি আর তাকওয়ার পোশাকই সর্বোত্তম।” (সূরা আল আরাফঃ ২৬)

o একই ভাবে দুনিয়ার কঠিন পথ, দূর দূরান্তের সফর অতিক্রম করার পর আখেরাতে পাথেয় বর্ণনা করা হলো এই আয়াতের মাধ্যমে وَعَلَى ٱللَّهِ قَصْدُ ٱلسَّبِيلِ বলে। যে কথার প্রতিধ্বনি শুনা যায় কুরআনের অন্য আয়াতেঃ

وَأَنَّ هَـٰذَا صِرَٰطِي مُسْتَقِيمًا فَٱتَّبِعُوهُ وَلاَ تَتَّبِعُواْ ٱلسُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ

“এ ছাড়াও তাঁর নির্দেশ হচ্ছে এইঃ এটিই আমার সোজা পথ তোমরা এ পথেই চলো এবং অন্য পথে চলো না কারণ তা তোমাদের তাঁর পথ থেকে সরিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেবে।” (সূরা আল আনআমঃ ১৫৩)

قَالَ هَذَا صِرَٰطٌ عَلَىَّ مُسْتَقِيمٌ

“বললেনএটিই আমার নিকট পৌঁছুবার সোজা পথ।” (সূরা আল হিজরঃ ৪১)

    وَلَوْ شَاءَ لَهَدَاكُمْ أَجْمَعِينَ - তিনি চাইলে তোমাদের সবাইকে সত্য-সোজা পথে পরিচালিত করতেন১০ 

-    অন্যান্য সকল সৃষ্টিকে জন্মগত ভাবে আল্লাহ সঠিক পথে পরিচালনা করার দায়িত্ব পালন করেন।

-    মানুষকেও সঠিক পথে পরিচালনা করা দায়িত্ব আল্লাহ পালন করতে পারতেন।

-    কিন্তু আল্লাহ সেটি চাননি। তিনি মানুষ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এমন ক্ষমতা দিয়ে, যাতে সে নিজের পছন্দ ও বাছ-বিচার দিয়ে সঠিক ও বেটিক পথ চিনতে পারে এবং সঠিক ও বেটিক পথে চলার স্বাধীনতা রাখে।

-    আল্লাহ মানুষকে তার স্বাধীনতা ব্যবহার করার জন্য জ্ঞান, বুদ্ধি, চিন্তার যোগ্যতা, ইচ্ছা ও সংকল্পের শক্তি দান করেছেন। নিজের ভিতরের ও বাহিরের সকল উপকরণ ব্যবহারের ক্ষমতা দিয়েছেন। তার ভিতরে ও বাহিরে এমন সব বিষয় রেখে দিয়েছেন, যা সঠিক ও ভূল পথে পরিচালিত হওয়ার কারণ হতে পারে।

-    যদি আল্লাহ অন্যান্য সৃষ্টির মতো জন্মগত ভাবে সঠিক পথের অনুসারী বানিয়ে দিতেন, তাহলে সে খলিফার মর্যাদা লাভ করতো না এবং উন্নতির উচ্চ পর্যায়ে পৌছতে পারতো না, যা স্বাধীনতার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে লাভ করতে পারে।

-    আল্লাহ উপরোক্ত কারণে মানুষকে জোর করে বা জন্মগত ভাবে সঠিক পথে পরিচালিত করার বদলে রিসালাতের পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন।

-    রিসালাতের এই পদ্ধতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। এর মাধ্যমে মানুষের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকবে, পরীক্ষার উদ্দেশ্য ও পূর্ণ হবে, সত্য-সরল পথ ও সর্বোত্তম যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতিতে তার সামনে পেশ করে দেয়া যাবে

-    কুরআনে হাকীমে অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

وَلَوْ شَآءَ رَبُّكَ لآمَنَ مَن فِى ٱلأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا

“যদি তোমার রবের ইচছা হতো ( যে যমীনে সবাই হবে মুমিন ও অনুগত্য) তাহলে সারা দুনিয়াবাসী ঈমান আনতো।” (সূরা ইউনুসঃ ৯৯)

 وَلَوْ شَآءَ رَبُّكَ لَجَعَلَ ٱلنَّاسَ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلاَ يَزَالُونَ مُخْتَلِفِينَ إِلاَّ مَن رَّحِمَ رَبُّكَ وَلِذٰلِكَ خَلَقَهُمْ وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ لأَمْلأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ ٱلْجِنَّةِ وَٱلنَّاسِ أَجْمَعِينَ

“অবশ্যি তোমার রব চাইলে সমগ্র মানব জাতিকে একই গোষ্ঠীভুক্ত করতে পারতেনকিন্তু এখন তারা বিভিন্ন পথেই চলতে থাকবেএবং বিপথে যাওয়া থেকে একমাত্র তারাই বাঁচতে যাদের ওপর তোমার রব অনুগ্রহ করেন এ (নির্বাচন ও ইখতিয়ারের স্বাধীনতার) জন্যই তো তিনি তাদের পয়দা করেছিলেন আর তোমার রবের একথা পূর্ণ হয়ে গেছে যা তিনি বলেছিলেন-আমি জাহান্নামকে জিন ও মানুষ উভয়কে দিয়ে ভরে দেবো (সূরা হুদঃ ১১৮, ১১৯)

আয়াত সমূহ থেকে শিক্ষাঃ

    আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়লা এক এবং একক, তিনি শিরক থেকে পবিত্র এই আকীদা পোষণ শক্ত রাখতে হবে

    মানুষ সৃষ্টির উৎস কি তা মনে রাখতে হবে এবং সেই অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হবে।

    আল্লাহর নিয়ামত সমূহ সর্বদা স্মরণে রাখতে হবে এবং নিয়ামতের শুকরিয়া আমলের মাধ্যমে করতে হবে।

    আল্লাহ যেহেতু বাঁকা পথ থেকে সোজা পথ দেখানোর দায়িত্ব নিয়েছেন, সেহেতু আল্লাহর দেখানো পথে চলতে হবে।

সমাপ্ত


নিয়মিত আপডেট পেতে যুক্ত হোন আমাদের হোয়াইটসআপ গ্রুপে।


Post a Comment

0 Comments