ই’তিকাফঃ
ই’তিকাফ আরবী শব্দ। যার অর্থ হলঃ অবস্থান করা, অভিমুখী হওয়া, নিবেদিত হওয়া, নিরবচ্ছিন্ন হওয়া ইত্যাদি।
দুনিয়াবী সকল কাজ থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ আল্লাহর ইবাদতের
জন্য মসজিদে অবস্থান করাকে ই’তিকাফ বলা হয়ে থাকে। কুরআনে
হাকীমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলেনঃ
وَإِذْ جَعَلْنَا الْبَيْتَ
مَثَابَةً لِّلنَّاسِ وَأَمْنًا وَاتَّخِذُوا مِن مَّقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى
ۖ وَعَهِدْنَا إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيْتِيَ
لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ
আর স্মরণ করো
তখনকার কথা যখন আমি এই গৃহকে লোকদের জন্য কেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল গণ্য করেছিরাম
এবং ইবরাহীম যেখানে ইবাদাত করার জন্য দাঁড়ায় সে স্থানটিকে স্থায়ীভাবে নামাযের
স্থানে পরিণত করার হুকুম দিয়েছিলাম। আর ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে
তাকীদ করে বলেছিলাম, আমার এই গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকূ–সিজদাকারীদের জন্য পাক-পবিত্র
রাখো। (আল বাক্বারাহঃ ১২৫)
ই’তিকাফ এর হুকুমঃ
ই’তেকাফ করা সুন্নাত।
ই’তেকাফ এর উদ্দেশ্যঃ
দুনিয়াদারীর ঝামেলা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে একাগ্রচিত্তে
আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হওয়া, বিনয় নম্রতায়
নিজেকে আল্লাহর দরবারে সমপর্ণ করা এবং বিশেষ করে লাইলাতুল ক্বাদরে ইবাদত করার
সুযোগ লাভ করাই ই’তিকাফের উদ্দেশ্য।
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُجَاوِرُ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ وَيَقُولُ " تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ "
হযরত আয়িশা রা.
থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা রামাদ্বানের শেষ দশদিন মসজিদে অবস্থান করতেন। বলতেন, তোমরা
রামাদ্বানের শেষ দশদিন লায়লাতুল ক্বাদর অনুসন্ধান করো। (বুখারী)
ই’তিকাফের শর্তঃ
১. মুসলমান হওয়া।
২. জ্ঞান থাকা।
৩. বড় নাপাকী থেকে পবিত্র থাকা, গোসল ফরয হলে
গোসল করে নেয়া।
৪. মসজিদে ই’তিকাফ করা।
কাজেই কাফির-মুশরিক, অবুঝ শিশু, পাগল ও অপবিত্র লোক এবং হায়েয-নিফাস
অবস্থায় নারীদের ই’তিকাফ শুদ্ধ হবে না।
ই’তিকাফের রুকনঃ
ই’তিকাফের রুকন ২টিঃ
১. নিয়ত করা।
২. মসজিদে অবস্থান করা, নিজ বাড়ীতে বা অন্য
কোথাও ই’তিফাক করলে ই’তিকাফ শুদ্ধ হবে না।
وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلاَ تَقْرَبُوهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
আর যতক্ষণ
তোমরা ই’তিকাফ অবস্থায় মসজিদসমূহে অবস্থান কর ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে
মেলামেশা করো না। এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। অতএব তোমরা এর নিকটবর্তী হয়ো না। এভাবে আল্লাহ
তাঁর নিদর্শনাবলী মানব জাতির জন্যে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, যাতে
তারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে। (আল বাক্বারাহঃ ১৮৭)
মেয়েদের জন্য নিজ বাসগৃহে ই’তিকাফঃ
রাসূলুল্লাহ সা. এর যামানায় নারীরা মসজিদে ই’তিকাফ করতেন।
عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها زَوْجِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ، ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ.
নবী সা. এর সহধর্মিণী
হযরত আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত যে, নবী সা. রামাদ্বানের শেষ দশক ই’তিকাফ করতেন। তাঁর ওফাত
পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তাঁর সহধর্মিনীগণও সে দিনগুলোতে ই’তিকাফ করতেন। (বুখারী)
ই’তিকাফ অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ সমূহঃ
১.
স্বামী স্ত্রীর মিলন, স্ত্রীকে চুম্বন ও স্পর্শ করা।
وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلاَ تَقْرَبُوهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
আর যতক্ষণ
তোমরা ই’তিকাফ অবস্থায় মসজিদসমূহে অবস্থান কর ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে
মেলামেশা করো না। এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। অতএব তোমরা এর নিকটবর্তী হয়ো না। এভাবে আল্লাহ
তাঁর নিদর্শনাবলী মানব জাতির জন্যে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, যাতে
তারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে। (আল বাক্বারাহঃ ১৮৭)
২. মসজিদ
থেকে বের হওয়া, বেচাকেনা, চাষাবাদ, এমনকি
রোগীর সেবা ও জানাযায় অংশ গ্রহণের জন্যও মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয নয়। বের হলে ই’তিকাফ
বাতিল হয়ে যাবে।
বিশেষ প্রয়োজনে ই‘তিকাফ অবস্থায় মসজিদ থেকে বের হওয়াঃ
মসজিদের গন্ডির
মধ্যে ব্যবস্থা না থাকলে শুধুমাত্র মানবিক প্রয়োজনে প্রস্রাব-পায়খানা, খাওয়া-দাওয়া
ও পবিত্রতা অর্জনের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয রয়েছেঃ
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا اعْتَكَفَ لاَ يَدْخُلُ الْبَيْتَ إِلاَّ لِحَاجَةِ الإِنْسَانَ
হযরত আয়িশা
রা. বলেন, নবী সা. যখন ই’তিকাফে অবস্থান করতেন, তখন একান্ত মানবীয়
প্রয়োজন পূরণ ছাড়া বাড়িতে প্রবেশ করতেন না। (মুসলিম)
তবে মসজিদে এসব
ব্যবস্থা থাকার পর যদি কেউ বাইরে যায় তাহলে ই’তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
ই’তিকাফ
অবস্থায় এক রাতে রাসূল সা. তাঁর স্ত্রী সাফিয়া রা. কে ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। (বুখারী)
ই‘তিকাফ ভঙ্গ হওয়ার কারণ সমূহঃ
নিম্নোক্ত যে
কোন একটি কাজ করলে ই’তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবেঃ
১. স্বেচ্ছায়
বিনা প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হলে।
২. কোন শিরক বা
কুফরী কাজ করলে।
৩. পাগল বা
বেঁহুশ হয়ে গেলে।
৪. নারীদের
হায়েয-নিফাস শুরু হয়ে গেলে।
৫. স্ত্রীসহবাস
বা যে কোন প্রকার যৌনসম্ভোগ করলে।
ই’তিকাফে বৈধ বা মুবাহ কাজসমূহঃ
ই’তিকাফকারীদের
জন্য নিম্নোক্ত কাজ গুলো বৈধঃ
১. একান্ত
প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা।
২. চুল আঁচড়ানো, মাথা
মুণ্ডানো, নখ কাটা, শরীর থেকে ময়লা
পরিষ্কার করা এবং সুগন্ধি ব্যবহার ও উত্তম পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করা।
৩. মসজিদের
ভিতরে পানাহার করা, ঘুমানো এবং বিশেষ প্রয়োজনে বিবাহের কাবিননামা ও ক্রয়-বিক্রয়ের
চুক্তিও সম্পাদন করা।
ই’তিকাফকারীর দায়িত্ব ও করণীয়ঃ
উত্তম হল নফল
ইবাদত বেশি বেশি করা। যেমনঃ সালাত আদায়, কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন করা,
যিকর-আযকার ও তাসবীহ-তাহলীল অর্থাৎ সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ,
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, তাওবাহ-ইস্তেগফার, দুআ’, দুরূদ
ইত্যাদি ইবাদতে সর্বাধিক সময় মশগুল থাকা এবং শরীয়াহ বিষয়ক ইলম চর্চা করা।
পার্থিব
ব্যাপারে কথাবার্তা বলা, অনর্থক গল্পগুজব ও আলোচনা থেকে বিরত থাকা। তবে পারিবারিক
কল্যাণার্থে বৈধ কোন বিষয়ে অল্পস্বল্প কথাবার্তা বলার মধ্যে কোন দোষ নেই।
ই’তিকাফ শুধুই রামাদ্বান মাসেঃ
বৎসরের যে কোন
সময় ই’তিকাফ করা যায়। এজন্য নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট কোন দিন তারিখ নেই। যিনি যখন
চাইবেন তখন তিনি ই’তিকাফ করতে পারবেন। রাসূল সা. একবার শাওয়াল মাসেও ই’তিকাফ করেছেন। উমার রা. একবার
মাত্র এক রাত ই’তিকাফ করেছিলেন।
ই‘তিকাফের উত্তম সময়ঃ
রামাদ্বান মাস
ই’তিকাফের উত্তম সময়। আরো উত্তম রামাদ্বানের শেষ দশদিন।
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رضى الله عنهما ـ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ.
হযরত আবদুল্লাহ
ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. রামাদ্বানের
শেষ দশক ইতেকাফ করতেন। (বুখারী)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَعْتَكِفُ فِي كُلِّ رَمَضَانَ عَشْرَةَ أَيَّامٍ، فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِي قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ يَوْمًا.
হযরত আবু হুরায়রা
রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সা প্রতি রামাদ্বানে দশ
দিনের ইতিকাফ করতেন। যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন সে বছর তিনি বিশ
দিনের ইতিকাফ করেছিলেন। (বুখারী)
ই’তিকাফের সর্বনিম্ন পরিমাণঃ
এটি একটি মতবিরোধপূর্ণ
মাসআলা। শাইখাইনের মতে ই’তিকাফের ন্যূনতম সময়সীমা ১দিন। কেননা, আহনাফদের
মতে ই’তিকাফের জন্য রোযা শর্ত। আর রোযা ১ দিনের কমে পূর্ণ হয় না।
ই’তিকাফের শুরু ও শেষ সময়ঃ
ফযরের সালাত
আদায় করে বা সূর্যাস্তের পর ই’তিকাফে প্রবেশ করা সুন্নাত বা মুস্তাহাব। আর ঈদের চাঁদ
দেখা গেলে ই’তিকাফ শেষ করত হয়। নবী সা. এমনটিই করতেন।
রাসূল সা. এর ই’তিকাফঃ
প্রত্যেক রামাদ্বানেই
রাসূল সা. শেষ দশ দিন ই’তিকাফ করতেন। কিন্তু জীবনের শেষ রামাদ্বানে তিনি ই’তিকাফ
করেছিলেন ২০ দিন। এভাবে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কোন বছরই তিনি ই’তিকাফ থেকে বিরত থাকেননি। (বুখারী)
ই’তিকাফ এর প্রকারভেদঃ
ইসলামী শরীয়াহ
মতে ই’তিকাফ ৩ প্রকারঃ
১. ওয়াজিব ই’তিকাফঃ উলামায়ে কেরামের ঐকমত্যে ওয়াজিব ই’তিকাফ হলো মানতের ই’তিকাফ। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ وَلۡيُوفُواْ نُذُورَهُمۡ তারা যেন তাদের মানত পূর্ণ করে। (আল হাজ্জঃ ২৯)
عَنْ عُمَرَ أَنَّهُ كَانَ عَلَيْهِ نَذْرُ لَيْلَةٍ فِي الْجَاهِلِيَّةِ يَعْتَكِفُهَا فَسَأَلَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَأَمَرَهُ أَنْ يَعْتَكِفَ
উমার রা. থেকে
বর্ণিত। জাহিলী যুগে তার এক রাত ই’তিকাফ করার মানত ছিল। তিনি এ সম্পর্কে নবী
সা.কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে ই’তিকাফ করার নির্দেশ দেন। (ইবনে মাযাহ)
২. সুন্নাত ই’তিকাফঃ রামাদ্বানের শেষ ১০ দিনের ই’তিকাফ হলো সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। যেমনঃ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَعْتَكِفُ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ রাসূলুল্লাহ সা. রামাদ্বানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। (বুখারী ও মুসলিম)
৩. মুস্তাহাব
ই’তিকাফঃ উপরোক্ত দুই প্রকার ই’তিকাফ ছাড়া বাকী সব ই’তিকাফই
মুস্তাহাব ই’তিকাফ। যেমনঃ রমযানের শেষ দশকে পূর্ণ দশ দিনের কম ইতিকাফ করা। অথবা বছরের অন্য
যেকোনো সময় যতক্ষণ ইচ্ছা, ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে
অবস্থান করা।
আমার লিখা অন্যান্য আর্টিক্যাল সমূহ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
0 Comments